নিরুদ্দেশের দেশে – ৫

বাইরে এসে মনে হলো, ঐ কৃষ্ণবসনাকে একবার বাজিয়ে দেখাই যাক না। কামড়ে তো দেবে না!

মহিলাটি এখন বারান্দায় নেই। আমি কাছাকাছি গিয়ে দু’একবার গলা খাঁকারি দিলুম। যার নাম জানি না তাকে কী বলে ডাকব?

এই বাড়িটাতে আগে কে ছিল? ঠিক মনে করতে পারি না। আমি অবশ্য এখানকার সবাইকে চিনি না। কেউ কেউ আজীবন থাকবে বলে আসে কিন্তু দু’এক বছর বাদে ফিরে যায়। এ বাড়ির আগের মালিক শৌখিন ছিলেন। তিনি বেগুন– আলু–পেঁয়াজ চাষ করার বদলে অনেকগুলি গোলাপ গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছগুলি এখন বিবৰ্ণ।

আমি ইচ্ছে করে মোরাম ঢালা পথে পা ঘষার শব্দ করলুম। তাতেই বেরিয়ে এলো মহিলাটি। ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে রইল সোজাসুজি।

আমি দু’ হাত তুলে বললুম, নমস্কার।

সে প্রতিনমস্কার করল না, কোনো উত্তরও দিল না। তাকিয়ে রইল একই ভাবে। ওর মুখের মধ্যে এমন একটা ভাব আছে যা চেনা চেনা, অথচ এই মহিলাকে আমি আগে কখনো দেখিনি, তা নিশ্চিত।

আবার বললুম, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি। অবশ্য এখন যদি আপনার অসুবিধে থাকে পরে আসব।

রমণীটি এবারে বলল, এসো, ভেতরে এসো।

প্রথমেই তুমি সম্বোধনে একটু চমক লাগে। ওর বয়েস তেত্রিশ–চৌত্রিশের বেশি নয়। অন্ধকারের সঙ্গে ওর কালো শাড়িখানা মিশে গেছে, দেখা যাচ্ছে শুধু মুখখানা আর হাত দুটি।

আমি বললুম, ঘরের মধ্যে তো বড্ড অন্ধকার, বাইরেই বসা যাক না।

– না, তুমি ভেতরে এসো।

ঘরে ঢুকে সে একটি মোটা লাল রঙের মোমবাতি জ্বালাল। সে ঘরে রয়েছে একটা খাট, একটি চেয়ার আর দেওয়ালে একটি আয়না।

সে নিজে চেয়ারটায় বসে আমাকে খাটে বসতে ইঙ্গিত করল। আমিও পা ঝুলিয়ে বসে পড়লুম বিনা দ্বিধায়, দিকশূন্যপুরে কোনো কিছুই অস্বাভাবিক নয়।

—আমার নাম রোহিলা। তুমি কে?

– আমার নাম নীললোহিত। আমি এখানে থাকি না, বাইরে থেকে বেড়াতে এসেছি আজই।

– আমি এসেছি বারোদিন আগে, কিংবা তেরোদিন, কিংবা সতেরো দিন, ঠিক জানি না, গুণতে ভুলে গেছি।

দু’ হাতে মুখ চাপা দিয়ে হঠাৎ সে কেঁদে উঠল। এক পশলা বৃষ্টির মতন। যেরকম বৃষ্টিতে মানুষ ছুটে পালায় না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজে, আমিও সেরকম ভাবে কোনো কথা না বলে দেখতে লাগলুম ওর কান্না

একটু পরে হাত সরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আমার চেহারায় বা মুখে কি এমন কিছু ছাপ আছে যাতে লোকে আমায় ঘৃণা করবে? এখানে সবাই আমাকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

–না–না, তা কেন হবে, আপনি ভুল ভাবছেন।

—আমাকে আপনি আজ্ঞে করতে হবে না। আমার বয়েস মাত্র তিন বছর। কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ একটাও কথা বলে না কেন?

এবারে শরীরে একটা শিহরণ হলো। বলে কী, ওর বয়েস মাত্র তিন বছর? মেয়েটা পাগল–টাগল না তো?

—আপনি…মানে…তুমি ভাবছ কেউ তোমার সঙ্গে কথা বলে না। আর এখানকার লোক ভাবছে, তুমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছ না।

–আমি নতুন এসেছি, আগে তো ওরাই এসে আমার সঙ্গে ভাব করবে, আমাকে সাহায্য করবে।

—যারা নতুন আসে, সব কিছু ছেড়েছুড়ে, তারা প্রথম প্রথম খুব স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। অন্য কেউ সে রকম কারুর সম্পর্কে কৌতূহল দেখালে সে রেগে যায় বা পুরোনো দুঃখটা হুহু করে এসে পড়ে।

—দুঃখ?

—কোনো না কোনো দুঃখের পটভূমিকা নিয়েই তো মানুষ এখানে আসে।

—ও হ্যাঁ। তা বোধহয় ঠিক। তাহলে তুমি, তোমার কী যে নাম বললে?

—নীললোহিত।

–এরকম নাম আগে শুনিনি। আমার নাম রোহিলা, এই নামটা কেমন?

—নতুনত্ব আছে। আমিও এই নাম আগে শুনিনি।

–আগে আমার অন্য নাম ছিল। অনেক দিন আগে, গত জন্মে।

– তুমি সব সময় এরকম কালো শাড়ি পরে থাক কেন?

–কেন, তাতে কী হয়েছে?

—সত্যি কথা বলব? ঐ কালো শাড়ির জন্য তোমার মুখটা পাথরের মতন দেখায়। মনে হয়, তুমি মানুষ নও, একটা মূর্তি।

রোহিলা মোমটা তুলে নিয়ে নিজের মুখের কাছে আনল। খুব কাছে। তারপর আলোর শিখার দিকে তাকিয়ে জোর দিয়ে বলল, আমার মুখে একটা ছ্যাঁকা দেব? তাহলে আমাকে মানুষ মানুষ মনে হবে না?

এই মেয়েটা পাগল নিশ্চিত। তার ফর্সা মুখে তার চোখদুটো হীরেকুচির মতন জ্বলছে।

আমি হাত বাড়িয়ে মোমবাতিটা সরিয়ে নিয়ে বললুম, ছিঃ, সুন্দরকে কখনো নষ্ট করতে নেই।

রোহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কালো কাপড়ে শরীরটা ঢেকে রাখি, যাতে লোকেরা আমার শরীরের বদলে শুধু মুখের দিকে তাকায়। একবার একজন আমার একটা মূর্তি বানিয়েছিল, তাতে কোনো পোশাক ছিল না!

আমার শ্রবণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। একটা গল্পের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কেউ ফেলে আসা জীবনের কথা বলে না।

—বম্বেতে আমি অনেকদিন মডেলের কাজ করেছি। তখন শুধু শরীর–দেখাতে হয়েছে। শুধু শরীর। মডেলের হৃদয় থাকতে নেই। হৃদয় নিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন হয় না। সেই সময়কার কথা ভাবলেই আমার কান্না পায়।

–তোমার কোনো বন্ধু ছিল না?

—ছিল অনেক শরীরের বন্ধু। মনের সঙ্গী ছিল না কেউ। আমার যে মন বলে কিছু আছে তা বুঝতেই শিখিনি। আমার ছিল কতগুলো ইচ্ছে, এটা চাই, সেটা চাই, ওটা ভালো, ওটা পছন্দ নয়, এই রকম। এর নাম মন?

–তারপর?

—তুমি কেন বললে আমার মূর্তির মতন দেখায়? যে–জীবন আমি ফেলে এসেছি…

–আমার ঠিক যা মনে হয়েছে, তাই বলেছি। এখন তোমার চোখে জল, এখন আর সেরকম দেখাচ্ছে না।

—মডেলিং করতে করতে আমি ফিলমে চলে এলাম। যারা আমার ছবি তুলত, তারা বলল, তুমি এবারে মুভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াও।

আমি সোল্লাসে বললুম, আহ্, এইবার বুঝতে পেরেছি। ঠিক ধরেছিলুম!

রোহিলা অবাক চোখ তুলে বলল, কী?

–তোমাকে আগে আমি কখনো দেখিনি, তবু তোমার রূপটা কেন চেনা চেনা লাগছিল! সিনেমায় নায়িকাদের মুখ এরকম হয়। যে–মুখে অনেক জোরাল আলো পড়ে, সেই মুখের ত্বক কেমন যেন বদলে যায়।

–না, আমি নায়িকা হইনি কোনোদিন, প্রথমে ছোটখাটো পার্ট, তারপর মাঝারি। বেশির ভাগ সময়েই ভিলেনের সঙ্গিনী! মদ খাওয়ার দৃশ্য, ষড়যন্ত্র, জাঙ্গিয়া আর কাঁচুলি পরে নাচ, ঘোড়ার পিঠে, কখনো হাতে মশাল… আমি কতবার মরেছি জানো? উনিশবার!

—বি–গ্রেড মুভি?

—একটা বইতে দিলীপকুমার ছিল। শোনো, আমি তখন মানুষ ছিলাম না, মেয়ে ছিলাম না, ছিলাম একটা পুতুল, কিংবা পোষা জন্তুর মতন। আমাকে ওরা বলত, তুমি চেয়ারের ওপর এই ভাবে এক পা তুলে দাঁড়াও, তাতে তোমায় সেক্সি দেখাবে। এই ভাবে তুমি ভিলেনের গলা জড়িয়ে ধরো, এই ভাবে তুমি শোও, যাতে তোমার ব্রেস্ট আর হিল্স এক সঙ্গে দেখা যায়। এই ভাবে তুমি ঘাগরা উড়িয়ে ঊরু দেখিয়ে, নদীতে ঝাঁপ দাও! হ্যাঁ, বিশ্বাস করো, ওরা এই রকম বলে।

–আন্দাজ করা শক্ত কিছু নয়।

–তাহলে বলো, আমি ছিলাম ঐ পুরুষদের হাতের একটা খেলনা কিনা? আর কিছু না! কিংবা, তুমি বাঁদর নাচ দেখেছ?

–তারপর তুমি বুঝি ফিল্ম ছেড়ে দিলে?

–প্রায় সব ফিলমেই শেষ দিকে আমাকে মরে যেতে হয়। কত রকম ভাবে আমি মরেছি। গুলি খেয়ে, আগুনে জ্যান্ত পুড়ে গিয়ে, সাপের কামড়ে, নিজের হাতে বিষ খেয়ে—মরতে মরতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সবাই বলত, আমার মরার সীনগুলো ভালো হয়। মফঃস্বলের দর্শকরা খুশি হয়ে হাততালি দেয়। সেই জন্য স্ক্রিপ্ট রাইটাররা আমার ডেথ সীন দেবেই দেবে। তিন বছর আগে রোহিলাখণ্ডে একটা শুটিং ছিল, পাঁচ দিনের কাজ, শেষ দিনে আমাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরতে হবে। আমি মরলুম। সেকেন্ড টেক–এই ও কে হলো, আমি পোশাকের ধুলো ঝেড়ে বেরিয়ে গেলুম সেট থেকে। তখনই ঠিক করলুম, এবারে আমি বাঁচব, নিজের মতন করে বাঁচব। সেট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম রেল স্টেশানে। টিকিট না কেটেই প্রথম যে ট্রেন পেলাম চড়ে বসলাম তাতে। সেই দিন থেকেই রোহিলার জন্ম।

—তুমি এই জায়গাটার খোঁজ পেলে কী করে?

– প্রথম প্রথম ভুল করেছি অনেক। নিজের মতন করে কী ভাবে বাঁচতে হয়, সেটাই তো শিখিনি। হাতে টাকা ছিল, এ হোটেলে, সে হোটেলে থাকতাম। ড্রিংকের নেশা হয়ে গিয়েছিল, কাটাতে পারছিলাম না। তারপর ছবি আঁকতে শুরু করলাম। আঁকতে জানি না, বুঝলে, এমনিই হিজিবিজি ছবি, এখানে সেখানে ধ্যাবড়া রং দিই, তবু এঁকে যেতে লাগলাম, একটার পর একটা, মন আনন্দ পাচ্ছিলাম তাতে। ওমা, সেই ছবিই অনেকে ভালো বলতে লাগল। হোটেলের বাগানে বসে ছবি আঁকছিলাম একদিন, কৃষ্ণ আইয়ার বলে একটা লোক, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে তা দেখছিল। সে হঠাৎ বলল, তোমার ছবি খুব দারুণ! একেবারে নতুন ধরনের। তুমি এক্সিবিশান করোনি? কী অন্যায় কথা!

–তুমি তোমার আঁকা ছবি এনেছ এখানে?

—তুমি ছবির কিছু বোঝ?

–না, সেরকম বুঝি না। তবে ভালো ছবি দেখলে ভালো লাগে। খারাপ ছবি দেখলে আপনি আপনিই চোখটা অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

–না, আমার কোনো ছবি আনিনি। শোনো না, তারপর কী হলো! ঐ কৃষ্ণ আইয়ার আরো কয়েকটা লোক জুটিয়ে আনল, তারা সবাই মিলে এমন প্রশংসা করতে লাগল যে আমি একেবারে গলে গেলাম। বেশি প্রশংসা শুনলে অনেকেরই মাখা ঘুরে যায় কিনা বলো? বুঝলে, নীললোহিত, তার মানে আমি আবার পুরুষদের হাতের পুতুল হয়ে গেলাম। ঐ কৃষ্ণ আইয়ারই উদ্যোগ করে পুনেতে আমার ছবির একটা এক্সিবিশন করল। দু’তিনটে কাগজে খুব প্রশংসা বেরুল আমার ছবির। একজন ক্রিটিক লিখল, আমার মতন বোল্ড স্ট্রোক সে আগে কখনো দেখেনি। আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল। এরকম কী হয়? ছবি আঁকা কোনোদিন শিখিনি। ভালো ভালো পেইন্টারদের আসল ছবিও দেখিনি বেশি… কিন্তু ওরা এরকম বাড়াবাড়ি করছে! একদিন সন্ধেবেলা ঐ কৃষ্ণ আইয়ার আর সেই ক্রিটিক মদের বোতল নিয়ে এলো আমার হোটেলের ঘরে। আমি ওদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিইনি। ওদের যত্ন করে বসালাম। গেলাস দিলাম, শুনতে লাগলাম ওদের কথা। তখন বুঝলাম, হ্যাঁ, যা সন্দেহ করেছিলাম, ঠিক তাই। ওরা এত আদিখ্যেতা করছে তার কারণ, আমি একজন মেয়ে। একা একা হোটেলে থাকি, আমার শরীরটা দেখতে খারাপ নয়…আমার শরীর বুঝলে? পরদিন আমি বিকেলবেলা আমার এক্সিবিশানে গিয়ে দেওয়াল থেকে সবকটা ছবি খুলে নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে দর্শকদের সামনেই তাতে আগুন ধরিয়ে দিলাম।

—সত্যি–সত্যি?

– আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? গত তিন বছর আমি একটাও মিথ্যে কথা বলিনি। আগে অনেক বলেছি অবশ্য। কিন্তু সে তো গতজন্মের কথা।

—তারপর এখানে কী করে এলে?

—ছবিগুলোতে আগুন ধরাবার পর আমি হাপুস নয়নে কাঁদছিলাম, তখন আমারই বয়েসী একটি মেয়ে জোর করে আমাকে তার বাড়িতে ধরে নিয়ে গেল। সেই মেয়েটির নাম ভারতী পটবর্ধন। কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী বলব। সে আমার বন্ধু হয়ে গেল। সে আমার সব কথা শুনে বলল, তুমি এরকম হোটেলে হোটেলে ঘুরে কী করে নিজের মতন করে বাঁচবে? হয় তুমি নিরুদ্দেশে চলে যাও কিংবা বিয়ে করে ঘর–সংসার পাতো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, নিরুদ্দেশে যারা যায় তারাও তো কোথাও না কোথাও থাকে। তারা কোথায় যায়? ভারতী তখন বলল, সবাই কোথায় যায় তা আমি জানি না। তবে কেউ কেউ যায় দিকশূন্যপুরে।

—ঐ ভারতী কী করে জানল?

—ভারতী নিজেও একবার নিরুদ্দেশ হয়েছিল। এখানে এসে ছিল টানা পাঁচ বছর। কিন্তু পিছুটান কাটাতে পারেনি। ফিরে গেছে। আমি ভারতীর কথা শুনে ভাবলাম, কোনো একটা জায়গায় পাঁচ বছর কাটিয়ে যদি ভারতীর মতন এরকম সুন্দর মন হয় তাহলে সেখানে আমি যাবই যাব!

—বোধহয় তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছ। এখানে তোমার কোনো অসুবিধে হয়েছে এ পর্যন্ত?

–না, সেরকম কোনো অসুবিধে হয়নি। এখানে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না বটে, কিন্তু কেউ ডিসটার্বও করে না। রাত্তিরে এসে কেউ দরজা ঠেলেনি। এরকম অভিজ্ঞতা আমার নতুন, একেবারে নতুন। এরকম জায়গা যে থাকতে পারে…তবে একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। বলব?

—কী?

—এখানে দেখছি, প্রায় সবাই সারাদিন খাবার–দাবারের চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। কেউ চাষ করছে, কেউ মুরগি কেউ হাঁস, গোরু…এইসব নিয়েই কেটে যায় দিন…কিন্তু এটা, এটার কী খুব দরকার? এটা অনেকটা প্রিমিটিভ ব্যাপার নয়? খাদ্যের চিন্তাতেই যদি দিন কেটে যায় …

—এখানে তো অনেক লেখাপড়া জানা লোকও আছে। কিংবা এমন অনেকে, যাদের আগেকার জীবন খুব শৌখিন ছিল, তারা যখন স্বেচ্ছায় এটা করছে… হয়তো এর মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। কয়েকদিন থেকে দ্যাখো।

–তুমি গম্ভীর ভাবে এসব কথা বলছ কেন? তুমি তো এখানে থাক না বললে?

—কী জানি, কোনোদিন হয়তো পাকাপাকি চলে আসব! তোমাকে আর একটা কথা বলতে চাই। হয়তো তোমার সত্যিই ছবি আঁকার প্রতিভা আছে। না শিখলেও ভালো ছবি আঁকা যায়। তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছ?

–কে না শুনেছে? তুমি আমাকে এত মূৰ্খ ভাবছ?

– না, তুমি বম্বেতে থাকতে তো। সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছবি আঁকা কখনো শেখেননি, কিন্তু শেষ জীবনে তিনি যেসব এঁকেছেন তা অনেক বড় বড় শিল্পীর চেয়েও…

—তিনি যে ছবিও এঁকেছেন সেটা জানতাম না।

—এখানে বসন্ত রাও নামে একজন শিল্পী থাকে। তার কাছে তুমি একদিন কিছু ছবি এঁকে দেখাও না। সে তোমায় মিথ্যেমিথ্যি প্রশংসা করবে না।

—আজ দুপুরে যে লোকটি ছবি আঁকছিল, তুমি যার সঙ্গে কথা বলছিলে? আমার খুব লোভ হচ্ছিল কাছে যেতে, কিন্তু সাহস হলো না, তোমরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বললে না।

—আমরা ভাবছিলুম, তুমিই কথা বলতে চাও না। এই রকম ভুল বোঝাবুঝিতে যে কত সময় নষ্ট হয়! যাকগে, আমি তোমার সঙ্গে বসন্ত রাও– এর আলাপ করিয়ে দেব!

–দেবে? এখন দেবে? চলো না, যাই।

—এখন? এখন এই অন্ধকারে তার বাড়ি চিনতে পারব না বোধহয়। কাল যাব নদীর ধারে। এখন, তুমি যদি চাও, তোমার সঙ্গে একজন ইন্টারেস্টিং মহিলার আলাপ করিয়ে দিতে পারি। তার নাম বন্দনা। তার বাড়িতেই আমি উঠেছি।

—হ্যাঁ, তাই চলো। প্রথমে একজন মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলেই আমার বেশি সুবিধে হবে। চলো—

–তোমার ঐ কালো শাড়িটা বদলে নাও, প্লীজ! ওটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। তোমার অন্য কোনো পোশাক নেই?

—জিন্‌স আছে। এখানে ওসব পরলে কেউ কিছু মনে করবে?

—এখানে কেউ কিছু মনে করে না!

—তাহলে এক মিনিট সময় দাও, আমি চেঞ্জ করে নিই।

—করে নাও, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।

–তুমি বসে থাকলেও আমার কোনো অসুবিধে নেই। জানো তো, আমি আগে—

—তাতে আমার অসুবিধে হতে পারে। তোমার আগের জীবনের কথা অন্যদের আর বলতে যেও না। এখানে কেউ শুনতে চায় না। তুমি তৈরি হয়ে এসো, আমি সামনের রাস্তায় আছি।

বেরিয়ে, মনের ভুলে সিগারেট ধরাতে গিয়েও প্যাকেটটা আবার পকেটে রেখে, হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বিজনের বাড়ির সামনে।

অন্ধকারের মধ্যেই বিজন ওর বাড়ির চত্বরে একটা বাঁশের খুঁটি পুঁতছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বিজন বলল, তুই তো অনেকক্ষণ কাটালি মহিলার সঙ্গে! কী বলল?

আমি বললুম, উঁহুঃ, এখানকার মানুষদের তো কৌতূহল দেখাতে নেই। সেইজন্য আমি কিছুই বলব না। তবে যে–বিষয়ে তোর কোনো কৌতূহল নেই সেই বিষয়ে আমি তোকে কিছু বলতে চাই। এখানে আসবার আগে লীলা কাকিমার সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। উনি তোর উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারটা বেশ সুন্দর ভাবে মেনে নিয়েছেন। উনি বললেন, আজকাল কত ছেলে তো বিদেশে থাকে, পাঁচ বছর দশ বছরেও দেখা হয় না। তা নিয়ে কী দুঃখ করলে চলে?

বিজন উঠে দাঁড়িয়ে হাত থেকে মাটি ঝাড়ল। চুপ করে রইল বেশ কয়েক মুহূর্ত।

তারপর আমার বাহু ছুঁয়ে গাঢ় গলায় বলল, দ্যাখ নীলু, এখানে এসে প্রায় প্রত্যেকদিনই আমার মা–র কথা মনে পড়ে। কলকাতার আর বিশেষ কিছু আমি মনে রাখতে চাই না, মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। কিন্তু মাকে প্রায় রোজই স্বপ্ন দেখি। নীলু, এখানে এসে আমি বুঝতে পারছি, ছেলেদের একটা বয়েস হলে মাকে আর তেমন প্রয়োজন হয় না, কাছাকাছি থাকলে মায়ের অস্তিত্বটাই অনেক সময় খেয়াল থাকে না। কিন্তু দূরে গেলেই মাতৃটান টের পাওয়া যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *