বসন্ত রজনী – ৯

নয় 

যাওয়ার আগে টুলু আর একবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল তার তেতলার ঘরে। ওর চোখে দেখেছিলাম জল। যেন নববধূ প্রথম শ্বশুরবাড়ী যাচ্ছে। ওর যাওয়া ক্ষণে ক্ষণে আমাকে ওর বিয়ের দিনটির কথা স্মরণ করে দিচ্ছিল। কিন্তু তফাৎ আছে। সে দিনের সঙ্গে এ দিনের অনেক তফাৎ! 

ওর যাওয়ার পালা আরও সহজ করতে পারত। চলে যেতে পারত নিঃশব্দে। হয়তো তার জন্যে চেষ্টাও করেছে। মনে হয়, যতই চেষ্টা করেছে, সমারোহ ততই গেছে বেড়ে।

যাওয়ার সময় প্রণাম করে বলেছিল, চললাম তো মৃণালবাবু, কিন্তু বড় ভয় করছে।

সাহস দিয়ে বলেছিলাম, ভয় কি? অপরিচিত তো কিছুই নয়। 

—কি জানি। তবু জেনে যাই, আবার যদি কোনোদিন আসতেই হয়, দুয়ার খোলা পাব তো? 

বলেছিলাম, পাবে। আমার দুয়ার তোমার জন্যে সর্বকাল খোলা থাকবে। 

টুলু আর কিছু বলেনি। আবক্ষ গুণ্ঠন টেনে স্বামীর পিছু পিছু গাড়ীতে গিয়ে ওঠে। তার মনে কি হচ্ছিল ভগবান জানেন। মুখ দেখতে পাইনি। 

রাত্রে রাধা আমায় খেতে দিয়ে কত কাঁদলে। কলকাতা এসে পর্যন্ত এক মিনিট টুলুকে ছেড়ে থাকেনি। এই রাত্রে একা থাকতে হবে ভাবতেও তার ভয় হচ্ছে। টুলুর বাসা কি অনেক দূরে? রাধা বার বার প্রশ্ন করলে, সেখানে মাঝে মাঝে যাওয়া যাবে তো? যেদিন যাবে সেদিনই ফিরে আসা চলবে তো? সে কি সহরের ভেতরেই? 

আশ্বাস দিয়ে বললাম, টুলু কাছেই রইল, দূরে যায়নি। তোমার যখন ইচ্ছে হবে গিয়ে দেখা করে আসবে। বড় জোর আধ ঘণ্টার রাস্তা। 

রাধা বললে, এ বাড়ী ফাঁকা হয়ে গেল মৃণালবাবু। আমি তো হাঁপিয়ে উঠব।

বললাম, দুঃখ করে কি করবে রাধা? পরের বউতো আর ধরে রাখা যায় না। 

রাধা চুপ করে রইল। এতদিন কিছুই সে ভাবেনি, বোঝেও নি। টুলু কোনোদিন চলে যেতে পারে, বিশেষ নিজের ইচ্ছায়, এমন সম্ভাবনার কথাও তার মনে উদয় হয়নি! উদয় হয়েছে সবে কাল, কাল রাত্রে। বুঝেছেও সমস্ত। অত্যস্ত সরল, অত্যন্ত গ্রাম্য প্রকৃতির হলেও মেয়েমানুষ তো! না বুঝে পারে না! টুলুর চলে যাওয়ার হেতু সম্পূর্ণভাবে না বুঝলেও অনেকটা নিশ্চয়ই বুঝেছে। 

রাধা আমার পাতের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে বললে, আপনার আজ কিছুই খাওয়া হল না। টুলু নেই! 

আমি সস্নেহে পরিহাসে বললাম, টুলু কি আমাকে হাতে করে খাইয়ে দিত? বেশ খাওয়া হয়েছে। 

রাধা সে কথা শুনতেই চাইলে না। বললে, এখন থেকে আপনার অনেক কষ্টই হবে। 

জিগ্যেস করলাম, একথা বলছ কেন? 

বললে, টুলু নেই। আমি কি তার মতো যত্ন করতে পারব? 

হেসে বললাম, কাজ কি তার মতো যত্ন করে? তুমি তোমার মতো যত্ন কোরো, তাহলেই আমার খুব হবে। 

রাধা মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললে, তাছাড়া আর উপায় কি? দুধের সাধ ঘোলেই মেটাতে হবে। 

বললাম, যা বরাত। ঘোলই বা মেলে কই? 

রাধা আমার দিকে পেছন ফিরে কি একটা করতে করতে বললে, ভগবানকে ডাকলে ভগবান মেলে। ঘোল মিলবে না? 

উঠতে উঠতে বললাম, এবার থেকে ঘোলকেই ডাকতে আরম্ভ করলাম, দেখি মেলে কি না। 

রাধা জবাব দিলে না, আপনার মনে কাজ করতে লাগল। 

.

অনিদ্রা বুঝি বা রোগেই দাঁড়ায়! 

আহারান্তে আবার নথি নিয়ে বসলাম। ভালো লাগে না। একখানা বই নিয়ে পড়তে লাগলাম। কি যে পড়ি কিছুই বুঝি না। অক্ষরগুলো চোখে পড়ে, কিন্তু তার অর্থ মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছয় না। সেখানে স্থান নেই। নানা এলোমেলো চিন্তায় মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত। তবু পাতার পর পাতা উলটে যাই। 

রাধা ক’বারই এসে তাগাদা দিয়ে গেছে শুতে যাওয়ার জন্য। আমার জন্যে ওরও চোখে ঘুম নেই। ও তো জানে না শুতে যাওয়া আমার পক্ষে নিষ্ফল। চোখে কিছুতে ঘুম নামবে না। রাধা বললেও না। কিন্তু রাধার বার বার তাগাদায় অবশেষে বই বন্ধ করে উঠতে হল। শোবার ঘরে এসে আজকে আর নীল আলোটা জ্বাললাম না। শুধু পায়ের দিকের জানালাটা দিলাম খুলে। বাইরে আজও অফুরন্ত জ্যোৎস্না। কিন্তু জানালা দিয়ে আমার ঘরে তার এক ফোঁটাও এল না। আমি অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে বাইরের জ্যোৎস্নালোকের দিকে চেয়ে রইলাম। একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে মাঝে মাঝে চোখ জ্বালা করে ওঠে। তবু চেয়ে থাকি। কি করব? 

ঘুম যে আসে না। কিছুতেই ঘুম আসে না। 

আমার খোলা জানালার সুমুখেই একটু খোলা ছাদ। রাধাতে আর টুলুতে মিলে সেখানে টবে-টবে ফুলগাছ লাগিয়েছে। তার মিঠে গন্ধ আসছে ভেসে। হঠাৎ মনে হল ওরই একদিকের কোণে কে যেন বসে রয়েছে না, বসে নেই, ত্বরিত পদে কে যেন এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল। সুনীল আঁচল বাতাসে দুলে উঠল। 

উঠে বসলাম। ভুল দেখছি না তো? কিছু বিচিত্র নয়। মস্তিষ্কের এই রকম অবস্থায় অমন নাকি হয়। কিন্তু কার পায়ের মৃদুধ্বনি পাচ্ছি যে! 

তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই দেখি, কে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে তেতলায় উঠছে। আমিও তার পিছনে ছুটলাম। রাধার ঘরের সামনে ধরে ফেললাম। 

—রাধা! 

রাধা উত্তর দিল না। আমার বাহুবেষ্টনের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়াল। পরিপূর্ণ চাঁদের আলো পড়ছে ওর মুখে! দুটি নয়ন নিমীলিত। ওর ঘরের মধ্যে গিয়ে বসলাম। 

বললাম, অমন করে ছুটে পালিয়ে আসছিলে কেন? 

রাধা নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করলে না। ওর শরীরের গ্রন্থি যেন শিথিল হয়ে এসেছে, দেহ এলিয়ে পড়ছে। 

বললাম, কেন পালিয়ে আসছিলে? 

রাধা অস্ফুট কণ্ঠে বললে, ভয় করছিল। 

—কোথায় গিয়েছিলে? 

—দেখতে গিয়েছিলাম ঘুমিয়েছেন কি না। 

রাধার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ওর কথা জড়িয়ে আসছিল। বললাম, কিছুতে ঘুম আসছে না রাধা। 

ও জবাব দিল না। আমার কাঁধের ওপর মাথাটি রেখে চুপ করে পড়ে রইল। বললাম, টুলু যেমন করে চলে গেল এমন করে তুমি একদিন যাবে না তো? 

রাধা নীরবে ঘাড় নেড়ে জানালে, যাবে না। 

ওর মাথাটি মুখের আরও সন্নিকটে টেনে এনে বললাম, না, তুমি যেন যেও না রাধা, তুমি থাক। তুমি চিরদিন ধরে থাক। 

আমার ঠোঁটের স্পর্শে ও একটিবার কেঁপে উঠল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *