মহাভারতের মহারণ্যে – ১.৫
ভীমের অনুজ্ঞাক্ৰমে কুন্তীর পঞ্চপুত্র যখন পাণ্ডুপুত্র হিশাবেই গৃহীত হয়ে ভীমেরই যত্বে রাজবাটীর ভোগ-উপভোগের দ্বারা পরম সুখে দুর্যোধনাদি ভ্রাতাদের সঙ্গে একই ভাবে বর্ধিত হতে লাগলেন, তখন কখনো শোনা যায়নি দুর্যোধন ঐ পাঁচটি আগন্তুকের সঙ্গে কোনো কলহে বৃত হয়েছেন। দোষ বার করার অনেক চেষ্টা করেও এই মিথ্যা উক্তিটি লিপিবদ্ধ করতে পারেননি রচয়িতা। কিন্তু ভীমের অসহ্য অকথ্য নিষ্ঠুর ব্যবহারে এবং তার অন্য চারটি ভ্রাতার সেই অমানবিক নিষ্ঠুরতার পৃষ্ঠপোষকতা দেখে দুৰ্যোধনাদিরা প্রকৃতই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। মহাভারতের একটি অংশের উল্লেখ করছি। ‘ধার্তরাষ্ট্ররা যখন আহ্লাদিত হয়ে খেলতো ভীম সততই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে রক্ত বার করে দিতো, সজোরে মাটিতে ফেলে দিয়ে চুল ধরে টেনে এমন বেগে আকর্ষণ করতো যে তারা কেউ ক্ষতজানু ক্ষতমস্তক ক্ষতস্কন্ধ হয়ে আর্তস্বরে চিৎকার করতো। জলে সাঁতার কাটবার সময়ে জলে ডুবিয়ে প্রায় মৃতকল্প করে ছাড়তো বৃক্ষে আরোহণ করলে গাছ নাড়িয়ে তাদের মাটিতে ফেলে দিতো।’
এই অদ্ভুত হিংস্র ব্যবহার একমাত্র কুরুভ্রাতাদের উপরেই করতো কিন্তু স্বীয় ভ্রাতাদের প্রতি নয়। যুধিষ্ঠির, অর্জন, নকুল, সহদেবের সঙ্গেও যদি ভীম এই একই খেলা খেলতো, তাহলে মনে হতো অতিকায় বলবান জীবের ন্যায় চেহারা ও চরিত্রের দরুণ এই খেলাই তার স্বাভাবিক। কিন্তু যখন কেবলমাত্র দুর্যোধনদের প্রতিই এরকম একটা শক্রসুলভ অত্যাচার চালাতো, তখন মনে হতো এই পার্বত্য পুত্ৰকটিই এই রাজপ্রাসাদের আজন্ম অধিকারী, ধৃতরাষ্ট্র পুত্ৰগণ-সহ গদি জবরদখল করে বসে আছেন। অতএব এভাবেই হোক, যেভাবেই হোক, তাদের উচ্ছিন্ন করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। কে জানে কুন্তী এবং বিদুর তাদের কী বুঝিয়ে কী বলে নিয়ে এসেছেন এখানে। এদের প্রতিহিংসাপরায়ণ জিঘাংসা কখনো কখনো এমন ভয়াল মূর্তিতে প্রকাশিত হতো যেটা এই পুরীর, এই বংশের যে কোনো পুত্রের পক্ষেই একটা বিভীষিকা। এঁরা এখানকার কারো সঙ্গেই মেলামেশা করতো না, ভ্রাতা বলে জানতো কিনা তা-ও বোঝা যেতো না। তবে মানতো না, সেটা সত্য। পরন্তু, বিদুরের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সর্বদাই সম্ভবত ভাবতো, এই শত্রুনিধন কার্যের জন্যই তারা তাদের গিরিগুহা প্রস্রবণের স্বাধীন স্বচ্ছন্দ বিহার থেকে এখানে আগত হয়ে বন্দী হয়েছে। অন্তত জান্তব চরিত্র নিয়ে পৰ্বত-প্রমাণ মনুষ্যাকৃতি ভীম যে সেটাই ভাবতো তাতে কোনো সংশয় নেই। ভীমের চরিত্রও তার আকৃতির তুল্যই ভয়ংকর। সে ক্ষমা করতে জানে না, শক্রকে ভোলে না, পরিহাসচ্ছলেও হাসে না; বক্রভাবে তাকায়, অস্পষ্টভাবে কথা বলে। সে উদ্ধত এবং বহুভোজী, তার চোখের রং পিঙ্গল, এবং মুখমণ্ডল শাশ্রুবিহীন। আসলে পাহাড়ে-পর্বতে জলে-জঙ্গলে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে স্বভাবতই এই বালকেরা কিছুটা হিংস্র চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তদ্ব্যতীত, পিতার মৃত্যুতে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। পিতার জন্য তারা কাঁদেনি, একবারও তাদের মুখ থেকে পিতার নাম উচ্চারিত হয়নি। পাণ্ডু যদি এদের পিতা হতেন, যদি জ্ঞানেন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডুকে পিতা বলে জানতো এঁরা, তা হলে তাদের পিতৃশোক নিয়ে রচয়িতা একটা দুটো লাইন লিখেই কর্তব্য সম্পন্ন করতেন না। নকুল সহদেব যদি মাদ্রীর পুত্র হতো, তবে তাদের মাতৃশোকও মাত্রই সতেরো দিনে অবসিত হতো না। কুন্তী-বিদুর ব্যতীত বস্তুতই তারা পাণ্ডু-মাদ্রী নামের কোনো মানুষকে কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। কুন্তী-বিদুর নামে চেনা মানুষ দুটি তাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে এনেছেন, এবং অনবরত বোঝাচ্ছেন, এই সিংহাসনের অধিকারী তারা, সুতরাং দখল নিতে হলে ধাৰ্তরাষ্ট্রদের সঙ্গে লড়াই ব্যতীত অন্য কোনো রাস্তা নেই। সে জন্যই ভীমের অত্যাচারের কোনো সীমা ছিলো না, এবং অন্য চারটি ভাইয়েরও এই অত্যাচার উপভোগের আনন্দ ছিলো অসীম। আক্রোশের বীজ বিদুর রন্ধে রন্ধে প্রবিষ্ট করিয়েই এদের নিয়ে এসেছেন এখানে।
ভীমের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুর্যোধন শেষে এই প্রাত্যহিক যন্ত্রণার হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য ভীমের মিষ্টান্নে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে লতাপাতা দিয়ে হাত পা বেঁধে জলের ধারে ফেলে রেখে এলো। হিংসার পরিবর্তে এই তাদের প্রথম প্রতিহিংসা। নচেৎ তারা এই অপরিচিত আগন্তুকদের সঙ্গে অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়েই ক্রীড়া করতো। ভীমের নিষ্ঠুর ব্যবহার যখন অসহ্য হয়ে উঠলো তখন তাঁকে রোধ করার কৌশল বার না করলে তারা থাকতোই বা কী করে? অন্য চারজন, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব, এঁরাও তো ভীমের এই অত্যাচার দেখে যথেষ্ট আমোদিত হচ্ছেন। সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির তো অন্তত তার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে এই ব্যবহার থেকে বিরত করতে পারতো? মহাভারতে ভীমের দেহ এবং শক্তি বিষয়ে যে বর্ণনা আছে তার সঙ্গে একমাত্র একটা হাতির তুলনা হতে পারে। অবশ্য হাতিও বোধহয় তার কাছে বালকমাত্র। ভীম ইচ্ছে করলে একটা বিরাট বৃক্ষকেও উপড়ে তুলে ফেলতে পারে। সে যখন হাঁটে তখন তার জঙ্ঘাপবনে সারা জঙ্গল কম্পিত হতে থাকে। এর সঙ্গে শক্তিতে পাল্লা দিতে যে কোনো মনুষ্যসন্তানই অক্ষম। তদ্ব্যতীত, ধাৰ্তরাষ্ট্রর রাজপুত্র, জন্মাবধি সুখে-সম্পদে লালিত পালিত। নিয়মবন্ধনে যুদ্ধ হলে তারা বীরত্ব দেখাতে সক্ষম, কিন্তু এই সব অশিক্ষিত পটুতা তাদের নেই। পরবর্তী জীবনে এর প্রমাণ দুর্যোধন দিয়েছেন। গদাযুদ্ধে ভীম সর্বদাই দুৰ্যোধনের নিকট পরাজিত হতো। বস্তুত, প্রাকৃতজনের মতো অভব্য মারামারিতে কী করে জয়ী হবে একজন সুখে-লালিত গৃহরক্ষিত শিক্ষিত সন্তান? এঁরা কেউ শিশু নয়, বালকও নয়, বলা যায় কৈশোরও প্রায় উত্তীর্ণ। রীতিমতো যৌবনের চৌকাঠে পা দিতে চলেছে। এই ধরনের খেলার বয়স তাদের ফুরিয়ে গেছে। দুৰ্যোধন দুঃশাসন ইত্যাদি ভ্রাতারা এদের শত্রুপক্ষ ব্যতীত আর অন্য কী ভাবতে পারে? তারা নিজেরাই তো পাঁচটি ভ্রাতা নিজেদের পৃথক করে রেখেছে দুৰ্যোধনদের থেকে। এই যে আক্রমণটা ভীম করে আর অন্য চারটি ভ্রাতা উপভোগ করে, সেখানেই তো একটা মোটা দাগ পড়ে গেলো দুই পক্ষের মাঝখানে। সেই দাগটাকে আরো মোটা করলেন বিদুর। তিনি বলে বেড়ালেন দুর্যোধনের মতো ক্রর পাপাচারী ও ঐশ্বৰ্যলুব্ধ পাপাত্মা ভীমসেনের অপরিমিত পরাক্রম দর্শনে অতিশয় উদ্বিগ্ন হয়েছে। বৃকোদরের শৌর্য দেখে ভেবেছে ভীমকে বধ করতে পারলেই অৰ্জুন আর যুধিষ্ঠিরকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হবে। প্রকৃতই অল্প বয়সের অপরিণত বুদ্ধিতে আপদ বিদায়ের এটাই তিনি মোক্ষম অস্ত্র বলে মনে করেছিলেন। এর মধ্যে রাজ্যপ্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কোনো কুট কৌশল ছিলো কি ছিলো না এসব বিবেচনা বিদুরের নিকট নিরর্থক। যে ছিদ্র তিনি অজস্রবার অন্বেষণ করে করে হতাশ হয়েছেন, পেয়ে গেলেন সেটা। বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে পড়লেন প্রচার কর্মে রটনা করে বেড়ালেন, দুরাত্মা দুর্যোধন (বেচারা দুৰ্যোধন যে কী করে এই দুরাত্মা আখ্যাটি পেলেন, তার কিন্তু কোনো কারণ এখনো পাওয়া যায়নি) যুধিষ্ঠিরকে রাজত্বের অধিকার দেবার ভয়ে ভীমকে বিষ ভক্ষণ করিয়েছে।
ছেলেদের দেখার ভার সম্ভবত তখন বিদুরের হস্তে অর্পিত। ভীষ্মকে তিনি কেবলমাত্র ধৃতরাষ্ট্রের জীবন থেকেই উচ্ছিন্ন করেননি, ছেলেদের থেকেও করেছেন। নিরপেক্ষ এই ব্যক্তিটির নিকট এই পঞ্চপুত্রকে বেশিদিন ছেড়ে রাখা তার নিরাপদ মনে হয়নি। দুর্যোধনদের অকীর্তির সংবাদ ধৃতরাষ্ট্র এবং ভীষ্ম দুজনেরই শ্রুতিগোচর করা হলো। তারা বিশ্বাস করলেন। দুঃখিত হলেন। বিদুর সকলের নিকটই ধর্মের ধ্বজা। বিদুরের সেই ছদ্মবেশ সকলের কাছেই অভ্রান্ত। কিন্তু এই প্রশ্নটা কেউ তোলেননি, দুর্যোধনের প্রতিপক্ষ তো ভীম নয়, যুধিষ্ঠির যুধিষ্ঠিরকে মারবার চেষ্টা না করে, ভীমকে করা হলো কেন?
দ্বৈপায়ন পুনরায় একটি চমৎকার গল্প উপহার দিলেন পাঠকদের বিষ খেয়েও ভীম না মরে যখন লম্বা একটি নিদ্রা সেরে, জৃম্ভণ তুলে, হস্তপদদ্বয়ের বন্ধন ছিন্ন করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন বিদুরের পিতা রচনা করলেন আর এক রূপকথা। ভীম বিষ খেয়ে জলমগ্ন হয়ে একেবারে নাগলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেখানে বিষধর সর্পকুল তাঁকে ভীষণভাবে দংশন করায় সেই সাপের বিষেই ভীমের শরীরের বিষক্রিয়া তিরোহিত হয়। আর নাগরাজ বাসুকি ভীমকে কুন্তিভোজের দৌহিত্র বলে চিনতে পেরেই প্রতিপ্ৰসন্ন চিত্তে আদর সমাদর করে প্রভূত ধন-রত্ন তো দিলেনই, আবার অমৃতও খাইয়ে দিলেন। তখন ভীম জলের তলা থেকে উঠে বাড়ি ফিরে এলো।
কী আশ্চর্য! ভীমেরা সব এতো পুণ্যবান যে তারা জলেও ডোবে না, বিষেও মরে না। মাত্রই পনেরো-ষোলো বছর বয়সের একটি কিশোরের এই বালকোচিত প্রতিহিংসা নিয়ে বিদুর এমন ষড়যন্ত্র পাকাতে বসলেন কুন্তীর সঙ্গে যেন একটা খুন হয়েছে। এবং সত্যি সত্যি দুটি প্রকৃত খুনী স্ত্রী-পুরুষ যুধিষ্ঠিরকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে কী বললেন, কী চক্রান্ত করলেন, আখেরে দেখা গেলো যুধিষ্ঠিরের চলাফেরা, কথা বলা, সব কিছুই বিদুরের নির্দেশে চলছে। ঝগড়া হলো ভীমের সঙ্গে, সাবধান করলেন যুধিষ্ঠিরকে। যা ঘটাতে চান, যা রটাতে চান, সমগ্র নগরের ঘরে ঘরে তা জানিয়ে দিলেন। রাজপুরীর সদস্যদেরও জানাতে বাকি রাখলেন না।
বিদুরের পিতা রচনার দ্বারা জানিয়েছেন বিদুর হচ্ছেন স্বয়ং ধর্ম। সামান্য অপকর্মের ফলে মর্ত্যভূমিতে জন্ম নিয়েছেন। আর দুর্যোধন ধর্মহীন অসূয়াপ্ৰমত্ত এক অতিপাপাত্মা মানব উল্টোদিকে, বিদুর আর দ্বৈপায়নের দ্বারা যুধিষ্ঠিরকে মহাত্মা প্রতিপন্ন করার চেষ্টাও নিয়ত চলতে লাগলো, কারণ দুর্যোধনই যুধিষ্ঠিরের প্রধান প্রতিযোগী, তার শিক্ষ-দীক্ষা ভীমের প্রতিফলনে সমৃদ্ধ। দুৰ্যোধনকে বিদুর অবিশ্রান্ত অবিরাম শাপশাপান্ত করছেন, প্রচার চালাতে চালাতে রাজ্যবাসীদের মনে বিষ ধরিয়ে দিচ্ছেন, যার ফলে সহস্ৰ সহস্র বছর পেরিয়ে আজও মানুষের মন থেকে সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস উৎপাটিত নয়। ভাগ্যের করুণা যে কখন কার ওপর বর্ষিত হয় বোঝা দায়। কপটতার মুখোশ পরে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাতে সব পলিটিশিয়ানই পটু। বিদুর এক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, ক্ষমতালোভী চতুর মহামন্ত্রী।
একটা সময়ে বিদুরের মনে হলো ভীষ্মই হবেন তার স্বার্থসিদ্ধির প্রধান অন্তরায়। অবশ্য এই চিন্তা বিদুরের নতুন নয়। স্বীয় পুত্র যুধিষ্ঠির এবং অন্য চারটি তরুণকে নিয়ে (অর্থাৎ যে চারটি তরুণ সৰ্বকর্মে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবে) যখনই কুন্তী রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হলেন, সেই থেকেই শুরু। কেবলমাত্র ভীষ্মই নন, নিজের পিতামহী সত্যবতীর অবস্থানও তখন তার খুব ভালো লাগছিলো না। কেবলই মনে হচ্ছিলো, যে কার্যের জন্য বিদুর এখন অতিমাত্রায় উৎসুক, সে অভিপ্রায়ে সত্যবতীও হয়তো অন্তরায় হবেন। তার কারণ, জন্মসূত্রে সত্যবতী তাঁর অবৈধ পুত্র দ্বৈপায়নকে এনে এই বংশের সমস্ত রক্ত ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তাঁকে মানুষ করেছেন বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজদের সঙ্গে, রাজা শান্তনুর একমাত্র পুত্র দেবব্রত ব্যতীত একটি আর্য সন্তানকেও তিনি তার সংকল্পের সংসারে ঢুকতে দেননি, তথাপি বিদুর যে দাসীপুত্র সেটা তিনি বিস্মৃত হবেন না। কূট বুদ্ধির স্বচ্ছ দর্পণে বিদুর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন রাজত্বের কুঞ্চিকাগুচ্ছ এখন থেকে সত্যবতীর হস্তগত না থাকলেই তার অসাধ্য সাধনের সাধ একদিন পূর্ণ হতে পারে। নচেৎ, কুরুকুলের সিংহাসন বিদুরকুলের হস্তগত হওয়ার পথে বাধা আসা সম্ভব।
কিন্তু সত্যবতীকে বনগমনে পাঠাবেন এবং ভীষ্মকে মাত্রই একজন বৃদ্ধ রাজকর্মচারীতে পরিণত করবেন, তেমন ক্ষমতা বিদুরের নেই। যাঁর আছে তার নাম দ্বৈপায়ন। এতদ্ব্যতীত, ঘুড়ির সুতো এখন আকাশে উড্ডীন, এবার লাটাইটা হাতে পাওয়া প্রয়োজন। যতোদিন সত্যবতী। স্বেচ্ছায় বনগমনে না যাবেন, সেই লাটাই তিনি হস্তান্তরিত করবেন এমন আশা দুরাশা মাত্র। সেটা যাঁর হস্তে দিতে পারেন, অথবা দিতে হয়তো উৎসুকই, তিনি তার অবৈধ পুত্র দ্বৈপায়ন। অতএব সংবাদটি অচিরেই দ্বৈপায়নের শ্রবণে গিয়ে পৌঁছলো, এবং দ্বৈপায়নও অচিরেই এসে পৌঁছলেন। মাতাঁকে বললেন, সময় অতিশয় দারুণ হয়ে উঠেছে, কুরুদের দুর্নীতিপ্রযুক্ত রাজশ্ৰী তাদের পরিত্যাগ করবেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এঁরা সবংশে কৃতান্তসদনে গমন করবে। এসব দেখার পরিবর্তে বনে গমন করে যোগানুষ্ঠানে যত্ন করুন।’
প্রকৃত পক্ষে সত্যবতীর সংসারে থাকার আর কোনোই যুক্তি ছিলো না। যা তিনি করতে চাইছিলেন, সে কার্য সম্পন্ন করেছেন। এই প্রাসাদের পুত্র পৌত্র সবই এখন তৈরি হয়েছে তার অবৈধ পুত্রের দ্বারা। তাঁর সাফল্যের যান এখন স্টেশন ছাড়িয়ে, হুইসিল বাজিয়ে, অতি দ্রুত চলমান তথাপি তিনি যে পুত্র এসে বলবার পূর্বেই সংসার পরিত্যাগ করেননি, তার কী কারণ থাকতে পারে? স্বামী হারিয়েছেন, পুত্রদ্বয় হারিয়েছেন, পৌত্রকেও হারাতে হলো। সংসার তবে তাঁকে কার টানে ধরে রেখেছিলো? কে সে? এতগুলো মৃত্যুশোক সহ্য করেও সত্যবতী যে সংসার ছাড়তে পারেননি, তার কারণ কি তবে দেবব্রত? যার সান্নিধ্য তাঁকে সেই অপরিমিত শোকেও সান্ত্বনা জুগিয়েছে, তার প্রতি যার আনুগত্যের কোনো সীমা ছিলো না? যখন তার গর্ভজাত অবৈধ পুত্র তাঁকে বনগমনে যেতে বাধ্য করলেন, তখন কি তাঁর সপত্নীপুত্রের জীবন থেকে এবং রাজ্যের নিশ্চল প্রতিষ্ঠা থেকে উচ্ছিন্ন হতে বেদনায় বক্ষ বিদীর্ণ হয়েছিলো? পতির মৃত্যুর পরেও, সারাজীবন ধরে যাঁর আনুকূল্যে এতো সুখ, এতো মর্যাদা, এতো সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সেই শতপুত্র অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, মহারাজা শান্তনুর কুলপ্রদীপ, নিখিলশাস্ত্রবিশারদ সত্যব্রত দেবব্রত, সেই জিতেন্দ্রিয় গাঙ্গেয়পুত্র বিরহিত জীবনকে শান্তভাবে মেনে নিতে তার মন কি বিদ্রোহ করেছিলো? অনন্যকৰ্মা হয়ে যে সপত্নীপুত্র তার পুত্রদের আমৃত্যু ব্ৰহ্মচর্য বরণ করে সত্যবতীর দাসানুদাস হয়ে আছেন, যার দাক্ষিণ্যে দ্বৈপায়ন এই আর্যপুরীতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন, স্বীয় পুত্রের একটি ইঙ্গিতেই ঘর ছেড়ে বনগমনে যেতে যেতে, দীর্ঘশ্বাস মোচন করে, কাষায়বস্ত্রে অশ্রু মার্জনা করে, একবার কি তিনি ফিরে তাকিয়েছিলেন তার দিকেই? এতদ্ব্যতীত, অম্বিকার পৌত্রের দৌরাত্যের কথা তিনি তো এর পূর্বে কিছু শোনেননি? ভীষ্মও তো কিছুই বলেননি। তবে দ্বৈপায়ন কার কাছে শুনে অতি দ্রুত এসে অতি দ্রুতই চলে গেলেন? সেই সঙ্গে সত্যবতীকেও পুত্রবধূদ্বয় সহ যেতে হলো বনগমনে।
এখন সত্যবতীর যেমন বয়স হয়েছে, ভীমের তেমনি বয়স বেড়েছে। তাঁর আর্যসুলভ স্বর্ণাভ কেশদাম এখন শ্বেত শুভ্র। মধুর মতো পিঙ্গলবর্ণ তার ত্বক অনেক ঋতুর স্বাক্ষরে রেখাঙ্কিত। এতোদিনে তিনি বিশ্রাম নিলেন তার রাজকার্য থেকে। এতোদিনে তিনি প্রকৃতই পরিণত হলেন মাত্র একজন রাজকর্মচারীতে। বিদুর যা চেয়েছিলেন তাই সর্বতোভাবে পূর্ণ হলো। এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই সংবাদ পাওয়া গেলো সত্যবতী ইহলীলা সংবরণ করেছেন। বৃদ্ধ রাজকর্মচারী পিতামহ ভীষ্ম হয়তো ভাবলেন, কাল কী ভয়ানক বস্তু! পণ্ডিতেরা বলেন, সূর্যের আগুনে দিবারাত্রির ইন্ধনে মাস ও ঋতুর হাতা দিয়ে নেড়ে নেড়ে কাল মহামোহময় কটাহে প্রাণীবৃন্দকে রন্ধন করছে। প্রত্যহ প্রাণীগণের মৃত্যু হচ্ছে তবু মানুষ চিরকাল বাঁচতে চায়। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী আছে? কিন্তু তিনি এখনো বেঁচে আছেন। এখনো তিনি কালের কবলে পতিত হননি। অথচ বক্ষস্থলে শুধুই শূন্যতার হাহাকার।