মিন্দানাওয়ের বন্দী – ১

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে চোখ খুলল আহমদ মুসা। হাত-পা নাড়তে গিয়ে একটুও পারল না। কঠিন ভাবে বাঁধা। মনে পড়ল তার, দু’জন লোক এসে প্রথমে আবদুল্লাহ হাত্তাকে একটি ইনজেকশন দিল, তারপর তাকেও একটি। তারপর কি ঘটেছে কিছুই জানে না সে। পাশ ফিরে শুতে চেষ্টা করল আহমদ মুসা। পাশ ফিরতে গিয়ে কান মেঝেতে ঠেকার সাথে সাথে একটি গুম গুম আওয়াজ তার কানে এল। কান পেতে শুনল সে। কয়েক মুহূর্ত শুনেই বুঝতে পারল, শক্তিশালী কোন ইঞ্জিনের শব্দ। পরক্ষণেই আহমদ মুসা অনুভব করল মেঝেটাও যেন মৃদু কাঁপছে। আহমদ মুসার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল-তাহলে সে কোন পানি জাহাজে? কোথাও পাচার করা হচ্ছে তাকে?

অনেক কষ্টে আহমদ মুসা উঠে বসল। পেট পিঠের সাথে লেগে গেছে। ক্ষুধায় জ্বলছে সারাটা পেট। একটু সরে বসতে গিয়ে হঠাৎ পায়ে কি যেন ঠেকল। সাথে ভারী কণ্ঠের একটি প্রশ্ন-কে?

-হাত্তা ভাই আপনি? উল্লোসিত কণ্ঠ আহমদ মুসার।

-একি, মুসা ভাই এখানেও আপনি আমার সাথে?

-সাথেই তো ছিলাম।

-কিন্তু এতো ভালো লক্ষণ নয়?

-কেন?

-আমি তো এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে। আমি আপনাকে সাথী করে নিতে পারি না।

আহমদ মুসা এগিয়ে গেল হাত্তার দিকে। তার বাঁধা দুটি হাত হাত্তার হাত দুটিকে খুঁজে নিল। শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলল সে, হতাশ হয়েছেন হাত্তা ভাই? কিন্তু জীবন মৃত্যুর ফায়সালা তো এভাবে জমিনে হয়না।

-আমি জানি, এ ফয়সালা আসে আসমান থেকে। কিন্তু আমার মন যেন বলছে এ কথা।

মুহূর্তের জন্য থামল হাত্তা। তারপর বলল আবার, তুমি জানো না মুসা ভাই, দীর্ঘ পনের বছরের বিনিদ্র প্রচেষ্টা আজ ওদের সফল হয়েছে।

আহমদ মুসা চিন্তা করছিল। বলল, যতটা চিনেছি ওরা সেই কুখ্যাত ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান। কিন্তু এ শ্বেত-সন্ত্রাসবাদীরা মিন্দানাও-এ কেন?

-এখানে সে শ্বেত-সন্ত্রাস এবং খৃস্টান স্বার্থ এক হয়ে গেছে।

-কি রকম?

খৃস্টান ক্রসের প্রচারে সহায়তা দানের জন্য মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জে শ্বেত সন্ত্রাস ক্লু-ক্লাক্স-ক্ল্যান আজ এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

মুহূর্ত খানেক থেমে আবার শুরু করল আবদুল্লা হাত্তা। জর্জ বানার্ডশ’র সেই বিখ্যাত উক্তিটি আপনি নিশ্চয় জানেন যে, ‘‘পশ্চিমারা যখন কোন দেশ দখল করতে চায়, তখন সেখানে তারা খৃস্ট ধর্মের বার্তা নিযে মিশনারী পাঠায়। স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা মিশনারী নিহত হয়। এরপর খৃস্টধর্ম রক্ষার বাহানা তুলে পশ্চিমী দেশগুলো সেখানে সসৈন্যে ছুটে যায় এবং স্বর্গের এক মহাদান হিসাবে দেশটি জয় করে নেয়।’’ ঠিক এমনিই ঘটেছে মিন্দানাও ও সোলোদ্বীপপুঞ্জে। স্পেনের ক্যাথলিক উপনিবেশিকরা সেখানে কি করেছে সে দীর্ঘ ইতিহাস বাদ দিলাম। সাম্প্রতিক কালের কথাই শুনুন। আজ থেকে বিশ বছর আগে দক্ষিণ মিন্দানাও- এর জাম্বুয়াঙ্গোতে একদল খৃস্টান মিশনারী উপস্থিত হলো। তাদের নিরাপত্তার জন্য অতি নিকটে মরো উপসাগরের কূলে নোঙ্গর করা থাকল সজ্জিত বিরাট এক রনপোত। জাহাজ থেকে মিশনারীর যখন নামত, তাদরে কোমরে ঝুলানো থাকত লম্বা চোঙওয়ালা রিভলভার। হাতে থাকত বই, বিস্কুট, সুন্দর সুন্দর সিট কাপড়। তারা জাম্বুয়াঙ্গোতে একটি বাইবেল শিক্ষার স্কুল খুলল। প্রতিদিন সন্ধায় সেখানে নাচ গানের অনুষ্ঠান ও ছবি দেখানো হতো। স্বর্ণাভ চুলের শেতাংগ তরুণীরা সেখানে নাচ গান করত। অনেকদিনের চেষ্টার পর তারা জাম্বুয়াঙ্গোর আফানি গোত্রের সর্দার শরিফ আফানিকে হাত করল। তারপর শুরু হলো জোর করে লোকদের বাইবেল স্কুলে ভর্তি, বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজী শিক্ষা ও লোকদের নাম পরিবর্তনের পালা। জাম্বুয়াঙ্গোর হুজুর মাখদুম (ওস্তাদ) জাফর আলী মিশনারীদের এ আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। সেই দিন রাতেই মাখদুম জাফর আলী জাম্বুয়াঙ্গোর মসজিদে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন। পরদিন আফানি গোত্রের ক্রুদ্ধ লোকেরা হত্যা করল তাদের গোত্র প্রধান শরিফ আফানিকে এবং সেই সাথে পুড়িয়ে দিল বাইবেল স্কুল। তারা উপকূল থেকে তীর বৃষ্টি করল মিশনারী রনপোতের দিকে। তীরের জবাবে জাহাজ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এল মেশিন গানের গুলী। এরপর জাহাজ থেকে কামানের গোলাবর্ষণ করে জাম্বুয়াঙ্গোর আফানি জনপদ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হলো। আফানিরা উপকূল থেকে অভ্যন্তর ভাগে পালিয়ে এলো।

এই ঘটনার পর থেকে শুরু হল গুপ্ত হত্যার হিড়িক। মিন্দানাও এর চারদিকে উপকূল সংলগ্ন স্থানে মিশনারী সাইনবোর্ডের আড়ালে প্রায় ২০টির মত শ্বেতাংগ ঘাটি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। শক্তির ছত্রছায়ায় ওগুলো টিকে আছে। ঐখান থেকেই দেশের অভ্যন্তরে গুপ্ত হত্যা চালানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৯৮ জন বিখ্যাত মখদুম (ওস্তাদ বা মওলানা) নিহত হয়েছেন এবং এক হাজারেরও বেশী মুর যুবক প্রাণ দিয়েছে তাদের হাতে।

কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, কি ভয়ংকর কথা। চলছে এটা এখনও হাত্তা?

-চলছে, তবে বাধাবন্ধনহীনভাবে নয়। আজ থেকে পনের বছর আগে আমরা এর মোকাবিলার জন্য প্যাসেফিক ক্রিসেন্ট ডিফেন্স আর্মি (পিসিডিা) নামে এক গুপ্ত সৈন্যদলের সৃষ্টি করেছি। এ পর্যন্ত আমরা ওদের প্রায় ১০০ জন এজেন্ট ধরেছি। দেশের অভ্যন্তরে ওদের কাজ অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওদের ঘাটির বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করতে পারছি না। খুবই মজবুত ঘাঁটি ওদের। ইলেকট্রিক তারে ঘেরা, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও সেখানে রয়েছে। ছোট ছোট হেলিকপ্টারও নামে ঘাঁটিতে।

-কেন? মোকাবিলার মত আধুনিক অস্ত্র পিসিডার নেই? বলল আহমদ মুসা।

-অস্ত্র এবং ট্রেনিং দুইয়েরই অভাব। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার জ্ঞাতি ভাইদের কাছ থেকে কিছু কিছু আধুনিক অস্ত্র আমরা পাচ্ছি, কিন্তু তা পরিমাণে ও মানে কোন দিক দিয়েই যথেষ্ট নয়। তবু পিসিডা আজ এইটুকু করতে পেরেছে যে, পিসিডার চোখ এড়িয়ে ওদের এজেন্টরা আর অবাধ বিচরণ করতে পারছে না। কিন্তু…..

আহমদ মুসা কথার মাঝখান থেকে বলে উঠলো, যে এজেন্টরা ধরা পড়েছে তাদের কি পরিচয় তোমরা জেনেছ হাত্তা ভাই?

-ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান। ওদের প্রত্যেকের ট্রাওজার ব্যান্ডে সাদা সাপ, সাপের মুখে লাল রঙের তিনটি সি (ট্রিপলসি) দেখা গেছে। একটু থেমে আবদুল্লাহহ হাত্তা আবার বলল, যে কথা বলছিলাম। নতুন এক বিপদ দেখা দিয়েছে। ভয়ংকর সে বিপদ। প্রায় দু’মাস আগে পশ্চিম মিন্দানাও-এর সোলো সাগর উপকূলের ‘নান্দিওনা’ নামক জায়গায় প্রায় দু’শ’ মুর (মিন্দানা ও সোলো দ্বীপপুঞ্জের মুসলমানরা মুর নামে অভিহিত) মুক্তা সংগ্রহে রত ছিল। পরে দু’ শ’ জনের সকলকেই উপকূল ভূমিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাদের দেহের রঙ হয়েছিল লালচে নীল। মিন্দানাওয়ের ডাক্তার কবিরাজদের কেউই এ মৃত্যুর কারণ বলতে পারেনি। এর দু’ মাস পরে রাজধানী শহর দাভাও থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত দাভাও উপসাগর তীরবর্তী ‘লানাডেল’ নামক মূর জনপদ একইভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ঘটনার আগের দিন সন্ধায় ‘লানাডেল’ থেকে আসা একজন পিসিডা কর্মী বলেছে, সেদিন সন্ধায় সে দু’টি শ্বেতাংগ স্পিড বোর্টকে লানাডেলের দিকে যেতে দেখেছে। আমাদের স্থির বিশ্বাস, কোন রোগ বা নৈসর্গিক কোন ঘটনা এ মৃত্যুর কারণ নয়, নিশ্চয় ট্রিপল সি’র কোন চক্রান্ত এটা। এই দুই ঘটনার পর মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জের মানুষ উদ্বেগ-আতংকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে।

স্বপ্নাবিষ্টের মত শুনছিল আহমদ মুসা। আবদুল্লাহহ হাত্তা থামলে সে যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠল। ধীর কণ্ঠে বলল, সেখানকার ঘাস ও গাছ পালার অবস্থা কেমন ছিল হাত্তা ভাই?

-ওগুলো পিতাভ রঙ ধারণ করেছিল। কিন্তু কোন লোকেরই প্রাণ ছিল না।

কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসার চোখ দুটি বিস্ফরিত হয়ে উঠল, কপালটা হয়ে পড়ল কুঞ্চিত। মুখ থেকে এক যন্ত্রণাদায়ক শব্দ বেরুল-উঃ?

-কি হলো মুসা ভাই? ত্রস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হাত্তা।

-এমন ভয়ংকর কথা কানে শুনব তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না হাত্তা।

-কেন, তুমি কিছু বুঝেছ?

-আমার ধারণা যদি সত্য হয়, তাহলে ওটা মারাত্মক ধরণের পারমাণবিক রেডিয়েশনের ফল।

তোমার ধারণা সত্য মুসা ভাই। আমি এর সূত্র সন্ধানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, মিশর এবং সর্বশেষে লিবিয়া হয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। দেশগুলোর আণবিক বিশেষজ্ঞদের সকলেই একমত যে, এটা মারাত্মক ধরণের রেডিয়েশনের ফল। কিন্তু তাঁরা এর প্রতিরোধের কোন পথ বাতলে দিতে পারেনি, কিংবা আন্তর্জাতিক ফোরামে এর প্রতিবিধানমূলক কোন ব্যবস্থা করতেও তারা রাজনৈতিক কারণে ভয় করেছেন। থামল আবদুল্লাহহ হাত্তা।

আহমদ মুসাও ভাবনার অতল গহবরে ডুবেছিল। কথা বলতে পারল না সেও।

নিঃশব্দ রাত্রির জমাট অন্ধকারে দু’জনই নীরব। কথা বলল প্রথমে আহমদ মুসা।

-এখন কি ভাবছ তাহলে?

-সবাই ত্যাগ করলেও আল্লাহ তো আমাদের ত্যাগ করেননি আমাদের যা আছে, তাই দিয়ে আমরা প্রতিরোধ করব, যদি সফল না হই, তাহলে আমরা মৃত্যুকে বরণ করে নেব। কিন্তু তবু আমরা ক্রুসের খৃস্টবাদের কাছে মাথা নত করবো না।

থামল আবদুল্লাহ হাত্তা। বোধ হয় একটা ঢোক গিলে নিল সে। আবার বলতে শুরু করল, কিন্তু সে সুযোগ হয়ত আমি আর পাব না মুসা ভাই। বলতে বলতে কণ্ঠ তার ভারি হয়ে উঠল। বলতে শুরু করল সে আবার, ভয়ংকর রেডিয়েশনের সংবাদও হয়ত আমি আমার জাতিকে জানাবার সুযোগ পাব না। তারা হয়ত অমনিভাবে নিরুপায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকবে। কান্নায় বুঁজে এল তার কথা।

-ভবিষ্যতের সবকিছুই আমাদের অজানা। আমরা হতাশ হব কেন হাত্তা। শান্তনার শান্তস্বর আহমদ মুসার কণ্ঠে। আবদুল্লাহ হাত্তা নীরব রইল। পরে ধীর কন্ঠে সে ডাকল, মুসা ভাই?

– বল।

-আমাদের উভয়ের এই সাক্ষাতের মূলে বোধ হয় আল্লাহর এক বিরাট ইচ্ছা কাজ করেছে।

-হয়তো হবে, হাত্তা।

আবদুল্লাহ হাত্তা একটু থেমে বলল, আমার দায়িত্ব আমি তোমার কাঁধে তুলে দিয়ে যেতে চাই।

এমন করে কথা বলো না হাত্তা, জীবন মৃত্যুর যিনি মালিক তিনিই সব কিছু করেন। আমি বলছি, সব কাজেই তুমি আমাকে পাশে পাবে।

আবদুল্লাহ হাত্তা একটু হাসলো। কান্নার মত করুণ সে হাসি। বলল সে, সে সৌভাগ্য আমার হলে দুনিয়ার মধ্যে আমিই হতাম সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। যাক সে কথা। এখন কয়েকটি কাজের কথা শুন। আমার যতদূর বিশ্বাস আমার ও তোমার অপরাধ একরূপ নয়। জাহাজ থেকে নেমে আসার পর ওদের কথোপকথন থেকে যা বুঝেছি, তাতে মনে হয় ট্রিপল সি’ তাদের নিজের ইচ্ছায় তোমাকে আটকায়নি। অন্য কোন এক পক্ষের ইচ্ছা ও অনুরোধ পূরণ করছে মাত্র। সুতরাং তুমি যেটুকু সময় হাতে পাবে, তা আমি পাব না বলে মনে হয়। যদি না পাই, তাহলে, মনে রেখ, পিসিডার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমার পরে যিনি পিসিডার নেতা হবেন তার কোড নাম হবে ‘রুড থানডার’ সংক্ষেপে ‘রুথ’। পিসিডার কাছে তোমার পরিচয় হবে ‘রুথ’। পিসিডার সহকারী প্রধান যিনি রয়েছেন, তার নাম মুর হামসার। কোড ‘ব্রাইট ফ্লাস’ সংক্ষেপে ‘বাফ’।

এই সময় বাইরে থেকে ঠক ঠক আওয়াজ ভেসে এলো। ভারি বুট পায়ে যেন কেউ আসছে। আবদুল্লাহ হাত্তার কথা মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। দু’জনেই কান পেতে রইল। পদশব্দটি তাদের অতি নিকটে এসে থামলো। মনে হলো দরজার বাইরে কেউ এসে দাঁড়াল। পরমুহূর্তেই চাবি খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আবদুল্লাহ হাত্তা চঞ্চল হয়ে উঠল। বলল, মুসা ভাই? কেউ যেন আসছে। শুন, মনে রেখ, মিন্দানাও-এর ‘আপো পর্বত’ হবে তোমার গন্তব্যস্থল।

আবদুল্লাহ হাত্তার কথার রেশ বাতাসে মিলিয়ে যাবার পূর্বেই তারেদ সামনে খুলে গেল একটি দরজা।

একটি টর্চের আলো এসে তাদের উপর পড়ল। টর্চধারী দীর্ঘাঙ্গ লোকটি উক্তি করল, ‘ও’ তাহলে জেগে উঠা হয়েছে?

পরিস্কার ইংরেজী কণ্ঠ। উচ্চারণে আমেরিকান ধরন আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়ালো না।

টর্চের আলো আবদুল্লাহ হাত্তার মুখে এসে স্থির হলো।

দীর্ঘাঙ্গ কালমূর্তিটি মুখটি ফিরিয়ে কাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘রবার্ট বি কুইক।’

সঙ্গে সঙ্গে রবার্ট নামক বিশাল বপু একজন লোক এসে ঘরে ঢুকল এবং আবদুল্লাহ হাত্তাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আহমদ মুসা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছিল, এবার হয়তো তার পালা আসবে। কিন্তু এলো না। আবদুল্লাহ হাত্তাকে বের করে নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেল। দরজা বন্ধেরও শব্দ শুনল। দরজা বন্ধের শব্দে ছ্যাঁৎ করে উঠলো আহমদ মুসার হৃদয়। কিছু বলার জন্য মনটা তাঁর উস-খুস করে উঠল, কিন্তু সে সুযোগ পেল না।

আবার সেই নিঃসীম ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেল ঘরটি। চোখ বুঁজে পড়ে থাকল আহমদ মুসা। হাত্তার জন্য মনের কোথায় যেন এ তীক্ষ্ণ বেদনা চিন চিন করে উঠছে তার। কোথায় নিয়ে গেল তাকে? এই ট্রিপল সি’র মত নৃশংস, রক্তপিপাসু, বর্বর কোন সংগঠন ভূ-পৃষ্ঠের কোথাও রয়েছে কি না সন্দেহ। এরা সভ্য সমাজের শিক্ষিত নরপশু। কিন্তু কি করবে আহমেদ মুসা। টর্চের আলোয় যতটা বুঝা গেছে ঘরটির দেওয়ালগুলো ইস্পাতের তৈরী। নিশ্চয় জাহাজের খোলের ভিতরের কোন বন্দীশালা এটি।

হাত-পা’র বাঁধনের জায়গাগুলো বেদনায় টন টন করছে। বাঁধা হাত মুখের কাছে তুলে নিয়ে দাঁত দিয়ে বাঁধন পরীক্ষা করল সে। পল্লাষ্টিকের কর্ড দিয়ে বাঁধা।

হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল তার জুতার গোড়ালির খোপে ল্যাসার বিম টর্চ রয়েছে। ওটা ব্যবহার করে সহজেই এ বাঁধন থেকে মুক্ত হতে পারে, ঘর থেকেও সে বেরিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু না, এত তাড়াতাড়ি এটা করা ঠিক হবে না। আগে এদের বুঝতে হবে, জাহাজ এখন কোথায় এবং কোথায় যাচ্ছে তা জানতে হবে। তাছাড়া আবদুল্লাহ হাত্তার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তাকে জানতে হবে ‘ট্রিপল সি’ কার ইচ্ছে বা কার অনুরোধে তাকে এভাবে বন্দী করছে? তাকে নিয়ে এখন কি পরিকল্পনা এদের?

এখন দিন না রাত? জাহাজের এ খোলে বিশেষ করে এ অন্ধ কুঠরিতে দিন-রাত্রি সবই সমান। অন্ধকার এ জগতে সময়েরও কোন হিসেব নেই। হাতের ঘড়ি ওরা খুলে নিয়েছে। হাত দিয়ে পরখ করে দেখল, ডান হাতের অনামিকার আংটিটি ঠিক আছে। খুশী হল আহমদ মুসার মন।

ক্ষুধা তৃষ্ণায় অবসন্ন আহমদ মুসার চোখে কেমন তন্দ্রার ভাব এসে গিয়েছিল। দরজার চাবি খোলার ধাতব শব্দে তার তন্দ্রার ভাব কেটে গেল। ভাবল সে, আবদুল্লাহহ হাত্তাকে নিয়ে এলো বোধ হয়। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। মনটি প্রসন্ন হয়ে উঠল তার।

দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক আলো এসে ভাসিয়ে দিল কক্ষটি। বাইরের করিডোরটি সোডিয়াম লাইটের উজ্জ্বল আলোতে হাসছে।

দরজায় দাঁড়িয়ে একজন দীর্ঘদেহী। হাত দু’টি প্যান্টের পকেটে ঢোকানো।

হ্যাল্লো, Cased Lion কেমন আছ। বাঁকা হাসি তার চোখে-মুখে।

উত্তরের অপেক্ষা না করে মুখটি ঈষৎ ফিরিয়ে বলল, এসো ডার্লিং এই যে।

তার কথা শেষ হতেই এক তরুনী এসে দরজার মুখে দাঁড়ালো। জ্বলন্ত আগুন যেন মেয়েটি। দেহের দুধে আলতা রংগে লাল জ্যাকেট আরও অপরূপ করে তুলেছে। বব কাট চুল। টানা নীল চোখ। কিছুটা বেঁটে মেয়েটি। অনেকটা মালয়ী বৈশিষ্ট্য দেহে।

লোকটি বলল, দেখ, আমার ডার্লিং-এর তোমাকে দেখার বড় ইচ্ছা।

-চিড়িয়াখানার জন্তু বানিয়েছ কি না। নিরুত্তাপ কন্ঠ আহমদ মুসার।

-No sir, you are more then that, মেয়েটির মুখে চটুল হাসি।

-Definitely, তুমি যা করেছ, চিড়িয়াখানার জন্তুর চেয়ে তা শতগুনে অদ্ভুত। তরল রসিকতার স্বরে বলল লোকটি।

-কিন্তু ক্যাপটেন, এঁকে এমন করে তোমরা জন্তু জানোয়ারের মত করে রেখেছ কেন। তোমাদের সাথে এর কোন শত্রুতা নেই। মেয়েটির স্বর নরম।

-বললাম তো, এ হলো Cased Lion. একটু সুযোগ, কিংবা খাঁচার একটু দুর্বলতা পেলে খাঁচা থেকে পালাবে। জানো তো, তাহলে আমাদের কত ক্ষতি। কম নয় ৫০ মিলিয়ন ডলার- ৫ কোটি ডলার।

-যাই বল, আমি হলে কিন্তু আমার কাছ থেকে সামান্য সহযোগিতাও পেতনা। দু’চোখে দেখতে পারি না ওদের আমি। জানো যুক্তরাষ্ট্রকে ওরা কেমন শোষণ করছে।

আহমদ মুসা যেন ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল। টাকার বিনিময়ে ট্রিপল সি, কি তাহলে ইহুদীদের পক্ষে কাজ করছে। ইহুদীদের হাতে তাকে তুলে দেয়াই কি এদের আসল লক্ষ্য? পরখ করার জন্য আহমদ মুসা মেয়েটিকে সরাসরি প্রশ্ন করে বলল, আপনি কি ইহুদীদের কথা বলছেন?

দু’জনেই ওরা চমকে উঠে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। পরে লোকটি বলল, ‘বুঝে ফেলেছ তাহলে, তা তোমার বুঝবার কথাই বটে।’ একটু থেমে লোকটি হেসে বলল, ভয় করছে না ইহুদীদের।

-কাউকেই আমি ভয় করি না। বলল আহমদ মুসা।

-তাহলে ঘৃণা করেন? মৃদু হেসে ত্বরিত কন্ঠে বলল মেয়েটি।

-কোন মানুষকেই আমি ঘৃণা করি না।

-ওদের সাথে তাহলে শত্রুতা কেন? লোকটি বলল।

-অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, অত্যাচারীর প্রতিরোধ করা আমার ধর্ম।

মেয়েটি মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলো আহমদ মুসার দিকে। বলল, তোমার ধর্মের কথা নাকি ওটা?

-নিশ্চয়, ‘তা মুরুনা বিল মারুফে ওয়া তানহাওনা আনিল মুনকার’ (ন্যায়ের জন্য নির্দেশ দাও, অন্যায়ের প্রতিরোধ কর)- এটা আমার নয়, আল কোরআন-এর কথা।

এ সময় একটি ট্রে হাতে একজন লোক এসে দরজায় দাঁড়াল।

তার পিছনেই সাব মেশিনগান হাতে একজন প্রহরী।

ওদের দেখেই পূর্বোক্ত লোকটি মেয়েটিকে লক্ষ্য করে বলল, এসো স্মার্থা এবার যাওয়া যাক। খাবে এখন।

ওরা চলে গেল। মেয়েটির প্রতি লোকটির শেষ সম্বোধন আহমদ মুসার দৃষ্টি এড়ালো না। তাহলে মেয়েটি লোকটির স্ত্রী নয়?

খেতে খেতে আহমদ মুসা ভাবছিল। অনেক কিছই তার কাছে এখন পরিস্কার। কিন্তু জাহাজ এখন কোথায়? কোথায় যাচ্ছে এ জাহাজ? হঠাৎ তার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। খাওয়া শেষে যখন থালা-বাসন গুছিয়ে নিচ্ছিল বেয়ারা লোকটি, তখন আহমদ মুসা বলল, দ্বিতীয় খানা আবার কবে হবে বেয়ারা।

বেয়ারা আহমদ মুসার দিকে চাইল। প্রশ্নের ধরনে বোধ হয় সে কিছুটা কৌতুক বোধ করল। বলল সে, কর্তার যখান ইচ্ছা। একটু থেমে সে বলল, কাল দুপুর নাগাদ আমরা মিন্দানাওয়ে পৌছে যাব। কাল সকালে একবার খাবার দেবার হুকুম হতেও পারে।

চট করে আহমদ মুসা প্রশ্ন করল, এখন কয়টা বাজে বেয়ারা?

-সন্ধ্যা ৭টা।

ওরা চলে গেল। আবার বন্ধ হয়ে গেল কক্ষের দরজা। সেই নিঃসীম ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে গেল আহমদ মুসা।

পেটের জ্বালা কমল। মিন্দানাও পৌছার পূর্বে ইহুদীদের হাতে তাকে হস্তান্তর করা হচ্ছে না, এ সম্পর্কেও সে নিশ্চিত। কিন্তু আবদুল্লাহ হাত্তার জন্য মনটি তার অস্থির হয়ে উঠেছে। হাত্তা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন আহমদ মুসা ইচ্ছা করেই ওদেরকে জিজ্ঞাসা করেনি।

এ কক্ষ থেকে কিভাবে বের হওয়া যায়? দরজার ইন্টারলক ল্যাসার বিম দিয়ে গলিয়ে সহজেই বের হওয়া যায়, কিন্তু এটা তাদের চোখে পড়বে সহজেই। আহমদ মুসা ওদের মনে তার সম্বেন্ধে কোন সন্দেহের উদ্রেক করতে চায় না। তাহলে?

আহমদ মুসা চিন্তা করল, নিশ্চয়ই এই ঘরের সারিতে আরও ঘর আছে এবং সে ঘরগুলোতে নিশ্চয়ই কোন লোক বাস করে না। গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঘরগুলো। সুতরাং পাশের ঘর দিয়ে বের হওয়াই নিরাপদ।

চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করে দিল আহমাদ মুসা।

কি জানি কেন ওরা যাবার সময় বেঁধে রেখে যায়নি তাকে। আহমদ মুসার শান্ত ব্যবহারে ওরা বোধ হয় ওকে কিছুটা নিরাপদ বোধ করেছে।

সুতরাং আহমদ মুসার সুবিধা হলো। জুতার গোড়ালির একাংশে চাপ দিতেই উপরের অংশ এক পাশে সরে গেল। গোড়ালির খোপ থেকে দু’ ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা একটি ল্যাসার বিম টর্চ বের করে নিল সে।

অন্ধকারের মধ্যে হাতড়িয়ে উত্তর দিকের দেয়ালের দরজার কাছাকাছি একটি স্থান ঠিক করে নিয়ে সে বসে পড়ল। অন্ধকারের মধ্যেই সে ল্যাসার বিমের মাথার ক্যাপটি খুলে নিল, তারপর পরীক্ষামূলকভাবে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে পিছনের দিকের ক্ষুদ্র একটি বোতাম টিপে ধরল।

সঙ্গে সঙ্গে টর্চের পিনহেড মাথা দিয়ে চোখ ঝলসানো এক আলোকশলাকা তীরের মত বেরিয়ে এলো। উজ্জ্বল এক আভায় অনেকখানি জায়গা আলোকিত হয়ে উঠল।

আহমদ মুসা ল্যাসার বিম টর্চ ইস্পাতের দেয়ালে চেপে ধরল। মোমের মত গলে পড়তে লাগল ইস্পাত। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ২ বর্গফুট পরিমিত স্থানের ইস্পাত সিট কেটে সরিয়ে নিল আহমদ মুসা।

সুড়ঙ্গ পথে হাত বাড়িয়ে দেখল দেয়ালের ওপারে কোন কিছু নেই। সে মাথা গলিয়ে ওপরের ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে কি আছে আধারে কিছুই ঠাহর করতে পারলোনা সে। ল্যাসার বিম টর্চটি মুহূর্তের জন্য আবার জ্বালালো। ঘরের অনেকখানি জায়গা আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোকে দেখল, ছোট ছোট কালো বাক্সে ঘরটি ভর্তি। কৌতুহল হল তার, এমন সব ক্ষুদ্র বাক্সে কি থাকতে পারে?

একটি বাক্স হাতে তুলে নিয়ে সে ল্যাসার বিম দিয়ে ঢাকনির চারটি স্ক্রু গলিয়ে ফেলল। তাপর বাম হাতে অতি সন্তর্পণে ঢাকনি খুলে নিল। ভিতরে গোলাকৃতি লোহার সিলিন্ডার। ঠিক ছোট ফুটবলের মত। সিলিন্ডারের গায়ে এক জায়গায় একটি সুইচ বসানো। লোহার এতবড় একটি সিলিন্ডার যতটুকু ভারি হতে পারে তার চেয়ে এটা অন্তত দশগুণ বেশী ভারী। বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। হঠাৎ আহমদ মুসার মনে হলো ট্রিপল সি’র এটা কোন বিশেষ মারণাস্ত্র নয়তো? জাহাজটি কি ট্রিপল সি’র জন্য অস্ত্রের চালান নিয়ে যাচ্ছে?

এ নুতন চিন্তার উদ্রেক হবার সাথে অপর কক্ষগুলো অনুসন্ধান করে দেখার দুর্বার ইচ্ছা জাগল আহমদ মুসার মনে।

ল্যাসার বিম দিয়ে দেয়ালে সুড়ঙ্গ কেটে পরবর্তী রুমেও প্রবেশ করল আহমদ মুসা। বিভিন্ন মিলিটার কামানের গোলায় ভর্তি সে ঘর। আহমদ মুসা দেখে বিস্মিত হলো- ১৫০ মিলিটার কামানের গোলাও সেখানে রয়েছে।

অন্য ঘরগুলোও তাহলে অস্ত্রে ভর্তি, স্থির করল আহমদ মুসা।

অতঃপর সে তৃতীয় ঘরটির সামনের দেয়াল সুড়ঙ্গ কেটে করিডোরে বেরিয়ে এলো। করিডোরটি অন্ধকারে ডুবে আছে। সে একটু দাঁড়িয়ে দিক ঠিক করে নিল। তার ঘরের ওপাশের দিক থেকে লোকেরা তার ঘরে এসেছে এবং গেছে। সুতরাং ওদিক দিয়েই জাহাজের ডেকে উঠা যাবে বলে ভাবল সে।

আহমদ মুসা তার ঘর পাশে রেখে বিড়ালের মত সামনে এগিয়ে চলল। কয়েক গজ যাবার পর হঠাৎ সামনে থেকে ভারি বুটের শব্দ এলো তার কানে। কে যেন আসছে। প্রহরী নয়তো? এখনি টর্চ জ্বাললেই তো সে ধরা পড়ে যাবে। করিডোরের দু’পাশে সারিবদ্ধ ঘর। লুকোবার কোন জায়গা নেই। আহমদ মুসা দ্রুত হেঁটে লোকটির নিকটবর্তী হতে চাইল। কিন্তু তার আগেই জ্বলে উঠল টর্চ। লোকটি তখনও চার পাঁচ গজ দূরে।

টর্চ জ্বলে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা করিডোরে ঝাপিয়ে পড়ে ফুটবলের মত গড়িয়ে দ্রুত ছুটল লোকটির দিকে। লোকটি এমনি ভূতুড়ে কিছু আশা করেনি। সে কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই পায়ের গোড়ালীর উপর প্রচন্ড ধাক্কা খেল। লোকটি উপুড় হয়ে আহমদ মুসার গায়ের উপরই পড়ে গেল। পড়ে গিয়েই কিন্তু লোকটি জাপটে ধরল আহমদ মুসার মাথা। লোকটি তার হাত আহমদ মুসার গলায় নামিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসার প্রচন্ড ঘুষি গিয়ে পড়ল লোকটির তলপেটে। পরমুহূর্তেই লোকটির হাত পা শিথিল হয়ে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি লোকটিকে টেনে এনে সেই সুড়ঙ্গ পথে কামানের গোলাপূর্ণ ঘরের মধ্যে গুজে দিল। তারপর লোকটির টর্চ ও রিভলবার কুড়িয়ে নিয়ে সে সামনে এগুলো।

টর্চ থাকায় কাজের অনেক সুবিধা হলো। টর্চ জ্বেলে গোটা করিডোরটাকে সে একবার দেখে নিল। দু’পাশে সারিবদ্ধ ঘর। মাত্র দুটি ঘর ছাড়া সবগুলো একদম সিল করা। এ দু’টি ঘরের একটিতে সে ছিল অন্যটিতে কি আছে? ওটা সিল করা নয় কেন? ওটাও কি তাহলে বন্দীশালা? আবদুল্লাহ হাত্তাকে ওখানে রাখা হয়নি তো?

আহমদ মুসা ফিরে এসে রুমটির সামনে দাঁড়াল। জুতার গোড়ালি থেকে ল্যাসার বিম টর্চ বের করে ইন্টারলক গলিয়ে প্রবেশ করল সে। ভালো করে দরজা এটে দিয়ে টর্চ জ্বালাল আহমদ মুসা।

ঘরটি শূন্য। একটি মাত্র লম্বা কাঠের বাক্স পড়ে আছে। বাক্সের ঢাকনির স্ক্রু আটা নয়-পল্লাস্টিক কর্ড দিয়ে বাঁধা। বাঁধন ছিড়ে ঢাকনা খুলে ফেলল আহমদ মুসা। বাক্সের মধ্যে টর্চের আলো ফেলেই আৎকে উঠল সে।

বাক্সের মধ্যে আবদুল্লাহ হাত্তার লাশ। চোখ দু’টি তার বিষ্ফারিত। গোটা দেহ কালচে হয়ে গেছে। আহমদ মুসা হাত দিয়ে দেখল, গোটা দেহটাই তার ভীষণ শক্ত।

ইলেকট্রিক শক্ দিয়ে ওকে হত্যা করা হয়েছে-স্বগত কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।

বিমূঢ়ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল আহমদ মুসা লাশের দিকে চেয়ে। তারপর স্বগত কণ্ঠে বলল, ‘‘বিদায় বন্ধু। তুমি যে দায়িত্বের বোঝা রেখে গেলে, সানন্দে আমি তা কাঁধে তুলে নিলাম। কথা দিচ্ছি যে পা আজ সামনে বাড়ালাম, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তাকে আর কিছুই থামিয়ে দিতে পারবে না।’’

আবদুল্লাহ হাত্তার মুখ থেকে চোখ নামিয়ে ঘুরে দাড়াল আহমদ মুসা। সামনে পা বাড়াল তারপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *