নিম্নলিখিত উত্তরমালা

নিম্নলিখিত উত্তরমালা 

“পাঁচ বছর আগে একটা পাপের সাথে আমাকে জড়িয়ে ফেলা হয়। প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প। আমি এই প্রকল্পের কেউ ছিলাম না। আমাকে শুধু গিনিপিগের মত ব্যবহার করা হয়েছিল,” শংকর বললেন। বললেন কীভাবে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল গিনিপিগ হতে। কীভাবে তাকে ব্যবহার করে দেশের শীর্ষ তেরো আসামীকে জেল ভেঙে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তার মুখ বন্ধ করানোর জন্য মেজর ইকবাল তাকে হত্যা করতে গিয়েছিল। আর কীভাবে তিনি তার পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন আজীবনের জন্য। 

খাইরুল বললেন, “আপনাকে বাধ্য করা হয়েছিল মানে? বুঝলাম না। আর মেজর জেনারেল ফিরোজের নাম আমি আগে অনেক শুনেছি। কখনও দেখার সৌভাগ্য হয়নি।” 

“তাকে দেখাটা একটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি জানেন না লোকটা একটা জলজ্যান্ত পিশাচ। লোকটা আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল যে আমার আর আমার পরিবারের কিছু হবে না। কিন্তু না। জানোয়ারের বাচ্চাটা আমার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।” 

রুমের দরজা খুলে একটা ছেলে ঢুকল। দুই হাতে দুইটা মগ। মগ দুইটা খাটের পায়ার কাছে রেখে বলল, “চা।” তারপর চলে গেল। 

শংকর আবার শুরু করলেন, “বশিরের কথায় মেজর ইকবাল আমাকে গুলি করে। আমার বাম কাঁধে আর হাতে গুলি লাগে। তারপর আমার আর তেমন কিছু মনে নেই। মাঝে মাঝে ফোঁটা ফোঁটা হলুদ আলোর কথা মনে পড়ে। মাঝে মাঝে ঝাপসা আগুন জ্বলতে দেখি। কিছু ঘোলাটে মেঘের কথাও আবছা মনে পড়ে। এই ছেঁড়া ছেঁড়া জিনিসগুলো বাদে আমার আর কিছুই মনে নেই। একদিন আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমি নিজেকে একটা পাহাড়ি বাজারে আবিষ্কার করি। গায়ে একটা গাড় সবুজ চাদর, একটা ফতুয়ার মত জামা আর একটা একটা সবুজ ঢোলা পায়জামা। শরীরের কোথাও কোন গুলির আঘাত বা কোন ধরণের আঘাতের চিহ্ন নেই। বাজারের সবাই ওই চাদরটা দেখে আমাকে শ্রদ্ধা করত না ভয় পেত বুঝতাম না। কিন্তু ওটার জন্য আমি সব জায়গায় আলাদা সমাদর পেতাম। বাজারে বেশ কিছুদিন থাকার পরে আমি জেলা শহরে চলে আসি। সেখানে এসে জানতে পারি, পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও পুলিশ আমাকে খুঁজছে। আমার মাথার দাম ধরা হয়েছে দশ লক্ষ টাকা। আমাকে দেখা মাত্রই গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আর কোন উপায় নেই। এটা জেনেও মাথার ওপরে একটা মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে রাজধানীর দিকে রওনা হই।” 

শংকর সাহেব থামলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার বললেন, “জেলা শহরে এক আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার আমাকে এক লোকের ঠিকানা দেয়। ঈশ্বর বাগচী। বলে, এই লোকের কাছে গেলেই আমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব। আমি রাজধানী চলে আসি। ঈশ্বর বাগচীর সাথে দেখা করার আগে ছদ্মবেশে আমি আমার পরিবারের খোঁজ করি। আমার পরিবার বলতে আমার স্ত্রী সুলেখা আর আমার একমাত্র মেয়ে সুতপা। ওদেরকে আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। পাঁচ বছর পর ওদেরকে খুঁজে পাবো না স্বাভাবিক। কিন্তু মন মানছিল না। তারপর আমি ঈশ্বর বাগচীর সাথে দেখা করি। লোকটার ভেতরে কি যেন একটা আছে বুঝলেন খাইরুল সাহেব। নিজেকে একদম নিষ্পাপ মনে হয় লোকটার কাছে গেলে।” 

শংকর চুপ হয়ে যান। গভীরভাবে কি যেন একটু ভাবলেন। 

খাইরুল বললেন, “তারপর?” 

“তারপর ঈশ্বর আমাকে একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিয়ে বলেন অপেক্ষা করতে। তিনি আমাকে ডাকবেন। আরও বললেন, আমি যেন রেস্টুরেন্টের বাইরে বের না হই। রেস্টুরেন্টের নাম ছিল ‘ব্ল্যাক স্টার চাইনিজ রেস্টুরেন্ট’। রেস্টুরেন্টের মালিকের দেশ ছিল মায়ানমার। আমি তাকে ঈশ্বর বাগচীর কথা বলতেই তিনি আমাকে রেস্টুরেন্টের পেছনে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বাবুর্চীর কাজ জানি কিনা জিজ্ঞাসা করেন। আমি আগে রান্নাবান্নার কাজ কিছু জানি না। রেস্টুরেন্টের মালিক আমাকে বাবুর্চীদের সাথে কাজ করার জন্য বলেন। 

“আমি সারাদিন রেস্টুরেন্টের পেছনের দিকটায় থাকা শুরু করি। সারা দিন রান্নার কাজে বাবুর্চিকে সাহায্য করতাম। আর রাতে রেস্টুরেন্টের দোতলায় একটা তোষক পেতে ঘুমিয়ে পড়তাম। প্রায় রাতে এক লোক আসত রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের ছাদে বসে আমাকে শেখাতো, কীভাবে মানুষ খুন করতে হয়। কিভাবে মারলে একজন মানুষের কার্ডিও পালমোনারি সিস্টেম মুহূর্তের ভেতরে থেমে যাবে। কিভাবে মারলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এইসব আর কি। আমি আর্ট রকম ছুরি চালানো শিখে ফেলি। শংকর আপন মনেই একটু হেসে ফেললেন। সেই হাসি যেন মরিচা ধরা হাসি। যেন অনেকদিন পরে হাসলেন শংকর। বদ্ধ ঘরটাতে মরচে পড়া হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হল। 

“এভাবে কেটে গেল দুই মাস,” শংকর আবার বললেন, “ঈশ্বর বাগচীর কোন সাড়া শব্দ নেই। এরই মধ্যে বাবুর্চি কাদেরের সাথে আমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কমবয়সী ছেলে কাদের। ও আমাকে বিদেশ ফেরত একজন শ্রমিক হিসেবেই জানত। বিদেশের গল্প শুনতে চাওয়া ছাড়া আর কোন কৌতূহল ছিল না ওর। একদিন কাদের জোর করে আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। কাদেরের বাড়ি ছিল তারাগাছি। আমিও দুইমাস রেস্টুরেন্টে বন্দী থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কাদেরের সাথে ওর বাড়ি গেলাম। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। তারাগাছি মোড় থেকে বহরমপুরের বাস ছাড়ে। আমি কাদেরের বাড়ি থেকে তারাগাছি মোড় পর্যন্ত হাঁটতে থাকি। হঠাৎ একটা পুলিশের ভ্যান দেখে পাশের বিলের পানিতে নেমে পড়ি। পুলিশের ভ্যান থেকে মেজর রঞ্জনকে নামতে দেখি। মেজর রঞ্জনকে আমি আগে থেকে চিনতাম। ফিরোজের বাসায় একদিন দেখা হয়েছিল। রঞ্জন ভ্যানের পেছন থেকে একজন লোককে নামিয়ে আনে। লোকটা রঞ্জনের হাত পা ধরে মাফ চাচ্ছিল দেখে আমার সন্দেহ হয়। অন্য সময় হলে লোকটাকে বাঁচাতে আমি ছুটে যেতাম। কিন্তু সেই সময়ে আমার মাথার ওপরেই সমন ঝুলছে। আমাকে আমার পরিবারকে খুঁজতে হবে। আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমার সন্দেহ সত্যি হয়। রঞ্জন লোকটাকে পর পর তিনটা গুলি করে। তারপর লাশটা একটা কাঁটাতারের বান্ডিলে পেঁচিয়ে ফেলে দেয় পাশের বিলে। তারপর পুলিশ ভ্যানটা চলে যায়। আমি বিলের পানিতে নেমে পড়ি। লাশটাকে টেনে তোলার চেষ্টা করি। ভীষণ ভারি ছিল লাশটা। সম্পূর্ণটা তুলতে পারিনি। তাছাড়া কাঁটাতারের জন্য আমি লাশটাকে ধরতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে আমি লাশটা ওভাবেই রেখে তারাগাছি মোড় থেকে বাস ধরে বহরমপুর শহর চলে আসি। রাতের অন্ধকারে রেস্টুরেন্ট পৌছে যাই।” 

খাইরুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু শংকর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “পরদিন কাদের এসে বলে তারাগাছিতে একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। সেদিন খুব উৎকণ্ঠার সাথে কাটে আমার। আমি কাদেরকে লাশটার ব্যাপারে কোন প্রশ্নও করতে পারছিলাম না। চুপচাপ মুখ বুজে রান্না করে গেলাম। পরদিন সকালে কাদের আসলে আমি কথায় কথায় লাশটার কথা জিজ্ঞাসা করি। কাদের বলল যে বহরমপুর থানার ওসি খাইরুল ইসলাম, মানে আপনি লাশটার ব্যাপারে তদন্ত করছেন।” 

খাইরুল আবার কিছু একটা বলতে গেলেন। শংকর আবার আগের মতই খাইরুলকে থামিয়ে দিয়ে ইশারায় শুয়ে থাকতে বলে বললেন, “আমি কতবার আপনার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কতবার চেষ্টা করেছি এটা বলতে যে আমি ওই খুনিকে চিনি। কিন্তু নিজের পায়ে শিকল পরে কতদুর যাওয়া যায় বলেন? আমি পারলাম না। তার আগেই ঈশ্বর বাগচী ডেকে পাঠালেন।” 

এবার আর ধৈর্য্য ধরতে পারলেন না খাইরুল। বললেন, “আপনি জানেন তারাগাছির ওই লাশটার খুনি কে!? আপনি…… আপনিই ওই লাশটাকে টেনে পাড়ে এনেছিলেন?” 

শংকর হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “খুনিকে চিনি। ঐ যে বললাম, ফিরোজের আরেকটা পোষা কুকুর। রঞ্জন মৈত্র। আর লাশটা আমি পাড়ে আনিনি। পাড়ের কাছাকাছি আনতে পেরেছিলাম। তারপর হয়ত কোনভাবে স্থানীয়দের চোখে পড়ে তারপর ওরাই পুলিশে খবর দেয়।” 

খাইরুল নিজের কানে কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারলেন না। মনে হল তিনি স্বপ্ন দেখছেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললেন, আপনি আমাকে খুঁজছিলেন? শংকর আবার মাথা নাড়লেন। আজ তাহলে আমাকে অনুসরণ করেই কি আপনি রাইসমিলের গুদামে এসেছিলেন? 

মগের শেষ চা টুকু এক চুমুকে শেষ করে শংকর বললেন, “আজকের ঘটনাটা পর্যন্ত আসছি দাঁড়ান। আমাকে ঈশ্বর বাগচী ডেকে পাঠালেন। বললেন, একজনকে খুন করতে হবে। এই মানুষটাকে খুন করতে পারলেই আমি নতুন এক পরিচয় পাব। নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারব। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আপনার বাসার ঠিকানা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আমি আপনাকে অনুসরণ করে মতিনগরের রাইসমিলে আসি। আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত বক্সিং দেখবেন। ভিড়ের ভেতরে আপনাকে মেরে ফেলা আমার জন্য অনেক সহজ হবে। কিন্তু যখন জানলাম আপনি রিং-এ লড়বেন, আমিও সিদ্ধান্ত বদলে ফেলি। রিংয়েই আপনাকে খুন করব ঠিক করি।” 

কেমন অবলীলায় শংকর কথাগুলো বললেন। যেন সবজির বাজারে দরদাম করে সবজি কেনার গল্প বলছেন। অনুশোচনা অভিব্যক্তি নিয়ে তিনি বলতে থাকলেন, “আপনার আগের দুইজন লোক একেবারেই রিং-এ দাঁড়ানোর যোগ্য ছিল না। অপুষ্টিতে ভোগা খেটে খাওয়া মানুষ। হয়ত টাকার দরকার পড়েছে তাই রিং-এ নেমেছিল। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল, আপনি অন্য লাইনের। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বললেন, যদি তালেব আপনার আসল নাম ধরে না ডাকত, তাহলে আমিও জানতে পারতাম না আপনিই খাইরুল। যে মানুষটার কাছে আমি গত কয়েক মাস ধরে যাওয়ার চেষ্টা করছি সেই মানুষটার লাশের ওপর দিয়েই হয়ত আমি আমার নতুন পরিচয় আর আশ্রয় পেতাম। কিন্তু এখন আর সম্ভব না। ঈশ্বর বাগচীর কথা আমি রাখতে পারিনি। এখন একটা রাস্তা খোলা আছে। হয় নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করা, নয়ত পুলিশের গুলি খেয়ে মরা। আমাকে ক্ষমা করবেন খাইরুল সাহেব।” 

শংকর চুপ হয়ে গেলেন। চুপ খাইরুলও। বদ্ধ ঘরটাতে আর কোন শব্দ নেই। খাইরুল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আপনাকে বাধ্য করা হয়েছে বললেন- ব্যাপারটা বুঝলাম না।” 

কী একটা বলতে গিয়ে শংকর মেজাজ হারিয়ে ফেলছিলেন। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর বললেন, “আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছিল। জেলখানায় একটা মেয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায়। সবাই ভাবে এটা একটা আত্মহত্যা। এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হয়। সবাই বলতে থাকে, আমি থাকা সত্ত্বেও কেন একজন কয়েদী গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে? পরে জেনেছি, এইটা মেজর জেনারেল ফিরোজের কাজ। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য শুধু শুধু ওই নিরপরাধ মেয়েটাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল সে। আমাকে এই মেয়েটার খুনের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে আমাকে দিয়ে নোংরা কাজ করিয়ে নেয় জানোয়ারটা। আর তারপর…” 

শংকরের কথাগুলো শুনে খাইরুলের মাথায় বাজ পড়ল যেন। তিনি বললেন, “কি বলছেন আপনি? পাঁচ বছর আগের ঘটনা বলছেন তো?” 

শংকর নীরবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। 

“মেয়েটার নাম কি জিনাতুল তাসমিয়া জুঁই ছিল? মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?” উত্তেজনায় উঠে বসতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে আবার শুয়ে পড়লেন খাইরুল। 

শংকর বললেন, “নাম মনে নেই। কেন আপনি মেয়েটাকে চেনেন নাকি?” 

“মেয়েটা আমার বোন।” 

শংকর অবাক হয়ে খাইরুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। খাইরুলের চোখদুটো যেন অন্ধকারে জলছে। 

শংকর বললেন, “মেয়েটা আপনার বোন? আপন বোন?” 

খাইরুল চাপা কণ্ঠে উত্তর দিল, “ হ্যাঁ। আমার একমাত্র বোন।” সব ব্যথা যেন এই একটা মাত্র কথার কাছে হার মানল। 

শংকর উঠে বসলেন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মেঝের দিকে। 

উত্তেজনায় হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক, শংকর টুল ছেড়ে উঠে পড়লেন। খাইরুল তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “জুঁইকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল আপনি নিশ্চিত?” 

শংকর পায়চারী করতে করতে বললেন, “হুম। আমি আসল পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা দেখেছিলাম। পরে বশিরের কথায় সেটা বদলে ফেলা হয়।” 

কেউ তাকায়নি, কিন্তু জ্বলে যাওয়া খড়ের পুতুলের মত লাশটার দিকে খাইরুল তাকিয়েছিলেন। এই লাশ হয়ে যাওয়া মেয়েটাকেই তিনি ছোট বেলায় কোলে বসিয়ে বেণী করে দিতেন। কলেজ থেকে ফেরার পথে ওয়েফার আনতেন। মেয়েটাকে চোখের সামনে বড় হতে দেখেছেন। বিয়ের দিন মেয়েটার থেকে তিনিই কেঁদেছিলেন বেশি। কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন। খাইরুল সাহেবের ভেতরটা আজ যেন সেই কালো লাশটার মত শক্ত হয়ে গেল। মেজর জেনারেল ফিরোজকেও তিনি পুড়িয়ে মারবেন। কুকুরের মত পিটিয়ে তারপর পুড়িয়ে মারবেন।”ফিরোজের কোন ছবি আছে আপনার কাছে? শয়তানটাকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি কখনও।” দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললেন খাইরুল। 

শংকর নিজের ওয়ালেট বের করে সেখান থেকে একটা ছবি বের করে এগিয়ে দিলেন খাইরুলের দিকে; বললেন, “ছবিটা আমি ওর কবরে দেওয়ার জন্য বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।” 

খাইরুল কাঁপা হাতে ছবিটা নিলেন। মৃদু আলোতে ছবিটা দেখেই তার মনে পড়ল, এই লোককে তিনি আগে দেখেছেন। হোটেল সুকর্ণে। মেরিলিনার সাথে একই টেবিলে বসে কথা বলছিল। শুধু পার্থক্য এই যে সেদিন লোকটার মুখে দাড়ি ছিল, ছবিতে লোকটার মুখে কোন দাড়ি নেই। মনে পড়ে গেল মেরিলিনার বাবার নাম। মাথার ভেতরে যেন সবগুলো ভাঙা কাঁচের টুকরো একসাথে জোড়া লাগতে লাগতেও লাগছে না। তার মানে রঞ্জন মৈত্রই অটোওয়ালা জামিলকে খুন করেছে। তারপর সেটার পোস্টমর্টেমটা যেন না হয় সে জন্য ডাঃ শফিককে অপহরণ করেছে। তারমানে যে কালো টয়োটাটা জয়ন্তকে ধাক্কা মেরেছিল সেটা কি তাহলে রঞ্জনই ছিল? জয়ন্ত তাহলে এই চাবিটা পেল কোথা থেকে? রঞ্জনের কাছ থেকে? জয়ন্ত রঞ্জনকে কোথায় পাবে? তাছাড়া রঞ্জন যদি মেজর জেনারেল ফিরোজেরই লোক হয় তাহলে ফিরোজের আদেশেই কি সে এমনটা করেছে? জয়ন্তর সাথে কথা বলতে হবে। সকাল হলেই হাসপাতালে যেতে হবে। 

খাইরুল শংকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ডঃ বশির জামান আর মেজর ফিরোজ কি একই সাথে প্রজেক্টটা হাতে নিয়েছিলেন?” 

শংকর টুলে বসতে বসতে বললেন, “হ্যাঁ কেন?” 

“কারণ, বশিরকে খুঁজতে তার মেয়ে দেশে এসেছে।” খাইরুল ছবিটা ফেরত দিতে দিতে বললেন। 

“আপনি কিভাবে জানলেন?” 

“মেয়েটা আমার কাছে এসেছিল। ব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিল ওর। ব্যাগটা অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেয়েটাকে আমি একদিন মেজর ফিরোজের সাথে কথা বলতে দেখি।” 

“কি বলছেন আপনি! মেয়েটা ফিরোজের সাথে কথা বলছিল? তারপর?”

“তারপর মেয়েটাকে আমি আমার কাছে এনে রেখেছিলাম। ভয় হচ্ছিলো যে কেউ ওর কোন ক্ষতি টাত করে ফেলবে। কিন্তু ……. কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ পরশুদিনের আগের দিন আমাকে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। আমাকে কিছু জানিয়েও যায়নি। শুধু একটা চাবি……” চাবির কথা মনে হতেই খাইরুল 

পকেটে হাত দিলেন। একটা শীতল ধাতব স্পর্শ পেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। চাবিটা আছে। 

“কিসের চাবি?” 

“মেয়েটার একটা চাবি আমার কাছে ফেলে গিয়েছে। ফেলে গিয়েছে না রেখে গিয়েছে বুঝতে পারছি না। বলছিল যে এটাই তার বাবার শেষ স্মৃতি।” 

“আপনি কি বলছেন কিছু বুঝতে পারছি না খাইরুল। বুঝিয়ে বলেন।”

খাইরুল একটু বিরক্তি নিয়ে সবটা বুঝিয়ে বললেন। বললেন কিভাবে তিনি চাবিটা পেয়েছেন। 

শংকর বললেন, “মেয়েটা তার বাবার শেষ স্মৃতি ফেলে কেন চলে যাবে খাইরুল সাহেব?” 

খাইরুল বোকার মত শংকরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তাই তো! এটা তো ভাবেনি খাইরুল। 

শংকর বললেন, “আমার মনে হয়, মেয়েটাকে অপহরণ করা হয়েছে খাইরুল সাহেব। এখন বুঝতে পারছি না কেন। কিন্তু এটুকু বলতে পারি মেয়েটা বিপদের মধ্যে আছে। ফিরোজ যেদিকে তাকায় সেদিকে আগুন জ্বলে। ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে খাইরুল সাহেব। না হলে ডঃ বশিরের মত একজন মানুষকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।” 

খাইরুল মাথা নেড়ে শংকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কটা বাজে?”

“পাঁচটা সতেরো।” 

খাইরুল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন দেখে শংকর এগিয়ে এলেন। খাইরুলের মুখ থেকে একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, “আপনাকে নিরপরাধ প্রমাণ করার দায়িত্ব আমার শংকর সাহেব। যদি আপনার পরিবার বেঁচে থাকে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আপনার কাছে পৌঁছে দেব।” 

শংকর বললেন, “আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব। এই মুহূর্তে ফিরোজকে খুঁজে বের করতে হবে। ফিরোজের কপালে বুলেট গেঁথে তারপর বশিরকে কুকুর দিয়ে খাওয়াব।” খাইরুলকে নিয়ে শংকর বদ্ধ ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেলেন। খাইরুল শংকরের কাঁধে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল। এখনও আলো ফোটেনি। অন্ধকার গ্যারেজে সারি সারি অটো। 

দুজনকে বেরিয়ে আসতে দেখে তালেব অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। খাইরুলের আরেকটা হাত কাঁধে তুলে নিতে নিতে বললেন, “আরে আরে ছার, করেন কি! মাথা নষ্ট হইছে? এই শরীর নিয়ে হাটে কেউ? বললামই তো সকাল হইলেই আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।” 

খাইরুল গোঙাতে গোঙাতে বললেন, “সময় নেই তালেব। সময় নেই। আপনি যা করলেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমাকে একটু আমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসেন। শংকর আপনিও চলেন। আজ থেকে আমার বাসায় থাকবেন।”

তাহেরের গাড়ি আছে জানতেন না খাইরুল। একটা বহু পুরনো মডেলের করোলা। খাইরুল আর শংকর পেছনের সিটে বসলেন। সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে এসে বসল রনি। এতদিনে রনির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন খাইরুল। তালেব গাড়ি স্টার্ট দিল। করোলাটা বেরিয়ে গেল অটো গ্যারেজ থেকে। 

তাহেরের গাড়িটা যখন বহরমপুরে ঢুকল, তখনও আকাশে একটু আঠালো অন্ধকার লেগে আছে। শহরের রাস্তাগুলো গভীর ঘুমে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলছে। মসজিদে ফজরের আজান হল। হেমন্তের ভোরের নরম বাতাস খাইরুলের চোখে মুখে একটা সান্ত্বনা বুলিয়ে গেল। মেরিলিনা অপহরণ হলে হয়েছে, তার থেকে বড় কথা, মেয়েটা তাকে ছেড়ে তো চলে যায়নি। মেরিলিনা যেখানেই থাকুক, তাকে খাইরুল বাঁচাবেন। মেয়েটাকে নিয়ে একদিন ভোর হওয়া দেখতে হবে। হেমন্তের ভোর। পকেটে হাত দিয়ে মেরিলিনার চাবিটা বের করলেন তিনি।”আমার মনে হয় চাবিটা আমাকে বাবা পর্যন্ত নিয়ে যাবে”- মেরিলিনার কথাটা মনে পড়ে গেল খাইরুল সাহেবের। খাইরুল ধাতব পাতে লেখা ঠিকানাটা পড়লেন। মনে মনে ঠিক করলেন, এই ঠিকানায় যাবেন তিনি। একাই যাবেন। 

খাইরুল জানতেন না, তিনি হাতের ভেতরে নরকের চাবি ধরে আছেন। ল্যাম্পপোস্টগুলো তখনও নেভেনি। সেই ল্যাম্পোস্টের আলোতেই খাইরুল দেখলেন, শহরের ফুটপাথ ঘেঁষা প্রাচীরগুলোতে বড় বড় করে লেখা, 

“প্রায়শ্চিত্ত করতে পাপের কারণ বিনাশ কর।” 

খাইরুল আর শংকর তখনও জানেন না, সমীকরণটা এখন ফিরোজ আর বশিরের ভেতরে আটকে নেই। অনেকগুলো অজানা চলক ঢুকে পড়েছে সমীকরণের ভেতরে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *