কংসচক্র

কংসচক্র 

শেষ বিকালের সোনালী রোদে দেবতাদের শহর বেনারসকে সোনার শহর ‘এল ডোরাডো’ বলে মনে হচ্ছে। গঙ্গার পাড়ের মাথা উঁচু করে থাকা মন্দিরগুলো মনে হচ্ছে সোনার মন্দির। সেই সোনালী মন্দিরগুলোর চূঁড়াতে কবুতরদের ঝাঁক বসে আছে। গঙ্গায় ছায়া ফেলেছে মন্দিরগুলোর অবয়ব। 

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে হরে কৃষ্ণা হরে হরে। 

গেরুয়া রঙের মিছিলের স্রোতটার একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল। মিছিলে যাদেরকে দেখা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই স্থানীয় সাধু সন্ন্যাসী। বেশিরভাগেরই পরণে গেরুয়া রঙের একহারা সেলাইহীন কাপড়। কিছু সাধারণ মানুষজনও দেখা যাচ্ছে মিছিলে। কয়েকজন বিদেশীকেও দেখতে পেলেন জেনারেল। গোলাপী আর গেরুয়া রঙের পতাকা উড়ছে মিছিলের এখানে ওখানে। পতাকায় পদ্মফুলের চিহ্ন। দেবতা বিষ্ণুর প্রতীক। প্রতিরক্ষার প্রতীক। 

মাদকতায় ভরা ধূপের গন্ধ আর ঢোল করতালের শব্দ পেছনে ফেলে মিছিলটা বিশ্বনাথের মন্দিরের দিকে চলে গেল। মিছিলের পেছনে পেছনে আরও অনেক সাধু সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন জেনারেল। এলোমেলোভাবে সবাই গঙ্গার দিকে যাচ্ছে। সামনেই প্রেমাচাঁদ ঘাট। কবি মুনশী প্রেম চাঁদের নামে নামকরণ করা এই ঘাট। 

কিন্তু জেনারেলকে দশাশ্বমেধ ঘাটে যেতে হবে। 

মনে মনে সব হিসাব কষে এসেছেন তিনি। প্রথমে আশফাক চৌধুরীকে সরিয়ে দেবেন তিনি। তারপর তফিসুল বারীকে। দেশে নেতৃত্বহীনতার সৃষ্টি হবে। এই সুযোগে তিনি একটা অভ্যুত্থান ডেকে ক্ষমতা নিয়ে নেবেন। আশফাককে মাথায় হাত বুলিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে হবে যতদিন পর্যন্ত না বশির ধরা পড়ছে। বশির ধরা পড়লেই আশফাক আর তফিসুল বারীকে তিনি সরিয়ে দিয়ে জনগণের কাছে বলবেন, এই দুইজন মিলে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের নামে মানুষের ওপরে ভয়ানক গবেষণা করছিল। আর ফিরোজ? তফিসুল বারী আর আশফাককে সরিয়ে দেওয়ার পরে ওকে সরানো কোন ব্যাপারই না। 

জেনারেল উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলেন। সরু রাস্তার দুপাশ দিয়ে বিভিন্ন দেব দেবতার মূর্তির দোকান। মিষ্টির দোকান। ছোট ছোট হোটেলও দেখতে পেলেন জেনারেল। এখানে মাংস পাওয়া যায় না। সব পদই নিরামিষ। বাতাসে হাজারটা জিনিসের গন্ধ। চাটনির গন্ধ, মসলার গন্ধ, ধুপের গন্ধ-আরও অনেক গন্ধ যা জেনারেল চিনতে পারলেন না। 

সাধু আর ভিখারীরা এখানে দলে দলে ভিক্ষা করছে। প্রত্যেকের হাতেই আছে গাড়ু, গোটানো কম্বল, ত্রিশুল। সবার কাঁধেই ছোটখাট ঝোলা আছে। অনেকের কাঁধে আবার বানর বসে থাকতে দেখলেন জেনারেল। এরা দেবতা হনুমানজীর ভক্ত। এই দলগুলোর একজনকে দিলে সবাইকেই দিতে হবে। জেনারেল দলগুলোর দিকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছেন। কিন্তু তিনি যা খুঁজছেন তা এখনও পাননি। 

একজন অঘোরী। যার হাতে থাকবে একটা ত্রিশুল। আর ত্রিশুলে বাঁধা থাকবে গাঢ় বেগুনী রঙের এক টুকরো কাপড় 

অঘোরীরা অনেক প্রাচীন একটা ভ্রাতৃসদ্ধ। পুরো ভারতবর্ষে এদেরকে রহস্যময় সন্ন্যাসী হিসাবে মানা হয়। এরা শিব আর শক্তির পূজা করে। এদের বিশ্বাস মতে, এই পৃথিবীতে যা কিছু হয় তা শিবের ইচ্ছা অনুযায়ীই হয়। অঘোরীরা গৃহত্যাগী। এরা একবার ঘর ছেড়ে চলে আসলে আর কখনও ঘরে ফিরে যায় না। যেহেতু শিব ছাই মাখে (এই জন্য শিবের আরেক নাম বিভূতিভূষণ), সেহেতু শিবের ভক্ত হিসাবে অঘোরীরাও সারা গায়ে ছাই মাখে। অঘোরীদেরকে নিয়ে অনেক উপকথা চালু আছে। যার বেশিরভাগেরই বাস্তবিক ভিত্তি নেই বলে জানা যায়। এরা নাকি মানুষের মাংস খায়। এরা অমর। এদের সব থেকে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হচ্ছে ‘মৃত্যু অভিশাপ’। এরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে আরেকজনের জীবন নিয়ে নিতে পারে শুধু মাত্র একটা মন্ত্র পাঠ করে। 

অঘোরীরা বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করে। কারণ, সাধারণ মানুষজন এদেরকে খুব একটা ঘাঁটায় না। সাধারণ সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও এদেরকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। 

ভিড় ঠেলে জেনারেল দশাশ্ববেধ ঘাটের প্রবেশ পথটা খুঁজতে লাগলেন। এই ঘাটেই অঘোরীটাকে পাওয়ার কথা। বিকালের রোদ কমে আসছে আস্তে আস্তে। মন্দিরগুলোতে সান্ধ্যকালীন পূজা অর্চনা শুরু হয়েছে। স্তব গান শোনা যাচ্ছে। 

জেনারেল ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন। একটা অন্যরকম গান কানে আসল তার। এই গান মন্দিরের গানগুলো থেকে আলাদা। কেউ যেন খুব অদ্ভুত সুরে গুন গুন করছে। তিনি সুরের উৎস খুঁজতে লাগলেন। 

ঘাটে অনেক ভিড়। অনেকে পবিত্র গঙ্গায় ডুব দিয়ে সুর্যকে প্রণাম করছে। এখানে ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলা সূর্যকে প্রণাম করা একটা পবিত্র রীতি। জেনারেল সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে এদিকে ওদিকে লক্ষ্য করলেন। সুরটা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোথা থেকে সুরটা আসছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছে সুরটা ডান দিক থেকে আসছে। আবার মনে হচ্ছে সুরটা বাম দিক থেকে আসছে। একবার মনে হচ্ছে গঙ্গার পানির নিচ থেকে আসছে। যেন সুরের উৎসটা স্থির না। তিনি সুরটাকে অনুসরণ করতে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে গেলেন যে তিনি একটু আগে একজন অঘোরীকে খুঁজছিলেন। 

সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে এসে জেনারেল সুরের উৎসটা খুঁজে পেলেন। ঘাটের সিঁড়িগুলোর রেলিং-এর পাশে, যেখানে গঙ্গার পানি এসে ছলাত ছলাত করে আছড়ে পড়ছে, সেখানেই একজন অঘোরী পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করে গুন গুন করছে। জেনারেলের দেখে মনে হল অঘোরীটা যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। 

অঘোরীটার পাশেই একটা ত্রিশুল পড়ে আছে। আর সেই ত্রিশুলে জড়ানো আছে একটুকরো বেগুনী রঙের কাপড়। 

জেনারেল চমকে উঠলেন। এই সেই অঘোরী! তিনি অঘোরীটাকে ডাকতে গেলেন। কিন্তু কী বলে ডাকবেন তিনি? লোকটার কাছেই যেতে হবে। জেনারেল কাছে যাওয়ার কোন রাস্তা দেখতে পেলেন না। উঁচু রেলিং পার হয়ে নিচে লাফ মারাটা বেশ বিপজ্জনক হবে। গঙ্গায় ডুব দিয়ে এক লোক উঠে আসছিলেন, তাকেই জেনারেল প্রশ্ন করলেন, “আমি একটু নিচে নামব। রেলিং-এর ওইপারে যাব আরকি। কিভাবে যাব?” 

লোকটা পৈতা ঠিক করতে করতে বলল, “নিচে নামবেন কেন? আপনাকে তো সেরকম লোক মনে হচ্ছে না!” 

জেনারেল বুঝতে পারলেন না লোকটা কি বলতে চাচ্ছে। তিনি বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না আপনি ঠিক কি বলছেন। আমি নিচে নামব। কিভাবে নামব সেটা বললে উপকার হত।” 

লোকটা বলল, “এই রেলিং-এর ওপারে শুধু অঘোরীরা নামে দাদা। আপনি ওপারে নামবেন না। জীবিত মানুষের যেতে নেই ওপারে।” 

লোকটা দুই হাত জোড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে চলে গেল। 

সূর্যের শেষ আলোটুকু নিচে নেমে যাচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। জেনারেল হাল ছাড়লেন না। ওই অঘোরীটাই তাকে তার কাঙ্খিত জায়গায় নিতে যেতে পারবে। যেভাবেই হোক, তাকে ওই অঘোরীটার কাছে যেতেই হবে। জেনারেল রেলিং-এর ওপর দিয়ে নিচে উঁকি ঝুঁকি মারছিলেন। হঠাৎ একদল অঘোরীকে দেখতে পেলেন তিনি। তারা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। ওদেরকে অনুসরণ করলেন তিনি। ওরা হয়ত বলতে পারবে। 

চারজনের দলটা খুব দ্রুত হাঁটছিল। অদ্ভুতভাবে প্রত্যেকে একই তালে পা ফেলছে। অনেকটা সামরিক কুচকাওয়াজের মত। জেনারেল অনেক দ্রুত হেঁটেও দলটার কাছাকাছিও যেতে পারলেন না। দলটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘাটের পাশের রাস্তা ধরল। তারপর একটা বিরাট বটগাছের পেছনে হারিয়ে গেল। 

জেনারেল দলটাকে হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু তার যেটা দরকার ছিল তিনি সেটা পেয়ে গিয়েছেন। একটা সরু সিঁড়ি ঢালু হয়ে সোজা নেমে গিয়েছে গঙ্গায়। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে জেনারেল সেই ধ্যানরত অঘোরীটাকে দেখতে পেলেন। জেনারেল সরু সিঁড়িটা ধরে নিচে নামতে লাগলেন। 

অঘোরীটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল। এদিকে স্বাভাবিকভাবেই ভিড় কম। আর বেশ অন্ধকার। মন্দিরগুলোর আলো এদিকে আসছে না। পাশেই উঁচু রেলিং ঘেরা সিঁড়ি। যেখানে জেনারেল একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জেনারেল অঘোরীটার পেছনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গলা খাঁকারি দিলেন। অঘোরীটার গুন গুন করা থেমে গেল। কিন্তু কিছুই বলল না। পদ্মাসনেই বসে থাকল মূর্তির মত। 

“আমি কংসচক্রের খোঁজে এসেছি।” জেনারেল বললেন। 

অঘোরীটা উঠে দাঁড়াল। হাড় জিরজিরে শরীর। পাজরের হাড়গুলো এই মৃদু অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে। মাথা ভর্তি জট আর দাড়িগোঁফে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। পরনে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়া ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সারা শরীরে ছাই মাখা বলে অন্ধকারে অঘোরীটাকে ধূসর বলে মনে হচ্ছে। 

অঘোরীটা জেনারেলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। জেনারেল এই অন্ধকারেও জ্বলজ্বলে চোখজোড়া দেখতে পেলেন। তারপর বললেন, “আমি খুব জরুরী কাজে কংসচক্রের সাথে দেখা করতে চাই।” অঘোরীটা কিছুই বলল না। শুধু বেগুনী ন্যাকড়া বাঁধা ত্রিশুলটা তুলে গঙ্গার ধার দিয়ে হাঁটা শুরু করল। 

জেনারেল বুঝতে পারলেন, অঘোরীটা তাকে অনুসরণ করতে বলছে। তিনি অনুসরণ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ কিছুই বললেন না জেনারেল। ধীরে ধীরে বাঁধানো ঘাট শেষ হয়ে গেল। পায়ের নিচে দেখা গেল নরম মাটি। মন্দিরের আলো কমে আসল। কমে আসল জনসমাগম। অনেক উঁচুতে তাকালে দূরের আলোকিত মন্দিরগুলো চোখে পড়ে। 

অঘোরীটা একটা জায়গায় এসে থেমে গেল। তারপর পানির ভেতরে যাওয়া শুরু করল। জেনারেল হকচকিয়ে গেলেন। পানির ভেতরে কেন! তার পক্ষে তো পানির ভেতরে নামা সম্ভব না। অঘোরীটা কিছু না বলে হাঁটু পানি থেকে বুক পানিতে নামতে শুরু করল। জেনারেল অঘোরীটাকে ডাকলেন, “এই। এই যে।” 

অঘোরীটা শুনেও যেন শুনল না। গলা পানিতে নেমে থামলো। তারপর ডুব দিল। 

জেনারেল কিছুই বুঝতে পারলেন না কি হচ্ছে। বেনারসের গলিতে গলিতে রহস্য। এমন কিছু রহস্য আছে যে রহস্যে কেউ জড়িয়ে যেতে চায় না। অঘোরীরা তেমনই একটা রহস্য। জেনারেল সেই রহস্যেই আস্তে আস্তে জড়িয়ে যাচ্ছেন না তো? তিনি বাম হাত দিয়ে তার নাইন এম এমটা একবার স্পর্শ করলেন। জ্যাকেটের নিচে নাইন এম এম এর হাতলটা যেন জেনারেলকে আশ্বাস দিল, আমি আছি। কিছু হবে না। 

হঠাৎ অঘোরীটা ভেসে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে ডাঙার দিকে আসতে লাগল। জেনারেলের ভ্রু কুঁচকে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তিনি দেখলেন, অঘোরীটা একটা মোটা শেকল টানতে টানতে ডাঙ্গায় উঠে আসল। শেকলের সাথে সাথে উঠে আসল একটা মাঝারী সাইজের ডিঙ্গি নৌকা! 

জেনারেল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। অঘোরীর কালো ছায়া মূর্তিটা নৌকাতে উঠতে ইশারা করল। জেনারেল কোন বাক্য ব্যয় না করে ভেজা নৌকাটায় উঠে পড়লেন। অঘোরীটা ঠেলে নৌকাটাকে পানিতে নিয়ে গেল। তারপর নিজেও লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে পড়ল। নৌকাটা কল কল শব্দ করে পানি কেটে সামনে এগোতে শুরু করল। 

জেনারেল বললেন, “কোথায় যাচ্ছি?” অঘোরীটা যথারীতি কিছুই বলল না। সেই ন্যাকড়া পেঁচানো ত্রিশুলটা দিয়ে দাঁড় বাইতে লাগল। দশাশ্বমেধ ঘাট, আলোকিত মন্দির, মানুষের কোলাহল আস্তে আস্তে দৃষ্টিসীমা থেকে সরে যেতে শুরু করল। আর যতই সরে যেতে শুরু করল, ততই একটা অদ্ভুত ভয় জেনারেলের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করল। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সাঁতরে পেরোনোর মত কূলও এখন আর চোখে পড়ছে না তার। চারপাশে শুধু জমাট অন্ধকার আর পানির ছলাত ছলাত শব্দ। একটু পরপর হু হু করে বাতাস দিচ্ছে। 

জেনারেলের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ। অঘোরীটা কিছু করতে আসলেই বিদ্যুতগতিতে তিনি রিভলভার চালাবেন। এই মাঝ নদীতে কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। অ্যাম্বাসীতেও জবাবদিহি করতে হবে না। জেনারেল কিছুটা নির্ভার বোধ করলেন। 

ধীরে ধীরে নৌকাটার গতি যেন বেশ বেড়ে গেল। তর তর করে নৌকাটা এগিয়ে যাচ্ছে। কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না জেনারেল। অন্ধকারে অঘোরীটাকে দেখতে পারছেন না তিনি। শুধু তার হাড় জিরজিরে দেহাবয়বটাই বোঝা যাচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে একটা কঙ্কাল ত্রিশুল দিয়ে নৌকা বাইছে। 

হঠাৎ অন্ধকারে কিসের যেন একটা গন্ধ নাকে এলো। কিছু একটা পুড়ছে। খুব বিশ্রী আর বিকট গন্ধ। সময়ের সাথে সাথে গন্ধটাও আরও প্রকট হতে শুরু করল। 

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যাওয়ার পরে ডানদিকে অনেক জোনাকী দেখতে পেলেন জেনারেল। এত জোনাকী তিনি আগে কখনও দেখেননি। ঝিঁ ঝিঁর ডাকও শুনতে পেলেন। আস্তে আস্তে নৌকাটা একটা উঁচু টিলার ধার দিয়ে যেতে শুরু করল। পোড়া গন্ধটাও আরও তীব্র হল। তারপর একটা জায়গায় গিয়ে থেমে গেল। মৃদু একটা ধাক্কা লাগল নৌকাটাতে। অঘোরীটা জেনারেলকেসহই নৌকাটা টেনে ডাঙায় আনল। জেনারেল অবাক হলেন। এই হাড় জিরজিরে শরীরে এত শক্তি তিনি আশা করেননি। 

অঘোরীটা জেনারেলকে নামতে ইশারা করল। জেনারেল নামলেন। পায়ের নিচে গুড়িগুড়ি বেলে পাথর। মড় মড় করে শব্দ হল। আশেপাশে কোন পাহাড় আছে। সেখান থেকে কোন ঝর্ণা আছে। কুল কুল করে শব্দ শোনা যাচ্ছে। বেলে পাথরগুলোও তার আরেকটা প্রমাণ। 

দুরে একটা হলুদ বিন্দু দেখতে পেলেন তিনি। অঘোরীটা আস্তে আস্তে সেই বিন্দুটার দিকে যেতে থাকল। তিনিও অঘোরীটাকে অনুসরণ করলেন। যতই এগোতে লাগলেন, ততই পোড়া গন্ধটা আরও বিকট হল। কিছুদুর যাওয়ার পরেই বুঝলেন, ওটা একটা ছোটখাট অগ্নিকুণ্ড। 

জেনারেলের বুঝতে বাকি থাকল না, এটা একটা শ্মশান। অঘোরীটা তাকে একটা শ্মশানে নিয়ে এসেছে। এই অগ্নিকুণ্ডটা মড়া পোড়ানোর অগ্নিকুণ্ড। তাই এমন উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে। তিনি নাকে রুমাল চাপা দিলেন। 

হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন, অঘোরী নেই। আশেপাশে শুধু অন্ধকার। তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি এই অগ্নিকুণ্ডটার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। গন্ধটা এত বেশি তীব্র হয়ে গেল যে জেনারেল আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না, কাশতে শুরু করলেন। পচা পোড়া গন্ধটা যেন নাক মুখ দিয়ে তার ভেতরে ঢুকে যেতে শুরু করল। পেট মোচড় দিয়ে তিনি বমি করতে শুরু করলেন। 

কে যেন কাঠের তৈরি একটা মগ বাড়িয়ে ধরল জেনারেলের দিকে। জেনারেল বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে মগটা হাত বাড়িয়ে নিলেন। তারপর ঢকঢক করে পুরো মগটা শেষ করলেন। মুখ তুলেই দেখলেন একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। অঘোরীদের মতই সারা গায়ে ছাই মাখা। মাথায় জট। মুখমন্ডলটা যেন সরীসৃপের মত ফ্যাকাশে। 

জেনারেল কাশতে কাশতে উঠে দাঁড়ালেন। লোকটার চোখ জোড়া দেখার চেষ্টা করলেন। ঘোলাটে চোখ। সেই চোখে অগ্নিকুণ্ডের কোন প্রতিফলন নেই। তিনি যেন একটা সরীসৃপের সামনে বসে আছেন। 

লোকটা হিস হিস করে বলল, “জেনারেল! কেমন আছেন?” জেনারেল বললেন, “তুমি আমাকে চেন?” 

“চিনব না মানে? দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া এসেছি আজ দশ বছর। তাই বলে আপনাকে ভুলে যাব?” 

জেনারেল উঠে দাঁড়ালেন। অগ্নিকুণ্ডটা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসছে। জেনারেলের মাথাটা ভারি ভারি মনে হল। তিনি বেলে পাথরের ওপরে বসে পড়লেন। 

“হঠাৎ আমাদের মত ফেরারী পলাতক কংসচক্রের কাছে কি দরকার পড়ল আপনার?” 

“তুমি কে?” জেনারেল বললেন। 

“আমি ‘কংস’। কংসচক্রের প্রধান হিসাবে এখন এই নামেই আমাকে সবাই চেনে। কংসচক্রের প্রধান হওয়ার পরে আমরা আমাদের পূর্বের নাম ত্যাগ করি।” 

“আসল নাম কি?” 

“আসল নাম জানতে চাইবেন না। বললাম না, কংসচক্রের প্রধান হওয়ার পরে আমরা কংস নামটাই ধারণ করি। আমিই কংসচক্রের প্রধান, কংস।” 

জেনারেলের মাথাটা আরও ভারী মনে হল। যেন মাথার ভেতরটা ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। 

“তো জেনারেল, বলেন। কি এমন কারণ যা আপনাকে দেশ থেকে ভারতে এনে দাঁড় করালো।” 

“তোমাদের সাহায্য লাগবে আমার।”

“কি সাহায্য?” 

“প্রধানমন্ত্রী তফিসুল বারী আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আশফাক চৌধুরীকে সরিয়ে দিতে হবে। আমি যখন বলব, তখনই এই কাজটা করতে হবে। যেভাবে বলব সেভাবেই করতে হবে।” 

নীরবতা নেমে এলো পুরো শ্মশানে। শুধু কট কট করে কাঠ পোড়ার শব্দ। অগ্নিকুণ্ডের আলোতে জেনারেল কংসের মুখে মুচকি হাসি দেখতে পেলেন। সে বলল, “আপনি প্রধানমন্ত্রীকে খুন করার জন্য আমাদের কাছে এসেছেন জেনারেল! হা হা হা হা,” কংস হা হা করে হাসতে লাগল। তার হাসি পাশের টিলাটায় ধাক্কা খেয়ে শ্মশানে প্রতিধ্বনিত হল। 

মেজর জেনারেল দুই হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বললেন, “আমি ইয়ার্কি মারতে আসিনি। তোমাদের কি মনে হয়? এটা ইয়ার্কি? তোমাদের আতঙ্কে দেশের মানুষ ঘরেও শান্তি পেত না। তোমরা কি করনি দেশে? খুন করেছ। মাদক পাচার করেছ। বিদেশ পাঠানোর নাম করে মানুষের কিডনী চুরি করেছ। সেই কিডনীবিহীন মানুষগুলোর লাশ পাওয়া যেত কালেশ্বরী নদীর পাড়ে। তোমাদের কি মনে হয় তোমাদের মতো নোংরা কীটদের সাথে আমি তামাশা করতে এসেছি?” 

“নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে না আমরা কি করতাম জেনারেল। এখনও দেশের সীমান্তে যত মাদক পাচার হয় তার নব্বইভাগ আমরা করি। যত মানব পাচার হয় আমরাই তো করি। আমরা জানি আমরা কি করছি আর কি না করছি।” 

“তোমরা জানো কায়জুদ্দিনের কি হয়েছিল?” 

এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে কংসের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। কায়জুদ্দিনের আসল নাম কারও জানার কথা না। কংসচক্রের প্রধান হিসাবে তাকে সবাই ‘কংস’ নামেই জানত। কংস জেনারেলের মুখের দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল। জেনারেল সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললেন, “কায়জুদ্দিনের মৃত্যুটা সাজানো ছিল। কায়জুদ্দিন বেঁচে ছিল বেশ কয়েক বছর। তফিসুল বারী কায়জুদ্দিনকে দিয়ে এমন অনেক কাজ করিয়েছেন যাতে করে তার রাজনৈতিক জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আশা করি বুঝতে পারছ আমি কি বলছি। ছাই ফেলতে তফিসুল বারী ভাঙা কুলোই ব্যবহার করেছেন।” 

কংস আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকল। জেনারেলের কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য এই নিয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। 

হঠাৎ জেনারেল অনুভব করলেন যে তার চোখ জ্বলছে। মাথার সামনের অংশটা যেন ব্যথায় ফেটে যাবে। তিনি দুই হাত দিয়ে মাথার সামনেটা চেপে ধরলেন। 

কংস কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, “আমরা কাজটা করব। আমাদেরকে শুধু দেশে ফেরার সুযোগ করে দিতে হবে।” 

জেনারেল ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন ‘কংসচক্রের অতীত’। এই অভিশপ্ত চক্রটাকে দেশে প্রবেশ করতে দেওয়ার মানে আত্মহত্যা করা। খুব কষ্টে এদেরকে দেশ থেকে বের করা সম্ভব হয়েছে। কায়জুদ্দিন পুলিশের হাতে নিহত হয়। লাশটা জনসমক্ষে দেখানো হয়নি কোথাও। তার সেই মৃত্যুর পরেই হঠাৎ করে কংসচক্র যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। অদৃশ্য হয়ে যায় তাদের অত্যাচার। দিনে দুপুরে পাওয়া বীভৎস লাশের সংখ্যা কমতে থাকে। হাসপাতালে নবজাতক শিশু চুরিও কমে যেতে থাকে। তাদের এই অন্তর্ধানের পেছনে তাদের চক্রের একটা ডায়েরির হাত আছে বলে ধারণা করা হয়। যেটা কায়জুদ্দিনের মৃত্যুর পর পরই হারিয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন এই রহস্যময় ডায়েরি নিয়ে মিডিয়াতে খুব তোলপাড় হয়। কেউই অবশ্য সঠিকভাবে বলতে পারে না যে ওই ডায়েরিটার সাথে কংসচক্রের কি সম্পর্ক। কিই-বা আছে সেই ডায়েরিতে। কয়েকদিন পরেই মিডিয়া ফ্রেঞ্জি বলে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয় সবাই। এত কিছুর পরে এই অভিশপ্ত চক্রটাকে দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। 

কিন্তু জেনারেল এসব কথা ভুলে গেলেন। 

তার চোখজোড়া লাল হয়ে পানি পড়তে শুরু করল। তিনি গোঙাতে শুরু করলেন। বুঝতে পারলেন, একটু আগে তাকে যে পানিটা খেতে দেওয়া হয়েছিল, সেটা পানি না। অন্য কিছু। কংস বলল, “যদি আপনি আমাদেরকে দেশে ফেরার সুযোগ করে দেন, তাহলেই একমাত্র আমরা তফিসুল বারীকে আপনার হয়ে সরিয়ে দেব। তাছাড়া আমাদের চক্রের ডায়েরিটা খুঁজে বের করতে হবে। কায়জুদ্দিনের মৃত্যুর প্রতিশোধ আমরা নিতে চেয়েছি বহু আগে থেকে। কিন্তু কার ওপরে নেব, সেটাই এতদিনে বুঝতে পারিনি। আজ বুঝলাম। আর এখানেও বেশিদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারব না আমরা। খুব শীঘ্রই আবার আমাদেরকে কাজের ধান্দায় আত্মপ্রকাশ করতেই হবে। এই শ্মশানে থাকি কারণ এদিকে পুলিশের ঝামেলা কম। অঘোরীদেরকে দলে টেনেছি। হয়ত আস্তে আস্তে পুলিশগুলোকেও দলে টেনে ফেলব। কিন্তু যতদিন না ডায়েরিটা পাচ্ছি, ততদিন আমরা পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসতে পারব না।” 

জেনারেলের কাছে কথাগুলো অর্থহীন প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন তিনি। দুই হাতে মাথা চেপে ধরলেন। কংস বলল, “রাজি হয়ে যান জেনারেল। না হলে বেঁচে ফিরতে পারবেন না। এই যে আগুনটা দেখছেন না? এটা কার লাশ হজম করল জানেন? বেনারসের বিশিষ্ট মাড়ওয়ারী ব্যবসায়ী মানব চাকি’র। মুক্তিপণ তো দিলই না, পুলিশকে ফোন করল উল্টো। বাধ্য হয়ে জ্বালিয়ে দিতে হল ভদ্রলোককে। যাই হোক, বলেন আপনি আমাদের শর্তে রাজি? নাকি …….” 

কংস আগুনের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি হাসল। 

জেনারেল বুঝতে পারলেন, ফাঁদ এটা। পানির ভেতরে কোন মাদক মেশানো ছিল। তিনি চোখে অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পেলেন। তিনি দেখতে পেলেন, আগুনের ভেতর থেকে একটা হলুদ গিরগিটি বের হয়ে আসছে। কুমিরের সমান বড় সেই গিরগিটিটা জেনারেলের দিকেই এগিয়ে আসছে। তিনি বেলে পাথরের ভেতরে ডুবে যেতে শুরু করলেন। চিৎকার করে তিনি বাম হাতে নাইন এম এম পিস্তলটা বের করে পাগলের মত গুলি করতে শুরু করলেন। পিস্তল দিয়ে গুলি বের হল না। তিনি দেখলেন, পিস্তল দিয়ে রঙ বের হচ্ছে। লাল। নীল। সবুজ। কমলা। তিনি তারস্বরে চিৎকার করে বললেন, “রাজি রাজি আমি রাজি।” 

কংস হো হো হো করে হেসে উঠল। সেই হাসি টিলার ধার ঘেঁষা শ্মশানের আত্মাদেরকেও ভয় পাইয়ে দিল। 

জেনারেল জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *