নিরুদ্দেশের দেশে – ১০

১০

নদীর ধারে আজ বেশ জনসমাগম হয়েছে। গরম পড়ে গেছে যথেষ্ট। আমরা একটা নির্জন জায়গা খুঁজতে লাগলাম। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথরের চাঁইতে নদীটা অনেক জায়গায় আড়াল হয়ে আছে। সেরকম একটা পাথরে হেলান দিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জয়দীপ।

ডান দিক ধরে খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা ঝুপসি গাছতলায় আজও ক্যানভাস সাজিয়ে এক মনে ছবি এঁকে চলেছে বসন্ত রাও।

ওর সঙ্গে রোহিলার আলাপ করিয়ে দেব বলেছিলাম।

আমরা আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ালাম বসন্ত রাও–এর পেছনে। ভ্যান গগের সাইপ্রেস গাছের ছবির মতন কয়েকটি দেবদারু গাছের অবয়ব ফুটে উঠেছে ক্যানভাসে। তার ওপরে কি গ্রহণ–লাগা সূর্য?

বেশ কয়েক মিনিট আমাদের উপস্থিতি টেরই পেল না বসন্ত রাও। শিল্পচর্চাও গভীর ধ্যানের মতন, চার–চারজন মানুষের নিঃশ্বাস ওর গায়ে লাগছে, তবু হুঁশ নেই

বন্দনাদি চোখের ইশারায় আমাকে বলল, এখন ডাকিস না!

মুনি–ঋষিদের ধ্যানভঙ্গ করালে তাঁরা অভিশাপ দিতেন। শিল্পীদের কাছে সে ভয় নেই। তাছাড়া আমি শিল্পীদের একটু একটু চিনি, দুটি রূপসী যুবতীকে দেখলে যে–কোনো শিল্পীই খুশি মনে কাজ বন্ধ করতে পারে!

ঠিক যা ভেবেছি তাই, ওর নাম ধরে ডাকতেই মুখ ফেরাল, আমাদের চারজনের মধ্যে বেছে বেছে ও বন্দনাদি ও রোহিলাকে দ্রুত দেখে নিল, রোহিলার মুখে একটু বেশি কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলল, তারপর হাসি মুখে বলল, কী ব্যাপার, পুরো একটা ডেলিগেশান! আমার ছবি দেখতে নাকি? আমি কৃতাৰ্থ

বন্দনাদি বলল, বসন্ত রাও, তুমি নীহারদার খবর শুনেছ?

হাত থেকে তুলিটা নামিয়ে রেখে সে বলল, আমি কাল রাত্রে মাদলের ডাক শুনে জ্যোৎস্নার বাড়িতে গিয়েছিলাম। জীবন কী মধুময়, বলো, বন্দনা? জ্যোৎস্না মেয়েটি ধন্য, তার জন্য একজন মানুষ মৃত্যুকে অস্বীকার করেছে!

আমি বললুম, আমরা এই মাত্র দেখে আসছি, নীহারদা ভালো আছেন। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন!

বসন্ত রাও বলল, নীহারদা এখন মরে গেলেও ক্ষতি নেই। একটি চুম্বনের জন্য সে মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে এসেছিল, এইটুকুই যথেষ্ট। দুঃখের বিষয় আমাদের এখানে একজনও কবি নেই, তা হলে এই কাহিনীটা লিখে অমর করে রাখতে পারত! নীললোহিত, তুমি কি কবি?

আমি দু’দিকে মাথা নেড়ে বললুম, নাঃ!

বন্দনাদি বলল, বসন্ত রাও, তুমি তো এই ঘটনা নিয়ে একটা ছবি আঁকতে পার! আমরা সেই ছবি গির্জার গায়ে টাঙিয়ে রাখব!

বসন্ত রাও বলল, তোমার অনুরোধ আমি অবশ্যই মান্য করতাম, বন্দনা, যদি আমার সে ক্ষমতা থাকত। কিন্তু আমি তো মনুষ্য–মুখ আঁকি না, কোনো গল্প আঁকতে পারি না, আমি শুধু ল্যাণ্ডস্কেপ করি।

বন্দনাদি বলল, হ্যাঁ, তা তো ঠিক। তোমার যত ছবিই আমি দেখেছি, সবই গাছপালা আর পাহাড়–পর্বত নিয়ে।

বসন্ত রাও বলল, আমি কবিতা লিখতে পারি না, কিন্তু কাল রাতে আকাশ– প্রিয়া জ্যোৎস্নার বাড়িতে মহাকাশের মতন নীহারদাকে দেখে আমার চেনা একটি কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছিল!

হে প্ৰিয় নিঃশ্বাস তুমি জাহাজের পতাকা ওড়াও
হে প্ৰিয় নিঃশ্বাস তুমি পুষ্পবৃষ্টি আনো
আকাশ এসেছে কাছে, আরো কাছে এসো
জলের দর্পণ থেকে তুলে দাও নক্ষত্রের মালা
হিরণ্য গর্ভের দ্যুতি রাখো এই হাতে
আমি চলে যাবো, তাকে এই সমস্ত মহিমা
আমি দিয়ে যেতে চাই…

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার বলল, আমরা সবাই একা, তবু যাবার আগে কোনো একজনকে সব কিছু দিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো! বন্দনা, তোমাকে অনেকদিন দেখিনি!

বন্দনাদি বলল, আমরা নদীতে স্নান করতে যাচ্ছি, তুমি আসবে আমাদের সঙ্গে?

—আমাকে যে আগে ছবিটা শেষ করতে হবে। তোমরা বসো না একটু!

আমি রোহিলাকে দেখিয়ে বললাম, বসন্ত রাও, এই মেয়েটিকে চিনতে পারছ?

–না, দেখিনি তো আগে।

—হ্যাঁ দেখেছ। কাল আমরা যে ঘন কালো শাড়ি পরা মহিলাকে দেখেছিলাম …

—সেই কৃষ্ণবসনা? এই সে নাকি?

—হ্যাঁ। এখন জিনস্ পরেছে তাই চেনা যাচ্ছে না!

-ওরে বাবা! সত্যি চেনবার উপায় নেই! আগে তো দেখে মনে হতো…

রোহিলা ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, কী মনে হতো? কী মনে হতো বলো।

বসন্ত রাও লাজুক হেসে বলল, সত্যি কথা বলব? তোমাকে দেখে একটু ভয় ভয় করত। মনে হতো তুমি কৃষ্ণ–ক্ষ্যাপা। ঐ কালো পোশাক তোমাকে মানায় না, তুমি আর পরো না!

–এই নীললোহিতও আমাকে সেই কথা বলেছে। আচ্ছা ওটা আর পরব না!

আমি বললুম, বসন্ত রাও, এই মেয়েটির বয়স তিন বছর। তিন বছর আগে থেকে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। কিন্তু নিজের ছবি নিজেই পুড়িয়ে ফেলে। তুমি একটু দেখে দিও তো, ওর সত্যিই ছবি আঁকার হাত আছে কি না!

বসন্ত রাও হালকা সুরে বলল, তুমি ছবি আঁকো? তুমি নিজেই তো একটা ছবি।

এই কথায় রোহিলার মুখে একটা ম্লান ছায়া পড়ল। সে কাতর গলায় বলল, ও কথা বলো না! আমি ছবি নই, আমি মাংসের পুতুল নই। আমি মানুষ। তুমি, বন্দনাদি, নীললোহিত, জয়দীপ এদের মতন আমিও একজন মানুষ। যদি এখনো পুরোপুরি মানুষ না হয়ে থাকি, তোমরা আমাকে মানুষ করে দাও!

বন্দনাদি বলল, ঠিকই বলেছে রোহিলা। শিল্পীরা আমাদের বড্ড মেয়ে মেয়ে ভাবে, সব সময় কল্পনার রং মেখে দেখতে চায়। যেন আমরা স্বাভাবিক মানুষ নই!

বসন্ত রাও এ কথায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে রোহিলাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওকে বন্দনাদি বললে কেন? ওকে আগে চিনতে?

বন্দনাদি বলল, না। ঐ নীলু আমাকে বন্দনাদি বলে, রোহিলাও তাই শুনে শুনে…

আমি বললুম, ও তো বাচ্চা মেয়ে। শুনে শুনেই সব শিখবে!

বসন্ত রাও বলল, তোমার বয়েস তিন বছর—হাউ ইন্টারেস্টিং! তোমার মুখে খানিকটা রোদ এসে পড়েছে, তাতে সত্যিই যেন একটা শৈশবের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।

বসন্ত রাও এমনভাবে কয়েক মুহূর্ত রোহিলার দিকে তাকিয়ে রইল যে আমার মনে হলো, এতকাল সে শুধু ল্যাণ্ডস্কেপ এঁকে এলেও এবার রোহিলাকে মডেল করে ও বোধহয় হিউম্যান ফিগারও আঁকতে শুরু করবে।

এতক্ষণ জয়দীপ একটাও কথা বলেনি, এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে একটা গাছের কয়েকটি পাতা দেখছিল, এবারে সে খানিকটা অধৈর্যভাবে বলল, তোমরা কি স্নান করতে যাবে না? সূর্য যে মাথার ওপর চলে এলো।

বন্দনাদি বলল, হ্যাঁ চলো, চলো! বসন্ত রাও, তুমি পারলে চলে এসো পরে!

বসন্ত রাও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এমন লোভনীয় ব্যাপার, আমি আর ছবিতে মন বসাতে পারব না। চলো, আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।

বন্দনাদি জয়দীপের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, এই ছেলেটা কী অদ্ভুত না? এতক্ষণ একটা গাছের মতন ঠায় দাঁড়িয়েছিল, আমরা যে কত কথা বললাম, বসন্ত রাও একটা অপূর্ব কবিতা শোনাল, তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। কিছুতেই ওর এই স্বভাবটা ছাড়াতে পারছি না!

বসন্ত রাও বলল, তুমি চিন্তা করো না বন্দনা। জয়দীপ ঠিক আছে। শুধু মাঝে মাঝে ওর মনটা উধাও হয়ে যায়।

জয়দীপ একথার প্রতিবাদ করে বলল, না, আমার মন উধাও হয় না। আমি এক এক সময় আমার মনটা দুই ভুরুর মাঝখানে, কপালের এই জায়গাটায় স্থির করে রাখি। তখন অন্যদের কোনো কথা শুনতে পাই না।

বসন্ত রাও বলল, তাহলে তুমি তো দেখছি হঠযোগী!

জয়দীপ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাব না!

বন্দনাদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হলো?

জয়দীপ বলল, তোমরা যাও, আমি এখন স্নান করতে যাব না। আমার ইচ্ছে করছে না!

বসন্ত রাও জয়দীপকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করলে? হঠযোগী বলেছি বলে? সীতা রাম, সীতা রাম! আমি একটা বেহুদা লোক, যখন যা মনে আসে তাই বলি, আমার কথার কি কোনো মূল্য ধরতে আছে!

কাঠের পুতুলের মতন সে জয়দীপকে টানতে টানতে নদীর ধারে নিয়ে চলল।

বন্দনাদি হাসছে। আমি তাকে বললুম, এখানে শুধু রোহিলার বয়েসই তিন বছর নয়, আরো অনেক বাচ্চা আছে!

বন্দনাদি বলল, যা বলেছিস! এই সব বাচ্চাদের জেদ সামলাতে এক এক সময় সত্যি বেশ মুশকিল হয়।

পর পর দু’দিনের বৃষ্টিতে নদীর জল বেশ বেড়েছে। রীতিমতন স্রোত দেখা যাচ্ছে। আমি আসবার সময় কোমর জলের বেশি ছিল না। এখন মাঝখানে নিশ্চয়ই ডুবজল।

বন্দনাদি বলল, যে–যা পরে আছ তাই পরেই নেমে যাও। ভিজে গায়ে বাড়ি ফিরলেই হবে।

রোহিলারই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল নদীতে স্নান করার, কিন্তু এখন তার মুখখানি আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

সে অস্ফুট স্বরে বলল, এত জল! আমি নামব কী করে? আমি যে সাঁতার জানি না!

বন্দনাদি বলল, তাতে কী হয়েছে। আমরা তো আছি।

–না বন্দনাদি। আমার জলকে বড় ভয়। আমি একবার ডুবে গিয়েছিলাম।

—এখানে কোনো ভয় নেই। আমরা তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেব। আজ থেকেই শুরু হয়ে যাক।

–আমার দ্বারা সাঁতার শেখা হবে না কখনো। আমি যে ভয় পাই!

—এখানে যখন এসেছ, তখন সব শিখে যাবে। এখানে সবাই সাঁতার জানে। আমি আগে জাম গাছ আর জামরুল গাছের তফাৎ জানতুম না। শহরের মেয়ে, গাছপালা কি ভালো করে দেখেছি কখনো? অথচ এখন আমি কলমের চারা বানাতে পারি। আমার বাগানে দেখেছ তো কত বড় বড় বেগুন হয়েছে! তুমিও সব পারবে।

–তোমরা দুজনে আমার হাত ধরে থাকো, বন্দনাদি!

—ঠিক আছে, নীলু ধর তো একটা হাত!

আমরা দুজনে দুদিক থেকে ধরে ধরে জলে নামালুম ওকে। জল বেশ ঠাণ্ডা। শিশুর চোখের মতন টলটলে। এত মাদকতা লাগছে যেন এর আগে আমি কোনোদিন নদীতে স্নান করিনি।

রোহিলা নানারকম উঃ, আঃ, ভয় করছে, আর যাব না ইত্যাদি বলতে থাকলেও আমরা প্রায় জোর করেই ওকে নিয়ে এলাম বুকজল পর্যন্ত। তারপর বন্দনাদি বলল, তুই এবার ছেড়ে দে, নীলু!

সঙ্গে সঙ্গে বন্দনাদিও ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে হাঁটতে লাগল।

রোহিলার প্রায় কেঁদে ফেলবার জোগাড়।

বন্দনাদি বলল, শোনো, এইটুকু জলে কেউ ডুবে যায় না। তাছাড়া, আমরা তো আছিই। আজ তোমার প্রথম দিনের ট্রেনিং হলো এখান থেকে তোমার একা একা পাড়ে ফিরে যাওয়া।

রোহিলা চেঁচিয়ে উঠল, আমি পারব না, আমি পারব না!

বন্দনাদি বলল, এক্ষুনি তো ফিরছ না। এখন দাঁড়াও। পায়ের তলা দিয়ে বালি সরে গেলে পা জোর করে চেপে রাখো!

বন্দনাদির সাঁতারে ট্রেনিং ব্যাহত হলো। একটু দূরে দুজন লোক স্নান করছিল, তাদের একজন এগিয়ে এসে রোহিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি—তুমি সুলোচনা না?

রোহিলার উচ্ছলতা থেমে গেল। লোকটির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, না, আমি রোহিলা!

লোকটির মাথায় টাক, জোড়া ভুরু খুব ঘন, মুখখানা অভিমানী ধরনের। জল সরিয়ে আর একটু কাছে এসে সে বলল, তোমার চেহারা অনেক পাল্টে গেছে, মাথায় বড় চুল রেখেছ, ভুরু প্লাক করা নেই। কিন্তু তোমার কান্নার আওয়াজ শুনে চিনতে পারলুম। তুমি এখানে কবে এসেছ?

রোহিলা লোকটির চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে আবার বলল, আপনার ভুল হয়েছে। আমি রোহিলা!

লোকটি জোর দিয়ে বলল, এখন তুমি যে–নামই নাও, তুমি সুলোচনা, আমি ঠিক চিনেছি। একদিন আমার ঘরে তুমি কত কেঁদেছিলে মনে নেই? তুমি এখানে কেন এসেছ?

এই লোকটি দিকশূন্যপুরের অলিখিত নিয়ম গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। এখানে কেউ কারুর পুরোনো জীবনের পরিচিত হলেও প্রকাশ্যে এরকমভাবে জেরা করার প্রথা নেই। এখানে কেন এসেছ, সে প্রশ্ন তো করাই যায় না!

বন্দনাদির নেত্রী হবার সহজাত ক্ষমতা আছে। আমরা কেউ কিছু বলবার আগেই বন্দনাদি রোহিলার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে আড়াল করে বলল, নমস্কার, আমার নাম বন্দনা। আপনার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়নি।

লোকটি রুক্ষভাবে বলল, তুমি একটু সরে যাও। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

জয়দীপ আর বসন্ত রাও বেশ খানিকটা দূরে চলে গিয়েছিল, এখানে কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে টের পেয়ে ওরা কাছে চলে এলো।

রোহিলা বলল, বন্দনাদি, এই লোকটিকে আমি চিনি না। আমি কি এর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য?

বন্দনাদি বলল, না, ইচ্ছে না করলে তুমি একটাও কথা বলো না।

তারপর বন্দনাদি লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি বোধহয় এখানে নতুন এসেছেন? আপনাকে আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।

লোকটি চেঁচিয়ে বলল, না আমি এখানে নতুন আসিনি! বললাম না, তুমি একটু সরে দাঁড়াও, সুলোচনার সঙ্গে আমি কথা বলব।

আমি এখানকার মানুষ নই, আমার শরীরে রাগ আছে, হিংসে আছে। বন্দনাদির সঙ্গে এরকম ব্যবহার আমি সহ্য করতে পারি না। আমি বলে উঠলুম, আপনি কে মশাই? এরকম বিশ্রীভাবে কথা বলছেন?

বন্দনাদি বলল, তুই চুপ কর, নীলু।

তারপর আঙুল তুলে লোকটির প্রতি হুকুমের সুরে বলল, আপনি যেখানে স্নান করছিলেন সেখানে চলে যান। আপাতত আমরা ব্যস্ত আছি। আপনার যা কিছু কথা আছে পরে বলবেন।

লোকটি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে জয়দীপ এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। গভীরভাবে লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি একটু ওদিকে আসুন, আগে আমার সঙ্গে দু’একটি কথা বলে নিন।

জয়দীপ লোকটিকে টেনে নিয়ে চলে গেল।

বসন্ত রাও মুচকি হেসে কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, এখনো ঠিক ভাত সেদ্ধ হয়নি, তাই হাঁড়ির ঢাকনা ঢকঢকাচ্ছে।

বন্দনাদি বলল, কিছু হয়নি। আয় আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে একটু ডুব দিই, তাতেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। রোহিলা, আমি তোমার হাত ধরছি।

সবাই ডুব দিয়ে ওঠার পরই বসন্ত রাও একগাল হেসে বলল, নীলুসাহেব, তুমি হেমেন মজুমদারের ছবি দেখেছ? হায় আমি যদি ওরকম ছবি আঁকতে পারতুম!

আমি বললুম, তুমি এবারে গাছপালা ছাড়ো, মানুষ আঁকতে শুরু করো।

বসন্ত রাও রোহিলাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি ছবি আঁকো, তুমি কিসের ছবি আঁকো?

রোহিলা বলল, সে কিছু না। সেসব এলেবেলে।

আমি বললুম, রোহিলার উচিত পুরুষমানুষের ছবি আঁকা। যুগ যুগ ধরে তো পুরুষরা মেয়েদের কতরকম ছবি এঁকেছে, কত মূর্তি গড়েছে। এখন আমরা জানতে চাই, মেয়েরা কী চোখে পুরুষদের দেখে।

বসন্ত রাও বলল, ঠিক বলেছ। ঠিক আমাদের মনের কথা বলেছ! বন্দনা, এই ছেলেটাকে ছেড়ে দিচ্ছ কেন? ও তো আমাদেরই লোক। ওকে এবার যেতে দিও না, ধরে রাখো!

রোহিলা বলল, নীললোহিত এখান থেকে চলে যাবে বুঝি?

বন্দনাদি সুর করে গেয়ে উঠল, ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না, ওকে দাও ছেড়ে, দাও ছেড়ে!

গানের মাঝখানে ফিরে এলো জয়দীপ। টাক মাথা লোকটি সম্পর্কে সে একটি কথাও বলল না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না!

বসন্ত রাও বলল, না–না, এবার ওকে ফিরে যেতে দেওয়া হবে না, ওকে ধরেই রাখতে হবে!

এক আঁজলা জল তুলে সে আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে বলল, এই জর্ডন নদীতে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে দীক্ষা দিলুম নীললোহিত, তুমি বিশুদ্ধ হও, পবিত্র হও, তুমি আমাদের হও।

রোহিলা বলল, আমিও দেব। আমিও দেব। এই নাও নীললোহিত, তুমি ফিরে যাবার কথা ভুলে যাও।

বসন্ত রাও বলল, জয়দীপ, বন্দনা, তোমরাও জল ঢালো ও বেটার মাথায়! ওকে মন্ত্র দিয়ে বেঁধে ফেলো।

তারপর ওরা সবাই মিলে জল চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগল, নীললোহিত, তুমি থাকো থাকো, তুমি থাকো!

আমি প্রথম প্রথম হাসছিলুম। হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল, আমি অভিভূত হয়ে পড়লুম, সত্যি যেন একটা মন্ত্র দিয়ে আমাকে বাঁধা হলো। আমার গলা ধরে গেল, আমি কোনো ক্রমে বললুম, আচ্ছা, আমি থাকব, আমি আর ফিরে যাব না।

জয়দীপ চেঁচিয়ে বলল, বাঃ চমৎকার। এই তো চাই।

বসন্ত রাও চেঁচিয়ে বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, বাকি আছে। ও বেটার মাথা এবারে জলে ঠেসে ধরো। পুরোনো সব ময়লা ধুয়ে যাক!

ওরা ধরবার আগেই আমি ডুব দিলুম। বাল্যস্মৃতির মতন নীল জলের মধ্যে ডুব সাঁতারে চলে গেলুম অনেকটা দূরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *