বজরঙ্গি ভাইজান
কাল কবির খান পরিচালিত সালমান খান অভিনীত বজরঙ্গি ভাইজান দেখলাম। আশির দশকের পর থেকে আমি হিন্দি ছবি দেখি না। কিন্তু এক বন্ধুর অনুরোধ আমাকে ছবিটা দেখতে হলো।বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতি আশির দশকের নির্মাণ পদ্ধতির চেয়ে এখন অনেক উন্নত। তবে চলচ্চিত্র এখনও মেলোড্রামা মুক্ত হতে পারেনি। এখনও ছবিগুলো অযথা নাচে গানে ভরপুর। হাফ মিউজিক্যাল যাকে বলে। বজরঙ্গি ভাইজান সব কিছুর মিশেল। ছবিটায় নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বরাবরের মতো ভালো অভিনয় করেছেন। ভালো একটা মেসেজ দেওয়ার জন্য ছবিটার গল্প লেখা হয়েছে। গল্পে গোঁজামিল আছে, অসম্ভব অসম্ভব ঘটনা আছে, ওগুলো না হলে হয়তো মূল মেসেজটার দিকে এত দ্রুত যাওয়া যেত না। রাজনীতিকরা বিভেদ সৃষ্টি করছে মানুষের মধ্যে, হিন্দু আর মুসলমানকে আলাদা করছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনও হৃদয়বান, এখনও তাদের কাছে মানুষের পরিচয় মানুষই। এক কট্টর হিন্দুত্ববাদীর কাছে ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে মানবতার সেবা। পাকিস্তানের মুসলমানের কাছে বজরঙ্গীও তার মানবতার জন্য হয়ে ওঠে ভাইজান।
আমরা জানি, আমরা দেখেছিও, সরকার ধর্মকে ব্যবহার করে, মানুষের মধ্যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়াতে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এখনও মানবতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। এটা যে শত ভাগ সত্য নয়, তা আমরা জানি। মানুষের বর্বর, নৃশংস, কুৎসিত চরিত্র বারবারই তো প্রকাশিত হয়। আমরা এও দেখি, এক নেতা আরেক নেতার সঙ্গে ঠিক ঠিক ভাব করে নেয়, কিন্তু তারা যাদের মগজধোলাই করেছে, মারামারিটা, হিংসাহিংসিটা, খুনোখুনিটা সাধারণত তারাই করে।
সেদিন ভারতের ওয়াঘা-আত্তারি আন্তর্জাতিক সীমান্তে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মিষ্টি পাঠিয়েছে। কিন্তু পাক সেনারা সেই মিষ্টি গ্রহণ করেনি। সেনারাও ঘৃণার রাজনীতি শিখেছে। এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ আম পাঠালে মোদি কিন্তু সেই আম ফিরিয়ে দেননি।
ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতা ভারত ভাগের শুরু থেকেই। শত্রুতা শুরু করেছিল রাজনৈতিক নেতারা, জনগণ প্রভাবিত হয়েছিল। হয়েছিল বলেই ভারতভাগের সময়। হিন্দু মুসলমানকে কুপিয়ে, মুসলমান হিন্দুকে কুপিয়ে, দশ লক্ষ মানুষের লাশ ফেলেছে। আমি আজও মনে করি, ইচ্ছে করলেই সাতচল্লিশে ভারত ভাগ ঠেকাতে পারতো রাজনীতিকরা। ইচ্ছে করলেই অগুনতি মৃত্যু ঠেকাতে পারতো। ধর্মটাকে মানবতা হিসেবে প্রচার করলেই ঘৃণা হিংসে বর্বরতাগুলো দূর হয় না। বরং মানবতাকে ধর্ম হিসেবে প্রচার করলে শান্তির দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
একাত্তরের যুদ্ধে ভারত যদি বাংলাদেশকে সাহায্য না করতো, তা হলে বাংলাদেশের যুদ্ধে জেতা হতো না। তিরিশ লক্ষ শুধু নয়, আরও অনেক লক্ষ মানুষকে মরতে হতো। দুলক্ষ নারীকে ধর্ষণ করে পাক সেনারা থামতো না, আরও অনেক লক্ষকে ধর্ষণ করতো ওরা। এই মিত্রশক্তি ভারতকেও রাজনীতির প্রভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ শত্রু বলে মনে করে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। বিশ্বাস করে, তাদের অনেকের কাছেও মানবতার ভাষাটা ঠিক বোধগম্য নয়।
দুদিন আগে এমন এক প্রগতির পক্ষের যুবকের সঙ্গে কথা হলো। যুবকটি এখন নরওয়েতে। কথোপকথন পুরোটাই তুলে দিচ্ছি।
যুবক: বাইরে কারো সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলতে গেলে ঐ একই কথা শোনা যায়, বাংলাদেশে নাকি ইসলামিস্ট নেতাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। বিচার করা হচ্ছে?
তারপর যখন বলি যে, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন লোককে হত্যা করেছিলো এবং যাদের বিচার হচ্ছে তারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলো, কেউ কেউ নিজের হাতেই হত্যা করেছে এবং জামাতে ইসলামীর ইসলাম আসলে একটা লেবাস মাত্র, তখন তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে।
কিন্তু কেউ যখন প্রশ্ন করে যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তোমাদের তিন মিলিয়ন লোক হত্যা করলো, তারপরও বাইরের দেশে পাকিস্তানীদের সাথে বাংলাদেশীদের ভাল সম্পর্ক কেন, তখন বেদনা হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
আমি: বাঙালিদের মেরেছে পাকিস্তানি সরকারের আদেশে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী। এ কারণে সাধারণ পাকিস্তানিদের দোষ দিচ্ছেন কেন? বাংলাদেশের সরকার বা সেনা বাহিনী কোনো অন্যায় করলে তার দায় কি আপনার? নরওয়ের বিশাল পপুলেশন পাকিস্তানি অরিজিন। ওরা ষাটের দশকে শ্রমিক হিসেবে নরওয়েতে এসেছিল, পরে ফেরত যায়নি দেশে। ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছে। মিলে মিশে থাকবেন।
যুবক: আপনার কথা ঠিক দিদি। কিন্তু যখন শুনি যে পাকিস্তানীরা এখনো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ মনে করে তখন আর ঠিক মনে হয় না। পাকিস্তান বা পাকিস্তানীদের একাত্তরে বাংলাদেশের হত্যা সম্পর্কে কোন সিমপ্যাথি বা অনুশোচনা না থাকলে আমি একপাক্ষিক প্রেম দেখানোকে ভাল চোখে দেখতে পারি না। আর ভাল মানুষ সবখানেই আছে, খুঁজলে জামাতে ইসলামীতেও পাওয়া যাবে।
আমি: আপনি জেনারাইলাইজ করছেন। পাকিস্তানীরা যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ মনে করে, তাদের সংখ্যাটা কত? সব পাকিস্তানিই নিশ্চয়ই তা মনে করে না। এটা মনে রাখতে হবে, আমাদের মতো তারাও ইসলামি রাজনীতির ভিকটিম। অনেক পাকিস্তানী মানুষ একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। নিজেদের সরকারকে দোষ দিয়েছেন। পাকিস্তানের সবাই ইসলামি-মৌলবাদী নয়, তাঁদের অনেকে শিক্ষিত, সচেতন, অনেকে মুক্তচিন্তায় গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, ইসলামিজমের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই করে বেঁচে আছেন। জামাতি ইসলামিতে খুঁজলে। কিছু খুনী এবং ধর্ষক নাও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভালো আদর্শবান মানুষ পাওয়া কঠিন। কারণ জামাতির আদর্শ নারীবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, সমানাধিকার বিরোধী, বিজ্ঞানবিরোধী। এই আদর্শকে জেনেশুনে যারা সমর্থন করছে, তাদেরকে আমরা আমাদের লোক বলে গণনা করতে পারি না।
যুবক; জেনারেলাইজেশন যে হয়েছে তা আমি মানছি। সেজন্য এই পোস্টে আপনার মন্তব্য পেয়েছি। এটাও কিন্তু একটা পাওয়া আমার। জেনারেলাইজ না করলে তো পেতাম না। তবে পাকিদের সাথে যারা বেশি অন্তরঙ্গ হয়, ভাই মনে করে, তারা আসলে নিজেরাও নষ্ট।
আমি: তবে পাকিদের সাথে যারা বেশি অন্তরঙ্গ হয়, ভাই মনে করে, তারা আসলে নিজেরাও নষ্ট।–এটাও জেনারাইজেশন। পাকিস্তানি একজন মানববাদীর সঙ্গে বাংলাদেশি একজন মানববাদীর বন্ধুত্ব হতেই পারে। তারা সে কারণে নষ্ট হবে কেন?
কথোপকথন যারা পড়েছে, আমার মানবতার আহবান তাদের উত্তেজিত করেনি। ঘৃণা আর হিংসের ভাষাটা এখনও খুব শক্তিশালী কিনা। এখনও এই ভাষা মানুষকে আকৃষ্ট করে।