নতুন পৃথিবী
পৃথিবীর মতো আরেকটা গ্রহ পেয়ে যাওয়া, এর চেয়ে চমৎকার কী আর ঘটতে পারে এই পৃথিবীতে! একটা গ্রহ যেটার ওপরে জল আছে, যেটা একটা নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে, যেটা আমাদের এই পৃথিবীর মতোই দেখতে! এরকম পৃথিবী যে আরও পাওয়া যায়নি কখনও তা নয়। পাওয়া গেছে তবে ওগুলোর নক্ষত্র আমাদের সূর্য নামের নক্ষত্রের তুলনায় ছোট আর ঠাণ্ডা।
কিছুদিন আগে কেপলার ৪৫২বি নামের যে গ্রহটা পাওয়া গেল, সেটা যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে, সেই নক্ষত্রটা কিন্তু আমাদের সূর্যের মতোই। নক্ষত্র আর গ্রহের মধ্যে দূরত্ব ১৪০০ আলোকবর্ষ। কেপলার ৪৫২বি গ্রহ তার নক্ষত্রকে, আমাদের পৃথিবী সূর্যকে যতবার প্রদক্ষিণ করছে, তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি প্রদক্ষিণ করছে। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর লাগে ৩৬৫ দিন। আর ৪৫২বির তার নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করতে লাগে ৩৮৫ দিন।
আমাদের সূর্যের চেয়েও ৪৫২বি গ্রহটি যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে তার বয়স বেশি। যত বেশি বয়স তত বেশি তাপ, সে কারণে কেপলার ৪৫২বি আমাদের পৃথিবী থেকেও বেশি গরম।
দুশ কোটি বছর আগে ৪৫২বির নক্ষত্রের তাপ এখনকার চেয়ে আরও কম ছিল। ঠিক আমাদের এখনকার সূর্যের মতো ছিল। দুশ কোটি বছর আগে আমাদের সূর্যের তাপ আর ৪৫২বির নক্ষত্রের তাপ ছিল একই রকম। এই গ্রহ আর ওই গ্রহ একই রকম আলো আর উষ্ণতা পেতো।
কিন্তু তারপরও কেপলার ৪৫২বিকে পৃথিবীর মতো বলা যাবে না। বলা যাবে না এই কারণে যে ৪৫২বি আমাদের পৃথিবীর চেয়ে আকারে বড়। এর ব্যাস পৃথিবীর ১.৬ গুণ বেশি। আর তাছাড়া আমরা এখনও জানিনা কী পদার্থ দিয়ে তৈরি ওই গ্রহ। পদার্থটি সম্পর্কে যতক্ষণ না জানছি, ততক্ষণ ওর ঘনত্বটাও তো জানা যাচ্ছে না। একেক পদার্থের ঘনত্ব একেকরকম। পানির একরকম, লোহার আরেকরকম, পাথরের আরেক।
যদি পৃথিবীতে যা আছে, তাই থাকে ৪৫২বি তে, তাহলে পৃথিবীর চেয়ে চার গুণ বেশি পদার্থ আছে ওর। তা যদি হয় তা হলে গ্র্যাভিটি বেড়ে যাবে পৃথিবীর চেয়ে ১.৬ গুণ। কারও ওজন যদি পৃথিবীতে একশ পাউণ্ড হয়, ৪৫২বিতে তার ওজন হবে ১৬০ পাউণ্ড, অবশ্য যদি আমাদের পৃথিবী যে পদার্থ দিয়ে তৈরি, সে পদার্থ দিয়ে যদি তৈরি হয় কেপলার ৪৫২বি। গ্র্যাভিটিটা বেশি হলে বেশি গ্যাস থাকে চারদিকে, এতে করে বাতাসটা বেশি ভারী হয়ে যায়। কেপলার ৪৫২বি গ্রহ কিন্তু আমাদের পৃথিবীর চেয়ে বেশি আলো আর বেশি তাপ গ্রহণ করতে পারে।
৪৫২বির আকার আমাদের পৃথিবীর মতো নয়। কিন্তু কেপলার-১৮-৬এফ-এর আকার ছিল পৃথিবীর আকারের মতো। কিন্তু ওটা ঠিক সাধারণ কোনও নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল না, যেটাকে ঘিরে আবর্তিত হতো সেটা যে কোনও নক্ষত্রের চেয়ে আকারে অনেক ছোট, তাপও যে কোনও নক্ষত্রের চেয়ে অনেক কম। কেপলার ১৮৬এফ-এ যদি প্রাণী থেকে থাকে, তবে সে প্রাণ ঠিক কেমন প্রাণ? ওখানকার বায়ুমণ্ডলই বা কেমন!জানতে ইচ্ছে হয়।
একটা সময় আমরা জানতাম না কোনও নক্ষত্রকে ঘিরে পৃথিবী ছাড়া আর কোনও গ্রহ আদৌ আবর্তিত হচ্ছে কি না। এখন আমরা জানি হাজারো গ্রহের খবর। আমাদের গ্যালাক্সিতেই তো কোটি কোটি পৃথিবীর মতো একই আকৃতির গ্রহ আছে। এও জানি ওগুলোর একটিও বাসযোগ্য নয়। ওগুলো হয় অতি ঠাণ্ডা নয়তো অতি গরম।
হয়তো কেপলার ৪৫২বি’টা ততটা পৃথিবীর মতো নয়, যতটা কেপলার ১৮৬এফ-টা। কারণ কেপলার ৪৫২বি টা পৃথিবীর চেয়ে আকারে অনেক বড়, গরমও অনেক বেশি। আমাদের কাজ পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য কোনও গ্রহ খুঁজে পাওয়া। খাপে খাপে না মিললেও হয়তো চলে, বাসযোগ্য হওয়াটাই আসল। কেপলার ১৮৬এফ এর সঙ্গে আকৃতি মিললেও উষ্ণতায় মিল নেই। কেপলার ৪৫২বির সঙ্গে উষ্ণতা মিললেও আকৃতিতে মিল নেই।
আমরা যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি হলে চলবে না। আমাদের আরও খুঁজতে হবে গ্রহ নক্ষত্র। আমরা আরও জানতে চাই, আরও বুঝতে চাই, আরও পেতে চাই। আমাদের আরও ভালো, আরও বড় টেলিস্কোপ দরকার, যে টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহগুলো আরও নিখুঁত করে দেখতে পাবো, কী পদার্থ দিয়ে গ্রহগুলো তৈরি, কীরকম তাপমাত্রা ওগুলোর, সব বুঝতে পারবো।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে হয়তো আমরা একা নই। কিন্তু মহাশূন্য এত বিশাল যে আমরা একা হলেও আমরা একা পড়ে গেছি। অন্যান্য প্রাণীও হয়তো আমাদের মতোই একা পড়ে গেছে। আসলে কী, এই সৌর জগতের বাইরে অন্য কোনও সৌর জগতে একদিন না একদিন আমাদের পাড়ি জমাতেই হবে, যদি মানুষ নামক প্রজাতিকে বাঁচাতে চাই। কারণ এই পৃথিবী যে কোনও কারণেই হোক একদিন আর বাসযোগ্য থাকবে না। কোনও এসটোরয়েড পড়ে পৃথিবী অন্ধকার করে ফেলবে, তাছাড়া আমাদের সূর্য একসময় তো গ্যাস ফুরিয়ে নিভে যাবেই। সে সময় পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য কোনও গ্রহ আমাদের পেতেই হবে।
এত সহস্র কোটি গ্রহ বাসযোগ্য অবস্থানে যদি থাকে, তবে কোথাও না কোথাও প্রাণের জন্ম নিশ্চয়ই হয়েছে। সেই প্রাণীকূল আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হলে হয়তো এতদিনে আমাদের খুঁজে পেতো। অথবা, কেউ একজন বলেছিলো, বেশি বুদ্ধিমান বলেই হয়তো আমাদের মতো গবেটদের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ওরা মনে করছে না।
এই অন্তহীন মহাশূন্যে আমরা একা, এটার চেয়ে আমরা একা নই, এটাই হয়তো অনেক ভয়ের।