নিরুদ্দেশের দেশে – ৯

আমি ঘড়ি পরি না, এখানে কেউই ঘড়ি ব্যবহার করে না, আকাশের ঘড়িই ভরসা। সকালের রোদ দেখে মনে হলো নটা–সাড়ে নটা বাজে। আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে বেশ ভরাট ব্রেকফাস্ট হলো, সঙ্গে দু’ কাপ করে চা। বন্দনাদি বলল, শোনো, তোমরা যে আমার সব খাবার খেয়ে নিচ্ছ, তার জন্য তোমাদের কিন্তু দু’দিন আমার বাগানে কাজ করে দিয়ে যেতে হবে। চা–টা অবশ্য নীলু এনেছে!

জয়দীপ বলল, আমি তোমার বাগানের মাটি কুপিয়ে দেব!

রোহিলা বলল, আমি জল এনে দেব নিচ থেকে?

আমি বললুম, আজকের দিনটা ছুটি নিলে হয় না? আমি তো আর এখানে রোজ রোজ থাকছি না।

চোখে এখনো ঘুমের আবেশ লেগে আছে। আড্ডা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। চা জিনিসটাকে এত প্রিয় আগে কখনো মনে হয়নি। বৃষ্টি উধাও হয়ে গেছে, আজ আকাশে রোদ বেশ চড়া।

পুরোনো অভ্যেসে আমি বলে ফেললুম, এখন কটা বাজে?

সবাই হেসে উঠল, বন্দনাদি বলল, কেন, তোর অফিস যাবার তাড়া আছে নাকি? তুই তো বেকার!

ঘড়ির প্রসঙ্গ উঠতে জয়দীপ জানাল যে এখানে আসবার সময় তার হাতে একটা ঘড়ি ছিল। সেটা কোয়ার্টজ ঘড়ি, দম দিতে হয় না। এখানে কোনো ঘড়ির পাট নেই দেখে সেটা সে নদীর ধারে বালিতে পুঁতে রেখেছে

বন্দনাদি বলল, কোথায় রেখেছ মনে আছে? তাহলে নীলুকে দিয়ে দিতে পার। শুধু শুধু নষ্ট করে কী হবে?

জয়দীপ বলল, কী জানি, ঠিক জায়গাটা খুঁজে পাব কি না!

আমি বললুম, যাক ভালোই হয়েছে। ঘড়ি আমার সহ্য হয় না। ঘড়ি পরলেই আমার মাথা ধরে।

বন্দনাদি বলল, অনেকের কিন্তু পুরোনো অভ্যেস রয়ে যায়। আমি দেখেছি, এখানে কেউ কেউ কথা বলবার সময় বাঁ হাতটা ঘুরিয়ে দেখে নেয়। তারপর আকাশের দিকে তাকায়।

রোহিলা বলল, আমার তো এক সময় ঘড়ি ছিল একটা গয়না। ঘুমের মধ্যেও ঘড়ি হাতে থাকত।

জয়দীপ বলল, আমি তো এক একদিন সুইমিংপুলে নামার সময়ও ঘড়ি খুলতে ভুলে যেতাম!

রোহিলা যেন হঠাৎ কিছু আবিষ্কার করার মতন চেঁচিয়ে বলল, এই!

তারপর চোখ বড় বড় করে আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, কাল রাত্রে আমাদের নদীর ধারে ঘুমোনো হয়নি। আজ এখন সবাই মিলে নদীতে স্নান করতে গেলে কেমন হয়?

জয়দীপ বলল, ভালো আইডিয়া! সাঁতার কাটতে আমার খুব ভালো লাগে! আমি বন্দনাদির মুখের দিকে তাকালাম। বন্দনাদি খানিকটা অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, আমার বাগানে অনেক কাজ পড়ে আছে…রাত্তিরে গেলে হয় না? রাত্তিরবেলা, একটু একটু জ্যোৎস্নার আলো, তখন আরো ভালো লাগবে!

এক একটা কথা হঠাৎ হঠাৎ ছবি হয়ে যায়। আমি এক পলকের জন্য দেখতে পেলাম রাত্তিরবেলা নদীর জলে কয়েকজন নারী–পুরুষের স্নানের দৃশ্য। হ্যাঁ, দিনের বেলার ছবির চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।

রোহিলা বলল, অতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকতে পারব না। চলো, এক্ষুনি চলো! বন্দনাদি, প্লিজ চলো!

–তোমাদের জামাকাপড় আনতে যেতে হবে তো তাহলে? জলে নামবে কী পরে?

–আমি তো জামাকাপড় খুলেই—

বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল রোহিলা। লজ্জা পেয়ে বলল, না, তা বোধহয় চলবে না? তাহলে কী করবে বলো।

—তুমি তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে, তুমি কিছু না পরেই জলে নামতে পার। কিন্তু আমরা তো তা পারব না!

জয়দীপ বলল, চলো, চলো, বন্দনা। একটা–দুটো তোয়ালে নিয়ে চলো, তাতেই হয়ে যাবে!

বন্দনাদি ঘরে গিয়ে একটা পুঁটুলি তৈরি করে নিয়ে এলো। তারপর শুরু হলো স্নান–যাত্ৰা।

মধ্য–যামিনীতে যে–পাথরের বেদিটার ওপরে বসেছিলাম, সেটার কাছে আসতেই বন্দনাদি তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি হাসলুম। বন্দনাদির গোপন কথা আমি বুকের অনেক ভেতরের সিন্দুকে বন্ধ করে রেখেছি।

একপাল ছাগলছানা নিয়ে ওপরের দিকে উঠে আসছেন এক ভদ্রলোক। একটু কাছে আসতেই চিনতে পারলুম, এঁকেই কাল বন্দনাদি প্রভাসদা বলে ডেকেছিল। ভদ্রলোকের চেহারা তবলচির মতন, ছাগল–পালকের ভূমিকায় তাঁকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, বন্দনা, দলবল নিয়ে কোথায় চললে? আমি তোমার কাছেই আসছিলুম!

বন্দনাদি বলল, আপনার সঙ্গেও তো দলবল কম নেই দেখছি! আমরা নদীতে স্নান করতে যাচ্ছি।

ভদ্রলোক বললেন, তাহলে আমিও তো গেলে পারি। কিন্তু এদের নিয়ে কী করি? এদের ছেড়ে দিলেই তোমার বাড়ির দিকে চলে আসে।

–তাই নাকি? ওরা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে!

—ছাগল তো পাহাড়ী জীব, ওরা সব সময় উঁচুতে উঠে বসে থাকতে ভালোবাসে! ওদের মালিক যে তোমাকে ভালোবাসে, সেটাও ওরা বুঝে ফেলেছে! –

বন্দনাদি খপ করে একটাকে ধরে কোলে তুলে নিল। ছাগলছানার সঙ্গে হরিণছানার বিশেষ কোনো তফাৎ নেই, রংটা ছাড়া। মুখখানাতে যেন মানবশিশুর চেয়েও বেশি লাবণ্য। বন্দনাদির বুকে সেটা ছটফট করে।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, প্রভাসদা, কাল রাত্তিরে দ্বিতীয়বার মাদল বেজেছিল কেন?

–সেকথা তো আমি তোমাকেই জিজ্ঞেস করতে আসছি। তোমাদের এদিকেই বেজেছিল না?

—না তো! আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে!

–আমার বাড়ি থেকেও তো অনেক দূরে মনে হলো, তাই আমি যাইনি! ছাগল ছানাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বন্দনাদি ছদ্মকোপে বলল, প্রভাসদা! আপনার মনে হয়েছিল বাজনাটা আমার বাড়ির দিকে। তা আপনি ছুটে আসেননি কেন? এই আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা!

এ কথার উত্তর দিলেন না প্রভাসদা। ছাগলছানাগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে যাচ্ছিল, তিনি তাদের সামলাবার জন্য ছড়ি তুলে এই হ্যাট হ্যাট বলে ছুটে গেলেন এবং ধুতির খুঁটে পা জড়িয়ে আছাড় খেলেন প্ৰকাণ্ড।

আমরা হাসি চাপতে পারলুম না। প্রভাসদা আগের জীবনে তবলচি ছিলেন কিংবা ইংরিজির অধ্যাপক ছিলেন তা জানি না, কিন্তু এখানে ছাগল–চরানোর ভূমিকাটা তিনি এখনো রপ্ত করতে পারেননি।

জয়দীপ এবং বন্দনাদি ছুটে গিয়ে ওঁকে টেনে তুলল।

প্রভাসদা উঠে বসে বন্দনাদির দিকে চেয়ে বললেন, আমি জানতুম, কাল তুমি কোনো বিপদে পড়লেও তোমাকে সাহায্য করার অনেক লোক আছে।

বন্দনাদি বলল, প্রভাসদা, তুমি তোমার পোষ্যদের কী ব্যবস্থা করবে করো। তারপর এসো। আমরা নদীর দিকে এগোচ্ছি।

টিলার নিচে নেমে আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, তোমার অঙ্কের মাস্টার প্রেমিকটিকেও ডেকে নেবে নাকি?

—ডাকব? ওকে কেউ ডাকে না। আমরা ডাকলে খুব খুশি হবে!

–হ্যাঁ, ডাকো না। মোর দা মেরিয়ার।

—না থাক। বুড়ো মানুষ, নদীতে স্নান করলে যদি অসুখ–বিসুখ বেধে যায়! বৃদ্ধকে দেখা গেল নিজের বাড়ির উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছেন। হাতে একটি খোলা বই।

—বই? এখানে বই থাকে বুঝি?

বন্দনাদি বলল, কেন থাকবে না? বই ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে নাকি? এখানে অনেকেই তো মাঝে মাঝে শহরে লোক পাঠিয়ে বই আনায়।

–তোমার বাড়িতে কোনো বই দেখিনি। তোমার দরকার থাকলে আমি নিয়ে আসতে পারতুম।

–না, আমি এখন বই পড়ি না। বই আমাকে বড় উতলা করে দেয়।

কুয়োর ধারে দু’বালতি জল কেউ তুলে রেখে গেছে। কয়েকটা পেয়ারা আর দুটো ভুট্টাও রেখে গেছে কেউ। ঐ বৃদ্ধের জন্যই নিশ্চিত।

আমি রোহিলাকে বললুম, জানো তো, ঐ বুড়ো লোকটি বন্দনাদিকে বিয়ে করার জন্য ঝুলোঝুলি করে।

রোহিলা হি হি করে হেসে উঠে বলল, তাহলে বেশ মজা হতো! এখানে সত্যি সত্যি কারুর সঙ্গে কারুর বিয়ে হয়?

বন্দনাদি বলল, জয়দীপ, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে দেবদত্ত আর সহেলীর কথা? দু’জনের চরিত্রে কোনো মিল নেই, বুঝলি। সহেলী নাকি একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল, তারপর বেঁচে গেছে বলে জীবনটাকে পূর্ণমাত্রায়, প্রতি মিনিট ইচ্ছে মতন ভোগ করতে চায়। দারুণ ছটফটে আর খেয়ালী। অনেকে তো ওকে সহেলীর বদলে খেয়ালী বলেই ডাকতো! আর দেবদত্ত ছিল দারুণ গম্ভীর আর মনমরা ধরনের, যেন সব সময় কোনো অপরাধ বোধে ভুগছে। কারুর সঙ্গে মিশতে চাইত না, ওর এখানে কোনো বন্ধু ছিল না, আমাদের সন্দেহ ছিল ও রোজ ঠিক মতন খায় কি না! এই দেবদত্ত আর সহেলীর যে কী করে আলাপ– পরিচয় হলো, মনের মিল হলো, তা আমরা কেউই জানি না!

জয়দীপ বলল, কেউ কেউ বলে, জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে এক সঙ্গে একটি মৃতদেহ দেখার পর ওদের প্রেম হয়। ওরা দু’জনে মৃত মানুষটির দু’পাশে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে প্রথম ভালো করে দেখে।

বন্দনাদি বলল, কী জানি! কিন্তু সেই যে ওদের প্রেম হলো, তারপর কী প্রেম কী প্রেম! তুই লাভ বার্ডস দেখেছিস, নীলু–সবুজ রঙের পাখি, টুনটুনির থেকে খানিকটা বড়, সব সময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে, কখনো একটাকে আলাদা দেখা যায় না, ওরাও ঠিক সেই রকম। সহেলীকে দেখলেই এদিক ওদিক তাকাতাম আমরা, দেবদত্তকে কাছাকাছি দেখতে পাওয়া যাবেই। তারপর ওরা একদিন মিটিং–এ জানাল যে ওরা বিয়ে করতে চায়, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি আছে কি না! এখানে কারুর আপত্তি থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রভাসদা বলেছিলেন, ফর্মাল বিয়ে করারও দরকার নেই, ওরা একসঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে পারে অনায়াসে। কিন্তু ওরা তাতে রাজি নয়, ওরা চাইল যে সবার সামনে ঘোষণা করে পরস্পরকে স্বামী–স্ত্রী হিসেবে বরণ করতে। আমরা বললুম, ঠিক আছে, সামনের পূর্ণিমা রাতে আমরা সবাই মিলে গান গেয়ে, কবিতা পাঠ করে ওদের স্বামী–স্ত্রী হিসেবে বরণ করব। কিন্তু সেটাও বোধহয় ওদের পছন্দ হয়নি। ওরা চেয়েছিল আনুষ্ঠানিক বিয়ে। একদিন কারুকে কিছু না জানিয়ে ওরা এখান থেকে চলে গেল। আশা করি ওরা সুখে আছে!

জয়দীপ বলল, ওদের দু’জনের মধ্যে অন্তত একজন যদি আবার এখানে খুব শিগগিরই ফিরে আসে, আমি তাতে আশ্চর্য হবো না!

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, কেন, একথা বলছ কেন, জয়দীপ?

–কেন যেন আমার মনে হয় ঐ কথা! অত প্রেম থাকলে কি বিয়ে ঢেঁকে? ভালোবাসা হচ্ছে বেলজিয়ামের কাচের বাসন, তা প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য নয়। আমি জানি, আমি জানি!

–বাঃ, অদ্ভুত ধারণা তো তোমার! আচ্ছা জয়দীপ, যদি ওদের দু’জনের মধ্যে শুধু একজন ফিরে আসে, তাহলে কে ফিরে আসবে বলে তোমার ধারণা?

জয়দীপ কৃত্রিম ভাবে হা–হা করে হেসে বলল, আমি বলব না! আমি এখন বলব না। লেট আস কীপ আওয়ার ফিংগারস ক্রস্ড!

রোহিলা বলল, আমি বলছি, ঐ মেয়েটাই ফিরে আসবে। ঐ পুরুষটার প্রেম চলে যাবে ক’দিন বাদেই, তারপর সে মেয়েটাকে মুরগিহাটার মুরগির মতন বিক্রি করে দেবে!

বন্দনাদি ভর্ৎসনা করে বললেন, যাঃ, কী অলুক্ষুণে কথা বলছ! দেবদত্ত সেরকম মানুষই নয়। ও সহেলীকে একেবারে পুজো করে।

রোহিলা চোখ মুখ সঙ্কুচিত করে বলল, তুমি জানো না বন্দনাদি, এখানকার বাইরের যে পৃথিবী, সেখানে ভালোবাসা বলে কিছু নেই। কিছু থাকতে পারে না! পুরুষরা যখন তখন মেয়েদের বিক্রি করে দেয়!

বন্দনাদি আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই তো এখানে একজন বাইরের মানুষ আছে, ওকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, এটা সব জায়গায় সত্যি কি না!

রোহিলা বলল, ওকে আর আমরা বাইরে যেতে দেব না, এখানেই ধরে রাখব!

কুড়ি–একুশ বছরের একটি ছেলে হেঁটে আসছে রাস্তা দিয়ে। হাতে একটা সদ্যকাটা পেয়ারা গাছের ডাল, তাতে কচি কচি পেয়ারা ফলে আছে কয়েকটা। আমাদের দিকে সে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, বাবুসাহেব, ঐ ডালটা কোথা থেকে কাটালেন? কী হবে ওটা দিয়ে?

ছেলেটি বলল, ঐ যে মুরাদ বলে একটা লোক আছে, তার বাগান থেকে এনেছি। আমার বাগানে লাগাব। আমার একটাও পেয়ারা গাছ নেই।

—কিন্তু ঐভাবে ডাল কেটে এনে পুঁতলে বাঁচবে নাকি? আমায় বললে পারতেন, কলম করে দিতাম!

ছেলেটি বলল, হ্যাঁ বাঁচবে। ঠিক বাঁচবে। তোর সঙ্গে এরা কারা রে?

—এরা তো এখানেই থাকে। আপনি দেখেননি আগে? অবশ্য একজন বাদে, ও নতুন এসেছে।

ছেলেটি ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করল। জয়দীপ বলল, বাবুসাহেব কালই তো আপনার সঙ্গে কথা হলো আমার, মনে নেই?

ছেলেটি একই রকম ভঙ্গি করে বন্দনাদিকে জিজ্ঞেস করল, তোরা কোথায় যাচ্ছিস?

—নদীতে। আপনি যাবেন নাকি?

—নাঃ!

—চলুন না, জয়দীপ আপনাকে সাঁতার শিখিয়ে দেবে!

–না যাব না!

আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। এ ছেলেটি কে? বয়েসে এত বাচ্চা, অথচ বন্দনাদি আর জয়দীপকে তুই তুই করছে?

ছেলেটি একটু দূরে চলে যেতেই বন্দনাদি আর জয়দীপ এক সঙ্গে হো–হো করে হেসে উঠল।

তারপর জয়দীপ বলল, একেবারে ধানী লংকা!

বন্দনাদি আমাকে আর রোহিলাকে বলল, তোরা খুব অবাক হয়েছিস তো? ঐ ছেলেটি কারুকে নিজের নাম বলে না, আর সবাইয়ের সঙ্গে তুই তুই করে কথা বলে। এমন কি প্রভাসদার মতন বয়স্ক লোকদের সঙ্গেও। তাই আমরা প্রথমে নাম দিয়েছিলুম রাগীবাবু। তারপর নাম হলো তুই–বাবু। এখন নাম হয়েছে বাবুসাহেব।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, তোমরা ওকে আপনি বলো? ঐ চ্যাংড়া ছোকরাকে?

–আমরা কেউ ওর কথায় রাগ করি না। তাতেই ও আস্তে আস্তে নরম হয়ে যাবে! এর মধ্যেই অনেকটা হয়েছে। আগে ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তেড়ে মারতে আসত!

রোহিলা বন্দনাদির একটা হাত চেপে ধরে বলল, বন্দনাদি, তোমরা কি ভালো গো? ও–রকম চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনলে আমি তো মেজাজ ঠিক রাখতে পারতুম না!

বন্দনাদি বলল, ঐ ছেলেটা কীরকম দুঃখী তা ভাবো! ঐ বয়েসের ছেলে কিন্তু সমস্ত বিশ্বসংসারের ওপর ওর রাগ। নিশ্চয়ই তীব্র ঘৃণা আর রাগ নিয়ে ওর বাড়িঘর ছেড়ে চলে এসেছে! চেহারা দেখে মনে হয় না ভালো বাড়ির ছেলে?

জয়দীপ বলল, হয়তো ওর মা–বাবার মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া!

বন্দনাদি বলল, ওকে একটা পেয়ারার কলমের চারা করে দিতে হবে। আমি চেষ্টা করব, ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে। ঐ বয়েসের ছেলে এখানে থেকে কী করবে!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, ঐ ছেলেটি যে মুরাদ নামে একজনের কথা বলল, তার বাড়ি কি কাছেই?

–হ্যাঁ, ঐ তো দেখা যাচ্ছে। কেন, তুই ওকে চিনিস নাকি?

-একজনকে চিনি ঐ নামে, তবে ইনি সেই লোক কি না জানি না। একটু ঐ বাড়ির পাশটা ঘুরে যাবে?

— চল!

মুরাদ সাহেবকে দেখেই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। যেন একজন মৃত মানুষকে দেখছি। ট্রেন লাইনে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন, বাড়িতে সেই মর্মে চিঠি লিখেও রেখে গিয়েছিলেন, যদিও তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুরাদসাহেব যে বেঁচে আছেন তা আমিও ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু এই তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছি জলজ্যান্ত।

দুটো পেয়ারা গাছের গুঁড়িতে একটা দড়ি বাঁধবার চেষ্টা করছেন মুরাদসাহেব। আমাদের দেখে চোখ তুলে তাকালেন।

আমি চেঁচিয়ে ডাকলুম, মুরাদ ভাই, চিনতে পারছেন আমাকে?

ভুরু কুঁচকে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, চেনা চেনা লাগছে, তুমি, তুমি নীলকমল না?

—নীললোহিত। রফিকের ঘরে কতদিন আড্ডা দিয়েছি আপনার সঙ্গে।

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তুমিও এখানে আমাদের দলে ভর্তি হলে নাকি? খুব ভালো কথা। আরে, বন্দনা, তোমাকে দেখতেই পাইনি! তুমিই নীলকমলকে এই জায়গাটার সন্ধান দিলে বুঝি!

বন্দনাদি বলল, ওকে সন্ধান দিতে হয় না, ও নিজেই খুঁজে বার করে। মুরাদ, তোমার বাগানের পেয়ারাগাছগুলোর জাত ভালো। আমি দু’একটা কলম করব! মুরাদসাহেব বললেন, যেদিন ইচ্ছে! বন্দনা, তুমি আমার বাগানে আসবে, সে তো আমার সৌভাগ্য!

—আচ্ছা মুরাদ, কাল রাত্রে দ্বিতীয়বার মাদল বেজেছিল, তুমি শুনেছিলে?

– হাঁ!

—তুমি গিয়েছিলে?

–যাব না কেন? মাদলের ডাক শুনলে যাব না!

—কী হয়েছিল?

মুরাদসাহেব আমাদের দিকে চেয়ে চুপ করে রইলেন। উনি আমাকে ভালোভাবে চিনতে পারেননি বা চিনতে চাইছেন না! ওঁর কপালে একটা গভীর কাটা দাগ, ওটা আগে ছিল না। ট্রেন লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরেও বেঁচে গেছেন কোনো ক্রমে! অবশ্য একজন শক্ত–সবল, শিক্ষিত পুরুষ নিজের স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে কেন রেলে গলা দিয়ে আত্মহত্যা করতে যায়, তা আমার বুদ্ধির অগম্য। মুরাদসাহেব বললেন, বন্দনা, তোমরা তো জ্যোৎস্নার বাড়িতে যাচ্ছ, সেখানেই সব জানতে পারবে!

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চারজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। অর্থাৎ এক্ষুনি নদীর ধারে যাবার দরকার নেই, আগে জ্যোৎস্নার বাড়িটা ঘুরে যেতে হবে।

– আচ্ছা, চলি মুরাদ, পরে দেখা হবে!

—দাঁড়াও, বন্দনা, একটু দাঁড়াও!

গাছতলায় ফিরে গিয়ে মুরাদসাহেব অনেকগুলো পেয়ারা এনে দিলেন আমাদের। এবারে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে থাকছ তো? তোমার গা থেকে কলকাতার গন্ধ একেবারে মুছে গেলে তারপর এসো আমার কাছে একদিন।

—খোদা হাফেজ, মুরাদভাই!

—আমার নামটা শুধু এক আছে, আমার আর সব কিছু মুছে গেছে নীলকমল! আমাকে ওসব বলবার দরকার নাই!

আমরা প্রত্যেকে একটা করে পেয়ারা কামড়াতে কামড়াতে হাঁটতে শুরু করলুম। বেশ সুস্বাদু পেয়ারা। মুরাদসাহেব এক সময় খুব আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ ছিলেন, আমরা ওঁর বাড়িতে রেশমী কাবাব খেতে যেতাম, হঠাৎ গিয়ে পড়লেও কিছু না কিছু ভালো খাবার পেতামই। আজকের পেয়ারা যেন তারই স্মৃতি। মুরাদসাহেব এখানে গোমড়া হয়ে গেলেও বন্দনাদির সঙ্গে বেশ মধুর সম্পর্ক মনে হলো।

সেই কথা বন্দনাদিকে বলতেই বন্দনাদি একটুও দ্বিধা না করে বলল, হ্যাঁরে, এখানে অনেকেই আমাকে ভালোবাসে। শুধু এই জয়দীপটাই কক্ষনো আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। এর মধ্যে একদিনও বলল না, আমি দেখতে ভালো কী মন্দ!

জয়দীপ বলল, আমি তো তোমাকে মেয়ে হিসেবে দেখি না, একজন বন্ধু হিসেবে দেখি। বন্ধুর আবার রূপের প্রশংসা কেউ করে নাকি।

রোহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা নীলু, এই মুরাদ নামে লোকটা কী ওর বউকে খুন করে পালিয়ে এসেছে? মুখখানা কীরকম নিষ্ঠুরের মতন।

আমি বললুম, ঠিক তার উল্টো। বউয়ের ওপর রাগ করে উনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন!

বন্দনাদি বলল, ওসব কথা নয়, ওসব কথা নয়! ঐসব পুরোনো কথা তুললে এখানকার হাওয়া খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু জ্যোৎস্নার বাড়িটা ঠিক কোন দিকে? আমি যাইনি কখনো। জয়দীপ, তুমি চেনো?

জয়দীপ বলল, আমিও চিনি না। তবে চলো, পথে কারুকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে।

এই সময়ে অনেকেই নিজের বাগানে বা ক্ষেতে কাজ করে, তাই পথে বিশেষ মানুষজন নেই। এখানে গাছপালা এত বেশি যে রাস্তা থেকে চোখেই পড়ে না কোথায় কোথায় বাড়ি আছে। এক সময় যারা এসে এখানে প্রথম উপনিবেশ বানিয়েছিল তাদের রুচি আছে স্বীকার করতে হবে।

দু’এক জায়গায় জিজ্ঞেস করতে করতে আমরা জ্যোৎস্নার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। সেই বাড়ির সামনে দশ–বারো জন মানুষের নিঃশব্দ জমায়েত। দেখলেই বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। মনে পড়ে কোনো শোকের বাড়ির কথা।

বন্দনাদি বিবর্ণ মুখে বলল, কী হয়েছে এখানে?

বলেই সে ছুটে গেল আগে।

জয়দীপ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমি যাব না! আমি এসব সহ্য করতে পারি না।

আমি বললুম, ঠিক আছে, আমরা এখানেই দাঁড়াই। বন্দনাদি দেখে আসুক আগে, ওর মুখ থেকেই শুনব!

জয়দীপের মুখখানা বদলে গেছে। চোখ দুটি বিস্ফারিত। সে ফিস ফিস করে বলল, না, আমি এখানেও দাঁড়াতে চাই না। আমি জানি, কী হয়েছে! আমি নদীর ধারে চলে যাচ্ছি। তোমরা পরে এসো।

জয়দীপ উল্টো দিকে ফিরে হনহন করে চলে গেল।

রোহিলা বলল, চলো, তুমি আর আমিও নদীর ধারে চলে যাই। বন্দনাদি ঠিক বুঝবে!

কিন্তু আমার যে অদম্য কৌতূহল। আমার পা গেঁথে গেছে মাটিতে, সব কিছু না জেনে যাওয়ার উপায় নেই।

আমি রোহিলার বাহুতে চাপড় মেরে বললুম, আগে ভয় পাচ্ছ কেন? আগে দেখাই যাক না ব্যাপারটা কী!

জ্যোৎস্নার বাড়িটা ছোট। দুটি মাত্র ঘর, সামনে কোনো বারান্দা নেই, পেছন দিকে আছে কিনা কে জানে। তার বাগানটিও বিশেষ বড় নয়। সেখানে লাল রঙের ডাঁটা শাক ফলেছে, আর রয়েছে দুটো বড় ইউক্যালিপটাস গাছ। তার বাড়ির সামনের দিকটা অনেকটা ফাঁকা, আর বাড়িঘর নেই। শোবার ঘরে জানলা খুলে সে সব সময় আকাশ দেখতে পারে।

তার বাড়ির বাইরে যে–ক’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে তারা কেউ আমার চেনা নয়। তারা কথা বলছে অতি নিম্ন স্বরে, এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না। বন্দনাদি ঢুকে গেছে বাড়িটার মধ্যে।

আমি রোহিলার হাত ধরে টেনে চলে এলুম সেই জনতার মধ্যে। একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

লোকটির মুখে কার্ল মার্কসের মতন দাড়ি, মাথার চুলে বাবরি, চোখদুটি প্রশান্ত। আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু একটা আঙুল তুলে বাড়ির ভিতরটা দেখিয়ে দিল।

এখানকার লোকেরা কেউ প্রকাশ্যে কৌতূহল দেখায় না, অন্যদের কৌতূহল প্রবৃত্তিকেও উৎসাহ দিতে চায় না। এক এক সময় এই নিরুত্তাপ ভাবটা আমার অসহ্য লাগে!

এই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে নিশ্চয়ই কোনো বাধা নেই। কেউ কেউ গেছে তো দেখা যাচ্ছে। একটা ঘরে বেশ কয়েকজন নারী–পুরুষের পিঠ।

রোহিলাকে বললুম, চলো, ভেতরে গিয়ে দেখি!

রোহিলা ভয়ার্ত মুখে বলল, না!

অধীর প্রতীক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। বন্দনাদি নিশ্চয়ই আমাদের খবর দিতে আসবে।

একটু বাদেই সেই বাড়ির মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। কারা যেন কাকে কী বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে। তারপর সবাই একদিকে সরে গেল, একজন লোক টলতে টলতে বেরিয়ে এলো বাইরে।

লোকটিকে দেখে আমি স্তম্ভিত। নীহারদা! জঙ্গলের মধ্যে জলাশয়ের পাশে শুয়ে থাকা সেই মুমূর্ষু মানুষটি!

বন্দনাদি আর ইসমাইল সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে নীহারদাকে ধরবার চেষ্টা করলেও তিনি নিজেই মোটামুটি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। প্রণামের ভঙ্গিতে হাতজোড় করে কম্পিত গলায় আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমায় ক্ষমা করুন। বেঁচে থাকার জন্য…মানুষ কত কী–ই না করে! আমি…হয়তো এ যাত্রা…বেঁচে যাব! আপনারা…আমাকে ক্ষমা করুন!

আমার পাশ থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, সব ঠিক আছে, নীহারদা! আপনি সুস্থ হয়ে উঠছেন দেখে আমরা দারুণ খুশি হয়েছি। আপনি শুয়ে পড়ুন, বিশ্রাম নিন!

জনতার প্রত্যেকের ঠোটেই খুশির ঢেউ। দু’তিনজন এক সঙ্গে হাত তুলে বলল, আমরা আপনাকে ফিরিয়ে এনেছি, নীহারদা। আপনি আরো অনেকদিন আমাদের মধ্যে থাকবেন।

নীহারদার ঠোঁট কাঁপছে। তিনি আরো কিছু বলতে চান। বন্দনাদি আর ইসমাইল তাকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।

রোহিলা আমার দিকে প্রশ্নমাখা চোখে তাকাল। সব ব্যাপারটা আমার কাছে দুর্বোধ্য রয়ে গেল। মুমূর্ষু নীহারদা জঙ্গল থেকে জ্যোৎস্নার বাড়িতে এলেন কী করে? তার সঙ্গে কাল রাতে মাদল বাজার সম্পর্ক কী!

আমাদের কাছের ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল। এরা নীহারদাকে দেখবার জন্যই দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ এরা জানত যে নীহারদা ভেতরে আছেন।

আমরা অপেক্ষা করতে লাগলুম বন্দনাদির জন্য।

রোহিলা বলল, আমার এইটুকু জীবনে কত তাড়াতাড়ি সব ঘটনা ঘটছে, তাই না? আমিও সেই জন্য তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠছি।

আমি বললুম, তুমি তো নীহারদাকে আগে দেখনি। আমি কাল বিকেলে দেখেছি জঙ্গলে শুয়ে থাকতে। মৃতুশয্যায়। উনি যে আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন, হাঁটতে পারবেন, তা কল্পনাও করতে পারিনি!

–সত্যি সত্যি কি অসুখ হয়েছিল?

—ঠোট দুটো একেবারে চুপসে গিয়েছিল। কোনো সুস্থ মানুষের ঠোট ওরকম হতে পারে না! আমি আগে কখনো দেখিনি।

খানিক বাদেই বন্দনাদি বেরিয়ে এলো হাস্যোজ্জ্বল মুখে। আমাদের কাছে এসে বলল, চল, এবারে স্নান করতে যাই। রোহিলা, তুমি অধৈর্য হয়ে উঠছ নিশ্চয়ই। জয়দীপ কোথায় গেল?

—জয়দীপ এগিয়ে গেছে।

— মানুষের জীবনটা কী আশ্চর্য রহস্যময়, তাই না–রে নীলু, এমন এমন সব কাণ্ড ঘটে যা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না!

–দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ, হোরেসিও…। তা হোরেসিও, আজকের পরমাশ্চর্য ব্যাপারটা কী?

—নীহারদাকে দেখলি না? উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, পায়ে হেঁটে এতখানি আসবেন, কেউ কি বিশ্বাস করতে পেরেছিল? কাল যে আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করলুম, নীহারদা, ফিরে এসো, নীহারদা ফিরে এসো! তার জন্যেই এটা হয়েছে! – যাঃ, তা কি কখনো সম্ভব! বন্দনাদি, আমি সন্দেহবাদী মানুষ। নীহারদা স্ট্যান্ট দেননি তো? রোহিলার মনেও প্রশ্ন জেগেছে যে নীহারদা সত্যিই অসুস্থ হয়েছিলেন কি না!

-তোরা কী বলছিস রে? সাধ করে কেউ কি জঙ্গলে গিয়ে ঐ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকে? তাছাড়া এখানে দু’জন ডাক্তার আছে। এককালের খুব নাম–করা ডাক্তার। সব ছেড়ে চলে এলেও তারা ডাক্তারি বিদ্যেটা তো আর ভোলেনি! সেই ডাক্তার দু’জন আগে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে নীহারদার বাঁচার আর কোনো আশা নেই। তারপরই তাঁকে জঙ্গলে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল!

—ইনি জ্যোৎস্নার বাড়িতে এলেন কেন? কাল রাত্তিরে দ্বিতীয়বার মাদল বেজেছিল এই জন্যে?

–আরো আশ্চর্য ঘটনাটা তো এখনো জানিস না। পরশু রাতে জ্যোৎস্না যে একজনকে দেখে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, তা ঐ নীহারদাকে দেখেই। নীহারদাই পরশু এসেছিলেন।

—অ্যাঁ! উনিই এসে জ্যোৎস্নার গলা টিপে ধরেছিলেন।

রোহিলা কুঁকড়ে গিয়ে বলল, বন্দনাদি, আর বলো না, আমার ভয় করছে! ঐ বুড়োটা জঙ্গল থেকে এতখানি এসে জ্যোৎস্নার গলা টিপে ধরেছিল – ওরে বাবারে! ওরে বাবারে!

বন্দনাদি কুলকুল করে হেসে বলল, এই রোহিলাটা দেখছি সত্যিই বাচ্চা! আরে না–না, গলা টিপে ধরেনি। ওটা ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার। সব ব্যাপারটা খুলে বলছি, শোন! নীহারদাই আজ বলেছে। ঐ জঙ্গলের মধ্যে নীহারদা বেশ কয়েকদিন ধরে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ছিলেন তো? শরীরটা অশক্ত হয়ে গেলেও মনটা তো ঠিকই ছিল! ঐ অবস্থায় শুয়ে শুয়েও নীহারদার মনে ঈশ্বর চিন্তা আসেনি, পুরোনো জীবনের কথা মনে পড়েনি, শুধু তিনি জ্যোৎস্নার কথা ভেবেছেন। চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে দেখতে তিনি ভাবতেন, জ্যোৎস্নাও যদি তাঁর পাশে শুয়ে আকাশ দেখত! জ্যোৎস্নাকে উনি ভালোবাসতেন। জ্যোৎস্না তা জানত না। সেই ভালোবাসার জোরেই উনি পরশুদিন মাঝ রাত্রে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, এতখানি রাস্তা হেঁটে এসেছিলেন। ভেবে দ্যাখ, কী অসম্ভব মনের জোর। জ্যোৎস্নার বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে উনি দেখলেন, জ্যোৎস্না ঘুমিয়ে আছে। উনি তখন জ্যোৎস্নার মুখখানি দু’হাতে ধরে আদর করতে গিয়েছিলেন একটু। জ্যোৎস্না হঠাৎ জেগে উঠে কে কে বলে চিৎকার করে ওঠে। নীহারদা তখন ঘাবড়ে যান, সেই সময় বোধহয় জ্যোৎস্নার গলায় হাতের চাপ লেগে যায়!

—অন্য লোক এসে পড়ায় উনি দৌড়ে পালিয়েছিলেন? একজন মুমূর্ষু রোগী দৌড়োয়?

রোহিলা বলল, বন্দনাদি, আমার এখনো ভয় করছে এসব শুনতে!

বন্দনাদি বলল, মনের জোরে সবই সম্ভব। মৃগী রুগীদের দেখিসনি, কী রকম অসম্ভব গায়ের জোর হয়ে যায়? নীহারদা ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কী করে অতটা গেল, সে কথা তার ভালো করে মনেই নেই।

—তারপর আবার কাল রাত্তিরে এসেছিলেন।

—হ্যাঁ। ওর মনে হয়েছিল, জ্যোৎস্নাকে অন্তত একটা চুমু না খেলে উনি মরে গিয়েও তৃপ্তি পাবেন না। কিংবা তৃপ্তিতে মরতে পারবেন না! কিন্তু কাল রাত্তিরে জ্যোৎস্নার ঘরে একটা মাদল রাখা ছিল। জ্যোৎস্নাও জেগে ছিল। তখন বৃষ্টি পড়ছিল, আকাশে আলো ছিল না। ঘরের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি দেখেই জ্যোৎস্না চিৎকার করে ওঠে, তারপর মাদল বাজিয়ে দেয়।

রোহিলা বলল, ওরে বাবারে, আমি হলে তো ভয়েই মরে যেতাম! আমি পুরুষমানুষদের ভয় পাই না, কিন্তু যদি ভূত হয়…

বন্দনাদি বলল, ধুৎ! ভূত আবার কী? অত ভয় পেলে এখানে একা একা থাকা যায় না!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, তারপর কী হলো?

বন্দনাদি বলল, কাল রাতে জ্যোৎস্নার চিৎকার শুনে নীহারদা আর মনের জোর রাখতে পারেননি, ঐখানেই ঝুপ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। জ্যোৎস্নার চিৎকার আর মাদলের শব্দ শুনে প্রথমে দু’তিনজন দৌড়ে এসেছিল। তারা নীহারদাকে ওখানে ঐভাবে পড়ে থাকতে দেখে আবার মাদল বাজিয়ে দেয়। তাতে আরো কয়েকজন আসে। দু’জন ডাক্তারের মধ্যে রজত ডাক্তার এসে পৌঁছোয় আগে। সে চিকিৎসা শুরু করে দেয়। এক সময় নাকি নীহারদার হার্ট বীট থেমে গিয়েছিল। তখন রজত ডাক্তার জ্যোৎস্নাকে বলে, উনি তোমার জন্যই তো এসেছিলেন, তুমি ওর ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেশান দাও! তাতে কাজ হবে। সত্যিই কাজ হয়েছে। জ্যোৎস্না বোধহয় অন্তত একশো বার নীহারদার ঠোটে ঠোঁট দিয়ে চুমু খাওয়ার মতন ফুঁ দিয়েছে। দেখলি তো, নীহারদা শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াতে পেরেছেন, বাইরে এলেন জেদ করে, সবার সঙ্গে কথা বললেন!

রোহিলা বলল, এখনো যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। উনি সত্যি বেঁচে আছেন? কিছু খাবার খেয়েছেন?

বন্দনাদি বলল, হ্যাঁ, চিকেন সুপ খেয়েছেন দু’একবার। শেষবার তো আমিই খাইয়ে দিলাম!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা বন্দনাদি, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে নীহারদা বলেছিলেন, উনি এখানকার কোনো একজনকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সে কে? কী হয়েছিল?

বন্দনাদি মৃদু হেসে বলল, তুই নিশ্চয়ই তা জানিস বা বুঝতে পেরেছিস, তবু আমার কাছে যাচাই করে নিচ্ছিস, তাই না? সেটা বছর খানেক আগেকার ব্যাপার। নীহারদা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয়, বুঝলি। অনেকেই নানা ব্যাপারে নীহারদার কাছে পরামর্শ নিতে যেত। উনি ছিলেন নির্লোভ, মুক্তপুরুষ। তবু উনি একদিন নিরালায় জ্যোৎস্নাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গিয়েছিলেন, জ্যোৎস্নার মেজাজ তখন ভালো ছিল না। সে উল্টে নীহারদাকে দুই থাপ্পড় কষায়।

রোহিলা বলল, বেশ করেছিল!

—তুমি সব ঘটনাটা জানো না, আগে শোনো! ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায়। ওরকম থাপ্পড় খেয়েই নীহারদা প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটা মানসিক আঘাত তো। সেই ঘটনা শুনে আমরা জ্যোৎস্নাকে খুব বকাবকি করেছিলুম! নীহারদা বয়স্ক মানুষ, অনেক ব্যাপারেই শ্রদ্ধেয়, যদি তাঁর একবার একটু চুমু–টুমু খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাতে অত আপত্তি করার কী আছে? জ্যোৎস্নার আপত্তি ছিল অন্য। চুমু খেতে তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু সে বলেছিল, নারীর একটা স্বাভাবিক অধিকার আছে পুরুষের স্তুতি পাবার। নীহারদা যতই শ্রদ্ধেয় হোক, চুমু খাবার চেষ্টা করার আগে তাঁর তো উচিত ছিল একবার অন্তত হাঁটু মুড়ে বসে জ্যোৎস্নার কাছে দু’একটা ভালোবাসার কথা বলা!

রোহিলা বলল, জ্যোৎস্না ঠিকই তো বলেছে!

বন্দনাদি বলল, রোহিলা, সবাই সব কথা মুখে প্রকাশ করতে পারে না। যারা ভালোবাসে কিন্তু মুখে বারবার ভালোবাসার কথা বলে না, তারাই খাঁটি। মানুষ চিনতে হয়, মানুষের মুখ দেখে বুঝে নিতে হয়। যাই হোক, সে সব চুকে গেছে। কৃত্রিম নিশ্বাস দেবার অজুহাতে জ্যোৎস্না আজ নীহারদাকে অন্তত একশো বার চুমু খেয়েছে। তাইতেই নীহারদা চাঙ্গা হয়ে উঠছেন ক্রমশ। এখানে তো অক্সিজেন টেণ্ট নেই। অন্য কোনো ব্যবস্থাও নেই। নীহারদা মাঝে মাঝে সিংক করে গেলে রজত ডাক্তার চেঁচিয়ে উঠছে, অক্সিজেন! অমনি জ্যোৎস্না এসে নীহারদার ঠোটে ঠোঁট ঠেকাচ্ছে।

হাতের পুঁটলিটা একবার শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ফের লুফে নিয়ে বন্দনাদি বলল, আজকের দিনটাতে এটাই সবচেয়ে সুন্দর খবর!

আমি বললুম, বন্দনাদি, তা হলেই দেখা যাচ্ছে, তোমাদের প্রার্থনাতে উনি সুস্থ হয়ে ওঠেন নি। উনি সেরে উঠেছেন একটা চুমুর জন্য। যতদূর মনে হয়, ঐ একই কারণে আমিও আরো একশো বছর বাঁচব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *