ব্যাগের পিরামিডের নিচে

ব্যাগের পিরামিডের নিচে 

একটা অটো খোঁজা খুব সহজ কাজ না। এই শহরে রেজিস্টার্ড অটোর সংখ্যা মাত্র দুইশটা। কিন্তু খাইরুল সাহেবের মনে হল রেজিস্টার্ড অটো বাদে আরও কয়টা অটো রাস্তায় চলছে তা হাতে গুনে শেষ করার মত না। 

তার থেকেও বড় কথা অটোওয়ালাকে খোঁজা। 

শহরের বড় বড় বেশ কয়েকটা অটোর গ্যারেজে খাইরুল খোঁজ করলেন। মোটামুটি সবাই বলল, তালেব মাস্টারের গ্যারেজে খোঁজ করেন। ভদ্রলোক অটো গ্যারেজ মালিক সমিতির সভাপতি। উনি একটা সমাধান দিতে পারবেন। 

অটো গ্যারেজেরও মালিক সমিতি আছে এইটা খাইরুল জানতেন না। বাস ও ট্রাক মালিক সমিতির লোকজনের সাথে যতটা ওঠা বসা, অটো মালিক সমিতির লোকদের সাথে ততটা ওঠাবসা তার নেই। থাকার কথাও না। 

তালেব মাস্টার আসলে কোন শিক্ষক না। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সে শিক্ষকতা করেনি। লোকটা ছিল বাস টারমিনাল মাস্টার। কখন কোন বাস টার্মিনাল থেকে বেরোচ্ছে, কখন ঢুকছে সেইটা দেখা ছিল তার কাজ। একটা সময়ে সে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দুটো অটো কিনে ভাড়া দেয়। সেই দুটো অটো থেকে এখন তার সাইত্রিশটা অটো। দুটো অটোর গ্যারেজ। মানুষ হিসাবে সে রহস্যময়। তাকে মাঝে মাঝে নিষিদ্ধ কিছু জায়গায় দেখা যায়। এমন কিছু কাজ করতে দেখা যায় যা কোন সুস্থ মানুষ করার আগে দুইবার ভাববে। 

তালেব মাস্টারের দুটো অটো গ্যারেজের একটা চামড়াপট্টির দিকে। আরেকটা বহরমপুর স্টেশনের পাশে। তালেব মাস্টারকে পাওয়া গেল প্রথম গ্যারেজটাতে। 

খাইরুল গ্যারেজের সামনে তার মোটর সাইকেলটা রাখলেন। বাইরের কাঠফাটা রোদ আর চামড়াপট্টির তীব্র গন্ধ পেছনে ফেলে গ্যারেজের ভেতরে ঢুকে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। 

টিনশেড আর বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা গ্যারেজ। ভেতরটা স্বাভাবিকভাবেই বেশ অন্ধকার। কোন জানালা নেই, তাই গুমোট একটা ভাব। কিন্তু বাইরের মত গরম না। বেশ ঠাণ্ডা। কিসের একটা কটকটে গন্ধ গ্যারেজের ভেতরে। গরম লোহা পানিতে ভেজালে যেমন গন্ধ হয় তেমন। গ্যারেজের মাঝখানে একটা টিন উঁচু করা আছে। সেখান থেকেই রোদ এসে গ্যারেজের মাঝখানে পড়ছে। সেই রোদ প্রতিফলিত হয়ে গ্যারেজের ভেতরটা যা একটু আলোকিত করেছে। এক পাশে দুটো অটো পার্ক করা আছে। একটা পায়ে টানা রিক্সাও দেখতে পেলেন খাইরুল। 

খাইরুল ভেতরে ঢুকতেই এক রোগামত লোক এসে জিজ্ঞাসা করল, “কাকে খুইজচ্ছেন?” 

লোকটার পরনে শ্যাওলা রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি আর চেক লুঙ্গি। ঠোঁট আর চোখ দেখলেই বোঝা যায়, নেশা করে। ঠোঁটের কোনায় থু থু আর ঘোলাটে চোখের কোনায় পিচুটি। পিচুটি মাখা সেই চোখের চাহনিতে কোন অভিব্যক্তি নেই। যেন মাছের চোখ। 

খাইরুল রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “তালেব সাহেবের সাথে একটু দেখা করব। আছেন?” 

লোকটা একবার পেছনে তাকাল। গ্যারেজে দ্বিতীয় আর কেউ আছে বলে মনে হল না খাইরুল সাহেবের। তারপরও আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “আছেন?” 

লোকটা বলল, “ইট্টু দারান। আমি দেকছি।” 

চলেই যাচ্ছিলো লোকটা। হঠাৎ খাইরুল বললেন, “দাঁড়াও। তুমি এখানে কি কর?” 

লোকটা খাইরুল সাহেবের দিকে না তাকিয়েই বলল, “কাম করি।”

“এখানে কাজ কর তো জানো না কেন যে তোমার মালিক আছে কি নেই? গ্যারেজে তুমি বাদে আর কে কে আছ?” 

এবার লোকটা অভিব্যক্তিহীন চোখে খাইরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকল। খাইরুল অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন। লোকটা কেন শুধু শুধু এমন অস্বাভাবিক আচরন করছে? নাকি তিনিই বেশি বেশি সন্দেহ করে ফেলছেন? নাকি সত্যিই কোন ঝামেলা আছে? 

খাইরুল উঁচু গলায় কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নিজেকে সামলে স্বাভাবিক গলায় বললেন, “সবাইকে এখানে দাঁড়িয়েই ডাকো। আমি তালেব সাহেবের সাথে কথা বলতে এসেছি।” 

“কে রে রনি,” গ্যারেজের পেছন থেকে খনখনে গলায় কে যেন প্রশ্ন করল। রোদের প্রতিফলিত আলোতে খাইরুল এক মাঝারী গড়নের লোককে দেখতে পেলেন। পরনে আকাশী রঙের পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা। 

“কে?” লোকটার গলায় এবার আরও একটু কৌতূহল। 

রোগা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা লোকটা পেছনে তাকিয়ে বলল, “থানাত্তে লোক এইসছে।” 

এইবার পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটা সামনে আসলেন। আলোতে আসতেই খাইরুল লোকটার মুখটা ভালো করে দেখতে পেলেন। ছোটখাট বিশেষত্বহীন চেহারা। গালে মেহেদী রাঙা কমলা রঙের চাপ দাড়ি। কড়া আতরের গন্ধ। 

লোকটা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে চশমা বের করে পাঞ্জাবী দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, “ভেতরে নিয়ে আয়। আমারে ডাকিস নাই ক্যান?” তারপর চশমা চোখে দিয়ে খাইরুলকে বলল, “আসেন ছার, ভিত্রে আসেন।” 

রনি একপাশে সরে গেল। দৃষ্টি অবনত। 

খাইরুল লোকটাকে অনুসরন করে গ্যারেজের পেছনে গেল। গ্যারেজের পেছনে একটু ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাতে অটো ধোয়ামোছা করা হয়। লোকটা খোলা জায়গার এক কোনায় একটা ত্রিপল টানানো জায়গায় নিয়ে গেল। লোকটা খাইরুলকে চেয়ার এগিয়ে দিল। কোথা থেকে একটা স্ট্যান্ড ফ্যান এনে সেট করে দিল। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস দেওয়া শুরু করল ফ্যানটা। 

তালেব নিজেও একটা চেয়ার এনে খাইরুল সাহেবের পাশে বসল। 

“বলেন ছার, আপনাক কিভাবে সাহায্য কত্তে পারি।” তালেব বলল।”গতকাল বিকালবেলা একটা মেয়ে একটা অটোতে তার ব্যাগটা ভুল করে ফেলে যায়। মেয়েটা বিদেশ থেকে এসেছে। ওই ব্যাগের ভেতরে ওর পাসপোর্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কিছু আছে। ব্যাগটা কোন অটোতে ফেলে গিয়েছে সেই অটোটাকে খুঁজছি। বেশ কয়েকটা অটো গ্যারেজে খোঁজ করলাম। পাইনি। আপনার জানামতে কি এমন কেউ আছে যে এই ব্যাগটা পেতে পারে?” 

“দেখেন। আমার এইখানে বিশটার মত অটো থাকে। যারা অটোগুলা চালায় তাদের ক’জনকেই আমি নিজে থেইকা চিনি। বাকিদের নাম জানা পোয্যন্তই। রোজ আসে, ভাড়া মাওে, রাতে টাকা জমা দিয়ে হাজিরা খাতায় নাম লিইখে বাড়ি চইল যায়। এখন কেউ যদি একটা ব্যাগ পায় আর সেটা যদি গোপন করে, তাহলে আমার কি কিছু করার আছে? তাছাড়া আমি তো সবসময় এখানে থাকিও না।” 

“তাহলে কে থাকে সবসময় গ্যারেজে?” 

“রনি থাকে। মাঝে মাঝে মইনুল থাকে।” 

“মইনুল কে?” 

“আমার ছেলে।” 

“রনিকে একটু ডাকেন। কথা বলব।” 

রনিকে ডাকতে হল না। রনি নিজেই আসল। হাতে একটা ছোট পিরিচে করে বিস্কুট আর দুই গ্লাস শরবত নিয়ে। তালেব মাস্টার একটা শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নেন স্যার। লেবুর শরবত।” 

নিতে না বললেও খাইরুল নিতেন। প্রচণ্ড গরমে তার পিপাসা পেয়েছে। তিনি তিন ঢোঁকে পুরো শরবতটা শেষ করলেন। তারপর রনির দিকে তাকালেন। রনি মাছের চোখ নিয়ে খাইরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। 

খাইরুল বললেন, “কাল কেউ কোন ব্যাগ ট্যাগ পেয়েছে বলে শুনেছ?” রনি মাথা নেড়ে জানালো, “না।” 

তালেব মাস্টার রনিকে হাত নেড়ে চলে যেতে বলল। খাইরুল সাহেবের কাছে একবার শুনলোও না যে তার আর কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে কিনা। রনি চলে গেল। খাইরুল তোষামদি পেয়ে অভ্যস্ত। যদিও এইটা তিনি চান না। তারপরেও এমন আচরণ তাকে খোঁচা দিল। 

খাইরুল বললেন, “আপনার আরও একটা গ্যারেজ আছে না?”

“জী আছে।” 

“ওখানে একটু খোঁজ করতে হবে। আপনি চলেন আমার সাথে।”

“ওখানে সালেক থাকে। আমি ফোন দিচ্ছি। আপনি কথা বলেন।”

“না, আপনি আমার সাথে চলেন।” 

তালেব মাস্টার মুখে খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “হাতে অনেক কাজ স্যার। বিকালে যাই? নাকি?” 

খাইরুল সাহেবের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। ইচ্ছা হল লোকটাকে কষে একটা থাপ্পড় দিতে। তিনি রোজ গড়ে বিশ ত্রিশটা থাপ্পড় দেন। লকআপের ওপাশে যে থাকে তার বয়স, চেহারা, টাকা পয়সা কোন কিছুই ব্যাপার না। শুধু থাপ্পড়। কিন্তু তালেব মাস্টার গরাদের ওপাশে নেই। তাই কিছু করা সম্ভব না। তিনি হ্যাঁ স্যার শুনে অভ্যস্ত। অনেকদিন পরে ‘না’ শুনে তিনি বড় একটা ধাক্কা খেলেন। 

তালেব মাস্টার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আপনারা রোজ অনেক স্যালুট পান তাই না স্যার?” 

খাইরুল কিছুই বললেন না। তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, থানায় চলেন। সেটাও বলার আগেই তালেব মাস্টার বললেন, “সবাই শুধু চেয়ারটারে স্যালুট করে ছার।” 

খাইরুল উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়াল তালেব মাস্টারও। খাইরুল বললেন, “সময় নষ্ট হচ্ছে। যাবেন, না যাওয়াব? “ 

“আরে কি জ্বালা দেখ তো। ছার দেখি গোসসা করে।” তালেব মাস্টার হাসতে হাসতে বলল, “আপনি খুব বেশি ভদ্রলোক ছার। হা হা হা। আপনাকে এই পোষাকে মানায় না। অন্য কোন পুলিশ অফিসার হলে এতক্ষণে আমাকে থাপড়াইতে থাপড়াইতে থানায় নিয়ে যাইত। সেখানে আপনি এখনও আমাকে আপনি আপনি করছেন। চলেন চলেন। হা হা হা, চলেন। আজ আপনার ব্যাগ খুঁজে তারপর ভাত খাব। তাছাড়া স্যালুট করা লোকজন দিয়ে কাজ হয় না ওসি সাহেব। ওরা নিজের কাজটাই ঠিক মত করেনা। ওদের দিয়ে আর কি কাজ হবে। নিজের কাজটা করলে ওরা আজ আপনারে স্যালুট করত?” 

করত?” হাসতে হাসতে খাইরুল সাহেবের মোটরসাইকেলে উঠল। নিজের থেকে বড় কোন মানুষকে দয়া দেখানোতে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে। 

স্টেশন গ্যারেজে গিয়ে জানা গেল জামিল নামের এক অটোওয়ালা কাল অনেক রাতে অটো জমা দিয়েছে। জামিলের খোঁজে তালেব মাস্টারকে নিয়ে বের হতেই থানা থেকে ফোন আসল। 

তারাগাছিতে একটা লাশ পাওয়া গেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *