৪
আহমদ মুসা প্রায় মাসাধিকাল ধরে মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমন করলো। সঙ্গে ছিল মুর হামসার। ভ্রমণকালে পিসিডা কর্মী ও মিন্দানাওবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠ আলাপ হলো আহমদ মুসার। এক হাতে ক্রস ও অন্য হাতে বন্দুক নিয়ে এসে জেঁকে বসা উপনিবেশিক খৃস্টান প্রভূদের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে সীমাহীন অসমেত্মাষ সে লক্ষ্য করলো, মুক্তির জন্য তারা অধীর। মিশনারীরা জ্ঞান বিতরণের নামে যে বিদ্যালয়সমূহ এবং চিকিৎসার নামে যে চিকিৎসালয়সমূহ খুলেছে, সেগুলো কেমন করে মিন্দানাওবাসীদের ধর্ম ও জাতীয়তার সমাধি রচনা করছে তার স্পষ্ট নিদর্শন প্রত্যক্ষ করল আহমদ মুসা। মিশনারীদের প্রেমের বাণী যেখানে মিন্দানাওবাসীদের বশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে মিন্দানাওবাসীদের প্রতিরোধ বহ্নি যেখানে জ্বলে উঠছে সেখানে ট্রিপল সি’র বিষাক্ত থাবা গিয়ে মিন্দানাওয়ের অসহায় মানুষের ঘাড়ে চেপে বসছে। এ সবের বহু দৃষ্টান্ত আহমদ মুসা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করলো। আহমদ মুসা অনুভব করলো, মিন্দানাওবাসীদের দুর্জয় সাহস আছে। শুধু এগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলেই মিন্দানাওবাসীরা মুক্তির স্বাদ পেতে পারবে।
আহমদ মুসা মাস খানেক ধরে শুধু নিরর্থক ভ্রমণ করেই কাটালো না। পিসিডার সংগঠনকে নতুন করে সাজাল। সমগ্র মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জকে ৫০ টি অঞ্চলে ভাগ করা হলো। ফিলিস্তিন থেকে ১০০ জন অভিজ্ঞ সাইমুম কর্মীকে আনা হয়েছিল। তাদের থেকে প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য দু’জন করে পাঠানো হলো পিসিডা কর্মী এ স্থানীয় অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় গেরিলা ট্রেনিং ও শিক্ষাদানের জন্য। আহমদ মুসা পিসিডার কেন্দ্রীয় কমিটিকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, সামরিক শক্তি যদি জাতীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনা-নির্ভর না হয় তাহলে তার প্রাণ শক্তি থাকে না। আহমদ মুসার এ পদক্ষেপের ফলে গেরিলা ট্রেনিং শিবিরের পাশাপাশি গড়ে উঠল জাতীয় শিক্ষা জন্য জাতীয় বিদ্যালয়। নতুন উৎসাহের প্রাণ বন্যায় উদ্বেল হয়ে উঠল মিন্দানাও সোলো দ্বীপপুঞ্জের জনজীবন।
আহমদ মুসা নৌবাহিনীও গড়ে তুলল। ‘ট্রিপল সি’র কাছ থেকে দখল করা জাহাজে ৫০টি মেরিন ইঞ্জিন পাওয়া গিয়েছিল। তাই দিয়ে ৫০টি বোট সজ্জিত করা হল। মিন্দানাওবাসীরা ঐতিহ্যগতভাবে দুঃসাহসী নাবিক। সুতরাং অল্প সময়ের মধেই ক্ষুদ্র অথচ এক দক্ষ নৌ-ইউনিট গড়ে উঠল। যে মিন্দানাও সাগর, সোলো সাগর, মরো উপসাগর ও দাভাও উপসাগরে একদিন ক্রস পরিশোভিত মিশনারী ‘ট্রিপল সি’র একচেটিয়া রাজত্ব ছিল, সেখানে আজ পিসিডার কর্মীরাও ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেল। আহমদ মুসা নৌ-সদর দফতর হিসেবে জাম্বুয়াঙ্গোকে মনোনীত করলো। কিন্তু যেহেতু এ সমুদ্র শহরটি ফিলিপাইন সরকারের নামে ট্রিপল সি’র দখলে, তাই আপততঃ শহরটি মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত নৌ-সদর দফতর আপো-সমুদ্র সৈকতেই থাকবে।
সাংগঠনিক সফর শেষে আহমদ মুসা ও মুর হামসার গভীর অরণ্য পথে আপো পর্বতের হেড কোয়ার্টারে ফিরছিল। চলতে চলতে মুর হামসার এক সময় বলল, মুসা ভাই, আমরা পনের বছরে যা পারিনি আপনি পনেরোর দুইগুণ তিরিশ দিনে তা করে ফেললেন।
-এমন করে কথা বলো না বন্ধু, তোমাদের সবই ছিল, আমি তাতে রংয়ের পরশ বুলাচ্ছি মাত্র।
-সার্থক শিল্পি আপনি।
-কারণ আমরা মহিমাময় এক মহাশিল্পীর দাস।
মুর হামসার কথা বলল না কিছুক্ষণ। বলল পরে, এই যে দ্বন্দ্ব সংঘাত এর কি অবসান ঘটবে দুনিয়া থেকে?
-ন্যায়ের পাশে অন্যায় যতদিন থাকবে ততদিন নয়।
-ন্যায় কি অন্যায়ের মূলোচ্ছেদ করতে পারবে না?
-পারতো, যদি ইবলিস এই জমিনে না আসতো।
-তাহলে?
-অন্যায়ের প্রতিবিধান ও প্রতিরোধ সত্য ও সত্যসেবীদের শির চির উন্নত থাকবে, আল্লাহ তার বান্দাদের কাছ থেকে এটুকুই তো কামনা করেন।
-এতো এক অনির্বান সংগ্রামের মহা আহবান।
-ইবলিসের সাথে এই অনির্বান সংগ্রামের ভাগ্যলেখা নিয়েই তো বনি আদম তার যাত্রা শুরু করেছিল এই পৃথিবীর বুকে।
-এ ভাগ্যলেখা কি সকলের জন্য অবধারিত?
-নিশ্চয়ই। যারা এ সংগ্রামের পথ থেকে সরে দাঁড়াবে, যারা অন্যায়ের পদতলে সমর্পন করে দেবে নিজেকে, তারা শুধু কাপুরুষ নয়, তারা মানুষ নামের অনুপযুক্ত। এদের প্রতিই বিধাতার সীমাহীন লানত। জাহান্নাম তো এদেরই জন্য।
কেপে উঠল মুর হামসারের গোটা শরীর। আজ সে যেন প্রথমবারের মত বুঝল, কেন পর্বতের উপর কোরআন নাজিল হলে তা মহাশংকায় ধূলায় বিদীর্ণ হয়ে যেত। অনুভব করলো মুর হামসার বনি আদম এ দুরহ দায়িত্ব পালন করে বলেই আল্লাহর বড় প্রিয় সে এবং সৃষ্টি জগতের রাজ শিরোপা এ কারণেই জুটেছে তার মাথায়।
মুর হামসার আর কোন কথা বলতে পারলো না। আহমদ মুসাও নীরব। বনানীর সবুজ সাগরের বুক চিরে আপো পর্বত অভিমুখে তারা এগিয়ে চলেছে দু’টি প্রানী। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পায়ের শব্দ উঠছে খট্ খট্ খট্।
আহমদ মুসা আগে, মুর হামসার পিছনে আবার কখনো তারা পাশাপাশি সামনে এগিয়ে চলছিল। সামনেই আপোয়ান উপত্যকা।একটি গিরীখাত পেরিয়ে ওপারে গেলেই তারা গিয়ে পৌছবে আপোয়ান উপত্যকায়।
পড়ন্ত বেলা। পশ্চিমের গিরী শৃঙ্গটির আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য। উপরে মেঘের কোলে রোদ চিকচিক করছে, কিন্তু নীচের ধরনী ঢাকা পড়েছে দৈত্যকার এক ছায়ায়।
সামনেই গিরীখাত। গিরীখাতের উপর কাঠের তৈরী একটি সেতু, সেতুটি লতা-পাতার ক্যামোফ্লেজে ঢাকা।
বামপাশে ঘুরে থুথু ফেলতে গিয়েছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ একটি সিগারেটের কার্টুনে নজর পড়তেই সে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল এবং নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে?
রাস্তার ধার থেকে সিগারেটের বাক্সখানা সে ধীরে ধীরে তুলে নিল। ‘রেডক্লাগ’ সিগারেটের বাক্স। সোভিয়েট ইউনিয়নের মিনস্কে তৈরী এ দামী সিগারেট সাধারণতঃ সোভিয়েট অফিসিয়ালসরাই ব্যবহার করে থাকে। আহমদ মুসার সমগ্র অনুভূতি জুড়ে একটি প্রশ্ন জ্বলজ্বল করে উঠলঃ মিন্দানাওয়ের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের এই অজ্ঞাত রাস্তার ধারে এই সিাগারেট এলো কি করে? সিগারেটের বাক্স উল্টিয়ে নিল আহমদ মুসা। একটি লেখার প্রতি নজর পড়তেই ভ্রু-কুঁচকে গেল তার। রুশ হস্তাক্ষর। কে যেন রুশ অংকে একটি হিসাব করেছে। ৩২০ মাইল¸ ১০ = ৩২ ঘন্টা। আরও খুটিয়ে দেখল সে। সিগারেটের বাক্সের ধারে কিছু পরিমাণ মাটি লেগে আছে। মাটি তখনও শুকিয়ে যায়নি। আহমদ মুসা অনুমান করলো, ঘন্টা খানেক আগে কেউ রাস্তার উপর থেকে ওখানে ওটা ছুড়ে মেরেছে। সতর্ক হয়ে উঠল আহমদ মুসা। শিকারী বাঘের মত একবার সে চারিদিকে চাইল।
পাশেই মুর হামসার বোবা দৃষ্টি মেলে চেয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা তাকে জিজ্ঞেস করলো, এখান থেকে জাম্বুয়াঙ্গোর দুরত্ব কত হামসার?
-৩২ মাইলের মত।
-ঠিক?
-হাঁ। কেন?
-কোন উত্তর না দিয়ে আহমদ মুসা আবার জিজ্ঞেস করলো, আমরা ফিরে আসছি আজ হেড কোয়ার্টারে এ কথা কেউ জানে মুর হামসার?
-জানে।
-কে?
-শিরী।
-শিরীকে তুমি কবে জানিয়েছ?
-গতকাল।
-কোন জায়গা থেকে?
-জাম্বুয়াঙ্গো থেকে।
-জাম্বুয়াঙ্গো থেকে?
-হাঁ।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি চিকচিক করে উঠল। যেন কিছু খুঁজে পেয়েছে সে। পুনরায় সে বলল, মুর হামসার, তুমি কী জানিয়েছিলে শিরীকে?
-জানিয়েছিলাম, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রা করছি, পৌছব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল বিকেলের দিকে।
আর কিছু বলল না আহমদ মুসা। মুহূর্তকালের জন্য চিন্তার অতল গভীরে চলে গেল সে। তারপর চোখ খুলে পুলের উপর দিয়ে সামনের রাস্তার দিকে চেয়ে সে বলল, হেড কোয়ার্টারে পৌছার জন্য এ ছাড়া আর কি দ্বিতীয় পথ নেই?
শুকনো কন্ঠে মুর হামসার বলল, না মুসা ভাই। একটু থেমে আবার সে বলল, কি ঘটছে তা কি জানতে পারি?
-নিশ্চয় বন্ধু। কিন্তু এখন নয়, আগে আমরা পৌছি।
-কিন্তু কোন পথে?
-গিরীখাত কত গভীর?
-প্রায় হাজার ফুটের মত।
-এই গিরীখাতের শেষ কোথায়?
-অনেকটা পথ ঘুরে আপোয়ান উপত্যকায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
-চল আমরা গিরীপর্বতের পথ ধরে উপত্যকায় গিয়ে উঠবো।
আহমদ মুসা ও মুর হামসার ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে রাস্তা পিছনে রেখে গিরীপর্বতের পথ ধরল। বড় কষ্টকর এ যাত্রা। মুহূর্তের অসাবধানতায় পা ফসকে গেলে ছয় শ’ হাত গভীরে গিরীর্বতের বুকে চির সমাধি লাভ হবে।
সন্ধার মধ্যেই তারা গিরীবর্তের খাড়া ঢাল পার হয়ে অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গায় গিয়ে পৌছল। পথ চলা সহজতার হয়ে উঠল তাদের। কিন্তু সেই সাথে নেমে এলো রাত্রির কালো অন্ধকার। আকাশে চাঁদ নেই তারার আলোয় তারা পথ চলতে লাগল। মুর হামসার বলল, রাত্রিটা কোথাও বসে কাটিয়ে দিলে হয় না?
আহমদ মুসা বলল, মনে হচ্ছে নতুন এক সংকট সামনে, বসে থেকে সময় নষ্ট করার সময় নেই। এসো আজ একটু কষ্ট করি।
-আমি আমার জন্য ভাবছি না, কিন্তু আপনি অনভ্যস্ত……
-আমার জন্য ভেব না বন্ধু, কি করব এ দেহকে অত মায়া করে!
-আপনার কেউ নেই মুসা ভাই?
-কেন, উপরে আল্লাহ, তার নীচে তোমরা। আর কি চাই?
-কেন, মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা কত কি তো মানুষ চায়?
-চাইলেই সবাই কি তা পেয়ে যেতে পারে?
-কিন্তু চাওয়ার বেদনাও কি আপনার নেই?
-আমি মানুষ। মানবিক বেদনার উর্ধে আমি নই মুর হামসার। কিন্তু মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ফেলে যদি আমি সে বেদনার পশরা মেলে বসি, তাহলে চোখের জল ফেলে আর আকাংখার শূন্য রাজ্যে হাত পা ছুঁড়তেই তো দিন কেটে যাবে।
মুর হামসার আর কিছু বলল না। এই বিরাট মানুষটির লৌহ হৃদয়ের অন্তরালে একান্ত নিজস্ব এক বেদনার নির্ঝরনী বয়ে চলেছে, তা যেন মুর হামসারকেও স্পর্শ করল। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনহীন এই মানুষটি তার হৃদয়ের আরো গভীরে যেন দাগ কেটে বসল।
মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। আপোয়ান উপত্যকা আর বেশী দূরে নেই। দুজনে আগে পিছে ঘনিষ্ঠ হয়ে চলছিল। হঠাৎ আহমদ মুসা থেমে যাওয়ায় মুর হামসার গিয়ে তার সাথে ধাক্কা খেলো। কিছু বলতে যাচ্ছিল মুর হামসার। আহমদ মুসা তার মুখ চেপে ধরল। আঙুল দিয়ে ইষাণ কোণে ইংঙ্গিত করলো। মুর হামসার তাকিয়ে দেখল প্রায় শ’ গজ দূরে হাত দু’য়েকের মত ব্যবধানে বিড়ালের চোখের মত দু’টি অগ্নিপিন্ড।
আহমদ মুসা ফিসফিসিয়ে বলল, খেয়াল কর, বাতাসে দামী তামাকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওখানে বসে কেউ সিগারেট খাচ্ছে।
-কিন্তু কে সিগারেট খাবে ওখানে বসে?
-ওরা কারা?
-রাশিয়ান।
-রাশিয়ান? কেমন করে বুঝলে?
-মিন্দানাওয়ে কি রাশিয়ার সিগারেট আসে? আপো পর্বতের ঘাঁটিতে পিসিডার কেউ কি রাশিয়ান সিগারেট খায়?
-কখনও না।
-তাহলে আপো পর্বতে রাশিয়ান সিগারেট এলো কি করে?
মুর হামসার মুহূর্তকাল ভেবে নিয়ে বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, কিন্তু…..
-কিন্তু, কেন ওরা আসবে, এইতো?
-আমি তাই ভাবছি।
-এর উত্তরও পাবে, এখন এস।
বিড়ালের মত গুড়ি মেরে নিঃশব্দে তারা এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। আহমদ মুসার চোখে ইনফ্রারেড গগলস। দু’জনের হাতেই সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার।
আহমদ মুসা দেখতে পেল দু’জন লোক একটি গুহার মুখে বসে আছে। তাদের থেকে হাতদশেক দুরে একটি পাথরের আড়ালে গিয়ে বসল আহমদ মুসা ও মুর হামসার।
লোক দু’টি নীচুস্বরে আলাপ করছিল। কি বলছিল, তা শোনার জন্য আহমদ মুসা সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল ওদিকে। হঠাৎ মুর হামসার একটি ধাক্কা খেয়ে আহমদ মুসা একপাশে কাত হয়ে পড়ল। বিরাট একটি পাথরের খন্ড তার মাথার এক পাশ ঘেঁষে পড়ে গেল। বিরাট একটি পাথরের খন্ড তার মাথার এক পাশ ঘেষে পড়ে গেল। মাথাটি যন্ত্রনায় ঝিম ঝিম করে উঠলো আহমদ মুসার। আর একটু হলেই মাথাটা গুড়ো হয়ে যেতো একদম। পাথরটি পড়ে যাওয়ার পরক্ষণেই একটি ’দুপ’ শব্দ শুনতে পেল এবং পিছনে একজন আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
আহমদ মুসা মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি সামনে তাকাল। দেখল লোক দু’টি উঠে দাড়িয়েছে। তাদের হাতে রিভলবার। এগিয়ে আসছে তারা। আহমদ মুসা তার রিভলভার উচু করল। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার থেকে নিঃশব্দে দুটি গুলি বেরিয়ে গেল। মাত্র হাত পাঁচেক দুরে লোক দু’টি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
মুর হামসার আহমদ মুসার কাছে সরে এসে বলল, আপনার মাথার আঘাত কেমন মুসা ভাই?
-তেমন কিছু না।
একটু থেমে আহমদ মুসা আবার বলল, আমাদের চুপচাপ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে ওদের আর কেউ আছে কিনা দেখতে হবে।
প্রায় পাঁচ মিনিট চুপচাপ কেটে গেল। কোন সাড়া শব্দ নেই কোথাও। আহমদ মুসা বলল, উঠে দাঁড়াও মুর হামসার, ওদের আর কেউ নেই এখানে। টর্চ জ্বালল আহমদ মুসা।
টর্চের আলো মুর হামসারের গুলিতে নিহত লোকটির মুখের উপর পড়তেই মুর হামসার আঁৎকে উঠে বলল, এযে, আমাদের সিকিউরিটি গার্ড শওকত আলী।
-আমি আশ্চর্য হইনি মুর হামসার। এমন না ঘটলেই আমি বিস্মিত হতাম।
কথা শেষ করে সে বলল, এস এবার আসল দু’টাকে দেখি।
টর্চের আলো ফেলে দু’জনকেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল আহমদ মুসা। দুজনেই রাশিয়ান। দু’জনেরই মাঝারী ধরনের গঠন দেহের।
আহমদ মুসা সার্চ করল ওদের জুতার গোড়ালী থেকে মাথার চুল পর্যন্ত। রিভলভার, মানিব্যাগ ও কয়েক ধরনের ক্ষুদ্র অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না তাদের কাছে।
গুহার মধ্যে টর্চের আলো ফেলল আহমদ মুসা। দু’টি বিছানা পাতা রয়েছে। বিছানা বালিশ দেখে মুর হামসার বলল, এসব তো পিসিডার বালিশ, এখানে এল কেমন করে?
-যেমন করে শওকত আলী। বলে সে মুর হামসারের দিকে চেয়ে বলল, এখানকার কাজ আপাততঃ শেষ চল তাড়াতাড়ি হেড কোয়ার্টারে।
হেড কোয়ার্টারে যখন তারা পৌছিল, তখন রাত তিনটা। আহমদ মুসার মাথার আঘাত বেশ গুরুতরই হয়েছিল। রক্তে তার জামা কাপড় ভিজে গেছে। এক থোপ রক্ত তার মাথার চুলে জট পাকিয়ে গেছে। মুর হামসার আহমদ মুসাকে নিয়ে সোজা পিসিডার ক্লিনিকে গিযে উঠল।
ক্লিনিকে পৌছে আহমদ মুসা মুর হামসারকে বললো, তুমি যাও হামসার। আমি ব্যান্ডেজ নিয়ে আসছি। যাবার সময় আলী কাওসারকে বলে যাও তৈরী থাকতে। আমি শীঘ্রই বেরুব।
আলী কাওসার আপো পর্বতের নিরাপত্তা প্রধান।
মুর হামসার আহমদ মুসার মুখের দিকে একবার চেয়ে আর দ্বিরুক্তি করল না। নীরবে সে পথে নামল আবার। যেতে যেতে ভাবল, এমন গুরুতর আহত তবু এক এক মিনিট বিশ্রামের চিন্তা করছে না। কি ত্যাগ, কি অপূর্ব নিষ্ঠা। এমন নেতার নির্দেশে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যেতেও আনন্দ আছে।
আলী কাওসারের সঙ্গে দেখা করে মুর হামসার বাড়ী পৌছল গিয়ে। নক করল দরজায়। নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট সংখ্যায়। খুলে গেল দরজা। শিরী দরজা খুলে দিয়েছে। মুর হামসারকে সহাস্যে স্বাগত জানাতে গিয়ে তার উপর নজর পড়তেই শিরী উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, তোমার জামায় রক্ত কেন ভাইয়া?
মুর হামসার চকিতে একবার তার জামার দিকে চেয়ে বলল, আহমদ মুসা আহত।
-আহত? কোথায় তিনি? কন্ঠ যেন শিরীর আর্তনাদ করে উঠল। নিজের কন্ঠস্বরে যেন সেও লজ্জা পেল। সংকুচিতা হয়ে পড়ল সে। বোনের দিকে চকিতে একবার চেয়ে মুর হামসার বলল, ক্লিনিকে ব্যান্ডেজ নিয়ে উনি আসছেন।
ধীর স্বরে শিরী বলল, কি ঘটেছে ভাইয়া?
মুর হামসার জামা কাপড় খুলতে খুলতে সমস্ত ঘটনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিরীকে শোনাল।
শিরী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ উত্তেজনা। এক সময় তার চোখ দু’টি ছলছলে হয়ে উঠল। বলল, আপনারা আসছেন, একথা আমাকে জানানোর সাথে এই ঘটনার কোন সম্পর্ক রয়েছে ভাইয়া?
-আমিও বুঝতে পারছিনা বোন?
-উনি আমাকে সন্দেহ করেছেন? শিরীর কন্ঠ ধরে এল।
মুর হামসার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে দরজায় নক্ করার শব্দ ভেসে এল। মুর হামসার উঠে গেল দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।
শিরী উঠে গেল তার ঘরের দিকে। মুর হামসারের সাথে ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। প্রবেশ করেই মুর হামসারকে বলল, তুমি একটু শিরীকে জিজ্ঞেস কর, আমরা আসব, সে কথা তার কাছ থেকে কোন ভাবে অন্যকারো কাছে প্রকাশ পেয়েছিল কিনা?
-এখানেই ওকে ডাকি?
-থাক। এই একটি মাত্রই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে এস।
মুর হামসার চলে গেল পিছন দিকের পর্দা ঠেলে শিরীর ঘরে।
শিরী আহমদ মুসার কথা শুনতে পেয়েছিল। মুর হামসার যেতেই সে বলল, আপনার অয়্যারলেস পেয়েই আমি রুনার মাকে বলেছিলাম, আগামী কাল বিকালে ভাইয়ারা আসবেন, ঘরগুলো পরিষ্কার করতে হবে, তুমি আমার সাথে থেক, ‘থামল শিরী’ পরে বলল, আর কাউকেতো কিছু বলিনি ভাইয়া? গলা কাঁপছে শিরীর।
মুর হামসার চলে গেল। শিরী খাটের রেলিং ধরে যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। তার বিষন্ন মুখে যে অভিব্যাক্তি, তার চেয়ে বহু গুন বেশী বেদনার ভার তার হৃদয়ে।
আহমদ মুসা মুর হামসারের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলল, কাউকে ডেকে রুনার মাকে ডাকতে পাঠাও মুর হামসার। এই মুহূর্তে তাকে আমরা চাই।
-আমিই যাই মুসা ভাই।
-কিন্তু তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে।
-আপনার শতাংশের একাংশ নয়।
-আমি আহমদ মুসা সামান্য মানুষ, কিন্তু তুমি পূর্ব এশিয়ার এক শ্রেষ্ঠ রাজ বংশের সন্তান।
-এগুলো মানুষের কৃত্রিম পোশাক, মানুষ, সে মানুষই।
বলে মুর হামসার উঠে দাঁড়াল। যেতে যেতে সে বলল, আপনি খেয়ে নিন মুসা ভাই, আমি আসছি।
মুর হামসার চলে গেলে আহমেদ মুসা তার কক্ষে চলে গেল। প্রথমেই কাপড় ছাড়ল সে। কক্ষটাকে কেমন যেন নতুন নতুন মনে হচ্ছে তার কাছে। কক্ষের চারিদিকে নজর বুলাল সে, কক্ষটিকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। ঘরের সবকিছু সাজানো গোছানো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বক-সাদা বেডসিড নিখুতভাবে বিছানো। বালিশে নতুন কভার। মাথার পার্শ্বের টিপয়ে একগুচ্ছ রজনী গন্ধা। কাপড় চোপড় আলনায় পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা। সবকিছুর মধ্যে আহমদ মুসা আন্তরিকতার এক নিবিড় স্পর্শ অনুভব করল।
বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। এক মধুর গন্ধে তার মন ভরে গেল। বালিশ বিছানায় মাখানো সেন্ট থেকে এটা আসছে অনুভব করল আহমদ মুসা। এ বিশেষ সেন্ট আরও একদিন সে পেয়েছিল। মনে পড়ল তার সেদিন অজ্ঞানাবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে আসার পর প্রথম এ সেন্টই তার নাকে এসেছিল। মাথার কাছে বসা ছিল শিরী। ভাবল আহমদ মুসা, এ ঘর সাজানো তাহলে শিরীর কাজ। মনে মনে হাসল সেঃ ঘরের শোভা ওরা। ঘরকে তাই এমন শোভামন্ডিত করা ওদের দ্বারাই সম্ভব।
দশ মিনিটের মধ্যে মুর হামসার ফিরে এল। সাথে রুনার মা। মুর হামসারের গৃহের একমাত্র পরিচারিকা। বয়স চল্লিশের কোঠায়।
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে আহমদ মুসা উঠে বসল। রুনার মাকে এক নজর খুটিয়ে দেখে নিল, সে। রুনার মার ঘুম জাগা চোখে-মুখে কেমন যেন একটা উদ্বেগ ফুটে উঠছে।
আহমদ মুসা রুনার মাকে প্রশ্ন করল ঘরের এসব কে সাজিয়েছে?
-কেন, শিরী আম্মা।
-তুমি সাথে ছিলে না?
-জি।
-তুমি জানতে আজ আমরা আসব?
-জি।
-কেমন করে জানতে?
-শিরী আম্মা বলেছিল।
-আচ্ছা রুনার মা, আমরা আজ আসব, একথা তুমি কাউকে বলেছিলে?
-বলেছিলাম।
-কাকে?
-আলী কাওসারকে।
-আলী কাওসার? কোন আলী কাওসার? আপো পর্বতের সিকিউরিটি প্রধান আলী কাওসার?
-জি।
একটু ভেবে আহমদ মুসা প্রশ্ন করল, তুমি তাকে এমনিতেই বলেছিলে, না তোমাকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল?
-সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সাহেবরা কখন আসবে তুমি আমাকে বলতে পার রুনার মা?
-আর কাউকে বলোনি?
-জি না, বলিনি।
-ভেবে দেখ রুনার মা।
-গত দু’দিনে আলী কাওসার ছাড়া কারো সাথে আমার দেখাই হয়নি।
-তুমি এখন যেতে পার।
রুনার মা চলে গেল। আহমদ মুসা মুর হামসারকে জিজ্ঞাসা করল, আলী কাওসারকে তুমি পেয়েছিলে মুর হামসার?
-পেয়েছিলাম।
-ঘরে পেয়েছিলে?
-জি।
-সে ঘুমিয়ে ছিল, না জেগে ছিল?
-জেগে ছিল।
-তার পরণে ঘুমানোর পোশাক, না বাইরের পোশাক ছিল?
-বাইরের পোশাক।
একটু চিন্তা করল। তারপর বলল সে আবার, রাশিয়ানদের পুতুল হিসাবে তাহলে সে-ই এখানে কাজ করছে মুর হামসার। ওর চিন্তাধারা সম্মন্ধে জান কিছু তুমি?
-হো-চি মিন, চে-গুয়ে ভারার ভিষণ ভক্ত সে। ওদের অনেক বই আমি তার কাছে দেখেছি। থামল মুর হামসার। আবার সে বলল, কিন্তু এ ষড়যন্ত্র কি চায়?
-আমার মৃত্যু, সেই সাথে মিন্দানাওয়ের মানুষের ইসলামী চেতনার উৎখাত।
বলে আহমদ মুসা রাশিয়ানদের কাছ থেকে পাওয়া মানিব্যাগ থেকে একটি চিঠি বের করে মুর হামসারের হাতে দিল।
ব্যগ্রভাবে চিঠি হাতে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। লেখা ছিলঃ
কমরেড উচিনভ।
তোমরা পাঠানো রিপোর্ট এখানে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
ফিলিস্তিনের ঐ আপদ কেমন করে মিন্দানাওয়ে গেল আমরা বুঝতে পারছি না। যা হোক, মিন্দানাওয়ে ফিলিস্তিনের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে সেখানে মার্কসবাদের সফল প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, আহমদ মুসাকে মিন্দানাওয়ের মাটি থেকে সরাতে হবে। সরাতে হবে চিরদিনের জন্য পৃথিবীর বুক থেকে। তুমি যার সহযোগিতা পেয়েছ, তাতে সফলতার আশা আমরা করি। তুমি তাকে বলোঃ সেই হবে মিন্দানাওয়ের হো-চি-মিন।
শেষ কথাঃ দক্ষিণ ভিয়েতানাম বিজয়ের প্রধান স্তম্ভ কমরেড জেনারেল শোপিলভকে তোমার সাহায্যে পাঠালাম। তোমার এবং তার এখন একটিই কাজ হবেঃ আহমদ মুসাকে হত্যা করা।
কাগনোয়ারভিট
চেয়ারম্যান
সোভিয়েট ফার ইস্ট ইনটেলিজেন্স
সার্ভিস (ফিলিপাইন শাখা)
চিঠি পড়ে অনেক্ষণ মুখ দিয়ে কথা সরল না মুর হামসারের। অনেকক্ষণ পর সে ধীর কন্ঠে বলল, মিন্দানাওয়ের এই হো-চি-মিন কে হবে মুসা ভাই।
-আলী কাওসার।
-জাতির সাথে এত বড় বিশ্বাস-ঘাতকতা সে করল?
-মুর হামসার কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঘড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, আর কোন কথা নয় মুর হামসার। তৈরী হয়ে নাও এক্ষুনি। কালকের সূর্যোদয়ের পূর্বেই এ বিশ্বাস-ঘাতকদের উৎখাত করতে হবে মিন্দানাওয়ের মাটি থেকে।
মুর হামসার তার কক্ষে চলে গেল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিল। পকেটে রিভলবার। কাঁধে ঝুলছে সাব মেশিনগান। এ ছাড়া একটি গ্যাস রিভলভারও রয়েছে তার বাম পকেটে।
সজ্জিত হয়ে মুর হামসারের ঘরে ঢুকল আহমদ মুসা। মুর হামসারের ঘর থেকে শিরী তার ঘরে যাচ্ছিল। একেবারে আহমদ মুসার মুখোমুখী পড়ে গেল সে। দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জনের। শিরীর অশ্রু-ধোয়া চোখ।
শিরী চলে গেল তার ঘরে। আহমদ মুসা মুর হামসারকে জিজ্ঞারা করল, শিরীর কি হয়েছে মুর হামসার। গম্ভীর কন্ঠস্বর তার।
-ঐ যে আমাদের আসার খবর সে রুনার মাকে বলেছে, এখন সে মনে করছে এটা করে বিরাট অপরাধ সে করে ফেলছে। আমি অনেক বুঝিয়েছি, তবু…..
হো হো করে হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, বলো তাকে, এ ধরনের অপরাধ যারা করে, তাদের চোখে পানি থাকে না, থাকে প্রতিরোধ কিংবা প্রতিশোধের বহ্নি শিখা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বাইরের কড়া নড়ে উঠল। পরিচিত সংকেত। মুর হামসার গিয়ে বাইরের গেট খুলে দিল। প্রবেশ করল আপোয়ান উপত্যকার নিরাপত্তা প্রহরী মুখতার।
মুখতার আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল। হাপাচ্ছে সে। বলল, আমাদের আপোয়ান উপত্যকার ওপারে কাঠের ব্রীজ ধ্বসে গেছে। তার সঙ্গে গার্ড তাওছেরও মারা গেছে।
-ধ্বসে পড়েছে? তোমরা কোন বিষ্ফোরণের শব্দ পাওনি?
-তাওছের ব্রীজের মধ্যখানে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড এক শব্দে ব্রীজটি ভেঙ্গে পড়েছে।
-সংবাদটা আলী কাওসারকে দাওনি?
-তাঁর ঘর বন্ধ। পেলামনা তাকে।
-তার ঘর বন্ধ?
-জি।
আহমদ মুসা দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করল মুর হামসারের সাথে। বলল, দেরী করে ফেলেছি আমরা। মুর হামসার তোমরা এস, আমি চললাম।
-কোথায় যাবেন আপনি?
-আলী কাওসারের খোঁজে।
-কোথায় পাবেন তাকে?
-পাহাড়ের সেই গুহায়। দেরী হয়ে গেলে সেখান থেকে সে ভাগবে।
আহমদ মুসা দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তাঁর পিছে পিছে মুর হামসার এবং মুখতারও।
আহমদ মুসা তীরের ফলার মত নেমে গেল পাহাড় থেকে। তারপর অপোয়ান উপত্যকার সমতল ভূমির উপর দিয়ে সে ছুটছে দক্ষিণ দিকে। মুর হামসাররা অনেক পিছনে পড়ে গেছে তাঁর।
অন্ধকারে হাতড়িয়ে চলছে আহমদ মুসা। টর্চ আছে হাতে, কিন্তু জ্বালাবার সুযোগ নেই। আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলে সামনেই তার শত্রু। আলী কাওসার তাদেরকে অক্ষত দেহে ঘাঁটিতে ফেরতে দেখে ষড়যন্ত্র ফাস হওয়া সম্পর্কে নিশ্চয় সন্দিহান হয়ে পড়েছে। সুতরাং এই গুহায় তার প্রভূদের কাছে সে ছুটে আসবে সেটাই স্বাভাবিক।
পাহাড়ের সেই গুহাটি এসে পড়েছে। আর মাত্র পঞ্চাশ গজের মত। আহমদ মুসা ইনফ্রারেড গগলসটি পরে নিল। হাতে ছয়ঘরা বাঘা রিভলভার। শিকারী বিড়ালের মত হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগল সে।
হঠাৎ তার মনে হল সামনের অন্ধকারটি নড়ছে। যেন এগিয়ে আসছে অন্ধকারটি। আহমদ মুসা থেমে গেল। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগল সে। একটি পাথরের আড়ালে সে মাথা গুঁজে হামাগুড়ি দিয়ে বসে রইল। অন্ধকারটি তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। আলী কাওসারকে সে পরিষ্কার চিনতে পারল। আলী কাওসারের পিছনে আর কাউকে না দেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা। পিছু নিল সে আলী কাওসারের। পিছনে পদশব্দ শুনে আলী কাওসার থমকে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা গম্ভীর কন্ঠে বলল, ফিরতে চেষ্টা করোনা। যেমন যাচ্ছ, তেমনি এগিয়ে যাও।
কিন্তু আহমেদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই আলী কাওসারের একটি হাত বিদ্যুৎ গতিতে উপরে উঠে এল।
আহমদ মুসা ট্রিগারে হাত রেখেই কথা বলছিল। সুতরাং আলী কাওসারের তর্জ্জনি তার ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই আহমদ মুসার তর্জ্জনি চাপ দিল তার ট্রিগারে । একটি বুলেট আলী কাওসারের ডান বক্ষ ভেদ করল। আহমদ মুসা চেয়েছিল তার ডান হাতে গুলী করতে, কিন্তু আলী কাওসারের ডান হাতের বৃদ্ধাংগুলি ছুয়ে তা লাগল গিয়ে বুকে।
আর্তনাদ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল আলী কাওসারের দেহ।
মুর হামসাররা এসে পড়েছে।
টর্চের আলো জ্বলে উঠল।
রক্তে ভাসেছে আলী কাওসারের লাশ।
আহমদ মুসা ধীর কন্ঠে বলল, চেয়েছিলাম ওকে জীবন্ত ধরতে কিন্তু পারলাম না। বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সে।
-এ বিশ্বাস-ঘাতকদের হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি অব্যাহতি পাওয়া যায়, ততই লাভ। মুর হামসার বলল।
-কিন্তু আলী কাওসারের মৃত্যুর সাথে সাথে আমরা এই য়ড়যন্ত্রের সাথে লিংক হারিয়ে ফেললাম। শিকড় আরো রয়ে গেল কি না!
-ষড়যন্ত্র থাকলে লিংক আমরা পাবই, যেমন এক সিগারেটের কেস থেকে এতবড় এক ষড়যন্ত্রের উদঘাটন হল। থামল মুর হামসার। বলল, সে আবার, আচ্ছা মুসা ভাই, আমি বুঝতে পারছিনা, আপনি ব্রীজের উপর দিয়ে না গিয়ে এদিকে এসেছিলেন কেন?
-রাশিয়ান সিগারেটের প্যাকেট এবং তাতে রুশ ভাষায় হস্তাক্ষর থেকে নিশ্চিত বুঝলাম, এখানে এক বা একাধিক রাশিয়ানের আগমন ঘটেছে। তারপর যথন অনুভব করলাম আজ এই সময় আমরা পৌছব এটা এখানে প্রকাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং সবশেষে যখন দেখলাম আমরা ব্রীজের গোড়ায় পৌছার কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত রাশিয়ানরা এখানে অপেক্ষা করে গেছে তখন বুঝলাম, নিশ্চয় কোন ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে আমাদের জন্য। ব্রীজটি যতটা আমি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম সন্দেহের কিছু পাইনি। কিন্তু জানতাম এক ধরনের ম্যাগনেটিক মাইন আবিষ্কৃত হয়েছে, যার চারিদিকে সূক্ষাতিসূক্ষ তার বিছানো থাকে, মানুষের দেহ সে তার স্পর্শ করলেই মাইনে বিষ্ফোরণ ঘটে। আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল, ব্রীজের লতা-পাতার ক্যামফ্লেজে সে রকম কোন তার জড়ানো রয়েছে। থামল আহমদ মুসা। একটু পরে বলল, আমার সন্দেহ সত্যি পরিণত হয়েছে। তাওছের ম্যাগনেটিক মাইনের তারেই জড়িয়ে পড়েছিল।
-আপনার দুরদর্শিতা এক বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করল মুসা ভাই।
-কথাটা বড় ব্যক্তিকেন্দ্রীক হল মুর হামসার। এসব সাফল্যের কৃতিত্ব কোন ব্যক্তির নয়, সমষ্টির।
-ব্যক্তির ভূমিকার কি কোন মূল্য নেই এখানে?
-আছে, যেমন দেহের একটি অঙ্গের মূল্য। দেহেক বাদ দিয়ে অঙ্গের পৃথক কোন কৃতিত্ব নেই। সংগঠনও তেমনি দেহের মত। এখানে যদি ব্যক্তি চেতনা ও ব্যক্তি-কৃতিত্বের অহমিকা মাথা তুলে দাড়ায়, তা হলে সংগঠনের ‘সীসার প্রাচীর’ (বানিয়ানুম মারসুস) দেখা দেবে ফাটল।
মুর হামসার মৃগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছিল তার প্রিয় নেতার দিকে। নতমুখে দাড়ানো মুখতার এবং পিসিডার কর্মীদের চোখে ঝরে পড়ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা ও বিস্ময়।
পূর্ব আকাশ তখন সফেদ হয়ে উঠছে। স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে সোবেহ সাদেকের বাতাস।