মেয়েদের কেন ঠকানো হয়?
১৯৯৩ সালে আমার কাছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কিছু মেয়ে আসতো। ফ্যাক্টরিতে মেয়েদের টাকা-পয়সায় ঠকানো, মেয়েদের বেতন কম দেওয়া, বড় পদে মেয়েদের নিয়োগ না করা, ম্যাটারনিটি লীভ না দেওয়া, অসুখ বিসুখে ছুটি না দেওয়া, যৌন হয়রানির শিকার করা, ওভারটাইম করতে বাধ্য করা, রাত বিরেতে ট্রান্সপোর্ট না দেওয়া, এরকম অনেক অভিযোগ করতো। আজ ২২ বছর পর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির খবর নিয়ে দেখি, আগের সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। মেয়েরা আগের মতোই দারিদ্রের শিকার, আগের মতোই মেয়ে হওয়ার কারণে কাজটা বেশি করতে হয়, বেতনটা কম পেতে হয়, আগের মতোই তারা যৌন হয়রানির শিকার। আর মাঝে মাঝে তো আমরা দেখিই কী করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় আগুন লাগছে আর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ফ্যাক্টরির ভেতর আটকে পড়া শত শত বস্ত্র-বালিকা।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শুরু, নব্বইএর দশকে হৈ হৈ করে এর বাণিজ্য গেল বেড়ে। আজ বাংলাদেশ থেকে যা কিছু রফতানি হয়, তার আশি ভাগই গার্মেন্টস। তিরিশ লক্ষের চেয়েও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৮৫ ভাগই মেয়ে। দেশটি যদি সভ্য হতো, এই মেয়েদের মাথায় তুলে রাখতো। সভ্য নয় বলেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশাআঁকে, এদের কী করে আরও ঠকানো যায়, কী করে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন লংঘন করে এদের আরও নির্যাতন করা যায়, জাতিসঙ্খের সব রকম বৈষম্য থেকে নারীর মুক্তির কনভেনশনকে পায়ে মাড়িয়েও বৈষম্যের শিকার করে রাখা যায় এদের। বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র বিষমই দক্ষ এসবে।
গার্মেন্টসে মেয়ে-শ্রমিক নেওয়ার পেছনে মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা নয়, যা কাজ করে তা হলো মেয়েদের সস্তা মাল বলে ভাবার মানসিকতা। সস্তা মাল সস্তায় মেলে। সস্তা মাল আদেশ পালন করে। সস্তা মালকে দেখভাল করার দরকার হয় না। সস্তা মাল কী খাবে কী পরবে কোথায় শোবে তা না ভাবলেও চলে। সস্তা মাল দুঃখকষ্ট সইতে পারে। সস্তা মাল এটা চাই ওটা দাও করে না। সস্তা মালের দাবি দাওয়া নেই। সস্তামাল থেকে সহজে শ্রম আদায় করা যায়। সস্তা মালকে মারো ধরো, মুখ খোলে না। সস্তা মালরা মরে গেলেও কারও কিছু যায় আসে না।
একই কাজ করে একটা পুরুষ পারিশ্রমিক পায় বেশি, একটা মেয়ে পায় কম। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, এই সমস্যা সারা পৃথিবীতে। মেয়েদের কম বেতন দেওয়ার কারণ, জেণ্ডার স্টেরিওটাইপ। জেণ্ডার স্টেরিওটাইপ মানে কোন লিঙ্গ কী চরিত্রের, সে সম্পর্কে মানুষের বদ্ধমূল ধারণা অথবা পুঁতিগন্ধময় বিশ্বাস, যে বিশ্বাস সহজে মন থেকে দূর করা যায় না। জেণ্ডার স্টেরিওটাইপের কিছু উদাহরণ দিচ্ছি মেয়েদের টাকা পয়সা উপার্জনের খুব একটা দরকার নেই, কারণ মেয়েদের সংসার চালাতে হয় না। সংসার চলে পুরুষের উপার্জনে; মেয়েদের বেতন পুরুষের বেতনের সমান হওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই, কারণ পুরুষের মতো পরিবারের দায়িত্ব। মেয়েদের নিতে হয় না; মেয়েদের উপার্জন নিতান্তই স্বামীর মূল উপার্জনের বাইরে একটি বাড়তি উপার্জন; ঘরের বাইরে কাজ না করলেও মেয়েদের চলে, কিন্তু পুরুষকে কাজ করতেই হবে, মাস্ট; মেয়েরা উঁচুপদে চাকরি করতে পারবে না, কারণ মেয়েরা ঝুটঝামেলা সামলাতে পারবে না, প্রয়োজনে শক্ত হতে পারবে না, কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তো পারবেই না; মেয়েরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, আত্মবিশ্বাসী নয়, তার ওপর আবার তাদের কাচ্চা বাচ্চা পোষার ব্যাপার আছে; মেয়েরা হিসেব কষতে জানে না, বুদ্ধিতে-বিচক্ষণতায় কাঁচা, অল্পতে ভেঙে পড়ে, আবেগ প্রবণ, অহেতুক কান্নাকাটি করে, অতি নরম, দুর দুরান্তে ভ্রমণ করতে পারবে না, রাতে চলাফেরা করতে ভয় পাবে; মেয়েরা সেবা যত্ন করায় হয়তো দক্ষ, কিন্তু পুরুষেরা দায়িত্ব নেওয়ায় দক্ষ; মেয়েরা মা হতে চায়, দীর্ঘকাল চাকরি বাকরি করতে চায় না; সন্তানের দেখাশোনা করতে হয় বলে মেয়েরা চাকরিতে মনোযোগ দিতে পারে না। স্টেরিওটাইপের শেষ নেই। দক্ষ মেয়েদেরও শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে উঁচু পদে কাজ করতে দেওয়া হয়। না। লিঙ্গ বৈষম্য সবখানে, ঘরে বাইরে, অফিসে আদালতে। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে মেয়েদের চাকরি পাওয়াটা সহজ নয়, কিন্তু চাকরি হারানোটা সহজ।
জগত বদলাচ্ছে, মেয়েরাই অনেক সময় সংসার চালায় একা, স্বামী সন্তানের ভরণ পোষণও করে। তারপরও মেয়ে বলেই তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়। মেয়েরা অংক কম জানে, বিজ্ঞান কম বোঝে, এরকম ধারণাও ঢুকে আছে মানুষের মনে ও মস্তিষ্কে। মেয়েদের সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বিশ্বাস কত সহস্র বছর আগে ঘুণপোকার মতো ঢুকে গেছে মানুষের মগজে, তা থেকে মুক্তি আজও মানুষের নেই, আজও সেই বিশ্বাস উচ্চারিত হয় সবখানে, কোনও রকম প্রমাণ খাড়া করার দায়িত্ব কেউ বোধ করে না। মানুষের এই বিশ্বাসের জন্যও মেয়েরা কোনও কাজে পারদর্শী হয়েও যোগ্য পদ পায় না। মেয়েদের সম্পদ মেয়েদের শরীর, এই বিশ্বাসও শেকড় গেড়ে বসা। সে কারণে মেয়েদের শরীরের দিকেই চোখ পড়ে মানুষের। মেয়েরা কী বিষয়ে কতটা জানে, কতটা বোঝে, কতটা দক্ষ, সেসব কেউ জানতে চায় না, মেয়েদের রূপ হয়ে ওঠে প্রধান, মেয়েদের গুণ হয়ে ওঠে গৌণ। মেয়েদের যৌনসামগ্রী হিসেবে দেখা হয় বলে মেয়েদের মধ্যে যাদের বয়স অল্প, যারা দেখতে সুন্দর, তাদের চাকরি পেতে অসুবিধে হয় না। বিভিন্ন চাকরিতে, বিশেষ করে শোবিজে আমরা কাস্টিং কাউচের গল্প শুনেছি। মেয়েরা, ঘরে কাজ করুক কী বাইরে কাজ করুক, ব্যবহৃত হয় পুরুষের যৌন স্বার্থে। প্রায় মেয়েরাই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। মেয়েদের অধিকার এবং স্বাধীনতা যেখানে যত কম, মেয়েদের ওপর যৌন হয়রানির হার সেখানে তত বেশি।
সেদিন এক লোক আমাকে বললো, মেয়েদের পেশির জোর কম, পুরুষের পেশির জোর বেশি, তাই পুরুষের স্থান উঁচুতে, মেয়েদের স্থান নিচে, তাই চাকরিতে মাইনেটা মেয়েরা কম পায়, পুরুষরা পায় বেশি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাকরিগুলো কি নারী পুরুষের মধ্যে মল্লযুদ্ধ হওয়ার চাকরি, যেখানে শরীরের পেশির প্রয়োজন হয়? লোকটি ভুরু কুঁচকে বলেছে, না। আমিও ভুরু কুঁচকে বললাম, তবে পেশির প্রশ্ন ওঠে কেন? এও বললাম, আমরা পেশি দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোনওটাই চালাই না। আমরা মস্তিষ্ক দিয়ে চালাই সব। নারী পুরুষের মস্তিষ্কে তো কোনও পার্থক্য নেই বলেই জানি। লোকটি এরপর কোনও উত্তর দিতে পারেনি। সম্ভবত কুৎসিত কোনও গালি খুঁজছিল আমার দিকে ছোঁড়ার জন্য। জুৎসই উত্তর না থাকলে কুৎসিত গালিই ওদের ভরসা।
সবার আগে এই নারীবিদ্বেষী বিশ্বাসগুলোকে বিনাশ করতে হবে। এসবের বিনাস না হলে এসব বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যে লিঙ্গ বৈষম্য গড়ে উঠেছে, সেই লিঙ্গ বৈষম্যকে বিনাশ করা সম্ভব নয়। অসুখ দূর করতে হলে অসুখের কারণ দূর করতে হয়, তা না হলে অসুখ সারে না।
পৃথিবীর জনশক্তির অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক জনশক্তিকে যদি দুর্বল বলে ভাবা হয়, ছলে বলে কৌশলে যদি তাদের পারদর্শিতা দেখানোর সবরকম সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়, যদি তাদের শোষণ করা হয়, যদি তাদের কাজকে কাজ বলে না ভাবা হয়, উপার্জনকে উপার্জন বলে গণ্য করা না হয়, যদি তাদের প্রাপ্য সম্মান তাদের না দেওয়া হয়, তাদের সমতা আর সমানাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস না করা হয়, কর্মঠ, নিষ্ঠ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমতি, দায়িত্বশীল, ও দক্ষ হওয়ার পরও যদি তাদের তুচ্ছ করা হয়, শুধু মেয়ে বলেই তুচ্ছ করা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই আমাদের দুর্ভাগা জাতির! আবারও বলছি, মেয়ে বলেই যদি তাদের হাঁড়ি ঠেলার, রাঁধা-বাড়ার, সন্তান জন্ম দেওয়ার বস্তু, আর আবেগের পিণ্ড বলে ভাবা হয়, মেয়ে বলেই যদি তাদের কিছু কম-বুদ্ধির, কিছু কম-সম্মানের, কিছু কম মর্যাদার কিছু কম মানুষ বলে মনে করা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই আমাদের দুর্ভাগা জাতির। এইসব অসুস্থ ভাবনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারলে আখেরে মুক্তি নেই কারোর।