মহাভারতের মহারণ্যে – ২.৮
অতঃপর বনবাসপর্ব শেষ করে তারা উদ্যোগপর্বে এসে পৌঁছলে গৃহবিবাদের পুনরায় সূত্রপাত হলো। সেই সময়েই বিরাট রাজার কন্যা উত্তরার সঙ্গে অভিমনু্যর বিবাহক্রিয়া সাঙ্গ হয়। বিরাট রাজার গৃহেই মন্ত্রণাসভা বসলো, এখন কী ভাবে দুর্যোধনের হাত থেকে পাণ্ডবদের পিতৃরাজ্য উদ্ধার করা যায় মন্ত্রণার বিষয় সেটাই।
দ্রুপদ বললেন, ‘দুৰ্যোধন সহজে রাজ্য ফিরিয়ে দেবে না। আমাদের এখন প্রয়োজন ধর্মসম্মত যুক্তির দ্বারা ধৃতরাষ্ট্রকে স্ববশে আনা। অতএব তিনি তাঁর পুরোহিতকে দূত হিশাবে পাঠিয়ে দিলেন। বলে দিলেন, ‘পাণ্ডবদের হিত নিমিত্ত আপনি পুষ্যানক্ষত্রের যোগে জয়সূচক শুভ মুহূর্তে যাত্রা করুন।‘ পুরোহিতকে গোপনে পরামর্শ দিলেন, ‘আপনি সেখানে উপস্থিত হয়ে ধর্মবাক্যে ধৃতরাষ্ট্রকে প্রসন্ন করে, তাঁদের যোদ্ধৃবর্গদের গতি পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। এদিকে বিদুর সেইসব বাক্য শ্রবণ করে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য প্রভৃতির পরস্পরের মতভেদ উপস্থিত করবেন। অমাত্যবর্গের মধ্যে অন্তর্ভেদ সৃষ্টি হলে ও সৈনিকরা বিমুখ হলে তাদের একতা সম্পাদনের জন্য কৌরবগণকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। সেই সময়টুকুর মধ্যে পাণ্ডবেরা একাগ্রচিত্তে সৈন্যসংগ্রহ প্রভৃতি সাংগ্রামিক কাৰ্যসকলের আয়োজন করতে পারবেন। আত্মভেদ হলেই আপনি সে বিষয়ের পোষকতা করবেন। তা হলে বিপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়বে, আর ওরা সেনা সংগ্রহ করতে পারবে না। এখন আপনি যত্বপূর্বক আমাদের এই উদ্দেশ্য সাধন করুন।‘
বলরাম বললেন, “যুধিষ্ঠির দৃতিপ্রিয়, কিন্তু অজ্ঞ। সুহৃদগণের নিষেধ না শুনে দৃতিনিপুণ শকুনিকে আহবান করেছিলেন। অন্যান্য নৃপতিদের সঙ্গেও তিনি খেলতে পারতেন, হারাতেও পারতেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে না খেলে ঐ শকুনির সঙ্গেই তিনি খেলতে গেলেন, এবং প্রমত্ত হয়ে রাজ্য হারালেন। শকুনি নিজের শক্তিতেই যুধিষ্ঠিরকে পরাস্ত করেছেন। তাতে শকুনির কোনো দোষ হয়নি। যদি আপনারা শান্তি চান, তবে মিষ্ট বাক্যেই দুর্যোধনকে প্রসন্ন করুন। সামনীতিতে যা পাওয়া যায় তাই অর্থকর, যুদ্ধ অন্যায় ও অনিষ্টকর।’
কথাটা কারোই পছন্দ হলো না। যুধিষ্ঠির দ্রুপদ প্রভৃতি সংগোপনে যুদ্ধের আয়োজন করতে লাগলেন এবং নানা দেশের রাজাদের নিকট দূত পাঠালেন। আমন্ত্রণ পেয়ে রাজারা আসতেও লাগলেন।
সাত্যকি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘দুর্যোধন ছল করে যুধিষ্ঠিরের রাজ্য হরণ করেছেন। শকুনি কপট পাশায় যুধিষ্ঠিরকে হারিয়েছেন। আপনারা দুর্যোধনকে বলুন, দুর্যোধন যে ভরসায় যুদ্ধ করতে চান তা মিথ্যা। পাণ্ডবরাই অধিক বলশালী।‘
বলরাম বললেন, ‘যুধিষ্ঠির সমধিক সম্পদশালী ছিলেন, কিন্তু দ্যূতে প্রমত্ত হয়েই তাঁর সমস্ত রাজ্য পরহস্তগত হয়েছে, তাতে শকুনির কিছুমাত্র অপরাধ নেই। অতএব কোনো বাগ্মীপুরুষ ধৃতরাষ্ট্র সমীপে উপস্থিত হয়ে, প্ৰণিপাতপূর্বক সন্ধিবিষয়ক প্রস্তাবই করুন।‘
সাত্যকি বলরামকে দোষারোপ করে বলতে লাগলেন, ‘এক বংশে ক্লীব ও শূর দুই প্রকার পুরুষই জন্মগ্রহণ করে। যেমন তুমি, তেমনই তোমার বাক্য। অক্ষবিশারদগণ এই দূতানভিজ্ঞ মহাত্মাকে দূতে আহবান করলেন কেন? তা না হলে তো তিনি পরাজিত হতেন না? এখন তোমরা সতর্ক হলে মহারাজ যুধিষ্ঠির দীর্ঘকালের আশাপোষিত (আশাপোষিত শব্দটা লক্ষ করুন) ধৃতরাষ্ট্রবিসৃষ্ট রাজ্য গ্রহণ করতে পারবেন।‘
দুৰ্যোধন যা ভেবেছেন সেটা যে কতোখানি সত্য এই বাক্যই তাঁর প্রমাণ। তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্যই এই যুদ্ধের প্রয়োজন ছিলো যুধিষ্ঠিরের দ্রুপদ বলরামের দিকে তাকিয়ে আপোসের গলায় বললেন, “মহারাজ! আপনি যা বললেন, তাই হবে।’
আসলে বলরামের নির্মল হৃদয়ে কখনো কোনো মিথ্যার কলঙ্ক নেই। যে বিষয়ে তাঁর ভ্রাতা বাসুদেব অতি সুযোগ্য। ন্যায় অন্যায় দুটি শব্দকেই বলরাম কষ্টিপাথরে ঘষে যাচাই করে দেখেন। অন্যায়ের সঙ্গে আপোসে তিনি যতোটা অক্ষম, ততোটাই সক্ষম যা সত্য তাঁর মর্যাদা দিতে অকারণ অসূয়া বিদ্বেষ স্বাৰ্থ বা কৌটিল্য তাঁর চরিত্রের বিপরীত। শকুনি যে কপট পাশায় হারাননি তাঁর সাক্ষী ছিলেন অন্যান্য নৃপতিরা এবং ভীষ্ম। স্বয়ং যুধিষ্ঠিরও সেখানে এই মিথ্যেটা বলতে পারেননি যে শকুনি তাঁকে কপট পাশায় হারিয়েছেন। সভার সকল সদস্যই দেখেছেন এই খেলায় শকুনির প্রতিভা কী উর্ধ্বগতি। একমাত্র বিদুর তাঁর প্রতিকুল। তিনিই শ্রবণ থেকে শ্রবণান্তরে গুজব ছড়িয়ে দিলেন, যুধিষ্ঠিরকে কপট পাশায় হারিয়েছেন মাতুল শকুনি।
আজও পর্যন্ত সেই মিথ্যেই অকাট্য সত্য হিশাবে প্রচলিত। পাশাখেলায় সৌবল প্রকৃতই যে একজন অদ্বিতীয় ব্যক্তি, এবং যুধিষ্ঠির যে তাঁর মতো একজন খেলোয়াড়ের নিকট একটা ফুৎকারও নয়, এ কথা যুধিষ্ঠিরের তো প্রথম খেলাতেই বুঝতে পারা উচিত ছিলো। তখুনি তিনি শেষ করে দিতে পারতেন খেলা। অন্য কারো সঙ্গে খেলতে পারতেন। তাঁর সমকক্ষ খেলোয়াড়ের অভাব ছিলো না সেখানে। কিন্তু সর্ব বিষয়ে অক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে একটা মাত্রহীন জেদ থাকে, কিছুতেই হার স্বীকার করতে পারে না। আত্মসম্মান রক্ষার্থে সেই জেদই চালিত করেছিলো যুধিষ্ঠিরকে। সর্বত্র হেরে যেতে কার বাসনা থাকে? তদ্ব্যতীত, রাজসূয় যজ্ঞ করে এতো অঢেল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন যে মনে করেছিলেন তাঁর সঙ্গে এঁরা পাল্লা দিতে পারবেন না, এবং তিনি খেলতে খেলতে একবার জয়ী হতেই পারবেন। তখন এঁরা তাঁর অর্থের প্রাচুর্য দেখে নিজেদের অনেক দীন বলে ভাববে আর যথেষ্ট অপমানিত হবে। সে ইচ্ছে তিনি শেষ পর্যন্তও ছাড়তে পারেননি। এই অসৎ ইচ্ছাই তাঁকে সেই নরকে নিয়ে গেছে, যেখান নিঃস্ব হয়েছেন।
যুদ্ধের আলোচনা সবই একপক্ষে চলছিলো। অভিমনু্য-উত্তরার বিবাহে সব মহানুভব ব্যক্তিরা অতিথি হিশাবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সুতরাং ঐ পক্ষ কী করছে সেটা না জেনেই এই আলোচনা চলছিলো। কৃষ্ণ অন্যান্য আমন্ত্রিত রাজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, পরাজিত হলে হৃতরাজ্য ও বনবাসের জন্য সেবল শঠতাপূর্বক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। এখন কৌরব ও পাণ্ডবগণের পক্ষে যা মঙ্গল তাই আপনারা চিন্তা করুন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অধৰ্মগতভাবে সুরসাম্রাজ্যও কামনা করেন না। যদিও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা বলবীর্যে এদের পরাজিত করতে অসমর্থ হয়েই শঠতাপূর্বক পৈতৃকরাজ্য অপহরণ করে এদের এতোদিন দুঃখে দগ্ধ করেছে। কৃষ্ণ সব কিছু জেনেই এই অসত্য কথাগুলো বললেন।
স্বভাব দোষে অনর্থক অসূয়া বিভিন্ন পিতার পাঁচটি সন্তানের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। শৈশব তাদের কোথায় কীভাবে কেটেছে তা আমরা কেউ জানি না। কী তাদের বোঝানো হয়েছে তাও অজানা। কিন্তু কৃষ্ণ কেন দুৰ্যোধনের বৈবাহিক হয়েও তাঁর ঘোর শক্র সেটা বোঝা দুরূহ।
মহাভারত নামের বৃহৎ পুস্তকখানিতে আমরা কৃষ্ণকে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভাতেই প্রথম দেখতে পেলাম। দুৰ্যোধনের সঙ্গে তাঁর কোনো শক্রতাঁর সংবাদও আগোচর ছিলো। দুর্যোধন তাঁর বৈবাহিক। তাঁর পুত্র দুর্যোধনের কন্যাকে বিবাহ করেছে। সুতরাং একজন বিশেষ আতীয় তাঁকে এই ধরনের অপমান করার মধ্যে যে অশিষ্টতা এবং অভদ্রতা লক্ষ করা যায় তা উন্নতমনস্ক সজ্জনের শোভা পায় না।
কৃষ্ণ তখন প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন, দুর্যোধনের বয়সও কিছু থেমে নেই, একজন বিশিষ্ট রাজাও বটে। তাঁর সঙ্গে কৃষ্ণের যদি বা কোনো কারণে কোনো শক্রতাও থাকে, তথাপি এই ব্যবহার তাঁকে মানায় না। তবে কি যাদববংশের এই নেতা কৌলিন্যের অভাবেই বোঝেন না যে ব্যক্তিবিশেষ বলে একটা শব্দ আছে অভিধানে! একথাটা অবশ্যই জানা উচিত, একজন আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো অপমান ভুলবেন না, ভুলতে পারবেন না। ব্যাসদেব এমনভাবে ঘটনাটা সাজালেন যেন দুৰ্যোধন ঈৰ্ষাপরায়ণ হয়েই এই কৌশলে নিতান্ত অকারণে সরল সাধু যুধিষ্ঠিরকে এই অন্ধকারে ঠেলে দিলেন। যেমন একবার ভীমকে বিষ খাইয়ে জলে ফেলে দিয়েছিলেন বলে রটানো হয়েছিলো, এই ঘটনাটাও তাঁরই আর এক চেহারা। পিছনে কোনো কারণ নেই, যা আছে তা যুধিষ্ঠিরের দুৰ্যোধনের প্রতি নির্ভেজাল এক নারকীয় ঈর্ষা।
বলরামের বাক্য কারো কর্ণেই সুধাবর্ষণ করলো না, শুধু তিক্ততা ছড়ালো। অতএব সত্যটা কখন মুছে গিয়ে মিথ্যাটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
কৃষ্ণ উপস্থিত রাজনবর্গকে বললেন, “যদি কৌরবগণ এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, তবে এঁরা আহত হওয়ামাত্রই ওদের নিহত করবেন।’ আরো বললেন, “যদি আপনারা মনে করেন পাণ্ডবগণ সংখ্যায় অল্প বলে ওদের পরাজিত করতে অক্ষম হবেন, তা হলে সকল সুহৃদ একসঙ্গে হয়ে তাদের সংহার করতে যত্নশীল হবেন। এই পরামর্শে এটা অতি স্বচ্ছ যে কৃষ্ণ যুদ্ধটাই চাইছেন। কৌরব বংশ ধ্বংস করতে কৃষ্ণ এবং বিদুর একই রকম উগ্র ইচ্ছার অধীন। যুধিষ্ঠির তো বটেই।
এদিকে পাণ্ডবগণ সৈন্য সংগ্রহ করেছেন জেনে দুর্যোধনও সৈন্য সংগ্রহে একাগ্র হলেন। দুৰ্যোধনের আহবানে প্রচুর সৈন্য সংগৃহীত হলো। নানাবিধ ধ্বজা পতাকাশালী সৈন্যগণের সমাবেশে হস্তিনানগর পরিপূর্ণ হয়েও ছাপিয়ে গেলো। তাদের সব বিভিন্ন স্থানে সংস্থাপিত করলেন দুর্যোধন। পাঞ্চালপতি প্রেরিত সেই পুরোহিত সৈন্যর প্রাচুর্য দেখে স্তম্ভিত হলেন।
পুরোহিত কৌরবদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং দ্রুপদরাজার শিক্ষামতো যা যা বক্তব্য সবই ব্যক্ত করলেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ইত্যাদি তাঁকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণও করলেন এবং তাদের দিক থেকেও সঞ্জয়কে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘দুর্যোধন আমাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে যদি ইন্দ্রপ্রস্থ প্রদান করেন, তা হলে আমি শান্তিপক্ষ অবলম্বন করবো। প্রদীপ্ত অগ্নি যেমন ঘৃত পেয়ে তৃপ্ত হয় না, সে রকম বিপুলভোগ্যে বিষয় পেয়েও ধৃতরাষ্ট্র তৃপ্ত হননি। এখন সংকটে পড়ে পরের উপর নির্ভর করছেন। এতে তাঁর মঙ্গল হবে না। এখন তিনি তাঁর দুৰ্বদ্ধি ক্রুর স্বভাব কুমন্ত্রীবেষ্টিত পুত্রের জন্য বিলাপ করছেন কেন? বিদুরের উপদেশ অগ্রাহ্য করে অধর্মের পথে চলেছিলেন কেন?
সঞ্জয়ের বিনীত নিবেদনের উত্তরে এই জবাব নিতান্তই নির্লজ্জ জবাব। রাজা হতে চাইলেও রাজার আচরণ তিনি জানেন না। তদ্ব্যতীত, ধৃতরাষ্ট্রকে যদি নিজের পিতৃব্য বলে বিবেচনা করতেন, তা হলে এভাবে তাঁর বিষয়ে কথা বলতেন না। জন্মাবধি তিনি যদি পাণ্ডুর নিকটই বড়ো হয়ে উঠতেন, তা হলেও এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হতেন না। কথা বলতে জানাটাও যে একটা শিক্ষা, কথাবাতাঁর মধ্যেও যে মানুষ তাঁর সংস্কৃতির ও আভিজাত্যের প্রমাণ দেয়, তাহলে সেটুকু রাজকীয় জ্ঞান অন্তত জানা থাকতো তাঁর। যে ব্যক্তি জুয়ার নেশায় পত্নীকে পর্যন্ত বিক্রয় করেন, আমরা তেমন ব্যক্তিকে কোনোভাবেই সম্মানিত ব্যক্তি বলে গ্রহণ করতে পারি না। যুধিষ্ঠিরের সামান্য অপরাধবোধ থাকলেও তিনি এভাবে কথা বলতেন না। বিদুরের পুত্র বিদুরই হয়েছেন, রাজবাড়ির প্রলেপ পড়েনি সেখানে। তিনি জানেন, শান্তনুর সিংহাসনের অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত, কুরুদের অধীনস্থ না করা পর্যন্ত, শক্ৰতা স্তব্ধ হবে না। আর অন্য কিছুতেই তাঁর তুষ্টি নেই। ভীষ্মের রাজপুত্র বানাবার শিক্ষাও এখানে একান্তভাবেই ব্যর্থ হয়েছে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে যাঁর কিছুই স্বোপার্জিত নয়—সিংহাসন তো নয়ই, এমন কি পত্নীটিও নয়—ভোগের লালসা তাঁর মধ্যে সর্বাধিক। অর্ধরাজ্য পেয়ে তিনি তুষ্ট ছিলেন না, সমস্ত রাজ্যের আকাঙ্খা নিয়েই শকুনির সঙ্গে খেলেছিলেন। সমস্ত রাজ্যের অধিকার পাবার জন্যই বিদুর তাঁকে হাতে ধরে যে রাস্তায় পা ফেলতে বলেছেন সে রাস্তাতেই তিনি পা ফেলেছেন। তারপর পিতামহর হাত ধরে গিয়েছেন দ্রুপদরাজার কন্যার স্বয়ংবর সভায়। কনিষ্ঠ ভ্রাতার উপার্জিত পত্নীটিকে পর্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্র কী করেননি তাঁর জন্য? সাদরে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন, সন্তুষ্ট চিত্তেই রাজত্বের অর্ধাংশ দিয়েছেন সুখে থাকার জন্য।
সঞ্জয় বললেন, ‘আপনি উদ্বেগহীন হয়ে নিজে সরে যান। স্বর্গের পথ থেকে ভ্ৰষ্ট হবেন না।’
কৃষ্ণ বললেন, দস্যু বধ করলে পুণ্য হয়। অধৰ্মজ্ঞ কৌরবগণ দসু্যবৃত্তিই অবলম্বন করেছে।’
কৃষ্ণ হঠাৎ এই নতুন চেনা পাঁচটি ভ্রাতার সঙ্গে বন্ধুতা করে কেন এই বিবাদটা আরো পাকিয়ে তুলছেন তাঁর কোনো কারণ এই মহাগ্রন্থে লেখা নেই। দস্যুবৃত্তি কৌরবরা করেননি, যা করেছেন পাণ্ডবরাই করেছেন। গ্রন্থটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অবিশ্রান্ত দুর্ব্যবহার করাটাই ছিলো দুৰ্যোধনের সঙ্গে তাদের একমাত্র সম্পর্ক। কোনো না কোনো ছলে তাঁকে অপদস্থ করা আর হারিয়ে দেওয়া। দুর্যোধন মধ্যস্থ না থাকলে অন্ধ রাজটিকে রাজ্যচ্যুত করে কর্মচারী বানানোর কোনো অসুবিধে ছিলো না, এটাই কি তবে এই শক্রতাঁর মূল কারণ? কিন্তু কৃষ্ণ কেন তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়লেন, বাস্তববুদ্ধিতে তাঁর ব্যাখ্যা মেলে না।
প্রথম দিকে অনেক তেজ দেখিয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর রাজত্ব ফিরে চাইছিলেন, শেষের দিকে ভ্রাতাদের নিশ্চুপ দেখে কিছুটা ভীত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, রাজ্যের একটি প্রদেশ আমাদের দিক, নতুন আমাদের পাঁচটি ভ্রাতাকে পাঁচটি গ্রাম দিক।‘
সঞ্জয় ফিরে এসে যা বললেন তা শুনে ভীষ্ম বললেন, ‘বৎস দুর্যোধন! ধর্ম ও অর্থ থেকে তোমার বুদ্ধি চ্যুত হয়েছে। তুমি যদি আমার কথা অগ্রাহ্য করো, তাহলে বহু লোকের মৃত্যু হবে।’
দ্রোণও তাই বললেন, কিন্তু দুর্যোধন চুপ করে রইলেন। সবাই যখন ধৃতরাষ্ট্রকে পাণ্ডবদের শক্তির কথা বলে ভয় দেখাতে লাগলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে দুর্যোধন বললেন, ‘মহারাজা ভয় পাবেন না। পাণ্ডবরা বনে গেলে কৃষ্ণ, কেকয়গণ, ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও বহু রাজা সসৈন্যে ইন্দ্রপ্রস্থের নিকটে এসে আমাদের নিন্দা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, পাণ্ডবদের উচিত কৌরবদের উচ্ছেদ করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করা। গুপ্তচরদের মুখে এই সংবাদ পেয়ে আমার ধারণা হয়েছিলো পাণ্ডবরা তাদের বনবাসের প্রতিজ্ঞা পালন করবেন না। যুদ্ধে আমাদের পরাস্ত করবেন। সেই সময়ে পূর্বাপর না জেনে আমাদের মিত্র ও প্রজারা সকলেই ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের ধিক্কার দিচ্ছিলো। তখন আমি ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও অশ্বথামাকে বললাম, “পিতা আমার জন্য দুঃখবোধ করছেন।” অতএব সন্ধি করাই ভালো। তাতে ভীষ্ম দ্রোণাদি আমাকে আশ্বাস দিলেন, “ভয় পেয়ো না, যুদ্ধে কেউ আমাদের জয় করতে পারবে না।” মহারাজ অসীমতেজ ভীষ্মদ্রোণাদির তখন এই ধারণা দৃঢ় ছিলো। এখন পাণ্ডবগণ পূর্বাপেক্ষা বলহীন হয়েছে। সমস্ত পৃথিবী আমাদের বশে এসেছে। যে রাজারা আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন, তারা শোকদুঃখে আমাদেরই অংশভাগী হবেন। অতএব আপনি ভয় দূর করুন। আমাদের সৈন্য সমাবেশে যুধিষ্ঠির ভীত হয়েছেন। তাই তিনি কেবল পাঁচটি গ্রাম চেয়েছেন। তাঁর রাজধানী চাননি। যুদ্ধজয়ের বল সম্বন্ধে যা মনে করেন তা মিথ্যা। আমি যখন বলরামের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করতাম, তখন সকলে বলতো, সম্মুখ যুদ্ধে আমার সমান পৃথিবীতে কেউ নেই। আমি এক আঘাতেই ভীমকে যমালয়ে পাঠাবো। ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বথামা কৃপ কৰ্ণ ভূরিশ্রবা শল্য ভগদত্ত ও জয়দ্ৰথ এদের যে কেউ পাণ্ডবদের বধ করতে পারেন। এঁরা সম্মিলিত হলে ক্ষণমাত্রেই তাদের যমালয়ে পাঠাবেন। কর্ণ ইন্দ্রর কাছ থেকে অমোঘ শক্তি অস্ত্র পেয়েছেন। সেই অস্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধে অৰ্জুন কী করে বাঁচবেন? মহারাজ! বিপক্ষের বল আমাদের তুলনায় সবরকমেই হীন। আমি জীবন, রাজ্য ও সমস্ত ধন ত্যাগ করবো, কিন্তু কোনো কিছুর বিনিময়েই পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করবো না।‘
দুৰ্যোধন জানিয়ে দিলেন পাঁচটি গ্রাম তো দূরের কথা, তীক্ষ্ম সূচের অগ্রভাগ দিয়ে যতোটুকু ভূমি বিদ্ধ করা যায় তা-ও তিনি পাণ্ডবদের ছেড়ে দেবেন না।
ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘দেবগণ পাণ্ডবদের পিতা, তাঁরা পুত্রদের সাহায্য করবেন। দেবগণের সঙ্গে মিলিত হলে পাণ্ডবদের বিপরীত পক্ষে কেউ দৃষ্টিপাত করতেও ভয় পাবে।‘
দুৰ্যোধন বললেন, ‘তাই যদি হতো, তবে তাদের এতোদিন কষ্ট ভোগ করতে হতো না। দেবতারা আমার উপর বিক্রম প্রকাশ করবেন না, কারণ আমারও যথেষ্ট তেজ আছে। আমি মন্ত্রবলে অগ্নি নির্বাপিত করতে পারি, ভূমি বা পর্বতশিখর বিদীর্ণ হলে পুনরায় স্থাপিত করতে পারি, শিলাবৃষ্টি ও প্রবল বায়ু নিবারণ করতে পারি, জল স্তম্ভিত করে তাঁর উপর দিয়ে রথ ও পদাতিক নিয়ে যেতে পারি। আমি যা বলি তা সর্বদাই সত্য হয়। সেজন্যই লোকে আমাকে সত্যবাক্ বলে।’
কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে এলেন। কৃষ্ণ আসছেন শুনেই ধৃতরাষ্ট্র হৃষ্ট হয়ে তাঁর উপযুক্ত সম্বর্ধনার জন্য পুত্রকে আদেশ দিলেন। দুর্যোধন নানা স্থানে সুসজ্জিত পরিমণ্ডল নির্মাণ করে খাদ্য পেয় ইত্যাদির বন্দোবস্ত করলেন। বিদুর ইতিমধ্যে পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁর পুত্রের বিরূদ্ধে এবং পাণ্ডবদের সপক্ষে অনেক কথা বলে একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন।
কৃষ্ণ এসে তাঁর বৈবাহিক এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কোনো আদর আপ্যায়ন গ্রহণ না করে প্রথমেই বিদুরের কাছে গেলেন। আর বিদুরের কাছে যাওয়া মানেই কুন্তীর কাছে যাওয়া। কৃষ্ণ আসছেন জেনে দুর্যোধন যতো আয়োজন করেছিলেন তাঁর আসল উদ্দেশ্যটা খুব ভালো ছিলো না। তিনি তাঁকে বন্দী করতে চেয়েছিলেন। আবার এদিকে কৃষ্ণও যে এসেছিলেন সন্ধির নামে, তাও সন্ধির চেহারায় কর্ণকে দলে টেনে নেবার চেষ্টায়। বৈবাহিকের ভোজ্য পেয় গ্রহণ না করলেও সভাস্থ সকলের সঙ্গে দেখা করতে এসে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে একেবারে মুহ্যমান করে দিলেন সবাইকে।
দুৰ্যোধন এসব প্রদর্শনে বিচলিত হতেন না। বরং পাণ্ডব শিবিরে উলূককে পাঠাবার সময়ে বলে দিলেন, ‘কৃষ্ণকে আমার হয়ে বলবে, তোমার ইন্দ্রজাল দেখলে অস্ত্রধারী বীর ভয় পায় না, সিংহনাদ করে। আমরাও বহুপ্রকার যাদুবিদ্যা দেখাতে পারি, কিন্তু সেই উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না। রাজাদের পক্ষে সেটা লজ্জা। ছিলে তো কংসের ভূত্য, সেজন্য আমার মতো রাজা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ পর্যন্ত করে না।’
মহাভারতে এই ধরনের বিশ্বরূপ আরো দুজন দেখাতে পারতেন বলে উল্লেখ আছে। এ কথা তো একান্তই সত্য যে পাণ্ডবদের যতো ক্লেশ, যতো গ্লানি সবই যুধিষ্ঠিরের জন্য। রাজ্যলিন্সাও যুধিষ্ঠিরেরই প্রবল। যুধিষ্ঠিরই রাজা হয়েছেন, যুধিষ্ঠিরই রাজসূয় যজ্ঞের অধিকারী হয়েছেন, সেই সাধ মেটাতে অতি নিকৃষ্ট পদ্ধতিতে জরাসন্ধ বধ করেছেন, শিশুপালের মস্তক চূর্ণ করেছেন, অবশ্য সবই ভ্রাতাদের হাত দিয়ে। দেশদেশান্তরে ঘুরে ক্লান্তবিধ্বস্ত হয়ে ভ্রাতারাই কতো রাজ্য জয় করে কতো রাজাকে যুধিষ্টিরের পদতলে এনে ফেলেছেন, সীমাহীন ধনরত্বের অধীশ্বর করেছেন। তারপর তিনি কী করলেন? জুয়া খেলে সবাইকে ডোবালেন। এখনো যে যুদ্ধের জন্য এতো আস্ফালন করছেন, তা-ও তাঁর নিজের ক্ষমতায় নয়। এখন তো আবার চতুর কৃষ্ণ এসে সঙ্গে জুটেছেন।
দুৰ্যোধন পাণ্ডবপক্ষের সকলেরই শত্রু। এমন কোনো অপযশ নেই যা তাঁর কপালে জোটেনি বিদুরের দয়ায় এবং সেই বিদ্বেষ পরিজনদের মধ্যে ভালোভাবেই সংক্রামিত হয়েছে। অতএব দুর্নামের আর ভয় নেই দুর্যোধনের। পাণ্ডবদেরও যেমন সুনামের ক্ষয় নেই।
দুৰ্যোধন এটা ঠিকই বুঝেছেন যে পাঁচটা গ্রাম কেন ইন্দ্রপ্রস্থ দিয়ে দিলেও বিদুর এবং যুধিষ্ঠির যে ক্ষান্ত হবেন তা নয়। মাত্র ঐ অর্ধেক রাজত্বের জন্য তারা পর্বতশিখর থেকে নামেননি। প্রয়াত শান্তনুর সিংহাসনে বসে সম্পূর্ণ হস্তিনাপুরের অধীশ্বর হবার বাসনাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। বনবাসে যাবার সময়ও তারা এই প্রতিজ্ঞা করেই গিয়েছিলেন, যুদ্ধে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করবেন, দুঃশাসনের রক্তপান করবেন। যখন জতুগৃহে আগুন লাগিয়ে বিদুরের পাঠানো যন্ত্রযুক্ত নৌকায় উঠলেন, তখনও চালক বলেছিলো, বিদুর আপনাদের আলিঙ্গন জানিয়ে বলেছেন, আপনারা দুর্যোধন কর্ণ এবং শকুনিকে যুদ্ধে জয় করবেন। অবস্থাবৈগুণ্যে সে ইচ্ছা তাদের অবদমিত হয়ে থাকলেও সুযোগ পাওয়ামাত্রই সেটা তারা কার্যকর করবেন, সে বিষয়ে দুর্যোধনের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সুতরাং অর্জিত সম্পত্তি প্রত্যৰ্পণ করে নিজেকে বলহীন করা আর তাদের বলবান করার মতো মূর্খতা আর কী হতে পারে? ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধে পরাজুখ হলে চলে না।
কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনে মুগ্ধ ভীষ্ম ও দ্রোণ বললেন, ‘দুৰ্যোধন যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করো, তিনি তাঁর সুলক্ষণ দক্ষিণ বাহু তোমার স্কন্ধে রাখুন, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিন, (হে ঈশ্বর! কতো অলীক কল্পনাই না এঁরা করতে পারেন) ভীম তোমাকে আলিঙ্গন করুন (সর্বনাশ!)।‘
এসবের কী জবাব দেবেন দুৰ্যোধন মনে মনে বিদুরকে বাহবা দেন, কী করে এই সব সরল ধর্মজ্ঞ বৃদ্ধদের তাঁর কূটনীতির বুদ্ধি দিয়ে বশ করে ফেলেছেন। তাঁরা তো তাঁর ভালোর জন্যই বলছেন। ভাবছেন, এভাবেই তাদের সৌভ্রাত্র পুনরায় স্থাপিত হবে। প্রথমত, আদৌ তারা ভ্রাতা নয়; তদ্ব্যতীত, সেই ভ্রাতৃত্বের জন্মই তো হয়নি কখনো বিদুর ব্যতীত আর কারোকেই পাণ্ডবরা চেনেন না। জানেন না। মানেন না।
এদিকে হস্তিনাপুর থেকে সকলের বিদায় নিয়ে প্রত্যাবর্তিত হবার জন্য কৃষ্ণ যখন তাঁর রথে আরোহণ করলেন, তখন কর্ণকেও সঙ্গে নিলেন। আসল উদ্দেশ্য কৃষ্ণের এটাই ছিলো, যুদ্ধে কর্ণকে পাণ্ডবদের সঙ্গী হতে বলা। সন্ধির প্রস্তাবটা একটা ছলনামাত্র। এরকম যোদ্ধাকে সঙ্গে পেলে পাণ্ডবদের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
রথে তুলে বললেন, ‘কুমারী কন্যার গর্ভে পুত্র হলে তাঁকে কানীনপুত্র বলে। কর্ণ, তুমি কানীনপুত্র। রাধেয়, তুমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করেছো, ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্বসকল শিখেছো। তুমি ধর্মানুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব তুমি রাজা হও তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ, দুই পক্ষকেই তোমার সহায় বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চলো, পাণ্ডবরা জানুন যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচত্রাতা এবং দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র এবং অভিমনু তোমার চরণধারণ করবেন, দ্রৌপদীও ষষ্ঠকালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে অভিষিক্ত করবো। কুন্তীপুত্র, তুমি ভ্রাতৃগণে বেষ্টিত হয়ে রাজ্যশাসন করো, পাণ্ডবভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ্য হোক।’
মৃদু হেসে কর্ণ বললেন, ‘ধর্মশাস্ত্র অনুসারে আমি পাণ্ডুরই পুত্র, সে কথা আমি জানি। কুন্তী আমাকে গর্ভে ধারণ করেন এবং হিত চিন্তা না করে ত্যাগ করেন। অধিরথ আমাকে তাঁর গৃহে আনেন, তাঁর পত্নী রাধার স্নেহবশে স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হয়েছিলো। আমি কী করে তাঁর পিণ্ডলোপ করতে পারি? পত্নীদের সঙ্গে আমার প্রেমের বন্ধন আছে। গোবিন্দ! সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সুবর্ণ পেলেও আমি সেই সম্বন্ধ কখনো অস্বীকার করতে পারি না। তদ্ব্যতীত, আমি ত্রয়োদশ বৎসর দুর্যোধনের আশ্রয়ে নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগ করেছি, সূতগণের সঙ্গে আমি বহু যজ্ঞ করেছি, তাদের সঙ্গে সম্বন্ধও আমার গভীর। আর সর্বোপরি, দুৰ্যোধন আমার ভরসাতেই যুদ্ধের উদযোগ করেছেন। দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিযোদ্ধারূপেই আমাকে বরণ করেছেন। কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি তাঁর সঙ্গে মিথ্যাচার করতে পারি না। কেশব সারা বিশ্বে পুণ্যতম স্থান কুরুক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়মণ্ডল যেন অস্ত্রযুদ্ধে নিহত হন। সমস্ত ক্ষত্ৰিয়ই যেন স্বৰ্গলাভ করেন।‘
কৃষ্ণ একটু হাসলেন, ‘তাহলে তুমি পৃথিবীর রাজ্য চাও না?’
কর্ণও মৃদুহাস্যে বললেন, ‘সব জেনেও আমাকে কেন ভোলাচ্ছো। পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, আমরা তাঁর নিমিত্তমাত্র। আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, তুমি এক রক্তাক্ত পৃথিবীকে হাতে ধরে নিক্ষেপ করছে আর অগ্নিস্তুপের উপর উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির স্বর্ণপাত্রে ঘৃতপায়েস ভক্ষণ করছেন, আর তোমার পৃথিবী তা গ্রহণ করছে।‘
কৃষ্ণ বললেন, ‘তা হলে তুমি এই পৃথিবীর বিনাশই চাও?’
কৰ্ণ কৃষ্ণকে গাঢ় আলিঙ্গন করে বললেন, ‘হয়তো স্বর্গেই পুনরায় আমাদের মিলন হবে।’ এই বলে নেমে গেলেন রথ থেকে।
কৃষ্ণ বিফল হয়ে ফিরে গেলে কুন্তী ভাবলেন, কর্ণ তো আমারই পুত্র। আমি কিছু বললে কি সে শুনবে না? সকলের মতো আমিও জানি আমার পুত্র দয়ালু, সত্যনিষ্ঠ। এই রকম ভেবে কুন্তীও কর্ণর নিকটে গেলেন। কর্ণ কুন্তীকে দেখতে পেয়ে সবিস্ময়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, “আমি অধিরথ ও রাধার পুত্র কর্ণ। আজ্ঞা করুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি।’
কর্ণর বাক্য শুনে কুন্তী বললেন, ‘কৰ্ণ, তুমি কৌন্তেয়। রাধার গর্ভে তোমার জন্ম হয়নি, অধিরথও তোমার পিতা নন, তপনদেব তোমার জন্মদাতা। তুমি সর্বগুণসম্পন্ন, আমার পুত্রদের সর্বজ্যেষ্ঠ—‘
কৰ্ণ বললেন, ‘ক্ষত্রিয়জননী, আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই। আপনার অনুরোধও আমি ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। তাতে আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট করেছেন। জন্মে ক্ষত্রিয় হলেও আপনার জন্য আমি ক্ষত্রিয়োচিত সম্মান পাইনি। এরচেয়ে অধিক অপরাধ কোনো শত্রুও করতে পারে না। যথাকালে আমার প্রতি আপনার কিঞ্চিৎমাত্র দয়াও ছিলো না। এখন এসেছেন কেবল আপনার নিজের হিতের জন্য। আমার জন্য নয়। কিন্তু আপনার আগমন আমি ব্যর্থ করবো না, আমি অর্জুনকে নিহত করে অভীষ্ট ফল লাভ করবো, অথবা তাঁর হাতে নিহত হয়ে যশোলাভ করবো। যেই মরুক, অর্জুন অথবা আমাকে নিয়ে আপনার পাঁচপুত্ৰই জীবিত থাকবে।‘
স্বার্থপর কুন্তী বললেন, ‘এই কথা কিন্তু মনে রেখো।’ বলতে বলতে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে সহসা স্নেহে আপ্লুত হয়ে আলিঙ্গন করলেন পুত্রকে, আশীৰ্বাদ করলেন। কর্ণ তাঁকে অভিবাদন করলেন।