বসন্ত রজনী – ১

এক

বৌবাজারের দিকে বাসা করার পর থেকে বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গে দেখা বড় একটা হয়ে ওঠে না। ওকালতির ঝঞ্ঝাট তো কম নয়। সকালে সিনিয়ারের বাড়ী একবার হাজিরা দিতে যেতেই হয়। মাঝে মাঝে (কথাটা চেপে যাওয়াই উচিত ছিল) তাঁর ছেলেমেয়েদের হোয়াইটওয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে জামা-কাপড়ও কিনে দিতে হয়। দুপুরে কোর্ট আছে এবং বিকালের দিকে প্রায়ই কোনো না-কোনো মক্কেলের বাড়ী যেতে হয়। সুতরাং বন্ধু- বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেবার সময়ও নেই, উৎসাহও নেই। 

এমন সময় একদিন অজয়ের চিঠি পেলাম-সে মৃত্যুশয্যায়, আমাকে একবার দেখতে চায়। লেখা অজয়ের নিজের নয়, তার পিসতুতো বোন টুলুর। মেয়েলি হাতে লেখা। এক একটি মেয়ে দেখা যায়, বয়সের হিসাবে তাদের কৈশোর শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু যায় না। অকারণে ক্ষণে ক্ষণে উঁচু হাসি, লঘু চঞ্চল গতি এবং একটি অত্যন্ত সহজ, স্বাভাবিক নির্লজ্জতা তথাপি টিকে থাকে। তেমন একটি তন্বী সুন্দরী মেয়ে এই টুলু। 

অজয়ের সঙ্গে আমার অকৃত্রিম বন্ধুত্ব,—আজকের নয়, যখন আমাদের দু’জনেরই বয়স কুড়ির নীচে ছিল, যখন একজন আর একজনকে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে পারতো, সেই সময়কার। ও যে বেশীদিন বাঁচবে না সে আমি জানতাম। কলেজে পড়বার সময়ই ওর কানের উপরটা এবং আঙুলের ডগার মাংস কুঁচকে যেতে আরম্ভ করে। রোগের সূত্রপাত সেই সময় থেকেই। কিন্তু তাতে ও এতটুকু দমেনি,—সমানে পড়ে গেছে এবং লিখে গেছে। বাংলাদেশের সাহিত্য-পত্রিকাগুলি আজও ওর প্রশংসায় মুখর বৃন্দাবন থেকে ফিরে এসেই ওর অসুখ বাড়তে আরম্ভ করে। তার আগে ভালো বোঝা যেত না। 

আমি যখন অজয়ের ওখানে গেলাম, ও তখন গলা পর্যন্ত একটা পুরু চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। তখন সন্ধ্যের বেশী বাকী ছিল না। ও সুমুখের খোলা জানালা দিয়ে পশ্চিম গগনের বিচিত্র বর্ণচ্ছটার পানে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। টুলু শিয়রের দিকে একটা টিপয়ের পাশে ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে কি কতকগুলো ওষুধের শিশি সাজাচ্ছিল। 

আমি অতি সন্তর্পণেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। কিন্তু যেভাবে টুলু আমাকে কলকণ্ঠে স্বাগত জানালে, তাতে মনে হল এত সন্তর্পণে আসবার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। আশ্চর্য মেয়ে এই টুলু। মুমূর্ষু ভায়ের পাশে দাঁড়িয়েও তেমনি চঞ্চল, তেমনি উচ্ছল, তেমনি মুখর। টুলু বললে, এইমাত্র আপনার কথা হচ্ছিল মৃণালবাবু! 

অজয় যে আজ সন্ধ্যায় আমার প্রতীক্ষা করবে এ-তো জানা কথা। তবু বললাম, তাই নাকি? 

টুলু যেন দিগ্বিজয় করেছে এমনিভাবে বললে, দেখলে দাদা, আমি বললাম, উনি নিশ্চয়ই আসবেন। তুমি বিশ্বাস করতে চাওনি। 

অজয়ের চোখ একটা পুরু চশমায় ঢাকা ছিল, দেখা যাচ্ছিল না। ওর মুখ বীভৎস দেখাচ্ছিল। নাক এবং ঠোঁট অসম্ভব রকম ফুলে উঠেছিল। টুলুর কথায় ও একটু ক্ষীণ হাসলে। 

চেয়ারটা আরো সরিয়ে নিয়ে জিগ্যেস করলাম, এখন কেমন বোধ হচ্ছে?

এ কথারও অজয় কোন জবাব দিলে না। বললে, তোমার খবর কি? 

দেবার মতো খবর আমার অনেকই ছিল। আমি জানি, কোর্টের খবর ওর কম প্রিয় নয়। একটা ছোট ঘটনাকে আইন ব্যবসায়ী সত্যি-মিথ্যায় কেমন জটিল করে তোলে, কি আশ্চর্য নিপুণতায় একটা মামলার গতি ফিরিয়ে দেয় সে কাহিনী শুনতে শুনতে ও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, অধীর হয়ে ওঠে। কিন্তু ওকে দেখে সেদিন আমার মনটা দমে গেল। বেশী কথা বলতে ইচ্ছেই হল না। আমি শুধু ঘাড় নেড়ে জানালাম, ভালো। 

—সবাই ভালো আছে? আর আর বন্ধুরা? 

আমি এবারও ঘাড় নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ। 

ও যেন আশ্চর্য হয়ে গেল। আপন মনে অস্ফুটকণ্ঠে কি যেন বললে। যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, একা ও-ই অসুস্থ, আর সবাই ভাল আছে। খানিক পরে বললে, আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টুলু? 

—একটুখানি। 

—তাই হবে। চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। 

অসুস্থ শরীর। একটু তন্দ্রা এলে সকলেই অমন কত স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অজয়ের সবটাতেই টুলুর আগ্রহ অপরিসীম; ও অজয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বললে, কি স্বপ্ন বলো না? 

অজয় একটু হেসে বললে, যাকগে। সে শুনে তুই হাসবি। 

—না, হাসবো না। তুমি বলো। 

অজয় আস্তে আস্তে বললে, স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি যেন যুদ্ধে গেছি। মস্ত বড় একটা প্রান্তর। চারিদিক ধূ ধূ করছে। কোথাও একটা গাছ পর্যন্ত নজরে পড়লো না। যুদ্ধ করতে গেছি, কিন্তু একা আমি। আমার গায়ে চুমকি করা মখমলের পোশাক, কোমরে তলোয়ার। কার সঙ্গে যুদ্ধ করছি জানি না, কিন্তু আমি কেবল চ্যাঁচাচ্ছি, আর প্রাণপণে তলোয়ার ঘুরোচ্ছি,—এতো ঘুরোচ্ছি যে গা দিয়ে প্রচুর ঘাম ঝরতে লাগলো। 

অজয় চুপ করলে। 

টুলু যে ওর গল্প খুব মন দিয়ে শুনছিল তা বোধ হল না। কিন্তু অজয় চুপ করতেই বললো, তারপর? 

—তারপর আর নেই। আচ্ছা মৃণাল, মানুষ স্বপ্ন দেখে কেন জানো? 

অন্যমনস্কভাবে বললাম, না। 

টুলু বললে, তুমি নিশ্চয়ই আজকে যুদ্ধের কথা ভেবেছ। 

অজয় সবিস্ময়ে বললে, আমি? যুদ্ধের কথা? 

টুলু আবার বললে,—আজ না হোক, এর মধ্যে কোনোদিন ভেবেছ নিশ্চয়। 

এবারে অজয়ের যেন কি কথা মনে পড়ে গেল। বললে, তা হতে পারে। যুদ্ধ নয়, কিন্তু এই শীর্ণ হাতখানা যখন দেখি তখন মনে মনে ভাবি, আমি যদি বলবান হতাম! বেশী না, এমনি সাধারণ মানুষের মতোও যদি হতাম! 

টুলু এমন অদ্ভুত কথা যেন কখনও শোনেনি, এমনভাবে হেসে লুটিয়ে পড়বার মতো হল। 

বললে, তাহলে কি করতে? আমরাই বা কি করি? চুরি করি, না ডাকাতি করি, না খুন করি? 

অজয় স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ টুলুর পানে চেয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, আমি খুনও করতে পারি। মাঝে মাঝে ভয়ানক খুন করবার ইচ্ছা হয়। কিন্তু তাও নয় টুলু, আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই, শুধু সবারই মতো রাস্তা দিয়ে চলতে চাই, স্ত্রী-পুত্রের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করতে চাই। আর কিছু নয়। 

অজয়ের গলার স্বর ভারী হয়ে এলো। কিন্তু সে স্বরে ক্লান্ত বিষণ্ণতা নেই, আছে একটা অতি তিক্ত ক্ষোভ। আমি সইতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, কথার ধারা এবার বদলাতে হবে। 

কিন্তু টুলু বললে, তোমার তো রাস্তা দিয়ে চলার দরকার নেই দাদা, স্ত্রী-পুত্রের জন্যে রোজগার করারও না। তোমার তো টাকার অভাব নেই। 

উত্তেজনায় অজয় উঠে বসল। টান দিয়ে চশমাটা খুলে ফেলে বললে, সমস্ত দিয়ে দিতে পারি টুলু, আমার বাড়ী, আমার ব্যাঙ্কের টাকা, সব, যদি একটি দিনের জন্যেও কেউ আমাকে ভালো করে দিতে পারে। এ-জীবনে আমি অন্তত একদিনও সুস্থ দেহে বেঁচে থাকতে পেলে ধন্য মানবো। 

চোখ ফেটে যেন রক্ত ঝরছে এমনি লাল ওর চোখ। আর সওয়া গেল না। আমি তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করলাম, তোমার বৃন্দাবন কেমন লাগলো? 

অজয় বিরক্তভাবে বললে, ছাই লাগলো। 

–সেই নাটকখানি শেষ হয়েছে? 

অজয় আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, ওসব আর ভালো লাগে না,—বুঝেছ মৃণাল, সাহিত্য চর্চাও আর ভালো লাগে না। 

হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু সে টুলুর সামনে নয়। 

টুলুকে বললাম, আমি বরাবর কোর্টের ফেরত আসছি কি না, সে কথাটি একবারও জানতে চাইলে না? 

টুলু আমার কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলে না। বললে, সে তো আমি জানিই।—জানো যদি, তবে চা খাওয়ানোর উৎসাহ দেখছি না কেন? 

টুলু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বললে, ভারী ভুল হয়ে গেছে মৃণালবাবু, আমি এক্ষুনি আসছি। 

টুলু চলে গেল। আমি চেয়ারখানি অজয়ের বিছানার দিকে আরও সরিয়ে নিয়ে চুপি চুপি জিগ্যেস করলাম, আর তোমার সেই বৈষ্ণবী, তার খবর কি? 

এতক্ষণে অজয়ের মুখে হাসি ফুটলো। বললে, তার কথা কি তোমাকে লিখেছিলাম?

—লেখোনি? তারই কথাই তো কেবল লিখতে। তোমার কথা আর ক’টা থাকতো?

গভীর তৃপ্তির সঙ্গে হাসতে হাসতে অজয় বললে, তাই বটে। তারই তো কথা। আমার আর নতুন কথা কিই-বা ছিলো! কিন্তু তুমি কি টুলুকে তাড়ালে এই জন্যে?

হেসে বললাম, এই জন্যে। আমি তোমার কাছ থেকে সকল কথা শুনতে চাই।

—তা শোন। কিন্তু টুলুকে সরাবার দরকার ছিল না। ও জানে। বিস্মিত হচ্ছ? কিন্তু দোষটা কি শুনি? স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসে একথা সবাই জানে। সে যদি না দোষের হয়…

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না দোষ কিছুই নয়। তুমি বলো। অজয় বলতে লাগলো : 

—ওরা বলে কুঞ্জ! বৃন্দাবন পৌঁছবার আগে পর্যন্ত জানিনে কোথায় গিয়ে উঠবো, কি করে থাকবো। কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে কিছুই আমাকে ভাবতে হল না। কোথা থেকে কে এসে যে বাক্স বিছানা সমেত আমাকে একটা কুঞ্জে নিয়ে গিয়ে ফেললে সে আজ আর মনে করতে পারি না। কেবল মনে আছে, কুঞ্জে গিয়ে যে দৃশ্যটি দেখলাম সেই কথা। সুমুখেই দাওয়ায় বসে একটা ঘোরতর কালো, বেঁটে স্থূলকায় ব্যক্তিকে পাঁচ-ছ’টি মেয়ে পরম যত্নে তেল মাখাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, একেই বলে ভাগ্যবান। বাবাজি স্মিতহাস্যে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। অতি মিষ্টি ধার কণ্ঠে বললেন, আজ তেল মাখানো থাক রাধা, আগে বাবুর ঘরটি ঠিক করে দিয়ে এসো। 

রাধার বয়স চব্বিশ-পঁচিশের কম না। দীঘল তনুদেহ ছাড়া গর্ব করবার ওর কিছুই ছিল না। 

আমি কিছুই ভুলিনি। বললাম, আর ওর হাসি? শীর্ণ, উদাস। 

অজয় হেসে ফেললে। বললে, হ্যাঁ, ওর হাসিটি বেশ মিষ্টি। তুমি কিছুই ভোলনি দেখছি। প্রথম প্রথম আমি থাকলে আমার ঘরের মধ্যে আসতে সঙ্কোচ বোধ করত। কিন্তু ক’দিনেই বুঝলে, আমার মতো দুর্বল, ব্যাধিগ্রস্ত নিরীহ লোকের কাছ থেকে ভয় করবার কিছু নেই। ক্রমেই ওর সাহস বাড়তে লাগলো। অজয় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ জিগ্যেস করলে, আচ্ছা তুমি জীবন কাকে বলো? 

আমি হেসে বললাম, বেঁচে থেকে ওকালতি করাকে। 

কিন্তু উত্তরের প্রত্যাশা করে অজয় প্রশ্ন করেনি। আমার কথা ওর বোধ হয় কানেই গেল না। আপন মনেই বলতে লাগলো, সেই প্রথম দেখলাম জীবনের রূপ। স্বর্গের কল্পবনের বাইরে দাঁড়িয়ে রুদ্ধদ্বারের ছিদ্রপথ দিয়ে শুধু একবার একটুখানি দেখতে পেলাম—অফুরন্ত জীবনের স্রোত বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় বয়ে চলেছে! তীরে পড়ে আছে কত মেঘলা, কত মণিমঞ্জীর, কত আমীলিত লীলাকমল। তাই ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে অফুরন্ত জীবনের খরস্রোত। শুধু দেখলাম। ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি তো নেই। 

অজয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে। 

—রোজ সন্ধ্যায় ওখানে কীর্তন হত। ঘরে শুয়ে শুয়ে আমি শুনতাম অভিসারিকার নিগূঢ় মর্মকথা, অবরুদ্ধ অশ্রুর অস্ফুট গুঞ্জন। জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম দূরের বনশ্রেণী। পরিপূর্ণ চাঁদের আলোয় রহস্যলোকের মতো। মনে হতো, এখুনি দেখা যাবে সুনীল বসনে সর্বাঙ্গ ঢেকে চির-অভিসারিকা ওই পথে চলেছে। চরণে মঞ্জীর নাই। নিঃশব্দ সে চলা। 

বিন্দু বিন্দু করে অজ্ঞাতসারে মনে জমছে রস, অকস্মাৎ চমকে উঠলাম। কে যেন ফিস্ ফিস্ করে জিগ্যেস করলে, ঘুমুলে? 

আমার মাথার চুলে কার যেন মৃদু স্পর্শ পেলাম। যাদু যে কোথায় ছিল, চাঁদের আলোয়, না দূরের নিঝুম বনপ্রান্তে, না নারীর মৃদুকণ্ঠে জানিনে। আমিও ফিস ফিস করে জবাব দিলাম, না। 

আবার তেমনি ফিস ফিস করে সে বললে, আজকে ঘুমিও না, বুঝলে? 

—আচ্ছা। 

—দরজা খুলেই রাখ তো? 

—রাখি। 

আবার মাথার চুলে মৃদু স্পর্শ..শাড়ীর খস্ খস্ শব্দ…দ্বারের শিকলটি একবার নড়ে উঠলো…বুঝলাম, ও চলে গেল, সেই চিরঅভিসারিকা…চরণে মঞ্জীর নাই…. 

জীবনে যে এত আনন্দও আছে এ আমি কোনদিন ভাবিনি মৃণাল। আমি শুধু আলোর শিখার মতো কাঁপতে লাগলাম। 

অজয় ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলে। 

আমি জিগ্যেস করলাম, সে কি রাত্রে এসেছিল? 

—এসেছিল। কিন্তু আমি যেমন করে চেয়েছিলাম, তেমন করে তো এলো না। আমি একবার অত্যন্ত ঝড়ের রাত্রে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম। তার পরনে ছিল রক্তের মত টকটকে লাল একখানা শাড়ী। তাই আড়াল দিয়ে সে একটি প্রদীপ বুকের মধ্যে নিয়ে অতি সন্তর্পণে আসছিল। কিন্তু ও তো তেমন করে এলো না। ও এলো কখন? ওর প্রতীক্ষায় চেয়ে চেয়ে আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছি। তখন হঠাৎ জেগে উঠে দেখি, সাপের মতো ও যেন আমার সর্বাঙ্গ জড়িয়ে জড়িয়ে বেষ্টন করে আছে। কী উষ্ণ স্পর্শ! বললাম, জানালাটা ভালো করে খুলে দেবে? আমি তখন উঠে বসেছি। বিছানার উপর অনেকখানি চাঁদের আলো এসে পড়লো। সেই আলোতে আমি ওর বুভুক্ষু চোখের পানে চাইতেই চোখ নামিয়ে নিলে। ও যেন বিষ খেয়েছে এমনি করে আমার কোলের উপর ঢলে পড়লো। 

একটু দম নিয়ে অজয় বললে, আমার আজও সংশয় যায়নি মৃণাল, আমার মধ্যে ও কি পেয়েছিল যার জন্যে এমন করে আত্মসমর্পণ করেছিল? কথাটা একদিন ওকে জিগ্যেসও করেছিলাম। ও সোজা উত্তর দেয়নি, বলেছিল, আমিও তো সুন্দরী নই, তবু তুমি কি করে ভালোবাসতে পারলে? আমি বলেছিলাম, আমি তোমায় ভালোবাসিনি। সে কথায় ও হেসেছিল, বিশ্বাস করেনি। 

আমি অজয়কে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু তুমি তো ওকে সত্যিই ভালোবেসেছিলে?

অজয় চট করে উত্তর দিতে পারলে না। যেন মনে মনে কি একটা খুঁজতে লাগলো। তারপর বললে, দেখ মৃণাল, ও যে আমার জীবনে একটি বিশেষ মুহূর্ত এনেছিল, সে কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। কিন্তু তারপরে কি করলে জানো? কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়ে না। বিকেলে হয়তো একা একাই বাগানে বেড়াচ্ছি, ও হঠাৎ এসে উপস্থিত। কথা দিয়ে, হাসি দিয়ে, চাউনি দিয়ে, আমাকে জয় করবার সে কী দুরন্ত চেষ্টা! শেষে এমন হল যে, ওকে দেখলে আমি অস্বস্তিতে হাঁপিয়ে উঠতে লাগলাম। ঘরে একা একটু বিশ্রাম করবার উপায় নেই, চিলের মতো শোঁ করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাগানে বেড়ানোর উপায় নেই। এমন কি যমুনায় স্নান করতে গিয়ে দেখি, কলসী কাঁখে নিয়ে ও কখন এসে উপস্থিত হয়েছে। আমার উপেক্ষা ওর বুঝতে দেরী হয়নি। একদিন হঠাৎ এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বললে, তুমি আমাকে দেখে অমন করে পালিয়ে বেড়িও না। আমি মনে করি, তোমার কাছে আসব না। কিন্তু পারি না, কিছুতেই মনকে আটকাতে পারি না। তার সে কী কান্না! 

এমন সময় টুলু চা আর খাবার নিয়ে উপস্থিত হল। একটা টিপয়ের উপর সেগুলো রাখতে রাখতে বললে, কার দাদা? 

অজয় আবার চোখ বন্ধ করলে। তার গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো। একটুখানি থেমে সে বললে, আমার ভয়ানক কষ্ট হল। ওর মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বললাম, আমি যে পালিয়ে বেড়াই সে-কথা তোমায় কে বললে? ও বললে, আর মিথ্যে কৈফিয়ৎ দিও না। আমি সব বুঝতে পারি। আমার কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমার বলবার কিই-বা ছিল? চুপ করে বসে রইলাম। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে অজয় ব্যগ্রকণ্ঠে বললে, একদিন একটি বিশেষ ক্ষণে যে আমাকে অসীম আনন্দ দিলে, কি করে সে ফুরিয়ে গেল বলতে পারো? ওকে আমি কেন সইতে পারতাম না, বলতো? 

এ-বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুবই সামান্য। সুতরাং চুপ করে রইলাম। টুলুর পানে চেয়ে দেখি, সে মুখ ফিরিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। 

বললে, আমি বলবো? 

—বল তো। 

—তোমার রাধা একটি সাধারণ মেয়ে। তোমার মন যাদের ঘিরে তরঙ্গ তোলে ও তাদের বাইরে। কিন্তু একটি বিশেষ ক্ষণে তোমার মনে জোয়ার এসেছিল। তোমার তরঙ্গের পরিধি গিয়েছিল বেড়ে। সেই ক্ষণটিতে তোমার চোখে ও যে অসাধারণ হয়ে ফুটে উঠেছিল, সে ওর গুণে নয়, তোমার গুণে। 

আমার দিকে চেয়ে অজয় জিগ্যেস করলে, তাই? 

এ বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই! সুতরাং চুপ করে রইলাম। 

অজয় বলতে লাগল, দেহ, দেহ, দেহ। কেবল একখানি দেহ এবং একটি পিপাসার্ত হৃদয়! তুই বোধ হয় ঠিকই বলেছিস টুলু, আমাকে ক্লান্ত করেছিল ওর অতি সাধারণ পিপাসা। কিন্তু—অজয় টুলুর দিকে চেয়ে অনুনয়ের সুরে বললে,—আচ্ছা ওকে আসতে লিখলে কি ও আসবে না? তুই কি মনে করিস? 

—ওকে আসতে লিখে দিয়েছি যে। 

—দিয়েছিস? বেশ করেছিস। কিন্তু অজয় খুব অস্ফুটস্বরে বললে,—কিছু টাকাও বোধ করি…। 

—তাও পাঠিয়ে দিয়েছি। 

টুলু মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে নিল। 

অজয় বললে, দেখতে ইচ্ছা হয় বইকি! আর ক’টা দিনই বা আছে? জীবনের পথে যাদের পেয়েছি সবাইকে মৃত্যুশয্যার পাশে জড় করতে ইচ্ছা হয়। 

.

রাধাকে দেখলাম। একখানি সাদা সরুপাড় ধুতি পরে প্রায় শেষ মুহূর্তে সে এসে পৌঁছুল। নিতান্ত সাধারণ মেয়েই বটে। চোখে মুখে বুদ্ধির এতটুকু দীপ্তি নেই। শহরের বিরুদ্ধ আবেষ্টনের মধ্যে এসে আরও যেন কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। বড় বাড়ী এবং অপর্যাপ্ত বিলাসোপকরণের সঙ্গে তার যে কখনও পরিচয় ছিল এ কথা মনেই হয় না, এমন কুণ্ঠিত ব্যবহার। সত্যি বলতে কি, ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই তাকে মনে হল না। টুলুর হাসির মানে বোঝা গেল। 

রাধা সঙ্কোচে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। টুলু বললে, দাদা, রাধা এসেছে যে! 

রাধা কাছে সরে এল। 

অজয় একবার চোখ চাইলে। শুধু একবার। তারপর চোখ বন্ধ করলে। 

অজয়ের সে চাওয়া আমি আজও ভুলতে পারিনি,—যেন অস্তরবি চাঁদের দিকে একখানি হাত বাড়িয়ে দিলে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *