মৃতদেহের অভিশাপ

মৃতদেহের অভিশাপ 

খাইরুলের ফ্ল্যাট।

সসপেন থেকে কফি ঢালতে গিয়ে খাইরুলের মনে পড়ল, তার বাসাতে কফির মগ একটা। শুধু কফির মগ না, টুথব্রাশ থেকে শুরু করে খাবার প্লেট পর্যন্ত সবকিছুই একটা। তার বাসায় কখনও কোন মেহমান আসে না। কাজেই অতিরিক্ত কিছুই খাইরুলের কেনা হয়নি। এখন মেরিলিনাকে তিনি কিসে কফি দেবেন? এই ব্যাপারটা একেবারেই পরিকল্পনাবিহীন একটা কাজ হয়ে গিয়েছে। 

মেরিলিনাকে বাধ্য হয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এনে রেখেছেন খাইরুল। দ্বিতীয় কোন উপায় তিনি বের করতে পারেননি। কিভাবে বের করবেন? এমনিতে মাথার ভেতরে দশটা ঝামেলা। একে তো ডাঃ শফিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর মল্লিকের অবস্থাও ভালো না। ডাক্তার আশাব্যাঞ্জক কিছুই বলতে পারছে না। মল্লিক কোন লোকের কথা বলতে চাচ্ছিলো সেটাও জানা যাচ্ছে না। মল্লিককে যে কালো গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে সেটারও কোন হদিস পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত। ওদিকে মেরিলিনার ব্যাগটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারাগাছির বিলটাতে টানা ছয় ঘণ্টা ধরে জাল ফেলেও কোন ব্যাগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসপি স্যার বিকালে ফোন দিয়ে বলেছেন এই কেসটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করতে। খাইরুল মুখের ওপরে কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু কথার ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই কেসের তদন্ত থামবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি এর শেষ দেখছেন। এই লাশটাতে হাত দেওয়ার পরেই যেন সব কিছু আরও বেশি গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। সব কিছুতেই শুধু না আর না। এতগুলো ঝামেলা নিয়ে মেরিলিনার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা ঠিক করা খাইরুল সাহেবের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। 

মেরিলিনা তার পাশের রুমটাতেই আছে। আজ সারাদিন সে একা এই দুই রুমের ফ্ল্যাটে কাটিয়েছে। একটা মেয়ে নিজের বাবাকে খুঁজতে এসে ব্যাগ পাসপোর্ট হারিয়ে সারাদিন একা একা বন্দী হয়ে আছে, ব্যাপারটা ভেবেই খাইরুল নিজের কাছে নিজেই যেন ছোট হয়ে গেলেন। 

কফির কাপটা ডাইনিং টেবিলে রেখে খাইরুল মেরিলিনার রুমের দরজায় টোকা দিলেন। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার টোকা দিলেন। আনমনেই একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন খাইরুল। রাত আটটা। এখন কি কফি খাওয়ার সময়? মেরিলিনা রাতের খাবার কখন খায়? হোটেল থেকে রাতের খাবার আনতে হবে। খাইরুল এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে দরজায় নক করলেন। নক করার সাথে সাথে মেরিলিনার নাম ধরে ডাকলেন। 

দরজা খুলে গেল। মেরিলিনা কান থেকে খাইরুলের হেডফোনটা খুলতে খুলতে বলল, “ইয়েস?” 

মেরিলিনা একটা পাতলা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা সর্টস পরে আছে। তার বুকের অনেকটা অংশ বেয়াড়াভাবে বের হয়ে আছে। খাইরুল বিব্রত বোধ করলেন। মাথা নিচু করে বললেন, “কফি খাবেন? কফি করেছি। 

মেরিলিনা হেসে বলল, “না। আমি সন্ধ্যায় কফি করে খেয়ে নিয়েছি।”

“ও আচ্ছা, ওকে। ঠিক আছে। আপনি, আপনি রাতের খাবার কখন খান?” 

“পরে খাব। তাছাড়া আমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হবেন না।” 

কথাগুলো হাসি মুখেই বলল মেরিলিনা। কিন্তু খাইরুলের মনে হল, কথাগুলো খোঁচা মেরে বলল। খাইরুল নিজের ঘরে গেলেন। দরজা বন্ধ করলেন। পরণের ইউনিফর্মটা খুলতেই যেন সারাদিনের ক্লান্তি তাকে জড়িয়ে ধরল। অন্ধকার ঘরে রাস্তার ল্যাম্পোস্টের আলো এসে পড়ছে। আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে সেই আলো লম্বা হয়ে খাইরুলের বুকে এসে পড়ল। যেন কেউ আলোর তলোয়ার দিয়ে খাইরুলের বুকটা চিরে দিয়েছে। খাইরুল ল্যাম্পোস্টের ক্লান্ত আলোর দিকে তাকাতেই সেই পুরনো প্রশ্নটা মনে পড়ল। পুরুষ মানুষ মানে কি শুধুই বিনয় দেখানো? নাকি কিছুটা কর্তৃত্বও ফলাতে হয়? শুধু বিনয় দেখানো কি কাপুরুষতা? নাকি কর্তৃত্ব ফলাতে গিয়ে একটু আধটু সহিংস হওয়াটা কাপুরুষতা। তিনি কাপুরুষ। কারণ তিনি তার বোনকে বাঁচাতে পারেননি। তিনি মনে করেন তার বোনের মৃত্যুর জন্য কোন না কোনভাবে তিনিই দায়ী। 

খাইরুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভাবলেন, একটা অচেনা অজানা মেয়ের জন্য কফি বানানো কি তার ঠিক হয়েছে? এত তোয়াজ করে খাওয়া দাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করাটাও কি বেশি বেশি হয়ে গিয়েছে? মেরিলিনা যদি অন্য কিছু মনে করে? এই জন্যই কি দরজা খুলছিল না? মনে করলে করল। তিনি তো মেয়েটার সাহায্য করতে চাচ্ছেন। কাল পরশুর ভেতরে কোন মহিলা কলিগের বাসায় রেখে আসবেন। তারপর অ্যাম্বাসিতে জানাবেন। ওরা যা খুশি করবে। খাইরুলের কাছে তার আত্মসম্মান খুব বড় জিনিস। তিনি বয় বেয়ারা নন। যার ইচ্ছা হবে নিজে কফি বানিয়ে নেবে। এখন থেকে এত নরম হওয়া যাবে না। নিজেকে নিজেই বললেন যেন। 

হঠাৎ মেরিলিনাকে রুম থেকে বের হয়ে আসতে দেখে খাইরুলের ধ্যান ভাঙ্গল। কখন যে তিনি ইউনিফর্ম পালটে ঘরে পরা পোষাক পরে কফির কাপ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছেন, নিজেই খেয়াল করেননি। মেরিলিনাকে বের হয়ে আসতে দেখেই খাইরুলের একটু আগে করা সংকল্পটা ভুল হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে তিনি কেমন কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন। এর কারণ কি মেরিলিনার স্বল্পবসন? খাইরুল কফির কাপে মন দিলেন। দৃষ্টি সংযত রাখতে তিনি তারাগাছির কেসটা নিয়ে ভাবতে শুরুর করলেন। 

মেরিলিনা ফ্রিজ খুলে দুটো বাটি নিয়ে রান্নাঘরে গেল। খাইরুল দেখবেন না দেখবেন না করেও একবার উঁকি দিলেন রান্না ঘরে। ফ্রিজে বাটি আসল কোথা থেকে? বুয়া তো আজ দুইদিন আসে না। রান্না বান্নাও হয়নি। 

চুলা জ্বালিয়ে বাটি থেকে কি সব গরম করতে লাগল। মেরিলিনার চোখে চোখ পড়তেই খাইরুল চোখ সরিয়ে নিলেন। নিজেকে প্রবোধ দিলেন। নাহ, তিনি এই মেয়ের খোলা উরু দেখেননি। উঁচু খোপা আর ঈষৎ কেশাবৃত ঘাড়ও দেখেননি। তিনি তারাগাছির কেসটা নিয়ে ভাবছিলেন। 

দুটো প্লেট এনে ডাইনিং টেবিলের ওপরে রাখল মেরিলিনা। সাদা ভাত, মাছ আর সালাদ। খাইরুল পিট পিট করে প্লেটের দিকে তাকালেন। 

চেয়ার টেনে বসতে বসতে মেরিলিনা বলল, “সময় কাটছিল না। তাছাড়া ক্ষিদে পেয়েছিল খুব। তাই রান্না করেছি। ইতালিতে টুকটাক রান্না করতাম।” 

“মাছ কোথায় পেলেন? আর নতুন প্লেটটা কোথা থেকে আসল?” খাইরুল প্রশ্ন করলেন। 

“সামনের সুপার শপ থেকে কিনে এনেছি।” 

“আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? আবার বাইরে বের হয়েছেন? আপনাকে না বললাম আপনি একা একা বের হবেন না। জানেন এই দেশের মানুষ কতটা খারাপ? আপনি কত বড় একটা বিপদের ভেতরে আছেন তা আপনি জানেন?” 

“আশ্চর্য! কোথায় আপনি একটু ধন্যবাদ দেবেন, তা না করে উল্টো আপনি আমাকে বকছেন! আপনার নূন্যতম কৃতজ্ঞতা বোধ কি আছে? আর খারাপ মানুষ সব দেশেই আছে। তাই আমি মেয়ে বলে খারাপ মানুষের ভয়ে আমাকে ঘরে বসে থাকতে হবে নাকি? মেয়েরা কেয়ারিং হলেও দোষ, আবার ড্যাম কেয়ার হলেও দোষ?” 

মেরিলিনা চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেল। খাইরুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মেরিলিনার ঘরের দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। 

***

সন্ধ্যেবেলা থানা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে একটা মোটরসাইকেল খাইরুলকে অনুসরণ করে। মোটরসাইকেলটা বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসে। বাসস্ট্যান্ড থেকে মোটরসাইকেলটা ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আরেকটা মোটরসাইকেল তাকে অনুসরণ করা শুরু করে। এই মোটরসাইকেলটা তাকে অনুসরণ করে সুখীর মোড় পর্যন্ত। সুখীর মোড় থেকে একটা নেভি-ব্লু হায়েস খাইরুল সাহেবের পিছু নেয় এবং অনুসরণ করতে করতে দ্বীপ শহরে তার এপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পুরো ব্যাপারটা তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। 

হায়েসের ভেতরে অপেক্ষা করছে MRAU এর পাঁচজন চৌকশ এজেন্ট। তাদের ভেতরে মেজর রঞ্জন একজন। কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে এক দৃষ্টিতে খাইরুল সাহেবের এপার্টমেন্টের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। এবার আর কোন ভুল করা যাবে না। সব পরিকল্পনা করা আছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। গার্ডের শিফট পরিবর্তন অপেক্ষা। রঞ্জন ল্যাম্পোস্টের আলোয় হাত ঘড়ি দেখে বললেন, “আর চল্লিশ মিনিট। তৈরি হও সবাই। মনে রাখবা, এপার্টমেন্টের ভেতরে কোন গুলি চলবে না। প্রাইমারি টার্গেট মেয়েটা। আর সেকেন্ডারি টার্গেট চাবিটা,” মেজর রঞ্জন বললেন। অন্ধকারে চারটা ছায়ামূর্তি মাথা নাড়ল। 

***

সরি বলতে হবে। খাইরুল মেরিলিনার দরজায় নক করলেন। জানেন এত সহজে দরজা খুলবে না তারপরেও তিনি নক করতে লাগলেন। 

“মেরিলিনা, দরজাটা খোলেন। আসলে আমি খুব চাপের ভেতরে আছি কদিন। বুঝতেই পারছেন। তারাগাছির কেসটা নিয়ে খুব ঝামেলার ভেতরে আছি। এসপি স্যার ফোন দিয়েছিলেন বিকালে। কেসটা বন্ধ করে দিতে বলছেন তিনি। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। দরজাটা খোলেন। কথা আছে, প্লিজ।” 

খাইরুলের মনে হল, এইসব কথা তিনি মেরিলিনাকে কেন বলছেন? শুধু শুধু সাফাই গাওয়ার তো প্রয়োজন নেই। মেয়ে মানুষ অভিমান করে দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করবে, এটাই স্বাভাবিক। এত সরি বলার তো কোন প্রয়োজন নেই। দরজার সামনে থেকে সরে যাচ্ছিলেন তিনি। 

মেরিলিনা দরজা খুলল। ফোলা ফোলা দুজোড়া চোখে চাপা ক্রোধ।

“বলেন।” মেরিলনা বলল। 

“আমার মনে হয় আমাদের কথা বলা উচিত। কিন্তু তার আগে আসেন খেয়ে নেই। ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।” 

“খিদে নেই।” 

খিদে নেই বললেও মেরিলিনা খেতে বসল। খাইরুল তার সামনের চেয়ারটা টেনে নিতে নিতে বললেন, “জানি আপনার নিজেকে বন্দী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু….” খাইরুল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখতে বললেন, “আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমি আমার একমাত্র বোনকে হারিয়েছি। আমার সব থেকে কাছের মানুষ ছিল সে। ওর মৃত্যুর পরে আমার আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। সব সময় একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি।” 

“আমাকে নিয়ে?” মেরিলিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রশ্নটা করল। 

খাইরুল বিব্রত বোধ করলেন। নাহ। এত বেশি কথা কেন বলছেন তিনি? শব্দের অপচয় বেশি হয়ে যাচ্ছে। খাইরুল ভাত মাখানোতে মন দিলেন। 

মেরিলিনা কিছুক্ষণ খাইরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর মাথা নিচু করে খেতে থাকল। 

খাইরুল শব্দের অপচয় থামাতে পারলেন না। বললেন, “ছোটবেলায় একটা রোড এক্সিডেন্টে মা আর বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি আর আমার ছোটবোন জুঁই আমাদের ছোট চাচার কাছে থাকা শুরু করি। ছোট চাচার সাথে আমাদের পরিবারের কোন যোগাযোগ ছিল না কখনও। মা বাবাকে কখনওই ছোট চাচার সাথে যোগাযোগ রাখতে দেখিনি। কিন্তু যখন ছোট চাচার সাথে থাকা শুরু করলাম, কিছুদিন পরে বুঝলাম ছোট চাচার সাথে বাবা মা কেন যোগাযোগ রাখতেন না।” 

মেরিলিনা নাক টানল। মাথা নিচু করে থাকায় খাইরুল বুঝতে পারলেন না যে সে কাঁদছে কিনা 

“চাচার সাথে সারাদিন দেখা হত না। যদি তিনি বাড়ি থাকতেন, তাও চাচী আমাদেরকে তার সাথে দেখা করতে দিতেন না। চাচার শোওয়ার ঘরের দরজা সারাদিন বন্ধ থাকত। আমি আর জুঁই চাচার বাড়ি থেকে একটু দুরে একটা বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি হয়ে যাই। চাচাই আমাদেরকে সকালের নাস্তা টাস্তা বানিয়ে দিতেন। আমাদের সব আব্দার ছিল চাচীর কাছেই। চাচী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তার জমানো ভালোবাসাটুকু দিয়েই আমাদের দুজনকে ভালোবেসেছিলেন। কখনও জোরে কথা বলেছেন কি শাসন করেছেন বলে মনে পড়ে না। তার প্রতিটা আচরণ দেখে মনে হত, আমি আর জুঁই চাচার বাসায় বেড়াতে এসেছি। কিছুদিন থেকে আবার বাসায় ফিরে যাব। তিনি ছিলেন যথেষ্ট স্নেহশীলা এবং প্রিয়ংবদা।” 

পানির বোতল থেকে পানি ঢাললেন খাইরুল। কলকল করে পুরো গ্লাসটা পানিতে ভরে গেল। খাইরুল ঢকঢক করে পুরো গ্লাসটা শেষ করলেন। তারপর আবার শুরু করলেন। 

“একদিন গভীর রাতে চাচাকে দেখে ফেললাম। নিঃশব্দে বাড়িতে ঢুকলেন। রক্তাক্ত। চোখের কোণায় কালশিটে। চোয়াল ফুলে একপাশে ঝুলছে। চাচীর কাঁধে ভর দিয়ে চাচা ভেতরের ঘরে চলে গেল। আমি তখন ক্লাস সেভেন। বুঝতে পারছিলাম না কি করব। চাচাকে ওভাবে দেখতে পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু চাচীকেও কিছু বলতে পারছিলাম না। কারণ ততদিনে বুঝে গিয়েছি, চাচী চায় না আমরা চাচাকে এভাবে দেখি বা চাচার সাথে কথা বলি কিংবা চাচাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন করি।” 

মেরিলিনার ভেতরে কোন কৌতূহল লক্ষ্য করলেন না খাইরুল। ভাত খাওয়া ছাড়া তার মনোযোগ অন্য কোন দিকে আছে বলে মনে হল না। তাও খাইরুল বলতে থাকলেন। 

“ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলাম। আর জুঁই ক্লাস ফাইভে। চাচী ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আমাকে আর জুঁইকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, কি চাস বল। যা চাবি তোদের তাই দেব। আমি আমতা আমতা করে সেদিন বলেছিলাম, চাচার সাথে তুমি আমাদেরকে দেখা করতে দাও না কেন চাচী? চাচীর মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমি কোন উত্তর পাইনি। নিঃশব্দে উঠে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় আমাদেরকে গরুর মাংসের হালিম রান্না করে দিলেন। তারপর আমাকে ডেকে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, চাচা আন্ডারগ্রাউন্ড বক্সার। আন্ডারগ্রাউন্ড বক্সার কি আমি জানতাম না। চাচীর কান্না দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো তাই জানতেও চাইনি। কোনদিন প্রশ্নও করিনি। 

“একদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসেছি, হঠাৎ দেখি অনেকগুলো লোক আসল। আমাকে আর জুঁইকে চাচী ভেতরে যেতে বললেন। আমরা ভেতরে গেলাম। তারপর……” 

মেরিলিনা শূন্য প্লেট রেখে উঠে পড়ল। হাত ধুতে ধুতে বলল, “পুরুষ মানুষের জন্য আবেগ একটা বিলাসিতা খাইরুল। আপনি জানেন আমার মা আত্মহত্যা করেছেন? আমি একবারের জন্যও আপনাকে বলেছি সেটা?” নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল সে। খাইরুলের গালে যেন ঠাস করে একটা চড় লাগল। পুরো ঘটনাটা না শুনেই মেরিলিনা এভাবে উঠে চলে গেল? খাইরুল সাহেবের কথার কি এতটুকু দাম নেই? খাইরুল সাহবের ভেতরে ক্রোধ পাক খেতে শুরু করল। এত বড় বেয়াদবি করার সাহস পেল কোথা থেকে মেয়েটা? কালই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অ্যাম্বাসিতে রেখে আসবেন মেয়েটাকে। মা আত্মহত্যা করেছে তো কি হয়েছে? তার জন্য কি তিনি দায়ী নাকি? 

খাইরুল অনেক কষ্টে রাগ সামলে প্লেটটা নিয়ে রান্না ঘরে গেলেন। ট্যাপ ছাড়তেই প্লেটের ওপরে ছড় ছড় করে পানি পড়তে শুরু করল। প্লেটটা ধুতে ধুতে তার রাগ অনেকটা কমে আসল। মগের কফির দিকে চোখ পড়তেই মনে হল, কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। দরকার নেই কাউকে কফি অফার করার। তিনি একাই কফি খাবেন। কফির মগটা মাইক্রোওয়েভ 

ওভেনে গরম করে খাইরুল বারান্দায় চলে গেলেন। 

***

রাত নয়টা বাজতেই গার্ড বদরুল বেরিয়ে গেল। তার সাইকেলটা অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন রঞ্জন। তারপর বাকি চার এজেন্টকে বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব কাজ সারবেন। পরবর্তী গার্ড শামসুলের আসতে কিছুক্ষণ দেরি হবে। আমাদের এজেন্ট মারুফ ওকে সামনের মোড়ে ব্যস্ত রাখবে। এই সময়ের ভেতরে আমাদেরকে বেরিয়ে যেতে হবে। কোন ধরণের চিৎকার চেঁচামেচি যেন না হয়। সুনীল আর তন্ময়, আপনারা আপনাদের কাজ শুরু করেন। বাকি দুইজন আমার সাথে আসেন। আর তন্ময়, খাইরুল চলে যাওয়ার সাথে সাথে আপনি গাড়ি নিয়ে আসবেন। আমাদের ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।” 

***

খাইরুল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরম পড়া শুরু হয়েছে। রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা একেবারে ফাঁকা। খাইরুলের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। ছোটবেলা থেকেই তার কথা মন দিয়ে শোনার মত কেউ ছিল না। আজও নেই। মনের গভীরে কোন এক গুহার দেয়ালে তিনি তার কথাগুলো লিখে রাখেন প্রতিনয়ত। সব শ্রোতাহীন বক্তারা বোধহয় এমনই করে থাকেন। খাইরুল কফিতে চুমুক দিলেন। 

কয়েকটা কুকুর লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। হু হু করে এক পশলা বাতাস বয়ে গেল। দুর থেকে আলোকিত বহরমপুর শহর দেখা যাচ্ছে। খাইরুল ইচ্ছা করেই শহর থেকে দূরে বাসা নিয়েছেন। শহরের কোলাহল তার কাছে খুব নোংরা মনে হয়। এই ভালো। ভোরে উঠে নির্ভেজাল পাখির ডাক শোনা যায়। আরও অনেক অসংলগ্ন চিন্তা আস্তে আস্তে শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করল খাইরুল সাহেবের মাথার ভেতরে। 

হঠাৎ খাইরুল দেখলেন, একটা লোক ফুটপাথ ধরে হেঁটে আসছে। বাম হাতে একটা মাঝারী আকারের ব্যাগ। লোকটার হাঁটার ভেতরে কেমন যেন একটা উদাসীন ভাব আছে। লোকটাকে দেখে খাইরুল সাহেবের নিজেকে আরও বেশি একা মনে হল। আশে পাশে যেন কেউ নেই। কিছু নেই। 

ল্যাম্পপোস্টটা পেরিয়ে লোকটা আরও একটু কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ কোথা থেকে আরেকটা লোক এলো। পেছন পেছন এগিয়ে গেল লোকটার কাছে। অন্ধকারে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলেন খাইরুল। কিন্তু যখন বুঝতে পারলেন, ততোক্ষণে অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। একটা আর্তনাদ শুনতে পেলেন তিনি। দ্বিতীয় লোকটাকে প্রথম লোকটার ব্যাগটা নিয়ে দৌড় দিতে দেখলেন। আর প্রথম লোকটাকে দেখলেন ফুটপাতের ওপরে পড়ে থাকতে। লোকটা কেউ আছেন? কেউ আছেন? বলে চিৎকার করছে। দ্বিতীয় লোকটা কিছুদূর গিয়ে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। 

খাইরুল সাথে সাথে “ঐ ঐ” বলে চিৎকার করলেন। তারপর দৌড়ে গিয়ে ইন্টারকমে গার্ডকে ফোন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ রিং হল। কেউ ধরল না। খাইরুল নিজেই বের হয়ে গেলেন। তার এপার্টমেন্ট তিনতলায়। নিচে নামতে সময় লাগল না। 

গার্ডরুম ফাঁকা। পার্কিং লটে একটা একটা বিড়াল বসে বসে হাত চাটছে। কেউ নেই। বদরুলের ডিউটি শেষ। ও চলে গিয়েছে। কিন্তু এতক্ষণে তো মোসাদ্দেকের চলে আসার কথা! অতকিছু ভাবার সময় নেই। খাইরুল সদর দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এলেন। সামনের অন্ধকার ফুটপাথে তখনও লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। খাইরুল লোকটার কাছে যেতেই লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে কাতর স্বরে বলল, “আমার টাকা। আমার জমি বেঁচা টাকা। হারামিটাকে ধরেন। প্লিজ।”

খাইরুল দেখলেন, ছিনতাইকারী ব্যাগটা নিয়ে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দেখে মনে হল, “ব্যাগটা যথেষ্ট ভারি। খাইরুল আবার চিৎকার করলেন, “ঐ, দাঁড়া। দাঁড়া। পুলিশ।” ফাঁকা রাস্তায় খাইরুলের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, তিনি রিভলভার, ব্যাজ কিছুই আনেননি। অত কিছু ভাবার সময় নেই। খাইরুল লোকটাকে পিছু ধাওয়া করলেন। কিছুক্ষণ পরে হারিয়ে গেলেন অন্ধকারে। 

খাইরুল অন্ধকারে হারিয়ে যেতেই এজেন্ট তন্ময় বিদ্যুতবেগে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দৌড়ে গিয়ে হায়েসের ড্রাইভিং সিটে বসলেন। মাউথপিসটা মুখের কাছে নিয়ে বললেন, “অল ক্লিয়ার। মুভ।” 

রাস্তার পাশে দুপুরমডু ফুলের ঝোপ। নিকষ কালো অন্ধকার জমাট বেঁধেছে সেখানে। তিনজন এজেন্ট সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো। প্রত্যেকের হাতে ক্লিনিক্যাল গ্লাভস। মেজর রঞ্জন আবারও ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, কোনভাবেই রিভলভার ব্যবহার করা যাবে না। তারপর বিদ্যুতগতিতে সদর দরজা দিয়ে পার্কিং লটে ঢুকে পড়ল তিনজন। এজেন্ট বরুণ নিচের ফাঁকা পার্কিং লটে থাকল। যদি কোন ধরণের এদিক ওদিক হয়, সে প্রাথমিকভাবে সামলাবে। বাকি দুইজন, রঞ্জন আর এজেন্ট শিমুল তিনতলায় উঠে গেল। প্রত্যেকের চালচলন স্বাভাবিক কিন্তু ক্ষিপ্ৰগতি। প্রতিটা পদক্ষেপ, প্রতিটা গতিবিধি যেন মাপা মাপা। 

যেরকম ভাবা হয়েছিল, সেটাই হয়েছে। খাইরুল তাড়াতাড়িতে এপার্টমেন্টের দরজা খোলা রেখে গিয়েছেন। বিড়ালের মত নিঃশব্দে দুইজন এজেন্ট এপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ল কোন রকম বাধা ছাড়াই। রঞ্জন মুখে একটা নাক ঢাকা মাস্ক পরে নিলেন। ক্লোরোফর্ম মাখানো টিস্যু বাম হাতে ধরতে ধরতে শিমুলকে বন্ধ দরজাটার দিকে ইশারা করলেন। 

শিমুল নক করবেন। আর রঞ্জন মেরিলিনার নাকে টিস্যুটা চেপে ধরবেন। 

নক করা হল। একবার, দু’বার, তিনবার। দরজা খুলে গেল। সাথে সাথে রঞ্জন এনেস্থেশিয়া মাখানো টিস্যুটা দিয়ে মেরিলিনার মুখ চেপে ধরলেন 

কাজ হল না। মেরিলিনা অজ্ঞান হল না। দুই হাত দিয়ে রঞ্জনকে ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করতে গেল। দরজায় পাল্লায় বাড়ি খেয়ে শিমুল নিয়ন্ত্ৰণ হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। রঞ্জন হাল ছাড়লেন না। বাম হাতের বাইসেপ দিয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা মারতেই মেরিলিনা ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। কোন রকমে উঠে দাঁড়াতেই রঞ্জন ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে মেরিলিনাকে কষে একটা থাপ্পড় দিলেন। মেরিলিনা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আবার পড়ে গেল। তার মাথা ঠুকে গেল খাটের কোণায়। মেরিলিনা হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচে যাওয়ার আগেই রঞ্জন টিস্যুটা আবার মেরিলিনার মুখে চেপে ধরলেন। আগের চেয়েও শক্ত করে। 

মেরিলিনার শরীরটা মেঝের ওপরে এলিয়ে পড়ল। মেরিলিনা অজ্ঞান হয়ে গেলে রঞ্জন চাবিটা খুঁজতে শুরু করবেন, ঠিক তখনই ব্লু-টুথ হেডফোনে তন্ময়ের কণ্ঠ শোনা গেল। 

“খাইরুল আসছেন। আই রিপিট। খাইরুল আসছেন, কুইক।” 

চাবি খোঁজা হল না। মুহূর্তের ভেতরে শিমুল আর রঞ্জন মিলে মেরিলিনার অচেতন দেহটা নিয়ে এপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় রঞ্জন খাওয়ার টেবিলের ওপরে একটা চিরকুট ফেলে গেলেন। 

“আই রিপিট খাইরুল আসছেন।” তন্ময়ের এক ঘেয়ে গলা। 

কথা বলার সময় নেই। চেতনাহীন মানুষ ওজনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভারী হয়ে যায়। মেরিলিনার ভারি দেহটা বয়ে নিয়ে যেতে রঞ্জন আর শিমুলের তাই অনেক সময় লাগল। শুধু একটাই ভয়, এই সময়ে কেউ দরজা খুলে বেরিয়ে আসলে বিপদ। 

দ্বিতীয় তলা গেল। 

এক তলা গেল। 

গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতেই এজেন্ট বরুণ এগিয়ে এলো। মেরিলিনাকে ধরা ধরি করে সদর দরজার দিকে এগুতে থাকল তিনজন। 

“কুইক। খাইরুল আসছেন। আর কয়েক মিটার।” তন্ময়ের নিস্তরঙ্গ কণ্ঠ। 

রঞ্জন চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “গাড়ি আনো।” 

প্রায় নিঃশব্দে হায়েসটা এসে সদর দরজার সামনে থামলো। মাঝখানের দরজা খুলে গেল। মেরিলিনার দেহটা গাড়িতে একরকম ছুঁড়ে ফেলা হল। তারপর তিনজন এজেন্ট কোনমতে গাড়িতে উঠতেই নেভি-ব্লু হায়েসটা চলতে শুরু করল স্বাভাবিক গতিতে। 

মোড় ঘুরে খাইরুলের সামনে দিয়েই সোজা হারিয়ে গেল অন্ধকারে। 

খাইরুল হায়েসটাকে লক্ষ্য করলেন না। ছিনতাইকারীটাকে ধরতে পারেননি তিনি। পাশের ব্লকে অনেকগুলো গলি আছে। এত দ্রুত দৌড়াচ্ছিল শয়তানটা। পিছু ধাওয়া করতে করতেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল। একজন পুলিশ হয়ে একটা সামান্য ছিনতাইকারীকে ধরতে পারলেন না! খাইরুল নিজের ভেতরে পুড়তে লাগলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্ল্যাটের সামনে পৌছতেই লক্ষ্য করলেন ফুটপাত ফাঁকা। সেই ভদ্রলোক নেই। সাথে সাথে খাইরুল সাহেবের গা শিরশির করে উঠল। বুঝতে পারলেন গণ্ডগোলটা কোথায় হয়েছে। 

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেক বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। দ্রুত তিনতলায় এসে দেখলেন, এপার্টমেন্টের দরজা খোলা। পুরো এপার্টমেন্ট ফাঁকা। মেরিলিনা নেই। খাবার টেবিলের ওপরে শুধু একটা চিরকুট পড়ে আছে। 

“আপনার মত একটা জানোয়ারকে বিশ্বাস করা আমার ভুল হয়েছে। দয়া করে আমাকে খুঁজতে যাবেন না।” 

খাইরুল উদ্ভ্রান্তের মত নিচে নেমে এলেন। পার্কিং লট ফাঁকা। একটা বিড়াল শুধু বসে বসে পা চাটছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *