নিরুদ্দেশের দেশে – ১৩

১৩

বাড়িতে এসে আমি প্রথমেই একটা সিগারেট ধরালুম। সব নিয়মকানুন যে মানতে হবে তার কোনো মানে নেই। এটা আমার নিজের বাড়ি, এই চৌহদ্দির মধ্যে শুধু আমার নিয়মের রাজত্ব

এখানে কোনো যানবাহন নেই বলেই কি জায়গাটা এত বেশি নিঃশব্দ? এই বাড়ির কাছাকাছি আর কোনো বাড়ি নেই, দূরে কোনো বাড়ির আলোও দেখা যায় না।

অনেক ডাকবাংলোতে আমি একা একা রাত কাটিয়েছি। মানসের জঙ্গলে সেই রাত, কী নিদারুণ নিঃসঙ্গ ছিল! একা থাকার একটা রোমাঞ্চ আছে, সেটা আমি বেশ উপভোগ করি। কিন্তু এখন কী রকম যেন একটা অস্বস্তির ভাব, একটা কিসের যেন চাঞ্চল্য টের পাচ্ছি নিজের মধ্যে। এটা আমার নিজের বাড়ি। এখানে আমি সারা জীবন থাকব?

রান্নাঘরে গিয়ে একটা মোমবাতি জ্বাললুম। এঁটো থালা–বাসনগুলো পড়ে আছে, কাল সকালে মাজতে হবে। বিলেত–আমেরিকায় যেসব ছেলেরা যায়, তাদেরও তো ঘর ঝাঁট দিতে হয়, থালা–বাসন মাজতে হয়!

মোম নিয়ে সারা বাড়িটা ঘুরে দেখলুম। খাট–বিছানা কিছু নেই। তাতে কী হয়েছে? আজকাল ডাক্তাররা নাকি বলে, বালিশহীন শক্ত বিছানায় শোওয়াই স্বাস্থ্যকর। তাছাড়া ইজি চেয়ারটা রয়েছে।

সিগারেটটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে শেষ করলুম। তারপর ঝোলা থেকে বার করলুম আমার যাবতীয় সম্পত্তি। কয়েকটি জামা–প্যান্ট, পায়জামা, দু’খানা বই, একটা খাতা, কলম, দু’ প্যাকেট সিগারেট, একটা ছোট ছুরি, এক পাতা সেফটিপিন, ছোট একটা ব্র্যান্ডির শিশি—এই সব আমার ভ্রমণ–সঙ্গী।

প্রথমে সিগারেটের প্যাকেট দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিলুম জানলা দিয়ে। নিয়ম– ভাঙা হয়ে গেল, আর সিগারেট দরকার নেই।

ফেলে দেবার পর মনে মনে হাসলুম। এরকম অনেকবার হয়েছে, আর সিগারেট খাব না ভেবে প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েও একটু বাদে আবার কুড়িয়ে এনেছি, এমনকি পোড়া টুকরো খুঁজে এনেছি মাটি থেকে। সুতরাং ঐ প্যাকেট দুটোর চিরতরে গতি করা দরকার।

এক গেলাস জল নিয়ে চলে এলাম বাইরে। জানলার বাইরে ফাঁকা মাটিতে প্যাকেট দুটো পাশাপাশি পড়ে আছে। তার ওপরে ঢেলে দিলুম জল। বিদায় সিগারেট! অনেক বছরের বন্ধু ছিলে, অনেক দুঃখে–সংকটে তুমি আমায় সাহায্য করেছ, ভরসা দিয়েছ, অনেক আনন্দ দিয়েছ, এবার থেকে তোমার সঙ্গে সব সম্পর্কের ইতি। তুমি সভ্যতার অগ্রগতির অঙ্গ। আমি এখন সভ্যতার আওতার বাইরে।

সিগারেট ফুরিয়ে গেলে সেই যে পাগলের মতন খোঁজাখুঁজি, এবার সেই পাগলামি থেকেও নিষ্কৃতি! বেশ একটা মুক্তির স্বাদ পাওয়া গেল!

ঘরে ফিরে এসে খাতা আর কলমের দিকে তাকিয়ে রইলুম কিছুক্ষণ। ও দুটো রাখারই বা কী দরকার? অতিরিক্ত আবর্জনা ছাড়া আর তো কিছু না! কলম আমার আর কোন্ কাজে লাগবে?

পেছন দিকের বাগানে এসে খুব জোরে ছুঁড়ে মারলুম কলমটাকে। ওদিকে একটা ডোবা মতন আছে। আমার কলমের সলিলসমাধি হওয়াই ভালো। এবারে খাতাটাকেও পাঠালুম সেই দিকে।

এবারে বই দুটো?

বই দুটোর মালিক আমি নই, ধার করে নিয়ে এসেছি। ঐ বইয়ের মালিককে আর কোনোদিনই ফেরৎ দেওয়া হবে না বটে, তবু পরের জিনিস ফেলে দিতে আমার হাত ওঠে না! আর কিছু না হোক, উনুন ধরাবার জন্যও ঐ বইয়ের পাতা ছিঁড়ে কাজে লাগানো যেতে পারে। বই দুটি রেখে দিলুম রান্নাঘরে।

ব্র্যান্ডির শিশিটিা? ঠিক নেশার জন্য তো ওটা রাখিনি, হঠাৎ শরীর খারাপ হলে কিংবা খুব শীত করলে ওটা কাজে লাগে। নেশার দ্রব্য হলে তো জমিয়ে না রেখে আগেই খেয়ে ফেলতুম। ওটা রেখে দেওয়া হবে না ফেলে দেওয়া উচিত? ঠিক মতো মন ঠিক করতে পারি না।

একটু বাদে একটা উপায় মাথায় আসে। ছিপিটা খুব শক্ত করে এঁটে শিশিটা নিয়ে চলে এলুম বাগানে। ক’দিনের বৃষ্টিতে মাটি বেশ নরম হয়ে আছে, খালি হাতেই অনেকটা খুঁড়ে ফেলা গেল। তারপর ব্র্যান্ডির শিশিটাকে সেই গর্তে কবর দিলাম। জয়দীপ যদি তার ঘড়ি পুঁতে রাখতে পারে তা হলে আমিই বা ব্র্যান্ডির শিশি সেই ভাবে রাখতে পারব না কেন? পরে অন্য কারুর উপকারে লেগে যেতে পারে।

এবারে আমি প্রকৃত স্বাধীন। মোমবাতি নিবিয়ে জামাকাপড়ও খুলে ফেললুম। গ্রীষ্মকালে, একলা নিজের বাড়িতে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে থাকতেও তো অসুবিধে কিছু নেই। ঘরে না শুয়ে যদি উন্মুক্ত মাঠে শুই তা হলে একেবারে সাড়ে সাত লক্ষ বছর আগেকার পৃথিবীতে চলে যাওয়া যায়।

কিন্তু বর্ষাকাল, সাপের ভয় আছে। এই বাড়িটা অনেকদিন অব্যবহৃত ছিল, আশেপাশে সাপ–খোপ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সন্ধেবেলা আমি একটা ধেড়ে ইঁদুর দেখেছি।

থাক, এক লাফে সাড়ে সাত লক্ষ বছর পিছিয়ে যাবার দরকার নেই, তিন– চার হাজার বছরই যথেষ্ট। ঘরেই শোব ঠিক করলুম।

চোখ একেবারে খরখরে শুকনো। সহজে ঘুম আসবে বলে মনে হয় না।

টাক–মাথা লোকটার কথা মনে পড়ল হঠাৎ, ও রোহিলাকে হঠাৎ সুলোচনা বলে ডেকে উঠল! রোহিলার সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক ছিল, এখানে এসেও সেটা ভুলতে পারছে না? রোহিলা কিন্তু আগাগোড়া অবিচলিত। এই মেয়েটি সত্যিই অসাধারণ!

— নীলু! নীলু!

কে ডাকছে আমাকে। ধড়মড় করে উঠে পায়জামাটা পরে নিলুম। ডাকটা থেমে গেছে। তবু আমি উঁকি মারলুম বাইরে। কেউ নেই। পুরুষের গলা, ঠিক চিনতে পারিনি।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, কে? কেউ আছ ওখানে?

কোনো উত্তর নেই। একটুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো স্পন্দন টের পেলুম না। তাহলে কি আমার শোনার ভুল? কোনো রাতপাখি ডেকে উঠেছিল?

ফিরে এসে শুয়ে পড়লুম আবার। ডাকটা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল। কেন, কিসের ভয় আমার? খুব ঘনিষ্ঠ কেউ না হলে তো নীলু বলে ডাকবে না, এখানে সেরকম পুরুষ কে আছে।

আবার একটু পরেই স্পষ্ট শুনতে পেলুম সেই ডাক। কণ্ঠস্বরে একটা ব্যাকুলতা রয়েছে। কেউ যেন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, নীলু নীলু, এদিকে আয়! এবারে আমি উঠে খুঁজতে গেলুম না। আমার শরীর শিরশির করছে। আবার সেই ডাক শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলুম।

যদিও অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, তবু আমি চোখ বুজলুম। যে ডাকছে তার মুখখানা যদি চেনা যায়। কিন্তু অস্পষ্ট রেখা ঠিক চেনা যাচ্ছে না।

তারপরেই হঠাৎ এক ঝলক হলুদ আলোর মধ্যে দেখা গেল দুটি মেয়েলি হাত, কেউ বলল, নীললোহিত, তুমি আসবে না?

আমি উঠে বসলুম। প্রথম রাত্রে এইরকম হয়? তাহলে ঘুমাবার চেষ্টা না করাই তো ভালো। একা একা মানুষ কী করে জেগে থাকে? বই দুটো নিয়ে এসে পড়ব মোম জ্বেলে। হাতের আঙুল নিশপিশ করে উঠল অমনি। রাত জেগে বই পড়ার সময় সিগারেট খাব না, এটা যেন চিন্তাই করা যায় না। সিগারেটগুলোকে নিজের হাতে ধ্বংস করেছি। সব কটাই ভিজে গেছে? একটা দুটো যদি উদ্ধার করা যায়…কিংবা ব্র্যান্ডিতে দু’ এক চমুক দিলে যদি ঘুম আসে…

নিজের মনেই হাসলুম। প্রথম রাত্তিরে সবারই কি মাথায় এই রকম চিন্তা আসে? কাল বন্দনাদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে তো! পিছুটান এত তীব্র?

খর–র–র খ–র–র–র শব্দ হলো বাইরে। এটা সত্যিকারের শব্দ, আমি বানাইনি! কান পেতে আরো দু’ একবার শুনলুম। কোনো সন্দেহ নেই, একটা জীবন্ত কিছু উপস্থিত হয়েছে।

বাগানে এসে দেখি, শব্দটা আসছে আমার রান্নাঘরের ছাদ থেকে। একটা কোনো পাখি এসে বসেছে। ভালো করে নজর করলুম। সাদা রঙের একটা প্যাঁচা। তার মানে লক্ষ্মীপ্যাঁচা? আমার মতন এক লক্ষ্মীছাড়ার বাড়িতে?

অল্প অল্প জ্যোৎস্নায় দুধ–সাদা রঙের প্যাচাটিকে বড় সুন্দর দেখায়। বিস্ময়মাখা বড় বড় চোখ, ঠিক মানুষের মতন।

আমি একটু কাছে এগিয়ে যেতেই সেই প্যাঁচা আমায় স্পষ্ট ভাষায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

আমি বিনীতভাবে বললুম, আমি নীললোহিত, এখানে নতুন অতিথি হয়ে এসেছি।

প্যাঁচাটি মাথা নেড়ে বলল, তোমার নাম জানতে চাইনি, প্রকৃত পরিচয় দাও। তুমি কে?

—আমি একজন মানুষ। আর তো কিছু পরিচয় নেই।

—তুমি নিজের পরিচয় জানো না। তুমি কী চাও?

—আমি কী চাই? তাও তো জানি না!

–তোমার জীবন কার জন্য

– আমার জীবন কার জন্য? তার মানে?

—তুমি আমার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করো না। উত্তর দাও।

—জানি না।

–তুমি কেন এখানে থাকতে চাও?

বন্দনাদি যখন এই প্রশ্নটা করেছিল, আমি তৎক্ষণাৎ বলেছিলাম, তোমার জন্য। সেই মুহূর্তে ঐ উত্তরটাই মানায় এবং সেটা সেই মুহূর্তের সত্যও বটে। কিন্তু এই নিশি–বিহঙ্গকে আমি কোন উত্তর দেব?

আমাকে নীরব থাকতে দেখে সেই শুভ্র পাখি তার দুই ডানা বিস্তার করল। ঈষৎ কঠোরভাবে বলল, তোমাকে আমি আর একটি মাত্র প্রশ্ন করব। তার সঠিক উত্তর দিতে না পারলে তোমার স্মৃতিলোপ ঘটবে। তুমি পুরোনো সব কথা ভুলে যাবে। আর যদি উত্তর দিতে পার…

আমি ভয়ে কেঁপে উঠলুম। বিষাক্ত এক পুষ্করিণীর পাশে এক বক যুধিষ্ঠিরকে অনেক প্রশ্ন করেছিল। এই প্যাঁচাও কি ছদ্মবেশী কোনো দণ্ডদাতা? কিন্তু আমি কি যুধিষ্ঠির নাকি যে শক্ত শক্ত দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব?

আমি বললুম, না না, না, আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না। আমি স্মৃতি হারাতে চাই না। আমি হার স্বীকার করছি।

—তাহলে তুমি এখানে থাকার যোগ্য নও!

এরপর আমার মাথার ওপর দিয়েই উড়াল দিয়ে সেই প্যাঁচা চলে গেল পশ্চিম দিগন্তের দিকে।

একটুক্ষণ সেখানেই মূর্তির মতন নিথরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি শুনতে · পেলুম ট্রেনের চাকার শব্দ, হকারদের চিৎকার, কফি হাউসের গমগমে আওয়াজ। আমার নাকে এলো ডাব্ল ডেকার বাসের পোড়া ডিজেলের গন্ধ, মানুষের ভিড়ের গন্ধ, খুব চেনা কোনো হাতের গন্ধ। একটু দূরেই কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে, হাতছানি দিচ্ছে।

আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললুম। সাদা প্যাঁচা তাহলে আমার স্মৃতিলোপ করে দেয়নি। আমি ভুলতে চাই না।

যারা আগেকার স্মৃতি ভুলতে চায়, তারাই তো এখানে আসে। প্যাঁচা ঠিকই বলেছে, আমি এখানে থাকার যোগ্য নই। এতদিন মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখতাম, কোনো একদিন দিকশূন্যপুরে যাব। এখানে পাকাপাকি পৌঁছে গেলে আর কোথায় যাবার স্বপ্ন দেখব? যদি এখানে থাকতে ভালো না লাগে তাহলে যে দিকশূন্যপুর চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে!

বন্দনাদি বলেছিল, প্রথম রাতটাই খুব কঠিন। প্রথম রাতেই এই সব দ্বিধা মনটাকে দুর্বল করে দেয়?

আকাশের দিকে তাকিয়ে কত রাত বোঝা যায় না। দু–একটা তারা দেখা যাচ্ছে। হাউইয়ের মতন কী যেন একটা ছুটে গেল নিঃশব্দে। এইমাত্র একটা নক্ষত্রপাত হলো? আমার বুকের ভেতরটা সমুদ্রের মতন তোলপাড় হচ্ছে, কিন্তু আমি আকাশের মতন শান্ত হতে চাইছি।

মোম জ্বেলে বাসনপত্রগুলো মেজে ফেললুম। কাজ গুছিয়ে রাখা ভালো। জল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এখন কুয়ো থেকে জল আনতে গেলে কেমন হয়?

আমার জীবনটা কার জন্য? আমি কী চাই? কোনোদিন এই প্রশ্ন আমার মনে জাগেনি। কারুর প্রতি আমার রাগ বা অভিমান নেই। তবে আমি কেন এখানে থেকে যেতে চাই? ঐ প্যাঁচা কাল আবার ফিরে আসবে, আবার প্রশ্ন করবে!

আগে এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। তাড়াতাড়ি আমার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিলুম থলিতে। রান্নাঘরের তাক থেকে পেড়ে নিলুম বই দুটো। খাতা আর কলম উদ্ধার করা যাবে না। ব্র্যাণ্ডির শিশিটাও আমি ভূমিকে দান করেছি।

বাইরে বেরিয়ে খানিকটা খুঁজতেই চটি দুটো খুঁজে পাওয়া গেল ঝোপের মধ্যে। সে দুটোকে ভরে নিলুম থলের মধ্যে, পরে কাজে লাগবে। কারুকে কিছু জানিয়ে যাবার দরকার নেই, তাছাড়া রাত্রে কারুর বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। যার বাড়িতে যাব, সে–ই ভাববে আমি ভূতের ভয় পেয়ে চলে এসেছি। এক হিসেবে মিথ্যে নয়, ভূতের টানেই চলে যাচ্ছি আমি। বন্দনাদি ঠিকই বুঝবে।

সাধারণভাবে হেঁটে যাবার বদলে আমি ছুটছি কেন? কে আমাকে টানছে! খেয়াল হবার পর আমি গতি কমালুম। এত ব্যস্ততা নেই তো কিছুর। রাত অনেক বাকি। তাছাড়া কারুর সঙ্গে দেখা হলেও ক্ষতি নেই, কেউ তো আমায় বাধা দেবে না।

বন্দনাদির বাড়ির টিলার পাশে থমকে দাঁড়ালুম। বন্দনাদি কাল একটা চুমু দেবে বলেছিল। সে কথাটা মনে হতেই যেন এলাচের গন্ধ পেলুম। সেই গন্ধটা বাতাসে ভাসতে লাগল। রাত্রির আকাশ যেন বন্দনাদির চুম্বন। থাক। পাওনা রইল। না–পাওয়া চুমুর আকর্ষণ অনেক বেশি।

এক দৌড়ে এই টিলার ওপরে উঠে গিয়ে আমি বন্দনাদির বুকে মাথা রাখতে পারি। তার বদলে আমি নদীর দিকে হাঁটতে লাগলুম। কেন? আমি কী চাই তা আমি জানি না।

কাল বোধহয় এই সময়েই বন্দনাদি একটার পর একটা গান গাইছিল। আজ সবাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। দেরি করে জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ, তা কেউ দেখল না। জ্যোৎস্না… বন্দনাদি বলেছিল, জ্যোৎস্নাকে ঠিক বিধবার মতন দেখাচ্ছে। কী করছে এখন জ্যোৎস্না? সে–ও কি ঘুমিয়েছে? জ্যোৎস্নার মুখটা আমার ভালো করে দেখার ইচ্ছে ছিল। এখন আর যাওয়া যায় না। সম্ভবত নীহারদার দেহ এখনো সেখানে রয়ে গেছে।

নদীর ধারে এসে আমি একটা সুবিধে মতন জায়গা খুঁজতে লাগলুম। নদীটা কোথাও বেশি চওড়া ও গভীর, কোথাও খানিকটা রোগা। তবু যা মনে হচ্ছে, সাঁতার কাটতেই হবে।

পাজামা–পাঞ্জাবি খুলে ফেলতে যাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ একটা ঠক ঠক শব্দ শুনতে পেলুম। সঙ্গে সঙ্গে আবার পোশাক পরে নিতে হলো। জনমানবের চিহ্ন নেই, তাহলে কিসের শব্দ। অনেকটা কাঠঠোকরার আওয়াজের মতন। ঠক ঠক ঠক! ঠক ঠক ঠক!

আওয়াজটা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলুম। একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে শব্দটা আসছে। কেমন যেন অলৌকিক লাগছে। এটা কোনো পাখির ব্যাপার নয়।

খুব সন্তর্পণে পাথরের আড়াল থেকে একটুখানি মুখ বাড়িয়ে দেখে দারুণ চমকে উঠলুম। ছায়ার মতন একটা মূর্তি, অন্ধকারের মধ্যে অনেকখানি মিশে আছে। মনে হয় মানুষ নয়। পরক্ষণেই বুঝতে পারলুম, এ তো রোহিলা, এখন আবার কালো শাড়িটা পরে এসেছে!

একটা ছেনির মতন জিনিস পাথরের খণ্ড দিয়ে ঠুকছে রোহিলা। তা দেখেই মনে পড়ে গেল, ‘আসবার সময় এখানকার একটা বড় পাথরের চাঁইতে একটা অসমাপ্ত রিলিফ ছবি দেখেছিলাম। ওটা তাহলে রোহিলারই কীর্তি? একবারও ওটার কথা উল্লেখ করেনি।

হঠাৎ ওকে চমকে দেবার বদলে প্রথমে মাটিতে পা ঘষে একটা ছোট আওয়াজ করলুম। রোহিলা মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই আমি বললুম, রোহিলা আমি নীললোহিত!

কাজ থামিয়ে রোহিলা বলল, তুমি! ঘুম আসছে না বুঝি? প্রথম রাতে ঘুম আসে না, আমিও ঘুমোতে পারিনি।

কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, তুমি এত রাতে ছবি আঁকছ? কিংবা এটা ভাস্কর্য?

রোহিলা বলল, সে রকম কিছুই না! এই পাথরটার গা কীরকম মসৃণ দেখ। এরকম পাওয়াই যায় না। এটা দেখেই মনে হয়েছিল, এটার গায়ে একটা ছবি হলে মানাবে। তাই একটু চেষ্টা করছি!

—এত রাত্তিরে কেন?

–দিনের বেলা লজ্জা করবে না? আমি কী ছবি আঁকতে জানি? সবাই এসে দেখবে। বলবে, ঠিক হচ্ছে না। কেউ বলবে মুখটা ওপরের দিকে তুলে দাও। কেউ বলবে চিবুকটা ধারালো করো! তার চেয়ে রাত্তিরেই সুবিধে! নীললোহিত, তুমি কিন্তু কারুকে বলবে না যে এটা আমার!

–আচ্ছা বলব না।

—তুমি কী করে এখানে এলে, নীললোহিত? অনেক দূর থেকে শব্দটা শোনা যায় বুঝি?

–না, আমি কাছাকাছি এসে শুনতে পেলাম!

–একটা হাতুড়ি পেলে বড্ড সুবিধে হতো! পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে ঠিক হয় না। তুমি আমাকে একটা হাতুড়ি বানিয়ে দেবে?

– আমি? আমি হয়তো পারব না, রোহিলা। তুমি বরং বসন্ত রাও–কে বলো, ওর কাছে থাকতেও পারে!

–না, আমি ওকে বলব না। তুমি তৈরি করে দেবে না কেন, নীললোহিত? তুমি তো খুব খারাপ লোক।

আমি চুপ করে রইলুম। রোহিলা ছেনিটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বলল, চলো, জলের ধারে বসি, তোমার সঙ্গে গল্প করি। এখানকার রাতগুলো বড় সুন্দর, আমার ঘুমোতে ইচ্ছে করে না।

কয়েক পা এগোবার পর রোহিলা জিজ্ঞেস করল, এ কী, তোমার কাঁধে ব্যাগ কেন?

নিজে থেকে বলতে পারছিলুম না, ও জিজ্ঞেস করাতে সুবিধে হলো। আমি রোহিলার হাত ছুঁয়ে বললুম, রোহিলা, আমি চলে যাচ্ছি।

যেন একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখছে এই ভাবে রোহিলা আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, চলে যাচ্ছ? আজ রাতেই? নীললোহিত, প্রথম রাতে এরকম হয়। আমি খুব কেঁদেছিলুম। দুতিন দিন থাক!

আমি বললুম, তুমি এখানে কেন এসেছ তা তুমি জানো। কিন্তু আমি যে সেটা জানি না!

রোহিলা বলল, এখানে কেউ কারুকে কোনো ব্যাপারে বাধা দেয় না, তাই না? আমারও তোমাকে বাধা দেওয়া উচিত নয়! কিন্তু, তুমি চলে যাচ্ছ, সেই সময় কেন আমার সঙ্গে দেখা হলো? আমার যে মনটা খুব খারাপ লাগছে! এখন আমি কী করি?

–আমি পরে আবার আসব, রোহিলা!

–আবার আসবে, তবে কেন চলে যাচ্ছ? ও, থাক, উত্তর দিতে হবে না। এখানে এসব কৌতূহল দেখাতে নেই। তুমি আবার একদিন তাজমহলের বারান্দায় গিয়ে শোবে একা একা?

—কী জানি, হতেও পারে।

– তাজমহল, খাজুরাহো মন্দিরে আমার কোনোদিন শোওয়া হলো না।

—তাতে কী হয়েছে, ওসব জায়গা মনে মনে কল্পনা করে নিলেই হয়!

রোহিলা আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। রাত্তিরবেলা কালো রঙের শাড়িতে ওকে বে–মানান লাগছে না। মনে হয় যেন অন্ধকারের মাধুরী।

আমি খুব আস্তে আস্তে বললুম, রোহিলা, আমি এবার যাই?

—নীললোহিত, তুমি আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে?

–কোথায়?

–ভয় নেই, তোমার সঙ্গে তোমার বাড়িতে যাব না। আমি আর কোনো বাড়িতেই যাব না। তুমি আমাকে তাজমহল কিংবা খাজুরাহোতে পৌঁছে দেবে?

–তা দিতে পারি। কিন্তু তারপর সেখান থেকে কোথায় যাবে?

-সে তোমাকে ভাবতে হবে না! আমি যে অনেক কিছু দেখিনি, তাই আমার কল্পনাশক্তি এত কম। এত ছোট জীবন নিয়ে আমি কী করে বাঁচব? তাই দেখতে ইচ্ছে করে… তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না?

–কেন নিয়ে যাব না, চলো!

নদীর জলে একটুখানি নেমে এলো রোহিলা। আমার হাত ধরল। আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি সত্যিই যেতে চাও? তোমার তো এখানে ভালো লাগছিল।

রোহিলা বলল, আবার ওপারে গিয়ে দেখি এখানে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে কি না?

হাঁটু জলে আসবার পর রোহিলা আমার হাত শক্ত করে ধরে বলল, নীললোহিত, আমার ভয় করছে। আমি যে সাঁতার জানি না!

—ভয় নেই। আমাকে ধরে থাকো। ডুব জল হলে আমি তোমার কোমর ধরে ভাসিয়ে নিয়ে যাব।

—তুমি ভালো সাঁতার জানো?

–তোমাকে নিয়ে যেতে পারব ঠিকই।

–আমি অন্যদিক থেকে এসেছিলাম এখানে। সেখানে নদী ছিল না, পাহাড় ছিল। পাহাড় পেরিয়ে যাওয়া সহজ। সেই দিক দিয়ে চলো।

–সেদিক দিয়ে তুমি তো একাই যেতে পারবে। আমার সাহায্য লাগবে না। রোহিলা, আমাকে এইদিক দিয়েই যেতে হবে।

কোমর জল এসে গেছে। রোহিলা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, নীললোহিত, তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও না?

–কেন চাইব না। এসো—

– না। আমি যাব না। যেতে পারবে না, তুমি ফিরে এসো। নীললোহিত, তুমি ফিরে এসো!

আমি রোহিলার হাত ধরে টানলুম, রোহিলা আমাকে টানল বিপরীত দিকে। আমরা একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। পল–অনুপল–মুহূর্ত কেটে যেতে লাগল। জোনাকির মতন ঝরে ঝরে পড়ছে জ্যোৎস্না। নদীর ওপার থেকে বাতাস এসে মাথার ওপর খেলা করছে।

দূরে কয়েকজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল হঠাৎ। কারা যেন আসছে। বোধহয় নীহারদাকে নিয়ে আসছে সমাধি দিতে।

রোহিলার কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি নেমে গেলুম গভীরতর জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *