নিরুদ্দেশের দেশে – ৮

সবচেয়ে আগে ঘুমিয়ে পড়ল জয়দীপ। তার একটু একটু নাক ডাকে।

রোহিলা একেবারেই গান গাইতে পারে না, কিন্তু গান ভালোবাসে খুব। আমি ধরিয়ে দেবার পর বন্দনাদি পর পর গান গেয়ে যাচ্ছে, একটা শেষ হতেই রোহিলা বলছে, আর একটা, আর একটা, প্লিজ!

কত গান বন্দনাদির এখনো মুখস্থ আছে। বই–টই কিছু লাগে না। বন্দনাদির গাইবার ধরন অনেকটা ঋতু গুহর মতন, সেই রকম একই সঙ্গে সুরেলা ও জোরাল এবং কথাগুলি স্পষ্ট। নাচ আর গান, দুটোতেই সমান প্রতিভা ছিল বন্দনাদির, কোন্ অভিমানে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার পথ তুচ্ছ করে এখানে চলে এলো, তা জানবার জন্য আমার মনটা ছটফট করে।

রোহিলা একবার উঠে দাঁড়াতেই আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি নাচবে? নাচো না, এই গানের সঙ্গে!

রোহিলা ঠোট উল্টে বলল, দূর, আমি তো ক্লাসিকাল নাচ একটুও জানি না। ইংরিজি বাজনার সঙ্গে শরীর দোলানো নাচ খানিকটা শিখেছিলুম বটে, কিন্তু তা তো এর সঙ্গে চলবে না।

–বন্দনাদি কিন্তু খুব ভালো নাচতে পারে।

–ওমা, সত্যি? তা হলে একটু নাচো, বন্দনাদি, একটু নাচ দেখাও!

গান থামিয়ে বন্দনাদি বলল, যাঃ, নাচ আমি একেবারে ভুলে গেছি! নিয়মিত প্র্যাকটিস না করলে নাচা যায় না।

আমি বন্দনাদির হাত ধরে টেনে বললুম, নাও, ওঠো, কী রকম ভুলে গেছ, সেটাই দেখি! সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা এগুলো একবার শিখলে আর কেউ জীবনে ভোলে না। নাচও সেই রকম।

–তুই ছাই জানিস! নাচ হচ্ছে ফ্রেঞ্চ ভাষার মতন, দু–এক বছর প্র্যাকটিস না করলেই জিভে আর সেই উচ্চারণ আসে না!

আমার মনে পড়ল, বন্দনাদি ফ্রেঞ্চ ভাষাও শিখেছিলেন বটে! আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে ক্লাস করার সময় স্বরূপ রায় নামে একটি যুবক বন্দনাদিকে বিয়ে করার জন্য একেবারে পাগল হয়ে উঠেছিল। সেই স্বরূপ রায় এখনো আধ–পাগল।

–তুমি ফ্রেঞ্চ ভুলে গেছ? স্বরূপ রায়ের কথা তোমার মনে আছে?

—না।

–বন্দনাদি, একটু তবু নাচ দেখাও! নাচ ছেড়ে দিলে তো শুনেছি সবাই মোটা হয়ে যায়। কই, তুমি তো মোটা হওনি। নিশ্চয়ই প্র্যাকটিস রেখেছ।

—আমি মোটা হবো কী করে, সারা দিন এখানে খাটাখাটনি করতে হয় না? রোহিলা এসে বন্দনাদির আর একটা হাত ধরল, আমরা জোর করে ওকে টেনে দাঁড় করালুম। রোহিলা বলল, একটু না দেখালে তোমাকে ছাড়বই না।

বন্দনাদি চোখ বুজে প্রথমে একটু চিন্তা করে নিল। দুটো হাত ছড়িয়ে তুড়ি দিতে দিতে তাল ও লয় এলো। তারপর পদক্ষেপ। তারপর ঊরুর ভঙ্গিমা। তারপর কোমর। তারপর বুক। শরীরটা মোটা না হলেও বন্দনাদির বুক দুটি ভারি হয়েছে মনে হয়। কিংবা, এখানে তো ব্রা পরে না।

একটা পাক দিয়ে ঘুরে যেতেই ঘাঘরাটা ছড়িয়ে প্যারাসুটের মতন হয়ে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে গিয়ে বন্দনাদি বলল, দেখলি, দেখলি, স্টেপিং কত শ্লো হয়ে গেছে।

দেখেও সেরকম আমি কিছু বুঝিনি। আমার তো মনে হলো, খুব সুন্দর, আগেরই মতন। রোহিলা বলল, চমৎকার, চমৎকার। আর একটু!

বন্দনাদি ‘আর না’ বলে বসে পড়ল। আর জোর করে লাভ নেই। বেচারি জয়দীপটা দেখতে পেল না!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, তুমি সেই যে এলাহাবাদে একটা নাচের টিমের সঙ্গে গেলে…তখনই ঠিক করে নিয়েছিলে যে আর কোনোদিন কলকাতায় ফিরবে না?

বন্দনাদি বলল, গোয়েন্দা নীলুচরণ! দ্যাখো রোহিলা, ও এখন শখের ডিটেকটিভ হয়েছে, আমাদের পেটের কথা সব বার করে নেবে। হ্যাঁরে, নীলু, তোকে যে এত বকি, তাতেও বুঝি তোর শিক্ষা হয় না?

আমি ঠিক একই সুরে বললুম, দ্যাখ্ বন্দনা, তুই আমার কাছে কী লুকোবি? তোর অনেক কথা আমি জানি! এলাহাবাদে একজনের সঙ্গে তোর দেখা হয়েছিল, যে অফিসের কাজের ছুতো করে ওখানে গিয়েছিল, কিন্তু আসলে তোরই সঙ্গে সে নিরালায় দেখা করে…

—চুপ! তোর এত সাহস, তুই আমাকে তুই তুই করে কথা বলছিস? আর ঐ সব বস্তাপচা পুরোনো কথা,…এতক্ষণ বেশ সুন্দর মুড হয়েছিল, তুই সব নষ্ট করে দিলি!

রোহিলা বলল, ঠিক বলেছ! এসব কথা কেউ শুনতে চায় না! আর গান হবে না, নাচ হবে না, তাহলে আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।

একটুখানি সরে গিয়ে বাইরের দিকে পা করে শুয়ে পড়ল রোহিলা। বিছানার কোনো বালাই নেই। বন্দনাদির একটি মাত্র বালিশ, সেটা মাথায় দিয়েছে জয়দীপ।

বন্দনাদি বলল, আমারও ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়লুম।

বন্দনাদি শুয়ে পড়ল আর একদিকে। ডান কাত হয়ে মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে।

আমি বসেই রইলুম। চোখে ঘুমের নাম–গন্ধ নেই, শুধু শুধু শুয়ে কী হবে? অন্য যে–কোনো জায়গা হলে এই সময় একটা সিগারেট ধরাতুম। কিন্তু এখানে সাহস হচ্ছে না। এখানে সবাই স্বাধীন, কিন্তু সিগারেটের ওপর নিষেধাজ্ঞাটা বোধহয় স্বাধীনতা–হরণের পর্যায়ে পড়ে না। যেমন কুয়োর জলে বিষ মেশাবার স্বাধীনতা কারুর নেই। মাঝ রাতে একটি মেয়ের গলা টিপে ধরার স্বাধীনতাও কারুকে দেওয়া যায় না।

আজ দ্বিতীয়বার কেন মাদল বাজল? স্বর্গলোকে সত্যিই দৈত্যের উপদ্রব শুরু হয়েছে? আজ রাতে কি কেউ জ্যোৎস্নার বাড়ির সামনে পাহারা দেবে?

চুপচাপ সময় কেটে যেতে লাগল। বাইরে কোনো শব্দ নেই। এখানে কোনো কুকুর নেই। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। রাস্তায় কুকুরের ডাক শোনা যায় না। এমন জায়গাও রয়েছে ভারতবর্ষে! শুধু শোনা যাচ্ছে ঘুমন্তদের নিঃশ্বাস। জয়দীপের তো অদ্ভুত চরিত্র। এরকম নিশ্চিন্তভাবে কেউ ঘুমোতে পারছে? দু দিকে দুই সুস্বাস্থ্যবতী তরুণী, তার মাঝখানে ঘুমোনো যায়? আমার দ্বারা তো সম্ভব না কিছুতেই। সারা রাত গল্প করা যেতে পারে, কিন্তু পাশাপাশি শুয়ে থাকা…না, আমি শুকদেব নই।

তার থেকে একটু হেঁটে এলে মন্দ হয় না। কিংবা সেই গির্জাটার মধ্যে একা একা ঘুমোবার চেষ্টা করলে কেমন হয়?

আমি উঠে পড়লুম। বাগানটা পার হবার আগেই বন্দনাদি ডাকল, এই নীলু কোথায় যাচ্ছিস? এই নীলু!

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে হাত নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু বন্দনাদি তা বুঝল না, ধড়মড় করে উঠে প্রায় ছুটে চলে এলো। আমার হাত ধরে বলল, রাগ হয়েছে বুঝি বাবুর? আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া হচ্ছে!

আমি ফিরে দাঁড়িয়ে বললুম, তুমি ঘুমোওনি?

–তুই শুয়ে পড়ছিস না দেখে আমারও ঘুমটা ঠিক আসছিল না!

–বন্দনাদি, আজ তোমাকে ঐ কথাটা ঐরকমভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি। আমার মাথাতেও বোধহয় মাঝে মাঝে পাগলামি চাপে। ভাবলুম, তোমাকে একটা আঘাত দিয়ে তোমার মুখ থেকে কথা বার করব।

—তোরা সব সময় গল্প মেলাতে চাস, তাই না? কিন্তু সকলের জীবনে কি আর রোমহর্ষক গল্প থাকে? অনেকের জীবন সাদামাটাও হয়। মনের খেয়ালে এমনিই কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। এর মধ্যে গল্পের কী আছে?

–তোমার জীবন মোটেই সেরকম নয়। তোমার ব্যাপারটা এমনই রোমাঞ্চকর যে প্রায় অবিশ্বাস্য। সবটা জানি না, অনেকটাই রহস্যে ঢাকা, সেইজন্যই কৌতূহল এত বেশি।

—জানতেই হবে, তার কি কোনো মানে আছে, চল, শুয়ে পড়বি চল।

— আমার এখন ঘুম আসছে না। বড্ড গরম লাগছিল। বৃষ্টি তো থেমে গেছে, আমি একটু হেঁটে আসি।

–তুই একা একা যাবি?

–তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

—আমি? আমি গেলে তোর ভালো লাগবে? তুই বরং রোহিলাকে ডাক। ওকে নিয়ে বেড়াতে যা। ও মেয়েটা বড্ড প্রেম করতে চাইছিল। এখানে কিন্তু সত্যি ভয়ের কিছু নেই। জ্যোৎস্না নামের মেয়েটির কাল সত্যি কী হয়েছিল, পুরোটা তো জানা হলো না। হয়তো অন্য কোনো ব্যাপার আছে। নইলে এখানে কেউ গলা টিপে ধরবে, আমার সত্যি বিশ্বাস হয় না। তুই দাঁড়া, আমি রোহিলাকে ডেকে দিচ্ছি! আমি বন্দনাদির হাত চেপে ধরে কড়া গলায় বললুম, শোনো, আমি কলকাতা থেকে এখানে কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে আসিনি। কলকাতায় মেয়ের অভাব নেই। আমি এত দূরে আসি, শুধু তোমাকে দেখবার জন্য।

বেশ কয়েক মুহূর্ত অপলক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল বন্দনাদি। তারপর অস্ফুট ভাবে বলল, তুই আমাকে সত্যিই ভালোবাসিস, নারে নীলু? আমারই বুঝতে ভুল হয়।

একটু থেমে, আমার কাঁধে হাত রেখে আবার বলল, আমি ভেবেছিলুম রোহিলাকে তোর খুব পছন্দ হয়েছে।

–অপছন্দের কোনো কারণ নেই। কিন্তু সেটা অন্য কথা!

—ঠিক। চল, একটু হাঁটি।

বাগান থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ পার হবার পর আবার থমকে দাঁড়িয়ে বন্দনাদি বলল, এর মধ্যে দু’বারই তুই আমাকে রূপসার খবর এনে দিয়েছিস। এক হিসেবে তোর জন্যই আমি এখানে থাকতে পারছি। এতদিন রূপসার কোনো খবর না পেলে আমি বোধহয় থাকতে পারতুম না। রূপসাকে দেখবার জন্য ছুটে যেতুম, আর ফেরা হতো না। পরশু রূপসাকে স্বপ্ন দেখলুম, তারপর কাল সারাদিন মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল, আজই তুই এসে পৌঁছে গেলি। কী আশ্চর্য না!

–আমি শুধু রূপসার খবর আনিনি। ওর একটা ছবিও এনেছি।

—অ্যাঁ? ছবি? এখনকার? কই? কোথায় সেই ছবি? এতক্ষণ বলিসনি কেন?

—আমার ঝোলার মধ্যে আছে। ফিরে গিয়ে দেখাব! ছবিটা কী করে পেলাম জানো? তপেশদার বসবার ঘরের টেবিলে একটা ফ্রেমে বাঁধানো গ্রুপ ছবি ছিল। তপেশদা একবার ভেতরে যেতেই আমি সেটা টপ করে পকেটে ভরে নিয়েছি। পরে ওরা ছবিটা খোঁজাখুঁজি করবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি সাধারণ একটা ফ্যামিলি গ্রুপ ছবি চুরি করতে পারি, এটা ওরা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না।

—পাগল ছেলে একটা। তুই আমার জন্য এত সব করতে গেলি? কেন রে?

–তোমাকে ভালোবাসি বলে।

—তুই সেই ছোট বয়েস থেকেই আমায় খুব ভালোবাসিস, আমি জানি, কিন্তু আমারই মনে থাকে না। আমি তোকে বকুনি দিই!

—আকাশের মতন ভালোবাসার রং–ও পাল্টায়। ছোটবেলায় আমি ছিলাম তোমার ভক্ত। তোমার হাসি, তোমার কথা বলা, সব কিছুই ছিল অন্য রকম। বড় হবার পর আমি ঠিক আর ভক্ত থাকিনি, অন্য কিছু, তবে তোমার কাছাকাছি যাইনি। দূর থেকে লক্ষ্য করতুম। তুমি যে হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে যাবে, তা কখনো কল্পনাও করিনি। বন্দনাদি, সেদিন আমি কেঁদেছিলাম, খুব কেঁদেছিলাম, তোমার কাছে এখন স্বীকার করতে লজ্জা নেই। তোমার জন্যই আমি অনেক কষ্টে এই দিকশূন্যপুর খুঁজে বার করেছি।

— নীলু?

বন্দনাদি আর কিছু না বলে আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরল। আমার চুলে হাত ডুবিয়ে বলতে লাগল, নীলু, তুই এত ভালো…।

এসবই স্নেহের অভিব্যক্তি। আমার ঠিক পছন্দ হলো না। না চাইতেই আমি জীবনে অনেক স্নেহ পেয়েছি বলেই বোধহয় আমি স্নেহের মর্ম বুঝি না। স্নেহের চেয়েও খানিকটা চড়া ধরনের কিছুর প্রতি আমার আকর্ষণ। আমার নিজের কোনো দিদি নেই, তাই পৃথিবীর কোনো রমণীকেই আমি দিদি ভাবে দেখি না।

আমি বন্দনাদির আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে মাথাটা সরিয়ে নিলাম। তারপর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার কোমরে বাঁ–হাত রেখে ডান হাত রাখলুম তার বুকে। এটা আমার প্ৰতিবাদ।

বন্দনাদি কোনো আপত্তি করল না, সরে গেল না, স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হু–হু করে পল–অনুপল কেটে যেতে লাগল। পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে তা এখন টের পাচ্ছি। অন্তরীক্ষে বেজে চলেছে নিস্তব্ধতার এক বিশ্বসঙ্গীত।

বন্দনাদির বুকে আমি হাত রেখেছি বটে কিন্তু চাপ দিইনি। যেন একটা পায়রার গা। আমার হাত থেমে আছে, কিন্তু আমার শরীর দুলছে।

এক সময় বললুম, বন্দনাদি, তোমায় একটু আদর করব? বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল।

বন্দনাদি তার বুকের ওপর রাখা আমার হাতটা ধরে নিজের গালে ছোঁয়াল। আস্তে আস্তে বলল, আমায় এইখানে আদর কর, নীলু! হয়তো আমি তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না।

––আমি বুঝেছি!

বন্দনাদির গালে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে দেখলুম তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। সেই অশ্রু মুছে দিতে দিতে বললুম, আমি তোমায় দুঃখ দিয়েছি? তুমি এত সুন্দর, তাই তোমাকে না ছুঁয়ে পারা যায় না।

—না–না, দুঃখ নয়। তুই এসেছিস, সে জন্য আমার যে কী অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে, তা ঠিক মুখে বলা যায় না।

ঝট করে আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে বন্দনাদি আমার ঠোঁট খুঁজল। তারপর একটা উষ্ণ, গভীর পরিপূর্ণ চুম্বন দিল।

ফের নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝলমলে ভাবে হেসে বলল, এবারে পছন্দ হয়েছে?

-এর চেয়ে বেশি কিছু পাবার কথা আমি কল্পনাই করিনি!

—দ্যাখ মেঘ কেটে গেছে, সুন্দর জ্যোৎস্না ফুটেছে। ওরা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, আমরা একটু বেড়িয়ে আসি। ঘুম পাচ্ছে না একটুও।

দু’জনে হাতে হাত ধরে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটতে লাগলুম। টিলা থেকে খানিকটা নেমে একটা বেশ চওড়া পাথর চোখে পড়ল। এখানে বসলে সামনে একেবারে খোলা উপত্যকা দেখা যায়।

সেই পাথরটার কাছে এসে বন্দনাদি বলল, এখানে আমি প্রায় রাত্তিরেই এসে একা একা বসে থাকি। এখানে এসেই কেন জানি না পুরোনো সব কথা মনে পড়ে। ওপরে নিজের বাড়িতে কিন্তু অতটা মনে পড়ে না।

–এসো, এখানে একটু বসা যাক। তোমাদের এখানে বেশ মজা আছে, রাত জাগলেও ক্ষতি নেই, পরের দিন তো কাজে যেতে হবে না।

—আসলে খুব বেশি ঘুমের দরকার হয় না। সারা দিনে–রাতে ভাগ ভাগ করে পাঁচ ছ’ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলেই হয়। তুই এখানে কিছুদিন থাকলে বুঝতে পারবি, মানুষের প্রয়োজন কত কম। সিগারেট, মদ, পারফিউম, লিপস্টিক, সাবান, টুথপেস্ট এসব কোনোটারই দরকার হয় না। তাতেও অনেক আনন্দ পাওয়া যায়।

—তা জানি। কিন্তু একবার এসবে অভ্যেস হয়ে গেলে ছাড়তে পারাটা যে খুব কঠিন।

–সবচেয়ে পুরোনো অভ্যেস হচ্ছে নিজের বাড়ি। সেটা যে ছাড়তে পারে, তার পক্ষে অন্য কিছুই ছাড়া কঠিন নয়।

-একটা কথা জিজ্ঞেস করব, বন্দনাদি? শরীরের কিছু কিছু দাবি থাকে, তাও কি তোমরা বাদ দিয়েছ?

–না–না, তা বাদ দেব কেন? যার যা ইচ্ছে হবে, তা বাদ দেবার তো কোনো প্রশ্নই নেই। আমার ব্যাপারটা তোকে বলি, যে–কোনো কারুর সঙ্গে শারীরিক মিলন, আমার একদম পছন্দ হয় না। ও জিনিসটাকে আমি পবিত্র মনে করি, সত্যিকারের কারুর সঙ্গে মনের মিল হলেই তবে ওটা ভালো লাগে। তা বলে আমার কোনো শুচিবাই নেই। কেউ আমার গায়ে একটু হাত রাখলেই আমার গা ক্ষয়ে যায় না। কারুর কারুর এ রকম থাকে। এই জয়দীপের কথাই ধর না। ওর আগেকার জীবনে কী ছিল, আমি জানি না, কিন্তু ও মেয়েদের স্পর্শ সহ্য করতে পারে না। আমি একদিন এমনিই হালকা ভাবে ওকে একটু চুমু খেতে গিয়েছিলাম, ও মাথা সরিয়ে নিয়ে বলেছিল, না, না, না, না!

–আমি ভুল ভেবেছিলাম। আমার ধারণা হয়েছিল, জয়দীপ তোমার প্ৰেমিক!

—জয়দীপকে আমি প্রেমিক হিসেবে চিন্তাই করতে পারি না। তবে আমি বন্ধু হিসেবে ওকে সাহায্য করতে চাই।

—অতবড় চেহারার মানুষটা, কিন্তু খুব অসহায় মনে হয়।

—এখানে এসে অনেককে দেখছি তো? প্রথম প্রথম যাদের খুব অস্বাভাবিক মনে হয়, যাদের মন খুবই অস্থির কিংবা অসুস্থ, তারাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। এই জায়গাটার একটা গুণ আছে ঠিকই। মানুষের উন্নতি আর অবনতির মূল কারণ কিন্তু একটাই। প্রতিযোগিতা! এই প্রতিযোগিতায় দু’ একজনই তো মাত্র জেতে। আর যারা হেরে যায়? তাদের সংখ্যাই তো বেশি, তারা সবাই ওটা ঠিক মেনে নিতে পারে না। তাদের কারুর কারুর কেন্দ্র নড়ে যায়। আমাদের এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। তাই আমরা সবাই সুখী।

–প্রতিযোগিতার বদলে এখানে সহযোগিতা।

—ঠিক তাই। আচ্ছা নীলু, তুই যে তখন বললি, এলাহাবাদে আমার সঙ্গে একজনের দেখা হয়েছিল, সে অফিসের কাজের ছুতো করে এসেছিল, সে কে তা তুই জানিস?

—হ্যাঁ জানি। দীপক নামে আমার এক বন্ধু বলেছে, সে তোমাদের দু’জনকেই এলাহাবাদে দেখেছিল।

– আমি যেখানে যেখানে মিউজিক কনফারেন্সে যেতাম, সেখানেই সে যেত, তাও কি তুই জানিস?

–আন্দাজ করতে পারি।

–তোকে আমি এখন যা বলব, তুই পৃথিবীর আর কারুকে তা বলবি না, বল?

—আমি কী প্রতিজ্ঞা করব বলো? তোমার পা ছুঁয়ে?

–না, অত ভক্তির দরকার নেই। আমার হাত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।

আমি বন্দনাদির দুটি হাত তুলে এনে আমার ঠোটে ছোঁয়ালুম। তারপর বললুম, গোপনীয়তা একটা বিরাট কঠিন বোঝা, সারা জীবন একা একা বহন করা যায় না।

বন্দনাদি সামনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে যেন ছায়াছবি দেখছে এইভাবে বলল, তোরা জানিস, আমার অনেক বন্ধু ছিল, আমি খোলামেলাভাবে মিশতাম। ফাস্ট লাইফের দিকে আমার ঝোঁক ছিল, গাড়ি করে হঠাৎ ডায়মণ্ডহারবার যাওয়া কিংবা কোনো ফাংশান শেষ হবার পর সারারাত এয়ারপোর্ট হোটেলে…অনেকে ভাবত আমি বুঝি ছেলেদের সঙ্গে যা–খুশি তাই–ই করি।

– না, তা ভাবত না কেউ। বরং সবার ধারণা ছিল, তুমি সহজভাবে মিশলেও কিছুতেই ধরা দিতে চাও না।

—তুই কী করে জানলি?

-আমি তো তোমার প্রেমিক ছিলাম না, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। এই ভালোবাসার তুমি যে নামই দাও! আমি দূর থেকে সব সময় লক্ষ করতাম তোমাকে।

—আমি যখন বাইরে যেতাম, তখন তুই দেখতে পেতিস না আমাকে।

—তা পেতাম না অবশ্য। স্বরূপ রায় তোমার সঙ্গে বাইরেও যাবার চেষ্টা করত অবশ্য।

–না–না, স্বরূপ কেউ নয়, ও তো একটা পাগল। একবার বেঙ্গালোরে একটা অনুষ্ঠান করার সময় দেখি, দর্শকদের মধ্যে থার্ড রো–তে একজন বসে আছে। আমার খুব চেনা। তিনি অফিসের কাজে ওখানে গিয়েছিলেন, হঠাৎ আমার অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে দেখতে এসেছিলেন। আমি চমকে গেছিলাম, খুব ভালোও লেগেছিল।

–তপেশদা!

—তুই জানিস! বলিস না, প্লীজ, লক্ষ্মীটি, কারুকে বলিস না।

– না, বলব না। তারপর?

—তপেশদা সব সময় ভালো হোটেলে ওঠে। আমাকে ডেকে নিয়ে ডিনার খাওয়ালেন। পরের মাসে একটা অনুষ্ঠান ছিল জামশেদপুরে। সেখানেও দেখলুম তপেশদাকে। জোর দিয়ে বললেন, সেখানেও অফিসের কাজেই এসেছে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে ওর অফিসের কী কাজ থাকতে পারে? সেখানে তপেশদাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলুম, একী? তপেশদা বলল, আমার আসল কাজ ছিল দুর্গাপুরে, তোমার অনুষ্ঠানের একটা পোস্টার দেখে এই পর্যন্ত চলে এলাম। তোমার প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানই আমার দেখতে ইচ্ছে করে।

—অপর্ণাদিকে উনি জানিয়েছিলেন কী?

—তখন আমি বাবা–মায়ের সঙ্গে থাকি। দিদির বাড়িতে তো আর রোজ যাই না। প্রথমবার বেঙ্গালোরে ষে তপেশদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে কথা আমি নিজেই দিদিকে বলেছি। পরেরগুলো তপেশদা জানিয়েছিলেন কি না, তা তো আমি জানি না। তপেশদার সেলস–এর চাকরি, নানান জায়গায় যেতেই হয়। আমার জামাইবাবু আমার অনুষ্ঠান সম্পর্কে এত আগ্রহী তা জেনে আমার ভালো লাগবে না? তখন তো আমি মশগুল হয়ে ছিলাম। তপেশদা চমৎকার মানুষ, হৈ চৈ ভালোবাসেন, ওঁর চেনাশুনোর সংখ্যা অনেক, অচেনা জায়গায় ফাংশান করতে গেলে উনি অনেক হোমরা–চোমরা লোকদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন। তপেশদার উৎসাহেই আমার প্রথম রেকর্ড বেরোয়। বাইরের শহরে তপেশদা আমাকে হোটেলে নিয়ে খাওয়াতেন, তখন আমি ড্রিংক করতাম, সিগারেট খেতাম, তুই তো জানিস তপেশদা আদর করে আমায় জড়িয়ে ধরতেন, গালে চুমু খেতেন, জামাইবাবু এরকম করতেই পারে। একদিন আমাদের দু’জনেরই একটু নেশা হয়ে গিয়েছিল, তপেশদা আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন, তারপর আদর করতে করতে—ঐ ব্যাপারটা হয়ে গেল।

–সেই জায়গাটা কোথায়?

—হ্যাঁ, জায়গাটি ইম্পর্ট্যান্ট। সেবারে ফাংশান করতে গিয়েছিলাম শিলং–এ। ফাংশন খুব ভালোভাবে হয়ে গেল, তপেশদা আমাকে নিয়ে বেড়ালেন খানিকক্ষণ, রেস কোর্সের দিকে গিয়েছিলাম, কী চমৎকার লাগছিল, শীত ছিল না বেশি, হাওয়া দিচ্ছিল, তারপর বৃষ্টি নামল, আমরা হোটেলে চলে এলাম। ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিতে দিতে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখা…

দৃশ্যটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। নাচের অনুষ্ঠান থাকলে বন্দনাদি দারুণ সাজগোজ করত। অনুষ্ঠান ভালো হয়েছে,তাই মনটা খুশির চাঞ্চল্যে ভরা, তারপর তপেশদার সঙ্গে বেড়ানো, পটভূমিকায় শিলং–এর বিখ্যাত সৌন্দর্য, হোটেলে এসে ব্র্যাণ্ডি পান…এই রকম একটা সন্ধের জন্যই জীবনটা বদলে যেতে পারে।

বন্দনাদি বলল, প্রথমে আমি ঘটনাটাকে গুরুত্ব দিইনি খুব বেশি। সকালে উঠে কান্নাকাটি করেছিলুম বটে কিন্তু এটাও বুঝেছিলুম, আগে থেকে ঠিকঠাক করে তো কিছু হয়নি। এমনিই এক রাত্রির মাদকতা! ছোড়দিকে আমি খুবই ভালোবাসি, ছোড়দি জানতে পারলে দুঃখ পাবে, তপেশদার ওপরেই বেশি রাগ করবে, তাই ঠিক করলুম, একেবারে কিছু না বলাই ভালো। কিন্তু তপেশদাই পাপ বোধে ভুগতে লাগল। ওর ধারণা হলো, আমার খুব ক্ষতি করে দিয়েছে, সেটা শোধরাবার দায়িত্বও ওর। যখন বোঝা গেল যে আমি প্রেগন্যান্ট তখন তপেশদা বলল, আমাকে বিলেতে পাঠিয়ে দেবে, সেখান থেকে কিউরেট করে…। তাতেই আমার জেদ চেপে গেল। আমি কি নিজের দায়িত্ব নিতে পারি না? যা হয়ে গেছে, তাতে আমারও তো সমান দায়িত্ব ছিল! আমি জীবনে একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত মারিনি, আর একটা মনুষ্যপ্রাণ, আমার প্রথম সন্তান, তাকে মেরে ফেলব। কোনো আর্টিস্ট তা পারে?

—তুমি তো বিলেতেই গিয়েছিলে?

—বিলেতে নয়, ক্যানাডায়। সেখানে তপেশদা পাঠাননি, আমি নিজেই একটা কোর্স করতে গিয়েছিলাম। এক বছর বাদে আমি রূপসাকে কোলে নিয়ে ফিরলে সবচেয়ে বেশি চমকে গিয়েছিল তপেশদা। সবাই ভাবল, ক্যানাডায় আমার বিয়ে হয়েছে, সেখানে আমার স্বামী আছে। আমি মিথ্যে কথা বলি না, আমি জানিয়েছিলুম যে ক্যানাডায় আমার স্বামী নেই। তখন সবাই ভাবল, ওখানে আমার বিয়ের পরেই ডিভোর্স হয়ে গেছে।

–তুমি ক্যানাডা থেকে ফিরে এলে কেন?

—কারণ কলকাতাই ছিল আমার নিজস্ব জায়গা। আমার নাচ ও গানের জগৎ তো কলকাতাকে ঘিরেই। ক্যানাডায় থেকে কী করব!

—তখন তুমি বাবা–মায়ের কাছ থেকে চলে এসে পার্ক সার্কাসে আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে। তখনও তোমার অনেক অ্যাডমায়ারার ছিল। আচ্ছা বন্দনাদি, তুমি তো তারপরেও কারুকে বিয়ে করতে পারতে। আজকাল ডিভোর্সি মেয়েদের, একটি–দুটি বাচ্চা সমেত তো বিয়ে হয় দেখেছি।

—সেটা ভেবে দেখা যেত। বিয়ে না করলেই বা ক্ষতি কী ছিল? তখন আমি নিজে রোজগার করছিলাম, ভেবেছিলাম রূপসা একটু বড় হলে ওকে হস্টেলে পাঠিয়ে আমি গান–বাজনা নিয়েই থাকব। ঐসবের দিকেই তো খুব ঝোঁক ছিল। কিন্তু, সব গণ্ডগোল করে দিল তপেশদা। ওঃ কী কষ্ট যে পেয়েছি তখন, তুই বুঝবি না, কেউ বুঝবে না। রূপসার যখন আড়াই বছর বয়েস, তখন আমি আবার একটা ফাংশান করতে গেলাম পাটনায়। মাঝখানে অনেক দিন যাইনি। সেই পাটনাতেও গিয়ে দেখি সেখানে তপেশদা উপস্থিত। আমার রাগও হলো, দুঃখও হলো। আমি বললুম, তুমি এ কী করছ, তপেশদা! আগে যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, কিন্তু এখন তুমি এরকম বাড়াবাড়ি করলে সব জানাজানি হয়ে যাবে! তপেশদা কিছুতেই শুনবে না। তার তখন ঠিক পাগলের মতন অবস্থা। নেশাও করছে খুব। আমার তখন কী করার ছিল বল তো? আমি কি আমার নিজের ছোড়দির সংসার ভাঙব? ছোড়দির সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, কোনোদিন ঝগড়া হয়নি! আমি সেই ছোড়দির সর্বনাশ করতে পারি? তাছাড়া, তপেশদার সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার মনে জাগে নি। আর এটা এমনই ব্যাপার যে অন্য কারুর কাছে সাহায্যও চাওয়া যায় না। তপেশদা আমার বারণ শুনল না, বাইরের সব ফাংশানে আসতে লাগল। তখন আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো। এলাহাবাদে যাবার সময়েই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেই গিয়েছিলুম, সেখানেও যদি তপেশদাকে দেখি, তাহলে আমি আর ফিরব না। আমার মেয়ে ছোড়দির কাছে ভালোই থাকবে। ছোড়দি তাকে নিজের মেয়ের মতনই দেখবে, তপেশদাও অযত্ন করতে পারবে না। আমার যা হয় তা

—এলাহাবাদ থেকে তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে। তারপর এখানে কী করে এলে? এই জায়গাটার কথা তুমি আগে জানতে?

–না, জানতুম না। অনেক ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পৌঁছেছি। এই জায়গাটায় তো সহজে আসা যায় না, দিকশূন্যপুরকে আবিষ্কার করতে হয়। তবে এখানে যারা আসে, তারা অনেক দুঃখে পুড়ে খাঁটি হয়ে আসে।

—এখানে এলে সবারই পিছুটান চলে যায়?

—সবার যায় কি না জানি না। কেউ কেউ তো ফিরেও যায় দেখেছি। কিন্তু আমার আর একটুও পিছুটান নেই। লোকে আমাকে ভালো বলবে, নাচ–গানের জন্য খ্যাতি হবে, এই মোহটা যে একদম চলে গেছে, এখন একলা জঙ্গলের গাছপালাকে গান গেয়ে শোনাই, তাতেও ভালো লাগে।

—কিন্তু রূপসা, রূপসার জন্য টান নেই!

ও হ্যাঁ, তোকে ভুল বলেছি, ঐ একটা পিছুটান এখনো আমার রয়ে গেছে এক এক সময় বুক টনটন করে, মনে হয় ছুটে যাই। রাত্তিরে ঘুম ভেঙে উঠে বসি, ফাকা বুকটার কাছে দু’হাত এনে ওকে আদর করি। রূপসা হয়তো একদিন– আমাকে ভুলে যাবে, কিন্তু আমি যে ওকে কিছুতেই ভুলতে পারব না!

একটু থেমে বন্দনাদি আবার বলল, তপেশদার ওপর এখন আমার একটুও রাগ নেই। তপেশদার জন্যই তো আমি শেষ পর্যন্ত এখানে এসে পৌঁছেছি, আগেকার জীবনের চেয়ে এখানে অনেক বেশি সুখে আছি।

–হয়তো তপেশদা এখনো কষ্ট পাচ্ছে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না, নিজেকে আজকাল সব সময় কাজেকর্মে ব্যস্ত রাখেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট আছে নিশ্চয়ই।

– অনেক মানুষ কষ্ট পাবার জন্য কষ্ট তৈরি করে। এখানে ওসব বালাই নেই। কেউ অকারণে নিজেও কষ্ট পায় না, অন্যকেও কষ্ট দেয় না!

—তা হলে জ্যোৎস্নার ব্যাপারটা?

—ওটা শুনে আমি সত্যিই আশ্চর্য হয়েছি। ভালো করে জানতে হবে। ঠিক এ সময় একটা আর্তস্বর শুনতে পেলাম। নারী কণ্ঠ, বন্দনাদির বাড়ি থেকে। ওখানে জয়দীপ আর রোহিলা ‘শুয়ে আছে।

শব্দটা একবার হয়েই থেমে গেল। বন্দনাদি তাকাল আমার চোখের দিকে। তারপর কেউ কিছু না বলে দ্রুত পা চালালুম।

ওপরে এসে দেখলুম, জয়দীপ তখনও শুয়ে আছে পাশ ফিরে, একটু দূরে বসে আছে রোহিলা, দু’হাতে মুখ ঢাকা।

আমরা কাছে যেতেই রোহিলা বলল, তোমরা কোথায় চলে গিয়েছিলে আমার ভয় করছিল খুব। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল…

আমি জয়দীপের দিকে তাকাতেই রোহিলা আবার বলল, ওঃ, কী ঘুম ঘুমোতে পারে, আমি ডাকলুম, তাও উঠল না!

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, তুমি চেঁচিয়ে উঠলে কেন?

—একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখলুম। একটা মস্ত বড় দাঁড়িপাল্লা, তার একদিকে আমাকে বসানো হয়েছে, আমার গায়ে কোনো জামাকাপড় নেই, আর অন্যদিকে অনেক টাকা আর শিশি–বোতল। কয়েকজন লোক মিলে আমাকে ওজন করে বিক্রি করে দিচ্ছে। লোকগুলোকে আমি চিনি। ওরা আমাকে আগেও কয়েকবার বিক্রি করে দিয়েছে। কেন এই স্বপ্নটা দেখলুম? বন্দনাদি, ওরা আবার এখানে আসবে না তো? আমাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো?

রোহিলার মুখে সত্যিকারের ব্যাকুলতা দেখে বন্দনাদি এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, যাঃ পাগল।! এখানে ওরা কেউ আসবে না। ঐসব খারাপ লোক দিকশূন্যপুরের সন্ধান কোনোদিনই পাবে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *