মাকড়সার লাশ

মাকড়সার লাশ 

তারাগাছি জায়গাটা এখন গ্রাম। জনবসতি একেবারেই কম। খাঁ খাঁ করা আবাদি মাঠের মাঝখানে হঠাৎ হঠাৎ দু’তিনটে ঘর দেখা যায়। আগে তারাগাছিতে একটা পাটকল ছিল। পাটকলের জন্যই অনেক মানুষের বসতি ছিল সেখানে। তারাগাছি বাজারও ছিল আশেপাশের গ্রামের ভেতরে বেশ নামকরা। প্রতি শুক্রবারে তারাগাছির হাটও বসত। 

পাটকল বন্ধ হওয়ার পর আস্তে আস্তে জনবসতিও কমতে শুরু করল। কাজের খোঁজে লোকজন অন্য শহরে পাড়ি জমাতে শুরু করল। বাজার ঘাটও জৌলুস হারিয়ে ফেলল। শুধু পোড়োবাড়ির মত পড়ে থাকল পাটকলের কারখানাটা। 

আস্তে আস্তে তারাগাছি হয়ে গেল একটা নবজাতক শহরের কবর। 

তারাগাছিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে খাইরুল সাহেবের এক ঘণ্টারও কিছু বেশি লেগে গেল। এমনিতে গাড়িতে করে বহরমপুর থেকে তারাগাছি আসতে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। ভাঙ্গা চোরা আর খানা খন্দযুক্ত রাস্তা খাইরুল সাহেবের দেরি করিয়ে দিল। 

লাশ পাওয়া গিয়েছে একটা বিলে। পুলিশ ভ্যানটা বিলের ধারে যখন পৌঁছাল তখন গোধুলি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ আলো মুছে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। খাইরুল ভ্যান থেকে নামলেন। সাথে দুইজন হাবিলদার আর একজন ফটোগ্রাফার মল্লিক। মল্লিক বহরমপুরের স্থানীয় একটা ছোটখাট পত্রিকা “মাটির ডাক”-এর ফটো সাংবাদিক। খাইরুলের পেছনে চুইংগামের মত লেগে থাকে। আজও চুইংগামের মত লেগেই এসেছে। গ্রামগঞ্জের খুনখারাবীতে এর থেকে বেশি কিছুর দরকারও নেই তেমন একটা। শহরে লাশ টাশ পাওয়া গেলে তাও ফরেনসিক থেকে কাউকে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসা যায়। গ্রামে কে আসবে? 

পনেরো বিশজনের জটলা সরিয়ে হাবিলদার দুজন বিলের ধারে গেল। খাইরুল বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে লাশটাকে দেখতে পেলেন। বিলের পানিতে আধ ডোবা হয়ে ভাসছে। বিশ্রী গন্ধ। নাড়ি উলটে আসে। খাইরুল পকেট থেকে একটা মাস্ক বের করে পরলেন। গোধুলির আলোআঁধারিতে লাশটাকে চট করে দেখে মনে হল, কেউ এক পলিথিন আবর্জনা ফেলে গিয়েছে। লাশটাকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। 

হাবিলদার দুজন লাশটাকে ডাঙায় তুলতে পারল না। ভীষণ ভারি। আশেপাশের কেউ সাহায্য করতেও রাজি হল না। বাধ্য হয়ে দুজন মেথর ডেকে আনতে হল। আধা ঘণ্টা কেটে গেল মেথরের অপেক্ষায়। 

ডাঙায় তুলতেই বোঝা গেল লাশটাকে অদ্ভুত লাগার কারণ। খাইরুল টর্চের আলো ফেললেন লাশটার ওপরে। পুরো লাশটা একটা মোটা কাঁটাতার দিয়ে আষ্টে পৃষ্টে জড়ানো হয়েছে। লাশটা উলঙ্গ। গায়ে কাপড় ছিল নাকি উলঙ্গ করেই লাশটাকে এইভাবে ফেলা হয়েছে বুঝতে পারলেন না খাইরুল। লাশটা মনে হয় ফেলা হয়েছে দু তিনদিন আগে। কাপড়চোপড় থাকলে তো কাঁটাতারে বিধে থাকত। খাইরুল নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলেন। 

লাশটা যত ফুলেছে, কাঁটাতার তত লাশটায় দাঁত বসিয়েছে। কাঁটাতার বিধে পুরো লাশটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছে। পঁচে যাওয়া নরম মাংসে কাঁটাতারের কাঁটা খুব গভীরভাবে বসে গিয়েছে। এইভাবে কাঁটাতারে মোড়ানোর উদ্দেশ্য খাইরুল সাহেবের বুঝতে একটু সময় লাগল। ভারি কাঁটাতার দিয়ে পেঁচানোর ফলে লাশটা পচে পানিতে ভেসে উঠবে না- এটাই ছিল উদ্দেশ্য। 

খাইরুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন লাশটাকে। হাতে ক্লিনিক্যাল গ্লাভস পরে লাশটাকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। লাশের হাতের মুঠোয় কিছুই নেই। থাকার কথাও না। হাতের তালুর মাংস গলে অনেকখানি হাড় বেরিয়ে গিয়েছে। শরীরে কোথাও কোন আঘাত আছে কিনা সেটাও প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারলেন না খাইরুল। ঘন কাঁটাতারের জালে লাশের মুখটাই দেখতে পেলেন না। কাঁটাতারের চাপে মুখমন্ডলটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। তাকানো যাচ্ছে না। 

পরনে কাপড় নেই। চেহারাও চেনা যাচ্ছে না। তাই লাশটা সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। খাইরুল সাহেবের কেন জানি মনে হতে লাগল, এই লাশ কিছু একটা বলতে চায়। জমি-জমা নিয়ে এদিকে খুন-টুন হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু সেই লাশগুলো কেউ এভাবে গায়েব করে দেয় না। এই লাশ এত নিখুঁতভাবে গায়েব করার চেষ্টা করা হয়েছে, কারণ এই লাশের মুখ বন্ধ করতে চাওয়া হয়েছে। 

খাইরুল একজন হাবিলদারকে ডেকে বললেন, তার কাটার মত কিছু আছে নাকি গাড়িতে? প্লায়ার্স জাতীয়? হাবিলদার মাথা নাড়ল। গাড়িতে কোন তার কাটার যন্ত্র নেই। খাইরুল বললেন, লাশ সবার আগে কে দেখেছে তাকে ডেকে আনো। আর লাশটা গাড়িতে তোল। তোলার সময় খেয়াল রাখবা যেন লাশটার কোন ক্ষতি না হয়। রাতেই পোস্টমর্টেমের জন্য সাবমিট করব। কথা শেষ করে খাইরুল দুটো একশ টাকার নোট বের করে হাবিলদারের হাতে দিলেন। মেথর দুইজনের মজুরী। 

কে সবার আগে লাশ দেখেছে কেউ বলতে পারল না। তবে উপস্থিত অনেকে বলল ময়নার মা দেখেছে। কিন্তু ময়নার মা পুলিশের সাথে কথা বলবে না। বিকেলের দিকে বিলের ধারে কচুশাক তুলতে এসে লাশ দেখে সে নাকি অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। অগত্যা লাশ দেখে কে প্রথমে পুলিশে খবর দিয়েছিল সেইটা খোঁজ করা হল। 

সেটাও জানা গেল না। উপস্থিত সবাই এলোমেলোভাবে অনেক নাম বলল, কিন্তু কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য না। কেউ এগিয়ে এসেও বলল না যে সে থানায় খবর দিয়েছে। 

কিছু টাকার লোভ দেখালে হয়তো লাশের প্রত্যক্ষদর্শীকে বের করা যেত। কিন্তু খাইরুল সেদিকে গেলেন না। প্রত্যক্ষদর্শী এখানে অতটা গুরুত্বপুর্ণ না। শুধু সময় নষ্ট হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সুরতহালের ব্যবস্থা করতে হবে। 

লাশটাকে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিলো, তখন হঠাৎ খাইরুল সাহেবের সেলফোনে একটা ফোন আসল। অচেনা নম্বর। ল্যান্ডলাইন। 

“হ্যালো ওসি খাইরুল ইসলাম বলছি।”

“গুড ইভনিং। আমি মেরিলিনা জামান বলছিলাম।“ 

“কে মেরিলিনা?…… ও হ্যাঁ। হ্যাঁ বলেন। কি অবস্থা? এই নম্বর কোথায় পেলেন? আর এই নম্বরটা কার?”

“এটা হোটেলের রিসিপশনের নম্বর। আমি থানায় ফোন করেছিলাম। ওরা বলল আপনি বাইরে গিয়েছেন। পরে ফোন করতে বলল। তো আমি জোরাজুরি করতেই ওরা এই নম্বরটা দিল। আমার ব্যাগটা পেলেন?”

“আমি আসলে খুবই দুঃখিত বুঝেছেন। আপনার ব্যাগটা খুঁজতে খুঁজতেই একটা ঝামেলার ভেতরে পড়ে গেলাম। চিন্তা করবেন না। ব্যাগ আপনি পেয়ে যাবেন। আমি আপনার সাথে পরে যোগাযোগ করছি।” 

“আমি কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব স্যার। তারপর অ্যাম্বেসিতে যোগাযোগ করব।” 

লাইনটা কেটে গেল। এটা কি হুমকি ছিল? নাকি শুধুই একটা স্টেটমেন্ট? খাইরুল বুঝতে পারলেন না। কিন্তু খাইরুল সাহেবের মনে হল পুলিশ হিসাবে এত দুঃখিত টুঃখিত বলা তার ঠিক হয়নি। পুলিশের আরও অনেক কাজ আছে। শুধু তার ব্যাগ খোঁজার জন্য সবাই বসে আছে নাকি? 

“তাড়াতাড়ি কর নারে ভাই,” খাইরুল বিরক্তি ভরে হাবিলদার দুজনকে বললেন। 

ভর সন্ধ্যেবেলা পুলিশ ভ্যানটা চাটাইয়ে মোড়া লাশটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল বহরমপুর শহরের দিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *