মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০৪

মহাভারতের মহারণ্যে – ২.৪

কৃষ্ণের দুজন শক্রর একজন এই জরাসন্ধ, অন্যজন শিশুপাল। জরাসন্ধ শিশুপাল অপেক্ষা কৃষ্ণের অন্তরে অনেক বেশী ভীতিজনক ব্যক্তি ছিলেন। জরাসন্ধের ভয়েই তিনি লুকিয়ে দ্বারকাবতীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাঞ্চালীর স্বয়ংবর সভাতে গিয়েই তিনি বুঝেছিলেন অৰ্জুন এবং ভীম একত্র হলে তিনি অনেক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাতে পারেন। দেরি না করে তিনি তাঁদের প্রিয় সখা হয়ে উঠলেন। অনুমান ব্যর্থ হলো না।

এবার যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের পরামর্শে নিৰ্ভয়ে যজ্ঞে নিয়োজিত হলেন। অতঃপর চতুর্দিকে সমস্ত ব্রাহ্মণ এবং রাজগণকে আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ করতে দূত পাঠালেন। সকলেই সে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে চলে এলেন সভাতে। কৃষ্ণের আর একজন শত্রু শিশুপালও এলেন। তিনি যে আসবেন কৃষ্ণ জানতেন। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইলেন এই ব্যক্তিটিকেও নিধন করার জন্য।

সেটা অবশ্য লিখিত নেই, তবে বুঝতে দেরি হয় না। এবং ঘটনাটা অচিরেই ঘটে গেলো। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, যে পাণ্ডবরা বিদুর ব্যতীত কুরুকুলের আর কারো প্রতিই কোনো আতীয়তা অনুভব করতেন না, হঠাৎ দেখা গেলো কুরুপিতামহ ভীষ্মকে তারা এই বৃহৎ যজ্ঞের একজন বিশিষ্ট গণ্যমান্য কর্তব্যক্তি হিশাবে স্থান দিয়েছেন। অথচ এতোকাল তাঁকে উপেক্ষাই করে এসেছেন তারা। যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষেক, জতুগৃহদাহ, পাণ্ডবদের দগ্ধ হবার সংবাদ, পাঞ্চালরাজের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক, একজন কন্যাকে পাঁচজন ভ্রাতার বিবাহ এতোগুলো ঘটনার মধ্যে কখনোই কুরুকুলপতি পিতামহকে কেউ স্মরণ করেননি। আর কোথাও না হোক, বিবাহ বাসরে তাঁর উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিলো। সতেরো দিনের মৃত গলিত পাণ্ডু ও পাণ্ডুপত্নী মাদ্রীকে নিয়ে যখন কুন্তী বহু বৎসর পরে পাঁচটি বড়ো বড়ো পুত্রসহ এলেন, ভীষ্মই তখন তাদের সমাদরে গ্রহণ করে পুরবাসীদের মনকে সংশয়হীন করেছিলেন। পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ বলে গ্রহণ করে কুন্তীর সম্মানও যেমন রক্ষা করলেন, পাঁচটি অজানিত পুত্রদেরও কুরুকুলে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তিনিই তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। ক্ষত্রিয়জনোচিত বীর তৈরী করতে দ্রোণাচার্যকে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে গুরু নিয়োগ করেছেন। স্নেহ মমতা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু কার্যকালে দেখা গেলো বিদুর এবং ব্যাসদেবই পাণ্ডবদের সব।

প্রকৃতপক্ষে ভীষ্ম ছিলেন সত্যবতীর প্রয়োজনের হাতিয়ার। কিন্তু এখন আর কীসের প্রয়োজন? বরং যে উদ্দেশ্যে বিদুর তাদের অজ্ঞাতবাসে রেখে ব্যাসদেবের সাহায্যে মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রকে গদিচ্যুত করবার বাসনায় অন্য কোনো বলশালী রাজার সঙ্গে যুক্ত, সেখানে ভীষ্ম অবশ্যই অপাঙক্তেয়। তদ্ব্যতীত, যে পদ্ধতিতে একজন কন্যা পঞ্চস্বামীর হস্তে সমৰ্পিত হলো, সেই পদ্ধতি আর্যকুলে বা ক্ষত্রিয়কুলে সম্ভবই নয়। আর্য নিয়ম বা ক্ষত্রিয় নিয়ম না মেনে অনার্য অবৈধ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন যেভাবে তাঁর পৌত্র যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের রাজত্বে সর্বময় কর্তৃত্বের আসনে বসাবার রাস্তা সাব্যস্ত করলেন, সেখানে ভীষ্মকে স্মরণ করাও একটা মস্ত বড় বাধা। পাণ্ডুর ক্ষেত্ৰজ হলে এই প্রথা অনুসারে বিবাহ করা বা বিবাহ দেওয়া তিনি কি মেনে নিতেন? কিন্তু নিয়েছিলেন। কেন নিয়েছিলেন? তাঁর কারণও কি সত্যবতী? মৃত সত্যবতীকে স্মরণ করে?

অকস্মাৎ দেখা গেল সত্যবতীর দয়ায় অপাঙক্তেয় বৃদ্ধ প্রায়বিস্মৃত ভীষ্মকে পাণ্ডবরা অতিশয় সম্মান দেখিয়ে সেই যজ্ঞে আহবান করে একজন প্রধান ব্যক্তি হিশেবে নিয়ে এসেছেন। সম্ভবত কৃষ্ণের পরামর্শেই সেটা করেছিলেন তারা, এবং নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিলো। নচেৎ এতোকাল পরে এ বৃদ্ধকে তাদের কী দরকার? কিন্তু যতোই নিস্তাপ হয়ে যান না কেন, তিনি খাঁটি ক্ষত্রিয় তো বটে। এই আগুন কখনো নির্বাপিত হয় না। একটু খুঁচিয়ে বাতাস দিলেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এই সত্য কৃষ্ণের বুদ্ধির অন্তর্গত হওয়াই স্বাভাবিক। এতোবড়ো যজ্ঞসভায় এই রকম ক্ষত্রিয় বীরকে সহায় পাওয়া প্রয়োজন। তাঁকে হাতে রাখার জন্য কৃষ্ণ অবশ্যই অনেক মধুর ব্যবহার এবং অনেক মধুর বাক্য বিনিময়ে সম্মোহিত করে ফেলেছিলেন ভীষ্মকে। এসব কথা লিখিত না থাকলেও অলিখিত সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়। যজ্ঞের শুরুতে প্রধান পদের মর্যাদায় স্থিত ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ঋত্বিক, সম্বন্ধী, স্নাতক এবং প্রিয় ব্যক্তি এঁরাই অৰ্ঘাৰ্হ। এদের সকলের জন্যই এক একটি অর্ঘ্য নিয়ে এসো।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আপনি কাকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করছেন?’

ভীষ্ম শেখানো বুলির মতো বললেন, ‘কৃষ্ণ।‘

সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণকে অর্ঘ্যও প্রদান করা হলো, কৃষ্ণও তা গ্রহণ করলেন।

তারপরেই, যা অবশ্যম্ভাবী বলে কৃষ্ণ ভেবে রেখেছিলেন, তাই হলো। রাজন্যবর্গের প্রতিভূ হয়ে সঙ্গত কারণেই শিশুপাল প্রতিবাদ করে বললেন, বাসুদেব ঋত্বিক নয়, আচার্য নয়, নৃপতি নয়, তবে কেন তাঁকে অৰ্ঘ্য প্রদান করা হবে? হে পাণ্ডব। এই সমস্ত রাজগণ উপস্থিত থাকতে কখনোই কৃষ্ণ পূজার্হ হতে পারে না। তুমি কামতঃ কৃষ্ণের অর্চনা করেছো। ধর্মের কিছুই জানো না, ধর্ম অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। আর এই ভীষ্ম অদূরদশী এবং স্মৃতিশক্তিহীন। হে ভীষ্ম! যে কৃষ্ণ রাজা নয়, তুমি তাঁকে কী বলে অর্ঘ্য প্রদান করলে? সে-ই বা কী করে সকল মহীপতির মধ্যে সেই পূজা গ্রহণ করলো? হে কুরুনন্দন! কৃষ্ণ সর্বদাই তোমার অনুবৃত্তি করে তোমার প্রিয়ার্থী হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু দ্রুপদ থাকতে কৃষ্ণের পূজা করা তোমার উচিত হয়নি। যদি কৃষ্ণকে আচার্য মনে করে থাকো, তা হলে দ্রোণ থাকতে কৃষ্ণ কেন অৰ্চিত হলো? কৃষ্ণকে ঋত্বিক মনে করে থাকলে বৃদ্ধ দ্বৈপায়ন উপস্থিত আছেন। শান্তনব ভীম, সর্বশাস্ত্রবিশারদ অশ্বথামা, রাজেন্দ্র দুৰ্যোধন, ভারতাচার্য কৃপ, মদ্রাধিপ শল্য, এই সমস্ত মহাত্মারা থাকতে এবং জমদগ্নির প্রিয় শিষ্য, যিনি আত্মবল আশ্রয় করে রণক্ষেত্রে সমুদয় রাজলোক পরাভব করেছিলেন, সেই মহাবল-পরাক্রান্ত কর্ণকে অতিক্রম করে কী করে কৃষ্ণের পূজা করলে? মনে মনে যদি এই স্থির ছিলো তোমার, তবে এ সমস্ত রাজাদের আহবান করে তাদের অপমান করলে কেন? কোন ধাৰ্মিক পুরুষ ধর্মভ্রষ্ট ব্যক্তিকে সজ্জনেচিত পূজা করে? যে বৃষ্ণিকুলে জন্মগ্রহণ করেছে এবং ভীমসেন ও ধনঞ্জয় দ্বারা অতি হীনভাবে মহাত্মা জরাসন্ধের প্রাণ সংহার করিয়েছে, কোন ব্যক্তি তাঁকে ন্যায্য বলে স্বীকার করতে পারে? সেই দুরাত্মা কৃষ্ণকে অর্ঘ্য নিবেদন করাতে আজ যুধিষ্ঠিরের নীচত্বই প্রদর্শিত হলো। ধাৰ্মিকতাও বিনষ্ট হলো। জানি কুন্তীতনয়েরা ভীত, নীচস্বভাব তপস্বী, কিন্তু ওহে কৃষ্ণ তারা না হয় নীচতাপ্রযুক্ত তোমাকে পূজা প্রদান করলো, তুমি কী করে তা স্বীকার করলে?

এ সমস্ত বলে শিশুপাল গাত্ৰোখান করে অন্যান্য রাজগণের সঙ্গে সভা ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, “হে মহীপাল তুমি যা বললে তা নিতান্ত অধৰ্মযুক্ত, পরুষ ও নিরর্থক। ধর্ম কাকে বলে তুমি নিজেই তা জানো না।’

ভীষ্ম বললেন, ‘হে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের অর্চনা যার অনভিমত, এমন ব্যক্তিকে অনুনয় করার দরকার নেই। এই নৃপসভায় এমন কোন নৃপতি আছেন, তেজবলে কৃষ্ণ যাকে পরাভব করেননি?’

এটা সত্য কথা নয়। কৃষ্ণ যাদববংশের সন্তান, তাদের পেশা যুদ্ধ বিগ্রহ নয়। কোনো নৃপতির সঙ্গেই তিনি কখনো যুদ্ধ করেননি, হারজিতের প্রশ্নও ওঠেনি। ভীমের এ অদ্ভুত কথা শুনে সমস্ত নৃপকুল সংক্ষোভিত হয়ে উঠলো। কৃষ্ণ রাজা নন, ক্ষত্রিয় নন, কবে কোন রাজার সঙ্গে যুদ্ধ হলো তাঁর?

কৃষ্ণ তাঁর তৃতীয় নয়নের তীব্রতায় এই ছবিটা পূর্বেই দেখতে পেয়েছিলেন। কোনটার পর কী ঘটবে সেটা তাঁর নখদর্পনে ছিল। সুতরাং তিনি জানতেন অপমান আর যে নৃপই সহ্য করুন, শিশুপাল করবেন না। এবং এই ক্ষেত্রে কুরুকুলের সর্বজ্যেষ্ঠ ভীষ্মকেই সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। তাঁকে প্রধান করে কলহের সূত্রপাত তাঁর দ্বারা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাঁকে কোনোক্রমে যদি ক্ষিপ্ত করে তোলা যায়, তবে আর কোনো ভয় থাকে না। ভীমের মতো যোদ্ধার কাছে শিশুপালও শিশুই যজ্ঞ পণ্ড হতে পারে, তা হোক, এই সুযোগে শিশুপালকে নিহত করাই আসল কথা।

শিশুপালকে বধ করতে হলে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কিছু হতে পারে না। অসংখ্য লোকের মধ্যে, বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে, এই রকম প্রচণ্ড গোলমালের মধ্যে, যেখানে কে কী করছে বোঝা দুষ্কর, যেখানে অধিকাংশই অধিকাংশকে চেনে না, সেখানে কে কোথায় কোন অবস্থায় অবস্থান করলে আসল কর্মটি সকলের অলক্ষ্যে সাধন করা যায়, সে ভাবেই গতিবিধি নির্দিষ্ট ছিলো। জরাসন্ধের ক্ষেত্রে কৃষ্ণ যেমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভীমকে, এখানে তেমন ইঙ্গিতেরও প্রয়োজন নেই। শিশুপাল এলেই যে তাঁকে অৰ্ঘ্য দেওয়া নিয়ে একটা প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হবে সেটা কৃষ্ণের জানাই ছিলো। ভীষ্মকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করানো হয়েছে কৃষ্ণ মানুষের আকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও ইনিই ঈশ্বর। ঈশ্বরের সব মহিমাই তাঁর মধ্যে নিহিত হয়ে আছে। ইনি ইচ্ছা করলে এই মূর্তিতেই সৃষ্টি স্থিতি প্ৰলয় সবই মুহুর্তে ঘটিয়ে ফেলতে পারেন।

ভীমের কথা শুনে সুনীথনামা এক পরাক্রান্ত বীরপুরুষ ক্রোধে কম্পিত হয়ে আরক্ত নয়নে বললেন, “আমি পূর্বে সেনাপতি ছিলাম, সম্প্রতি যাদব ও পাণ্ডুকুলের সমূলোম্মলন করার জন্য সমরসাগরে অবগাহন করবো।’

অন্যান্য রাজারাও কৃষ্ণের প্রতি এই মিথ্যা গৌরব আরোপ করাতে ক্ৰোধপরবশ হয়ে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। রাজমণ্ডলে রোষপ্রজ্বলিত দেখে ভীতু যুধিষ্ঠির আরো ভীত হয়ে আশ্রয় নিলেন। ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির, ভীত হয়ো না, কুকুর কখনো সিংহকে হনন করতে পারে না। এঁরা চিৎকার করছে, করুক। পার্থিবশ্রেষ্ঠ শিশুপাল অচেতন হয়ে পার্থিবদের যমালয়ে নিয়ে যাবার বাসনা করছে। চেদিরাজের এবং সমস্ত মহীপতিরই মতিচ্ছন্ন হয়েছে। নারায়ণ শিশুপালের তেজ অবিলম্বেই প্রত্যাহর করবেন।‘

শিশুপাল বললেন, ‘হে ভীষ্ম! বৃদ্ধ হয়ে কি তুমি কুলের কলঙ্ক হয়েছো? তোমার কি মতিভ্রম হয়েছে? স্থবিরাবস্থা উপস্থিত হয়েছে? তুমি কি বিচেতন হয়ে দুরাত্মা কেশবের স্তুতিবাদ করছো? যাকে বালকেরাও ঘৃণা করে, তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে তাঁকে কী ভেবে প্রশংসা করছো? তুমি কি জানো, এই দুরাত্মা কংসের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে তাঁকেই সংহার করেছে? অন্নদাতাঁর প্রতি শস্ত্রপাত কি মহাত্মার লক্ষণ? না কি গোপনে হত্যা করা কোনো তেজের লক্ষণ? তাঁকে কি ধর্ম বলে? তুমি কৌরবের প্রধান হয়েছো। ধর্মসঙ্গত বাক্য প্রয়োগ করাই তোমার কর্তব্য। স্তাবকতা নয়।‘

ভীষ্ম বললেন, ‘কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করা থেকে যে সব অলৌকিক কর্মের পরিচয় দিয়েছেন, আমি পুনঃ পুনঃ তাঁর ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি এবং আশ্চর্য হয়েছি। অতএব অশেষ গুণবাহুল্যযুক্ত বৃদ্ধ ব্যক্তিদিগকে অতিক্রম করেও কৃষ্ণের অর্চনা করা বিধেয়। কৃষ্ণ যা করেছেন তা কোনো সামান্য ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। হে চেদিরাজ! তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আর যেন কখনো বুদ্ধির এরকম ব্যতিক্রম না হয়। যেন কখনো এরকম গর্ব প্রকাশ না করো।’

হাস্যসহকারে শিশুপাল বললেন, ‘তুমি কি বাসুদেবকে অপার্থিবজ্ঞানে পার্থিবগণকে বিভীষিকা দেখাচ্ছে, না কি পুতনাঘাত প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপ কীর্তন করে আমাদের কাছে পরিহাসের পাত্ররূপে প্রদর্শন করছো? ক্রীড়নকের মতো ব্যবহার করছো কেন? বাল্যকালে পক্ষীর ন্যায় আকাশে উড্ডীন তৃণাবর্ত এবং যুদ্ধানভিজ্ঞ অশ্ব ও বৃষভ বিনষ্ট করেছিলো, প্রাণহীন এক কাষ্ঠময় শকট পাদদ্বারা পতিত করেছিলো, অথবা রাশিকৃত অন্নভোজন করেছিলো, বাসুদেবের এই কর্মের মহিমাতেই, হে ভীষ্ম! তুমি সেই গোপ বালকদের মতো বিস্ময়াবিষ্ট হলে? তুমি এখন কৌরবশ্রেষ্ঠ না কৌরবাধম!’

ভীম দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে মূর্তিমান কালান্তকের মতো অগ্রসর হয়ে এলেন শিশুপালের দিকে।

ভীমের ক্ৰোধ দেখে কুপিত সিংহ যেমন মৃগের প্রতি উপেক্ষা করে থাকে, সেই রকম উপেক্ষা সহকারে হাসতে হাসতে শিশুপাল বললেন, ‘হে ভীষ্ম, একে পরিত্যাগ করো, এই ভীম পতঙ্গকে আমি এখুনি দগ্ধ করছি, উপস্থিত নরপতিরা দেখুন। আর, তোমার মন যদি কেবল পরের স্তুতিবাদ করেই সন্তুষ্ট থাকে, তবে অন্য ভূপালদের স্তুতিবাদ করো। মহাবীর কর্ণের প্রশংসা করো, যিনি অঙ্গ ও বঙ্গদেশের অধ্যক্ষ এবং সহস্রাক্ষসদৃশ বলশালী, যার মহাবাহুর চাপবিকর্ষ অতি ভয়ানক, কুণ্ডলদ্বয় সহজাত, যিনি সত্যি সত্যি বীর, যিনি সম্মুখযুদ্ধে জরাসন্ধকে পরাজিত করেছিলেন। আরো কতো সব অনন্যসাধারণ বীরগণ উপস্থিত আছেন, তাদের প্রশংসা করো না। তাছাড়া সাগর স্বনা পৃথিবীতে যিনি অদ্বিতীয়, সেই রাজেন্দ্র দুৰ্যোধনই তো এখানে উপস্থিত, তাঁকে স্তুতি করতে ইচ্ছা হয় না তোমার? তুমি মোহবশত এদের উপেক্ষা করে ঐ অস্তবনীয় বাসুদেবকে স্তব করছো কেন? তোমার বুদ্ধি প্রকৃতির অনুগত নয়।’

ভীষ্ম বললেন, ‘আমরা গোবিন্দকে পূজা করেছি, তিনিও সম্মুখে বিদ্যমান। বেশ তো, যার নিতান্তই মরণসাধ হয়েছে সে বাসুদেবকে যুদ্ধে আহবান করুক না।’

ভীমের বাক্য শ্রবণমাত্রই শিশুপাল বাসুদেবকে সংগ্রামে আহবান করে বললেন, ‘কই হে, এসো, আমি তোমাকে আহ্বান করছি। সাহস থাকে তো আমার সঙ্গে সংগ্রাম করো। আজ তোমাকে পাণ্ডবগণ সমভিব্যাহারে যমালয়ে প্রেরণ করি। তুমি রাজা নও, তুমি দাস, দুর্মতি, ও পূজার অযোগ্যপাত্র। এই পাণ্ডবরা সেই তোমাকেই অন্য সব মাননীয়কে অবজ্ঞা করে পূজনীয় হিশাবে পূজা দিয়েছে। তাদের বধ করেও এই অপমানের প্রতিশোধ নেবো।’

কৃষ্ণ অতি সত্বর গা ঢাকা দিলেন। পাণ্ডবরাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। কৃষ্ণ পাণ্ডবদের নিয়ে অন্যান্য ক্রুদ্ধ ভূপতিদের আড়ালে বসে খুব নিচুস্বরে অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনারা দয়া করে শুনুন, এই সাত্যকিনন্দনের কর্মই হলো যে তাঁর উপকার করে তাঁর অপকার করা। এটাই ওর স্বভাব। এই পাপিষ্ঠ আমাকে অনর্থক পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে। আমার সহচরদের বিনষ্ট করেছে। স্বীয় মাতুল বিশালাপতির কন্যা ভদ্রাকে অপহরণ করেছে। (এখানে পুনরায় উল্লেখ করছি, কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুনও তাঁর মাতুল কন্যা সুভদ্রাকে অপহরণ করেছিলেন। অর্জুনের মাতা কুন্তী বাসুদেবের পিতা বসুদেবের ভগ্নি। সুতরাং সুভদ্রাও তাঁর মাতুলকন্যা।) এই পাপাত্মার কুকর্মের সীমা নেই, দুষ্কর্মের শেষ নেই। তথাপি আমি একে কেন এতোদিন সহ্য করেছি জানেন? এর মাতা আমার নিজের পিতৃস্বসা। তাঁর কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ওর সহস্র অপরাধ ক্ষমা করবো। এখন আপনাদের অবগতির জন্য জানাই আজই ওর সেই সহস্র অপরাধ পূর্ণ হলো। আর আমি ওকে ক্ষমা করবো না।’

নিন্দিতকৰ্মা যাদুকর কৃষ্ণ তাঁর বাকচাতুর্যে যতক্ষণ এইসব ক্রুদ্ধ নৃপতিদের বিভ্রান্ত করে, ব্যস্ত করে, অমনোযোগী করে রাখলেন, সেই সুযোগে শিশুপালবধ সাঙ্গ হলো।

এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, যা পূর্বেই কী ভাবে কী করতে হবে স্থিরীকৃত ছিলো, তাঁর সমস্ত প্রক্রিয়াটাই যুধিষ্ঠিরের অনুমোদনে কৃষ্ণের বুদ্ধিতে যে সংগঠিত হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যজ্ঞবাড়ির কোলাহল তখন তুঙ্গে। সহস্ৰ সহস্র ব্রাহ্মণ, জ্ঞাতিকুল, সহকারীগণ, নানা দেশ থেকে আগত প্রধান প্রধান সব ক্ষত্রিয়রা ও অমাত্যবর্গ, লোকে লোকারণ্য। সেইসব হট্টগোলে আর দীয়তাং ভূজ্যতাং শব্দে আকাশ পরিব্যাপ্ত। তাঁর মধ্যে কাকে কোথায় কী উদ্দেশ্যে নিয়োগ করে রাখা হয়েছিলো কে লক্ষ করেছে? মন্ত্রণাপ্রদানে সুচতুর বাসুদেব প্রকৃতই অতি দক্ষ। অনবধান ব্যক্তিকে পিছন থেকে লুকিয়ে সংহার করানোই তাঁর ধর্ম। এই হত্যাকাণ্ড অতি নিপুণতাঁর সঙ্গে সাঙ্গ হলো। শব্দসমুদ্রের মধ্যে একটু উচু থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখে খুব কাছে থেকেই কেউ আঘাত করেছিলো শিশুপালকে আঘাতের প্রচণ্ডতা এতো অধিক ছিলো যে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মস্তক বিদীর্ণ হয়ে গেলো। যে গুরভার লৌহচক্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো, কোনো মানুষের পক্ষে সে আঘাত সহ্য করা সম্ভব নয়। চক্রের ফলা অতি সুতীক্ষ ছিলো। মহাভারতে অবশ্য মধুসূদনের চক্র নামক অলৌকিক বস্তুকে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষ্ণের গরিমা প্রকট করতে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে শিশুপালের মতো বীরকে বধ করার জন্য নিশ্চয় সেই রকমই এক বলিষ্ঠ গুপ্তঘাতক সংগ্রহ করা হয়েছিলো, যার হাতের জোরও প্রচণ্ড। চোখের পলকে কী ভাবে যে নৃপতিদের অমনোযোগের সুযোগে (যে সুযোগটা কৃষ্ণ দিচ্ছিলেন নিজের ক্ষমতার গল্প শুনিয়ে) ঘটনাটা ঘটে গেলো বোঝাও গেলো না।

অকস্মাৎ এই রকম একটি ভয়ঙ্কর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে নৃপতিগণের বাক্য স্ফরিত হলো না। সবাই নিঃশব্দ হয়ে রইলেন। ভয়ে বিস্ময়ে কেউ এর বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে সাহস পেলেন না। নিঃশব্দেই কেউ কেউ ক্রোধে করে কর পেষণ করলেন, কেউ কেউ ওষ্ঠ দংশন করতে লাগলেন, কেউ কেউ ভীষণ ক্রোধে ক্ষিপ্ত বোধ করলেন, কেউ বা উদাস ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন, অনেকে আবার এটা কৃষ্ণেরই অলৌকিক লীলা ভেবে কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি অনুভব করলেন। অতঃপর বাসুদেব সম্পূর্ণ নির্ভয় হয়ে শঙ্খচক্ৰগদা হস্তে আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত ঐ যজ্ঞ রক্ষা করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *