৩
আপো পর্বত শৃঙ্গের নীচে আপোয়ান উপত্যকা। উপত্যকা ও পর্বতের গাত্রদেশ ঘনবনে আচ্ছাদিত। যেন সবুজ চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে সবদিকটাই। উপর থেকে দেখলে তাই মনে হয়। কিন্তু সে সবুজ চাদরের নীচে উপত্যকা ও পর্বতের গাত্রদেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে নেমে এসেছে রাস্তা নীচের উপত্যকায়। পথ যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখানে এক পর্বত গহবরে এক পাথুরে বাড়ী। এটাই পিসিডার সদর দফতর। নীচের উপত্যকা ভূমিতে পর্বতের দেয়াল ঘেঁষে আরও অনেক সবুজ রঙের পাথুরে বাড়ী। তিনদিকে পর্বত ঘেরা চার হাজার ফুট উঁচুতে এই আপোয়ান উপত্যকাই পিসিডার প্রধান ঘাটি-রাজধানী।
সদর দফতরের অভ্যন্তরে একটি প্রকোষ্ঠ। বৈদ্যুতিক আলোয় উজ্জ্বল। ঘরের কোণে খাটিয়ায় বিছানা পাতা। এর বিপরীত দিকের কোণে একটি টেবিল। তার পাশে ঈজি চেয়ার।
ঈজি চেয়ারে এক যুবক গা এলিয়ে পড়ে আছে। চক্ষু মুদ্রিত। কপালে চিন্তার বলি রেখা। গৌর বর্ণ মুখমন্ডলে বিষাদের কালো ছায়া। তার সামনে টেবিলে এক গ্লাস দুধ। ঠান্ডা হয়ে গেছে।
যুবকটি মুর হামসার। পিসিডার সহকারী অধিনায়ক। মুর হামসারের আর একটি পরিচয় আছে সে মিন্দানাওয়ের ‘মাগনদানা’ রাজ বংশের রাজপুত্র। তার পূর্ব পুরষ সুলতান আবুবকর ওরফে পাদুকা মহাশারী মওলানা আস-সুলতান শরিফ আল-হাশমি বিখ্যাত সুলু সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আনুমানিক ১৪৫০ খৃঃ সুলু দ্বীপে আগমন করেছিলেন। মিন্দানাও ও সুলু দ্বীপপুঞ্জের গ্রাম-গ্রামান্তরে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন তিনি। স্পেন ও পরে মার্কিনীদের বিরামহীন বিরোধীতা ও হামলা সত্ত্বেও বর্তমান শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সুলু ও মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জে এই রাজবংশের হাতে মুসলমানদের স্বাধীন রাজত্বব প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজকুমার মুর হামসার মিন্দানাও বাসীদের রক্ষার জন্য তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামে সকলের সাথে আজ নেমে এসেছে পথে।
ধীরে ধীরে কক্ষটির দরজা খুলে গেল। উঁকি দিল একটি মুখ। যুঁই-এর মত অপরূপ শুভ্র ও পবিত্র সে মুখ। তারুণ্যের চাঞ্চল্য দু’টি চোখে।
দরজা ঠেলে সে ভিতরে ঢুকল। পাতলা একহারা গড়ন দেহের। বয়স বিশের বেশী হবে না। যৌবনের জোয়ার এসেছে দেহে। নীল গাত্রাবাস বাড়িয়ে দিয়েছে দেহের সুষমা।
ঘরে ঢুকে গল্লাসের দুধের দিকে নজর পড়তেই মেয়েটি বলল, দুধতো একটুকুও খাননি ভাইয়া?
মুর হামসার মাথা তুলল না। যেমনি ছিল তেমনি পড়ে রইল। মেয়েটি মুর হামসারের মাথার কাছে গিয়ে ধীর স্বরে বলল, বৃথাই চিন্তা করছেন ভাইয়া, দেখবেন দু’ একদিনের মধ্যেই জনাব হাত্তা এসে পড়বেন।
ধীরে ধীরে চোখ খুলল মুর হামসার। বলল, বিধির বিধান বোধ হয় অন্য রকম শিরী।
-কেন?
-ইয়াসির সিঙ্গাপুর থেকে কিছুক্ষণ হলো ফিরে এসেছে।
-কি খবর এনেছে ভাইয়া?
-পিসিডার জন্য মারাত্মক দুঃসংবাদ বোন।
-কি?
-আবদুল্লাহ হাত্তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
-ভাইয়া! আর্তনাদ করে উঠল শিরীর কন্ঠ। কিছুটা থেমে সে বলল, কেমন করে এটা সম্ভব হলো? কোথা থেকে?
-জেদ্দা থেকে বিমান ছাড়ার পর জেদ্দা ও করাচির মাঝ পথ থেকে বিমান কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল ভারত মহাসাগরের এক জনশূন্য দ্বীপে। সেখানে নামিয়ে নেয়া হয়েছে আবদুল্লা হাত্তাকে। হাত্তার পরে নাকি আরও একজন লোককেও নামিয়ে নেয়া হয়েছে। তারপর বিমান ফিরে এসেছে। মুর হামসার থামল।
কিছুক্ষণ দু’জনেই কথা বলতে পারল না। পরে শিরী জিজ্ঞেস করল, কিন্তু দ্বীপে গিয়ে কেউ কোন খোঁজ নিল না ভাইয়া?
-বিমান ফিরে আসার পর সেখানে উদ্ধারকারী এক স্কোয়াড্রন বিমান গিয়েছিল করাচী থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তৈরী করা বিমান বন্দর এবং এক পরিত্যক্ত বাড়ী ছাড়া সেখানে আর কিছই পায়নি।
আবার দু’জনেই নীরব। বিষাদের ছায়া দু’জনের চোখে মুখে। নীরবতা ভাঙ্গল শিরীই। বলল সে, এটা কাদের কাজ বলে অনুমান করছেন ভাইয়া?
সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতিভূ ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানেরই কাজ এটা।
মুর হামসারের কথা শেষ হতেই টেবিলের পাশে বোর্ডে লাল সংকেত জ্বলে উঠল। মুর হামসার সোজা হয়ে বসল। বলল, শিরী তুমি আড়ালে যাও। আবার কোন বিপদ বার্তা এলো নাকি দেখি। ভারী শোনাল মুর হামসারের কথা।
-এমনভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না ভাইয়া? আমাদের ভরসা তো কোন মানুষ নয়! আমরা বিপদে ভয় পাব কেন?
মুর হামসার ছোট বোনটির মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, সত্যি বলেছিস বোন। একটু থেমে বলল আবার, মিন্দানাওয়ের হতভাগ্য মুসলমান সবাই যে দিন তোর মত করে ভাবতে শিখবে সেদিনই আমাদের জীবন থেকে অমানিশার অবসান ঘটবে।
শিরী ঘরের পিছন দিকের একট পর্দা ঠেলে আড়ালে চলে গেল। মুর হামসার চাপ দিল একটি সুইচে।
মুহূর্ত কয়েক পরেই খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করল পিসিডার কর্মী শায়রা আলী। সে এসে ছালাম জানিয়ে মুর হামসারের সামনে দাঁড়াল। হাপাচ্ছে সে। চোখে মুখে তার উত্তেজনা।
-কি খবর শায়রা? উদগ্রীব কন্ঠ মুর হামসারের।
-আমাদের উপকূলে একটি জাহাজ ভিড়ছে।
-জাহাজ? আমাদের উপকূল রক্ষীরা…………….
মুর হামসারকে কথা শেষ করতে না দিয়েই শায়রা বলল, জাহাজ আমাদের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসতেই আমাদের রক্ষীরা জাহাজ লক্ষ্য করে গুলী ছুড়তে শুরু করে। একজন লোক জাহাজের ডেকে নেমে আসে। সে কিছু বলার জন্য এগিয়ে এসেছিল। একটি গুলি লেগে সে পড়ে যায়। আমরা দূরবীন দিয়ে তাকে বাম হাত চেপে ধরে ক্যাপটেন ব্রীজের দিকে উঠে যেতে দেখি। পরে জাহাজের মাইক থেকে তিনি বলেন, ‘মিন্দানাওয়ের মুসলিম ভাইয়েরা, আমি ‘রুড থান্ডার’। আমি ‘ব্রাইট ফ্লাস’ মুর হামসারের সাথে কথা বলতে চাই। তিনি আসার আগে কাউকে জাহাজে না উঠার জন্য আমি অনুরোধ করছি।
মুর হামসার উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। সে দ্রুত কন্ঠে বলল, ‘কি বললে শায়রা, তাঁর নাম কি বলেছিল?’
-রুড থান্ডার।
-আর আমার?
-ব্রাইট ফ্লাস।
দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল মুর হামসার। তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। মুর হামসার ভেঙে পড়ল কান্নায়।
শায়রার কাছে এ দৃশ্য অভাবিত। বিস্ময় বিমূঢ় কণ্ঠে সে বলল, জনাব আপনি……….
শায়রা কথা শেষ করতে পারলো না। মুর হামসার তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসল। রুমাল দিয়ে অশ্রু মুছে বলল, আবদুল্লাহ হাত্তা আর এই দুনিয়ায় নেই শায়রা! যাও তুমি। সবাইকে বল গিয়ে, তাঁর যেন কোন ক্ষতি না হয়। জাহাজের কোন ক্ষতি করো না তোমরা। আমি আসছি।
শায়রা চলে গেল। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল শিরী। বলল সে, কি বললেন ভাইজান, জনাব হাত্তা নেই?
-নেই বোন।
-‘কাল বাজ’ চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। এবার ‘রুড থান্ডার’ আমাদের নেতা।
-অর্থাৎ? বিস্ময় বিষ্ফরিত শিরীর দু’টি চোখ।
মুর হামসার শিরীকে বুঝিয়ে বলল, পিসিডার গোপন গঠনতান্ত্রিক কোড অনুসারে ‘কালো বাজ’ আবদুল্লাহ হাত্তার পরে যিনি নেতা হবেন। তাঁর কোড নাম হবে ‘রুড থান্ডার’।
-কিন্তু একজন অজানা অচেনা লোক এ দাবী তুলতে পারেন কেমন করে?
-সেটাই রহস্য। তাঁর কাছে গেলেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার যতদূর বিশ্বাস আবদুল্লাহ হাত্তার সাথে তাঁর দেখা হয়েছে।
আপো পর্বত। পিসিডার দরবার কক্ষ। পিসিডার পাঁচ শত নেতৃস্থানীয় কর্মী এবং কেন্দ্রীয় কমিটির ১১ জন সদস্য দরবারে উপস্থিত। মঞ্চের বাম পাশ দিয়ে নাইলনের পর্দা উড়ছে। ওপারে বসেছে মহিলা কর্মীরা।
সহকারী প্রধানের সামনে বসেছেন মুর হামসার। দলের প্রধান আবদুল্লাহ হাত্তার আসন খালি পড়ে অছে। মঞ্চের সামনে কফিনে আবদুল্লাহ হাত্তার মরদেহ। তার পাশেই একটি চেয়ারে বসেছেন আহমদ মুসা। বলে যাচ্ছেন তিনি কাহিনী। গুলীবিদ্ধ তার বাম হাতটি ব্যান্ডেজ করা। নিচ্ছিদ্র নীরবতা দরবার কক্ষে।
বিমান কিডন্যাপ থেকে শুরু করে জাহাজের সমগ্র কাহিনী শেষ করে চুপ করলো আহমদ মুসা। কাঁদছে সকলেই। গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাদের চোখের পানি। কিন্তু জাহাজ দখলের কাহিনী শুনতে শুনতে তাদের সে চোখ শুকিয়ে গেছে। সম্মোহিতের মত তারা শুনছে এক অপরূপ কাহিনী। আহমদ মুসা কথা শেষ করলেও তাই কেউ কথা বলতে পারলো না।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মুর হামসার। আহমদ মুসার পাশে এসে দাড়ালো সে। আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়াল। আহমদ মুসার একটি হাত তুলে নিয়ে সে কর্মীদের উদ্দেশ্য করে বলল, মিন্দানাও সোলো দ্বীপপুঞ্জের দুঃখী ভাইয়েরা, আমরা এঁকে চিনি না, জানি না। আর আমরা এর প্রয়োজনও বোধ করি না। আমরা জানি, আমাদের নেতা আমাদের মাথার মনি। মিন্দানাওয়ের অমর সন্তান আবদুল্লাহ হাত্তা যাঁর হাতে মহা দায়িত্বের মহা ভার দিয়ে গেছেন আমরা তার আনুগত্য করব, আমারা তাঁকে প্রতি পদক্ষেপে অনুসরণ করব।
সমগ্র দরবার সমস্বরে বলে উঠল, আহমদ মুসা জিন্দাবাদ, প্যাসেফিক ক্রিসেন্ট ডিফেন্স (পিসিডা) আর্মি জিন্দাবাদ। স্বাধীন মিন্দানাও-সোলো সালতানাৎ জিন্দাবাদ।
মুর হামসার আহমদ মুসার জামার কলারের ব্যাক ব্যান্ডে পিসিডার প্রতিক ‘কালো ব্যাজ’ পরিয়ে দিল। হাত ধরে নিয়ে বসাল আবদুল্লাহ হাত্তার শূন্য আসনে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। কর্মীদের উদ্দেশ্য করে বলল সে, মিন্দানা ও সোলো দ্বীপপুঞ্জের ভাই-বোনেরা, মরহুম আবদুল্লাহ হাত্তার লাশ সামনে নিয়ে আমি জাহাজেই শপথ নিয়েছি ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান এবং তার সাম্রাজ্যবাদী মুরুবিবদের হাত থেকে মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জকে রক্ষার জন্য আমি আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দান করব। আমি আবার সেই শপথেরই পুনারাবৃত্তি করছি।
থামল আহমদ মুসা।
আবার শুরু করল সে, আমার পরিচয় সম্পর্কে কি বলব? আমি জাতির একজন দীন খাদেম। সমগ্র বিশ্বই আমার বাসগৃহ, আল্লাহর বড় আদরের সুষ্টি মানুষ আমার আপন জন। আমি সাইমুমকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। ফিলিস্তিনের কাজ শেষ করে যাচ্ছিলাম মধ্য এশিয়ায়। কিন্তু আল্লাহ আমাকে নিয়ে এসেছেন মিন্দানাওয়ে। যতদিন না মিন্দানাওয়ের………….
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো দরবার কক্ষে। তার সাথে গুঞ্জনও।
শ্লোগান উঠল কর্মীদের মধ্য থেকেঃ ফিলিস্তিন বিজয়ী আহমদ মুসা জিন্দাবাদ, মজলুম মানবতার মহান দরদী আহমদ মুসা জিন্দাবাদ, সংগ্রামী সাইমুম জিন্দাবাদ, নয়া সাইমুম পিসিডা জিন্দাবাদ।
গভীর রাত। জাহাজ থেকে পাওয়া কাগজপত্র পরিক্ষা করে ওগুলো রেখে দিল আহমদ মুসা। জাহাজ থেকে যে অস্ত্র পাওয়া গেছে তা দিয়ে এক ডিভিশন সৈন্যকে অস্ত্র সজ্জিত করা যায়। অস্ত্রের মধ্যে দূর পালল্লার ১৫০ মিলিমিটার কামান এবং ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে।
কিন্তু আহমদ মুসাকে উত্তেজিত করে তুলেছে লোহার সেই গোল সিলিন্ডার। তালিকার বক্তব্য অনুযায়ী ওগুলো ‘রেডিয়েশন বম্ব’। মিন্দানাওয়ের ‘নান্দিওনা’ও ‘লানাডেল’- এর মুর জনপদ কি এই রেডিয়েশন বম্ব দিয়েই ধ্বংস করে দিয়া হয়েছে? এই মহা ধ্বংসের ক্ষমতা কি তাহলে তার হাতেও এলো? আঁতকে উঠল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার এ কক্ষটি মুর হামসারের কক্ষের পাশেই। মুর হামসার পাশের টেবিলেই বসে ছিল। তাঁর সামনে মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জের এক বিরাট মানচিত্র।
-মুর হামসার। ডাকল আহমদ মুসা।
-জি, মাথা ঘুরিয়ে জবাব দিল মুর হামসার।
-নীলের আতংক এবার আমরাও সৃষ্টি করতে পারি।
-নীল-আতংক? একরাশ প্রশ্ন ঝরে পড়ল মুর হামসারের কন্ঠে।
-হ্যাঁ, নীল আতংক। যে রেডিয়েশন বম্ব দিয়ে ওরা ‘নান্দিওনা’ ও ‘লানাডেল’ ধ্বংস করেছে, সে রেডিয়েশন বম্ব এখন আমাদের হাতে।
মুর হামসারের মুখে কোন কথা সরল না। শুধু বোবা সৃষ্টি মেলে সে চেয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বলল, জাহাজ থেকে যে কালো বাক্সগুলো নামানো হলো, ওর মধ্যে রয়েছে লোহার গোলাকৃতি সিলিন্ডার। সে লৌহ বলের এক জায়গায় রয়েছে লাল সুইচ। অন করলেই অলক্ষ্যে ধীর গতিতে শুরু হবে প্রলয়ংকারী রেডিয়েশন। মানুষ, পশু-পাখি, গাছ-পালার জীবনে নেমে আসবে নীল আতংক- নীল মৃত্যু। এ রেডিয়েশন প্রতিরোধ করার মত কোন উপায় এখনও উদ্ভাবিত হয়নি।
-এ এক ঘৃন্য আবিষ্কার মুসা ভাই!
-তবুও এটাই আমাদের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে বন্ধু।
-আমরা কি এর প্রতিশোধ নেব?
সেটা পরের কথা। কিন্তু আমি ভাবছি এই মারাত্মক অস্ত্র ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান পেল কেমন করে? হয় পারমাণবিক কোন রাষ্ট্র তাদেরকে এটা সরবরাহ করেছে, নতুবা তারা কোন উপায়ে পারমাণবিক কোন রাষ্ট্র থেকে এগুলো সংগ্রহ করছে। যেটাই সত্য হোক, এর একটা বিহিত হওয়ার দরকার। তা না হলে এর ব্লাক মার্কেট চলতেই থাকবে।
একটু চিন্তা করল আহমদ মুসা। তারপর বলল, ‘কালকেই আমি রেডিয়েশন বম্বের ফটোসহ ‘এম, পি, আই’ (Muslim Press International) এর কাছে খবর পাঠাচ্ছি যে, পারমাণবিক কোন একটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান বিপুল পরিমাণ রেডিয়েশন বম্ব যোগাড় করেছে, এগুলোর দু’টি ইতিমধ্যেই মিন্দানাওয়ের মুরদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে।’
-ফল হবে কি কোন?
-নিশ্চয়। দেখবে কেমন হৈ চৈ বেধে যায়।
-আহমদ মুসা থামল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মিন্দানাওয়ের মানচিত্রের কাছে। ঝুঁকে পড়ল মানচিত্রের উপর। বলল, বলত কোথায় ওরা ঘাঁটি করে বসেছে।
মুর হামসার মানচিত্র দেখিয়ে বলল, উপনিবেশিক প্রভূদের কল্যানে এবং মিশনারী ও ওদের অমানুষিক অত্যাচারে মিন্দানাওয়ের উলেস্নখযোগ্য শহরের মধ্যে দিভাও, জাম্বুয়াঙ্গো, কোটাবাটো, ইলিনোয়েস, ফাগায়ান ইতিমধ্যেই ওদের দখলে চলে গেছে। এছাড়া উপকূলের আরও পনরটি জায়গায় ওরা ঘাঁটি তৈরী করে বসেছে।
-লোক সংখ্যা কত হবে মুর হামসার?
লোক সংখ্যা প্রায় দু’ কোটি। এর মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা সোয়া কোটির মত। কিছু খৃস্টান রয়েছে, আর কিছু রয়েছে প্রকুতি পূজারি। কিন্তু উপনিবেশিক শাসকদের হিসাবে মুসলমানদের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশী নয়। বিশ্ববাসির চোখ ধূলা দিয়ে নিরুপদ্রবে মুসলমানদের হজম করে ফেলার লক্ষ্য নিয়েই তারা এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে থাকে।
মানচিত্রে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আহমদ মুসা বলল, এই আপো পর্বত থেকে আমরা কিভাবে ওদের ঘাঁটিগুলোতে পৌছতে পারি?
মানচিত্রে বুঝিয়ে দেবার জন্য মুর হামসার আরও একটু সরে এলো। আঙ্গুল দিয়ে সে মানচিত্রে পথ নির্দেশ করতে গিয়ে হঠাৎ তার আঙ্গুল আহমদ মুসার আঙ্গুল স্পর্শ করল। চমকে উঠল মুর হামসার। বলল, একি! আপনার জ্বর?
বলেই সে কাছে এসে আহমেদ মুসার কপালে হাত রাখল। আগুনের মত গরম কপাল। মুর হামসারের মুখ পাংশু হয়ে গেল। বলল, এমন ভীষণ জ্বর নিয়ে আপনি বসে আছেন, বলেননি তো?
আহমদ মুসা নিজের কপালটা নিজে পরীক্ষা করে বলল, তাই তো, এতটা আমি খেয়াল করিনি।
মুর হামসার জোর করে এনে আহমদ মুসাকে শুইয়ে দিল। তার চোখের দিকে চেয়ে সে আরও আঁতকে উঠল। রক্তের মত লাল হয়ে গেছে চোখ। শোবার পর আহমদ মুসাও কেমন যেন সংজ্ঞাহীনের মত হয়ে পড়ল।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল মুর হামসার। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, রাত দু’টা বাজে।
সে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো তার ঘরে। দেখল, শিরী বসে আছে। মুর হামসার কিছু বলার আগে শিরী বলে উঠল, ওঁকে রাত জাগতে দেয়া কি ঠিক হয়েছে? উনি যে আহত, আপনারা ভুলেই গিয়েছিলেন?
কথাগুলো কানে তুলল না মুর হামসার। বলল, ভুল হয়েছে ডাক্তারকে কাছে না রেখে। তুই ওর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা কর। আমি ডাক্তারকে ডাকার ব্যবস্থা করেই আসছি।
মুর হামসার চলে গেল। শিরী তাড়াতাড়ি তার কক্ষ সংলগ্ন বাথরুম থেকে একটি বড় বালতি ও একটি প্লাস্টিক নল নিয়ে আহমদ মুসার রুমে ঢুকল। নলের মুখ বাথরুমে টেপের মুখে লাগিয়ে কল ছেড়ে দিয়ে বালতি নিয়ে সে চলে এলো আহমদ মুসার মাথার কাছে।
আহমদ মুসা অসাড়ভাবে পড়ে আছে। তার চোখ দু’টি মুদ্রিত। আহত হাতটি খাটিয়া থেকে নীচে ঝুলে আছে। মুখটি তার রক্তাভ।
শিরী ধীরে ধীরে ঝুলে থাকা হাতটি বিছানায় তুলে দিল। কোন সাড়া পেল না আহমদ মুসার। ঘুমিয়ে পড়েছে কি সে? না, এত তাড়াতড়ি এইভাবে তো ঘুমিয়ে পড়তে পারেন না। তাহলে কি অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন জ্বরের তীব্রতায়! কথাটা মনে হওয়ার সাথে গোটা দেহে তার এক হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল।
সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে সে কপালে হাত রাখল। স্পর্শ করেই চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিল সে। এত গরম?
নল দিয়ে পানি এসে গেছে। তাড়াতাড়ি সে একটুখানি জলের ঝাপটা দিল আহমদ মুসার মুখে। তাপর মাথার তল থেকে বালিশ সরিয়ে নিয়ে তার দু’টি কাঁধ ধরে অতি কষ্টে তার মাথাকে আরো খাটের কিনারায় টেনে নিল। মাথার নীচে বালতি পেতে মাটিতে হাটু গেড়ে আহমদ মুসার কাছে একান্ত হয়ে বসল। ডান হাতে পানির নল ধরে বাম হাত দিয়ে মাথা ধুয়ে দিতে লাগল সে।
ছোট করে ছাঁটা চুল। ঘন আর কোঁকড়ানো। অদ্ভুত কালো রং তার। সমগ্র মাথাটা ভিজিয়ে নিতে বেশ সময় লাগল শিরীর। মাঝে মাঝে আগুনের মত কপালটাকেও সে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। মসৃণ কপাল। দৃঢ় সংবদ্ধ চোয়াল। উন্নত নাসিকা। রক্তাভ ঠোঁট। নীচের ঠোঁটের ক্ষুদ্র একটি নীলাভ তিল অপরূপ লাগছে দেখতে।
কেঁপে কেঁপে ধীরে ধীরে খুলে গেল আহমদ মুসার চোখ। শিরী চকিতে তার চোখ দুটি সরিয়ে নিল আহমদ মুসার মুখ থেকে। কিন্তু আবার বন্ধ হয়ে গেল আহমদ মুসার চোখ দু’টি। ঠোঁট দু’টি তার ঈষৎ কেঁপে উঠল। অষ্ফুট কন্ঠে বলল সে, তুমি এ কষ্ট করছ মুর হামসার?
বলে আহমদ মুসা তার ডান হাত তুলে শিরীর হাত স্পর্শ করেই চমকে উঠল। চোখ খুলে মাথা ঈষৎ বাঁকিয়ে শিরীকে দেখে জিজ্ঞেস করলো সে, কে তুমি?
আহমদ মুসার অভাবিত স্পর্শে কেঁপে উঠেছিল শিরীর গোটা শরীর। আহমদ মুসার চোখের সামনে রাজ্যের সমস্ত সঙ্কোচ ও লজ্জা এসে শিরীকে ঘিরে ধরেছিল। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। নল ধরে রাখা হাতটি তার কাঁপছিলো। প্রায় অষ্ফুট কন্ঠে সে বলল, আমি শিরী।
-রাজ কুমারী শিরী! মুর হামসারের বোন?
-জি।
-মুর হামসার কোথায়?
-ডাক্তারের জন্য গেছেন?
-তুমি কেন, কাউকে ডাকলেই তো পারতে?
শিরী কোন জবাব দিল না। আরও রাঙা হয়ে উঠল তার মুখ। এই সময় মুর হামসার ঘরে ঢুকল। পিছনে পিছনে ডাক্তার।
জেদ্দায় মুসলিম প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (এম পি আই) সদর দফতরে আহমদ মুসার চিঠি পৌছার পরদিনই বড় বড় সংবাদপত্রে প্রধান শিরোণামায় খবর বেরুলঃ
আণবিক মারণাস্ত্রের কালোবাজারী
বেসরকারী এক সংগঠন রেডিয়েশন বম্ব ব্যবহার করছে।
খবরের কোন সুত্র উল্লেখ না করে লেখা হয়েছে, ‘‘আটলান্টিক পারের কোন একটি আনবিক দেশ থেকে বহুসংখ্যক রেডিয়েশন বম্ব তথাকার এক বেসরকারী সংগঠনের হাতে গিয়ে পৌছেছে। সংগঠনটি ইতিমধেই দু’টি বোমা ফিলিপাইনের সংঘাত সংক্ষুব্ধ একটি দ্বীপের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। ভয়ংকর রেডিয়েশনের শিকার হয়ে প্রায় দুই হাজার আদম সন্তান নীল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। শান্তিকামী বিশ্ব এবং ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আণবিক কমিশনের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করছে।’’
এ খবর প্রকাশিত হবার একদিন পরে বিশ্বের প্রায় সকল সংবাদপত্রে এক চাঞ্চল্যকর খবর বেরুল। খবরটি হলোঃ
পারমানবিক মারণাস্ত্র লাপাত্তা
মার্কিন যুক্তরাষ্টের পেন্টাগণ সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক অস্ত্রাগার থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্রাকৃতি রেডিয়েশণ বম্ব হাওয়া হয়ে গেছে। মনে করা হচ্ছে, সুপরিকল্পিত কোন ষড়যন্ত্র এই মারাত্মক অপহরণের কাজ সম্পন্ন করেছে। অবিলম্বে এই ষড়যন্ত্র উদঘাটনের সমূহ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কতিপয় কংগ্রেস ও সিনেট সদস্য সমবায়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
খবর পড়ে আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠলো এক টুকরো হাসি। ট্রিপল সি’র রেডিয়েশন বম্ব সংগ্রহের পথ বন্ধ হলো। মুর হামসারের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, মিন্দানাওবাসীদের সামনে সেই নীল আতংক আর নেমে আসবে না। ‘নান্দিওনা’ ও ‘লানাডেলের’ ঘটনার পুনারাবৃত্তি হয়তো এর পরে আর ঘটবে না।
মুর হামসার মুখ টিপে হেসে বলল, রুড থান্ডারের প্রথম বিজয় এটা।
-বিজয় রুড থান্ডারের নয় বন্ধু। এ বিজয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের। এ ধরনের বিজয় ব্যক্তির মধ্যে সীমিত হয়ে পড়লে বা ব্যাক্তির মধ্যে সীমিত করে ফেললে তা স্বার্থদুষ্ট হয়ে থাকে এবং আর এক অন্যায়ের সৃষ্টি হয় তা থেকে। এ ধরনের রাজতান্ত্রিক ব্যক্তিবাদের কবর রচিত হয়েছে তেরশ’ বছর আগেই বন্ধু।
মুর হামসার মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার নেতার দিকে। বলল, আমাদের এতদিনের কল্পনার আহমদ মুসার চাইতে বাস্তবের আহমদ মুসা অনেক-অনেক বড়।