বসন্ত রজনী – ৩

তিন 

পরের দিন ঘুম ভেঙে যখন উঠলাম, তখন বেলা অনেক হয়েছে। কাল সমস্ত দিন ধরে মনে অবসাদ জমেছিল। তাও আর নেই। মুখ হাত ধুয়ে এসে বসতেই রাধা চা জলখাবার নিয়ে এল। 

বললে, রাত্রে আপনার ঘুম ভাল হয়েছিল তো? 

—ভালোই হয়েছিল। কিন্তু এসব আবার কেন, চা জলখাবার?

কুণ্ঠিতভাবে রাধা বললে, সকালে আপনি জলখাবার খান না?

—খাই। তবে—

যাক্ গে। রাধাকে ইঙ্গিতে বোঝানো অসম্ভব। জিজ্ঞেস করলাম, টুলু উঠেছে?

—উঠেছেন। কাল সমস্ত দিন তো জলবিন্দুও খান নি। জোর করে মুখে কিছু দিয়ে এলাম। গুরুদেব বলতেন, চক্ষু বুজলেই সকলি অন্ধকার। 

রাধা দোরগোড়াতেই ভক্তিযুক্ত হয়ে বসল। পরনে তার চওড়া লাল পাড় গরদের শাড়ী। মাথায় ভিজা এলোচুল পিঠের কাছে গেরো দেওয়া। টিকলো নাকটির উপর পরিপাটি করে সরু রসকলি এঁকেছে। মনে হয় একটু আগে পূজো সেরে উঠেছে। মুখে শিশুসুলভ অর্থহীন হাসি। ওকে দেখলে গত কালের ঘটনা ভুল হয়ে যায়। মুখে-চোখে শোক-দুঃখের চিহ্নমাত্র নেই। দেখে আমার কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। 

বললাম, চল, টুলুর ঘরে যাওয়া যাক! 

—চলুন। 

টুলু তখন খাটের বাজুতে মাথা রেখে চুপ করে পড়েছিল। কাঁদছিল না, বোধ হয় কিছু ভাবছিল। আমার পায়ের শব্দে প্রথমটা চমকে উঠল। বোধ হয় অন্যমনস্কতার জন্যে। তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, আসুন। 

কেঁদে কেঁদে ওর চোখ জবাফুলের মতো লাল হয়েছে। আলুথালু বেশবাসে নিদারুণ শোকাবহতা। নিঃশব্দে একখানা চেয়ার টেনে বসলাম। কিছুই বললাম না। মনে হল ওরই যেন কিছু বলার আছে। নীরবে তারই প্রতীক্ষা করতে লাগলাম অন্য দিকে চেয়ে। 

অকস্মাৎ টুলু আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলে। অত্যন্ত শীর্ণ ম্লান এক টুকরো হাসি। সে হাসি যেন কালের স্রোতে অসহায়ভাবে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে গেল। মনে হল বলতে চাইলে, এইবার? এইবার কি? 

রাধা ধীরে ধীরে ওর পিঠের কাছে বসে স্নেহভরে চুলের জট ছাড়াতে বসল।

টুলু বললে, আমি বড় ভাগ্যবতী, না মৃণালবাবু? যেখানে গেছি সেখানেই আগুন জ্বালিয়েছি। এর পর কার ঘাড়ে গিয়ে চাপি বলুন তো? 

আমি চুপ করে রইলাম। 

টুলু আবার বললে, অজয়দার খুড়তুতো ভায়েরা এখনও খবর পান নি। দু’তিন দিনের ভেতর পেয়ে যাবেন নিশ্চয়। খবর পাওয়ার পর যে বাড়ী দখলের জন্যে বিলম্ব করবেন এমন মনে হয় না। 

সে বিষয়ে আমিও নিঃসংশয়। 

টুলু বলতে লাগল, এই দু’তিন দিন এখানে থাকা চলবে। তারপর? 

সংস্কারের চেয়ে করুণা আমার মনে প্রবল হয়ে উঠল। বললাম, তারপরেও তুমি জলে পড়বে না টুলু। আমি তো রয়েছি। 

টুলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, হ্যাঁ। সেই আমার শেষ ভরসা! কিন্তু সে কি আপনার সুবিধা হবে? 

বললাম, আমার জন্যে ভেব না টুলু। আমার অসুবিধা কিছুই হবে না। কিন্তু তার আগে তোমার মাকে একখানা চিঠি দেওয়া দরকার। 

টুলু চমকে বললে, কে? 

বুঝিয়ে বললাম, তাঁর আশ্রয়ই তোমার পক্ষে সবচেয়ে নিরঙ্কুশ। রাগের মাথায় যাই তিনি বলে থাকুন, তিনি তো মা! কিছুতেই তোমাকে ফেলতে পারবেন না। 

টুলু অবিশ্বাসের সঙ্গে হাসলে। 

বললে, না। সেখানে কোন সুবিধার আশা নেই। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

টুলু রাধার হাত থেকে এলোচুলগুলো মুক্ত করে নিয়ে আর একটু সরে বসল।

বললাম, তবে আমার ওখানেই চল। সেখানে যাওয়ার জন্যে অনেক ক্ষতি অবশ্য তোমাকে সইতে হবে। জানোই তো, আমার বাড়ীতে আর স্ত্রীলোক কেউ নেই। 

পায়ের আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে কথাটা সে ভালো করে ভাবতে লাগল।

বললাম, অনেক সাহসের দরকার হবে। 

ভাসা ভাসা নিস্পৃহ চোখ তুলে টুলু বললে, সাহস ছাড়া আর আমার কি রইল বলুন।

কিছুক্ষণ ওর চিন্তাক্লিষ্ট অবসন্ন মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললাম, তবে তাই চল। আমি বলি, আজ বিকেলেই তো আর…. 

টুলু সাগ্রহে বললে, বিকেলেই তো ভালো। এখানে আর এক দণ্ড থাকতে পারছি না। বাধা দিয়ে বললাম, সে তো হয় না টুলু। এ বাড়ীর যাঁরা মালিক তাঁরা আসুন। সমস্ত বুঝেসুঝে নিন। তারপরে। 

টুলু বললে, তাঁরা যদি এখন না আসেন? 

আমার ওকালতি করাও তো অনেকদিন হল! প্রাপ্য সম্পত্তির দখল নিতে দেরী করবে এমন বোকা বেশী নেই। হেসে বললাম, তা কি হয়। তাঁরা এলেন বলে! হয়তো আমরা যা ভাবছি তারও আগে এসে পড়বেন। 

উদাসকণ্ঠে টুলু বললে, এলেই ভালো। 

এ ব্যাপারের এখানেই নিষ্পত্তি হল। এবার রাধা। 

রাধার দিকে চেয়ে বললাম, তুমি তো এখান থেকে বৃন্দাবন যাচ্ছ। 

রাধা বাইরের দিকে চেয়ে অন্যমনস্কভাবে কি যেন ভাবছিল। আমার কথা শুনে বিস্মিতভাবে বললে, কেন এখানে তো বেশ আছি। 

সে আবার কি কথা! যেতে তো কোথাও হবেই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে টুলুর দিকে চাইতে টুলু বললে, থাকনা এখন ক’দিন। 

বেশ! 

রাধা গম্ভীরভাবে বললে, আমি টুলু-দিদিমণিকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।

আমি আর কিছুই বললাম না। থাকে থাক। বরং ও থাকলে টুলুও একজন সঙ্গী পাবে। টুলুর পক্ষে সে বড় কম নয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *