বসন্ত রজনী – ৭

সাত 

কাছারী থেকে একটু সকাল সকাল ফিরলাম। 

টিকিট আর কিনলাম না। ভাবলাম, রাধা যদি শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি না হয়! কাছারী থেকে চিরদিন ফিরি নিঃশব্দে। আজকে সোরগোল তুললাম। সে শব্দে রাধা নেমে এল। তার পিছনে টুলু। 

বললাম, এ কি! তোমরা এখনও সাজগোজ করনি? ছ’টা বাজে যে! 

টুলু উত্তর দিতে পারলে না। নতনেত্রে দাঁড়িয়ে রইল। রাধা বললে, দিদিমণির বড্ড মাথা ধরেছে মৃণালবাবু। দুপুর থেকে। 

চেয়ে দেখলাম, গ্রীষ্মের রোদে গাছের পাতা যেমন ঝলসে যায় ওর মুখখানি তেমনি গেছে ঝলসে। তাতে যেন একবিন্দু রস নেই। 

বিরক্তভাবে বললাম, তবে তুমি কষ্ট করে নেমে আসতে গেলে কেন টুলু? চুপ করে একটু শুয়ে থাকলেই তো পারতে! ওই তো তোমার দোষ! 

টুলু ভীতভাবে অপাঙ্গে আমার দিকে চাইলে। ওর মনে বোধ হয় ভয় হয়েছে আমার রাগের কারণ ঠিক ওর নীচে নেমে আসার জন্যে নয়, কারণ অন্য! কিছুটা আশাভঙ্গের জন্যেও হতে পারে। যাই কিছু সে, ভাবুক, আমার বিরক্তি দেখে ও একটু ভয় পেলে। কোনো জবাব দিলে না। 

টুলু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দেখে আমি আবার বিরক্তভাবে বললাম, যাও!

টুলু তথাপি গেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। 

বললাম, মিছিমিছি কাজ কামাই করে ছুটে এলাম। রাধা চা-টা কি তৈরি করেছ নিয়ে এস। আমাকে এখনি আবার বেরুতে হবে! 

রাধা যাচ্ছিল, টুলু তাকে বললে, তুমি থাক আমি আনছি। 

বিস্ময়ে রাধাকে দাঁড় করিয়ে রেখে টুলু চলে গেল। রাধার সত্যিই বিস্ময়ের সীমা ছিল না! এই আকস্মিক রাগারাগির মধ্যে পড়ে সে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে আমার ক্রোধের প্রকাশ সে কখনও দেখেনি। আজকে কেনই বা এমন অকস্মাৎ চটলাম, আর টুলুই বা এমনভাবে তাকে বসিয়ে রেখে নিজে কেন গেল খাবার আনতে, তার কারণ নির্ণয় করতে না পেরে বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। 

টুলু খাবার নিয়ে এল। আমার খাওয়ার শেষ পর্যন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রাগ করেও চলেও গেল না, কথা দিয়ে হাসি দিয়ে আমার রাগ ভাঙাবার চেষ্টাও করলে না। আমিও নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে উঠলাম। একবার কেউ প্রশ্নও করলে না কতদূরে যাচ্ছি, ফিরতে কত দেরী হবে। 

আমি কিন্তু রাস্তায় নেমে বিপদে পড়লাম। কোথায় যাই? বহুকাল ক্লাবে যাইনি। সেখানে গেলে তো আস্ত রাখবে না! অকারণে আত্মীয় বন্ধুর বাড়ী যাওয়াও ছেড়েছি। বিনাকাজে এখন যেতে বাধ-বাধ ঠেকে। এক গড়ের মাঠে গিয়ে বসে থাকা। কিম্বা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, চৌমাথায় দাঁড়িয়ে গাড়ী ঘোড়া মোটর মানুষের ভীড় দেখা। ভিড় ভালো লাগছে না। রাস্তায় ঘোরা নয়, সিনেমাতেও যাওয়া নয়। বরং একটা ফিটন করে এমনি খানিকটা মাঠে হাওয়া খেয়ে ফিরে আসাই সব চেয়ে ভালো। 

তাই করলাম। সামনে দিয়ে একটা খালি ফিটন যাচ্ছিল। সেইখানায় উঠে বললাম, ময়দান চল। 

কাল সারারাত্রি চোখের পাতাটি বুজিনি। কাছারীতে কাজের ভিড়ে ঘুমের কথা মনেও হয়নি। এখন ফিটনে উঠতেই শরীর ঘুমে যেন এলিয়ে এল। একটি কোণে ঠেস দিতেই রাজ্যের ঘুম নামল চোখে। খিদিরপুর পুলের কাছাকাছি গাড়োয়ান ডেকে তুললে, বাবু কোথায় যেতে হবে? 

বললাম, ময়দান ঘুরে বাড়ী। 

বলেই আবার চোখ বন্ধ করলাম। সন্ধ্যার হাওয়ায় মাথাটা যেন সুস্থ বোধ হচ্ছিল। বেশ একটু শীত-শীত করছিল। কিন্তু সে বেশ ভালোই লাগছিল। এমন ঘুম অনেকদিন আসেনি। সমস্ত দুশ্চিন্তা কোথায় উড়ে গেল। মন হালকা বোধ হল। পৃথিবীর সুখ দুঃখ, ভাবনা চিন্তা কিছুরই সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রইল না। নিশ্চিন্তে নিদ্রা গেলাম। 

কতক্ষণের জন্যেই বা ঘুমিয়েছি। বাড়ীর কাছে যখন ফিরলাম ঘড়িতে দেখলাম দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। এই দু’ঘণ্টাতেই আমার শরীর মন হালকা হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে যেন আর কোনো গ্লানি নেই, টুলুর সম্বন্ধে আর আমার কোনো রাগ নেই। আশাভঙ্গের বিরক্তিও গেছে কেটে। বরং মনে মনে ওর জন্যে ব্যথিত হলাম, উদ্বিগ্ন হলাম। মনে পড়ল ওর মলিন মুখ। 

টুলুর শরীর হয়তো কিছুকাল থেকেই ভাঙতে সুরু করেছে। আমিই ওর দিকে চাইবার সময় পাইনি। আমার চিত্ত থেকে আমার স্বপ্ন থেকে যে আনন্দরস উৎসারিত হচ্ছিল তাই নিয়ে ছিলাম ডুবে। এতদিন নিজেকে নিয়েই ছিলাম ভুলে। অন্যের দিকে চাওয়ার অবকাশ হয়নি। মনে হল টুলুর শরীর নিশ্চয়ই কিছুদিন থেকে খারাপ যাচ্ছে। একদিনে হঠাৎ একটা লোক এমন শুকিয়ে যায় না, কারও এমন করে ফিটও হয় না। মনে মনে লজ্জিত হলাম, অনুতপ্ত হলাম। বেচারা টুলু। ওর ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন। 

রাধা এসে বললে, আপনার খাবার জায়গা করি? 

—কর। 

রাধা খাবার দিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। 

জিগ্যেস করলাম, টুলু কেমন আছে? 

বললে, তেমনি। 

সন্ধ্যার কাণ্ডে রাধাও যেন ভড়কে গেছে। সেও যেন কেমন ভয়ে ভয়ে কথা বলছে। কৃতকর্মের জন্যে বড়ই লজ্জিত হলাম। ওরা হয়তো ভাবছে দু’মুঠো খেতে দিচ্ছি বলেই এমন করে চোখ রাঙাতে সাহস করছি। আমি যেন ওদের মাথা কিনে নিয়েছি। 

ব্যাপার লঘু করার জন্যে বললাম, তোমরা সবাই আমার ওপর খুব রেগে গেছ, না রাধা? 

রাধা শান্তভাবে ঘাড় নেড়ে জানালে, না। 

বললাম, তুমি হয়তো রাগনি, কিন্তু টুলু রেগেছে। বলে নি কিছু? 

রাধা বললে, না। বলবে কি? 

বললাম, বলেনি হয়তো, কিন্তু রেগেছে নিশ্চয়। নইলে আমার খাওয়ার সময় নীচে নামতো। 

রাধা ব্যস্তভাবে বললে, বা রে! ওকে শুয়ে থাকতে বলেছেন যে! নীচে আসতে নিষেধ করেন নি? 

আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, ও, এইজন্যে? 

রাধা ঘাড় নেড়ে বললে, হুঁ। 

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, আর কিছুতে না হলেও তোমাদের চেয়ে আমি বয়সে বড়। যদি কখনও কিছু বলেই ফেলি, কিছু মনে করো না রাধা। দুঃখ শুধু তো তোমাদের নয়, আমারও আছে। 

এমন সময় টুলু ধীরে ধীরে নেমে এল। তার দিকে না চেয়েই বলতে লাগলাম, আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে তিনটি অভাগা প্রাণীকে ভগবান এক জায়গায় জড় করেছেন। আমাদের দিকে সমস্ত পৃথিবী পিছন ফিরেছে। এই কথা ভেবে আমাদের দোষ ত্রুটি আমরা যদি না ক্ষমা করতে পারি, বিড়ম্বনার আর শেষ থাকবে না। 

টুলু আমার এ সব কথা শুনছিল বলে মনে হল না। আমার প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে রাধাকে বললে, চাটনি করনি? 

—করেছি বৈ কি! ওই যাঃ 

রাধা চাটনি আনতে গেল। টুলু দুধের বাটিতে একটু চিনি ঢেলে বাতাস করতে করতে বললে, রাগের কথা কি হচ্ছিল শুনি? 

বললাম, হয়নি কিছুই। তুমি আমার ওপর রেগেছ তাই বলছিলাম। 

বললে, সমস্ত দিন কোর্টে বসে হয়কে নয় করেন সেই ভালো। অকারণে রাত্রিবেলায় মিথ্যে কথা বলছেন কেন? 

বললাম, মিথ্যে বলিনি তো। 

টুলু আর একটা বাটিতে দুধটা ঢালতে ঢালতে বললে, তা হবে। পুরুষমানুষের দস্তুরই তাই। গরীবের ওপর অকারণে চোখও রাঙাবেন আবার দোষও চাপাবেন। 

রাধা চাটনি নিয়ে এল। টুলু তাকে বললে, তুমি একটা ভয়ানক অন্যায় করেছ রাধা। 

রাধা এই আকস্মিক দোষারোপে ভয় পেয়ে গেল। বললে, কি করেছি?

–তুমি মৃণালবাবুর ওপর রাগ করেছ? 

রাধা হেসে বললে, কখন রাগ করলাম? 

হাসি চেপে টুলু বললে, করনি? সেই! সন্ধ্যাবেলায় বলছিলে যে। বলে দোব? 

—দাও বলে। 

ওরা দুজনেই হেসে উঠল। টুলু দুধের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে উঠতে উঠতে বললে, আমরা দুজনেই ভীষণ রেগেছি। আমাদের রাগকে যদি ভয় করেন তাহলে পাতে কিছু ফেলে রাখতে পারবেন না। আমি আপনার বিছানাটা করতে চললাম। বুঝলেন? 

টুলু কি আমাকে কিছু ইঙ্গিত করে গেল? ওর মুখের ভাব লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। মুখ দেখা গেল না। ও যেন ইচ্ছে করেই আমাকে আড়াল করে চলে গেল। টুলুর রহস্য আমার কাছে দিন দিন বেড়েই চলছে। 

.

অনেক রাত্রি পর্যন্ত আমি বিছানায় চুপ করে বসে রইলাম। আমার মনে ধারণা হয়েছিল, টুলু আসবে। বিছানা করার কথায় ও সেই ইঙ্গিতই নিশ্চয় করে গেছে। ওর জন্যে আমার দুয়ার খুলে রাখলাম। কোথাও একটু কিছু শব্দ হলেই চমকে উঠি। দেহের রক্ত দ্রুততালে নেচে ওঠে। কিন্তু টুলু এল না। 

সকলের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল। নীচে বাসন মাজার শব্দ বন্ধ হল। বসে বসেই শুনছি রাধা ঝিকে বিদায় করে সদর দরজা বন্ধ করে দিলে! নীচের আলো নিভল। তারপর তেতলা যাওয়ার সিঁড়িতে রাধার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। এক সময়ে মনে হল, রাধা তেতলার বারান্দায় দ্রুতপদে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বোধ হয় বাইরে কাপড় মেলা আছে সেইগুলো তুলছে। কিম্বা হয়তো অন্য কিছু বাইরে পড়ে রয়েছে। অবশেষে সে শব্দও মিলিয়ে গেল। রাধার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ হল। এইবার সে আসবে। 

সে বলেছে আমি তার সকলের চেয়ে আপন। বলেছে সবাই যখন অবলীলাক্রমে তাকে অমর্যাদার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে তখন আমি দিয়েছি আশ্রয়! এ কি শুধুই আশ্রয়! আমি তার সমগ্র সত্ত্বাকে সম্মানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছি। ও নিজে মুখ ফুটে দুঃখ করেছে। কেন আমি দ্বিধা করি? কিসের জন্যে সঙ্কোচ? পুরুষের মনের কথা টের পেতে মেয়েদের এক মিনিটও লাগে না। সে বুঝেছে আমার প্রেম কারও প্রেমের চেয়ে ছোট ও নয়, দুর্বলও নয়। আমার বলিষ্ঠ বাহুর আশ্রয় রমণীর পক্ষে উপেক্ষা করবার নয়। সে আসবে। 

টুলুর সম্বন্ধে সুকোমলের মন এখনও সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়নি। এখনও সন্দেহ আছে। এখনও দুলছে। টুলু জানে, ওর ওপর এখনও নিঃসংশয়ে নির্ভর করা চলে না। টুলুর মর্যাদা ওর হাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। ও নিজে যেচে এসেছে সত্যি। একবার বললেই হয়তো ওকে নিয়েও যাবে। কারণ, ওকে ঘরে রেখে ও যেমন স্বস্তি পাচ্ছিল না, ওকে ছেড়েও ওর পক্ষে থাকা অসম্ভব। টুলুকে যে ও ভালবাসে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সে ভালোবাসা কণ্টকসঙ্কুল। কোমলচিত্ত নারীর পক্ষে সে কাঁটার জ্বালা সহ্য করা সহজ নয়। তা সে পারবে না। টুলু সুনিশ্চিত আসবে। 

টুলু আসবে এই সম্ভাবনাতেই আমার ছোট ঘরটির রূপ গেছে বদলে। ছোট নীল আলো জ্বলছে। তার স্বল্প আলোয় চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। ঘরখানিকে যেন নীল দিয়ে মেজে দিয়েছে। রোজ জ্বলে এই আলো। কিন্তু এমন ভালো কোনদিন লাগেনি। 

নীচের বড় ঘড়িটায় ঢং করে একটা বাজল। কত এখন রাত? এরই মধ্যে একটা হবে? ওটা কি আধঘণ্টার ঘণ্টা? কতক্ষণ থেকে প্রতীক্ষা করে আছি জানি না। হয়তো অনেকক্ষণ। যুগযুগান্ত থেকে। কিম্বা হয়তো এই এখনি থেকে। সময়ের হিসাব মন থেকে মুছে গেছে। যে কাল অনন্ত, যাকে খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করা চলে না, আমি চলেছি তারই মধ্যে দিয়ে। দণ্ডের সঙ্গে পল আশ্চর্যরকমভাবে মিলে সমান হয়ে গেছে। 

ঘড়িতে ঢং করে বাজল একটা। আমার স্বপ্ন গেল টুটে। ঘণ্টাতো নয় যেন একটি জিজ্ঞাসা-চিহ্ন। কই এল? টুলু কই এল? সেই থেকে বসে রয়েছি, এল না তো? 

ঘরের কোণে কোথায় একটি ঝিঁঝি পোকা ডাকছিল একঘেয়ে সুরে। সে সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল একেবারে আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুতে। তার মধ্যে হতাশার সুর ছিল বুঝি। আমাকে আর বসে থাকতে দিলে না। ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগলাম। 

মাথার ভিতর কি রকম যন্ত্রণা হচ্ছিল। ঘরের আলো মনে হল পর্যাপ্ত নয়। এদিকের দেওয়াল থেকে ওদিকের দেওয়ালের ছবি ভালো দেখা যায় না। কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যায় না। সব ঝাপসা। ঘর যেন গরম হয়ে উঠেছে। চারিদিকের জানালা দরজা সব বন্ধ। মাথা ঝিম ঝিম করছে। হাত কাঁপছে। ভয় হল, এ ঘরে আর বেশীক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। মুক্ত হাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম। 

আমি বাইরে বার হলাম। 

.

সেই কালকের মতো আলো। 

খোলার ঘরের সেই বউটি উঠেছে আজও। পাশের দোতলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আজও দেখা যাচ্ছে আলো। কিন্তু খোকাটি বোধ হয় আজ আর কাঁদেনি। মায়ের কোলের মধ্যে চুপটি করে ঘুমিয়েছে। বুড়ো ভদ্রলোকটি মাঝে মাঝে কাশছেন। আর তারই পাশের ঘর থেকে মৃদুগুঞ্জন আসছে ভেসে। চন্দ্রালোকিত নিস্তব্ধ নিশীথে এই ক’টি প্রাণীর চোখে নেই ঘুম। আর ঘুম নেই মোড়ের পাহারাওয়ালার, নেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের। আর নেই আমার। 

কিন্তু অনিশ্চয়তার মধ্যে আর আমি থাকব না। সমস্ত দ্বিধা সঙ্কোচ সবলে আমায় দূর করে ফেলতে হবে। যা কিছু হয় হোক, সেই সঙ্গে এই সংশয়সঙ্কীর্ণ, আশা- নিরাশায়ভরা পথ চলাও হোক শেষ। আমি তেতলায় টুলুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘর বন্ধ, কিন্তু ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। খাটের উপর টুলুর নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি। সে কি তবে জেগে আছে এখনও? 

দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিলাম। 

হাঁ, টুলু জেগেই আছে। খাট থেকে সে বোধ করি নামল। দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় এক মুহূর্তে অবশ হয়ে গেল। ইচ্ছে হল টুলু দরজা খোলার আগেই ছুটে পালাই। সেই মুহূর্তেই ও দরজা খুলে শান্তকণ্ঠে বললে, আসুন। 

আমাকে অঙ্গুলি নির্দেশে খাটের উপর বসতে বলে ও মেঝেতেই বসল। দরজার পাশে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে। ওদিকের খাটে রাধা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। 

টুলু হেসে বললে, অনেকদিন বাঁচবেন। 

টুলুর হাসি দেখে আমি অনেকটা সাহস পেলাম। বললাম, এমন আশঙ্কা কেন করছ?

খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস আসছিল। দরজা বন্ধ করে টুলু আবার নিজের জায়গায় এসে বসল। বললে, এই মুহূর্তে আপনার কথা ভাবছিলাম। 

বললাম, আমার সৌভাগ্য। প্রসঙ্গটা কি? 

কাপড়ের পাড়টা সমান করতে করতে ও বললে, অনেক ভেবে দেখলাম মৃণালবাবু, আপনার কথাই ঠিক। 

ওর গাম্ভীর্য দেখে হেসে ফেললাম। বললাম, এর জন্যে তো অনেক ভাববার প্রয়োজন ছিল না। কথা আমি প্রায়ই ঠিক বলি। কিন্তু কথাটি কি? 

টুলু সে কথার উত্তর না দিয়ে বললে, আপনি ওখানকার ঠিকানা জানেন? 

—কোনখানকার? 

টুলু মুখ নীচু করে বললে, আবার কোনখানকার? আপনার বন্ধুর। 

ও কি পরিহাস করছে?—বললাম, জানি। সেখানে কি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে? 

ও হেসে বললে, না। অতটা সহজ নয়। একখানা চিঠি লিখতে হবে। 

—কি লিখবে? 

—লিখব শ্রীচরণকমলেষু। 

বললাম, তুমি কি পরিহাস করছ? 

ঘাড় নেড়ে বললে, না। 

সেখানে যাওয়ার অর্থ কি জান? 

এবারও নতমুখে ঘাড় নেড়ে জানালে, জানে। 

—তবে যেতে চাও কেন? মিথ্যে বোলো না টুলু, আমি সত্যি কথা শুনতে চাই। টুলু ম্লান হেসে বললে, কি হবে সত্যি শুনে? বরং ঠিকানাটা কখন দিচ্ছেন বলুন। 

—কখনই দোব না। কেন দোব? কী আমার লাভ? 

—একবার না হয় নিঃস্বার্থ হলেন। 

উত্তেজিতভাবে বললাম, একবারও হব না। টুলু, রাত্রে আমার নিদ্রা নেই। নিজের বাড়ীতে সমস্ত রাত চোরের মতো ঘুরে বেড়াই। আমার দুঃখ তুমি যদি না বোঝ, তোমার দুঃখ আমি কেন বুঝব? 

টুলু আমার দিকে চোখ তুলে চাইতে পারছিল না। মৃদুকণ্ঠে বললে, কে বললে বুঝি না? 

—কিছুই বোঝ না। আমি তো কোনদিন বলিনি। 

—সবই কি বলতে হয়? আমরা পুরুষের চোখ দেখে মনের কথা বলতে পারি। ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে সাগ্রহে বললাম, বোঝ যদি তবে কেন যেতে চাও? আমার স্নেহ কি এতই অকিঞ্চিৎকর? 

টুলু অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললে, অকিঞ্চিৎকর নয় বলেই যেতে চাই মৃণালবাবু, আমাকে বিদায় করে আপনি বাঁচুন। এ ছাড়া আপনার আর বাঁচবার পথ নেই। 

—পথ নেই? আমি কি মিথ্যার পেছনে ছুটলাম এতদিন? 

—মিথ্যে কিছুই নয়। আপনি আলেয়ার পেছনে ছুটলেন। আলেয়া আলেয়া, গৃহের মঙ্গলদীপ নয়। 

আমার কপালের রগ দপ দপ করছিল। মাথা শূন্য বোধ হচ্ছিল। ডান হাতে কপাল টিপে ধরে বসে রইলাম। 

টুলু শান্ত মৃদু কণ্ঠে বলতে লাগল, আপনাকে দুঃখ দিয়ে আমি যে কত দুঃখ পেলাম, সে আর বোঝাবার চেষ্টা করব না। এ পৃথিবীতে আপনার চেয়ে আপন আর আমার কেউ নেই। তবু দুঃখ দিতে হল। ঠকানোর চেয়ে সে ভালো। 

—ঠকাবেই বা কেন? 

—আর কি করব? আমার দেবার আছে কী? 

ওর কথা বুঝতে দেরী হচ্ছিল। এতক্ষণে যেন একটু খেই ধরতে পারলাম। বললাম, কিছুই নেই? কিচ্ছু নেই? সব দিয়ে বসে আছ? 

টুলু উত্তর দেওয়া আবশ্যক বোধ করলে না। চুপ করে রইল। বললাম, তবে তুমি কেন সেদিন অত করে আশা দিলে? 

টুলু ধীরে ধীরে বললে, ভুল করেছিলাম। 

—ভুল করেছিলে? এত দিন ধরে কেবলই ভুল করে গেলে? 

টুলুর মুখে ঠিক কথাটি কিছুতে যোগাচ্ছিল না। নতমুখে কিছুক্ষণ চুপ ক’রে রইল। তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বললে, আপনার অসীম স্নেহের বদলে আমি কিছু করতে চেয়েছিলাম। 

বললাম, শুধু এই? আর কিছু না? আমাকে তোমার কিছু ভালো লাগে নি? 

এবারে টুলু চোখ তুলে চাইলে। মুখখানি ওর আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, ভালো লাগে নি? খুব ভালো লেগেছিল। আপনাকে আমি জীবনে কখনও ভুলব না।

দু’জনেই যে কথা বলতে চাই, তা কেবলই জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। স্পষ্ট করে বলবার ভাষা কিছুতে মুখে যোগাচ্ছিল না। 

সমস্ত সঙ্কোচ এই প্রথম এবং শেষ বারের জন্যে সবলে দূরে ফেলে দিয়ে বললাম, ভালো লাগার কথা ভুল বলেছি টুলু, বলতে চেয়েছিলাম, ভালোবাসার কথা। না, না, এর উত্তর তোমাকে দিতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আমি জানি, আমি অনধিকারচর্চা করছি। এ শুধু আমার কৌতূহল। ইচ্ছে করলে এ প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পার। 

টুলু এক মিনিট চুপ করে থেকে বললে, নিজের সম্বন্ধে কিছু করার অধিকার আমার নেই। আমি আর কি বলব? আমার এ অপরাধ ক্ষমা করবেন। 

—ক্ষমা সব অপরাধই একে একে করতে হবে। কিন্তু এই যদি তোমার মনে ছিল, কেন আমায় অমন করে জয় করলে? কী প্রয়োজন ছিল? বেশ তো ছিলাম। 

টুলু জবাব দিলে না। বললাম, বল। 

বিব্রতভাবে বললে, ও কথার উত্তর চাইবেন না। বললাম তো ভুল করেছি।

জেদ করে বললাম, না, পাশ কাটালে চলবে না। উত্তর দিতেই হবে। বল, কেন এমন করলে? 

বললে, কি করেছি জানি না। কিন্তু আপনাকে জয় করার লোভ সামলান যে-কোনো মেয়ের পক্ষে কঠিন। যা করেছি, নিজের অজ্ঞাতসারে করেছি। করেছি স্বভাববশে। 

শ্লেষের হাসি হেসে বললাম, তোমার এই কথাটি আমিও চিরকাল মনে রাখব টুলু। মনে রাখব, একটি মেয়ের পক্ষেও আমাকে জয় করার লোভ দুর্জয় হয়ে উঠেছিল। একটি মেয়েও আমাকে তার খেলার যোগ্য মনে করেছিল। কিন্তু যাবার বেলায় ফাঁকা কথা ছাড়া আর কিছুই কি তোমার দিয়ে যাবার মতো ছিল না? 

—ফাঁকা কথা!—টুলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে,—তা হবে। অপরাধ করেছি, শাস্তি তার নিতেই হবে। কিন্তু যাবার বেলায় আপনিও কি শুধু আমায় শাস্তিই দেবেন? কেন যে চলে যাচ্ছি, একবার ভেবে দেখবেন না? 

টুলু ভালো করে মুখ তুলে চাইলে। ওর বাষ্পসমাকুল চোখ আলোয় জ্বল- জ্বল করছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। তবু নিষ্ঠুর হয়ে বললাম, কি হবে ভেবে? কি লাভ? 

টুলু তখনও এক দৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। কিছু উত্তর দিলে না। 

বললাম, তুমি গেলে সত্যিই আমি বাঁচব টুলু, বেঁচে যাব। আমি আগেই তো পাঠাতে চেয়েছিলাম। তুমিই ইচ্ছে করে যাও নি। 

টুলু চুপ করে রইল। 

বললাম, কিন্তু বেশী দয়াও ভালো নয়। তাতে ঠকতে হয়। এবারে আমি কিছুতে তোমায় পাঠাতাম না। জোর করেই আটকে রাখতাম। যদিনা…যাকগে সে কথা। 

টুলু তথাপি চুপ করে রইল। 

এতক্ষণ খেয়াল করি নি। চেয়ে দেখি, রাধা, উঠে বসেছে বিছানার উপর। অবাক হয়ে আমাদের কথা শুনছে। 

আমি উঠতে উঠতে বললাম, আর আমার কিছু জিগ্যেস করবার নেই। আমি উঠলাম। কাল সকালে ঠিকানা নিও আমার কাছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *