বসন্ত রজনী – ৪

চার 

আমার বাড়ীটা বড় নয়। তবে এদের অসুবিধা হওয়ার মতো ছোটও না। তেতলার ঘর দু’খানি দিয়েছি টুলু আর রাধাকে ছেড়ে। দোতলার দু’খানি এতদিন পড়েই ছিল। আমি ব্যবহার করছি সেই দু’খানি ঘর। নীচের তলায় আমার বসবার ঘর। 

মৃত্যুশোক সামলাতে মানুষের বেশী দেরী লাগে না। শোক যেখানে শুধু বিচ্ছেদের দুঃখ, সেখানে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলে। সেখানে শুধু তা নয়, যেখানে দুঃখের সঙ্গে আছে বিপদ, সেখানে মানুষকে দুঃখ ভুল বুক বাঁধতে হয়। টুলুর হল তাই। দু’দিনের মধ্যে তাকে সামলে নিতে হল। শোক করার অবসরকে সে কমিয়ে আনলে। তার জন্যে আমার ঠাকুরটির গেল চাকরী। 

টুলু দু’বেলা রাঁধে। আমার জামা-কাপড় ধোপাবাড়ী দেয়, কোথাও ছিঁড়ে গেলে রিপু করে! মুদী-গয়লা-বাজারখরচের হিসাব রাখে। আরও নানা কাজ করে। রাধা আমার ঘর দোর-পরিষ্কার রাখে। ছাদের আলশের টবে নানা ফুলের গাছ লাগিয়েছে, দু’জনে মিলে বিকেল বেলায় তাতে জল দেয়। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে রাধা এক ব্রজকিশোর প্রতিষ্ঠা করেছে। রোজ সকালে ফুলের মালা গেঁথে ঠাকুরের গলায় দেয়, আর আপনি পরে। কিছু ফুল আমিও পাই। রোজ সকালে একটি ছোট রেকাবীতে করে আমার টেবিলে সাজিয়ে রেখে যায়। এর উপর টুলুর দর্জির কাজ তো আছেই। আজকে টেবিলের ঢাকা তৈরী করছে, কাল আবার আমার একটা পাঞ্জাবী তৈরীতে হাত দিলে। শীত আসতে দেরী আছে, কিন্তু এরই মধ্যে ওর আয়োজন আরম্ভ হয়ে গেছে। এক জোড়া মোজা তৈরী আরম্ভ হয়েছে। তারপরে একটা গলাবন্ধ তৈরী হবে তাও জানিয়েছে। মোটের উপর ওদের দু’জনের হাতে পড়ে এই ক’মাসেই বাড়ীর শ্রী গেছে ফিরে। মেঝে থেকে সীলিং পর্যন্ত সমস্ত ঝকঝক তকতক করছে। এখন আর আমাকে কাছারী থেকে ফিরে এসে বাজারের খাবার খেতে হয় না। বন্ধু-বান্ধব এলে এক পেয়ালা চায়ের জন্যও অনাবশ্যক কাল অপেক্ষা করতে হয় না। অবাক হয়ে ভাবি, ঠিক কোন সময়ে কোন জিনিসটা আমার দরকার টুলু জানতে পারে কি করে? 

টুলুর মাকে পর পর দু’খানা চিঠি দিয়েছি। অবশ্য ওকে না জানিয়েই। একখানারও উত্তর এল না। বোধ করি কলঙ্কিনী মেয়ের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ রাখতে চান না তিনি। বৌদির কাছেও চিঠি লিখেছি। অনেকদিন পরে সম্প্রতি তিনি জবাব দিয়েছেন, এলাহাবাদ থেকে। ঘর-গৃহস্থালীর অনেক খুঁটিনাটি সংবাদ দিয়ে শেষের দিকে টুলুর সম্বন্ধেও দু একটা কথা লিখেছেন। তারও সুর যেন বাঁকা-বাঁকা। বুঝলাম, ওদিকে বিশেষ ভরসা নেই। এখন একমাত্র আশা সুকোমলের। তার মন ফিরলেই একসঙ্গে সকল দিকের হাওয়া ফিরবে। 

কিন্তু কি জানি কোথায় যে আমার মনের মধ্যে দুর্বলতা জমেছে, নিজে তার কাছে যেতে সঙ্কোচ বোধ করছি। এতদিন সুকোমলই হয়তো আমার কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা পেত। অন্তত আমি মনে করতাম অপরাধ তারই। লজ্জাও তারই হওয়ার কথা। কিন্তু এখন যেন সব উলটে গেছে। এখন প্রত্যহ যাই-যাই করেও তার কাছে যেতে পারছি না। কি কারণে বাধছে জানি না। 

হয়তো সংস্কার। বহুকালের বহুপুরুষের পাপ-পুণ্য ভালোমন্দ বোধের বোঝা রয়েছে রক্তের মধ্যে। এড়িয়েও এড়ানো যায় না। জট ছেড়েও ছাড়ে না। মানুষের মন কোনকালেই যথেষ্ট সবল নয়। তার মনের শেষ দুর্বলতার মধ্যে সংস্কার বাসা বাঁধে। এক পুরুষের সাধনায় এর হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। যুক্তি দিয়ে, তর্ক করে নিজেকে নিজে অনেক বোঝাই। সংস্কার যায় উড়ে। তবু কোথায় যেন একটুখানি কালো ছায়া ফেলে রেখে যায়। সে ছায়া পাপের। আশঙ্কা করছি, এই পাপ আমাকে স্পর্শ করেছে। সেই জন্যেই আমি সুকোমলের কাছে যেতে সঙ্কোচ বোধ করি। 

দেখতে দেখতে মনে হল টুলু যেন তার নিজেকে সম্পূর্ণ করে ফিরে পেয়েছে। মনে হল—মনে আর তার দ্বিধা নেই, কিছু নেই। নিজেকে যেন সে নিশ্চিন্ত চিত্তে আমার গৃহে প্রতিষ্ঠিত করেছে। হাসিতে, গানে, গল্পে বর্ষার ভরা নদীর মতো আবার সে ফেঁপে উঠল। নীচে বসে তার কলহাস্য শুনতে পাই। অবসরক্ষণে বসে দু’দণ্ড হাসি-গল্প করে আমিও যেন বেঁচে যাই। একটা রেডিও সেট তো আছেই, তার উপর নতুন একটা গ্রামোফোন এসেছে। ক’দিন থেকে বার বার তেত্রিশ কোটি দেবতার পায়ে মাথা কুটছে, এ মাসে রোজগার যেন আমার বেশী হয়! একটা হার্মোনিয়ম না হলে তার আর চলছে না। শেখা গান ভুলে যেতে বসেছে। টিয়া পাখী আমার বাড়ীতে এসে গান ভুলে যাবে এ কলঙ্কও দুঃসহ। আসছে মাসের প্রথমে যা করে হোক হার্মোনিয়ম একটা কিনে দিতেই হবে। 

কিন্তু রাধাকে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। সে থাকে দিবারাত্রি টুলুর কাছে কাছে। দাসীর মতো তার সেবা করে। বড় বোনের মতো ক্ষুধা না থাকলেও জোর করে খাওয়ায়। সে হাসলে হাসে, মুখ ভার করে থাকলে কি করবে ভেবে না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। কোথাও তার যেন সত্ত্বা নেই। রাধা টুলুর ছায়া, টুলুর প্রতিধ্বনি। 

মাঝে মাঝে চাঁদিনী রাতে ছাদে আমাদের সাহিত্য সভা বসে। রাধা মনোযোগের সঙ্গে সমস্ত আলোচনা শোনে, হাসির কথায় আমরা হেসে উঠলে সেও হাসে। আর যদি কোনোদিন তর্ক তুমুল হয়ে ওঠে, সে শশব্যস্তে যাহোক একটা কিছু ব’লে আপোস- মীমাংসার চেষ্টা করে। তাতে আর কিছু হোক না হোক প্রচুর হাসির খোরাক মেলে। কিন্তু আমাদের পরিহাসে সে রাগ করে না। পরমানন্দে পরিপাক করে। 

সেদিন গিয়েছিলাম সিনেমায়। মাঝে মাঝে যাই আজকাল। ছবিটি বড় ভালো লেগেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের একটি দ্বীপ। সমুদ্র গর্জন করছে। তীরে নারিকেল বনশ্রেণী চোখে স্বপ্নের অঞ্জন লাগায়। সেইখানকার একটি প্রেমের ঘটনা নিয়ে বই। কাছের মানুষকে আরও কাছে পাওয়ার যে বাধা তাই ছবির বিষয় বস্তু। প্রচলিত সমাজবিধি, সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে উদ্দাম উদারতাকে খর্ব করে আনার সনাতন প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে যে সমস্ত বাধা, বড় প্রেমের জন্যে মানুষকে যে সমস্ত বড় দুঃখ সইতে হয়, সইতে হয় যে মর্মান্তিক লাঞ্ছনা, স্তব্ধ হয়ে তাই চলেছিলাম দেখে। নিজেকে ছবির নায়কের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে কখনও সমুদ্রে দিচ্ছিলাম ঝাঁপ, কখনও পাহাড়ে উঠে শিকারীর মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলাম কোথায় প্রিয়া। যখন ছবি শেষ হল নিজের অজ্ঞাতসারে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। আলো জ্বলে উঠেছে। পাশে চেয়ে দেখি, টুলুর চোখে জল। তখনও স্তব্ধভাবে ঠায় বসে আছে। 

বললাম, চল। 

টুলু নিঃশব্দে আমার পিছনে বেরিয়ে এল। 

বাড়ী ফিরে জিগ্যেস করলাম, বেশ ছবি! না? 

তখনও টুলুর সম্পূর্ণ ঘোর কাটেনি। আধ মিনিট ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, বেশ ছবি। 

বললাম, তপস্যা নইলে বড় বস্তু মেলে না। কি বল? 

টুলু ঘাড় নেড়ে বললে, হ্যাঁ! 

হঠাৎ এক সময় জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা, একটা কথা ভাবছি টুলু, অত দুরন্ত যে সাধনা, অত বড় ক্লেশ স্বীকার, কিন্তু তার বদলে কী ও পেলে? কী সে বস্তু? 

টুলু বিস্মিতভাবে বললে, আবার কি পাবে? যাকে চেয়েছিল তাকেই তো পেলে?

আমি মুখ টিপে একটু হাসলাম। বললাম, মনে কর আরও দশ বছর যদি ওকে এমনি করে ঘুরতে হত, আরও বিশ বছর? কী পেত তাহলে? ওর নিজের বয়স তখন যদি হত ষাট, আর মেয়েটির পঞ্চান্ন। মনে কর, একজনের তখন দাড়ি হয়েছে কাশ ফুলের মতো, আর একজনেরও চুল ধরেছে পাক, চামড়া হয়েছে লোল, নলিননয়নের কটাক্ষ গেছে হারিয়ে। তাহলে? 

টুলু অকস্মাৎ শিউরে উঠল। এক মিনিট কি যেন ভাবার চেষ্টা করলে। বললে, কি জানি? 

—আমি জানি। দু’জনেই হতাশভাবে সেদিন ভাবত কি মিথ্যে পণ্ডশ্রমই করা গেল!

টুলু নিঃশব্দে নতনেত্রে তার হাঁটুর কাছের শাড়ীর পাড়টা সমান করতে লাগল।

বললাম, ক’টা বছর আগে পেয়েছে বলেই এমন সার্থক হল। নইলে সবই মিথ্যে হয়ে যেত টুলু, সমস্ত ক্লেশ স্বীকারই মিথ্যে হয়ে যেত। 

টুলু বললে, কেন বুড়ো-বুড়ী কি ভালোবাসে না? 

হেসে বললাম, বাসে। কিন্তু মাদকতা তারা কোথায় পাবে? কোথায় পাবে হাঙরের দাঁতের পাশ দিয়ে তীরের মতো জল কেটে যাওয়ার সাহস? কোথায় বা পাবে গিরি- নদী-বন পার হওয়ার উত্তেজনা? স্থাণু মন কি এত বড় ক্লেশ স্বীকার করতে পারে? 

টুলু কিছুই বললে না। বোধ হয় কথাটা মনে-মনে ভাবতে লাগল। 

ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পট্ করে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা তুমি যদি নায়িকা হতে কি করতে? 

টুলু বিহ্বল চোখ তুলে বিব্রতভাবে বললে, আমি তো সাঁতার জানি না মৃণালবাবু। 

এর চেয়ে ভালো উত্তর আর হতে পারে না। যে সাঁতার জানে ওই অবস্থায় পড়লে সে সাঁতার কেটেই যায়। যে জানে না সে করবে কি? জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে? তীরে আছড়ে পড়ে অসহায়ভাবে অশ্রু বিসর্জন করবে? বুক চাপড়ে নদীর ধারে ধারে ছুটে বেড়াবে? সে কান্নায় আকাশ হয়তো ব্যথিত হবে, নারিকেল বনশ্রেণী করুণভাবে মাথা নাড়বে, বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে নামবে বিষণ্ণ ছায়া। যা যা আবশ্যকীয় সবই হবে, কেবল গল্প জমবে না। টুলু অজ্ঞাতসারেও বুঝতে পেরেছে সমস্ত গল্পটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই হাঙরের দাঁতের পাশ দিয়ে জল কেটে যাওয়ায় আর অসীম সাহসিকতায় গিরি- নদী-বন পার হওয়ায়। 

ইতিমধ্যে রাধা এক থালা গরম লুচি নিয়ে উপস্থিত হল। এরই মধ্যে কখন সে শুদ্ধ কাপড় পরেছে এবং লুচিও ভেজেছে। সেইজন্যে রাধাকে আমার এত ভাল লাগে। সে যা জানে না তার জন্যে সময়ক্ষেপও করে না। তাই আমরা দু’জনে যখন ছবি নিয়ে গবেষণা করছি সে তখন গভীর মনোযোগের সঙ্গে লুচি ভেজেছে। ভালোই করেছে। তর্কের কল্যাণে আমি বেশ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিলাম। 

ঘরের হাওয়া বদলাবার জন্যে আমি হেসে টুলুকে বললাম, জানো না সাঁতার? তাহলে চটপট শিখে নাও। 

টুলুও হেসে ফেললে। 

রাধাকে জিগ্যেস করলাম, ছবি কেমন লাগল রাধা? 

রাধা ঠোট উলটে বললে, ছাই। কী যে সাহেব মেমের নৃত্য আপনাদের ভালো লাগে আমি তো বুঝি না। 

—তোমার ভালো লাগে না? 

নাক সিঁটকে রাধা বললে, ওর আমি এক বর্ণও বুঝি না। তার চেয়ে সেদিন যে প্রহ্লাদ চরিত্র দেখলাম … 

আমরা দু’জনেই হেসে উঠলাম। 

রাধা রাগ করে বললে, তা হাসুনই আর যাই করুন, আমার কাছে লুকোছাপি নেই। স্পষ্ট কথা বলে দিলাম। 

আমি হাসি থামিয়ে বললাম, সত্যি কথা বলতে কি, আমারও ভাল লাগে না রাধা। শুধু টুলুর খাতিরে যাই। 

রাধা গম্ভীরভাবে বললে, ওর যত অদ্ভুত বাই। 

.

সকাল বেলায় টুলু এসে বললে, দেখি, চরণ দু’খানি বের করুন তো।

বিস্মিতভাবে বললাম, সকাল বেলায় হঠাৎ চরণ দু’খানির প্রয়োজন হল? কি ব্যাপার? 

কাপড়ের ভেতর থেকে এক জোড়া মোজা বের করে হাসতে হাসতে বললে, দেখি ঠিক হল কি না। 

হাত বাড়িয়ে বললাম, আমাকে দাও দেখছি। 

টুলু এক পা পিছিয়ে গিয়ে ঘাড় নেড়ে বললে, সে হবে না। আমি নিজে পরিয়ে দোব। 

টুলু ঘাড় নেড়ে হাত নেড়ে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললে। শেষে বাধ্য হয়ে বের করতে হল চরণ দু’খানি। ও যখন জেদ করে তখন নোয়ানো অসম্ভব। 

টুলু আমার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে একটি একটি করে মোজা পরিয়ে দিতে লাগল। বললে, আমি পা ছুঁলে দোষ হবে নাকি? 

বললাম, না দোষ নয়। তবে পা আমি কাউকে ছুঁতে দিই না। 

টুলু মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললে, আমাকে দিতে হবে।

আবার বললে, আর কেউ পা ছুঁতে এসেছিল নাকি? 

বললাম, আমার পা ছুঁতে কে আর আসবে? 

—তবে যে বললেন পা ছুঁতে দেন না। আপনার পা ছুঁচ্ছে কে? কার এত গরজ পড়েছে? 

হেসে বললাম, তা ঠিক। 

পায়ের সঙ্গে মোজা বেশ টান করে পরিয়ে দিয়ে টুলু দাঁড়িয়ে উঠে বললে, দেখুন তো কি চমৎকার ফিট করেছে! এমন মোজা পরেছেন কোনোদিন? 

—পরিনি। মোজা অনেক পরেছি টুলু, কিন্তু তার কোনোটাই বিশেষ করে আমার জন্যে তৈরী হয়নি। 

তারপরে একটু বিশেষভাবে হেসে বললাম, এমন যত্ন করে কেউ পরিয়েও দেয়নি।

টুলু মাথায় একটা ঝাঁকি দিয়ে বললে, যান। 

বলেই ছুটে বেরিয়ে গেল। আমি একটু হেসে আরাম কেদারায় আবার ভালো করে শুলাম। 

আধ ঘণ্টার মধ্যেই আবার টুলু ফিরে এল। দোর গোড়া থেকে বললে, বাঃ! দিব্যি শুয়ে আছেন যে! আজ কাছারী নেই বুঝি? না? 

 ওঠবার কোন লক্ষণ না দেখিয়ে বললাম, আছে বই কি। আর কিছু না থাক ওইটে আছে।

কোপ কটাক্ষ হেনে টুলু বললে, থাকবে না কেন? রাগটুকু তো ষোল আনার ওপর আঠারো আনা আছে। 

—রাগের কথাটা কি হল? 

টুলু ঘাড় নেড়ে বললে, হল না হল আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারব না। কাছারী যদি যেতে হয় উঠতে হচ্ছে। দশটা বেজে গেছে। 

চমকে উঠলাম। আজ আমার একটা জরুরী মামলা আছে। সবিস্ময়ে বললাম, দশটা বেজে গেছে? 

—বাজবে না? ঘড়িটা তো আর রাগ করেনি? 

জামা খুলতে খুলতে বললাম, আমিও রাগ করিনি। 

—না, করেন নি! থাকা না থাকার কথাটা তবে তুললেন কেন? আপনার যা আছে তাই বা ক’জনের আছে? সকলের কি সব থাকে? আমার যে কিছুই নেই! 

এবারে টুলুর দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললাম, কিছুই নেই কি করে জানলে? 

ঘাড় নীচু করে টুলু বললে, সে আমি জানি। 

—তুমি কিছুই জান না। 

টুলু হেসে ফেললে। বললে, বেশ, জানি না তো জানি না। আপনি উঠুন দেখি।

টুলু চলে গেল। 

.

কিছুই নেই একথা বলা ঠিক হয়নি। ওর দুঃখ দূর করার জন্যে আমি যে কি করি সে কি তা জানে না? ওর জীবনাযাত্রায় আমার কি কোনো স্থান নেই? 

কিন্তু তখনই ও ফিরে এল। বললে, যাকগে। কখন ফিরছেন বলুন তো? 

—যেমন ফিরি। 

—মানে পাঁচটা, ছ’টা? 

—মানে সাতটা, আটটা। 

টুলু ঘাড় নেড়ে বললে, সে হবে না। আজকে ছ’টার মধ্যে ফিরতেই হবে। 

—ফিরতেই হবে? ব্যাপারটা কি? 

ও মুখ নীচু করে হাসতে হাসতে বললে, ব্যাপারটা থিয়েটার। টিকিট কেনা হয়ে গেছে। রাধার জন্যেই কেনা। বেচারী সিনেমা দেখে দেখে হয়রান হয়ে গেছে। আসছেন তো ঠিক? 

বললাম, আসব। 

বললে, ঠিক? নইলে রাধা ভীষণ চটবে। 

মনে হল দরজার আড়াল থেকে কে যেন দ্রুতপদে পালিয়ে গেল। টুলু বললে, ওর জন্যে এত খরচ করে টিকিট কেনা হয়েছে শুনে পর্যন্ত ও আর এদিক মাড়াচ্ছে না। 

হাসতে হাসতে বললাম, তার আর লজ্জা কি? ইচ্ছে হয়েছে, দেখবে না? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *