মহাভারতের মহারণ্যে – ১.২
শকুন্তলার আরো কয়েক প্রজন্ম পরে পুনরায় যে রমণী সেই বংশে বিবাহিত হয়ে এসে খ্যাতির আসনে উপবিষ্ট হলেন তিনি সত্যবতী। শকুন্তলার পুত্র ভরত থেকে যে বংশ ভরতবংশ নামে খ্যাত তার একচ্ছত্র সম্রাজী সত্যবতীর মানসতাও শকুন্তলার সমগোত্রীয়, জন্মরহস্যও। সাহস এবং ব্যক্তিত্বের কোনো অভাব ছিলো না সত্যবতীর। যা চেয়েছিলেন তা সম্পন্ন করেই সংসার ত্যাগ করেছিলেন। দ্বৈপায়ন ওই একটি চরিত্রের উপর যথাসম্ভব কম আলো ফেললেও তিনি জানতেন ইনিই এই আখ্যায়িকার আসল নায়িকা, আর তিনি নিজে তার প্রধান পুরোহিত। নামত ভরতবংশের কাহিনী হলেও, আসল আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে সত্যবতী-দ্বৈপায়নই রয়েছেন।
রাজা শান্তনু সত্যবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন। এবং তা তিনি হতেই পারেন। তবে অবশ্যই তিনি তাঁকে ধীবরপল্লীতে দেখেননি। ধীবরপল্লী কখনো রাজামহারাজাদের ভ্রমণস্থল হতে পারে না। এখানে রচয়িতা পুনরায় একটি রূপকথার আবরণ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, একদা পরাশর মুনি নৌকা পার হবার সময়ে সত্যবতীর দেহের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ধীবরকন্যার দেহ থেকে সঙ্গমের পূর্বে মৎস্যগন্ধ দূর করে নিয়েছিলেন। সত্যবতীর দেহ তখন সুগন্ধে পরিপুত হয়। এবং সেই সুগন্ধ চিরস্থায়ী হয়। সুগন্ধ এমন যে বহুদূর থেকেও বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো।
একদিন শিকার করতে বেরিয়ে মহারাজা শান্তনু যমুনাতীরে এসে বাতাসে ভেসে আসা এক অতি সুগন্ধে আকৃষ্ট হয়ে সহসা সত্যবতীকে দেখতে পান এবং সেই সুগন্ধে যতো আকৃষ্ট হয়েছিলেন, ততোধিক আকৃষ্ট হন সত্যবতীকে দেখে। শান্তনুর মতো একজন সৎচরিত্র রাজা, যিনি তার প্রথমা পত্নী গঙ্গাকে হারিয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করে ছত্রিশ বছর বনে বনে ঘুরে বেরিয়েছেন, যিনি পরম প্রাজ্ঞ, পরম ধার্মিক, পরম ধীমান বলে বর্ণিত, যিনি দেবর্ষি ও রাজর্ষিগণের সম্মানভাজন, যার ধাৰ্মিকতা দেখে অন্যান্য নৃপতিরা তাঁকে সম্রাটপদে অভিষিক্ত করেছিলেন, সমগ্র পৃথিবীর যিনি অধিপতি হবার যোগ্য সেই বিশুদ্ধ কুলীন কুরুপতির পক্ষে মুহুর্তে সত্যবতীর প্রতি এতোটা আকৃষ্ট হওয়া যেমন আশ্চর্য, তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য ঘটনা সেই কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়ে সেই ধীবরের কুটিরপ্রাঙ্গণে গিয়ে দাড়ানো। ধীবর মানেই নিষাদ। সুতরাং অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য। নীচজাতি বা অন্ত্যজদের প্রতি উচ্চজাতির কী ধরনের মনোভাব ছিলো তা শাস্ত্রে, মহাপুরাণে, মহাকাব্যে, কোথাও অপ্রকট নয়। সেই জন্যই বিস্মিত হতে হয়, কেবলমাত্র সুগন্ধই তাঁকে এই আঙিনায় এসে দাঁড় করিয়ে দিলো?
যে করেই হোক, সত্যবতী তাঁকে যে যথেষ্ট সম্মোহিত করতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ধীবরের পাটনী কন্যার জন্য স্বয়ং সম্রাট এসে দাঁড়িয়েছিলেন এর চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য সেই পরিবার আর কী ভাবতে পারে! কিন্তু তারা তা পারলেন, এবং সত্যবতীর পিতা তৎক্ষণাৎ একটি শর্ত রক্ষার দাবী রাখলেন। সেই শর্ত রক্ষায় রাজি না হতে পারায় শান্তনুকে প্রত্যাখ্যানও করলেন।
পিতাকে বিষন্ন দেখে এবং তার কারণ জেনে পুত্র দেবব্রত, পিতার প্রিয়চিকীয়ঁ পুত্র দেবব্রত, সব শর্ত পালনে সম্মত হয়ে সত্যবতীকে নিয়ে এলেন পিতার কাছে। সত্যবতীর দূরদর্শিতা প্রথম থেকেই সীমাহীন। সেজন্যই, কেবলমাত্র তার গর্ভজাত পুত্রই যে সিংহাসনে বসবে সেই শর্তেই থেমে না থেকে, দেবব্রতর সন্তানও যাতে সিংহাসনের দাবিদার না হতে পারে তেমন প্রতিজ্ঞাই করিয়ে নিলেন দেবব্রতকে দিয়ে। দেবব্রত সেই শর্ত মেনে নিয়ে ঘোষণা করলেন, তিনি কখনো বিবাহ করবেন না।
সেই থেকেই তার ‘ভীষ্ম’ আখ্যা লাভ। কিন্তু এর মানে কি এই নয় যে শান্তনুর মৃত্যুর পরে সত্যবতী স্বীয় বংশ ভিন্ন অন্য কোনো রক্তের চিহ্ন রাখবেন না?
তাই হলো। আঁটঘাঁট বেঁধেই তিনি এসেছিলেন এই প্রাসাদের সর্বময়ী কত্রী হয়ে রূপেগুণে ঈর্ষাযোগ্য মহাভারতের শ্রেষ্ঠ আর্য যুবকটিকে সেই কারণেই তার স্বার্থসিদ্ধির বলি হতে হলো। মহাভারতের অজস্র ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এটা এমন একটি ঘটনা যার গুরুত্ব দ্বৈপায়ন তেমনভাবে না দিলেও, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী, এবং তাৎপর্য গভীর।
আমরা দেখতে পেলাম, যে সত্যবতী দেবব্রতর জীবনকে সমস্ত দিক থেকে পঙ্গু করে সমগ্র সুখের সুবর্ণ ফটকটি বন্ধ করে দিলেন, পরবর্তীকালে দেবব্রত সেই সত্যবতীরই একান্ত অনুগত একজন আজ্ঞাপালনের বাহকমাত্র। এসব অকল্পনীয় ঘটনা পড়তে পড়তে মনে হয় ভাগ্য আর পুরষকারের মধ্যে ভাগ্যই প্রধান ভাগ্যচক্রের ঘূর্ণায়মান চক্রটিকেই বড়ো আসন দিতে হয়। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, এই কাহিনীর নায়িকা সত্যবতীর ইচ্ছা নামের তরণীটিকে যিনি অবিরাম অনুকূল বায়ুপ্রবাহে বাহিত হবার সুযোগ দিয়েছেন তার নাম ‘ভীষ্ম’ আখ্যাধারী দেবব্রত। তিনি তার ত্যাগ ও ঔদার্যের বিনিময়ে এই নিষাদ রমণীটিকে কুরুকুলের মহারানীর সিংহাসনে বসিয়ে পিতাকে সন্তষ্ট করেই ক্ষান্ত হননি, তার সুখের জন্য নিজেকেও উৎসর্গ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, সত্যবতী দেবব্রতকে অগ্রবর্তী করেই সমগ্র কার্য, যা যা তিনি সম্পন্ন করতে সংকল্প করেছিলেন, সবই নির্বিবাদে সমাধা করতে সক্ষম হয়েছেন।
মহারাজা শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিবাহের পরে অবশ্য অনতিদীর্ঘকালের মধ্যেই দেখা গেলো দেবব্রত যেন মুছে গেছেন সব কিছু থেকে। সেটা তার স্বীয় সুখের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন দেখেই নিজেকে নিজে সরিয়ে নিয়েছিলেন, অথবা দ্বৈপায়ন আর তাঁকে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই বোধেই পরিত্যাগ করেছিলেন, জানি না। কিন্তু শান্তনুর ইহলীলা সংবরণের অচিরকালের মধ্যেই দেখা গেলো আবার তিনি রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ। এবং তার কারণও সত্যবতীই।
শান্তনুর ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে যে দুটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলো তার একজন তখনো বালক, অন্যজন অযোগ্য। এই অবস্থাতেই ছেলেদের রেখে শান্তনু লোকান্তরিত হন। সত্যবতী তার বড়ো পুত্রটিকে রাজপদে বসান। চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলবান ছিলেন, অত্যন্ত দাম্ভিকও ছিলেন। সকলকেই নগণ্য জ্ঞান করতেন। একদিন গন্ধৰ্বরাজ বললেন, ‘সবাইকেই নিকৃষ্ট ভাবো, আমার নাম আর তোমার নাম এক। তুমিও চিত্রাঙ্গদ, আমিও চিত্রাঙ্গদ। আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো, দেখি কে জয়ী হয়।’ আস্ফালন করে গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েই তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর অহংকারই তাঁকে নিহত করলো। নিজের পুত্রকে চিনতে সত্যবতীর দেরি হয়নি, এবং সেই কারণেই তিনি বুঝেছিলেন, এই পুত্রকে যদি কোনো দক্ষ শাসক পরিচালনা না করেন তবে রাজত্ব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। স্বভাবতই, দেবব্রত ব্যতীত সুচারুরূপে এই রাজ্য শাসন আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। অতএব সত্যবতী বাধ্য হয়েই পিছন থেকে রাজ্য চালনার গুরুভার তার হস্তে ন্যস্ত করলেন। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর অপ্রাপ্তবয়স্ক বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে পুনর্বার সেই পুতুল নিয়েই সত্যবতীর অনুজ্ঞাক্রমে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন ভীষ্ম।
সত্যবতী স্বীয় স্বার্থের প্রয়োজনে দেবব্রতকে ডেকে আনলেও দেবব্রতর বাধ্য হবার কোনো দায় ছিলো না। রাজত্ব যেন কোনোক্রমেই গঙ্গাপুত্র দেবব্রতর, অথবা তার বংশধরদের হস্তগত না হয়, সেজন্য সত্যবতী দেবব্রতকে দিয়ে যা যা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, তারপরে দেবব্রত কেন নতমস্তকে সত্যবতীর নির্দেশ শিরোধার্য করে নিলেন তার কোনো কারণ দেখতে পাই না। তবে কি যে মোহিনী মায়ায় মহারাজা শান্তনু আবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই মোহিনী মায়ায় সত্যবতী। তার পুত্র দেবব্রতকেও বন্দী করেছিলেন? সত্যবতী তাঁকে যে-ভাবে ব্যবহার করেছেন, এবং ওইরকম একটি কনককান্তি দ্বিতীয়রহিত বীর যুবক যে-রকম মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্যবহৃত হয়েছেন, দুয়ের চেহারা একে অন্যের পরিপূরক। জানতে ইচ্ছে হয় সত্যবতী বিষয়ে দেবব্রতর অন্তরে কী চেতনা কাজ করতো। কেন তিনি তার জীবন যৌবন ক্ষমতা এই হস্তিনাপুরের অভ্যন্তরে নিঃশেষ করলেন? তদ্ব্যতীত, পিতার মৃত্যু পর্যন্তই বা কেন এমন নিঃশব্দে আত্মগোপন করে রইলেন?
কুরুকুলের ভাগ্যদোষে শেষ পর্যন্ত সত্যবতীর সব আকাজক্ষা পূরণের প্রধান সহায় হলেন দেবব্রত। সত্যবতী যদি যন্ত্রী হন, দেবব্রত তাহলে যন্ত্র। আর এই যন্ত্রের যন্ত্রী হয়ে সত্যবতী। অতঃপর যে সুর বাজাতে সক্ষম হয়েছেন সেই সুরেই রচিত হয়েছে এ কাহিনী। এই পুস্তক। যে পুস্তকের নাম মহাভারত যে পুস্তককে বলা হয় পঞ্চম বেদ। তপোবনে সনাতন বেদশাস্ত্রের সারোদ্ধার করে এ পবিত্র গ্রন্থের জন্ম। যে গ্রন্থের যুদ্ধকে বলা হয় ধর্মযুদ্ধ। এবং যার তুল্য মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না।
পতির মৃত্যুতে সত্যবতী যে খুব কাতর হয়ে পড়েছিলেন এমন মনে হয় না। মহাভারতের নিয়ম অনুযায়ী আরম্ভ করলে শেষ হতে চায় না এই রকম কোনো বিলাপপূৰ্ণ শোকের চিত্র সত্যবতীর আচরণে দেখানো হয়নি। এমন কি দুই পুত্রকে হারিয়ে তার মাতৃহৃদয়ও যে খুব ভেঙে পড়েছিলো এমন আলেখ্যও রচয়িতা আমাদের প্রত্যক্ষ করাননি। তিনি যে কারণে ভেঙে পড়লেন তা হচ্ছে তার বংশরক্ষা। দুটি পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠটি তো বিবাহের পূর্বেই মারা যায়। কনিষ্ঠটি দুই মহিষীর ভর্তা হয়েও কারো গর্ভেই কোনো বীজ বপন করতে পারলো না।
বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পরে তাঁর পত্মীদের গর্ভে যখন পুত্রোৎপাদনের প্রশ্ন তুললেন সত্যবতী, তখন তিনি ভীষ্মকেই প্রথম অনুরোধ করেছিলেন। সেটা লোক দেখানো। তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, যে প্রতিজ্ঞা করে দেবব্রত ভীষ্ম হয়েছেন সে প্রতিজ্ঞা তিনি কখনোই লঙ্ঘন করবেন না। বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে ভীষ্মকে তিনি একটু সন্দেহের চোখেই দেখতেন। কিন্তু সে ভয় তার অচিরেই মুছে যায়। এই মানুষকে চিনতে খেটে খাওয়া নিষাদকন্যা সত্যবতীর বেশি দেরি হয়নি। বিশ্বাস না করলে পুত্রদের হয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনার ভার তিনি কখনোই তার উপরে ন্যস্ত করতেন না। ভীষ্ম বললেন, “আপনি আমাকে অপত্যোৎপাদন বিষয়ে যে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন তা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। আর দারপরিগ্রহ বিষয়েও পূর্বে যা সংকল্প করানো হয়েছিলো তা-ও নিশ্চয়ই ভুলে যাননি।’
ভীষ্ম পুনরায় বলেছিলেন, ‘পরশুরাম যখন একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন, তখন ক্ষত্রিয় রমণীরা ব্রাহ্মণ সহযোগেই পুত্রবতী হয়ে পুনরায় ক্ষত্রিয়কুল বৃদ্ধি করেছিলেন, সে ভাবেও আপনি বংশরক্ষা করতে পারেন। ভীমের মনে হয়েছিলো বংশরক্ষার সেটাই একমাত্র শুদ্ধ উপায়। তাই সেই পরামর্শই তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন। দেখা গেলো সে উপায়টা সত্যবতী গ্রহণ করলেন। অনতিবিলম্বেই তিনি তাঁর কুমারী জীবনের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ণকে আহ্বান করলেন। বোঝা গেলো ছেলের সঙ্গে তিনি সংশ্রব বহির্ভূত ছিলেন না।
পুত্রও এসে গেলেন তৎক্ষণাৎ, এবং মাতৃআজ্ঞা পালনে রত হতে বিলম্ব করলেন না। সদ্য স্বামী বিয়োগে শোকার্ত বধু দুটি দ্বৈপায়নের বিকট মূর্তি দেখে ও বীভৎস গন্ধে একজন ভয়ে দুচোখ বুজে এবং অন্যজন ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে মৃতের মতো পড়ে থেকে শ্বশ্রীমাতার নির্দেশ পালনে বাধ্য হলেন। স্বীয় পুত্রের দ্বারাই সত্যবতী স্বীয় পুত্রের বধু দুটির গর্ভোৎপাদন করালেন। এতোদিন কেন তিনি ইতস্তত করছিলেন সে কারণটা বোধগম্য হলো। এই উৎপাদন রুচিসম্মত নয়, শাস্ত্রসম্মত নয়, ধর্মসংগতও নয়। তদ্ব্যতীত, স্বামীর ইচ্ছেতে তার স্ত্রীর গর্ভে অন্যের ঔরসজাত সন্তানেরা ক্ষেত্ৰজ পুত্র হিশেবে তখনকার সমাজে স্থান পেলেও শাশুড়ির ইচ্ছেতে পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্রোৎপাদনের নজির মহাভারতে অন্য কোথাও নেই। এবং কার দ্বারা উৎপাদন? যে তাদের কেউ নয়। যাঁর মাতা তাদের শ্বশ্রীমাতা হবার বহুপূর্বেই এই সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। দ্বৈপায়ন নিজে কালো, তার মাতা কালো, তার পিতা কালো, সুতরাং এই তিনজনের একজনও যে আর্য নন, সে বিষয়ে কোনো তর্ক নেই। উপরন্তু দ্বৈপায়ন তাঁর মাতার বৈধ-সন্তান নন।
যে মেয়ে দুটি সত্যবতীর পুত্রের নিকট আত্মদান করতে বাধ্য হয়েছিলো, সে মেয়ে দুটিও শান্তনুর রক্তসম্পর্কিত কেউ নয়। সত্যবতী শান্তনুর বংশের জন্য বিচলিত ছিলেন না। ছিলেন স্বীয় বংশ বিস্তারের জন্য। অতএব ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুও এ বংশের কেউ নয়। সত্যবতীর অনুরোধে ভীষ্ম তার ব্রহ্মচর্য বিসর্জন দিতে অস্বীকার করলেও দ্বৈপায়ন নিজের ব্রহ্মচর্য বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি। অসহায় এবং শোকার্ত বধু দুটির উপরে তিনি বা তার মাতা কেউ সুবিচার করেছেন বলে মনে হয় না। আমরা ধর্মত জানি অনিচ্ছুক রমণীতে সংগত হওয়ার নাম বলাৎকার। সত্যবতী তার কানীন পুত্রকে দিয়ে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর উপর সেটাই করিয়েছেন। দুই বধূর গর্ভে দুটি পুত্রই প্রতিবন্ধী কেন হলো? তার কারণ হিসাবেও বধূদেরই দোষী সাব্যস্ত করা হলো। বলা হলো, একজন ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিলো তাই পাণ্ডু পাণ্ডুর হয়ে জন্ম নিয়েছেন। অন্য বধু চোখ বুজে ছিলো বলে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন।
এই বধু দুটির বেদনা নিয়ে কোনো হা হুতাশ নেই কোথাও অন্য পুত্র বিদুর দ্বৈপায়নেরই পুত্র, কিন্তু মাতা রাজবাটীর একটি দাসী। রাজবাটীর দাসীটির নিকট দ্বৈপায়ন দ্বৈপায়ন বলে নন, সত্যবতীর পুত্র বলেই মহার্ঘ। অপরপক্ষে, দাসী হয়ে রানীর পুত্রকে শয্যায় পাওয়া, রানীর পুত্রবধূদেরও যিনি শয্যাসঙ্গী হয়েছেন তাঁকে পাওয়া, কম সম্মানের কথা নয়। চেহারা যেমনি হোক সেই সম্মান সে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলো। একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম হলো সেই মিলনের ফলে, যার পিতামহী স্বয়ং সত্যবতী।
বলাই বাহুল্য, শান্তনুর পুত্র বিচিত্রবীর্যের বধূদ্বয়ের গর্ভে দুটি প্রতিবন্ধী পুত্রকে জন্ম দিয়ে দ্বৈপায়ন নিজেকে পিতা বলে ভাবেননি। কেননা তারা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ। সেই পুত্রদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকা নিয়ম নয়। সে দুটি প্রতিবন্ধী পুত্রের পিতার নাম দ্বৈপায়ন নয়, বিচিত্রবীর্য। তাই তার স্নেহও রাজকন্যাদের দুই পুত্রের চেয়ে দাসীপুত্রের প্রতিই বেশি ছিলো। তদ্ব্যতীত, রাজকন্যা দুটি যে তাঁকে অতিশয় অনিচ্ছা এবং ঘৃণার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলো যে বিষয়েও তিনি অবহিত ছিলেন। আবার ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের অপেক্ষা পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ নামধারী পুত্রদের প্রতিই তিনি বেশি আসক্ত ছিলেন। তার মধ্যে যেটি বড়, যার নাম যুধিষ্ঠির, সে ছেলে যে বিদুরের ঔরসে কুন্তীর গর্ভজাত অবৈধ পুত্র সেটা অন্যদের কাছে গোপন থাকলেও তিনি নিজে তা জানতেন বলেই মনে হয়।
দেখা যাচ্ছে, অসিতাঙ্গ ও অবৈধ সন্তানদের প্রতি দ্বৈপায়নের একটা বিশেষ আকর্ষণ, তাদের যে কোনো প্রকারে হোক জিতিয়ে দিতে তিনি আগ্রহী। তার সংকলনে তিনিই সমাজের নিয়ামক। তার বাক্যই চরম বাক্য। তার বিধানই বিধান। নিজেকে তিনি নিজেই স্রষ্টা হিশেবে দেখিয়েছেন। অনেক সময়ে গ্রীক নাটকের বিবেকের মতো হঠাৎ হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তিনি সত্য উদঘাটন করেন। কিন্তু তার বিধানে কর্ণ অপাঙক্তেয়। কর্ণকে তার জন্মকলঙ্কের লজ্জা থেকে তিনি মুক্ত করেন না। পুত্রবধূ কুন্তীকে এ ব্যাপারে অভয়দান করেন না। শুধু যে কর্ণের প্রতিই তিনি নির্মম তাই নয়, ভীমের প্রতিও খুব প্রণয়শীল মনে হয় না। ভীষ্মকে শেষ পর্যন্ত আমরা যে একজন বৃদ্ধ রাজকর্মচারী ব্যতীত আর বিশেষ কিছুই মনে করি না, সেই ছবিও সচেতনভাবে তারই অঙ্কন। তিনিই এই ছবিটি কাহিনীর বিভিন্ন পর্বে বার বার দেখিয়ে এতেই আমাদের এমন অভ্যস্ত করেছেন যে পিতার প্রিয়চিকীর্ঘ হয়ে নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করবার মাহাত্য তাঁকে মহাত্মায় পরিণত হতে দিলো না। সেই উৎসর্গিত অসাধারণ একটি ব্যক্তিত্ব শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে প্রায় স্মরণাতীত একটি সাধারণ মানুষে পরিণত হলো।
সত্যবতীর দূরদর্শিতার আয়নায় প্রথম থেকে শেষ ছবিটির পর্যন্ত ছায়া প্রতিফলিত হয়েছিলো। তাঁর এই অবৈধ পুত্র রাজা হবেন না সেটা সত্য। কিন্তু তার পুত্র পৌত্ৰাদি তো হতে পারে? সেটাই বা কম কী? তাই সেই ব্যবস্থাই পাকা করে ফেললেন রাজপুত্রদের অকালমৃত্যুর পর। পর্বত বন সমাকীর্ণ, সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে ধর্মানুসারে প্রজাপালনে যিনি সক্ষম, যশ সত্য দম দান্ত তপস্যা ব্রহ্মচর্য দান ধ্যানে যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁকেই হতে হলো কতগুলো অযোগ্য মানুষের হুকুম তামিলের দাস। শান্তনুর ঔরসে সত্যবতীর যে দুটি পুত্র ছিলো, একজন চিত্রাঙ্গদ, আর একজন বিচিত্রবীর্য, দুটি পুত্রই যথাক্রমে আস্ফালনে ও কামুকতায় সমান দক্ষ। সারা যৌবন ভীষ্মই বকলমে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব বহন করলেন, কিন্তু নামে এঁরাই রাজা। ঝুঁকি তার, উপভোগ ওঁদের যতোদিন জ্যেষ্ঠ চিত্রাঙ্গদ জীবিত ছিলেন, তিনিই ছিলেন রাজা। তাঁর মৃত্যুর পরে সত্যবতী ভীমের সাহায্যেই কনিষ্ঠ পুত্র বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসালেন। ঠিক আগের মতোই ভীষ্ম তাঁর প্রজ্ঞাতা দিয়ে, বিচক্ষণতা দিয়ে, নির্বিঘ্নে রাজ্যচালনার চাকাটি তৈলাক্ত রাখতে লাগলেন।
বিচিত্রবীর্যের জন্য মহিষী দুটিকেও ভীষ্মই সংগ্রহ করে এনেছিলেন। যখন বিচিত্রবীর্য অবিবাহিত ছিলেন এবং যুবক হয়ে উঠছিলেন, এই সময়ে সংবাদ এলো কাশীরাজ তাঁর কন্যাদের স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেছেন। তৎক্ষণাৎ সত্যবতীর অনুমোদন নিয়ে সেই কন্যাদের জয় করে আনতে চলে গেলেন ভীষ্ম। তার কি একবারও মনে হলো না, যিনি পাণিপ্রার্থী, এসব ক্ষেত্রে তারই যাওয়া উচিত? স্বয়ংবর সভায় কন্যা তার নির্বাচিত পাত্রকেই মাল্যদান করে, সেজন্য পাণিপ্রার্থীরাই যান। পরিবর্তে ভীষ্ম গিয়ে হাজির হলেন সেখানে এই বয়স্ক পাণিপ্রার্থটিকে দেখে অন্যান্য রাজনবর্গ পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিঞ্চিৎ ঠাট্টাতামাসাও করলেন। এই বয়সে বিয়ে করার শখ নিয়ে টিটকিরিও দিচ্ছিলেন।
প্রশ্নটা এই ভীমের মতো একজন প্রাজ্ঞ, বয়স্ক ব্যক্তি, শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয় যোদ্ধা, যিনি বলেন, “আমি ত্ৰৈলোক্য পরিত্যাগ করতে পারি, ইন্দ্রতু পরিত্যাগ করতে পারি, এবং তদপেক্ষাও যদি কোনো অভীষ্টতম বস্তু থাকে তা-ও পরিত্যাগ করতে পারি, কিন্তু কদাচ সত্য পরিত্যাগ করতে পারি না। যদি পৃথিবী গন্ধ পরিত্যাগ করে, যদি সূর্য প্রভা পরিত্যাগ করে, জল যদি মধুর রস পরিত্যাগ করে, জ্যোতি যদি রূপ পরিত্যাগ করে, বায়ু যদি সর্পিলগুণ পরিত্যাগ করে, তথাপি আমি সত্য পরিত্যাগ করতে পারি না। সেই তিনিই যখন বর না হয়েও কন্যাদের রথে আরোহণ করিয়ে বলেন, ‘কেউ কন্যাদের বিচিত্র অলংকারে আচ্ছাদিত করে ধনদান পূর্বক গুণবান পাত্রে সমর্পণ করেন। কেউ কেউ দুটি গোরু দিয়ে পাত্রসাৎ করেন, কেউ বলপূর্বক বিবাহ করেন। কেউ কেউ প্রিয় সম্ভাষণে রমণীর মনোরঞ্জন পূর্বক তার পাণিপীড়ন করেন। পণ্ডিতেরা অষ্টবিধ বিবাহবিধি নির্দেশ করেছেন। স্বয়ংবর বিবাহবিধি উত্তম বিবাহের মধ্যে গণ্য। রাজারা স্বয়ংবর বিবাহকেই অধিক প্রশংসা করেন। ধর্মবাদীরা তার চেয়ে বেশী প্রশংসা করেন পরাক্রম প্রদর্শনপূর্বক অপহৃত কন্যার পাণিগ্রাহীকে। সুতরাং আমি এদের বলপূর্বক হরণ করলাম। আমি যুদ্ধার্থে প্রস্তুত। ইচ্ছেমতো তোমরা যুদ্ধ বা অন্য যে উপায়ে হোক এদের উদ্ধার সাধনে যত্নবান হতে পারো।’ এই ব্যবহার কি তার উপযুক্ত?
ভীষ্ম নিজে পাণিগ্রাহী নন, তথাপি এইরূপে এই উক্তি তার চরিত্রের পক্ষে অমৃতভাষণের তুল্যই অসংগত। এই উক্তি শ্রবণে, এই কর্ম দর্শনে, অন্যান্য নৃপতিরা ক্রোধে কম্পান্বিত কলেবর হয়ে দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে সত্বর অলংকার উন্মোচন করে রাজসভায় একটা ভীষণ কলরোল শুরু করলেন। অতঃপর বহুসংখ্যক নৃপতিবর্গ ঘোরতর সংগ্রামে লিপ্ত হলেন। চতুর্দিক থেকে বিরোধীরা ভীষ্মকে ঘিরে ধরে ভীমের উপর অনবরত বাণ বর্ষণ করতে লাগলেন। কিন্তু ভীষ্ম রণনৈপুণ্যে সকলকে পরাস্ত করে কন্যাদের নিয়ে প্রস্থান করলেন। পথে শাল্ব সম্মুখীন হয়ে, ঈৰ্ষা এবং ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে, তিষ্ঠ তিষ্ঠ বলে পুনরায় ভীষ্মকে সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করলেন, এবং পরাস্ত ভূপতিবর্গ সাধুবাদ জানিয়ে শান্বকে খুব উৎসাহ দিতে লাগলেন। পুনরায় প্রজ্বলিত ভীষ্ম তার দিকে ধাবিত হয়ে তাঁকেও পরাভূত করলেন। কাশীপতির এই তিনটি কন্যাই সম্ভবত ভীমের এই যুদ্ধ-নৈপুণ্য দর্শনে মোহিত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, বয়স যাই হোক, এরকম বীর পাণিগ্রাহী অবশ্যই বরণীয়। কিন্তু যখন দেখলেন পাণিগ্রহীতা তিনি নিজে নন, তখন তিন ভগ্নীর মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠা, তিনি বললেন, “আমি মনে মনে শাল্বকেই বরণ করেছি। একথা শুনে তাঁকে তার স্বেচ্ছানুরূপ কার্য করবার জন্য মুক্তি দিলেন দেবব্রত। তারপর বিমাতার সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য দুটি কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহ দিলেন।
বিচিত্রবীর্য রাজ্যপালনে অক্ষম হয়েও রাজা, স্বয়ংবরসভায় না গিয়েও বিজয়ী। অন্যের শৌর্যে বিজিত কন্যাদের সঙ্গে বিবাহিত হয়ে মহানন্দে সাত বৎসর নিরন্তর বিহার করে যৌবনকালেই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে নিয়তিক্রমে তাঁকে শমনসদনে যেতে হলো। তারপরে কিছুকাল পর্যন্ত কোনো রাজা উপবিষ্ট ছিলেন না সিংহাসনে। সেই শূন্য সিংহাসন শূন্য রেখেই ভীষ্ম রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
শূন্য সিংহাসন পূর্ণ হতে বড়ো কম সময় লাগলো না। শিশুরা জন্ম নিলো, বড়ো হলো, তবে তো হস্তিনাপুরের রাজা হলো? কিন্তু সেখানেও বাধা। বড়ো পুত্রটি অন্ধ, ছোটো পুত্রটি পাণ্ডুর। সুতরাং আর একটি সুস্থ শিশু না জন্মালে চলে না। অতএব পুনরায় ব্যাসদেবের আবির্ভাব এবং সুস্ত শিশুর জন্ম দেবার আমন্ত্রণ এবং বিদুরের জন্ম। রাজকন্যাদের চালাকির ফলে বিদুর জন্ম নিলো রাজবাটীরই একটি সুন্দরী দাসীর গর্ভে। সে অবশ্য সুস্থ সন্তান এবং তার পিতা বিচিত্রবীর্য নন, একান্তভাবেই স্বয়ং ব্যাসদেব। কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো হলেও দ্বৈপায়ন বিদুরের পিতৃত্বকে অস্বীকার করলেন না। বিচিত্রবীর্যের পুত্ররা তার দ্বারা জন্মগ্রহণ করলেও তারা ক্ষেত্ৰজ বিচিত্ৰবীৰ্যই তাদের পিতা। প্রকৃতপক্ষে যে স্নেহ মমতা সন্তানের প্রতি প্রাকৃতিক ভাবেই পিতার বক্ষে জন্ম নেয়, সেটা এই ক্ষেত্রজদের প্রতি দ্বৈপায়নের ছিলো না। ক্ষেত্ৰজরাও নিজেদের বিচিত্রবীর্যের সন্তান হিশেবেই অজ্ঞান বয়স থেকে জানায় কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে পিতা ভাবার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু রাজকাৰ্য তো থেমে থাকে না। থাকেওনি।
হস্তিনাপুরের অধিবাসীরা ভীষ্মকে যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। সুতরাং তাদের নিকট ভীমের কোনো কার্যই প্রতিবাদযোগ্য নয়। ভীষ্ম যা করেন তাই যে তাদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য এ নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র সংশয়ী নন। এদিকে সত্যবতীও জানেন তিনি যা করবেন তা-ই মেনে নেবেন ভীষ্ম। তিনি সশব্দেই বলুন, নিঃশব্দেই বলুন, সত্যবতীর কোনো ইচ্ছেকেই ভীষ্ম প্রতিরোধ করতে অক্ষম। নচেৎ কুমার কালের সন্তানটিকে রাজপুরীতে আহবান করে নিয়ে আসার সাহস তিনি পেতেন না। প্রত্যয় হয়, এই ধীবরকন্যাটিকে রাজবাটীতে আনয়ন করে পিতার হস্তে সমর্পণ করার পরে তিনিও সমৰ্পিত হয়ে গিয়েছিলেন। মহারাজা শান্তনুর একমাত্র কুলতিলক দেবব্রতকে আমরা যতোদিন দেবব্রতরূপে প্রত্যক্ষ করেছি, সমস্ত দিক বিবেচনা করলে তার তুল্য এমন সর্বগুণসম্পন্ন মহৎ চরিত্র মহাভারতে আর নেই। যে মুহুর্তে তিনি ভীষ্ম হলেন সেই মুহুর্ত থেকেই তার দুর্বার ব্যক্তিত্ব স্তিমিত হলো। কেন হলো? সত্যবতীই কি তা সমূলে উৎপাটিত করে সেই অনন্য ব্যক্তিটিকে একেবারে নিজের কুক্ষিগত করে ফেললেন? নচেৎ, আমন বিচিত্র বিশাল মহাদেশে তো একটাই সিংহাসন পাতা ছিলো না দেবব্রতর জন্য? যাকে সমরোদ্যত নিরীক্ষণ করলে শত্রুপক্ষ ‘সিংহভীত গো-পালের ন্যায় ভয়ে উদ্বেগে কম্পমান’ হয়, যিনি ক্রুদ্ধ হলে যে কুলোদ্ভবই হোক না কেন অচিরকালের মধ্যেই পঞ্চতৃপ্রাপ্ত হয়, যার শৌর্যবীর্য পরশুরাম অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, নীতি ও মেধায় যিনি অপ্রমেয়, কী করে তিনি অমন নিশ্চেষ্টভাবে বছরের পর বছর নিক্রিয় হয়ে বসে রইলেন? কখনো কোনো যুদ্ধ জয়ে যাননি, শিকারে যাননি, ভ্রমণে যাননি, কিছুই করেননি। না হয় পূর্ববৎ মাতামহ জহুমুনির আশ্রমেই প্রত্যাবৃত হতেন। জীবনের উৎকৃষ্ট সময়টা তো তিনি সেখানেই কাটিয়েছিলেন। পিতার কাছে যতোদিন কাটিয়েছেন, মাতার কাছে তার বহুগুণ বেশি সময় কাটিয়েছেন। আশ্রম জীবন তো তার কাছে অচিন্ত্যনীয় নয়। অন্তত অন্যের বশবর্তী হয়ে থাকা অপেক্ষা অবশ্যই সম্মানজনক। সত্যবতীর বংশধরদের জন্য সিংহাসন অটুট রাখার দায়িত্ব তো তার নয়। মনে হয় সত্যবতী কখন কী করাবেন, কী বলবেন, সেই অপেক্ষাতেই তিনি যেন সদাসচকিত। বলা যায় সত্যবতীর অঙ্গুলি হেলনেই তিনি উঠতেন বসতেন। তার নিজের কি কোনো আশা আকাজক্ষা বাঞ্ছা বাসনা কিছুই আলাদাভাবে ছিলো না? যে রমণী তাঁকে জাগতিক সর্বসুখে বঞ্চিত করেছেন, তার জন্য এমন আত্মবিসর্জন কী করে সম্ভব? কুরুকুলের এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটিই যাঁর আয়ত্তে তার তবে কাকে ভয়? কাকে লজ্জা? তার ইচ্ছেই চরম ইচ্ছে। সেজন্যই নিদ্বিধায় সত্যবতী নিজের কলঙ্কটিকে আহবান করে নিয়ে এলেন এই রাজপুরীতে। তিলতম লজ্জাও তাঁকে বিড়ম্বিত করলো না। যদি তা না আনতেন তা হলে কি বিদুরের মতো একটি ধূর্ত, অবৈধ, পরগাছার প্রবেশ ঘটতো এই সংসারে?
সর্বাপেক্ষা বিস্ময়ের বিষয় এটাই, সত্যবতীর প্রতি মুগ্ধতাবশত ভীমের আনুগত্য যতটা সীমাহীন, ততোটাই কার্যকারণের অনধীন। কেবলমাত্র এই কারণেই তিনি যে স্বীয় সর্বনাশ ডেকে এনে সমগ্র কুরুকুলকেই নিশ্চিহ্ন করেছেন তা-ই নয়, সমগ্র দেশটাকেই প্রায় মনুষ্যহীন করে ভাসিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য পুস্তকটি অনেক স্থলেই অসঙ্গতি দোষে দুষ্ট। নিষাদ বালক একলব্যকে নিষাদ বলেই দ্রোণ শিষ্য হিশেবে গ্রহণ করতে পারলেন না, অথচ রাজ্যের যিনি প্রভু তিনি বিবাহ করলেন একজন ধীবরকন্যাকে ধীবররা যেখানে সকলেই নিষাদ। সঙ্গে সঙ্গে এই তথ্যটাও জানতে কৌতুহল হয়, দ্বৈপায়নের পিতা পরাশরমুনি যখন সত্যবতীর পাণিপ্রার্থী হয়েছিলেন, সত্যবতী তাঁকে কী কারণে প্রত্যাখ্যান করলেন? পরাশর অযোগ্য নন। তাঁকে গ্রহণ করলে অবৈধ পুত্রকে আর অবৈধ কলঙ্কে কলঙ্কিত থাকতে হতো না। সত্যবতীর চরিত্রেও কোনো কালো দাগ থাকতো না।