মহাভারতের মহারণ্যে – ২.১১

মহাভারতের মহারণ্যে – ২.১১

দুৰ্যোধনের হৃদয় আর প্রবোধ মানলো না। কর্ণ তো কেবলমাত্র বন্ধু ছিলেন না। ছিলেন আশ্রয়, অবলম্বন, পিতামাতাম্রাতাবন্ধুস্বজন, সব। সব কিছুর উৎস। সব কিছুর সমন্বয়। তাঁর দুই গাল জলে ভেসে গেলো। তারপরেই সমস্ত দুঃখ এবং ক্রোধ উত্তাল হয়ে উঠলো। সারথিকে বললেন, ‘হে সূত! আমি আজ অর্জুনকে সংহার করবো। অর্জুন আজ আমাকে কিছুতেই অতিক্রম করতে সমর্থ হবে না।’

দুৰ্যোধন সমাগত শক্রগণের প্রতি বেগে ধাবমান হলেন যে কৰ্ণ পৃথিবীর ঈশ্বর হতেও রাজি হননি দুর্যোধনের হিতাভিলাষে, সেই কর্ণকে ওরা এভাবে নিধন করলো? এর নাম যুদ্ধ যুদ্ধ করলে অর্জুন কি কর্ণের কাছে জয়ী হতে পারতেন? পিছন থেকে ছুরি মেরে খুন করতে তাদের বিবেকে কি এক ফোটাও দ্বিধা উদ্রিত হলো না? লজ্জা কুষ্ঠা ধর্ম কিছুই কি নেই তাদের মধ্যে? তারা কি মানুষ? মনুষ্য পদবাচ্য কোনো জীবই কি এটা করতে পারে? দুর্যোধন হা কৰ্ণ বলে রোদন করতে করতে উন্মাদের মতো প্রচণ্ড বেগে যাকে কাছে পেলেন তাঁকেই শরনিকরে বিদ্ধ করতে করতে আহবান করতে লাগলেন যোদ্ধাদের।

মদ্রাধিপতি শল্য শেষে কোনোরকমে নিবৃত্ত করলেন তাঁকে। বললেন, ‘হে রাজন! তোমার অদ্ভুত পৌরুষ দেখে আমি অভিভূত। তুমি একা একা এই অসংখ্য শত্রু সৈন্যকে কী ভাবে নিপাতিত করছো। কিন্তু আমাদের সৈন্যরা এখন চতুর্দিকে পলায়মান কর্ণের মৃত্যুতে তারা সকলেই ভীত, ব্যথিত। ক্ষত্রিয়ধর্ম যারা পালন করে না, যুদ্ধক্ষেত্রে যারা অন্যায় হত্যা করে, তাদের সঙ্গে একজন ক্ষত্রিয় যোদ্ধা ধর্মযুদ্ধ কী ভাবে পালন করবে? তুমি শান্ত হও। সূতপুত্রের নিধনে সকল সৈন্যই বিষাদগ্ৰস্ত, বিপন্ন এবং পরিশ্রান্ত। আজকের মতো সকলকে ছুটি দাও। তুমিও শিবিরে চলো।‘ শোকাকুলচিত্ত মদ্রাধিপতি এই সব বলে চুপ করলেন। তখন দুর্যোধন বাষ্পাকুল নয়নে যুদ্ধ শেষ করে সৈন্যদের ছুটি দিয়ে শিবিরে গেলেন।

সকলেই কর্ণের কথা বলতে বলতে গভীর রাত্রি পর্যন্ত জেগে কাটিয়ে দিয়ে অবশেষে নিদ্রিত হলেন। কিন্তু দুর্যোধনের নিদ্রা এলো না। গভীর যামিনী গত হয়ে কখন আকাশ রক্তবর্ণ হলো, তবু তাঁর দুই গাল জলেই ভরে রইলো। হৃদয় কেবলই হাহাকার করতে লাগলো একমাত্র বন্ধু কর্ণের জন্য।

কৃপাচার্য বলেছিলেন, হে রাজন! তুমি এবার ওদের সঙ্গে সন্ধি করো। আমার মনে হয় কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য লঙ্ঘন করতে সমর্থ হবেন না। হে মহারাজ। আমি দীনতা বা প্রাণরক্ষার নিমিত্ত একথা বলছি না। একথা তোমার হিতকর বলেই বলছি।‘

দুৰ্যোধন বললেন, ‘হে আচার্য। আপনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করেছেন, এখনো বন্ধুজনোচিত বাক্যই বলছেন, কিন্তু আমি কীরূপে এ কাজ করতে পারি! আমি আপনার বাক্য শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েও বলছি, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করা উচিত নয়, যুদ্ধ করাই শ্রেয়। দেখুন, আমি বহুবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত দক্ষিণাদান, বেদাধ্যয়ন ও বিপক্ষগণের শীর্ষস্থানীয়রূপে অবস্থান করেছি। আমি যা চেয়েছি সবই পেয়েছি। আমার ভৃত্যগণ অতি সুখে প্রতিপালিত হয়েছে। আমি দুঃখীদের দুঃখ দূর করেছি, স্বরাজ্য প্রতিপালন, ভোগ্যদ্রব্য উপভোগ এবং ধর্মঅর্থকামের সেবা করেছি। ক্ষত্রিয়ধর্ম ও পিতৃঋণ থেকেও আমার মুক্তিলাভ হয়েছে। এই পৃথিবীতে কিছুতেই সুখ নেই। কেবল কীর্তিলাভ করাই লোকের কর্তব্য। আমি ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়গণ গৃহমধ্যে রোগভোগ করে মরতে চায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুই আমার কাম্য। তদ্ব্যতীত, আমার জন্য নিহত পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, মহাবীর জয়দ্ৰথ এবং কর্ণ, যে আমার কথা ভেবে পৃথিবীর ঐশ্বর্য ও কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাদের কথা আমি কী করে ভুলতে পারি? কতো অবনীপাল আমার জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের নিকটও আমি বহুরূপে ঋণী। সেই কৃতজ্ঞতাঁর শোধ কি আমি নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে তাদের দিতে পারি? যুদ্ধক্ষেত্রে আমার প্রাণ দিয়েই আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করে তাদের সঙ্গে মিলিত হতে চাই।’

কুরুরাজ দুর্যোধনের একথা শুনে অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ সাধু সাধু বলে প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন পরাজিত হয়েছেন বলে কারো মনের মধ্যে কোনো কষ্ট রইলো না। বিক্রম প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। যুদ্ধার্থে নরপতিগণও স্ব স্ব মত প্রকাশ করলেন। আচার্যপুত্র অশ্বথামা প্রাণত্যাগে উদ্যত নগরপালদের ইঙ্গিত অবগত হয়ে রাজা দুৰ্যোধনের নবেদিত সূর্যতুল্য সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনুন, পণ্ডিতেরা স্বামীভক্তি, দেশকালাদি সম্পত্তি, রণপটুতা ও নীতি এই কয়েকটিকে যুদ্ধের সাধন বলে নির্দেশ করেছেন। আমাদের যে সব দেবতুল্য লোকপ্রবীর মহারথগণ নীতিজ্ঞ, রণদক্ষ, প্রভুপরায়ণ, ও নিয়ত যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন, তারা কেউ যুদ্ধের দ্বারা পরাজিত হননি। পাণ্ডবরা তাদের পিছন থেকে লুকিয়ে হত্যা করেছেন। তা বলে জয়ের আশা ত্যাগ করা উচিত নয়। সুনীতি প্রয়োগ করলে দৈবকেও অনুকুল করা যায়। এখন আপনি বিশ্রাম করুন। আপনি শান্ত হোন।‘

অতি প্রত্যুষে পুনরায় আবার সকলে একত্রিত হলেন। দুর্যোধনকে সম্ভাষণ করে বললেন, ‘হে মহারাজ! আপনি একজন সেনাপতি নিযুক্ত করুন, আমরা সেই সেনাপতির নিকট রক্ষিত হয়ে সম্মুখ সমরে সমুদয় শক্রকে পরাজিত করবো।‘ তখন রাজা দুর্যোধন নিজের রথে বসেই অশ্বথামার কাছে গেলেন।

অশ্বথামার রূপের কোনো তুলনা ছিলো না। তিনি বায়ুর মতো বলবেগশালী এবং তেজে দিবাকর ও বুদ্ধিতে শুক্রাচার্য। দুর্যোধন সেই দ্রোণপুত্রের নিকট গিয়ে বললেন, ‘হে গুরুপুত্র! আজ আপনিই অগতির গতি। আপনিই বলুন কাকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করবো।’ অশ্বথামা দুর্যোধনের বাক্য শুনে তখনি বললেন, ‘হে মহারাজ! মদ্রাধিপতি শল্য বলবীর্যে শ্রী ও যশ প্রভৃতি অশেষ গুণসম্পন্ন এবং সৎকুলসস্তুত। ঐ মহাবীরকেই আপনি আমাদের সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করুন। ঐ মহাত্মা নিজের ভাগিনেয়দের ছেড়ে আমাদের নিকট উপস্থিত হয়েছেন, তাঁর মিত্রতার তুলনা নেই।‘

তখন দুর্যোধন রথ থেকে নেমে ভীষ্মসদৃশ মহাবীর মদ্রাধিপতিকে বললেন, ‘হে মিত্রবৎসল, আপনি আমাদের বন্ধু। অসময়েই মানুষ জানতে পারেন কে বন্ধু আর কে নয়। অতএব আপনি আমাদের সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হোন।‘

শল্য বললেন, ‘হে কুরুরাজ, তুমি আমাকে যা বলবে, আমি তাই করবো। আমার রাজ্য মনপ্রাণ যা কিছু আছে সবই তোমার।’

দুৰ্যোধন বললেন, ‘হে মাতুল! আমি আপনাকে সেনাপতিপদে বরণ করছি। আপনি আমাদের রক্ষায় প্রবৃত্ত হোন।‘

শল্যরাজ বললেন, ‘হে মহারাজ। আমি যা বলছি তুমি তা অবিহিত হয়ে শোনো। ধনঞ্জয় আর বাসুদেবকে শ্রেষ্ঠ মনে করো না। সমস্ত পৃথিবী উদ্যত হলেও, আমি ক্রোধাবিষ্ট হলে অনায়াসেই তাদের জয় করতে পারি। এখন আমি তোমার সেনাপতি হয়ে বিপক্ষগণের নিতান্ত দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা এবং সমস্ত পাণ্ডবদের পরাজিত করবো সন্দেহ নেই।‘

বস্তুতই মদ্রাধিপতি শল্য একজন প্রকৃত যোদ্ধা। অবশ্য কুরুকুলে কুরুরাজ দুৰ্যোধন তো আছেনই, তাঁর জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তারা কেউ এমন যোদ্ধা ছিলেন না, যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাণ্ডবপক্ষের কেউ জয়ী হতে পারেন। পারেনওনি। কৃষ্ণের মিথ্যাচারেই অর্জুনের মতো যোদ্ধা একবারের জন্যও রণক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতাঁর প্রমাণ রাখার অবকাশ পেলেন না। ভীষ্ম দ্ৰোণ জয়দ্ৰথ ভূরিশ্রব কর্ণ কারো সঙ্গে তাঁকে যুদ্ধ করতে দেননি বাসুদেব। প্রত্যেককে যুদ্ধ ছাড়াই পিছন থেকে অতর্কিতে অথবা অসৎপন্থায় নিহত করিয়েছেন। যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর এই অন্যায় কর্ম অব্যাহত ছিলো।

কৰ্ণ অর্থিগণের কল্পবৃক্ষ স্বরূপ ছিলেন। যাচকদের কখনোই প্রত্যাখ্যান করতেন না। সাধু ব্যক্তিরা তাঁকে সৎপুরুষ বলে অতীব শ্রদ্ধা করতেন। কর্ণ কৃষ্ণেরও বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কৃষ্ণ তাঁকে ধর্মচ্যুত করতে পারেননি। দুৰ্যোধনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। এই সততা কুরুপক্ষের সকলের মধ্যেই বর্তমান ছিলো। দুৰ্যোধন নিজে একজন বিশেষ মানুষই ছিলেন। তাঁর পক্ষের রাজাগণ এবং সৈন্যগণ তাঁর প্রতি সেজন্যই এতো একনিষ্ঠ ছিলো। তিনি যুধিষ্ঠিরের মতো যুদ্ধের মধ্যে আরামশয্যায় শুয়ে বসে দিন কাটাননি। অবিশ্রান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকেছেন। পিতৃবৎসল, মিত্রবৎসল, প্রজাবৎসল—এসব গুণ তাঁর মধ্যে প্রভূত পরিমাণে ছিলো। একটি মিথ্যাবাক্যও তিনি উচ্চারণ করেছেন এমন ঘোষণা বিদুরও করতে পারেননি।

যেদিন কর্ণ অন্যায়যুদ্ধে অসহায় অবস্থায় নিহত হলেন, সেই সময়ে যুধিষ্ঠির তাঁর সুবর্ণময় উত্তম শয্যায় শুয়ে আলস্য যাপন করছিলেন। সহৰ্ষে অর্জুন ও কৃষ্ণ প্রবেশ করলেন। তাদের মুখ দেখেই যুধিষ্ঠির বুঝতে পারলেন কর্ণকে তারা নিহত করতে পেরেছেন। তাঁর মুখে উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠলো। তিনি গাত্ৰোখান করলেন। শুভসংবাদ অবগত হলেন। কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে তিনি কর্ণের মৃতদেহ দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে সমরক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালেন। আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বললেন, ‘এর কথা ভেবে আমি ভয়ে তেরো বৎসর ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। আজ সুখে নিদ্রা যাবো।’

কর্ণের মৃত্যুর পরে পাণ্ডবরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছিলেন। তাঁর পরেও শল্য যে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে একেবারে উথালপাথাল করে তুলবেন সেটা ভাবেননি। পাঞ্চাল আর সোমক আর পাণ্ডবেরা সেই সৈন্যনিপাতনে কৃতান্ততুল্য মদ্ররাজের পরাক্রম দেখে অধীর হয়ে উঠলো। সাত্যকি ভীম নকুল সহদেব অসাধারণ বলসম্পন্ন মদ্রাধিপতিকে সহসা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত দেখে আতি তৎপরতাঁর সঙ্গে তাঁকে পরিবেষ্টন করে মহাবেগসম্পন্ন শর দ্বারা মদ্রাধিপতি শল্যকে নিপীড়িত করতে লাগলেন। শল্য সে সব অগ্রাহ্য করে যুধিষ্ঠিরের দিকেই ধাবিত হলেন। সমরাঙ্গন মৃতের স্তুপে পরিণত হলো। এই যুদ্ধে কৃষ্ণ উপস্থিত ছিলেন না, তাই যুদ্ধটা যুদ্ধের মতোই হলো। যুধিষ্ঠির-পরিবেষ্টিত যোদ্ধাদের বাণে বিদ্ধ হতে হতে এক সময়ে যুধিষ্ঠিরের একটি বাণে তিনি বিনষ্ট হলেন। শল্য যুধিষ্ঠিরের দিকেই তাঁর একান্ত মনোযোগ নিবিষ্ট করেছিলেন। দেখতে পেয়েই অর্জুন ভীম নকুল সহদেব সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র পাঞ্চাল ও সোমকদল তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলেন। তাদের সকলের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির তাঁর জীবনের প্রথম কীর্তি স্থাপন করতে পারলেন। মহাভারত নামের গ্রন্থটিতে যুধিষ্ঠিরের এই একমাত্র বীরত্বের কাহিনী মোটা দাগে অঙ্কিত হলো। মহারাজা শল্য যে তাঁর দ্বারাই বিনষ্ট হয়েছেন, তা যেন অন্য কোনো পরিবেষ্টনকারীর নামে না যায় সেটাই বারে বারে উল্লিখিত হলো।

সেই সময়ে দুৰ্যোধনের দুর্জয় যুদ্ধ সন্দর্শন করে শত্রুপক্ষ ভীত হলেন। অরাতিগণ কোনোক্রমেই দুর্যোধনকে নিবারিত করতে সমর্থ হলো না। অসংখ্য সৈন্য নিহত হলো। শল্যকে মারতে পেরে তখন অন্যদিকে আনন্দ কোলাহল শুরু হলো, কুরুসৈন্যরা পলায়মান হলো। মহারাজা দুর্যোধন সমস্ত সৈন্যগণকে পালাতে দেখে একাই যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করে সরোষ নয়নে প্রত্যেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। খৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র এবং পাণ্ডব পাঞ্চাল কৈকেয় সোমক ও সঞ্জয়গণকে নিবারিত করে মন্ত্রপূত যজীয় পাবকের মতো বিচরণ করতে লাগলেন। শত্রুরা ঐ ভয়ঙ্কর রোষপূর্ণ মহাবীরের সম্মুখীন হতে সমর্থ হলো না।

একসময়ে দুৰ্যোধন রণাঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর ক্ষত বিক্ষত দেহ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো, দুই চোখ অশ্রুপ্লাবনে সিক্ত, শোকাকুল হৃদয়ে তিনি হ্রদের দিকে গিয়ে, সেখানে প্রবেশ করে, মায়ার দ্বারা তার জল স্তম্ভিত করে রাখলেন। জল স্তম্ভিত করা বিষয়ে শল্যপর্বে লেখা আছে ‘জলের উচ্ছাস কম্পনাদি সর্বপ্রকার গতিরোধ।‘ আধুনিক যুরোপীয় সাবমেরিনে লোকসকল জলমধ্যে যেমন অনায়াসে শ্বাসপ্রশ্বাসক্রিয়া নির্বাহ করে থাকে এই জলস্তম্ভন তাঁরই সূক্ষ্ম আদর্শ।

দুৰ্যোধন হ্রদের মধ্যে প্রবেশ করলে, কৃপাচার্য, অশ্বথামা ও কৃতবৰ্মা এই তিন মহাবীর ক্ষতবিক্ষত দেহে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে সেই প্রদেশের কাছাকাছি এসে সঞ্জয়কে দেখতে পেলেন। বললেন, ‘নিতান্ত ভাগ্যগুণেই তোমাকে দেখতে পেলাম। আমাদের রাজা দুর্যোধন জীবিত আছে কিনা তা কি তোমরা জানো?’

সঞ্জয় বললেন, ‘আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিলো। আমাকে এ কথাই বললেন যে তিনি হ্রদের জলে বিশ্রাম করতে যাচ্ছেন।‘ সঞ্জয় তাদের হ্রদটিও দেখিয়ে দিলেন। অশ্বথামা বেদনাৰ্দ্ৰ সুরে বললেন, ‘হায়! রাজা নিশ্চয়ই জানতেন না আমরা জীবিত আছি। কী কষ্ট আমরা তাঁর সঙ্গে মিলে অনায়াসেই যুদ্ধে অরাতি দমন করতে পারতাম।‘

দ্রুতপদে তারা রাজা দুর্যোধনের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন। অতি মৃদুকণ্ঠে বললেন, ‘মহারাজ, তুমি হ্রদ থেকে উঠে এসো, আমাদের সমভিব্যহারে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। হয় পাণ্ডুনন্দনকে নিহত করে পৃথিবী ভোগ করো, নচেৎ নিজে নিহত হয়ে সুরলোক প্রাপ্ত হও। হে দুৰ্যোধন! তুমি একাই পাণ্ডবসৈন্য সমুদয়কে প্রায় বিনাশ করেছে, যারা অবশিষ্ট আছে তারাও তোমার শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। আমরা তোমাকে রক্ষা করবো, পাণ্ডবরা তোমার বেগ সহ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না।’

অশ্বথামা বললেন, ‘হে বীর! কাল প্রভাতে আমি যদি শক্রদের বিনাশ করতে না পারি তবে যেন আমার দানধ্যান যাগযজ্ঞ সব বিফল হয়। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি যদি ওরা যুদ্ধ কাকে বলে সেই জ্ঞান মনে রেখে অবতীর্ণ হয়, তবে আমি বলছি পাঞ্চালগণকে শেষ না করে কবচ পরিত্যাগ করবো না। তুমি কিছু ভেবো না, শান্ত মনে বিশ্রাম করো। শঠতা না করলে অবশ্যই আমাদের জয় হবে।’

কিন্তু এখানেও বিধি বাম হলো।

কয়েকটি ব্যাধ, যারা ভীমের জন্যে মাংস সরবরাহ করতো, যাদের কাছে যুধিষ্ঠির কিছু পূর্বেই দুৰ্যোধনকে তারা দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা আড়াল থেকে এই সব আলোচনা শুনে ফেললো। ব্যাপারটা বুঝে পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকালো।

কথা আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন। মনে হয় রাজা দুর্যোধন নিশ্চয়ই এই হ্রদের কোথাও অবস্থান করছেন। চলো, আমরা গিয়ে এই বৃত্তান্ত প্রকাশ করি। তা হলে তাদের নিকট আমরা বিপুল অর্থ প্রাপ্ত হবো। তবে আর আমাদের প্রতিদিন এই রকম শুষ্ক মাংস বহন করতে হবে না। এই বলে তাড়াতাড়ি তারা পাণ্ডবদের শিবিরের দিকে রওনা হলো।

তাদের কাছে দুর্যোধনের খবর শুনে পাণ্ডবভ্রাতারা ও কৃষ্ণ তখুনি রথারোহণে সাগরতুল্য দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে এসে উপস্থিত হলেন। শঙ্খনাদ, রথের শব্দ এবং সৈন্যদের কোলাহলে নিঝুম হ্রদের তীর কম্পিত হয়ে উঠলো।

কৃপাচার্য, অশ্বথামা ও কৃতবৰ্মা দুর্যোধনকে অস্ফুটে বললেন, ‘রাজা! পাণ্ডবরা আসছে, আমাদের এবার যাবার অনুমতি দাও, আমরা চলে যাই।’

দুৰ্যোধন বললেন, ‘তারা এই স্থানে এলো কেন? কেউ তাদের কোনো খোঁজ দিয়েছে?’

তারা বললেন, ‘তা বোধহয় নয়। যাই হোক, আমরা সরে যাই, নচেৎ বুঝে যাবে।‘ এ বলে অতিশয় বিষন্নমনে চলে গেলেন তারা। কিন্তু শিবিরে গেলেন না। কিছু দূরেই একটি বৃক্ষের তলায় গিয়ে বসলেন।

যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সবাই এসেছে। কৃষ্ণ অৰ্জুন ভীম নকুল সহদেব ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী সাত্যকি দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সবাই দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে সমুপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘কৃষ্ণ ঐ দ্যাখো, দুর্যোধন মায়াবলে জলস্তম্ভ করে হ্রদের মধ্যে অবস্থান করছেন। আমি ঐ মায়াবীকে কদাচ জীবিতাবস্থায় পরিত্যাগ করবো না। যদি স্বয়ং ইন্দ্র ওর সহযোগিতা করেন, তবুও লোকে একে সংগ্রামে নিহত দর্শন করবে।’

যুধিষ্ঠির জলমধ্যস্থিত মহাবল পরাক্রান্ত দুর্যোধনকে বললেন, ‘তুমি সমস্ত ক্ষত্রিয় বিনষ্ট করে এখন নিজের জীবন রক্ষার্থে জলাশয়ে প্রবেশ করেছো। এই মুহুর্তে জল থেকে উঠে এসো। আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো। তোমার দৰ্পের তো কোনো সীমা ছিলো না, এখন সেই দৰ্প তোমার কোথায় গেলো? সভামধ্যে সকলেই তোমাকে বীরপুরুষ বলে থাকে, এখন তারাই বা কোথায় গেলো? নির্লজ্জ! এখন তুমি প্রাণভয়ে জলের মধ্যে লুকিয়ে আছো। ভেবো না এই সলিলমধ্যে লুকিয়ে থাকলে তুমি নিস্তার পাবে। তুমি কুরুবংশে জন্মগ্রহণ করেছো, যুদ্ধে ভীত হয়ে সলিলমধ্যে পলায়ন, এটা তোমার নিতান্ত অন্যায়। সমরে পরাজুখ হয়ে অবস্থান করা ক্ষত্রিয়ধর্ম নয় (যুধিষ্ঠির সর্বদাই যা করেছেন)। হে দুরাত্মা! তুমি লোকসম্মুখে আপনাকে যে বীর বলে পরিচয় প্রদান করো তা নিতান্ত নিরর্থক। বীরপুরুষেরা প্রাণান্তেও শক্রসন্দর্শনে পলায়ন করেন না। তুমি এখন জল থেকে উত্থিত হয়ে যুদ্ধ করো। তুমি মোহবশত কর্ণ এবং শকুনিকে আশ্রয়পূর্বক আপনাকে অমর জ্ঞান করে যে পাপাঁচরণ করেছে এখন তাঁর ফল ভোগ করো। তোমার ন্যায় বীরপুরুষেরা কখনোই সমর পরিত্যাগপূর্বক পলায়ন করে না। তুমি আর কীসের আশায় জলাশয়ে শায়িত আছো? ওঠো, গাত্ৰোখান করো, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও আমাদের পরাজিত করে এই পৃথিবী ভোগ করো।‘

দুৰ্যোধন জলের মধ্যে থেকেই বললেন, ‘প্রাণীমাত্রেরই অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু আমি প্রাণভয়ে পলায়ন করিনি। সংগ্রামে আমার রথ ও তৃণীর দুই-ই বিনষ্ট হয়েছে। সৈন্য সামন্ত পৃষ্ঠপোষক নিহত হয়েছে। আমি অতিরিক্ত পরিশ্রান্ত হয়েই সলিলমধ্যে প্রবেশ করে বিশ্রামের চেষ্টা করছি। প্রাণভয়ে বা বিষাদযুক্ত হয়ে এখানে লুকোতে আসিনি। অনুচরগণের সঙ্গে তুমিও কিয়ৎকাল বিশ্রাম নাও। আমি অবিলম্বেই সলিল থেকে সমুখিত হয়ে সংগ্রাম করবো।‘

যুধিষ্ঠির বললেন, “আমাদের কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। তুমি অবিলম্বে হ্রদের মধ্য থেকে উত্থিত হয়ে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও আমাদের হাতে নিহত হয়ে বীরলোক প্রাপ্ত হও।‘

দুৰ্যোধন বললেন, “আমি যাদের জন্য রাজ্যলাভের অভিলাষ করেছিলাম, আমার সেই সমস্ত ভ্রাতা পরলোক গমন করেছে। পৃথিবীও রত্নহীন, ক্ষত্রিয় বলেও আর কিছু নেই। এই অবনীকে ভোগ করতে আর আমার কোনো স্পৃহা নেই। হে যুধিষ্ঠির আমি এখনো পাণ্ডবগণকে ভগ্নোৎসাহ করে তোমাকে পরাজিত করতে পারি। কিন্তু পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণকে হারিয়ে আমার মনে আর যুদ্ধের কোনো স্পৃহ নেই। তুমিই এখন সকলকে নিয়ে এই পৃথিবী ভোগ করো। আমার জীবনধারণেরও কোনো ইচ্ছা নেই। আমি মৃগচর্ম পরিধান করে বনে গমন করবো। ভোগে আর বিন্দুমাত্র স্পৃহা অনুভব করছি না।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আর পরিতাপ করে কী হবে? তোমার আর্তপ্রলাপে আমার মনে অণুমাত্র দয়ার সঞ্চার হচ্ছে না। তুমি পৃথিবী দান করলে আমি নেবো কেন? আর এখন তুমি পৃথিবী দান করবার কে? এখন তোমার এই রাজ্য বলপূর্বক গ্রহণ বা দান করবার ক্ষমতাই কি আছে? দুৰ্যোধন, তুমি রাজ্য দানে অভিলাষী হলেও, আমি তোমার প্রাণ রক্ষা করবো না। এখন তোমার জীবন আমার অধীন। আমি ইচ্ছে করলে তোমার প্রাণ রক্ষা করতে পারি, কিন্তু তুমি আত্মপরিত্রাণে কখনোই সমর্থ হবে না। এখন তুমি জল থেকে উত্থিত হয়ে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।‘

এবার জল আলোড়িত করে উঠে এলেন দুৰ্যোধন। যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হয়ে বললেন, ‘তোমাদের রথ ও বাহন, বন্ধুবান্ধব সবই আছে। কিন্তু আমি একা এবং বিরথ, অত্যন্ত পরিশ্রান্ত। এখন তোমরা অনেকে রথারূঢ় হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে আছো, সুতরাং আমি কী করে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো? অতএব, তোমরা একে একে আমার সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও তোমাদের কারোকে দেখেই আমার মনে কোনো ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে না। আমি একা তোমাদের সকলকে নিবারণ করবো। হে যুধিষ্ঠির! আমি তোমাকে তোমার ভ্রাতৃগণের সঙ্গে নিপাতিত করে বাহুলীক ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্ৰথ, শল্য, ভূরিশ্রবা শকুনি এবং আমার ভ্রাতাগণ পুত্ৰগণ ও বন্ধুবান্ধব সকলের ঋণ পরিশোধ করবো।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তোমার অভীষ্ট আয়ুধ গ্রহণ করে আমাদের মধ্যে যে কোনো বীরের সঙ্গে সমাগত হয়ে যুদ্ধ করো। আমরা সকলে রণস্থলে অবস্থানপূর্বক যুদ্ধব্যাপার নিরীক্ষণ করবো। এখন আমি বলছি, তুমি আমাদের মধ্যে একজনকে বিনাশ করতে পারলে, সমুদয় রাজ্য তোমার হবে।’

দুৰ্যোধন বললেন, “যদি আমাকে একজনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, তা হলে আমি তোমাদের মধ্যে যে সর্বাপেক্ষা বলশালী তাঁর সঙ্গেই যুদ্ধ করবো। তুমি আমাকে যে কোনো আয়ুধ গ্রহণ করতে বলেছো, আমি এই গদা মনোনীত করলাম। এখন তোমাদের মধ্যে যিনি আমার বলবীৰ্য সহ্য করতে সমর্থ, তিনিই আসুন।‘

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তুমি যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।

দুৰ্যোধন তাঁর সুদৃঢ় ভীষণ লৌহময় গদা কাধে নিয়ে প্রচণ্ড মার্তণ্ডের ন্যায় সমাগত হলেন। বললেন, ‘হে পাণ্ডবগণ! আমি অচিরাৎ তোমাদের যমালয়ে প্রেরণ করবো।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘এখন তুমি কবচ পরিধান, কেশকলাপ বন্ধন ও যে কোনো দ্রব্যের অভাব থাকে, সে সব গ্রহণ করো। আমি এখনো বলছি, তুমি পাণ্ডবদিগের যার সঙ্গে অভিরুচি হয়, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। হয় তাঁকে বিনাশ করে রাজ্যপদ লাভ করো, না হয় তাঁর হস্তে নিহত হয়ে স্বৰ্গসুখ অনুভব করো।’

দুৰ্যোধন সুবর্ণময় বর্ম ও কনকমণ্ডিত বিচিত্র শিরস্ত্রণ গ্রহণ করে গদা সমুদ্যত করে পাণ্ডবদের বললেন, “হে বীরগণ, এখন তোমরা কে আসবে এসো। আমি ক্রমে ক্রমে সকলকেই বিনাশ করে বৈরানল নির্বাণ করবো।’

যখন দুৰ্যোধন এভাবে তর্জনগর্জন করছিলেন, কৃষ্ণ পরম ক্রোধান্বিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনি কোন সাহসে বলছেন যে আমাদের মধ্যে যাকে খুশি তাঁকে বেছে নাও? আপনি দুৰ্যোধনের সঙ্গে পারবেন লড়তে? সে যদি এখন আপনাকে চায়? আপনি কেন, অর্জুন নকুল সহদেব কেউ কি পারবে? তখন? তখন আপনার কী হবে ভেবে দেখেছেন? গদাযুদ্ধে দুৰ্যোধন অতিশয় পারদর্শী, ভীমসেনও পারবেন কিনা সন্দেহ। পূর্বে দূতক্রীড়া করে যে সর্বনাশ করেছিলেন, আবার তাই হবে। দুর্যোধন গদাযুদ্ধে কৃতী, যদি তিনি ভীমসেনকে চান, তবু রক্ষা। ভীমসেন পরাক্রমশালী, ভাগ্যবলে ভীমসেনকে নির্বাচন করলে তবু কিছু আশা করা যায়। নচেৎ, সেই পাশাক্রীড়াই পুনরায় শুরু হবে বলে ধরে নিন। যেখানে ভীমসেন পারবে কিনা সন্দেহ, আপনি এই প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, আমাদের মধ্যে যার সঙ্গে খুশি তাঁর সঙ্গেই এই গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হও।‘

কৃষ্ণের কথা শুনে ভীম বললেন, ‘যদুনন্দন! তুমি বিষন্ন হয়ে না। আমি নিশ্চয়ই দুর্যোধনকে বিনাশ করবো।‘

একথা শুনে কৃষ্ণ আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘হে বীর যুধিষ্ঠির তোমার বাহুবলেই আজ অরতিবিহীন হয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ করতে চলেছেন। এখন তুমি দুর্যোধনকেও নিপাতিত করে, বিষ্ণু যেমন দেবরাজকে স্বৰ্গরাজ্য প্রদান করেছিলেন তুমিও ধর্মরাজকে সেইরূপ পৃথিবী প্রদান করে।’

ভীমসেনকে তারপর সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগলেন।

ভীমসেন বললেন, ‘ঐ পুরুষাধম কখনোই আমাকে পরাজিত করতে পারবে না। আজ গদার আঘাতে ঐ পাপাত্মার প্রাণসংহার পূর্বক দুর্যোধনের প্রতি হৃদয়নিহিত ক্রোধানল নিক্ষেপ করবো। এই বলে ভীম গদা উত্তোলন করে দাঁড়ালেন।

দুৰ্যোধনও উত্তম মাতঙ্গ যেমন মত্ত মাতঙ্গ প্রতি ধাবমান হয়, সেভাবে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হলেন। নির্ভয়শরীরে অসংকোচিতচিত্তে সমরক্ষেত্র অবলোকন করতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘বাগাড়ম্বর করবার প্রয়োজন নেই। অবিলম্বে আমার সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। আমি সিক্ত দেহ তাতেই শুষ্ক করে নেবো। শোনো, ন্যায়ানুসারে গদাযুদ্ধে সুররাজ পুরন্দরও আমাকে পরাজিত করতে সক্ষম নন। কিন্তু বাসুদেবের পরামর্শে অন্যায়যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে না। সেটা ব্রাত্যের ধর্ম হতে পারে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়।’

বীরদ্বয়ের ভীষণ গদাযুদ্ধ আরম্ভ হলে পাণ্ডবগণ সকলেই উপবেশন করলেন। ঐ সময়ে বলরামও শিষ্যদ্বয়ের সংগ্রাম বৃত্তান্ত অবগত হয়ে সেখানে এলেন। তাঁকে দেখে সকলেই খুব প্রীত হলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদ্বয়ের যুদ্ধ দেখতে বসলেন। বলরাম কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘তুমি কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করো, কিন্তু কৃষ্ণ সেকথা না শুনে পাণ্ডবপক্ষে গেলেন। তখন বলরাম রোষপরবশ হয়ে, কারো পক্ষ অবলম্বন না করে, তীর্থযাত্রায় নির্গত হয়েছিলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে শিষ্যদ্বয়ের গদাযুদ্ধের সংবাদ পেয়ে এখানে এসেছেন। সকলেই তাঁকে যার যার সম্পর্ক অনুযায়ী আলিঙ্গন অভিবাদন নমস্কার পূর্বক স্বাগত ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। রাজা দুৰ্যোধন আর ভীমও এসে অতিপ্রীতমনে নমস্কার পূর্বক স্বাগত ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। অনন্তর, তিনিও অতি প্রীতমনে গদাযুদ্ধ নিরীক্ষণ করবার জন্য উপবেশিত হলেন।

ভীম চিৎকার করে দুৰ্যোধনকে নানা বাক্যশল্যে বিদ্ধ করছিলেন। দুৰ্যোধন বললেন, কেন বৃথা বাগজাল বিস্তার করছো, অদ্য অবশ্যই তোমার যুদ্ধ করার ঔৎসুক্য অপনোদন করবো। দুৰ্যোধন সামান্য ব্যক্তির মতো তৎসদৃশ লোকের কথায় ভীত হবার পাত্র নয়। আমার বহুদিনের বাসনা তোমার সঙ্গে গদাযুদ্ধ করবো। আজ দৈব অনুকূল। এখন বৃথা বাক্য ব্যয় না করে অচিরাৎ কার্যে সেটা পরিণত করো।” বলেই মহাবেগে ভীমের দিকে ধাবমান হলেন।

অনন্তর পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণপূর্বক জিগীষাপরবশ হয়ে তুমুল যুদ্ধে ব্যাপৃত হয়ে রণস্থলে ঘোরতর শব্দ সমুখিত করলেন। গদা নিষ্পেষণে হুতাশনস্ফুলিঙ্গ বিদ্যুতের মতো চমকাতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে দুজনে শ্রমকাতর হয়ে মুহুর্তকাল বিশ্রাম করে, পুনরায় যুদ্ধ শুরু করলেন। সেই বীরদ্বয়ের যুদ্ধ দেখে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হলেন এবং কার যে জয়লাভ হবে স্থির করতে পারলেন না। দুই যোদ্ধাই দুজনকে বিবিধ কৌশল দেখিয়ে সময় সুযোগমতো আঘাত করতে লাগলেন।

একসময়ে অর্জুন দুই যোদ্ধার এই ঘোরতর যুদ্ধ দেখতে দেখতে কৌতুহলবশত কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এঁরা সমানেই যুদ্ধ করছেন। তোমার মতে এদের মধ্যে কে অপেক্ষাকৃত যুদ্ধকুশল এবং কারই বা কোন গুণ অধিক বলো তো।‘

কৃষ্ণ বললেন, ‘এঁরা দুজনেই সমান উপদেশ পেয়েছেন। তবে ভীমসেন বলবান বটে কিন্তু দুৰ্যোধন ভীমসেন অপেক্ষা অনেক বেশি শিক্ষিত এবং যুদ্ধনৈপুণ্যে অনেক বেশি পটুত্ব অর্জন করেছেন। ভীমসেন ন্যায়যুদ্ধে কখনোই দুর্যোধনকে পরাজিত করতে পারবেন না। অন্যায় যুদ্ধ করেই দুর্যোধনকে বিনষ্ট করতে হবে। যদি ভীমসেন দুৰ্যোধনের সঙ্গে ন্যায়যুদ্ধ করেন, তবে রাজা যুধিষ্ঠির মহাসংকটে নিপতিত হবেন। পুনরায় ধর্মরাজের অপরাধেই আমাদের মহৎ ভয় উপস্থিত হয়েছে। ভীষ্ম প্রভৃতি মহাবীরগণ নিহত হওয়াতেই আমরা জয়লাভ করেছিলাম। এখন আবার ধর্মরাজের জন্যই ঘোর বিপদ উপস্থিত। তবু ভালো দুর্যোধন তাঁকেই যুদ্ধে আহবান করেননি। বীরগণ অবশ্য তা কখনো করেনও না। তদ্ব্যতীত, দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের মতো শুয়ে বসে অন্যদের বিক্রমে যুদ্ধ করেননি। তাঁর রাজত্বও তিনি তাঁর একার যোগ্যতাতেই অতি সুশৃঙ্খলভাবে চালিয়েছেন।

কৃষ্ণের কথা শুনে অৰ্জুন ভয় পেলেন। বললেন, তা হলে কী হবে?

কৃষ্ণ বললেন, ‘অন্যায় যুদ্ধেই জয়ী হতে হবে।’

অর্থাৎ এই পর্যন্ত যা করে এসেছেন, যে পরামর্শ দিয়ে এসেছেন, পুনরায় সে কার্যই করলেন তিনি। যুদ্ধের চরম মুহুর্তে অৰ্জুন ইঙ্গিতে তখন ভীমকে নিজের উরুদেশটা দেখিয়ে দিলেন।

অর্থাৎ মনে করিয়ে দিলেন তিনি দুর্যোধনের উরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

বৃকোদর তদর্শনে তাঁর অভিপ্রায় অবগত হয়ে গদাহন্তে বিবিধ গতি প্রদর্শন পূর্বক পরিভ্রমণ করে দুৰ্যোধনকে চমৎকৃত করতে লাগলেন। আরো কিছুক্ষণ অবিরাম যুদ্ধ করে সংগ্রামে উভয়েই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, দুজনেই পুনরায় ক্রুদ্ধচিত্তে গদা গ্রহণ পূর্বক সংগ্রাম শুরু করলেন। পরস্পর পরস্পরের আঘাতে শোণিতাক্ত কলেবর হয়ে আরো দুর্জয় হয়ে উঠলেন। একসময়ে ভীম মিথ্যা দৌর্বল্য দেখিয়ে, দুর্যোধনকে ঈষৎ গর্বিত করে, তাঁর প্রতি ধাবমান হতে প্রলোভিত করলেন। দুৰ্যোধন যেইমাত্র তাঁর সম্মুখীন হলেন তৎক্ষণাৎ ভীম অতি বেগে গদা নিক্ষেপ করলেন। দুর্যোধনও তৎক্ষণাৎ সেই স্থল হতে বহুদূরে অপসৃত হলেন। সুতরাং ভীমের এই সুযোগটা ব্যর্থ হলো। দুর্যোধন তখন স্বীয় গাদঘাতে ভীমকে এতো জোরে আঘাত করলেন যে বৃকোদর প্রায় মূৰ্ছাগত হলেন। এ অবস্থায় ভীমকে অবস্থিত দেখে দুৰ্যোধন আর তাঁকে প্রহার করতে পারলেন না। মানবিক ধর্ম প্রযুক্ত হয়ে ভীমকে সুস্থ হবার অবকাশ দিলেন। তিনি কুরুকুলের রাজা দুর্যোধন বীর্যপ্রয়োগেও তারা নিয়ম কানুনের অধীন। কৃষ্ণের মিথ্যাচারে সমাচ্ছন্ন পাণ্ডবদের প্রবঞ্চনা তিনি জানেন না। যেই মুহুর্তে দুর্যোধন একটু স্থির হলেন, তৎক্ষণাৎ ভীম দুর্যোধনের প্রতি মহাবেগে ধাবিত হলেন। ভীমকে রোষান্বিত চিত্তে আগমন করতে দেখে, তাঁর গদাঘাতের প্রহর ব্যর্থ করবার জন্য দুৰ্যোধন উর্ধ্বে উঠবার চেষ্টা করলেন, এবং লম্ফ দিয়ে যেই মাটি ছাড়লেন, তৎক্ষণাৎ বৃকোদর তাদের চিরাচরিত মিথ্যা কৌশলে, যুদ্ধের নিয়ম ভেঙে, তাঁর বজ্ৰতুল্য ভীষণ গদা দুর্যোধনের দিকে মহাবেগে নিক্ষেপ করে তাঁর জানুদ্বয় ভঙ্গ করে ভূতলে নিপাতিত করলেন। তারপর তাঁর মস্তক পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলেন।

এই অন্যায় যুদ্ধ দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রোধাবিষ্ট হলেন। হাত তুলে ভীষণ আর্তনাদ পরিত্যাগ ও ভীমসেনকে বারংবার ধিক্কার দিয়ে বললেন, ‘ধর্মযুদ্ধে নাভির অধঃস্থলে গদাঘাত করা নিতান্ত অন্যায় হয়েছে। গদাযুদ্ধে ভীম যেরকম কুকার্যের অনুষ্ঠান করলো, এরকম আর কখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। নাভির নিচে কদাচ গদাঘাত করবে না, এটা শাস্ত্রের নিয়ম ও স্থির সিদ্ধান্ত। কিন্তু মহামূর্খ বৃকোদর শাস্ত্রসম্মত ব্যবহার অতিক্রম করে স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হয়েছে। বলতে বলতে ক্রোধে একান্ত অধীর হয়ে লাঙল উদ্যত করে মহাবেগে ভীমের দিকে ধাবমান হলেন। অনেক কষ্টে বাসুদেব তাঁকে শান্ত করলেন।

হলধর বললেন, সাধু লোকেরাই ধর্মের অনুষ্ঠান করে থাকেন, কিন্তু সেই ধর্ম, অর্থ ও কাম দ্বারা নষ্ট হয়। অতএব, যে ব্যক্তি ধর্ম অর্থ ও কামের প্রতি সমদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে কালযাপন করতে পারে, সে-ই যথার্থ সুখভোগে সমর্থ হয়। হে হৃষিকেশ! এখন তুমি যতো চেষ্টাই করো না কেন, ভীম যে অধৰ্মাচরণ করেছে, তা আমার মন থেকে কখনোই দূর করতে সমর্থ হবে না। ভীম ধর্মপরায়ণ দুর্যোধনকে অধৰ্মানুসারে বিনষ্ট করেছে, এই কুট যোদ্ধাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না। আর ন্যায়যুদ্ধ করার জন্য দুৰ্যোধন শাশ্বত স্বৰ্গ লাভ করবেন।’ এই বলে নিতান্ত অসন্তুষ্ট চিত্তে তিনি চলে গেলেন সেখান থেকে।

অতঃপর কৃষ্ণ যখন দুর্যোধনের বিরুদ্ধে অনেক কটুবাক্য প্রয়োগ করছিলেন, তখন দুৰ্যোধন কৃষ্ণের মুখে ঐ ধরনের বাক্য শুনে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলেন। বললেন, ‘হে কংসদাসতনয়! অর্জুন তোমারই নির্দেশে ভীমকে আমার উরুভঙ্গ করতে ইঙ্গিত করেছিলো। হে নির্লজ্জ! প্রতিদিন তোমার কূট উপায় দ্বারাই যুদ্ধে প্রবৃত্ত সহস্ৰ সহস্ৰ নৃপতি নিহত হয়েছেন। তুমি শিখণ্ডীকে অগ্রসর করে পিতামহকে নিপাতিত করেছো। যুধিষ্ঠির তোমারই প্ররোচনায় মিথ্যা বলে আচার্যকে অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিয়েছিলো আর সেই অবসরে দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন তোমারই সমক্ষে আচার্যকে নিহত করেছে। কর্ণ অৰ্জুনের বিনাশার্থ বহুদিন অতি যত্ন করে যে শক্তি রেখেছিলেন, তুমি তোমার কৌটিল্যের দ্বারা সেই শক্তি ঘটােৎকচের উপর নিক্ষেপ করিয়ে ব্যর্থ করেছো। সাত্যকি তোমারই প্ররোচনায় ছিন্নহস্ত প্রায়োপবিষ্ট ভূরিশ্রবাকে নিহত করেছে। মহাবীর কর্ণ অৰ্জুন বধে সমুদ্যত হলে তুমি নিজে তাঁর সর্পবাণ ব্যর্থ করেছো। কিন্তু তোমার প্রতিজ্ঞা ছিলো তুমি যুদ্ধ করবে না। তদ্ব্যতীত, একজনের সঙ্গে দুজনের যুদ্ধও অধর্ম। তারপর কী-ভাবে তাঁকে মারলে রথ থেকে নেমে সে মাটিতে বসে যাওয়া রথের চাকাটা যখন তুলছিলো এবং বলেছিলো আমি এখুনি চাকাটা তুলে রথে উঠছি, তোমরা যেন আমাকে সেই নিরস্ত্র অবস্থায় মেরে অধৰ্ম করো না, সেটা ধর্মের বা যুদ্ধের রীতি নয়, তুমি তক্ষুনি অর্জুনকে বললে, ওকে রথে ওঠার সময় দিয়ো না, এই অবস্থাতেই নিহত করো। তোমার কি লজ্জাও হয় না। অনার্য। আজ তুমি আমাকে কীভাবে ভীমকে দিয়ে অন্যায় আঘাতে নিপাতিত করালে।’

এসব শুনতে শুনতে পাণ্ডবগণ ও অন্যরা নিজেদের অধৰ্মাচরণ স্মরণ করে বিষন্ন হলেন। কৃষ্ণ বললেন, হে পাণ্ডবগণ রাজা দুৰ্যোধন অসাধারণ সমরবিশারদ এবং ক্ষিপ্ৰহস্ত। তোমরা কোনোভাবেই তাঁকে ধর্মযুদ্ধে পরাজিত করতে সমর্থ হতে না। তোমাদের হিতের জন্যই আমি এই উপায় উদ্ভাবন করেছি। আর যে সব মহারথীকে কৌশলে নিহত করা হয়েছে, ধর্মযুদ্ধ করলে কি তোমরা কখনো তাদের জয় করতে পারতে? সেজন্যই ছলের প্রয়োজনে ছিলো।’

অতঃপর আস্তে আস্তে সকলেই সেখান থেকে চলে গেলেন।

তারা চলে গেলে সঞ্জয় এলেন। তাঁকে দেখে দুর্যোধন বললেন, ‘হে সঞ্জয়! আমার পিতামাতা যুদ্ধধর্ম বিলক্ষণ অবগত আছেন। তুমি তাদের বলো, আমি বিবিধ যাগযজ্ঞানুষ্ঠান, ভৃত্য প্রতিপালন, ধর্মানুসারে সসাগরাবসুন্ধরা শাসন, যাচকদিগকে অর্থদান, অধ্যয়ন ও মিত্ৰগণের প্রিয়কার্য সাধন করেছি। সৌভাগ্যবশত, স্বধর্মনিরত ক্ষত্রিয়গণ যেরূপ মৃত্যু অভিলাষ করে, আমি সেভাবেই মৃত্যুর সাক্ষাৎ পেয়েছি। হে সঞ্জয়! তুমি আমার বাক্যানুসারে অশ্বথামা, কৃতবৰ্মা ও কৃপাচার্যকে বলবে, “পাণ্ডবেরা নিয়ম ব্যতিক্রম ও সতত অধৰ্মানুষ্ঠান করে থাকে, অতএব তোমরা যেন তাদের বিশ্বাস করো না’।”

এদিকে হতাবশিষ্ট অশ্বথামা, কৃপাচার্য ও কৃতবৰ্মা দূতদিগের কাছে জানতে পারলেন দুৰ্যোধনের উরুভঙ্গ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অতি দ্রুতগামী রথে চলে এলেন সেখানে। দুর্যোধনের অবস্থা দেখে বাষ্পাকুল নয়নে বাকশূন্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের অতি প্রিয় রাজা আজ রুধিরাক্ত কলেবরে সহসা নিপতিত সূর্যমণ্ডলের ন্যায়, পরিশুষ্ক সাগরের ন্যায়, পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় ভূতলে শায়িত। শোকে দুঃখে তাঁরা অভিভূত হলেন।

দ্রোণপুত্র অশ্বথামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ক্ৰন্দনরত কষ্ঠে বললেন, ‘হয়, তুমি পৃথিবী শাসন করতে, আজ তুমি এই নির্জন অরণ্যে এভাবে অবস্থান করছো? কৃতান্তের গতি দুজ্ঞেয় হে মহারাজ! তোমার এ অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছি না। তুমি সর্বলোকের মাননীয়, সকলের প্রিয় ইন্দ্র তুল্য বিভবশালী হয়েও এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে।’

অশ্বথামার কথা শুনে দুর্যোধন দুই হাতে চোখের জল মুছে বললেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা তো জানো, কালক্রমে সর্বভূতেরই বিনাশ হয়। ভাগ্যক্রমে, আমি কোনো বিপদেই সমরে পরাজুখ হইনি; পাপাত্মারা ছলপূর্বক আমার এই অবস্থা ঘটিয়েছে। এই ভালো হলো, এখন আমি সমরক্ষেত্রে জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিহত হলাম। আর আজ যে তোমাদের এই ভীষণ জনক্ষয়ের মধ্য থেকে বিমুক্ত দেখছি সেটা আমার পরম সৌভাগ্য!” দুর্যোধনের চোখের জলে কথা থেমে গেল।

পাণ্ডবগণ একমাত্র তোমাকেই তো এই নৃশংস ব্যবহারের দ্বারা আহত করেনি, আমার পিতাকেও তো নিধন করেছে। তা-ও আমি তুলিনি, ভুলবো না। কিন্তু আজ তোমার জন্য যে কষ্ট আমার হৃদয়কে মথিত করছে, এমন কখনো হয়নি। আমি শপথ করছি, যে কোনো প্রকারেই হোক, বাসুদেব সমক্ষেই সমস্ত পাঞ্চালগণকে শমনসদনে প্রেরণ করবো। তুমি অনুজ্ঞা দাও।‘

দুৰ্যোধন প্রীত হয়ে তখনি কৃপাচার্যকে বললেন, ‘আচার্য সমস্ত নিয়মকানুন মান্য করে আমার সমক্ষেই এখন অশ্বথামাকে সেনাপতিপদে বরণ করুন।”

মহাবীর কৃপাচার্য সেই আদেশ শিরোধার্য করে অশ্বথামাকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করলেন, অতঃপর দুৰ্যোধনকে আলিঙ্গনপূর্বক সবাই বিদায় নিলেন।

সেখান থেকে চলে গিয়ে তারা শিবিরের অনতিদূরে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন, রজনী গভীর হয়ে এলে কৃতবৰ্মা এবং কৃপাচার্য নিদ্রিত হলেন, কিন্তু অশ্বথামা বসে রইলেন। তিনি কোনোক্রমেই নিদ্রাচ্ছন্ন হতে পারলেন না। দুর্যোধনকে মেরে পাণ্ডবরা দুর্যোধনদের সমস্ত শিবিরের অধিকার দখল করেছিলেন। অশ্বথামা কৃতবৰ্মা এবং কৃপাচার্যকে জাগরিত করে বললেন, “আমি এই সব কূটযুদ্ধের প্রতিশোধ নেবো। আমার পিতৃহন্তাকে, ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রথম হত্যা করে সমস্ত পাঞ্চাল এবং পাণ্ডবদের নিহত করবো। নীচাশয় ভীমসেন মহাবল পরাক্রান্ত অদ্বিতীয় বীর কুরুরাজকে অন্যায় ভাবে আহত করে মস্তকে পদার্পণপূর্বক যে নিষ্ঠুরকার্যের অনুষ্ঠান করেছে, সেটা ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যায়ের শাস্তি আমি অন্যায় ভাবেই দেবো। কীভাবে বিনাশ করেছে! হা কৰ্ণ! তোমাকেই বা কীভাবে বাণবিদ্ধ করলো।’

প্রকৃত অর্থে পাণ্ডবর একজন মহারথীর সঙ্গেও সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। আজ অশ্বথামা দুৰ্যোধনের কাছে প্রতিজ্ঞা করে এসেছেন, পাণ্ডবগণকে তিনি অবশ্যই বিনাশ করবেন। যে ভাবেই হোক, এখন ওরা বিজয়ী, অস্ত্রশস্ত্র ও উৎসাহশক্তিসম্পন্ন। তাদের সম্মুখ যুদ্ধে কোনোভাবেই বিনাশ করা সম্ভব নয়। ওরা কখনোই ধর্মানুসারে সংগ্রাম করেনি। কৃষ্ণের কুবুদ্ধিতে অন্যায় ব্যতীত একটি বড় যোদ্ধাকেও ধর্মসঙ্গতভাবে বিনাশ করতে সক্ষম হয়নি। সেই ক্ষমতা তাদের ছিলো না। নীচাশয় পাণ্ডবগণ পদে পদে শঠতা পরিপূর্ণ অতি কুৎসিত কার্যে অনুষ্ঠান করেছে। শ্রান্ত ক্লান্ত শস্ত্ৰদীর্ণ জলসিক্ত দুর্যোধনকে যেভাবে মিথ্যা আক্রমণে আহত করে, বিজয় গর্বে তার শিবির লুঠ করে, পাণ্ডবেরা সুখে নিদ্রা যাচ্ছে, সেই সুখ কেড়ে নেবার জন্য উত্তাল হয়ে উঠলেন অশ্বথামা।

অশ্বথামাকে কৃপাচার্য বললেন, ‘আমি সম্পূর্ণ অবগত আছি তুমি অতিশয় উত্তেজিত। কিন্তু বৎস, আমার ব্যক্য তুমি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করো। দৈব ও পুরুষকার অপেক্ষা কিছুই বলবান নয়। ঐ উভয়ের একত্র সমাবেশ না হলে সিদ্ধিলাভ হওয়া নিতান্ত সুকঠিন। পর্জন্য পর্বতোপরি সলিল বর্ষণ করে ফল উৎপাদনে সমর্থ হয় না। কিন্তু কৃষ্টক্ষেত্রে বারিবর্ষণ করলে প্রচুর ফল উৎপন্ন হয়। মনুষ্যের সমস্ত কার্যই দৈব ও পুরুষকারের সংযোগ সাপেক্ষ।‘

কৃপাচার্য তাঁকে উৎসাহ দিলেন না, বিরত করতে অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু অশ্বথামাকে কোনোক্রমেই শান্ত করা গেলো না। তাঁর মন তখন শোকানলে দগ্ধ হচ্ছিলো। বিষম দুঃখপ্রভাবে স্থির থাকতে পারছিলেন না। যা তিনি স্থির করেছেন, মনে হলো সেটা করতে পারলেই তাঁর শোক শান্ত হবে। সুতরাং, তাঁর সংকল্প তিনি ত্যাগ করতে অসমর্থ হলেন। সেই মুহুর্তেই স্বীয় পিতা এবং রাজা দুর্যোধনের জন্য তাঁর প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি প্রজ্বলিত হয়ে উঠলো। আজ পাণ্ডবরা জয়লাভে প্রফুল্ল হয়ে নিশ্চয়ই কবচ পরিত্যাগ করে শান্তিতে নিদ্রাগত হয়েছে। আজই সুযোগ। পাণ্ডবগণ কী করলো? শঠতা, প্রবঞ্চনা এবং সুযোগের দ্বারাই লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটালো। তা সত্ত্বেও তারা যদি নিন্দনীয় না হন, তাঁরও হবার কথা নয়।

পিতৃহন্তাকে নিধন না করা পর্যন্ত মুহুর্তকালও জীবিত থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। রাজা দুৰ্যোধন নিতান্ত অন্যায়ভাবে ভগ্নোরু হয়ে কীভাবে পড়ে আছেন সমরাঙ্গনে। সেই বেদনাতেও বার বার দুই চক্ষু জলে ভরে যাচ্ছে।

কৃপাচার্য ও কৃতবৰ্মার কোনো প্ৰবোধবাক্যই তাঁর ক্রোধ উপশমিত করতে পারলো না। অশ্বথামা চলে গেলেন শিবিরের নিকট। তারপরে অনেক অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা আছে। সেই অপ্রাকৃত ব্যাখ্যায় যাবার দরকার নেই। মোট কথা, ঈশ্বরের পদে নিজেকে সমৰ্পিত করে, অশ্বথামা শিবিরে প্রবেশ করলেন। কৃতবৰ্মা ও কৃপাচার্য দ্বারদেশে অবস্থান করতে লাগলেন। তাদের দেখে দ্রোণপুত্র খুব আহ্লাদিত হলেন, তাঁর মন অনেক সবল হলো। আনন্দিত চিত্তে বললেন, ‘হে বীরদ্বয়! আপনারা যত্ন করলে সবই সম্ভব। আমি এখন কৃতান্তের মতো শিবির মধ্যে প্রবেশ করি।‘

শিবির মধ্যে প্রবেশ করে নিঃশব্দ পায়ে ধৃষ্টদ্যুমের শয়নাগারে উপস্থিত হলেন। ঐ সময়ে সমরপরিশ্রান্ত পাঞ্চালগণ গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত ছিলেন। অশ্বথামা দ্রুপদপুত্রের শয়নগৃহে প্রবেশ করে তাঁকে অকুতোভয়ে নিদ্রায় মগ্ন দেখে প্রচণ্ড জোরে পদাঘাতে জাগরিত করলেন। দুই হাতে তাঁর চুল ধরে মাটিতে নামিয়ে নিষ্পেষিত করতে লাগলেন। খৃষ্টদ্যুম্ন নিদ্রার ঘোর ও ভয়ে তাঁর প্রতিবিধানের কোনো চেষ্টাই করতে পারছিলেন না। অশ্বথামা তাঁর দুপায়ের পাতায় সমস্ত শক্তি সংহত করে ধৃষ্টদ্যুমের বক্ষঃস্থল ও কণ্ঠদেশ আক্রমণ করে পশুর মতো নিধন করতে সমুত্থিত হলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুম্ন দুহাতের নখর প্রহারে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আচার্যপুত্র! তুমি আমাকে অস্ত্রপ্রহারে সংহার করো। তাহলে আমি তোমার প্রসাদে পবিত্ৰলোকে গমন করতে পারবো। অশ্বথামা দ্রুপদতনয়ের এই অব্যক্ত বাক্য শ্রবণ করে বললেন, ‘কুলাঙ্গার! আচার্যকে তুমি কী ভাবে সংহার করেছে তা কি তোমার স্মরণে নেই? আচার্য-হন্তা হয়ে এখন তুমি কোনো লোকেই স্থান পাবে না অতএব তোমার উপর আমি কোনো অস্ত্রই নিক্ষেপ করবো না।’ এই বলে সিংহ যেমন মদমত্ত মাতঙ্গের মর্মপীড়া করে সেভাবে পদাঘাতে পদাঘাতে ধৃষ্টদ্যুমের মর্মপীড়া করতে লাগলেন। তখন ধৃষ্টদ্যুমের চিৎকারে সবাই জেগে উঠলো। কিছু বুঝতে না বুঝতেই অশ্বথামা ধৃষ্টদ্যুম্নকে শেষ করে রথে উঠে বসলেন।

ধৃষ্টদ্যুমের গৃহ থেকে বহির্গত হতেই শিবিরের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা জাগরিত হয়ে অশ্বথামাকে পরিবেষ্টন করলেন। দ্রোণপুত্র তাদের রুদ্রাস্ত্র দিয়ে নিপাতিত করে অনতিদূরে নিদ্রিত উত্তমৌজাকে দেখে তাঁকেও পদদ্বয়ের শক্তিতে কণ্ঠ ও বক্ষঃস্থল আক্রমণ করে শমনসদনে পাঠালেন। মোটকথা, অশ্বথামা শিবিরে নিদ্রামগ্ন মহা মহা যোদ্ধৃগণকে নিধন করে, রুধিরাক্ত দেহে কালান্তকের চেহারা নিয়ে, সাক্ষাৎ যমের মতো দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ও শিখৰ্ত্তীসহ আরো অনেক মহারথকে নিধন করে, পাণ্ডবশিবির প্রায় শূন্য করে অপসৃত হলেন। দ্রোণপুত্রের রক্তমাখা ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে কেউ ভাবলে ভূত, কেউ ভাবলো রাক্ষস। কেউ যুদ্ধ করতে চেষ্টা করে বিফল হলো, কেউ পালিয়ে গেলো। কিন্তু কেউ তাঁকে চিনতে পারলো না। কিছু করতেও পারলো না। কৃতবৰ্মা ও কৃপাচার্যও দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে থেকে বহু পলায়ন-তৎপর রক্ষীকে নিধন করলেন। তারপর তারাই শিবিরের তিন স্থানে অগ্নিপ্রদান করলেন। অগ্নি প্রজ্বলিত হওয়াতে শিবির আলোকময় হয়ে উঠলো। সেই আলোতে অশ্বত্থামা তরবারি হাতে নিয়ে বিচরণ করতে লাগলেন এবং যারা তাঁর দিকে আসছিলো আর যারা ভয়ে পলায়ন করছিলো সকলকেই বিনাশ করলেন।

দ্রোণপুত্র এইভাবে অর্ধরাত্রির মধ্যেই পাণ্ডবদিগের সমুদয় সৈন্য শমনসদনে প্রেরণ করলেন। কুরুক্ষেত্রের মতো সেখানেও মৃতদেহের স্তৃপ জমে উঠলো। শিবিরের সব ঘুমন্ত মানুষ পুনরায় চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হলেন। অশ্ব গজ প্রভৃতি সেইসঙ্গে মৃত্যুর স্তুপে পরিণত হয়ে একটা ভীষণ আকৃতি নিলো। অতঃপর কৃতবৰ্মা, কৃপাচার্য ও অশ্বথামা তিনজন আনন্দে করতালি প্রদানপূর্বক হর্ষধ্বনি করতে আরম্ভ করলেন। আনন্দের আতিশয্যে তিনজনেই তিনজনকে আলিঙ্গন করে অতি দ্রুত কুরুরাজ দুর্যোধনের নিকটে এলেন।

এসে দেখলেন তখনো তিনি জীবিত আছেন, কিন্তু দেহের দুর্জয় যন্ত্রণায় প্রায় সংজ্ঞাহীন। এই অবস্থা দেখে তিনজনেই অতি শোকাকুল হয়ে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করে তাঁকে স্পর্শ করলেন। দুর্যোধন অতি কষ্টে চক্ষু উল্মীলিত করে তাকালেন তাদের দিকে। কুরুরাজকে তাকাতে দেখে তারা দুর্বিষহ দুঃখে অশ্রুসম্বরণ করতে পারলেন না। নিজেদের হস্তদ্বারা দুৰ্যোধনের মুখ থেকে রক্তধারা মুছিয়ে দিলেন। অশ্বথামা কুরুরাজকে সম্বোধন করে বিলাপ ও পরিতাপ করে বললেন, “হে মহারাজ! তোমাকে সবাই ধনুর্ধরাগ্রগণ্য বলে নির্দেশ করতো। বলরাম তোমার গুরু ও যুদ্ধে সর্বগ্রগণ্য। দুরাত্মা ভীম কীভাবে তোমার এমন দশা ঘটালো? সেই পাপাত্মা ছলপূর্বক তোমাকে ধরাশায়ী করেছে। ধর্মযুদ্ধে আহবান করে যারা এই ধরনের কটযুদ্ধে পরাস্ত করে তাদের নরকে ঠাঁই হয়। তদুপরি, সে তোমার মস্তকে পা রেখেছে, আর যুধিষ্ঠির বসে বসে তা দেখেছেন। যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার দেবার ভাষা নেই। হে মহারাজ! তুমি কখনো অন্যায় যুদ্ধ করেনি, তুমি সর্বদা সৎ থেকেছো, মহর্ষিগণ ক্ষত্রিয়দের যা প্রশস্ত গতি বলে কীর্তন করেছেন, তুমি সেই গতিই লাভ করবে। কৃষ্ণ ও অর্জুনকে ধিক। এঁরা আবার নিজেদের ধাৰ্মিক বলে প্রচার করে। দ্রোণপুত্র এইসব বলে পরিতাপ করতে লাগলেন। তারা তাদের এমন প্রিয় রাজাকে নিজেদের শক্তি দিয়ে রক্ষা করতে পারলেন না বিধেয় রোদন করতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, ‘হে রাজন! আপনার শ্রুতিসুখকর কিছু সংবাদ জ্ঞাপন করি। দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, ধৃষ্টদ্যুমের পুত্রসহ ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অবশিষ্ট সকলকেই আমরা পশুর ন্যায়

সংহার ও পাণ্ডবগণের সমুদয় বাহন, সৈন্য ও পুত্রগণকে বিনাশ করে এর প্রতিশোধ নিয়েছি।‘

দুৰ্যোধন দ্রোণপুত্রের এই সমাচার শুনে প্রীত হয়ে বললেন, ‘পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ এবং কর্ণ যা পারেননি, তোমরা তা পেরেছো। দুই বাহু বাড়িয়ে দিলেন তিনজনের দিকে, গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। বললেন, ‘তোমাদের মঙ্গল হোক। পুনরায় স্বর্গে দেখা হবে।’ এই বলে প্রাণত্যাগ করলেন।

দুৰ্যোধনের মৃত্যুতে নায়িকা সত্যবতীর সমস্ত সংকল্প পূর্ণ হলো। আর এক ফোটা রক্তও রইলো না যা তাঁর নিজের রক্ত নয়। যারা রইলেন তাদের একজন সত্যবতীর অবৈধ পুত্র অনার্য কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, কৃষ্ণদ্বৈপায়নের অবৈধ পুত্র বিদুর, আর বিদুরের অবৈধ পুত্র যুধিষ্ঠির যে যুধিষ্ঠিরকে শান্তনুর সিংহাসন অধিকার করাবার বাসনায় তাঁর পিতা বিদুর এবং পিতামহ দ্বৈপায়নের এতো কাণ্ড, সেই যুধিষ্ঠির ঠিকই সেখানে অধিরূঢ় হলেন। কিন্তু কাকে শাসন করবেন, প্রজা কোথায়?

কর্ণকে যখন কৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘তুমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করেছো, ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্ব সকল শিখেছো, তুমি ধর্মানুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব তুমি রাজা হও তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ, দুই পক্ষকেই তোমার সহায় বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চলো, পাণ্ডবরা জানুক যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচ ভ্রাতা, এবং দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, এবং অভিমুন্য, তোমার চরণ ধারণ করবেন। দ্রৌপদীও ষষ্ঠকালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করবো। কুন্তীপুত্র, তুমি ভ্রাতৃগণে বেষ্টিত হয়ে রাজ্যশাসন করো। পাণ্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ্য হোক। কর্ণ জবাব দিয়েছিলেন, গোবিন্দ! সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সুবর্ণ পেলেও আমি আমার পুরোনো সম্বন্ধ কক্ষনো অস্বীকার করতে পারি না। তারপর আরো অন্যান্য কথার শেষে বলেছিলেন, ‘আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, তুমি যেন এক রক্তাক্ত পৃথিবীকে হাতে ধরে নিক্ষেপ করছে আর সেই অগ্নিস্তুপের উপর উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির সুবর্ণপাত্রে ঘৃত পায়স ভক্ষণ করছেন।‘

সেই স্বপ্নই শেষ পর্যন্ত সফল হলো।

কিন্তু পার্থিব লীলা সাঙ্গ হবার পর যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দেখলেন দুর্যোধন সেখানে অতি সম্মানের সঙ্গে উপবিষ্ট। তাঁর পরমতম আতীয়গণ তখন নরকে। তাঁকেও কিছুকালের জন্য নরকবাস করতে হয়েছিলো। আসলে স্বর্গ কোথায় কেউ জানে না। কোথায় নরক তা-ও কেউ জানে না। স্বৰ্গ-নরকের ধারণা এবং অস্তিত্ব মানুষের মনেই। মানুষের মনই তাঁর অব্যর্থ বিচারে দুৰ্যোধনদের শাশ্বত স্বৰ্গবাসের গরিমাদান করে পাণ্ডবদের নরকদর্শন করিয়েছিলো।

2 Comments
Collapse Comments

আপনি পাঁঠা।

মহাভারত সম্পর্কিত একটা বই নিয়া বহুত আলোচনা শোনার পরও প্রায় দুই যুগ ধইরা মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটির সময়কালে সেই বইটা সংগ্রহ কইরা দেখতে পারি নাই; বইটা হইল প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’। এই বইটা পড়তে না পারার আফসুসে……

কিন্তু অভাজনের মহাভারত প্রকাশ হইবার এক বছর পর সেই বইটা পইড়া মনে হইল মহাভারতের মহারণ্যে বইটা না পড়াই মঙ্গল হইছে আমার। কারণ ওইটারে মহাভারত সংক্রান্ত পুস্তক না কইয়া দ্বৈপায়ন- বিদুর আর যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলাই বোধহয় সব থিকা ভালো। যদিও বিদুর যে মূলত একখান ভিলেন চরিত্র সেইটা খিটখিট করতে করতে তিনি বহুত ভালো কইরাই দেখাইয়া দিছেন…

কিন্তু আগাগোড়া অবৈধ সন্তান-অবৈধ সন্তান কইয়া খিটখিট করা এই লেখক সম্পূর্ণ এড়াইয়া গেছেন যে মহাভারতের কালে কোনো মানুষের জন্মই অবৈধ হিসাবে গণ্য হইত না। মহাভারতে বহুত আদিমতা থাকলেও যেকোনোভাবে যেকোনো মনুষ্য জন্মরে স্বাগত জানাইবার মতো উদারতাখান আছিল তাদের। মনুষ্যজন্মরে অবৈধ বলার সংস্কৃতিটা মূলত যিশুপুরাণ প্রভাবিত ইউরোপিয়ান সভ্যতার দান…

আর সেই ইউরোপিয়ান সভ্যতার বর্ণবাদী চশমা দিয়া প্রতিভা বসু মহাভারতের দিকে তাকান বইলাই সারা মহাভারতে তিনি খালি অসভ্য কালা মানুষ আর অবৈধ সন্তানদের আবিষ্কার করেন…

মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নাই; এই কথাখান দুনিয়ার প্রাচীন সাহিত্যগুলার মাঝে একমাত্র মহাভারতেই উচ্চারিত হইছে; জিনিসটা চোখেও পড়ে না প্রতিভা বসুর। তিনার মহাভারতের মহারণ্য একখানা কুৎসিত আচোদা ল্যাওড়া পুস্তক। মহাভারত সম্পর্কে এত বর্ণবাদী কোনো আচোদা পাছায় আঙ্গুল দিয়া পুস্তক আমি এর আগে আর পড়ি নাই…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *