৯
হন হন করে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসা। একবার হাত দিয়ে সোল্ডার হোলস্টারে সে তার প্রিয় রিভলবারটি দেখে নিল।
সাবেরার স্কেচটি এমন নিখুঁত যে, বেগ পেতে হচ্ছে না রাস্তা চিনে নিতে। মৃত পুরীর মতই অলি-গলি সব নীরব-নীর্জন। এই নীরবতার মাঝে আহমদ মুসার স্টিল সোলের জুতা বিদঘুটে শব্দ তুলছে।
আর বেশী দূর নয়। স্কেচ অনুসারে শেষ লেনের শেষ মাথা প্রায় এসে গেছে।
লেনটির মাথা জুড়েই পাওয়ার হাউজ। ৮ ফিটের মত উঁচু দেয়াল। দেয়ালের উপর দিয়ে আবার তারকাঁটার জাল। তারকাঁটার জাল যে ইলেকট্রিফায়েড তা সহজেই আঁচ করা যায়।
দেয়ালের বাইরে দিয়েও সেন্ট্রি রয়েছে।
আহমদ মুসা লেনের মুখে অন্ধকার মত জায়গায় দাড়িয়ে রইল। লেনের মুখ থেকে একজন সেন্ট্রিকে দেখা যাচ্ছে। সে হাটতে হাটতে দক্ষিণ দিকে চলে গেল। আর একজন সেন্ট্রিকেও দেখা গেল। সে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এসে আবার পশ্চিম দিকে চলে গেল। আহমদ মুসা বুঝল নির্দিষ্ট নিয়মেই এ পেট্রোল চলছে। যখন দক্ষিণের সেন্ট্রি মোড়ে আসবে, তখন এদিকের সেন্ট্রি চলে যাবে পশ্চিমে।
আহমদ মুসা লেনের দেয়ালের পাশে ব্যাগটি রেখে দিল। তারপর পকেট থেকে একটি ছোট্ট শিশি বের করে নিয়ে তা থেকে কিঞ্চিত পরিমাণ তরল পদার্থ রুমালে ঢেলে নিল। দক্ষিণের সেন্ট্রিটি মোড়ের কাছে প্রায় এসে গেছে।
আহমদ মুসা রেডি হলো। ডান হাতে রুমাল। সেন্ট্রিটি মোড়ে এসে মুহূর্তকাল দাড়িয়ে আবার দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করল।
আহমদ মুসা পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দ্রুত তার পিছু নিল। নাগালের মধ্যে আসতেই সে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। বাম হাতে চেপে ধরল গলা, আর ডান হাতে ক্লোরোফরম ভেজান রুমাল ঠেসে ধরলো নাকে। অষ্ফুটে কয়েকবার কোঁক কোঁক করে একেবারে হাত-পা আছড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
আহমদ মুসা দ্রুত তাকে লেনের অন্ধকারে কোণে টেনে নিয়ে এলো। তারপর তার ইউনিফরম খুলে পরে নিল নিজে। ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস পকেটে পুরল। এদিকে সেন্ট্রিটি মোড়ে এসে গেছে।
আহমদ মুসা অটোমেটিক রাইফেলটি কাঁধে ফেলে ক্যাপটি কপাল পর্যন্ত নামিয়ে পাওয়ার হাউজের দেয়ালের গা ঘেষে চলতে শুরু করলো।
দেয়ালটি দক্ষিণে এসে যেখানে শেষ হযেছে সেখান থেকে পুনরায় তা বেঁকে অল্প একটু গিয়ে উঁচু বারান্দায় শেষ হয়েছে। বারান্দায় এসে মিশেছে হোয়াইট রোডও। বারান্দার সিড়ির নীচে দুই প্রান্তে অটোমেটিক কার্বাইন হাতে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ দিকে হোয়াইট রোডের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। কিছু দূরে দু’টি জীপ দাড়িয়ে আছে। জীপের রং দেখে মনে হচ্ছে আর্মির।
আহমদ মুসা ফুলস্কেপ সাইজের একটি প্রিন্টেড কাগজ বের করে হাতে নিয়ে দ্রুত দৃঢ় পদক্ষেপে বারান্দার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলল। মনে হচ্ছে যেন জরুরী কোন কাগজ সে অফিসের ডিইটি অফিসারকে দিতে যাচ্ছে । অটোমেটিক কারবাইন হাতে দাড়ানো পুলিশ দু’জন তাকে দেখে নড়ে উঠল। কিন্তু আহমদ মুসা কাগজটি উঁচু করে অফিসের দিকে ইংগিত করে সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত বারান্দা অতিক্রম করে অফিসে ঢুকে গেল। সে যে রুমে প্রবেশ করলো, তা একটি হলঘর। হল ঘরে কোন লোক নেই। হল ঘরের পরেই আর একটি রুম। চেয়ার টেবিল পাতা। ডিউটি অফিসার চেয়ারে বসে ঢুলছিল। আহমদ মুসা ঘরে প্রবেশ করেই দরজা বন্ধ করে দিল। শব্দ পেয়ে ডিউটি অফিসার একটু নড়ে চড়ে বসল। চোখ দু’টিও তার খুলে গেল। উদ্যত রিভলভার হাতে একজন অপরিচিত পুলিশকে তার সামনে দাঁড়ানো দেখে সে হকচকিয়ে উঠল। বসে থেকে আপনা হতেই একান্ত অনুগত্যের মত হাত দু’টি উপরে তুলল।
আহমদ মুসা বলল, হাত উপরে তোলা নয় ইঞ্জিন রুমের চাবি দাও। কোন চালাকি করো না। মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।
লোকটি কাঁপতে কাঁপতে ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে ফেলে দিল টেবিলের উপর। আহমদ মুসা দ্রুত টেবিল থেকে চাবি কুড়িয়ে নিল। তারপর রিভলভার উচু করে চাপ দিল ট্রিগারে। একরাশ ধোয়া বেরিয়ে গেল নল দিয়ে। লোকটি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল চেয়ারের উপর। তারপর চেয়ার থেকে মেঝেতে।
আহমদ মুসা দ্রুত চাবি নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। ভিতরের উঠান বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সাজ সরঞ্জামে ভর্তি। উত্তর-পশ্চিম কোণে ইঞ্জিন কক্ষ। ভীষণ শব্দে ইঞ্জিন চলছে। আহমদ মুসা দ্রুত সেদিকে অগ্রসর হলো। ওদিক থেকে দু’জন লোক অফিস ঘরের দিকে আসছিল। ওরা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। পুলিশকে ওভাবে দ্রুত ইঞ্জিন রুমের দিকে যেতে দেখে তারা বিস্মিত কন্ঠে বলল, কি হয়েছে স্যার?
-কিছু হয়নি, তবু ইঞ্জিন রুমটা একটু চেক করে আসি। তোমরা এখানে একটু দাঁড়াও।
লোক দু’জন আহমদ মুসার ইংরেজী কথা শুনে মনে করল, নিশ্চয় উপর থেকে পাঠানো হয়েছে। তারা আহমদ মুসার নির্দেশ মত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
আহমদ মুসা দ্রুত গিয়ে ইঞ্জিন রুমে ঢুকে পড়ল। তারপর কাজে লেগে গেল সে।
পকেট থেকে সে ডিম্বাকৃতি একটি বস্তু অতি সন্তর্পনে বের করে নিল। সৌদি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে তৈরী অত্যাধুনিক ডিনামাইট এটি। এর জন্য পৃথক কোন ফিউজের দরকার হয় না এবং আগুনেরও প্রয়োজন হয় না কোন। এ ডিম্বাকৃতি ডিনামাইটের শীর্ষদেশে চ্যাপটা ধরনের সেফটি পিন রয়েছে। পিনটি খুলে নিলেই এর ভিতরের ক্ষুদ্র অটোমেটিক রিয়্যাকটরে বিষ্ফোরণ ঘটে যায় এবং তা থেকে উৎপাদিত তাপ ক্রমে ক্রমে এমন এক পয়েন্টে উন্নতি হয় যখন গোটা ডিনামাইটটিই ফেটে পড়ে প্রচন্ড বিষ্ফোরণে। এর ধ্বংসকারী ক্ষমতা ভীষণ। প্রায় তিনশ’ বর্গগজ পরিমিত স্থানের সবকিছুকে এটা ধুলায় পরিণত করতে পারে।
আহমদ মুসা সন্তর্পণে সেফটি পিন খুলে নিয়ে অতি সাবধানে তা রেখে দিল মূল ইঞ্জিনের অভ্যন্তরে নির্ভৃত এক কোণে। চট করে কারোরই তা নজরে পড়বে না।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে এলো। গেটে তালা লাগিয়ে চাবি ছুড়ে ফেলে দিল পাশের স্তুপিকৃত লোহা-লক্কড়ের মধ্যে। নিরাপদে ডিনামাইটটি পাততে পেরে আনন্দে গুনগুনিয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার মন। কিন্তু গুনগুনানি তার থেমে গেল যখন দেখল যাদেরকে সে দাঁড়াতে বলে গিয়েছিল তারা সেখানেই নেই। ধক করে উঠল তাঁর মন। ওদেরকে অমন করে মায়া দেখানো তার ঠিক হয়নি। শত্রুকে পিছনে ফেলে রেখে যাওয়াটা মারাত্মক ভুল হয়েছে তার।
দ্রুত সে ডিউটি রুমের দিকে পা বাড়াল। ডিউটি অফিসার তেমনভাবে পড়ে আছে তার চেয়ারের পাশে। কিন্তু বাইরের দিকের যে দরজা আহমদ মুাসা বন্ধ করে গিয়েছিল, তা খোলা। আর বাম পাশের সংযোগ কক্ষের খোলা দরজা বন্ধ। সন্দেহের এক শীতল স্রোত বয়ে গেল তার দেহে। শির শির করে উঠল তার মেরুদন্ডদেশ। সে তাহলে ট্রাপে পড়েছে?
বাইরের খোলা দরজার দিকে দ্রুত এগোল সে। কিন্তু দরজায় পা দিয়েই দেখতে পেল, কয়েকজন দ্রুত সিড়ি বেয়ে উঠে আসছে। হাতে উদ্যত সাব মেশিন গান।
রিভলভার এক্ষেত্রে অকেজো দেখে আহমদ মুসা দ্রুত বাম হাত দিয়ে প্যান্টের বাম পকেট থেকে স্মোক বম্ব বের করে নিল। বিদ্যুৎ গতিতে তার বাম হাত উপরে উঠল। কিন্তু বম্ব ছুড়তে সে পারল না। একেবারে পেছনে পদশব্দ শুনে সে তড়াক করে পেছনে ফিরল। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। প্রচন্ড এক আঘাত নেমে এলো তার মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে আহমদ মুসা লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
সবাই এসে ঘিরে ধরল তাকে। তাদের মধ্যে থেকে লেফটেন্যান্টের প্রতীক আটা একজন অন্য একজন অন্য একজনকে লক্ষ্য করে বলে উঠল, আলবার্ট তুমি এখনি গিয়ে স্যারকে খবর দাও। জীপ নিয়ে যাও।
একটা কড়া স্যালুট দিয়ে আলবার্ট নামক লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে দ্রুত জীপ লক্ষ্যে এগিয়ে গেল।
হোয়াইট রোড পার হয়ে পার্ক রোড ধরে আলবার্টের গাড়ী পূর্বদিকে দ্রুত এগিয়ে চলছিল। সামনেই একটি কালভার্ট। সংকীর্ণ রাস্তা সেখানে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে স্পিড কমাতে হলো। এই সময় সামনে থেকে একটি গাড়িকে সে তীরবেগে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখল। গাড়ীটির বেপরোয়া গতি দেখে প্রমাদ গুণল আলবার্ট। কালভার্টের মুখে এসে আলবার্টের গাড়ী ডেডশ্লো হয়ে গেল। সামনের গাড়ীটি তখন কালভার্টে উঠে পড়েছে। আলবার্টের গাড়ী থেমে গেছে রাস্তার কুল ঘেষে। সামনের গাড়ীটিও এসে দাঁড়াল তার গাড়ীর পাশে।
-কি ব্যাপার আলবার্ট, কোথায় চলেছ? জীপ থেকে মুখ বাড়িয়ে এক নারী কন্ঠ জিজ্ঞাসা করল।
-স্যারকে খবর দিতে।
-কি খবর?
-ও। আপনি তো জানেন না। পাওয়ার হাউজে এক শালাকে আমরা ধরেছি। আলবার্টের মুখে বিজয়ের হাসি।
-স্যারকে আবার খবর দেয়া কেন? তোমাদের সব কাজে দীর্ঘ সূত্রিতা। ওকেই তো এখনি হাজির করতে হবে স্যারের কাছে। চল ওকে নিয়ে আসব আমি।
আলবার্ট ও মেয়েটি ফিরে এলো পাওয়ার হাউজে। গাড়ী থেকে নেমেই তরতর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে মেয়েটি উঠে গেল পাওয়ার হাউজের ডিউটি রুমের দিকে।
আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে আসেনি তখনও। তেমনিভাবে সবাই বসে আছে তাকে ঘিরে। মেয়েটিকে ঘরে ঢুকতে দেখে সবাই সসম্ভ্রমে উঠে দাড়ায়। ফিলিপাইন সিক্রেট সার্ভিসের বাঘা এজেন্ট মিস হেনরিয়েটাকে দেখে তারা খুশী হল।
ঘরে ঢুকে সকলের দিকে স্মিত হাস্যে চেয়ে হেনরিয়েটা বলল, তোমাদের সকলকে ধন্যবাদ। তোমাদের কাহিনী আমরা পরে শুনব। একে বেঁধে তোমরা আমার জীপে তুলে দাও। এক্ষুনি একে হেড কোয়ার্টারে পৌছাতে হবে। অনেক কাজ আছে একে দিয়ে।
লেফটেন্যান্টের ইংগিতে দ্রুত আহমদ মুসাকে হেনরিয়েটার জীপে তুলে দেয়া হলো।
গাড়ীতে উঠতে উঠতে হেনরিয়েটা বলল, তোমাদের এ বিজয়ে হেড কোয়ার্টার অপরিসীম খুশী হবে। কিন্তু দেখো, আনন্দ যেন তোমাদের দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য না সৃষ্টি করে।
তীর বেগে ছুটে চলল হেনরিয়েটার জীপ। হোয়াইট রোড, পার্ক রোড পার হয়ে মার্কোস এভিনিউ ধরে তা এগিয়ে চলল উত্তর দিকে। মার্কোস এভিনিউ ধরে কিছু দূর যাবার পর গাড়ীটি বাম দিকে ঘুরে লেক সার্কাস রোড ধরে প্রায় মিনিট তিনেক চলার পর রাস্তা থেকে নেমে একটি অন্ধকার মত জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
গাড়ী থামতেই হেনরিয়েটা লাফ দিয়ে পিছনের সিটে এলো। অন্ধকারের মধ্যেই চাকু দিয়ে সে আহমদ মুসার হাত ও পায়ের বাঁধন কেটে দিল।
আহমদ মুসা গাড়ীতে উঠার পরেই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল। মাথা তার খসে যাচ্ছে বেদনায়। গোটা গা ঝিম ঝিম করছে। ভাবছিল সে, মেয়েটি তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে? বাঁধন কাটতে দেখেই তার মনে একটি কথা ঝিলিক দিয়ে গেল। সে বলল, কে, সাবেরা?
-জি, জনাব, আপনি জেগে উঠেছেন? কেমন বোধ করছেন এখন?
সাবেরার প্রশ্নের দিকে কর্ণপাত না করে আহমদ মুসা বলল, আমাকে কোথায় এনেছ সাবেরা?
-আমরা এখন লেক সার্কাস রোড রয়েছি।
-এখন সময়……
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় বিষ্ফোরণের এক বিরাট শব্দ শোনা গেল। গাড়িটিও কেঁপে উঠল সেই ধাক্কায়।
সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক বাতি নিভে গেল চারদিকের।
সাবেরা খুশীতে আহমদ মুসার হাত দু’টি ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, সফল মিশন আপনার।
আহমদ মুসা শান্ত স্বরে বলল-সবে কাজ শুরু, খুশী হবার সময় এখনো আসেনি সাবেরা।
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, এখন সময় কত?
-পৌণে বারটা।
-সাবেরা, গাড়ী চালিয়ে টার্মিনাল ভবনের দিকে চল।
-কিন্তু আপনার ফার্স্ট এইড না করে কিছুতেই যাওয়া যাবে না। এখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
-অবাধ্য হয়ো না সাবেরা। ইয়ারপোর্ট সংলগ্ন মার্কোস এভিনিউ-এর ব্রিজ আমাদের এই মুহূর্তেই দখল করতে হবে।
আর কোন কথা না বলে সাবেরা গিয়ে স্টিয়ারিং হুইলে বসল।
গাড়ীটি সবেমাত্র লেক সার্কাস রোডে উঠে চলতে শুরু করেছে, এমন সময় শহরের দক্ষিণাঞ্চল থেকে মেশিনগানের শব্দ ভেসে এলো। শুধু এক জায়গায় নয়, গোটা দক্ষিণ কাগায়ান ট্যা ট্যা র….র….র…. শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে।
প্রথমেই কথা বলল, সাবেরা। বলল, এই অবস্থায় কি আমাদের যাওয়া উচিত হবে?
-ভয় পেয়ো না সাবেরা, ওগুলো পিসিডার মেশিনগান। এতক্ষণ পাওয়ার হাউজের বিষ্ফোরণের অপেক্ষা করছিল, এবার ওরা ঢুকে পড়ছে দক্ষিণের বিভিন্ন পথ দিয়ে। আমাদের গিয়ে ব্রিজ দখল করে শত্রুর সরবরাহ ও যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দিতে হবে।
সাবেরার মুখে ফুটে উঠল সুন্দর এক টুকরো হাসি। বলল, ভয় পাব কেন জনাব, আপনার সাথে থেকে মৃত্যুবরণ করার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করলে আমি ধন্য হব।
-এ মৃত্যু কামনার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই সাবেরা, বরং এটা এক ধরনের অপরাধ।
-শহীদ হবার আকাঙ্খা কি পোষণ করে না মানুষ?
-করে হয় তো কিন্তু ওটা ভুল। শহীদ হলে বিজয় আসবে কার হাত দিয়ে? শহীদের আকাঙ্খা প্রকৃতপক্ষে শত্রুর হাতে বিজয়ের পতাকা তুলে দেবার মতই অপরাধ। সুতরাং আকাঙ্খা শহীদের নয়, গাজী হবার আকাঙ্খা পোষন করতে হবে। গাজী হবার আকাঙ্খা পুরণ করতে গিয়ে যে মৃত্যু আসবে, সেটাই শহীদের মৃত্যু, সম্মানের মৃত্যু-গৌরবের মৃত্যু।
মার্কোস এভিনিউ ধরে ঝড়ের মত ছুটে চলছিল জীপ। দু’জনেই নীরব।
আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করলো, তোমার জীপে কোন অস্ত্র আছে সাবেরা?
-দুটো মেশিনাগান আছে। আর আছে আধা ডজনের মত হাত বোমা।
-কোথায় মেশিনগান?
-উপরে তাকিয়ে দেখুন।
আহমদ মুসা উপরে তাকিয়ে দেখল, জীপের ছাদের সাথে টাঙানো আছে দুটি মেশিনগান। জীপের ছাদের সাথে ওগুলো এমনিভাবে সেটে আছে যে, হঠাৎ করে চোখেই পড়ছে না।
মেশিনগান দু’টো নামিয়ে নিতে নিতে আহমদ মুসা বলল, মাইকেল এ্যাঞ্জেলা ও ডেভিড ইমরানকে তো তুমি চেন? সোভিয়েটের পক্ষ থেকে এখানে কে এসছে জান?
-সোভিয়েট ইনটেলিজেন্সের কমান্ডার অপারেটর এয়াগোমোভিচ।
-আপো পর্বতে কামান্ডো হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে কি জান?
-ওটা ইরগুন জাই লিউমি ও সোভিয়েট ইনটেলিজেন্সের নিজস্ব অপারেশন। ফিলিপাইন ইনটেলিজেন্স এখানে শুধু ‘হস্ট’ -এর ভুমিকা পালন করছে। অবশ্য লাভের সিংহভাগ ফিলিপাইনীদের বরাতেই আসবে।
-কেমন করে? মুসলমানেদর উথাণ এভাবে রোধ করতে পারলেই কি মিন্দানাওয়ে খৃষ্টান স্বার্থের জয় হবে? কমিউনিস্টরা চেষ্টা করবে না তাদের স্থান করে নিতে?
-এটা ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান এবং খৃস্টান মিশনারী কর্মকর্তারা বুঝে। কিন্তু অবস্থার চাপে পড়েছে তারা। রেডিয়েশন বম্ব উদ্ধার করে পেন্টাগণকে ফেরত দিতে না পারলে বড় অসুবিধায় পড়তে হবে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান ও মিশনারী কর্তৃপক্ষকে। রেডিয়েশন বম্ব কেলেংকারী প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে পেন্টাগন ও মার্কিন সরকার যন্ত্রে।
সমগ্র শহর অন্ধকারে ডুবে আছে। অন্ধকারের আলো গিয়ে পড়েছে ব্রীজে। ব্রীজের উপর দু’জন পুলিশ। দু’জনার হাতেই সাব মেশিনাগান। সাব মেশিনগান উচিয়ে দক্ষিণ দিকে চেয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে।
সাবেরা জিজ্ঞেস করলো কি করব জনাব?
আহমদ মুসা বলল, জীপ কার, আরোহীর কারা, তা না জেনে ওরা গুলী করবে না। তাছাড়া অবস্থার আনুকুল্যটা আমাদের দিকেই রয়েছে। আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি, ওরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। তুমি ওদের পাশে গিয়ে গাড়ী থামাও।
আহমদ মুসা মেশিনগান রেখে দিয়ে সাবেরার রিভলভারটি তুলে নিল। সাইলেন্সার লাগানোই আছে তাতে।
গাড়ী ব্রীজের নিকটবর্তী হতেই ওরা হাত তুলে গাড়ী থামাবার ইংগিত করল। রাস্তার পুর্বধার দিয়ে গাড়ী চলছিল এবং ব্রীজের পূর্বদিকের দেয়াল ঘেষে গাড়ীটি দাঁড়িয়ে পড়ল।
গাড়ী দাঁড়াতেই পুলিশ দু’জনের একজন ছুটে এলো গাড়ীর দিকে। কিন্তু দু’তিন পা এগিয়েই সে অষ্ফুট আর্তনাদ করে ঢলে পড়ল মাটিতে।
পর মুহূর্তেই দ্বিতীয় জনের উচিয়ে ধরা সংগিন থেকে ছুটে এলো এক ঝাঁক গুলি। কিন্তু সাবেরা অদ্ভুত ক্ষীপ্রতার সাথে সামনে সরিয়ে নিয়েছিল গাড়ি। গুলীর ঝাঁক গিয়ে ব্রীজের দেয়াল বিদ্ধ করল। এই অবসরে আহমদ মুসার দ্বিতীয় গুলি নিঃশব্দে লক্ষ্য ভেদ করলো। দ্বিতীয় জনও মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ব্রীজের কংক্রিটের মেঝের উপর।
আহমদ মুসা লাফ দিয়ে জীপ থেকে নেমে পড়ল। সাবেরাও নেমে পড়ল সেই সাথে। দুজনার হাতেই দুটি মেশিনগান।
দক্ষিণ কাগায়ানে মেশিনগান ও হাত বোমা বিষ্ফোরনের অবিরাম শব্দ রাতের কালরূপকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছে।
টার্মিনালের বহিরাঙ্গন থেকে ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ পেল আহমদ মুসা।
একটি নয়, একই সঙ্গে কয়েকটি ইঞ্জিন স্টার্ট নিল। আহমদ মুসা সাবেরাকে ইংগিত করে ব্রীজের দক্ষিণ প্রান্তে সরে এলো। বলল, হাত বোমা লও সাবেরা, ট্রাকের বিরুদ্ধে মেশিনগান তেমন কাজে আসবে না।
ব্রীজের উপর দ্রুত অগ্রসরমান পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সাবেরার মেশিনগান উঁচু হয়ে উঠল। আহমদ মুসা বলল, কর কি সাবেরা, শত্রুর পায়ের শব্দ এটা নয়।
মুহূর্তকাল পরেই এসে হাজির হলো আবিদ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ইহুদী কমান্ডোরা ট্রাক বোঝাই হয়ে এদিকে আসছে। আর মাউন্টেন জেট তো রেডি হয়ে আছে। পালাবে না তো বড় ঘুঘুরা?
-উদ্বিগ্ন হবার কারণ নেই আবিদ। এতক্ষণে বিমান ক্ষেত্রের তিন ধারের বেড়া কাটা হয়ে গেছে। আবদুল্লাহ জাবেররা দেখ এসে পড়ল বলে।
আহমদ মুসার কথার রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি। বিমান ক্ষেত্রের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকে একই সঙ্গে গর্জে উঠল অর্ধশত মেশিনগান। ফুলঝুরির মত বুলেটের বৃষ্টি নামল বিমানক্ষেত্রে।
আহমদ মুসা বলল, সাবেরা আবিদ তোমরা এখানে বস, ব্রীজ যেন কেউ পার হতে না পারে। স্মরণ রেখো, উত্তর ও দক্ষিণ কাগায়ানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে তোমাদের।
বলে আহমদ মুসা দ্রুত ব্রীজ পার হয়ে ছুটল টার্মিনাল ভবনের দিকে। মাঝ পথে গিয়ে সে দেখল যে ট্রাকগুলো আসছিল, তা থেমে গেছে। ট্রাক থেকে জমাট অন্ধকারেরর মত মানুষগুলো নেমে টার্মিনাল ভবনের দিকে ছুটছে।
স্টেনগান ধরে রাখা আহমদ মুসার হাত নিসপিস করে উঠল। কিন্তু লোভ সম্বরণ করল সে। আহমদ মুসা ওদের একজন হয়ে ওদের পিছু পিছু চলল। একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে তার দেহে এখনও ফিলিপাইন পুলিশের পোশাক, সুতরাং সুবিধা হলো তার।
সকলের সাথে সেও গিয়ে দাঁড়াল রেস্ট হাউজের দোর গোড়ায়। দরজার সামনে টেবিলে একটি মোমবাতি জ্বলছে। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল এ্যাঞ্জেলো, ডেভিড এমরান ও মিঃ ইয়াগনোভিচ।
কামান্ডার ফিরে যেতে দেখে ডেভিড এমরান বলল, তোমরা তাহলে ফিরে এলে?
কমান্ডোদের মধ্যে থেকে তাদের নেতা এরিক স্যারণ বলল, পিছন থেকে আক্রান্ত হয়ে আর সামনে এগুবার কোন অর্থ হয় না স্যার।
-পিছনে ফিরেও লাভ নেই। প্রথম আঘাতেই বিমান ক্ষেত্রের প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে পড়েছে। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে সবাই। দেখ সবাই পালাচ্ছে।
-কিন্তু পালাবে কোন্ দিকে। ব্রীজও ওরা দখল করে আছে।
-তাহলে ফিলিস্তিনের পুনরাবৃত্তি আমরা এইভাবে ম্বীকার করে নেব? খেদের সঙ্গে বলল মাইকেল এ্যাঞ্জেলো।
-স্বীকার করব কেন? কিন্তু বর্তমান অবস্থায় কাগায়ানের বিচ্ছিন্ন ও বিশৃঙ্খল শক্তিকে সংঘবদ্ধ করার কোন উপায় কি আপনার কাছে আছে মিঃ এ্যাঞ্জেলো?
এ্যাঞ্জেলো নীরব। কোন জবাব এলো না তার মুখে।
ডেভিড এমরানই আবার সখেদে বলে উঠল, ‘‘ডিফেনসিভ ভূমিকাটাই খারাপ।’’ আহমদ মুসা আপো পর্বতে ডিফেনসিভ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না বলে ছুটে এলো কাগায়ানে। আমরা যদি তার ট্রাপে না পড়ে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আপো পর্বতে আঘাত করতাম, তাহলে আহমদ মুসাই ছুটে যেত আপো পর্বতে তার ডিফেন্সের জন্য। আহমদ মুসা যে সুযোগ এখানে পেয়েছে, সে সুযোগ আমরাই সেখানে করে নিতে পারতাম। ডেভিড ইমরানের কন্ঠে অনুশোচনার সুর।
মেশিনগানের গুলী টার্মিনাল ভবনের গায়ে এসে লাগছে। একজন দৌড়ে এসে বলল, তিনটি জেট নষ্ট হয়ে গেছে। পাখা ভেংগে গেছে ওগুলোর। অবশিষ্ট একটি বিমানকে পাইলট টার্মিনাল ভবনের ছাদে নিয়ে এসেছে। ডেভিড ইমরান বলল, কয়জন আর যাওয়া যাবে ওতে।
এ্যাঞ্জেলো বলল, তাহলে সরে পড়ার সিদ্ধান্তই আমাদের নিতে হচ্ছে।
এ্যাঞ্জেলোর কথা শুনে ইয়াগনোভিচের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। এতক্ষণে সে মুখ খুলল। বলল, টার্মিনাল ভবনকে কেন্দ্র করে আমরা যুদ্ধ চালাতে পারি, কিন্তু ফল কি তাতে? আমাদের প্রতিরোধ শক্তির বারো আনাই শেষ হয়ে গেছে, তার সাথে গেছে অস্ত্রও। কিন্তু অস্ত্র জেটে ছিল, তাও আনা সম্ভব হলো না। তাছাড়া মূল শক্তিকেন্দ্র দক্ষিণ কাগায়ানের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সুতরাং হিটলারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে তো লাভ নেই মিঃ এ্যাঞ্জেলো।
টার্মিনালের উত্তর দিকে বিরাট বিষ্ফোরণ ঘটল। পেট্রোল ট্যাংকে আগুন ধরেছে।
কমান্ডো নেতা এরিক স্যারণ জুনিয়র বলল, আপনারা কয়েকজন বিমান নিয়ে সরে যান স্যার। আমরা গাড়ি নিয়ে ব্রীজ পেরুবার আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।
বলেই সে কমান্ডোদের নির্দেশ দিল গাড়ীতে উঠার জন্য। এক সঙ্গে একটি বিদায়ী স্যালুট দিয়ে চলে গেল সাবাই।
মাইকেল এ্যাঞ্জেলা, ডেভিড ইমরান, ইয়াগনোভিচ ও পুলিশ প্রধান কিউই রেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে টর্মিনালের ছাদে উঠার সিঁড়ির দিকে ছুটল। আহমদ মুসা পিছু নিল তাদের।
শুভ্র কপোতের মত দু’টি পাখা বিস্তার করে টার্মিনালের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্টেন জেট। দেখে মনে হচ্ছে কত শান্ত-শিষ্ঠ, কিন্তু আসলে ভীষণ ক্ষীপ্র। পাখীর মত ছোঁ মেরে চোখের নিমিষে মাটিতে নেমে যেতে পারে। পাখির মতই নিঃশব্দ তার গতি। উঁচু-নিচু সব জায়াগাতেই সে সমান ক্ষীপ্রতার সাথে নামতে-উঠতে পারে।
পাইলট ককপিটে বসেছিল উদগ্রীবভাবে। বিমানের অটোমেটিক সিঁড়িটি নীচে নেমে আছে। উদগ্রীব পাইলট ছাদের উপর অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ইয়াগনোভিচের পরিচিত কন্ঠস্বরও তার কানে এলো। খুশী হলো পাইলট-আসছেন ওরা। সে স্টার্ট দিল ইঞ্জিন। হালকা ধরনের হিস্ হিস্ শব্দ উঠল। টেকঅফের জন্য সম্পূর্ণ রেডি মাউন্টেন জেট।
ডেভিড ইমরান প্রথমে গিয়ে পা রাখল বিমানের সিঁড়িতে। কিন্তু দ্বিতীয় পাটি সে তুলতে পারল না। পিছন থেকে ভারী কন্ঠধ্বনিত হলোঃ বিমানে চড়তে চেষ্টা করবেন না মিঃ ডেভিড। হাত তুলে দাঁড়ান।
তারা চার জনেই ঘুরে দাঁড়াল। চার জনের চোখে মুখেই ভয় ও আতংকের চিহ্ন ফুটে উঠল। হাত তুলতে তারা বোধ হয় ভুলে গেল।
আহমদ মুসা তারার আলোকে ওদের অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল। বলল সে, এখনও কিন্তু নির্দেশ পালন করেননি আপনারা। কঠোর কন্ঠ আহমদ মুসার।
আহমদ মুসা কথা শেষ করার সাথে সাথে ৮টি হাতই উপরে উঠল।
তাদেরকে এমনভাবে নির্দেশ করতে পারে এ কে? প্রশ্ন কিলবিল করছে ডেভিড ইমরানের মনে।
টার্মিনাল ভবনের দক্ষিণ ব্রীজের দিকে এই সময় দুটি প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ হলো। আহমদ মুসার চোখ ছুটে গেল ঐ দিকে। ব্রীজের উপর একটি ট্রাক জ্বলছে। পরক্ষণেই মেশিনগানের একটানা শব্দ ভেসে এলো। আহমদ মুসা বলল, দেখতে পাচ্ছেন ডেভিড ব্রীজের উপর কমান্ডোদের কবর রচনার দৃশ্য? খুব আশা করেছিলেন উগান্ডার এন্টেবী দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন আপো পর্বাতে।
কৌতুহল চেপে রাখতে পারল না ডেভিড ইমরান। বলল-তুমিই কি আহমদ মুসা?
‘তোমার কি মনে হয় ডেভিড ? বলতে বলতে আহমদ মুসা কয়েক পা সামনে এগোল। এই সময় হঠাৎ একটি গুলী এসে আহমদ মুসার ডান বাহুর কিছুটা মাংসপেশী ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্ধকার না হলে আহমদ মুসা দেখতে পেত বিমানের পাইলট চুপি চুপি এসে বিমানের দরজায় দাঁড়িয়েছে।
আহমদ মুসা বাম হাত দিয়ে ডান বাহু চেপে ধরে বসে পড়ল। কিন্তু স্টেনগান ছাড়েনি সে।
আহমদ মুসা বসে পড়ার সাথে সাথে ডেভিড ইমরান ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। আহমদ মুসা দেহটা বাঁকিয়ে নিয়েছিল। ডেভিড ইমরান হুমড়ি খেয়ে পড়ল আহমদ মুসার জানুর ইপর।
আহমদ মুসা বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাড়িয়েই কিছুটা পিছনে সরে গেল। ডেভিড উঠে দাড়িয়েছে, ওরা তিনজনই তার দিকে ছুটে আসছে। হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ল আহমদ মুসা আবার। মাথার উপর দিয়ে একটি গুলী চলে গেল। এটাও এলো বিমানের দরজা থেকে। আহমদ মুসার ষ্টেনগান গর্জে উঠল। এক ঝাক গুলী বেরিয়ে গেল। ছুটে আসা ডেভিড ইমরান, ইয়াগনোভিচ, এ্যাঞ্জেলো ও মি: কিউই আছড়ে পড়ল ছাদের উপর।
বিমানের দরজা লক্ষ্যে আর এক ঝাক গুলী বেরিয়ে গেল আহমদ মুসার ষ্টেনগান থেকে। হঠাৎ একটি হিস্ হিস্ শব্দ শুনতে পেল সে। পালাচ্ছে পাইলট।
জেটের ককপিট লক্ষ্য করে আবার ষ্টেনগান তুলে ধরল সে। কিন্তু ককপিটের বুলেট প্রুফ গা থেকে গুলীগুলো ব্যর্থ হয়ে ঝরে পড়ল নিচে। কিন্তু ঘূর্ণায়মান ডানার ক্ষতি হলো, কিয়দংশ তার ভেঙ্গে পড়ল।
সিড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল আহমদ মুসা। তীক্ষ্ণ এক শীষ দিয়ে উঠল সে। জবাবে পদ শব্দ দ্রুত হয়ে উঠল।
ছাদে উঠে এলো ফারুক উনিতো। এখানে আবদুল্লাহ জাবেরের সহকারী সে। তার পিছনে পিছনে উঠে এলো আরও দুই তিনজন।
টর্চ জ্বেলে বিমান সার্চ করে দেখা গেল পাইলট আত্মহত্যা করেছে। ডেভিড ইমরান ও মাইকেল এ্যাঞ্জেলা নিহত। মি: কিউই ও ইয়াগনোভিচ মারাত্মকভাবে আহত। ওদের দুজনার দায়িত্ব এক পিসিডা কর্মীর হাতে তুলে দিয়ে ফারুক উনিতোকে নিয়ে আহমদ মুসা নীচে নেমে এলো। আসতে আসতে জিজ্ঞেস করল, জাবের কোথায় উনিতো?
ফারুক উনিতো প্রথমে কোন জবাব দিল না। পরে বলল, নীচে চলুন জনাব।
ফারুক উনিতোর উত্তরের ধরন দেখে আহমদ মুসার মনটি ছাৎ করে উঠল। দ্রুত নীচে নেমে এলো তারা। নীচের হল ঘরে চার পাঁচজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহমদ মুসা সেখানে গিয়ে পৌছল। ফারুক উনিতোর টর্চ জবলে উঠল। চমকে উঠল আহমদ মুসা। জাবের রক্তে ভাসছে। মেশিনগানের গুলীতে ঝাঝরা হয়ে গেছে তার দেহ। দাঁতে দাঁত চেপে এক প্রবল উচ্ছাস রোধ করলো আহমদ মুসা। তবু চোখের দু’কোণ ফেটে নেমে এল দু’ফোটা অশ্রু।
সবাই নীরব। কথা সরছে না কারো মুখে। অতি শান্ত স্বরে এক সময় আহমদ মুসা বলল, আমার এক অংগ আজ আমি হারালাম ফারুক উনিতো। আমার এ উৎসর্গিত সৈনিক বন্ধু কোন দিন কোন কাজ থেকে পিছু হটেনি। গলার স্বরটি তার রুদ্ধ হয়ে এলো। সজল হয়ে উঠল সবারই চোখ।
আহমদ মুসা একটু পিছনে করে এলা। ফারুক উনিতোকে বলল, এসো, ব্রীজের ওখানে কি হলো দেখি।
দু’জনে এগোলো সেদিকে।
কমান্ডোদের একটি ট্রাকও পার হতে পারেনি। সবক’টিই দাড়িয়ে আছে খালি। তাদের প্রথম ট্রাকটি দাড়িয়ে আছে পুলের উপর। ভেঙ্গে কুকড়ে গেছে। ধুঁয়ায় অন্ধকার তখনও। ট্রাকের কেউই বাঁচেনি। ছড়িয়ে ছিটকে পড়ে আছে তাদের অগ্নিদগ্ধ দেহ। গুলীবিদ্ধ হয়ে মরেছে এমন লাশও ট্রাকের আশেপাশে পাওয়া গেল। সামনের ট্রাকের পরিণতি দেখেও তাহলে কমান্ডোরা মরিয়া হয়ে সামনে এগোবার চেষ্টা করেছিল।
আরো সামনে এগুলো তারা-একদম ব্রীজের দক্ষিণ প্রান্তে। ঐতো মেশিনগানের পাশে সাবেরাকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নড়ছে না কেন? তাদেরকে দেখেও কোন চাঞ্চল্য নেই কেন তার? তাহলে…? আর চিন্তা করতে পারলো না আহমদ মুসা। ছুটে গেল সে। না, সাবেরা নেই। তার হাতটি তখনও মেশিনগানের ব্যরেলে, কিন্তু প্রাণ নেই দেহে। দেহ তার জাবেরের মতই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত সে মেশিনগান চালিয়েছে। বিজয়ী হবার আমৃত্যু সাধনার মধ্যে দিয়ে সাবেরা এই ভাবেই শাহাদাৎ বরণ করেছে। এই মহীয়সী মহিলার বিদেহী আত্মার প্রতি সালাম জানাল আহমদ মুসা।
কিন্তু আবিদ কই ? হঠাৎ ফারুক উনিতো বল উঠল, দেখুন জনাব ট্রাকের তলায় একটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহ।
আহমদ মুসা গিয়ে ঝুঁকে পড়ল ট্রাকের নীচে। টর্চ জ্বেলে খুটে খুটে দেখলো। পুড়ে যাওয়া খন্ড-বিখন্ড নর মাংসের টুকরো। চেনার উপায় নেই। কিন্তু এ দেহ যে আবিদের সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না আহমদ মুসার। ট্রাকের গতি রোধ করার শেষ পন্থা হিসেবে গ্রেনেড বুকে বেঁধে ট্রাকের তলায় সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
এবার কিন্তু কোন দু:খ নয়, গর্বে ফুলে উঠল আহমদ মুসার বুক। এরা বিশ্বজয়ী সৈনিক। এদের দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। আহমদ মুসার মন চলে গেল সুদুর অতীতের এক দু:খজনক ঘটনার দিকে। ইসরাইলের এন্টেবী অপারেশনে উগান্ডার পক্ষে আবিদ, সাবেরা ও জাবেরের মত সৈনিকের অভাব ছিল বলেই বিশ্ববাসীর কাছে লজ্জায় হেট করতে হয়েছিল মুসলমানদের মাথা।
দক্ষিন কাগায়ানের দিক থেকে দু’টি অগ্নি গোলক ছুটে আসছে। ফারুক উনিতো তার ষ্টেনগান উঁচু করে ধরলো। আহমদ মুসা বলল, উনিতো ওটা পিসিডার গাড়ী। আলোক সঙ্কেত দেখে বুঝতে পারছো না? উনিতো ষ্টেনগান নামিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারছি জনাব।
গাড়ী এসে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ী থেকে নামল শরীফ সূরী। ছুটে এলো সে আহমদ মুসার কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল, আপনার জন্য উদ্বেগ উৎকন্ঠায় সকলে আমরা সারা হয়ে গেছি জনাব।
হঠাৎ হাতে ভিজা আঠালো মত কিছু ঠেকায় গাড়ীর আলোতে নিয়ে তা দেখল শরীফ সুরী। রক্ত কোথা থেকে এলো? টর্চ দিয়ে ভালো করে আহমদ মুসাকে দেখে আঁতকে উঠল শরীফ সুরী। গোটা ডান বাহুটাই তার রক্তে ভেজা। কনুই এর ইঞ্চিখানেক উপরে বিরাট ক্ষত। মাথার চুল রক্তে জট পাকানো। প্রায় আর্ত কন্ঠে শরীফ রুরী বলল, এ কি জনাব, আপনি এমনভাবে আহত, অথচ..। কথা শেষ কতে পারলো না শরীফ সুরী। একটি ঢোক গিলল সে।
আহমদ মুসা বলল, আহত আমি একা নই শরীফ। তারপর উনিতোর দিকে ফিরে বললো, সব আহতদের দক্ষিন কাগায়ানের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দাও। আর সতর্ক থেকো। পরে আসছি। বলে সে শরীফ সুরীর সাথে গিয়ে গাড়ীতে বসল। মাথা আর ডান বাহুটা যেন বেদনায় ছিড়ে যাচ্ছে। ঝিম ঝিম করছে। গোটা শরীর।
যেতে যেতে শরীফ সুরী বলল, দক্ষিন কাগায়ানে বড় রকমের কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়নি। ওরা মনে করেছিল আমরা হাজারে হাজারে প্রবেশ করেছি, তাই ঘাবড়ে গিয়েছিল ওরা।
-মৃত্যু ভয়কে যারা বশ করে, তারা একাই একশ’ হয়ে দাঁড়ায়। ওদের মনে করাটা তাই অমুলক নয় শরীফ সুরী। ধীর স্বরে বলল, আহমদ মুসা।
তারপর দুজনেই নীরব। ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে জীপ।