মেরিলিনার কথা

মেরিলিনার কথা 

বাবাকে আমি শেষ দেখেছি যখন আমার বয়স তেরো। আমরা ইতালীর তুসকানিতে থাকতাম। আমি তখন স্থানীয় একটা ক্যাথলিক চার্চ মিশনারী স্কুলে পড়তাম। মা একটা নাচের একাডেমীতে নাচ শেখাতেন আর বাসায় ছবি আঁকতেন। বাবা তুসকানিতে একটা মানসিক হাসপাতালে কাজ করত। আর মাঝে মাঝে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে প্যাডোভাতে যেত। 

আমার মা ইউলিন মেলিসা ইতালিয়ান ছিলেন। আমার আর মায়ের ভেতরে অনেক দূরত্ব ছিল। সেই দূরত্বের কারণ কি ছিল আমি জানি না। তবে সেই দূরত্বের শুণ্যস্থান বাবা কখনও বুঝতে দেননি। মা সারাদিন তার নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সকাল বেলা বাগান করা। ছবি আঁকা। নাচের ক্লাসে যাওয়া। তাকে আমি খুব একটা হাসতে দেখিনি। তিনি কখনও আমাকে তার নাচের একাডেমীতেও নিয়ে যেতেন না। একমাত্র বাগান করা ছাড়া অন্যান্য গৃহস্থালির কাজে তাকে খুব একটা দেখা যেত না। বাবা বাড়িতে থাকলে মা মাঝে মাঝে রাতে বাড়িও ফিরতেন না। মাঝে মাঝে তাকে বিষণ্নতায় ভুগতে দেখলেও কখনও ধুমপান করতে বা মদ্যপান করতে দেখিনি, যেটা আমার বান্ধবীর মায়েরা প্রায়ই করতেন। ভীষণ রকম অগোছালো আর কিছুটা সংসারবিমুখ আমার মা আমার জীবনে ছিলেন শুধুই একজন মানুষ। যিনি আমার আর বাবার সাথেই একই বাড়িতে থাকেন। মাঝে মাঝে আমার আর বাবার সাথে কথা বলেন। যার ফোলা ফোলা চোখে সব সময় থাকত মেঘলা আকাশের ছায়া। 

বাবা ছিলেন মায়ের একেবারে বিপরীত। দীর্ঘাঙ্গ এবং কেশহীন। গোছালো এবং সংসারী। আর আমার সব থেকে কাছের মানুষ। আমার জানামতে মেয়েদের এলোমেলো কৈশোর জীবন বাবাদের গুছিয়ে দেওয়ার কথা না। আমার বাবা দিয়েছিলেন। ভীষণ গোছানো ছিলেন আমার বাবা। প্রতিটা কাজ এত গুছিয়ে করতেন! প্রতিটা কথা ছিল তার গোছানো। তার কথাগুলো ছিল তার মতই ভীষণ রকমের পরিষ্কার। সব সময় অতিমাত্রায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে দেখতাম বাবাকে। ঘন ঘন হাত ধুতেন। সারাদিন কাজ সেরে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরলেও বাবাকে দেখে মনে হত বাবা এই মাত্র শেভ করে ও গোসল করে আসলেন। 

বাবা এমনিতে রাশভারী মানুষ ছিলেন। কোন অতিরিক্ত বা বাজে কথা তাকে বলতে শুনিনি। কোন শৌখিনতা তাকে স্পর্শ করেনি কখনও। তাই স্বাভাবিকভাবেই মায়ের ছবি আঁকাটাও তাকে তেমন টানেনি। টানেনি মায়ের নাচ শেখানোটাও। কিন্তু আমাকে তিনি শৌখিনতা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেননি। আমাকে নিয়ে মিলানে থিয়েটার দেখতে যেতেন। মাঝে মাঝে রান্না করতেন। আমি বাবাকে সাহায্য করতাম। বাবা আমাকে চমৎকার বাংলা শিখিয়েছিলেন। আমি প্রায়ই বাবার স্টাডির লাইব্রেরী থেকে বাংলা বই নিয়ে পড়তাম। বাবা চমৎকার গল্পও বলতে পারত। 

আমি আর বাবা সাইকেল নিয়ে লুকা শহরে যেতাম বই কিনতে। ফেরার সময় সূর্যাস্ত দেখতাম। দেখতাম কিভাবে লুকা শহরের বাড়িগুলোর টালি দেওয়া ছাদের আড়ালে হলুদ সূর্য লাল হতে হতে হারিয়ে যায়। এইসব ছোটখাট যাত্রায় কখনওই আমার মাকে আমি সহযাত্রী হিসেবে পাইনি। তার ভেতরে এ বিষয়ে কোন আগ্রহ ছিল বলেও আমার মনে হয়নি। 

মাঝে মাঝে আমি আর বাবা গাড়ি নিয়ে তুসকানি শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে যেতাম তারা দেখার জন্য। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঠে যাওয়া রাস্তায় গাড়িটা পার্ক করে আমি আর বাবা তারা ভরা রাতের আকাশের নিচে ঘাসের ওপরে শুয়ে থাকতাম। বাবা বলতেন, তারারা সব প্রশ্নের উত্তর জানে। ওরা ওপর থেকে সব কিছু দেখে। আমরা সবাই এই তারাদেরই সন্তান। আমি বলতাম, “বাবা একদিন তারাদের দেশে বেড়াতে যাব।” বাবা আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলতেন, “আমরা সবাই এক এক একটা তারা মেরিলিনা। আর এই তারাটা শুধু আমার তারা।” 

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরতাম। বাবার শরীর থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ আসত। অনেকটা পুরনো কাপড়ের গন্ধ। হু হু করে রাতের বাতাস বয়ে যেত পাহাড়ের ওপর দিয়ে। সেই বাতাসে ফিসফিস করত কত রহস্য। 

হঠাৎ বাবাকে একদিন খুব অস্থির হয়ে বাড়ি ফিরতে দেখি। সেদিন মা বাড়ি ছিলেন না। বাবার ভেতরে নির্লিপ্ততা দেখেছি, কিন্তু অস্থিরতা কখনও দেখিনি। অতিরিক্ত খুশি হতে দেখিনি কখনও। কোন বিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হতে দেখিনি। কিন্তু সেদিন বাবার ভেতরে অন্যরকম একটা অস্থিরতা দেখেছিলাম। বাবা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আগে চা বানাত। সেদিন চা বানায়নি। বাড়ি ফিরেই অনেকক্ষণ স্টাডিতে দরজা লাগিয়ে ফোনে কথা বলল। তারপর গোসল করতে বাথরুমে ঢুকল। 

আমি হোমওয়ার্ক করছিলাম। হঠাৎ ফোন বাজতে শুরু করল। আমি পড়ার টেবিলে বসেই বললাম, বাবা তোমার ফোন এসেছে। 

ফোন বেজেই যাচ্ছে। আমি দুইবার বাবাকে ডাকলাম। কোন সাড়াশব্দ নেই। একঘেয়ে শব্দে কিছুক্ষণ পর পর ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আমি টেবিল ছেড়ে উঠলাম। ফোনটা বাবার স্টাডিতে বাজছে। আমি বাবার স্টাডিতে যাওয়ার আগেই ফোনটা কেটে গেল। অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা বাজছিল। হঠাৎ থেমে যাওয়াতে কেমন চারদিক সব চুপচাপ হয়ে গেল। 

শুধু বাথরুম থেকে শাওয়ারের অবিরাম পানি পড়ার শব্দ আসছে। আর কোন শব্দ নেই। 

আমি বাথরুমের কাছাকাছি যেতেই শুনলাম, বাথরুমের ভেতরে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। বাবা কাঁদছিল। 

সে দিনটার পরে বাবা কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেল। হসপিটালে যাওয়া বন্ধ করে দিল। ক্যাম্পাসে যাওয়া বন্ধ করে দিল। বাড়ি থেকেও সেভাবে বের হত না। কোন একটা কারণে অনেক ভেঙে পড়েছিল বাবা। বাবাকে আমি এভাবে দেখতে পারছিলাম না। 

তার ঠিক আটদিন পরের ঘটনা। সকালবেলা বাবা আমাকে যথারীতি স্কুলে 

নামিয়ে দিয়ে গেল। আমিও যথারীতি বিকেলবেলা ট্রামে বাড়ি ফিরে আসলাম। দেখলাম বাড়ির পেছনের লনে মা ফুলের টব রঙ করছেন। আমি রোজকার মত গোসল করে টেনিস খেলতে গেলাম। সব কিছু প্রতিদিনের মতই হল। শুধু সন্ধ্যাবেলা বাবা বাড়ি ফিরে আসল না। 

আমি বাবার হসপিটালে ফোন করলাম। কেউ ফোন ধরল না। বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টে ফোন করলাম। যদিও তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে; অফিস বন্ধ। কেউ ফোন ধরবে না জেনেও ফোন করলাম। ফোন বেজে গেল। কেউ ধরল না। সারা রাত কেটে গেল। পরদিন সকালেও বাবা ফিরে এলো না। সকালেও আমি একবার হসপিটালে ফোন করলাম। পরে জেনেছিলাম, হসপিটালটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার কয়েকজন রোগী মারা যাওয়ার ঘটনায় রোগীদের কয়েকজন আত্মীয় হসপিটাল কর্তৃপক্ষের নামে মামলা করে। বাবা ছিলেন হসপিটালের চিফ সাইকিয়াট্রিস্ট। অভিযোগ আসে বাবার নামেও। অভিযোগ, হসপিটালে ভর্তি হওয়া অনেক মানসিক রোগীকে বাবা অমানুষিক নির্যাতন করত। সেই নির্যাতনেই কয়েকজন মারা যায়। অভিযোগ সত্য না মিথ্যা-এটা অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে। 

বাবা কি সেই জন্যই কিছু না বলে চলে গেল? বাবা ভয় পাওয়ার মত মানুষ না। যে কোন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাবা ছিল অসংবেদনশীল। কোন এক অদ্ভুত কারণে বাবা কোন মানুষকে ভয় পেতো না। কাজেই বাবা কারও ভয়ে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে-এটা আমি মানতে পারিনি। বাবার এই হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। মা কিছুটা কাছে আসলেও তাকে দেখে মনে হত না যে তিনি বাবার এই অন্তর্ধান নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত। তার দিন চলতে থাকল স্বাভাবিকভাবেই। আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। নিজে তুসকানির সবগুলো হাসপাতালে খোঁজ করলাম। ফলাফল শূন্য। পুলিশে জানালাম। তারাও কিছু বলতে পারল না। আমার সব থেকে কাছের মানুষটাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না এই কষ্ট জানানোর মত আমি কাউকে পেলাম না। পাঁচ বছর আমার বাবাকে ছাড়াই কেটে গেল। বাবাকে ছাড়া আকাশের তারা দেখে কেটে গেল এক হাজার আটশ পঁচিশটা রাত। 

আমি আমার বাবার অতীত সম্পর্কে যতটুকু জানি, তার বেশিরভাগই বাবার ব্যক্তিগত জার্নাল থেকে পড়া। আর কিছুটা মায়ের কাছে শোনা। বাবার অতীত জানাটা ছিল আমার কাছে নতুন একটা দ্বীপ আবিষ্কার করার মত। 

মনোবিজ্ঞানের দুর্দান্ত ছাত্র ছিলেন বাবা। রাজবীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানের ওপরে স্নাতক এবং শ্রীলতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। দুটোতেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া বাবা ছাত্র অবস্থাতেই বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালেখি করতেন। তার ছাত্রজীবনে অস্বাভাবিক কোন কিছু ঘটেছে বলে জানা যায়নি। ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল না সে। কোন অযাচিত ঝামেলায় জড়িয়েছে এমনও না। কিন্তু জাপানের তহুকো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার সময় তার নামে একটা অদ্ভূত অভিযোগ ওঠে। সে নাকি পিস্তলের মুখে ক্যাম্পাসের দুজন কর্মচারীকে দশজন শিশুর সামনে আপত্তিকর কিছু কাজ করতে বাধ্য করেছিল। সেই দুইজন কর্মচারীর একজন পরে আত্মহত্যা করে। যার জন্য বাবাই দায়ী বলে ধারণা করা হয়। 

পুলিশ তার এপার্টমেন্ট থেকে একটা লাইসেন্সবিহীন পিস্তল উদ্ধার করে। এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বাবা তার পিএইচডির স্কলারশিপ হারায়। তার পাসপোর্ট সিজ করে নেওয়া হয়। বাবাকে জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকার সময়ে এক ইতালিয়ান ভদ্রলোক তার জামিনের ব্যবস্থা করেন। সেই ভদ্রলোকই বাবাকে ইতালিতে নিয়ে আসেন। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডির ব্যবস্থাও করিয়ে দেন। সেই ভদ্রলোকের নাম জানতে পারিনি। বাবা কোথাও লেখেনি। বাবার অন্তর্ধানের সাথে কি সেই ভদ্রলোকের কোন সম্পর্ক ছিল? অতীতের ঋত শোধ করতে কি সেই ভদ্রলোক বাবাকে বাধ্য করেছিলেন? বাবার সেদিনের চাপা কান্নার কারণ কি এই ভদ্রলোক? বাবা আর মায়ের বিয়ে কবে কিভাবে হল সেই সম্পর্কেও কোথাও কিছু লেখা নেই। 

আমি মায়ের কাছে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি বাবার এভাবে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন কিনা। মা বরাবরই নিরুত্তর থেকেছেন। 

হঠাৎ একদিন সকালবেলা এক অচেনা নম্বর থেকে বাবার স্টাডির ল্যান্ডলাইনে একটা ফোন আসে। এক লোক ফোন দিয়ে জানায় যে সে আমার বাবা, মানে ডঃ বশির জামানের ছাত্র। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে পরিচয়। 

“স্যার আছেন?” 

“না। আপনি কে বলছেন?” 

“রাশিক ইসলাম। ডঃ বশির জামান স্যারের ছাত্র আমি।” 

“ফোন নম্বর কোথায় পেলেন?” 

“ক্যাম্পাসে ফোন করেছিলাম। ওরা দিল। আপনি কে বলছেন?” 

“উনার মেয়ে বলছি। বাবা তো নেই।” 

“জানি। স্যারকে ওইদিন দেখলাম মনে হল। তাও শিওর হওয়ার জন্য 

ফোন করলাম। স্যারের কাছে এখন যে ফোন নম্বর আ……” 

“বাবাকে দেখেছেন! কোথায়?” 

রাশিক ইসলাম যে দেশটার নাম বলল সেটা আমার বাবার জন্মভূমি। অনেকবার শুনেছি দেশটার নাম। অনেক গল্প শুনেছি সেই দেশের। বাবা তাহলে আমাকে না বলে দেশে ফিরে গিয়েছে? কিন্তু কেন? 

“হ্যাঁ। স্যারকেই তো দেখলাম বলে মনে হল। সেদিন সকালবেলা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে মর্নিং ওয়াক করছিলেন। আমি ডাকলাম। স্যার শুনতে পাননি মনে হয়।” 

আমি বজ্রাহতের মত রিসিভারটা কানে নিয়ে বসে থাকলাম। আমি এতদিন বিশ্বাস করে নিতে শুরু করেছিলাম যে বাবা মারা গিয়েছে। বাবা আর কখনও ফিরে আসবে না। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে কেউ একজন বাবাকে দেখেছে। জীবিত দেখেছে। একজন মানুষের মৃত্যু সংবাদ শোনার চাইতে একজন মৃত মানুষের জীবিত থাকার সংবাদটা যে কতটা দুর্বিসহ- তা আমিই জানি। 

“হ্যালো? হ্যালো?” 

“জী বলেন।” 

“বলছি স্যারের এখনকার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটা কি আমাকে একটু দেওয়া যায়? মানে যেই নম্বরে স্যারের সাথে এখন যোগাযোগ করা যাবে?” 

“আপনি বাবাকে দেখেছেন শিওর?” 

“হ্যাঁ। স্যারের ক্লাস করেছি তিন বছর। স্যারের সাথে আমার একটা জয়েন্ট পেপারও পাবলিশ হয়েছিল। স্যারকে চিনব না!” 

আমি লোকটার ফোন নম্বর নিয়ে রাখলাম। বললাম বাবা যদি অনুমতি দেয় তো জানাব। ভদ্রলোক ফোন রেখে দিলেন। 

সেদিন রাতে আমি আর মা খেতে বসেছি। মায়ের সর্দি হয়েছিল। নাক টানছিলেন বারবার। আমি সকালবেলার ব্যাপারটা বললাম। মায়ের ভেতরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। আমার ভীষণ রাগ হল। আমি খাবারের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ঝন ঝন করে প্লেটটা ভেঙে গিয়ে মেঝেতে খাবার ছিটিয়ে পড়ল। কেন মা এমন করবে? একটা মানুষ হয়ে একটা মানুষের বেঁচে থাকাতে কেন তার ভালো লাগবে না? কেন বাবার বেঁচে থাকার সংবাদ শুনে তিনি খুশি হবেন না? কেন দিনের পর দিন আমার বাবার কাছ থেকে দেয়াল তুলে নিজেকে আলাদা করে রেখেছেন? আমরা কি তার সাথে কথা বলার যোগ্য না? আমি কি তার নাচের একাডেমীতে যাওয়ার যোগ্য না? 

মা কোন কথার উত্তর না দিয়ে ভাঙা প্লেটের টুকরোগুলো তুলতে শুরু করলেন। আমি একটা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারলাম পাশের দেয়ালে। বললাম, “তুমি আমার মা না, তুমি একটা ডাইনী। আমি জানি, তোমার জন্যই বাবা আমাদের কাছ থেকে দুরে সরে গিয়েছে। তোমার অত্যাচারে বাবা দেশে ফিরে গিয়েছে।” চিৎকার করে কথাগুলো বললাম আমি। রাগে দুঃখে আমার শরীরে আগুন ধরে গিয়েছিল। সহ্যের সীমা আছে। আমি জানি না কেন বাবা এই মহিলাকে বিয়ে করেছিল। এই মহিলাকে আমি চিনি না। 

আমি আমার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। 

সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো, আমি নিজের কাছে ভীষণ ছোট হয়ে গেছি। আমি কি আমার মায়ের অনাহুত সন্তান? তিনি কি আমাকে পেয়ে খুশি হননি কখনও? বাবাও বা কেমন? এভাবে কিছু না বলে কেন চলে গেলেন? তার কাছেও কি আমি অবাঞ্ছিত ছিলাম? আমার বুকের ভেতরে দুঃখের ঢেউ যেন পাক দিয়ে দিয়ে উঠছিল। আমি কোনভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। আমি আমার দাদা দাদি কিংবা নানা নানির পরিচয় জানি না। এমন তৃতীয় কেউ নেই যে আমি তাকে গিয়ে এই কথাগুলো বলব। আমার বুকের ভেতরের অভিমানগুলো মেঘ হয়ে কান্নার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। 

সকালে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। আজ রবিবার, ছুটি। আমি রুম থেকে বের হলাম। মাকে সরি বলতে হবে। বাবা আমাকে সবার কাজের উদ্দেশ্য দিয়ে মানুষ বিচার করতে শিখিয়েছে। কাজ দিয়ে না। আমি জানি না মা কেন এমন করছেন? কাজেই তার সাথে এমন আচরণ করা অবশ্যই ঠিক হয়নি। একেবারেই ঠিক হয়নি। 

ডাইনিং স্পেসটাতে সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে। খাবার টেবিলে রাখা ফলের ঝুড়িতে রোদ পড়েছে। সবুজ আপেলগুলো রোদ পড়ে জ্বলজ্বল করছে। খাবার টেবিল দেখেই যেন মনে হল গত রাতে কিছুই হয়নি। গত পাঁচ বছরে কিছুই হয়নি। বাবা হাঁটতে বেরিয়েছেন। এখনই ফিরবেন। মা পেছনের বাগানের গাছে পানি দেবেন। 

কিন্তু, সব সময় সব কিছু ঠিক থাকে না। 

আমি খাবার টেবিলে একটা কেক দেখলাম। আর একটা চাবি। আমি ছোট ছোট পায়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলাম, কেকের ওপরে লেখা, “বুয়োন কমপ্লেয়ান্নো মেরিলিনা” -শুভ জন্মদিন মেরিলিনা। আমার মনে পড়ল, আজ আমার জন্মদিন। আমার এত ভালো লাগল! মা আমার জন্য কেক বানিয়েছেন এতে যতটা খুশি লাগল, আমার জন্মদিন যে তিনি মনে রেখেছেন এটা ভেবেই আমার চোখে পানি চলে আসল। আমি মাকে একবার ডাকলাম। তারপর চাবিটা হাতে নিলাম। কেকের ওপর থেকে একটু পেস্ট্রি আঙুলে মেখে নিয়ে আঙুল চুষতে চুষতে চাবির গোছাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। আমি আবার মাকে ডাকলাম, “মা, চাবিটা কি আমার জন্মদিনের গিফট? চাবিটার সাথে লাগানো একটা পিতলের ফলকে একটা ঠিকানা খোদাই করা।” 

তাকিয়া মহল 
১৩/৩, পানির ট্যাঙ্কের পাশের গলি 
মানিকপুকুর রোড, 
বহরমপুর। 

এটা কিসের চাবি? 

আমি চাবিটা শর্টসের পকেটে নিয়ে কিচেন থেকে একটা ছুরি আনলাম। মাকে ছাড়া কেক কাটব না। মা এই সময়ে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনতে শুনতে বাগানে কাজ করেন। এই জন্যই হয়ত আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। আমি বাড়ির পেছনের বাগানে মাকে খুঁজতে গেলাম। 

পেছনের বাগানে কাউকে পেলাম না। সামনের বারান্দার রকিং চেয়ারটাও খালি। রান্নাঘর থেকেও কোন শব্দ আসছে না। তাও একবার উঁকি দিলাম রান্নাঘরে। ওখানেও মা নেই। 

মা কি ঘুম থেকে ওঠেননি? 

মাকে পেলাম মায়ের শোয়ার ঘরে। উইন্ড চাইমারের হ্যাঙারের সাথে বাঁধা একটা দড়ির ফাঁসের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায়। বেডসাইড টেবিলের ওপরে পড়ে আছে মায়ের রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট। যে সুইসাইড নোট আমার এতদিনের বাস্তবতাকে চুরমার করে দেয়। 

এক মেঘলা দিনে মায়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হল। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটাও ছিল মায়ের মতই বিষন্ন। দু’তিনজন ক্যারোল সিঙ্গার আর ফাদার ছাড়া আর তেমন কেউ ছিলেন না। সব থেকে আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম, মায়ের নাচের একাডেমী থেকে কেউ আসেনি। 

তার দুইদিন পর আমি বাবার জন্মভূমির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই, বাবার খোঁজে। আর অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *