মহাভারতের মহারণ্যে – ২.৩
পরামর্শের পরে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মগধপুরে গমন করলেন। পথে যেতে যেতে নানাবিধ অন্যায় কর্মে নিরত করলেন নিজেদের। সারি সারি সব দোকান শূন্য করে ফেলে দিলেন, কাউকে কুবাক্য বললেন, তারপর দ্বারদেশে এসে নগরচৈত্যের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।
জরাসন্ধ বৃষরূপধারী দৈত্যকে সংহার করে তাঁর চর্ম দিয়ে তিনটি ভেরী প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। সেই ভেরীতে একবার আঘাত করলে একমাসব্যাপী গম্ভীর ধ্বনি অনুরণিত হতো। মহারাজা নিজপুরীতে সেই ভেরী তিনটি রেখেছিলেন। ভেরীগুলো এঁরা ভেঙে ফেললেন। তারপর নিজেদের অস্ত্র-শস্ত্র পরিত্যাগ করে জরাসন্ধের সঙ্গে বাহুযুদ্ধ করবার জন্য পুরপ্রবেশ করে জরাসন্ধের নিকট সমুপস্থিত হলেন।
মহারাজা জরাসন্ধ তাদের দেখে ব্রাহ্মণ ভেবে সত্বর গাত্ৰোত্থান করে, মধুপর্ক ইত্যাদি দ্বারা পাদ্য পূজা করে, স্বাগত প্রশ্ন করলেন। ভীম আর অর্জুন চুপ করে রইলেন। কৃষ্ণ বললেন, ‘হে রাজেন্দ্র। এঁরা নিয়মস্থ। এঁরা এখন কথা বলবেন না। এঁরা পূর্বরাত্রি অতীত হলে আপনার সঙ্গে আলাপ করবেন।‘ ভেবে দেখুন কী সহজে মিথ্যে কথা বলতে পারেন কৃষ্ণ!
সেদিন কোনো পূজা নিবন্ধন মহারাজা জরাসন্ধ উপবাসী ছিলেন। একথা শুনে তাঁদের যজ্ঞাগারে রেখে স্বীয় গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হলেন। কিন্তু কোনো স্নাতকব্রাহ্মণ অর্ধরাত্র সময়ে উপস্থিত হলে তিনি তৎক্ষণাৎ গমন করলেও প্রত্যুদগমন করতেন। অর্ধরাত্রে এসে পুনরায় তিনি তিনজনের সমীপে উপস্থিত হয়েই পূজা করলেন। একটু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘হে বিপ্রগণ! আমি জানি স্নাতকব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণগণ সভাগমন ব্যতীত কখনো মাল্য বা চন্দন ধারণ করেন না। আপনারা কে?”
কৃষ্ণ বললেন, ‘হে বৃহদ্রথনন্দন! ধীর ব্যক্তিগণ শক্ৰগৃহে অপ্রকাশ্যভাবেই প্রবেশ করে। আমরা স্বকার্য সাধনাৰ্থে শত্রুগৃহে প্রবেশ করেছি।‘
জরাসন্ধ বললেন, ‘হে বিপ্রগণ! আমি কখন আপনাদের শক্রতা করেছি? কী নিমিত্ত আমাকে শত্রু বলে স্থির করলেন? আমি সতত স্বধর্ম সাধনে নিয়ত থাকি। প্রজাদের ব্যথিত করি না। নিশ্চয়ই আপনাদের কোনো প্রমাদ ঘটেছে।‘
গভীর রাত্রির নির্জন মুহূর্তে দুটি বলবান যোদ্ধার আশ্রয়ে সাহসী হয়ে উঠে কৃষ্ণ স্বমূর্তি ধারণ করে বললেন, ‘তোমাকে কপট সংহার করতেই আমরা এখানে এসেছি। আমরা ব্রাহ্মণ নই। আমি বসুদেবনন্দন কৃষ্ণ, এঁরা দুজন পাণ্ডুতনয়।’
এরপর ভীমের সঙ্গে জরাসন্ধের প্রবল যুদ্ধ শুরু হলো। চতুর্দশ দিবসে ধূর্ত কৃষ্ণ ক্লান্ত মগধরাজকে কীভাবে হত করা যাবে জানাতে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে ভীমের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘হে ভীম! তোমার যে দৈববল ও বাহুবল আছে, আশু সেটা জরাসন্ধকে প্রদর্শন করাও।‘ বলামাত্র ভীম অব্যবস্থিত, ক্লান্ত, উপবাসী, অসতর্ক, জরাসন্ধকে তাঁর দানবীয় শক্তি দিয়ে উৎক্ষিপ্ত করে ঘূর্ণিত করতে লাগলেন। তারপর হাঁটু দিয়ে চেপে বসে তাঁর পৃষ্ঠদেশ ভগ্ন ও নিষ্পেষণ করে তাঁর পদদ্বয় দুহাতে ধরে দ্বিধা-বিভক্ত করলেন। কৃষ্ণ এবং অর্জুন বসে বসে সেই নারকীয় দৃশ্য উপভোগ করলেন।
অবশ্য আমি যতো সহজে যুদ্ধের শেষ দৃশ্যে এনে ফেলেছি এতো সহজে ভীম এখানে এসে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু সেই বর্ণনায় গিয়ে লাভ নেই। প্রকৃত পক্ষে, কৃষ্ণের লুকিয়ে পালিয়ে থাকা জীবন থেকে এতোদিন মুক্তি ঘটলো। এই কারণেই, এতোকাল পরে, নব পরিচিত এই যুবকদের সঙ্গে তাঁর বাড়াবাড়ি বন্ধুতার কার্যকারণটাও বুঝতে অসুবিধে হলো না। জরাসন্ধকে হত্যা করে এসে তিনি হাঁপ ছাড়লেন। এবং দেশে দেশে রটে গেলো পুরষোত্তম কৃষ্ণ, মহাবল ভীম, অজেয় যোদ্ধা অর্জুন, জরাসন্ধকে নিহত করেছেন।
পাণ্ডবরা যা করেছেন সবই ক্ষাত্রধর্ম বিরুদ্ধ। এভাবে গোপনে কারো অন্তঃপুরে প্রবেশ করে অসতর্ক গৃহস্থকে হত্যা করা, কেবলমাত্র ক্ষত্ৰিয়ই নয়, যে কোনো মনুষ্যের পক্ষেই অতিশয় গৃঢ় অপরাধ বলে গণ্য। প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত পাণ্ডবরা এই কর্মই করে গেছেন। কিন্তু তাতে তাদের কোনো নিন্দা নেই মহাভারতে। আইনত ফাঁসির যোগ্য অপরাধও বীরত্ব বলে ঘোষিত হয়েছে। আমরা পাঠকরা সেটা মেনে নিতে পারি না। যা অন্যায় তা অন্যায়ই, সেটা যিনিই করুন।