বিচ্যুত নিশানা

বিচ্যুত নিশানা 

মাথার ভেতরে চাপা একটা ব্যথা নিয়ে ডাঃ শফিকের জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরে ডাঃ শফিক হাত পা নাড়াতে পারলেন না। তার মনে হল, হাত আর পায়ে তিনি কোন কিছু অনুভব করছেন না। খুব আস্তে আস্তে নাড়ানোর চেষ্টা করার কিছুক্ষণ পরে বুঝলেন, তার হাত পা বাঁধা। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হাত-পা’গুলো অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারার সাথে তার ভেতরে একটা তীব্র ভয় পাক খেতে শুরু করল। ভ্যাপসা গরম। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার ফলে তার শরীরের সেন্সরগুলো তাকে বোঝাতে পারল না যে তাকে চেয়ার সুদ্ধ বসিয়ে রাখা হয়েছে নাকি শুইয়ে রাখা হয়েছে। কতক্ষণ তিনি এইভাবে আছেন? 

কিছুক্ষণ পরে ডাঃ শফিকের ঘ্রাণ শক্তি কাজ করতে শুরু করল। আর কড়া ওষুধের গন্ধ তার নাকে লাগল। স্যাঁতস্যাঁতে ওষুধের গন্ধ। ডাঃ শফিকের একবার মনে হল তিনি যেন মারা গিয়েছেন। তার কাছে সময় এখন স্থির। তার আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। ভ্যাপসা গরমে তার সারা শরীর চ্যাটচ্যাট করছে। মৃত্যুর এপারে কি সবারই গরম লাগে? নাকি তিনি পাপী বলেই তার গরম লাগছে? নাকি তিনি এখনও মরেননি। পোস্টমর্টেম না করার জন্য তিনি যে ঘুষ নিয়েছেন, তার জন্য কি দেবদূতেরা তাকে শুধু শাস্তি দিতে নিয়ে এসেছে? শাস্তি শেষে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে? সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি ঠিক মাফ করে দেবেন। ডাঃ শফিক মনে মনে ঠিক করতে লাগলেন কি বলে মাফ চাওয়া যায়। 

হঠাৎ খড় খড় করে কোথায় যেন একটা শব্দ হল। যেন পুরনো রেডিও বেজে উঠে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ডাঃ শফিক কিছু একটা বলতে গিয়ে বুঝলেন, তার মুখ বাঁধা আছে। তিনি কে কে বলে চিৎকার করলেন, কিন্তু সেটা বাইরে থেকে শুধু চাপা কণ্ঠস্বর বলেই মনে হল। 

কিছুক্ষণ নীরবতা। 

আবার খড়খড় করে শব্দ হল। একটা মহিলা কণ্ঠ শোনা গেল। কিন্তু মহিলা কি যে বলল, ডাঃ শফিক কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপর শোনা 

গেল কে যেন বলছে, “মুখটা খুলে দিতে বললাম না। যা গিয়ে মুখটা খুলে দে।” 

কে যেন এসে ডাঃ শফিকের মুখের স্কচটেপটা খুলে দিল। চামড়ায় টান পড়তেই ডাঃ শফিক ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেন। 

আবার সেই অর্থহীন মহিলা কণ্ঠ। ডাঃ শফিক বললেন, “আমাকে এইখানে এইভাবে রাখা হয়েছে কেন? কে আপনারা? আমি কোথায়? এটা কোন জায়গা? এখানে অন্ধকার কেন?” তার কণ্ঠে তীব্র ভয় স্পষ্ট। ঘুষখোর একজন মানুষের জন্য এইটাই স্বাভাবিক। ডাঃ শফিকের মনের ভেতরে তীব্র পাপবোধ কাজ করছে। 

স্পিকারে এবার একটা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, “আপনাকে এইখানে আপনার ভালোর জন্য আনা হয়েছে। নিজের ভালোর জন্যই আপনার উচিৎ আমাদেরকে সহযোগিতা করা। কাজ হয়ে গেলেই আমরা আপনাকে ছেড়ে দেব।” পুরুষ কণ্ঠ থামতেই আবার সেই মহিলা কণ্ঠ অর্থহীন ভাষায় কি সব বলতে লাগল।” 

ডাঃ শফিক বললেন, “আমি আপনাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।” 

মহিলা কণ্ঠস্বরটা আর কিছুই বলল না। শুধু একটানা একটা চাপা শব্দ হতে লাগল। তারপর আবার সেই পুরুষ কণ্ঠটা বলল, “আপনি এজেন্ট রঞ্জনকে কিভাবে চেনেন?” 

“এজেন্ট রঞ্জন কে?” উল্টো প্রশ্নটা করেই ডাঃ শফিকের মনে পড়ল হাসপাতালে দেখানো সেই লোকটার আইডি কার্ডের কথা। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “আমি ওই লোককে চিনি না। আগে কখনও দেখিনি।” 

“আপনার আর এজেন্ট রঞ্জনের ভেতরে কি কথা হয়েছে?” 

“লোকটা আমাকে পোস্ট মর্টেম করতে নিষেধ করছিল। আমি বলেছি আমি যেভাবেই হোক পোস্টমর্টেমটা করব। লোকটা আমাকে ফোর্স করছিল বারবার। আমাকে ঘুষও অফার করছিল। আমি নেইনি।” 

হঠাৎ একটা ঘুষি এসে পড়ল ডাঃ শফিকের চোয়াল বরাবর। এটার জন্য ডাঃ শফিক প্রস্তুত ছিলেন না। অন্ধকারেও তার চোখে সর্ষে ফুল ফুটে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে ইংরেজিতে কয়েকটা গালি দিলেন ডাঃ শফিক। 

স্পিকারে আবার সেই পুরুষ কণ্ঠ বলল, “আপনি যতবার মিথ্যা বলবেন ততবার একটা করে ঘুষি দিতে আমরা বাধ্য হব। পছন্দ আপনার। আপনার ব্যাগ থেকে আমরা একটা হলুদ খাম পেয়েছি যেটাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিল। আর আপনি বলছেন ঘুষ নেননি? বলেন এজেন্ট রঞ্জনকে আপনি কিভাবে চেনেন?” 

“আমি চিনি না। চিনি না আমি।” ডাঃ শফিকের কণ্ঠে রাগ আর ক্ষোভ।”মেজর জেনারেল মহিউদ্দিন হক ফিরোজকে কিভাবে চেনেন?” 

“উনাকে আমি কিভাবে চিনব?” কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, “ডিফেন্সের কাউকেই আমি সেভাবে চিনি না।” 

আবার একটা ঘুষি পড়ল ডাঃ শফিকের চোয়ালে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন তিনি। পুরুষ কণ্ঠটা বলল, “আপনার একমাত্র শ্যালক লেফটেন্যান্ট আর আপনি বলছেন ডিফেন্সের কাউকে চেনেন না?” 

ডাঃ শফিক এক দলা থু থু ফেললেন। মুখে নোনতা স্বাদ অনুভব করলেন তিনি। প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু হাঁপাতে লাগলেন। 

***

আশফাক চৌধুরী হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে হাতের মাইক্রোফোনটা নামিয়ে রাখলেন। ইশারা করতেই পাশে বসে থাকা মাইক্রোফোন অপারেটর মেয়েটা উঠে গেল। তারপর আশফাক চৌধুরী পাশে দাঁড়ানো জেনারেলকে বললেন, “ধুর। এইটা ডঃ বশির জামান না। এই লোক ইতালিয়ান ভাষা বোঝে না। এই লোকের এক শ্যালক লেফট্যানেন্ট। বশিরের কোন শ্যালক লেফটেন্যান্টও না। এই লোকের পারসোনাল ডিটেইলসের সাথে কোনভাবেই বশিরের পারসোনাল ডিটেইলস মেলে না। আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করলাম দেখলেনই তো। আমরা শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। বশির জামানের যে কয়টা ছবি আর ভিডিও ফুটেজ আপনি আমাকে দিয়েছেন, তার একটার সাথেও এই লোকের চেহারার মিল নেই। কথাবার্তাও একটা কাওয়ার্ডের মত। এই লোক বশির জামান হতেই পারে না।” 

জেনারেল গভীরভাবে কি যেন ভাবছেন। তার হিসাবে তো কোন ভুল হয় না। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এই লোকটা বশির না। আবার আশফাকের যুক্তিগুলোও ফেলে দিতে পারছেন না। তার কেন জানি মনে হচ্ছে যে কোথায় যেন ভুল হচ্ছে। কিন্তু কোথায় হচ্ছে সেটা – তিনি বুঝতে পারছেন না। এটা ফিরোজের কোন চাল না তো? কিন্তু এই লোকটা তো ফিরোজের ল্যান্ডরোভার থেকে বের হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী এই লোকটাই বশির জামান। 

“ছেড়ে দেই। না হলে নিউজ হবে। সুশীল সমাজ হাউকাউ করবে। আর ডাক্তারদের তো চেনেন। কিছু হইলেই অবরোধ ডাকবে। মেলা ভেজাল হবে। ছেড়ে দেই, নজরে রাখি তাহলেই হবে।” 

মাঝরাত। কালো টয়োটাটা মাঈজদির মোড় ঘুরে হাইওয়েতে হারিয়ে গেল। সাথীর বাপ চায়ের দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করে টর্চ জ্বালাতেই দেখলেন এক লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। মোটা-সোটা। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। চোখের কোণায় ব্যান্ড এইড লাগানো। ঠোঁটের কোণায় কালশিটে। কাছে এসে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, “এক্সকিউজ মি ভাই, এইটা কোন জায়গা। আমি বহরমপুর যাব। কিভাবে যাব একটু বলতে পারেন?” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *