বসন্ত রজনী – ৮

আট 

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা কাছারী থেকে ফিরে এসে দেখি সুকোমল আমার বাইরের ঘরে বসে রয়েছে। একা। 

জিগ্যেস করলাম, এই যে! কতক্ষণ এসেছ? 

সুকোমল প্রথমে বললে, এই মাত্র। তারপর বললে, অনেকক্ষণ এসেছি। তোমার জন্যে বসে আছি। 

বললাম, পোশাকটা ছেড়ে আসি? না তাড়াতাড়ি আছে? গাড়ী ডাকতে পাঠিয়েছ?

সুকোমল বললে, পাঠাই নি। আমি বলছিলাম কি…. 

বললাম, ফিরে এসে তোমার বক্তব্য শুনছি। 

বাইরে পর্দার আড়ালে টুলু দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বাইরে আসতেই চকিতে পাশের ঘরে চলে গেল। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলাম না। বাথরুমে গেলাম। ফিরে এসে বসতেই রাধা দুজনের খাবার দিয়ে গেল। 

বললাম, একটু চা খাও সুকোমল। 

—এই খেয়ে এলাম। 

হেসে বললাম, এই আর কি করে খেলে? এসেছই তো অনেকক্ষণ। খাও, খাও, একটু মিষ্টিমুখ করতে হয়। তারপর? কি যেন বলছিলে? 

সুকোমল বিস্মিতভাবে বললে, আমি? 

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। টুলুকে নিয়ে যাওয়ার সম্বন্ধে? 

—ও! বলছিলাম, আজকে দিনটা ভালো আছে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যে…

বললাম, বেশ! বেশ! পাঁজি দেখলে না কি? 

সুকোমল গম্ভীরভাবে বললে, পাঁজি না দেখে এক পাও চলি না আজকাল। তোমার মনে নেই টুলুকে কি অদিনে দেশ থেকে নিয়ে আসি? তার ফল আজও ভুগছি। সেই থেকে… 

বললাম, না, পাঁজি মানা ভালো। তা বেশ তো, আটটার মধ্যেই নিয়ে যাবে। এখন সাতটা। আর একঘণ্টা। কিন্তু এর মধ্যে কি খাবার হবে? 

সুকোমল তাড়াতাড়ি বললে, না, না, তার অসুবিধা হবে না। আমার বাসাতে গিয়েই হবে। দূরের রাস্তা তো নয়। 

—তা অবশ্য নয়। তবে এতদিন রইল টুলু, যাওয়ার দিন না খেয়ে যাবে?

বাইরে থেকে কে যেন রাধাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলে। রাধা বললে, খেয়ে যাবে না তো কি? আমার সমস্ত রান্না হয়ে গেছে। 

বললাম, হয়ে গেছে? বেশ, বেশ। তাহলে সুকোমলের খাবার জায়গা করে দাও বরং। সময়ও তো নেই। কি বল? 

রাধা জিগ্যেস করলে, সেই সঙ্গে আপনার জায়গাও কি করে দোব? 

—আমার এখন থাক। এত সকালে আমি খেয়ে কি করব? হেসে বললাম,—আমাকে তো আর যাত্রা করতে হবে না? তাই যাও সুকোমল, ইতিমধ্যে আমিও ক’টা জরুরী কাজ সেরে ফেলি। এ ক’দিনে অনেক ক্ষতি করেছি। 

.

শেষের কথাটা একটু জোরেই বললাম। 

সুকোমল চলে গেল। আমি একটা মামলার নথি নিয়ে বসলাম। মনে হল দ্বারের পর্দার পাশে কে যেন এসে দাঁড়াল। একটুখানি শাড়ীর খস খস শব্দ উঠল। চুড়ির আওয়াজ। কিন্তু আমার সময় কই। অনেক সময় নষ্ট করেছি, অনেক ক্ষতি সয়েছি। আর নয়। 

দ্বারে পর্দা সরে গেল। শাড়ীর শব্দ আরও কাছে এল। একেবারে আমার পাশে।

বললে, তবু রাগ করে থাকবেন? আমার প্রণামও কি নেবেন না? 

টুলু এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দরী। কিন্তু আজকে যেন বিশেষ করে সাজ করেছে। মেয়েদের সাজ সম্বন্ধে আমার অজ্ঞতা সাধারণের চেয়ে একটু বেশী। সুতরাং বেশের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম। মনে হল এতদিনের মধ্যে এমন নিখুঁত করে নিজেকে সাজাতে আর কোনোদিন দেখিনি। এমন পরিপাটি করে কেশও কোনোদিন বাঁধেনি। 

আমার মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে ও লজ্জিত হচ্ছিল, সঙ্কুচিত হচ্ছিল। চোখ নামিয়ে বললে, প্রণাম করতে এলাম। 

টুলু প্রণাম করতে এল। আজকে যাবে কি না! তাই। 

আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে টুলু উঠে দাঁড়াল। বললে, অনেক দুঃখ দিয়ে গেলাম…

বাধা দিয়ে বললাম, দুঃখের কথা থাক। সুকোমলের সঙ্গে কথা হল? 

ও ঘাড় নেড়ে জানালে, হল। মুখে বললে, দেখলেন তো উনি কি হ’য়ে গেছেন?

 সুকোমল রোগা হয়ে গেছে। ওর মস্তিষ্কেরও স্থিরতা নেই। আর আমি? থাক আমার কথা। 

বললাম, ওর মনে সন্দেহ আর নেই তো? একেবারে গেছে? 

ও হাসলে। বললে, ও বিষ কি একেবারে যায়? 

—তাহলে? 

টুলু আবারও সুন্দর করে হাসলে। বললে, কি করব তাহলে? আত্মহত্যা তো আর করতে পারি না! 

বাইরের দিকে চেয়ে নিরাসক্তভাবে বললে, দু’দিনে সয়ে যাবে। 

নথির দিকে মনঃসংযোগ করে বললাম, সয়ে গেলেই ভালো। 

টুলু অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেবিলের কোণ খুঁটতে লাগল। বললে, কোনো রকমে সুখে-দুঃখে ঘর করা। শতকরা নিরেনব্বুইজন স্বামী-স্ত্রী যা করে। 

আমি উত্তর দিলাম না। ওরা স্বামী-স্ত্রী যেমন করেই ঘর করুক তাতে আমার কথা বলবার কি আছে? আমি সেখানে নিতান্তই তৃতীয় ব্যক্তি। 

টুলু হেসে বললে, আজ সমস্ত দিন ধরে ঘোমটা দেওয়া প্রাকটিস করলাম, জানেন? চিঠিপত্র লেখাও বন্ধ করব। 

নথি থেকে চোখ না তুলেই বললাম, কাকেই বা লিখবে? 

টুলু সে খোঁচা নিঃশব্দে হজম করে বললে, রাস্তার দিকের বারান্দায় কোনোদিন দাঁড়াব না। ঘরের জানালা খুলে রাখব না, জোরে জোরে হাসব না, ছাদে যদি কোনো প্রয়োজনে যেতেই হয় হামাগুড়ি দিয়ে যাব, যাতে কেউ দেখতে না পায়। সাহিত্যচর্চা তো ছেড়েই দিয়েছি। সময়ে সময়ে যাও দু’একখানা বই খুলি আর খুলব না। ব্যস, হাঙ্গামা চুকে গেল। 

টুলু ফিক ফিক করে হাসতে লাগল। 

আমি জানি ওর মনের কোনখান থেকে একথা বার হচ্ছে। নথি থেকে মুখ তোলবার উপায় ছিল না, পাছে টুলু আমার চোখে জল দেখে ফেলে। 

বললাম, সুকোমলের খাওয়া হয়ে গেল বোধ হয়। তুমিও সেরে নাওগে। সময় সংক্ষেপ। 

—হ্যাঁ, যাই। 

বলে টুলু আরও কি যেন বলবার জন্যে একটু ইতস্তত করলে। শেষ পর্যন্ত বলতে আর পারলে না। না বলে চলে গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *