৫
ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান পাগল হয়ে উঠেছে। জলজ্যান্ত জাহাজটি গেল কোথায়? বানিও সেলিবিসের মধ্যে দিয়ে জাহাজটি যখন মাকাসার প্রণালী পার হচ্ছিল তখনও জাহাজটি দিভাও-এর সাথে রেডিও লিংক বজায় রেখেছে। তারপর সেলিবিস সাগর থেকে জাহাজ যাবে কোথায়?
ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান ও ইরগুন জাই লিওমির যৌথ অনুসন্ধানকারী দল গত এক মাসে সোলো সাগর, সেলিবিস সাগর, মরো উপ-সাগর ও দিভাও উপ-সাগর চষে ফেলেছে। ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান আর কিছু নয় চায় শুধু রেডিয়েশন বম্ব। আবদুল্লাহ হাত্তাকে তো মেরেই ফেলা হয়েছে। সুতরাং জাহাজের ১০০টি রেডিয়েশন বম্ব ফিরে পেলে জাহাজ শুদ্ধ সবকিছু চুলোয় যাক ক্ষতি নেই। আর ইরগুন জাই লিউমি আঙুল কামড়াচ্ছে আহমদ মুসাকে হাতে পেয়ে হারিয়ে। একবার ওকে হাতের মুঠোয় পেলে ফিলিস্তিনের বিজয় উলল্লাসকে তারা থামিয়ে দিতে পারতো।
সুতরাং তারা হন্যে হয়ে খুঁজছে সব জায়গা। সেলিবিস সাগর থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত কোন দ্বীপের উপকুল অঞ্চলও তারা বাদ দেয়নি। মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জের সমগ্র উপকুল তারা আতি পাঁতি করে খুঁজেছে। কিন্তু না পেয়েছে তারা জাহাজ না পেয়েছে তারা কোন সূত্র। পাবে কেমন করে? জাহাজটি আপো পর্বতে পৌছার দু’দিন পরেই আহমদ মুসার নির্দেশে উত্তর মিন্দানাওয়ের দুর্গম ও সংকীর্ণ ফাগায়ান উপসাগরে ওটাকে ডুবিয়ে ফেলা হয়েছে।
দীর্ঘ একমাস অনুসন্ধানের পর ক্লান্ত শ্রান্ত অনুসন্ধানকারী দল মিন্দানাওয়ে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের হেড কোয়ার্টার দিভাওয়ে ফিরে এলো।
রিপোর্ট শুনে মিন্দানাওয়ের ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান প্রধান মাইকেল এঞ্জেলো রাগে দুঃখে চুল ছিড়তে লাগল। রেডিয়েশন বম্ব কেলেঙ্কারী প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ওগুলো পাওয়ার পথই শুধু বন্ধ হয়নি, সংগঠনের মাথার উপর বিপদের খাড়াও ঝুলছে। কিন্তু এত কিছু করে লাভ হলো কি? পরীক্ষামূলক দু’টি বম্ব ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না তারা। সব রাগ গিয়ে পড়ল অনুসন্ধানকারী দলের নেতা জন উইলিয়ামের উপর। মাইকেল এঞ্জেলা দাঁত খিঁচিয়ে বলল, অপদার্থ তোমরা। জাহাজ নিশ্চয় আছে কোথাও। রেডিয়েশন বম্বের খবর সেই জাহাজ সূত্র থেকেই খবরের কাগজে প্রকাশ পেয়েছে এবং এটা করেছে এ দেশের নেটিভ মুর শয়তানরাই। তা না হলে খবরটি এম পি আই পেল কি করে?
ক্রিং ক্রিং ক্রিং। মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর লাল টেলিফোনটি বেজে উঠল। বিরক্তির সাথে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল সে।…………
মাইকেল এ্যাঞ্জোলোর পাঁচ তলা ভবনটির নীচে প্রায় ১০০ গজ দূরের একটি পাইলক টেলিফোন বুথে কানে টেলিফোন এলো- কে? মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর কন্ঠ।
-লিলিয়েভ। সোভিয়েট ফার ইস্ট ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের একটি চিঠি নিয়ে এসেছি।
-কার জন্য?
-আপনার নামে।
-আমার নামে? আমি কে?
-মাইকেল এ্যাঞ্জেলো। ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের মিন্দানাও প্রধান।
-আসুন।
-কখন আসব, এখনি?
-না, এখন আমি ব্যস্ত। আগামীকাল সকাল ন’টা।
-আচ্ছা। বলে টেলিফোন রেখে দিল লিলিয়েভ।
লিলিয়েভ টেলিফোনের রিসিভার রেখে দেবার সাথে সাথে একজন লোক টেলিফোন বুথের বন্ধ দরজার সামনে থেকে সরে গেল। এতক্ষণ সে দরজার ফুটায় কান লাগিয়ে কথোপ-কথন শুনছিল। লোকটি দ্রুত একটি দ্বিতল হোটেলে গিয়ে উঠল।
লোকটি আবদুল্লাহ জাবের। কায়রো থেকে তাকে এনে দিভাও-এ রাখা হয়েছে। দিভাও পিসিডা শাখার অধিনায়ক সে।
এখানে তার পরিচয়ঃ একজন নেটিভ খৃস্টান। ম্যানিলায় রেস্টুরেন্ট চালাত। উন্নতির আশায় এসেছে দিভাওয়ে। হঠাৎ সে হোটেলটি পেয়ে কিনে নিয়েছে। আবাসিক এ হোটেলটিতে মোট ২১ টি কক্ষ। এর একটিতে আবদুল্লাহ জাবের নিজেই থাকে। আবদুল্লাহ জাবের এখানে কলিন্স নামে পরিচিত। সবাই জানে লোকটি বড় আমুদে। অল্পদিনেই সে সবার সাথে সম্পর্ক পাতিয়েছে। দেড়শ’ গজ দুরের ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান হেড কোয়ার্টারের সবাই এখন তার ঘনিষ্ঠ খদ্দের।
টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে লিলিয়েভ মেয়েটাও এসে হোটেল ঢুকল। আজ ভোরে সে ম্যানিলা থেকে দিভাও এসেছে। সোজা এই হোটেলেই এসে উঠেছে সে।
লিলিয়েভ রাশিয়ান মেয়ে। কিন্তু তার দেহে জাপানী বৈশিষ্ট্যই যেন বেশী। বয়স ২৪/২৫ এর বেশী হবে না। উচ্ছ্বল যৌবনে অপরূপ লাবন্যের মোহনীয় প্রলেপ।
মিনিস্কার্ট পরে মাজা দুলিয়ে হাইহিলের গট্ গট্ শব্দ তুলে যখন লিলিয়েভ হোটেলের করিডোর দিয়ে প্রবেশ করছিল, তখনি আবদুল্লাহ জাবের স্বগতঃ কন্ঠে বলেছিল, ভদ্রে, হয় তুমি বল্লাক মার্কেটের, নয় কোন ভয়ংকর এজেন্ট, নতুবা হবে কলগার্ল।
কিন্তু কোনটি?
এই জবাব পাবার জন্যই আবদুল্লাহ জাবের চোখ রেখেছিল তার প্রতি।
কিন্তু যে জবাব পেল, তা রাতের ঘুম কেড়ে নিল। সোভিয়েট ফার ইস্ট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের এজেন্ট দিভাওতে কেন। পশ্চিমী সন্ত্রাসবাদী সংস্থার কাছে কি চিঠি বয়ে এনেছে লিলিয়েভ? আপো পর্বতে কুপোকাত হবার পর আবার কোন চাল শুরু করেছে তারা।
শেষে মনে মনে একটি বুদ্ধি স্থির করে খুশীতে গুনগুন করে উঠল আবদুল্লাহ জাবের।
নতুন বোর্ডারদের রুমে রুমে শুভেচ্ছা সফর আবদুল্লাহ জাবেরের বিশেষ একটি অভ্যাস।
এই শুভেচ্ছা সফরে সেদিন রাত সাড়ে ন’টায় সে গিয়ে নক করল লিলিয়েভের রুমে।
কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। ভিতর থেকে চাবি খোলার খুট খাট শব্দ এল। দরজা খুলে গেল।
দরজা খুলে আবদুল্লাহ জাবেরকে দেখেই লিলিয়েভ সহাস্যে বলে উঠল, হ্যাল্লো মিঃ কলিন্স, হাউ-ডু-ইউডু আসুন আসুন।
-ও! অল রাইট লিলিয়েভ। বলতে বলতে ঘরে ঢুকল আবদুল্লাহ জাবের।
লিলিয়েভ গিয়ে সোফায় বসল। ওর গায়ে জড়ানো ছিল বড় এক তোয়ালে। ছুড়ে ফেলে দিল তা দূরে। তার গোটা দেহে এখন মাত্র দু’চিলতে কাপড় অবশিষ্ট রইল।
ঘরের চারদিকে নজর বুলাল জাবের। লিলিয়েভের সামনের টেবিলে ছিল একটি রিভলভার, একটি সিগার কেস ও একটি লাইটার। ঘরে আর বাড়তি জিনিসের মধ্যে রয়েছে একটি ব্রিফকেস ও একটি সাইড ব্যাগ।
আবদুল্লাহ জাবের সোফায় বসতে বসতে রিভলভারটির দিকে ইংগিত করে বলল, ও বস্তুটি সরিয়ে নিন মিস লিলিয়েভ, আপনার মত মনোরমার সাথে কোন ঝগড়া-ঝাঁটি আমার নেই।
খিল খিল করে হেসে উঠল লিলিয়েভ। বলল, ‘ইউ আর ইন্টারেষ্টিং মিঃ কলিন্স।’ বলে সে রিভলভার ছুড়ে দিল বিছানার উপর।
-এন্ড নাও মিস লিলিয়েভ কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে নিলেই ভাল হয়।
-কেন?
-শান্ত মনে দুটো কথা বলতে পারি।
-মন অশান্ত হওয়ার কি ঘটেছে?
-তোমার অবারিত ওই উত্তাপ?
আবার সেই ঠান্ডা খিলখিল হাসি। বললো সে, সত্যিই তুমি এক প্রাণবন্ত পুরুষ মিঃ কলিন্স। কিন্তু এর পরের আবদারটা হবে কি শুনি।
-মিস লিলিয়েভ ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের জন্য কি সংবাদ বহন করে এনেছো?
লিলিয়েভ বিস্মিত হলো না, নড়ে চড়ে বসল। সেই ঠান্ডা হাসি তার মুখে। বলল, জানতাম এ প্রশ্ন তোমার কাছ থেকে আসবে, কিন্তু এমন সহজ আব্দার হয়ে আসবে, তা ভাবিনি। তুমি কে মিঃ কলিন্স?
-ইরগুণ জাই লিউমি’র ডেভিড আব্রাহাম। আজ একমাস ধরে কলিন্স সেজে হোটেল খুলে বসে আছি আমি।
-প্রমাণ?
-তুমি যে সোভিয়েট ফার ইস্ট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের লিলিয়েভ তার প্রমাণ?
লিলিয়েভ কোন উত্তর দিল না। আবদুল্লাহ জাবেরের চোখে চোখ রেখে কি ভাবছিল। বলল, পাবলিক টেলিফোন বুথে তোমার আড়িপাতা আমি ধরে ফেলতে পেরেছি, কিন্তু আমাকে তুমি সন্দেহ করেছিলে কখন?
-ম্যানিলা থেকে আমাকে জানানো হয়েছিল।
-কিন্তু আমরা ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের জন্য যে সংবাদ বহন করে এনেছি, তা তোমরা জানতে চাও কেন?
-তার সবটুকু আমরা জানতে চাই না, হারানো জাহাজ সম্পর্কে কিছু থাকলে সেটা আমরা জানতে চাই।
-ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের হারানো জাহাজের সাথে ইরগুন জাই লিউমির সম্পর্ক?
জাহাজে ছিল আহমদ মুসা জাহাজের সন্ধান পেলে তারও সন্ধান মিলবে।
-কিন্তু এটা তো ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের কাছ থেকেও জানতে পার।
-না, আমরা আর ওদের মুখাপেক্ষী হতে চাইনে।
৫০ মিলিয়ন ডলার আমরা পানিতে ফেলে দিতে চাইনে আর।
মিটি মিটি ঠান্ডা হাসি হাসছে লিলিয়েভ। সিগারেট কেস থেকে একটি সিগারেট বের করে হাতে নিল। বলল, কিন্তু তুমি কেমন করে বুঝলে যে সোভিয়েত ফার ইস্ট ইনটেলিজেন্স সার্ভিস খয়রাতি প্রতিষ্ঠান? পায়ে হেঁটে এসে এমনি এমনি তোমার পকেটে দিয়ে যাবে খবর?
-আহমদ মুসার উৎখাতের মধ্যে আমাদের কমন ইন্টারেস্ট রয়েছে লিলিয়েভ।
-তাহালে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানকে এ থেকে বঞ্চিত করতে চাও কেন?
-বঞ্চিত নয়, ওদের উপর নির্ভরশীল হতে চাইনা।
-হু। বলে সিগারেটটি মুখে পুরে দিল লিলিয়েভ।
আবদুল্লাহ জাবের লিলিয়েভের চোখের দিকে মুহূর্তের জন্য চেয়ে এক ঝটকায় উঠে দাড়িয়ে লিলিয়েভের মুখ থেকে সিগারেটটি কেড়ে নিতে নিতে বলল, রিভলভারের চেয়েও বড় সিরিয়াস, এর আলপিন হেডড বুলেট।
অদ্ভুত শক্তিশালী নার্ভ লিলিয়েভের। কোন ভাবান্তর এলনা তার মধ্যে। সাপের মত ঠান্ডা সেই নিঃশব্দ হাসি দেখা দিল তার ঠোঁটে। বলল, আমি যতটা মনে করেছিলাম, তার চেয়েও বেশী চালাক তুমি। এস শক্রতা ভুলে গিয়ে আমরা বন্ধু হই।
-কিন্তু তার আগে তোমার হাতের ঐ লাইটার ফেলে দাও। ওতে গ্যাস চেম্বার নেই কে বলবে?
লাইটারটি বিছানার উপর ছুঁড়ে দিতে দিতে লিলিয়েভ বলল, বড় শক্ত চিজ তুমি।
থামল লিলিয়েভ। একটু পরে আবার বলল, তুমি আমাকে জান, আমিও তোমাকে জানি। তুমি শক্তিমান, সুদর্শন, তীক্ষ্ণধী। তোমাকে বন্ধু হিসাবে পেলে আমি সুখী হব মিঃ কলিন্স।
চোখ দু’টি চক্ চকে হয়ে উঠেছে লিলিয়েভের।
-কিন্তু শত্রুতার কোন সুযোগ, কোন উপায়কেই তো তুমি হাতছাড়া করছ না।
লিলিয়েভ হাসল। বলল নিশ্চয়তা দাও, চিঠিটি তুমি চাইবে না।
-বন্ধুর প্রতি বন্ধুর এই কি মনোভাব।
-চিঠির সাথে আমাদের স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত।
কত কোটি টাকা নিয়ে সোভিয়েট ইনটেলিজেন্স সার্ভিস ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানকে জাহাজ সম্পর্কে তথ্য পরিবেশন করছে?
প্রথমবারের মত লিলিয়েভের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কিন্তু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে বলল, টাকার স্বার্থ নেই, স্বার্থটি অনেক বড়।
-কি সে স্বার্থ?
অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু এ প্রশ্ন? এর সাথে ইরগুন জাই লিউমি’র কোন সম্পর্ক নেই।
-নিশ্চয় আছে আমরা যদি সে মূল্য দিয়ে সে চিঠি কিনে নিতে পারি?
-তা যদি সম্ভব হতো আমার আপত্তি ছিল না।
কথাটি শেষ করেই লিলিয়েভ এসে আবদুল্লাহ জাবেরের পাশে বসল। তার মসৃণ উরুটি আবদুল্লাহ জাবেরের উরু স্পর্শ করেছে। ও সোফায় হেলান দিয়ে বসেছে। দু’টি হাত দু’দিকে সোফার উপর দিয়ে প্রসারিত। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে তার উন্নত বুকের উঠা-নামা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নীরব লিলিয়েভ।
আবদুল্লাহ জাবের বলল, দুনিয়ায় কি অসম্ভব কিছু আছে লিলিয়েভ?
লিলিয়েভ আবদুল্লাহ জাবেরকে জড়িযে ধরে বলল, ওসব সম্ভব অসম্ভবের কথা এখন থাক মিঃ কলিন্স। এস আমরা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাই সব।
আবদুল্লাহ জাবেরের ঠোটে খেলে গেল এক টুকরা হাসি। বলল সে, এটাই তোমার শেষ অস্ত্র লিলিয়েভ?
লিলিয়েভের হাতের বাঁধন দৃঢ়তর হলো। বলল সে, আবার সেই কথা। এসো না আমরা কিছুক্ষণের জন্য চাকরির জগত থেকে দূরে সরে যাই।
আবদুল্লাহ জাবেরের বাম কাঁধে লিলিয়েভের মাথা। ওর নরম ওষ্ঠাধরের উষ্ণ স্পর্শ সে অনুভব করছে তার গলায়। এক নির্মল শুড়শুড়ি ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দেহে। লিলিয়েভের ডান হাত জড়িয়ে রয়েছে তার গলা। আর তার বাম হাত আবদুল্লাহ জাবেরের জানুর উপর ছড়িয়ে রাখা ডান বাহুর উপর ন্যস্ত। লিলিয়েভের বাম হাতের মধ্যমায় একটি আংটি। বড় রকমের নীলাভ পাথর বসানো আংটিতে। পাথরের ঠিক মধ্যখানে সুক্ষ একটি ফুটো চোখে পড়ল আবদুল্লাহ জাবেরের। চেতনার দুয়ারে একটা কথা ঝিলিক দিয়ে গেল তার ডেথরিং-মৃত্যু আংটি।
ম্পাইগার্লদের একটা মোক্ষম অস্ত্র এই ডেথরিং। আংটির পাথরে একটু চাপ পড়লেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সূচের অতি তীক্ষ অগ্রভাগ। ভয়ংকর পটাসিয়াম সাইনাইড মাখানো তাকে তার মাথায়। শেষ অস্ত্র এটা স্পাইগার্লদের। কামনার জালে বেঁধে প্রতিদ্বন্দ্বীকে সে তুলে নেয় বুকে। তারপর নায়ক যখন উন্মুক্ত কামনার অথৈ স্রোতে ভুলে যায় নিজেকে, ভুলে যায় সব কিছু। তখন আস্তে করে সে ডেথরিং চেপে ধরে তার দেহে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খেলা সাঙ্গ হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী ঢলে পড়ে নীল মৃত্যুর কোলে।
আবদুল্লাহ জাবের লিলিয়েভের বাম হাতটি তুলে নিল হাতে। মুখনীচু করে ফিসফিসে কন্ঠে ডাকল, লিলিয়েভ।
লিলিয়েভ কোন কথা বলল না। মুখ উচু করে ওষ্ঠাধার মেলে ধরল। ধীরে ধীরে তা এগিয়ে এল আবদুল্লাহ জাবেরের ঠোট লক্ষ্যে।
আবদুল্লাহ জাবের মুখ ঈষৎ উঁচু করে বলল, কত লোককে এই ডেথ রিং দিয়ে হত্যা করেছ লিলিয়েভ?
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল লিলিয়েভ। এক লাফে গিয়ে রিভলভার তুলে নিল সে। চোখ ওর ধকধক করে জ্বলছে। রিভলভারের নল আবদুল্লাহ জাবেরের কপাল লক্ষ্যে চেয়ে আছে।
ঘটনাটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, আবদুল্লাহ জাবের বিস্ময় বিমুঢ় হয়ে পড়ল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। সে লিলিয়েভের চোখে চোখ রেখে বলল, দেবী যে বাহুপাশ থেকে একেবারে রণভূমে? আমি খারাপ তো কিছু বলিনি।
-আমার বাহুপাশ থেকে তুমিই প্রথম জীবিত বেরিয়ে গেলে। ডেথরিং থেকে বেঁচেছো, কিন্তু এ বুলেট তোমাকে খাতির করবে না।
-কিন্তু আমার দোষটা কোথায়?
আবদুল্লাহ জাবেরের চোখে কিন্তু পলক পড়েনি। লিলিয়েভের চোখও যেন গেথে আছে তার চোখের সাথে।
আবদুল্লাহ জাবেরের সামনে একটি কাঠের টিপয়, তারপর সোফা। সোফার ওপারেই দাড়িয়ে আছে লিলিয়েভ। দুরত্ব প্রায় ৩ গজের মত। ইঞ্চি ইঞ্চি করে আবদুল্লাহ জাবের টিপয়ের দিকে এগুচ্ছিলো। টিপয় পায়ের নাগালে আসলে একবার দেখা যেত।
-তুমি চালাক, আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমাকে ফাকি দিতে তুমি পারনি। তুমি জাননা, ইরগুণ জাই লিউমির সাথে আমাদের আগেই চুক্তি হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত সাগর তলার ‘ঘুমন্ত ক্ষেপনাস্ত্র’ সম্বন্ধনীয় গোপন তথ্য সরবরাহের বিনিময়ে আমরা ওদের আহমদ মুসা সম্পর্কিত তথ্যাদি দিয়ে দিয়েছি। সোলো সাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যবর্তী ‘পাল-ওয়াং’ দ্বীপ যদি ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান আমাদের দিতে রাজী হয় তাহলে ওদেরকেও আমরা জাহাজ ও রেডিয়েশন বম্ব সম্পর্কিত সব খবর দিয়ে দিব।
কথা বলার সময় লিলিয়েভের চোখ আনন্দে চিক্ চিক্ করছিল।
কাঠের টিপয়টি আবদুল্লাহ জাবেরের পায়ের আওতায় এসে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটা লিলিয়েভের দৃষ্টি এড়াল না। বলল সে, আর এক ইঞ্চি সামনে এগিও না, গুড়ো করে…..
কিন্তু কথা তার শেষ হলো না। আবদুল্লাহ জাবেরের পা বিদ্যুৎ গতিতে উপরে উঠল। এক নিখুঁত আঘাতে কাঠের ক্ষুদ্র টিপয়টি ছুটে চলল লিলিয়েভের মাথা লক্ষ্যে।
একটু সরে দাঁড়িয়েছিল লিলিয়েভ। রিভলভারের নল সরে গিয়েছিল। এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল আবদুল্লাহ জাবের। সে সোফার উপর দিয়ে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল লিলিয়েভের উপর। লিলিয়েভের তর্জ্জনি রিভলভারের ট্রিগার চেপে ধরল বটে, কিন্তু গুলী গিয়ে পড়ল দক্ষিণের দেয়ালে।
রিভলবার কেড়ে নিল আবদুল্লাহ জাবের। কিন্তু লিলিয়েভ দাঁত দিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে কামড়ে ধরেছে তার বাম বাহু। দাঁত বসে যাচ্ছে তার চামড়া কেটে ভিতরে। লিলিয়েভের ডেথরিং এর শিতল স্পর্শ অনুভব করল আবদুল্লাহ জাবের তার বাম পাজরে। প্রচন্ড এক ধাক্কায় সে সরিয়ে দিল লিলিয়েভকে। ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করল জাবের তার বাম বাহুতে। বাম বাহুর খানিকটা মাংস তুলে নিয়ে গেছে লিলিয়েভ। রক্তে ভিজে গেছে লিলিয়েভের মুখ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আবদুল্লাহহ জাবেরের বাম বাহু।
-রক্তপায়ী ডাইনি। বলে এক প্রচন্ড লাথি মারল লিলিয়েভের তলপেটে। বসে পড়ল লিলিয়েভ। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়ল মেঝেতে।
লিলিয়েভের ব্রিফকেস, সাইডব্যাগসহ সমগ্র ঘর আতি-পাতি করে খুঁজল আবদুল্লাহ জাবের। কিন্তু চিঠি কোথাও পেল না। শেষে ওয়েষ্টপেপার বাস্কেটের তলায় সে পেয়ে গেল চিঠিটি।
চিঠিটি পকেটে পুরে লিলিয়েভকে বেঁধে বিছানায় শুইয়ে রেখে দরজার চাবি এঁটে বেরিয়ে এলো জাবের।
আবদুল্লাহ জাবেরের কক্ষে উৎকণ্ঠিতভাবে বসে ছিল হোরায়রা। আবদুল্লাহ জাবেরের রক্তাক্ত হাত, আর বিরাট ক্ষত দেখে চমকে উঠল সে। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে ধরল আবদুল্লাহ জাবেরের দিকে।
হোরায়রা দিভাও থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের ছানাবাও অঞ্চলের ছালেমী গোত্রের সরদার জাফর আলীর ছেলে। ১০ বছর আগে মিশনারী ও নেটিভ খৃষ্টানদের সাথে সংঘটিত এক সংঘর্ষে জাফর আলী নিহত হয়। ২৫ বছরের যুবক হোরায়রা এখন পিসিডার একজন নিষ্ঠাবান কর্মী। দিভাওয়ে সে আবদুল্লাহ জাবেরের সহকারী হিসেবে কাজ করছে।
আবদুল্লাহ জাবের হোরায়রাকে লিলিয়েভের ঘরের চাবি দিয়ে বলল, রাত বারটার দিকে লিলিয়েভকে সরিয়ে ফেলতে হবে এখান থেকে। আপাততঃ ওকে রাখতে হবে শহরের বাইরে আমাদের নুরানাও ঘাঁটিতে। তারপর মুসা ভাইয়ের নির্দেশ মোতাবেক যা হয় করা যাবে।
আর সবাইকে বলে দেবে এবং থানাতেও জানিয়ে রাখবে আমাদের ১১ নং বোর্ডার রাত্রিতে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
-আচ্ছা জনাব। বলে উঠে দাঁড়াল হোরায়রা।
আবদুল্লাহ জাবের আলমারী খুলে ফার্স্ট এইডের বাক্সটি নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করল।
দরজা টেনে বন্ধ করে বেরিয়ে গেল হোরায়রা।