ছয়
সেদিন রাত্রে এবং পরদিন সকালে টুলু আর নীচে নামল না। আমিও আর উপরে যাইনি। কাছারী থেকে ফিরে আসতে টুলু ধীরে ধীরে নেমে এসে আমার টেবিলের ধার ঘেঁসে দাঁড়াল।
বললে, রাগ পড়েছে?
আমি হাসলাম।
ও হেসে বললে, কতখানি রাগ হয়েছিল?
একথারও উত্তরে আমি শুধু হাসলাম।
টুলু আবার বললে, আপনার কি মনে হয়, আমার ওঁর ওখানে যাওয়াই উচিত?
বললাম, সে তুমিই ভালো বোঝ।
বললে, আমি যা ভালো বুঝি সে তো করেইছি। আপনার মত কি তাই বলুন।
বললাম, করে যখন ফেলেছ তখন আর আমার মত জিগ্যেস করা অনাবশ্যক।
–অনাবশ্যক?–টুলু মাথাটা দুলিয়ে বললে, আচ্ছা আমি না হয় গেলাম, কিন্তু সত্যি বলুন, আপনার তাতে কিছু কষ্ট হবে না? কিচ্ছু কষ্ট হবে না?
বললাম, এ প্রশ্নও অনাবশ্যক। তোমার যাওয়া যদি উচিত হয়, তাহলে আমার কষ্ট হলেও যাওয়া উচিত, না হলেও যাওয়া উচিত।
টুলু একখানা চেয়ারে আরাম করে বসে বললে, আমি যাব না যান। কি করবেন করুন।
এমন সময় রাধা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। সে বললে, কোথায় যাবে না—কোথায়?
টুলু চোখ টিপে বললে, সিনেমায়। মৃণালবাবুর রোজ রোজ সিনেমা যাওয়া! আমি তো যাব না বাপু। তুমি যাবে?
সিনেমা সম্বন্ধে রাধার কোনোদিনই আগ্রহ নেই। সে ঠোঁট উলটে এক প্রকার শব্দ করলে।
টুলু বললে, সে হবে না। তোমাকে যেতেই হবে। তোমার টিকিট কেনা হয়ে গেছে।
রাধা বুঝতেই পারলে না টুলু তাকে নিয়ে পরিহাস করছে। গম্ভীরভাবে বললে, হোকগে টিকিট কেনা। আমি এই শীতে আর বের হচ্ছি না।
বেশী গোলযোগের আশঙ্কায় রাধা কালবিলম্ব না করে সরে পড়ল। তখন সবে সন্ধ্যা হয়েছে। হঠাৎ কি খেয়াল হল, বললাম, যাবে সিনেমায়? এখনও সময় আছে!
টুলু হেসে বললে, না, না, আমি রাধাকে ঠাট্টা করছিলাম।
—সে আমিও জানি। কিন্তু চলই না সিনেমায়। চমৎকার একটা ছবি আছে!
টুলু বললে, আজ আর কি করে হয়? দেখলেন তো রাধার ইচ্ছে নেই।
—ইচ্ছে নেই, ও যাবে না। চল তোমাতে আমাতে যাই। ওর একখানা হাত আমার হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম, শুধু দু’জনে। কেমন?
টুলু ধীরে ধীরে হাতখানা সরিয়ে নিলে। নিম্নস্বরে নতমুখে বললে, আজ থাক!
আমিও আর অগ্রসর হতে সাহস করলাম না। চেয়ারে ঠেস দিয়ে বললাম, আচ্ছা আজ থাক। আমারও একটু কাজ আছে। কিন্তু কাল নিশ্চয় যেতে হবে। কেমন?
টুলু ঘাড় নেড়ে সায় দিলে কি অসম্মতি জানালে ঠিক বোঝা গেল না। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়াল। বললে, কিছুদিন থেকে রাধা আর আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। কিন্তু আজ মুশকিলে পড়েছে।
আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘোঁট পাকাচ্ছিল। অন্যমনস্কভাবে জিগ্যেস করলাম, কেন?
—আজ মাংস।
বললাম, ও।
টুলু হেসে বললে, বৃন্দাবনের মানুষ। নিরিমিষ চমৎকার রাঁধে। মাছটাও আমার পাল্লায় পড়ে রাঁধছে। কিন্তু মাংস ছোঁবে না পর্যন্ত।
বললাম, তাহলে মাংস আনাবার কি দরকার ছিল?
টুলু হেসে বললে, বেশ! ও ছোঁবে না বলে মাংস আসবে না?
বললাম, সে জন্যে নয়। তোমার এই শরীরে রান্নাঘরের ধোঁয়ায় না যাওয়াই উচিত।
টুলু হাসলে। বললে, কেন? আমার শরীরের ত্রুটিটা কী ঘটেছে?
বললাম, এই ফিট-টীটের অসুখে…
টলু কথাটা উড়িয়ে দিয়ে জিভে একটা টোকা দিয়ে বললে, ওঃ!
তারপর বাইরে চলে গেল।
টুলু বহুরূপী। মিনিটে মিনিটে রং বদলায়।
ওর মনের আমি ঠিকানা পেলাম না। আকাশের শুকতারা আপন ইচ্ছায় আমার মনের মাটিতে নেমে এল। তবে না আমার মনে ভরসা এল, সাহস এল, এল সুদুৰ্জ্জয় আশা! ও নিজে না সাহস দিলে আমার সাধ্য কি ওকে বাঞ্ছা করি! কি সাধ্য আমার সঙ্কোচকুণ্ঠিত অন্তরের সুগোপন আশা আকারে, ইঙ্গিতে, ভাবে ওর সুমুখে প্রকাশ করি।
একথা সত্য, আমার লোভার্ত মনে সাহস ও নিজেই জুগিয়েছে। কখনও মুখের কথায়, কখনও চোখের ভাষায় ওই তো জাগিয়েছে সুদুর্লভের কামনা। বলেছে কেন আমি সঙ্কোচে পিছিয়ে থাকি, কেন করি ভয়? আমি কারও চেয়ে পর? বলেছে, এখান থেকে কিছুতে সে যাবে না। কিছুতে না। আমি ছাড়তে চাইলেও, না।
ওর প্রতি মুহূর্তের সঙ্গসুখ আমার মূক চিত্তকে নিয়ত মুখর করতে চেয়েছে। ভাবে ভয়। ভাবে, সঙ্কোচে থাকি পিছিয়ে। কিন্তু এ যে ভয়ে নয়, সঙ্কোচে নয়, এ যে শুধু অপরিসীম শ্রদ্ধায়, সে কথা বোঝেনি। পুরুষের মনোভাব সম্বন্ধে মেয়েরা কদাচিৎ ভুল করে। কেবল শ্রদ্ধা বোঝে না। বিজয়িনী নারীর প্রতি পুরুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধাকে কেবলই ভুল বোঝে। ভাবে ভয়, নয় ভাবে চাটুকারিতা।
টুলুও ভেবেছে ভয়। সেই ভয় ভাঙাবার জন্যে বহু আয়োজন করেছে। আর ভেবেছে, কিছুতে ভাঙে না, এ কেমন ভয়! স্পর্শব্যাকুল বাহু লোভার্ত হয়েও হয় না, এ কেমন সঙ্কোচ! অবশেষে এল আপনার সমস্ত চিত্তকে আমার সম্মুখে উন্মুক্ত করে ধরতে। আমায় দেহ, মন সমস্ত নিঃশেষে নিবেদন করতে। কিন্তু পারল না কেন? কেন ভেঙে পড়ল? এ সঙ্কল্প কিছু একটা আকস্মিক মহানুভবতায় তার মনে জাগেনি। এমন করে আত্মপ্রকাশ করার পূর্বে অনেকবার ভেবেছে নিশ্চয়। তবু পারল না কেন? কোথায় বাধা?
মাঝে মাঝে মনে হয়, কোথায় যেন এর মধ্যে মহানুভবতাও আছে। টুলু নিজেও ভুলতে পারে না, আমাকেও স্মরণ করিয়ে দেয়, পৃথিবীর সমস্ত দ্বার যখন বন্ধ হয়ে গেছে তখন আমার কাছে মিলেছে নিশ্চিন্ত আশ্রয়। সমস্ত অসম্মানের বিরুদ্ধে আমি তাকে সম্মানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছি। ও যা কিছু করে, যা কিছু বলে তার মধ্যে যেন দেনা শোধ করার ব্যাকুলতার পরিচয় পাই। জানে, এতে আমি ক্ষুণ্ণ হই, ক্ষুব্ধ হই, তাই প্রাণপণে সে চেষ্টা গোপন করে চলে। সুনিপুণভাবে গোপন করে চলে। কি যে ওর মনের গোপন কথা বুঝতে পারি না। শুধু ক্বচিৎ কখনও মনে হয়, আমাকে ও দয়া করতে চায়। আমার দেওয়া আশ্রয়কে ও দয়া বলে নিয়েছে। সেই দয়া ও আর একটা দয়া দিয়ে শোধ করবে ভেবেছে।
অবশ্য টুলুর সম্বন্ধে নিশ্চয় করে কিছুই বলা যায় না। পৃথিবীসুদ্ধ সবাই যদি ওর সম্বন্ধে ভুল করতে পেরে থাকে, আমার পক্ষেও ভুল করা বিচিত্র নয়। মেয়েদের সম্বন্ধে পুরুষ কতটুকু জানে? কতটুকু বোঝে? শুধু যা মনে হয় তাই বললাম! মনে হয়, টুলু বহুরূপী।
বলেছি তো, আকাশের শুকতারা নিজে থেকে নেমে এসেছিল। জাগিয়েছিল সুদুর্লভের কামনা। আমি তো নিজে থেকে কোনো দিন ওর নিভৃত সঙ্গসুখ কামনা করিনি। মনে আমার যাই থাক, কোনোদিন তো কোন ইচ্ছা মুখ ফুটে জানাইনি। কিন্তু মৌন মাটিতে বাণী যেই জাগল, সন্নিকটের বস্তুকে যেই করতলগত করতে চাইল, অমনি আকাশের শুকতারা চকিতে আকাশে গেল ফিরে, যে দুর্লভ সুলভ হয়ে উঠেছিল, সুদূর আকাশে সে আবার মিটি মিটি জ্বলতে লাগল, হাতের নাগালের বাইরে।
টুলুকে আমি দয়া করলাম কবে? অজয়ের মৃত্যুর পরে যেদিন তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, দয়ার কথা সেদিন হয়তো মনে উঠেছিল। আর কোনোদিন নয়। টুলুকে আমি করব দয়া? দয়া করে সেই রয়েছে আমার কাছে। আমি তো তার কাছে কিছুই চাইনি! সে নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। আমার কেবলই সন্দেহ হচ্ছে, দয়া করে সে ধরা দিতে চায়। তাই ধরা দিয়েও ধরা দিতে পারছে না! কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে করুণায় মন দ্রব হয়! আবার মাঝে মাঝে সহজ অবস্থা ফিরে আসে। মনস্থির করতে পারে না। তখনই পিছিয়ে যায়।
আমার সম্বন্ধে ওর বোধ হয় ভয় ঢুকেছে। বুঝেছে আমার মধ্যে সাহস এসেছে। পুরুষচিত্তের সুদুর্জয় সাহস! যাতে সে অসাধ্য সাধন করে, বাধাকে বাধা বলে মনে করে না, সে সাহস আর নেই। কেবলই পিছুচ্ছে। রাধা সুদ্ধ সঙ্গে থাকলে পারে। তাহলে ওর ভালোই হয়। তখন ও নির্ভয়ে আমার চোখে স্বপ্ন রচনা করতে পারে, পারে তলহীন মোহের সাগরে ডুবিয়ে দিতে।
আমি জানি, টুলু আমায় আনন্দ দিতে চায়। এ বাড়ীতে এসে সেই হয়েছে ওর একমাত্র সাধনা। আমার শুষ্ক মুখ, দীপ্তিহীন চোখ সইতে পারে না। মনে ওর কি আছে ভগবান জানেন, কিন্তু বিরুদ্ধ যদি কিছু থাকেও আমায় আঘাত দিতে কিছুতে পারবে না। কিন্তু তাই স্পষ্ট বলে না কেন? দুঃখ? দুঃখ তো আছেই। তার হাত থেকে আমায় বাঁচাবে কে? তবু স্পষ্ট বলা উচিত। ও তো ভালোই জানে, লোভ আমার যত বড়ই হোক, নৃশংস নয়। মার্জিত রুচির কল্যাণে সে লোভ সংযমের বাঁধন মানে।
নিতান্ত নিরাসক্তভাবে সে যেতে পারে চলে। যেন কিছুই হয়নি। আমার কথাটার যেন কোনো অর্থই নেই। কিন্তু আমার মাথায় আগুন জ্বলছে। ওর কুসুমসুকুমার হাতের স্পর্শ আগুনের মতো সর্পিল গতিতে পৌঁছেছে আঙুলের ডগা থেকে একেবারে মস্তিষ্কে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বদেহে। চোখের ঘুম নিয়েছে কেড়ে। বিছানায় কে যেন কাঁটা ছড়িয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করে অবশেষে উঠতে হল। একটা ব্যাপার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে বাইরে বেরুলাম। রাত দু’টোর কম নয়।
ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে। শীতের জ্যোৎস্না চোখে কেমন মায়াপুরীর স্বপ্ন আনে। অসীম নিস্তব্ধতায় চাঁদের আলো যেন ছম্ ছম্ করছে। বাইরে বেরিয়ে আসতে মনে হল এই যাদুর মধ্যে আমি যেন ডুবে গেলাম, হারিয়ে গেলাম।
ওদিকের পোড়ো জায়গায় কি একটা গাছের নীচে অন্ধকার যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝিমুচ্ছে। তার ওদিকের জীর্ণ বাড়ীটার নীচের ঘরের একটা জানালা আধখোলা। লণ্ঠনের আলোয় মনে হল একটা ছেলে দুলে দুলে পরীক্ষার পড়া তৈরী করছে। ওর পরীক্ষা কাছে এসেছে।
সামনের খোলার বাড়ীর কচি বউটি উঠেছে এত রাত্রে। কলতলায় বসে বসে অতি দ্রুত বাসন মাজছে! নিস্তব্ধ রাত্রি, ওর চুড়ির ঠুন ঠুন শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি। বোধ হয় ওর স্বামী মাতাল। কোথায় কোথায় ঘুরে একটু আগে ফিরেছে। তাকে খাইয়ে দাইয়ে বিছানায় শুইয়ে ও নিজেও বোধ হয় এখনি খেল। সকালে হয়তো সময় হবে না, তাই বাসন ক’খানাও এখনি মেজে নিচ্ছে। কিংবা স্বামী হয়তো মাতাল নয়। ভোরেই বোধ হয় কাজে বেরুতে হয়। পুরুষমানুষের পাতে তো আর নিতান্ত ভাতেভাত দেওয়া যায় না! দু’খানা ভাজা, একটা তরকারী চাই। যদি রাত্রের মাছ থাকে, তার একটা ঝোলও রেঁধে দিতে হয়। দু’টোয় না উঠলে ওর হয়তো চলে না।
হঠাৎ তার পাশের বাড়ীর দোতলার ঘরে আলো জ্বলে উঠল। শোনা গেল শিশুর কান্না। সঙ্গে সঙ্গে প্রহারের শব্দও শোনা গেল।…এত রাত্রে ঘুম ভাঙতে ওর মা বোধ হয় বিরক্ত হয়েছে। প্রহার খেয়ে ছেলেটা আরও জোরে কেঁদে উঠল। ওর বাবারও গজ গজ বকুনির শব্দ পাওয়া গেল। কাকে বকছে কে জানে। ওর মাকেও বকতে পারে, ওকেও বকতে পারে। হড়াম করে দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। আবার তেমনি শব্দ করে দরজা বন্ধ হল। ছেলেটার শান্ত হতে সময় লাগল। ওর মাকে এই রাত্রে বোধহয় ওকে কোলে করে মেঝেয় পায়চারী করতে হল। হাতেও বোধ হয় কিছু দিতে হল। একখানা বিস্কুট, একটি মিষ্টি কিম্বা একটা কিছু। খানিক পরে ছেলে ঘুমুল। আলো নিভল। চাঁদের আলোয় বাড়িখানা আবার যেন ঝিমুতে লাগল।
আমাদের সুমুখের বাড়ীর বুড়ো ভদ্রলোকটি সমস্ত রাত কাশেন। ক’দিন থেকে তাঁর বাড়ীতে ডাক্তারের আনাগোনাও দেখতে পাচ্ছি। কিছু একটা কঠিন অসুখ করেছে নিশ্চয়। বুড়ো মানুষ। এখন চোখ বুজলেই হয়। ঘরে তাঁর আলো জ্বলছে। সমস্ত রাতই জ্বলে। ভদ্রলোকের চোখে আর ঘুম নেই। থেকে থেকে কাশছেন। স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে বহুকাল। আর বিয়ে করেননি। একটিমাত্র ছেলে। কিছুদিন হল মহাসমারোহে তার বিয়ে দিয়েছেন। তাদেরও চোখে ঘুম নেই। অফুরন্ত স্রোতে তাদের চলেছে কানে কানে কথা।
হঠাৎ কি খেয়াল হল, তাদের কথা শোনবার জন্যে উৎকর্ণ হলাম। কথা শোনা যায়, কিন্তু বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো হাসির আওয়াজ পাই। চুড়ির আওয়াজের মতো মিঠে মিঠে হালকা হাসি। মাঝে মাঝে কথা যেন স্পষ্ট হয়। কিন্তু তখনই বুড়ো ভদ্রলোকের কাশির শব্দে তা যায় ডুবে। ভদ্রলোকের ওপর রাগ হয়! একবার যেন একটু স্পষ্ট করে শোনা গেল। মনে হল বউটি যেন রেগেছে। ছিপ ছিপে, সুন্দরী একটি মেয়ে! মাঝে মাঝে জানালার পাশে অন্যমনস্কভাবে বসে থাকতে দেখেছি। ভাবতাম বাড়ীর জন্যে ওর বোধহয় মন কেমন করে! সেই বউটি কি জানি কেন রাগ করেছে। চুপি চুপি গদগদভাষা যেন তীক্ষ্ণ হয়েছে। অকারণেই সহানুভূতিতে ওর জন্যে মন ভরে উঠল। ছেলেটি কি যেন বললে। অনেকগুলি চঞ্চল পদের ধ্বনি শোনা গেল। বন্ধ জানালায় কিসের যেন ধাক্কা লাগল। এতদূরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও মেয়েটির জন্যে আশঙ্কায় চঞ্চল উঠলাম। আমি বোধ হয় চেঁচিয়ে উঠতাম। কিন্তু তখনই বউটি খল খল করে হেসে উঠল। আমার বুকের ভেতরটা একবার চঞ্চল হয়েই শান্ত হল। যাক! মেয়েটি হাসছে।
বাইরের আকাশ তেমনি নীলাভ উজ্জ্বল। যেন কি কি স্বপ্ন দেখছে। পা টিপে টিপে তেতলায় গেলাম। টুলুর ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। জানালায় কান পাতলাম। টুলুর নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। নরম মসৃণ লেপের তলায় টুলু নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল না? কি যেন খস খস করে উঠল? নিঃশ্বাস রোধ করে কান পাতলাম। না, ও কিছু নয়। টুলু পাশ ফিরে শুল। টুলু ঘুমুচ্ছে।
.
শীতের বড় রাত্রিও ক্রমে ফুরিয়ে এল।
কুয়াশায় কিছু দেখা যায় না, তবু মনে হল পৃথিবীর ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে। অজগর সর্পের মতো এখনও সে এলিয়ে পড়ে আছে বটে, কিন্তু তার বিপুল দেহের এখানে- সেখানে স্পন্দন জেগেছে। এইবার জাগবে।
কুয়াশায় জমাট অন্ধকার ভেদ করে একটা ট্রাম ঘর্ঘর শব্দে ছুটে চলে গেল। তার পিছু পিছু একটা বাস। আর একটা। রাস্তায় জল দেওয়া আরম্ভ হয়েছে। একটা লোক মই কাঁধে করে ছুটে ছুটে রাস্তার আলোগুলো নিভুচ্ছে। মোড়ের চায়ের দোকানটা এইবার খুলল। ময়লা-ফেলা গাড়ীগুলোর ছুটোছুটি পড়ে গেছে। আঃ! বাঁচা গেল! ট্রাম-বাস- ময়লাফেলা গাড়ীর কর্কশ শব্দ কানে যেন মধুবর্ষণ করলে। বাঁচা গেল! রাত্রি শেষ হল। এই কুয়াশা যেন মহানগরীর ছড়ানো এলোচুল। এখন ধীরে নিদ্রালস আঙুল দিয়ে জড়িয়ে নিচ্ছে।
সুমুখের বাড়ীর বউটির ঘুম ভেঙেছে। সে উঠে জানলাগুলো খুলে পর্দাগুলো ঠিক করে দিলে। চোখে তার অত্যন্ত মধুর রাত্রি জাগরণের কলঙ্করেখা! পর্দা ঠিক করতে করতে নিদ্রিত স্বামীর মুখের দিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টি হেনে শিথিল কবরী ঠিক করতে করতে চঞ্চল পদে সে গেল বেরিয়ে।
ওদিকে খোলার বাড়ীর পাশের দোতালার বউটির ছেলে রাস্তার দিকের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলে আর কাঁদছে না। বউটির স্নেহস্নিগ্ধ মুখে শীতের প্রভাতের শীর্ণ আলো এসে পড়েছে।
আর উঠছে রাধা। চওড়া লাল পাড় একখানা মটকার শাড়ী পরে স্নান সেরে উঠে আসছে। মাথায় কাপড় নেই। কালো এলোচুল পিঠের ওপর গেরো দিয়ে বাঁধা। আমায় রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিঁড়ির মুখে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাথায় কাপড় দিয়ে স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করলে, এত ভোরে যে!
সে কথার উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলাম, তুমি শীতের দিনেও এত ভোরে স্নান কর?
রাধা মুখ নীচু করে হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তার অনাবৃত মসৃণ বাহুতে বিন্দু বিন্দু জল তখনও জমে ছিল। রাধা পূজোর ঘরে গিয়ে ঢুকল। ওর পূজোর পদ্ধতি অতি সহজ এবং সংক্ষিপ্ত। মন্ত্র আছে কি না জানি না। না থাকাও বিচিত্র নয়। আসবাবের হাঙ্গামা নেই। একটি ছোট কুশাসন আর একটি পাথরের রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি।
রাধা কুশাসনখানি পাতলে। সাজিভরা ফুল ছিল, আপন মনে গুন গুন করে কি গাইতে গাইতে মালা গাঁথতে লাগল। দু’গাছি মালা। একগাছি ঠাকুরের গলায় পরিয়ে দিলে। আর একগাছি ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে নিজের গলায় পরতে যাবে এমন সময় দৃষ্টি পড়ল আমার উপর। মালা আর পরা হল না। হাতে করে নিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে হাসতে লাগল। আমি ভেতরে এসে বসলাম।
রাধা হেসে জিজ্ঞাসা করলে, কি দেখছিলেন অমন করে?
বললাম, তোমার পূজো।
—অমনি করে?
বললাম, ক্ষতি কি? বললাম, বেশ লাগল তোমার পূজো। বেশী আড়ম্বর আমি ভালোবাসি না।
রাধা নম্রভাবে একটু হাসলে। হাতের মালাটা দোলাতে বললে, নেবেন? প্রসাদী মালা।
—দাও।
রাধা আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে মুখ নীচু করে হাসলে। রাধার ঠাকুরকে আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলাম।
বললাম, চমৎকার মূর্তি তোমার ব্রজকিশোরের!
রাধা স্নিগ্ধদৃষ্টিতে ব্রজকিশোরের মূর্তিটি আর একবার দেখে নিলে। বললে, আসবার সময় গুরুদেব এটি দিয়েছিলেন।
এমন সময় টুলু এসে দোরগোড়ায় দাঁড়াল। কাঁধে একখানা তোয়ালে। স্নান করতে নামছে। হাতে দাঁত মাজার ব্রাশ। টুলু আমার গলার মালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
রাধা ডাকলে, এস।
টুলু আসছি বলে নীচে নেমে গেল। ওকে কেমন অবসন্ন দেখাচ্ছিল। একরাত্রির মধ্যে যেন শুকিয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণের হাসির আভাসটি গেছে মিলিয়ে।
ও যখন ফিরে এল, আমি তখন আমার ঘরে এসে বসেছি। টুলু ধীরে ধীরে আমার ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
উদ্বিগ্নভাবে জিগ্যেস করলাম, তোমাকে বড় শুকনো দেখাচ্ছে! অসুখ-বিসুখ…
বললে, ও কিছু নয়।
আমার এই ঘরটি টুলু প্রত্যহ ঝেড়ে মুছে দেয়। টুকিটাকি জিনিসগুলি যথাস্থানে সাজিয়ে রাখে। টুলু তাই করতে লাগল।
বললাম, আজকে সন্ধ্যায় সিনেমায় যাচ্ছি তো?
টুলু যেন চমকে উঠল। বললে, আজ সন্ধ্যায়? কিন্তু তখনি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বললে, সন্ধ্যেই তো হোক।
হেসে বললাম, সন্ধ্যে কি হবে না ভাবছ?
বললে, যখন হবে তখন যাওয়ার ভাবনা। এখন কি?
বললাম, এখন থেকে ঠিক করতে হবে না?
টুলু মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে বললে, না।