মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৭
দুৰ্যোধন বিদুরের কাছে সততই দুরাত্মা, তথাপি কেন দুরাত্মা তার কোনো প্রমাণ তখনো তিনি দিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু প্রচারে তো কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু অনৃতভাষণের দুর্যোধনকে যে কোনো প্রকারে নিষ্পিষ্ট করার প্রয়োজন ছিলো বিদুরের। এ বিষয়ে তাঁর একাগ্রতারও অভাব ছিলো না।
এই পাঁচটি পার্বত্য পুত্র জানে কুরুবংশীয় বিপক্ষীয় মানুষগুলোকে যে ভাবে হোক, পাপপুণ্যের প্রশ্ন দূরে সরিয়ে, সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে, সর্বস্ব গ্রাস করাই তাদের একমাত্র কর্তব্য। এই প্রাসাদের এই মানুষগুলোর প্রতি তাদের কোনো আতীয়তাবোধও যেমন নেই, ভ্রাতৃত্ববোধ ততোধিক দূরে। এখানকার কারোকেই যেমন তারা চেনে না, তেমনি পছন্দও করে না। কারো সঙ্গে ভালো ব্যবহারেরও প্রশ্ন নেই মনের মধ্যে। এই বিশাল রাজপুরীতে যে দুটি মানুষকে তারা চেনে জানে ভালোবাসে তাদের একজন অবশ্যই তাদের মাতা, অন্যজন বিদুর। বিদুর কেন? সেখানেই একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকে। বিদুর ধার্তরাষ্ট্রদের অত্যাচার করলে তুষ্ট হন। ধাৰ্তরাষ্ট্ররা যদি সেই অত্যাচারের পরিবর্তে, অর্থাৎ হিংসার পরিবর্তে প্রতিহিংসায় প্রবৃত্ত হয়, তা হলেই তিনি হায় হায় করে ওঠেন। সারা নগরেই আলোড়ন তুলে দেন।
দু-বছর পরে সময় আগত হলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। পুনরায় বিদুরের প্রচার শুরু হয়ে গেল। পাণ্ডবদের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্যে কোনো অবহেলা ছিলো না। কার্যত তিনি কখনো কোনো অন্যায় করেননি পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনও কখনো কোনো দ্বেষ বা বৈরিতার প্রকাশ করেছেন বা মন্তব্য করেছেন এমন কথা এই মহাগ্রন্থের অন্য কোথাও নেই। শুধু বলা আছে বিদুরের মুখে। অর্থাৎ দুর্যোধন তাঁর কার্যের দ্বারা দুর্নামের কোনো প্রমাণ তখনো দিতে পারেননি। যুধিষ্ঠিরও তাঁর কার্যের দ্বারা অথবা ব্যবহারের দ্বারা আমাদের জানতে দেননি তিনি মহাত্মা বা পাপাত্মা। ধৈর্যশীল অথবা অসহিষ্ণু। স্থির অথবা অস্থির ঋজু অথবা বক্র৷ সহৃদয় অথবা হৃদয়হীন। ধর্মপরায়ণ অথবা অধাৰ্মিক অমৃতভাষী অথবা সত্যবাদী। যে সমস্ত গুণাবলী শুনে আমরা পাঠকরা মুগ্ধ হই, সেগুলোও সমস্তই বিদুরের ভাষ্য এবং রচয়িতার রচনা।
যুধিষ্ঠির সর্বদাই যবনিকার অন্তরালে। তথাপি সকলেই জ্ঞাত হলেন যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত হতে না হতেই বিবিধ সদগুণের দ্বারা যুধিষ্ঠির অনতিকালের মধ্যেই এমন প্রিয় হয়ে উঠেছেন, এমন পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছেন যে পরম প্রাজ্ঞ, পরম ধাৰ্মিক, পরম রাজনীতিবিদ, রাগদ্বেষশূন্য ভীষ্ম চালিত সেই রাজ্যের প্রজারা নাকি বলতে আরম্ভ করেছে, ‘এই রাজাকেই আমরা চাই।’ অথচ পূর্বাপর যুধিষ্ঠির যেমন আড়ালে ছিলেন সে রকম আড়ালেই আছেন, কোনো কর্মের দ্বারাই নিজের গুণাগুণ প্রতিষ্ঠিত করেননি, ভালো বা মন্দের কোনো পরিচয় কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। শুধু মুখ থেকে মুখে রটিত হচ্ছে যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্ব। এ-ও রটিত হলো যে এসব শুনে ধৃতরাষ্ট্রের মন থেকে সমুদয় সাধুভাব দূরিত হয়েছে এবং তিনি অত্যন্ত কাতর ও একান্ত চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছেন। বিদুর এসব সংবাদও যেমন রটাতে লাগলেন, সেই সঙ্গে একথাও রটালেন যে দুর্যোধন কর্ণ শকুনি মিলে এই পঞ্চপাণ্ডবকে পুড়িয়ে মারার পরামর্শ করছে। তিনি আকারে ইঙ্গিতে তা বুঝতে পেরেছেন, সেজন্য একখানি নৌকা প্রস্তুত করে রেখেছেন তাঁদের অজ্ঞাতবাসে পাঠাবার জন্য। বিদুর যে নিতান্তই একটি জম্বুক সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে মহাভারতের সুন্দর একটি গল্প উল্লেখ করি।
এক শৃগাল, কোনো এক বনে ব্যাঘ্ৰ, ইন্দুর, বৃক ও নকুল এই চারজনের সঙ্গে বাস করতো। জম্বুক, অর্থাৎ শৃগাল, অতিশয় ধূর্ত আর স্বার্থপরায়ণ। একদিন বনের মধ্যে যুথপতি এক মৃগকে লক্ষ্য করে বলপূর্বক আক্রমণ করবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মৃগ অতিশয় বলবান, এজন্য সে নিজের অভীষ্ট সাধনে নিতান্ত অশক্ত হলে শৃগাল বললো, হে ব্যাঘ্ৰ, এই মৃগ অতিশয় যুবা ও বেগবান। সুতরাং তুমি বার বার যত্ন করলেও একে আক্রমণ করতে পারবে না। অতএব যে সময়ে ঐ মৃগ শয়নে থাকবে, সেই অবসরে মূষিক গিয়ে ঐ হরিণের পদদ্বয়ে দন্ত দ্বারা খুব কাটুক, তাহলে তুমি অনায়াসে তাঁকে ধরতে পারবে। তারপরে আমরা সকলে সমবেত হয়ে প্রফুল্লচিত্তে ভক্ষণ করবো। জম্বুকের পরামর্শ সকলেরই পছন্দ হলো। তারপর তাদের আদেশে মূষিক গিয়ে মৃগের পদদ্বয় ভক্ষণ করলো এবং ব্যাঘ্র তাঁকে আক্রমণ করে মরে ফেললো। তখন জম্বুক বললো, “তোমরা যাও, সবাই মিলে স্নান করে এসো, আমি বসে একে রক্ষা করি।” তখন তারা সকলে স্নান করতে চলে গেলো।
মহাবল ব্যাঘ্ৰ সকলের পূর্বে স্নান করে এলো। শৃগালকে চিন্তাক্রান্ত দেখে বললো, ‘কী ভাই জম্বুক, এতো চিন্তা কীসের? এসো আমরা এই মৃগমাংস ভক্ষণ করে আনন্দ করি।‘ তখন জম্বুক বললো, ‘হে মহাবাহো, মূষিক কী করেছে, শোনো। তুমি স্নান করতে গেলে সে অহংকার পরতন্ত্র হয়ে আমাকে বললো, আমিই আজ এই মৃগকে বধ করেছি। ব্যান্ত্রের বলবিক্রমে ধিক। আজ আমারই ভুজবলে তোমাদের তৃপ্তিসাধন হবে। বলবো কী, সে অহংকার পূর্বক এই রকম তর্জন-গর্জন করছিলো, এ কারণে মৃগমাংস ভক্ষণে আমার আর রুচি নেই।‘ তখন ব্যাঘ্ৰ ক্রোধভরে বললো, ‘হে জম্বুক! যদি সত্যই সে এইরূপ বলে থাকে, ভালো, তুমি যথাকালে আমাকে প্ররোচিত করেছো। আমি অদ্য বাহুবলে বনচরদিগকে বিনাশ করবো।’
তারপর মূষিক এলো। তাকে স্বাগত জানিয়ে সে বললো, ‘হে মূষিক! তোমার মঙ্গল তো? ব্যাঘ্ৰ যা বলেছে শোনো। তুমি স্নান করতে গেলে সে বললো, মৃগমাংসে আমার অভিরুচি নেই। এখন এই মাংস আমার বিষ বলে বোধ হচ্ছে। তোমার অমত না থাকলে আমি এক্ষুনি গিয়ে মূষিককে ভক্ষণ করি।’
এই কথা শুনে মূষিক অতিমাত্রায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে প্রাণভয়ে সত্বর বিবর মধ্যে ঢুকে গেলো। ইতিমধ্যে বৃক স্নান করে এলো। তাকে দেখেই জম্বুক বললো, ‘ভাই, ব্যাঘ্ৰ তোমার উপর অতিশয় রোষাবিষ্ট হয়েছেন, অতএব তোমার অনিষ্ট ঘটবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। তিনি কলত্রসহকারে শীঘ্রই এখানে আসছেন। এখন যা কর্তব্য হয় করো।’ তখন বৃক ভীত ও সংকুচিত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এই অবসরে নকুল এসে উপস্থিত। জম্বুক তাকে আগত দেখে বললে, ‘ওহে নকুল। আমি নিজ ভুজবলে সকলকে পরাস্ত করেছি; পরাজিত হয়ে তারা স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করেছে। এখন আমার সঙ্গে যদি জয়লাভ করতে পারো, তবেই তুমি ইচ্ছেমতো মৃগমাংস ভক্ষণ করতে পারবে। তখন নকুল বললো হে জম্বুক! ওদেরই যদি তুমি পরাজিত করতে পারো, তবে তো তুমিই সর্বাপেক্ষা বলবান। সুতরাং তোমার সঙ্গে সংগ্রামে যাবার আর আমার ইচ্ছা নাই। চললাম। এই প্রকার মিথ্যা বাক্যে প্রত্যেককে তাড়িয়ে শৃগাল পরম সুখে একলা মৃগমাংস ভক্ষণ করলো।
বিদুর নামে জম্বুকটিও ঠিক একই ভাবে যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যাসনে বসাবার জন্য পথ পরিষ্কার করতে লাগলেন। যতোদিন ধৃতরাষ্ট্র জীবিত আছেন, ততোদিন এই রাজ্যের সকল কিছুর অধিকারী হয়ে সিংহাসন দখল সুদূর পরাহত। তারও পরে আছে দুর্যোধন। সে-ও নিশ্চয়ই বিনা যুদ্ধে সমস্ত অধিকার ছেড়ে দেবে না। এদের ধনবল জনবল সবই মজুত আছে। যুদ্ধবিদ্যায়ও দুৰ্যোধন পারদর্শী। যারা তাদের অর্থবহ, যেমন ভীষ্ম আর দ্রোণের মতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী বীর, তারাও সঙ্গে থাকবেন। কর্ণ তো আছেনই। সুতরাং রাজার পিতা হবার জন্য তাঁর বসে বসে যতোগুলো দিন গুনতে হবে, ততোদিন তাঁকে তাঁর আয়ু ইহসংসারের সুখ ভোগ করতে দেবে কি? কুরুবংশের প্রতি এই আক্রোশের আগুন কি নিভবে? যে উদ্দেশ্যে তিনি এক জলযান তৈরী করে অনেক আগে থেকেই ‘দুর্যোধন পুড়িয়ে মেরেছে’ বলে রটিয়ে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন এবং সমস্ত ঘটনাটা দ্বৈপায়নকেও জানিয়ে রেখেছিলেন, বিধাতার বিধানে সেটা নিজে থেকেই ঘটে গেল।
বিদুরের নিকট পাণ্ডবদের জনপ্রিয়তার বর্ণনা শুনে ধৃতরাষ্ট্র যে কিঞ্চিৎ বিচলিত হননি তা নয়। বিদুরই তাঁর পরামর্শদাতা, তাঁর বিশ্বস্ত মন্ত্রী। ধৃতরাষ্ট্রের কর্ণকুহরে বিদুর নিজেই হয়তো এসব রটনা শুনে ভীত বিহ্বল হবার অভিনয় করে তাঁকে অস্থির করেছেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রকৃতই চিন্তান্বিত হয়ে মন্ত্রজ্ঞ নীতিনিপুণ মন্ত্রীবর কণিককে আহবান করে বললেন, ‘পাণ্ডবরা নাকি অতিশয় বর্ধনশীল হয়েছে, তুমি বুদ্ধি দাও আমি কী করবো।’ এই কণিকই জম্বুকের গল্পটি তাঁকে তখন বলেছিলেন। আরো যে সব মন্ত্রণা দিয়েছিলেন সে সব পড়তে পড়তে মনে হয় রাজনীতি নামক পদার্থটির মধ্যে আর যাই থাকুক নীতি নামে কোনো বস্তু নেই। কণিক প্রথমেই তাঁকে রাজার যা যা করণীয় বলে শুরু করলেন সংক্ষেপে তা হলো এই। এক, রাজার নিরবচ্ছিন্ন দণ্ড বা নিয়ত পৌরুষপ্রকাশ করা উচিত নয়। দুই, যাতে প্রতিপক্ষেরা কোষবলাদির কোনো অনুসন্ধান না নিতে পারে সে বিষয়ে সতত সতর্ক থাকা দরকার। তিন, তিনি সাধ্যানুসারে বিপক্ষের রন্ধ্রান্বেষণে তৎপর হবেন। চার, রাজার আত্মচ্ছিদ্র, গোপন পরিচ্ছিদ্রের অনুসরণ করা অবশ্যকর্তব্য। পাঁচ, অপকারী শক্রকে বধ করাই সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়। ছয়, শক্র দুর্বল হলেও কোনোক্রমে অবজ্ঞেয় নয়। সাত, পণ্ডিতেরা বলেছেন, যদবধি সময় আগত না হয় তৎকাল পর্যন্ত শক্রকে স্কন্ধে বহন করবে। অনন্তর, নির্দিষ্টকাল উপস্থিত হলে, যেমন মৃন্ময়ঘটকে প্রস্তরোপরি নিক্ষেপ করলে চূৰ্ণ করা যায়, তাদৃশ অপকারী শক্রকে বিনাশ করবে।
মাত্রই কয়েকটি লাইন আমি এখানে তুলে দিলাম। ধৃতরাষ্ট্রর সততায় সেই সব উপদেশ বিশেষ ফলবতী না হলেও, তিনি খুব নিরাপদে আছেন সে বিশ্বাস বিঘ্নিত হলো। এই নীতি, যার নাম রাজনীতি, সেই নীতি বিষয়ে কণিক আরো বললেন, যেমন, শক্রকে শপথ, অর্থদান, বিষপ্রয়োগ, বা মায়া প্রকাশ করে বিনাশ করা বিধেয়। পরমর্মবিদারক দারুণ কর্ম সম্পাদন, ও শত শত শত্রু সংহার না করে মনুষ্য কখনোই মহতী শ্ৰী লাভ করতে পারে না। দণ্ডায়ত্ত শক্রকে যে রাজা ধনমানাদি প্রদানপূর্বক অনুগ্রহ করেন, তিনি আপনার মৃত্যু সংগ্রহ করে রাখেন। শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অলপ হলেও কদাচ উপেক্ষা করবে না। কারণ তারাই আবার কালক্রমে শক্ৰভাব বদ্ধমূল করতে পারে।
এই সব উপদেশ ধৃতরাষ্ট্র অনুসরণ করতে না পারলেও পাণ্ডবপক্ষীয়রা যে অবিকল সেই পথেই পা ফেলে ফেলে চলছেন এবং নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিদুর, সে বিষয়ে সন্দেহ না রাখাই ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্য ছিলো। কিন্তু সেকথা তিনি বোঝেননি। তবে জনগণকে বিদুর যা বোঝান আর না-ই বোঝান, দৃষ্টিহীন ধৃতরাষ্ট্রকে নিজের অক্ষিদ্বয় দিয়ে যা দেখান আর না-ই দেখান, ভীষ্মচালিত রাষ্ট্রে প্রজাবিদ্রোহ ঘটানো সাঁতার কেটে সমুদ্র অতিক্রম করার মতোই অসাধ্য ব্যাপার। যদি এই মুহুর্তেই এ রাজ্যের দখল নিতে হয় তা হলে অন্য কোনো শক্তিমান রাজার সাহায্য ব্যতীত তা সম্ভব নয়। বিদুর তাঁর সতর্ক বুদ্ধি, দৃষ্টি আর শ্রবণ সজাগ রেখে বসে থাকেন রাজসভায়। কেউ কল্পনাও করতে পারে না তাঁর কুটিল অন্তর কুরুবংশের সৌভাগ্যে কী ভীষণ অগ্নিযন্ত্রণায় দপ দপ করে জ্বলছে। ভিতরে এবং বাইরে বিদুর সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই মানুষ।