নিরুদ্দেশের দেশে – ৭

ফেরার পথে আমাদের আর একজন সঙ্গী জুটল। তার নাম জয়দীপ। দীর্ঘকায় পুরুষ, প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি পরা, অসম্ভব গম্ভীর ধরনের। ঠিক গাম্ভীর্যও নয়, তার মুখে যেন বিমর্ষতার ছাপ।

সভা শেষ হয়ে যাবার পর আমরা আরো প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে ছিলাম। বন্দনাদির অনেকের সঙ্গেই চেনা, তাই তাকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য দেখা যায়নি, রোহিলা নিজের থেকে কারুর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারে না বলে সে দাঁড়িয়েছিল আমার হাত ধরে। শেষ পর্যন্ত আমরা ইউক্যালিপটাস গাছটার তলায় বসে পড়েছিলাম।

আমাদের খুব কাছেই মাটির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল সতেরো–আঠেরো বছরের একটি কিশোর। টানা টানা দুটি চোখ, সে দেখছিল মেঘের খেলা। এই রকম মুখ দেখলেই চমকে উঠতে হয়। মনে হয় যেন কতবার খবরের কাগজে এই মুখখানাই ছাপা দেখেছি, যার তলায় লেখা থাকে, কিশোর, ফিরে এসো, তোমাকে কেউ ভুল বোঝেনি, মা মৃত্যুশয্যায়, কত টাকা পাঠাতে হবে সত্তর জানাও!

মা–বাবাকে চরম দুশ্চিন্তায় ফেলে রেখে এই কিশোরটি কেন এখানকার মাঠে নিশ্চিন্তভাবে শুয়ে আছে? এই সব পলাতকেরা কী করে দিকশূন্যপুরের সন্ধান পায়?

আমি কিশোরটির চোখে চোখ ফেলে একবার বলেছিলুম, মেঘ জমছে, আজ আবার বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে, তাই না?

কিশোরটি কোনো উত্তর না দিয়ে উদাসীন চোখে তাকায়।

আমি আবার তার সঙ্গে আলাপ–পরিচয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলুম, আমি আজ‍ই এখানে পৌঁছেছি। কলকাতায় এখন খুব ঝড়–বৃষ্টি হচ্ছে। কত গাছ উল্টে পড়েছে। কলকাতার খবর, বাইরের পৃথিবীর খবর সম্পর্কে কোনো আগ্রহই নেই, ঐটুকু ছেলের মনে কী এমন বৈরাগ্য?

সে আস্তে আস্তে উঠে চলে গিয়েছিল সেখান থেকে।

রোহিলা বলেছিল,আহা রে!

আমার বেশ রাগ হয়ে গিয়েছিল। আমি বলেছিলুম, আহা রে আবার কী! এ ছেলেটা হয়তো পরীক্ষায় ফেল করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, তারপর এখানে এসে দিব্যি মজায় আছে। পড়াশুনোর চিন্তা নেই।

রোহিলা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, পড়াশুনো কি সবাইকে করতেই হবে? পড়াশুনো না করলে কী ক্ষতি হয়? কেউ যদি গাছ পুঁতে তাতে ফল ফলাতে ভালোবাসে, তাকেও বই মুখস্থ করতে হবে? নীললোহিত, তুমি একি বললে?

আমি তৎক্ষণাৎ লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলুম। আমার অত অভিভাবকগিরি করার কী দরকার? পড়াশুনোয় ফাঁকি মারার সুযোগ পেলে আমিও কি কখনো ছেড়েছি। আসলে আমি বাইরের লোক বলে ওর বাবা–মায়ের পক্ষ নিতে চাইছিলুম।

এমনও তো হতে পারে, ঐ ছেলেটির বাবা–মা প্রতিদিন ঝগড়া করে ঘরের ছাদ ফাটায়। সন্ধেবেলা পার্টিতে যায়, গভীর রাতে ফিরে এসে কদর্য ভাষায় পরস্পরের নামে দোষারোপ করে। তাদের ছেলেমেয়ে সেই সময় কাঁচা ঘুম ভেঙে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ছেলেটি সেরকম বিষাক্ত পরিবেশ ছেড়ে চলে এসেছে। সেরকম পরিবারও আমি দেখিনি কি? দেখেছি!

তবু, ছেলেটি কেন আমার সঙ্গে কথা বলল না!

বন্দনাদি এক সময় জয়দীপকে সঙ্গে এনে বলেছিল, চল, এবার ফিরি।

আমাদের সঙ্গে জয়দীপের আলাপ করিয়ে দিলে সে নমস্কার করার জন্য হাতও তোলে না, শুধু মাথা নাড়ে।

অন্য একটা পথ দিয়ে ফিরতে ফিরতে আমার চোখে পড়ল একটা গির্জা। মাঝারি ধরনের সরু চূড়া, ওপরের দিকে একটা ঘড়িও লাগানো আছে, তবে তার একটাও কাঁটা নেই।

এখানেও ধর্মস্থান আছে? আগে তো দেখিনি।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, বন্দনাদি, এটা কে বানিয়েছে?

বন্দনাদি বলল, আমরা বানাইনি। এই দিকশূন্যপুর কলোনিটাও তো আমরা বানাইনি, বৃটিশ আমলের। তখন যারা ছিল, তারা গির্জা ছাড়া শহর বানাতো না!

–এই গির্জায় এখনো কেউ যায়?

—যায় কেউ কেউ। মাঝে মাঝে ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাই। আমিও এসেছি কয়েকবার। যীশুর যে–কোনো মূর্তিতেই মুখখানা এমন শান্ত যে দেখতে ভালো লাগে।

রোহিলা কপাল ও বুকে আঙুল ছুঁইয়ে ক্রুশ চিহ্ন আঁকল।

তা হলে কি ও তিন বছর আগে ক্রিশ্চিয়ান ছিল? সে কথা জিজ্ঞেস করবার আগেই জলদগম্ভীর স্বরে জয়দীপ বলল, আমি প্রথম এসে এখানে কোনো বাড়ি খালি পাইনি। তখন এই গির্জার মধ্যে শুয়ে থাকতাম।

বন্দনাদি বলল, তখন ..তুমি কোনো অলৌকিক স্বপ্ন দেখোনি?

জয়দীপ বলল, আমি জেগে জেগেই অনেকরকম স্বপ্ন দেখি! আমার কাছে এই জগৎটাই একটা স্বপ্ন।

আমি ইয়ার্কির লোভ সামলাতে পারলুম না। ঐ কথা শোনা মাত্র পট্ করে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি রূপনারায়ণ নদীর নাম শুনেছেন?

জয়দীপ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, রূপনারায়ণ নদী? হ্যাঁ, নাম শুনেছি। বেঙ্গলে তো, তাই না!

আমি বললুম, হ্যাঁ। একদিন ঐ রূপনারায়ণ নদীর ধারে আপনার ঘুমিয়ে পড়া উচিত ছিল। তারপর জেগে উঠলে ঠিক বুঝতে পারতেন, এ জগৎটা স্বপ্ন নয়। শুধু ঐ নদীর ধারে ঘুমোবার পর জেগে উঠলেই এরকম উপলব্ধি হয়

—তার মানে?

রোহিলাও মানে বুঝতে পারেনি, তারও চোখেমুখে কৌতূহল।

বন্দনাদি বলল, নীলুটা তোমার সঙ্গে হেঁয়ালি করছে। জয়দীপ, তুমি তো রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়োনি। তাঁর একটা কবিতা আছে।

রূপনারাণের কূলে
জেগে উঠিলাম
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়

রোহিলা বলল, নদীটার নাম বড় সুন্দর। ইস, আমি কেন ঐ নদী দেখিনি!

আমি বললুম, আমি কখনো কোনো গির্জার মধ্যে ঘুমোইনি। তবে একবার তাজমহলে গিয়ে রাত্তিরে আর ফিরিনি, চাতালটাতেই শুয়ে ছিলাম। ওঃ, কী দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখেছিলুম সে রাতে। আমি শাজাহান আর স্বয়ং মমতাজ বেগম সোনার পাত্রে আমাকে সিরাজী ঢেলে দিচ্ছে!

বন্দনাদি বলল, তুই আর গুল ঝাড়িস না, নীলু!

রোহিলার তো মাত্র তিন বছর বয়েস, সে সব কিছুতেই অবাক হয়। সে ভুরু তুলে বলল, তুমি সত্যি তাজমহলে ঘুমিয়েছিলে, না ঘুমোওনি?

আমি বললুম, আমি সত্যি একবার সেখানে সারা রাত শুয়ে থেকেছি, আর ঐ স্বপ্নটা নিজে তৈরি করেছি। চোখ বুজে যে–কোনো স্বপ্নই তো তৈরি করা যায়।

রোহিলা বলল, সেটা সত্যি। খুব সত্যি। ইস, আমি কেন একদিন তাজমহলে ঘুমোইনি?

বন্দনাদি এমনভাবে রোহিলার দিকে তাকাল যেন বলতে চাইল, ইচ্ছে করলে তুমি এখনো তাজমহলে চলে যেতে পার। কেউ তোমাকে বাধা দেবে না।

রোহিলা সেই অর্থ গ্রহণ করল না। সে আপন মনে বলল, এখানকার নদীটাও বেশ সুন্দর। একদিন ঐ নদীর ধারে সারা রাত শুয়ে থাকলে হয় না?

আমি বললুম, জ্যোৎস্নার ঘরে যে আততায়ী এসেছিল কাল রাত্রে, তাকে কেউ এখনো চিনতে পারেনি, সে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ভয়ে কেঁপে উঠে রোহিলা বলল, না–না, আমি একা শুতে পারব না। আমরা সবাই মিলে!

বন্দনাদি বলল, একটা পাগলকে আমরা ভয় পাব কেন? হ্যাঁ, নদীর ধারে শুয়ে থাকা যেতে পারে।

রোহিলা বলল, আজ রাত্তিরেই?

বন্দনাদি বলল, যদি বৃষ্টি না হয়!

সবাই একসঙ্গে আকাশের দিকে তাকালাম। হয়তো সবারই মনে পড়ল জ্যোৎস্নার কথা। তার আকাশ–প্রীতি বোধহয় একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। যতই নিরাপত্তা থাকুক, তবু কোনো যুবতী মেয়ে ঘরের দরজা খুলে ঘুমোয়, এরকম কখনো শুনিনি। অবশ্য, সামাজিক অর্থে যাদের স্বাভাবিক মানুষ বলে, এখানকার কেউই বোধহয় সেরকম নয়।

আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়েছে। জ্যোৎস্না হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

বন্দনাদির বাড়ির টিলাটার কাছে এসে বললুম, তোমার ঐ অঙ্কের পণ্ডিত বৃদ্ধকে তো মিটিং–এ দেখতে পেলুম না। উনি গিয়েছিলেন?

বন্দনাদি বলল, আমিও দেখিনি।

–অত বুড়ো মানুষ, একলা থাকেন কী করে?

– পাহাড়ে আরো বুড়ো বুড়ো সন্ন্যাসীরা থাকে না?

—যদি কখনো অসুস্থ হয়ে পড়েন?

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বন্দনাদি বলল, দাঁড়া, একটু দেখে আসি। আহা, আমায় কত ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়—

কুয়োর পাশ দিয়ে বন্দনাদি এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল বৃদ্ধের বাগানে। ডাকল না। একটা খোলা জানলার নিচে দাঁড়াল।

একটু পরে হাসি মুখে ফিরে এসে বলল, নাক ডাকছে, তার মানে দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে।

জয়দীপ জিজ্ঞেস করল, আমি কি এবার বাড়ি যাব?

বন্দনাদি বলল, কেন, তুমি এসো। আমাদের সঙ্গে কিছু খেয়ে নেবে। জয়দীপ যেন কী সব চিন্তা করল, আমার আর রোহিলার মুখের দিকে তাকাল। তারপর আবার বলল, যাব?

বন্দনাদি তার হাত ধরে বলল, এসো!

এখানে একটা সুবিধে এই, কারুর বাড়িতেই কেউ প্রতীক্ষায় বসে নেই। বেশি রাত করে বাড়ি ফিরলেও অন্য কেউ চিন্তা করবে না বা বকুনি দেবে না। কিন্তু এখানে কি কারুর সঙ্গে কারুর প্রেম হয় না। আমি আর রোহিলা সঙ্গে আছি বলেই কি জয়দীপ বন্দনাদির সঙ্গে যেতে ইতস্তত করছে!

ওপরে উঠে এসে বন্দনাদি মোমবাতি জ্বালাল।

রোহিলা বলল, এ বাড়িটা কী সুন্দর! এখান থেকে অনেক দূর দেখতে পাওয়া যায়। ঐ যে, ঐ তো নদী।

জয়দীপ আমার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, এ জগৎটা স্বপ্ন নয়, না?

আমি বললুম, রবীন্দ্রনাথের মতন কবি তা মানতে চাননি। তবে দার্শনিকরা তো অনেকেই ঐ কথা বলেন… কবিদের কথা বাদ দিন!

বারান্দা থেকে বন্দনাদি বলল, জানিস নীলু, আমাদের এখানে কিন্তু একজনও কবি নেই। কবিরা ভাবজগত নিয়ে কারবার করলেও তারা কিন্তু ঘোর সংসারী। কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যায় না।

আমি বললুম, কবিদের চিনবে কী করে? কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলে কবিদের তো চেহারা দেখে চিনতে পারার উপায় নেই।

–কেন, কবি–কবি চেহারা দেখলেই চেনা যায়!

– যাদের কবি–কবি চেহারা তারা সাত জন্মে কবিতা লিখতে পারে না। কে যেন একজন বলেছিলেন যে, জীবনানন্দ দাশের চেহারা খেয়া নৌকোর মাঝির মতন। আর একালের কবিরা তো.. সব ভিড়ে মিশে থাকে!

–সে যাই বলিস, এখানে কোনো কবি থাকলে ঠিক টের পাওয়া যেত।

—এখানে এলে সবাই বোধহয় দার্শনিক হয়ে যায়।

—দাশর্নিক কাদের বলে আমি জানি না। আয়, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

বন্দনাদি এক ডেকচি খিচুড়ি রেঁধে রেখেছিল, সেটা গরম করে নেওয়া হলো। তারপর বেশ কিছু আলু আর পেঁয়াজ মিশিয়ে ভাজা। আমার আবার কাঁচা লঙ্কা ছাড়া চলে না। তাও রয়েছে।

বারান্দায় বসে ডেকচিটা মাঝখানে রেখে ছোট ছোট প্লেটে তুলে তুলে খেতে লাগলুম। হঠাৎ এক সময়ে খাওয়া থামিয়ে রোহিলা এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মাটির দিকে।

বন্দনাদি বলল, কী হলো? তুমি মোটে ঐটুকু নিয়েছ, আরো নাও।

রোহিলা বাহু দিয়ে চোখ চেপে ধরে ধরা গলায় বলল, আমার এত আনন্দ হচ্ছে যে, কান্না পেয়ে যাচ্ছে। খেতে পারছি না। একবেলা আগেও তোমাদের কারুকে চিনতুম না। অথচ এখন কত সুন্দরভাবে একসঙ্গে খাচ্ছি… আগে কোনোদিন জানতুম না, মানুষ এত সহজ হতে পারে।

চোখ তুলে সে আবার বলল, তোমরা জানো না, আমার আগের জীবনটা কী সাংঘাতিক ছিল। সব সময় স্বার্থ আর হিংসে।

বন্দনাদি নরম গলায় বলল, তুমি এখানে সবে এসেছ তো, তাই পুরোনো কথা মনে পড়ছে। আর কিছুদিন বাদে, যত বেশি আগেকার জীবনটা ভুলে যেতে পারবে, দেখবে ততই বেশি সুন্দর হচ্ছে এখনকার জীবনটা

আমি নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করলুম, এখানে বুঝি কেউ কারুকে হিংসে করে না?

বন্দনাদি বলল, সকলের মনের কথা কি আমি জানি? তবে আমার সে– রকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি।

জয়দীপ প্রায় কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোকটি প্রথম থেকেই কেন যেন অপছন্দ করেছে আমাকে। এটা ঠিক বোঝা যায়। বিষণ্ণতার বদলে ওর মুখে এখন একটা অপ্রসন্ন ভাব। সে বলল, হাওয়া থেমে গেছে, আকাশে একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। তুমি কেন ঐ কথাটা বললে?

—কোন কথাটা?

—এখানে হিংসে আছে কি না! তুমি কি গুপ্তচর?

–না–না, আমি সে রকম কিছু ভেবে বলিনি!

জয়দীপ আবার আকাশের দিকে তাকাল। যেন মেঘ এসে তারা ঢেকে দেওয়ার জন্য আমিই দায়ী।

তারপর সে বন্দনাদির দিকে ফিরে বলল, জানো বন্দনা, আমার জন্য সারা ভারতবর্ষে স্পাই ঘুরছে। একদিন না একদিন এখানেও তারা আসবে। আমাকে ছাড়বে না।

বন্দনাদি বলল, কেন? তোমার জন্য স্পাই ঘুরছে কেন?

–আমি যে একটা ভীষণ গোপন কথা জানি। স্টেট সিক্রেট। আমি না মরে গেলে ওরা নিশ্চিন্ত হবে না! যদি কেউ একবার বলে দেয় যে আমি এখানে আছি, তা হলে ওরা ঠিক শিকারী কুকুরের মতন ছুটে আসবে।

বন্দনাদি জয়দীপের পিঠে মমতামাখা হাত রেখে বলল, না, জয়দীপ, এখানে কেউ আসবে না।

সে তবু আমার আর রোহিলার মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাতে লাগল।

রোহিলা বলল, তুমি কী গোপন কথা জানো? সবাইকে বলে দাও তা হলে আর সেটা গোপন থাকবে না!

জয়দীপ গর্জন করে উঠল, তুমি কেন এই কথা বললে? তুমি কেন এই কথা বললে? তুমি কে?

রোহিলা তাতে একটুও ভয় না পেয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, আমি গুপ্তচর! আমি গুপ্তচর! ধরা পড়ে গেছি!

জয়দীপ হাতের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, খান খান শব্দে সেটা ভাঙল। সে উঠে দাঁড়াতে যেতেই বন্দনাদি তার হাত ধরে টেনে বলল, আঃ জয়দীপ, কী ছেলেমানুষী করছ? বসো!

–না, আমি বসব না। এরা, এরা আমায় বাঁচতে দেবে না!

–বসো বলছি, নইলে মার খাবে আমার কাছে!

জয়দীপ তবু বন্দনাদির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বাগানের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। দু হাতে মাথা চেপে ধরে সে কর্কশ গলায় বলল, আমাকে ওরা বাঁচতে দেবে না! আমি আর কিছু চাই না, শুধু নিরিবিলিতে নিজের মতন থাকতে চাই, তবু ওরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চায়। আমাকে বড় চাকরির লোভ দেখায়। বন্দনা, তুমি কেন আমায় এখানে ডেকে আনলে?

—জয়দীপ, তুমি ভুল ভাবছ। এখানে কেউ তোমার খারাপ চায় না। এসো, খাবারটা শেষ করে নাও। তোমাকে আমি আর একটা প্লেট দিচ্ছি!

–নাঃ!

বন্দনাদি উঠে দাঁড়াবার আগেই জয়দীপ দৌড়ে চলে গেল, মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। বন্দনাদি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে টর্চ জ্বেলে কয়েকবার ডাকল ওর নাম ধরে। কোনো উত্তর এলো না।

বন্দনাদি ফিরে এলে রোহিলা বাচ্চা মেয়ের মতন ভীতু ভীতু গলায় জিজ্ঞেস করল, আমি কোনো দোষ করেছি?

বন্দনাদি বলল, না, তুমি কোনো দোষ করোনি। জয়দীপের __ এক সময় এই রকম হয়, ঠাট্টা–ইয়ার্কি কিছু বোঝে না!

রোহিলা বলল, খিচুড়িটা আমার খুব ভালো লাগছে। আমি আর একটু খেতে পারি? আমার আস্তে আস্তে খাওয়া অভ্যেস।

—হ্যাঁ, খাও’ বাঃ, খাবে না কেন? সবটা শেষ করতে হবে।

আমার খাওয়ার ইচ্ছে ঘুচে গেছে। একটু কু–চিন্তা ঝিলিক মারছে মাথার মধ্যে। এই জয়দীপ যে এক ধরনের পাগল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গুপ্তচর–ভীতি খুব সাধারণ একরকম পাগলামির লক্ষণ। কাল রাত্রে জ্যোৎস্না নামের ঐ মেয়েটির ঘরে এই জয়দীপই যায়নি তো? এদের যে কার ওপর কখন সন্দেহ হয় তার তো ঠিক নেই।

বন্দনাদি বলল, কাল সকালে দেখবি, ও একেবারে অন্য মানুষ!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, রোজ রাত্তিরেই এই রকম হয় নাকি?

–না–না, রোজ নয়। মাঝে মাঝে। ও কারুর সঙ্গে ভালো করে মিশতে পারে না। সেই জন্যই আমি ওকে ডাবি লোকজনের সঙ্গে থাকলে ভালো থাকে।

– আজকে আমাদের থাকাটাই ওর অপছন্দ হয়েছে। হয়তো তোমাকে একা পেতে চেয়েছিল।

বন্দনাদি গাঢ় চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর হেসে বলল, নাঃ, সে রকম কিছু না।

এই সময় বৃষ্টি নামল ঝিরঝির করে।

রোহিলা বলল, যাঃ, তা হলে আজ আর নদীর ধারে শোওয়া হলো না। আমি তা হলে কোথায় ঘুমোব?

বন্দনাদি বলল, বৃষ্টি থামুক, তারপর নীলু তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

একটু থেমে বন্দনাদি আবার বলল, নীলু, তুই ইচ্ছে করলে ওখানে থেকেও যেতে পারিস। আবার কেন কষ্ট করে এতটা ফিরে আসবি?

আমার একটু ধাঁধা লাগল। বন্দনাদি কি চায় না যে আমি রাত্রে এখানে থাকি? আগেরবার তো এই বাড়িতেই ছিলাম।

আবার মাদলের শব্দ শোনা গেল।

বন্দনাদি বলল, এই রে!

আমি জিজ্ঞেস করলুম, আবার মিটিং ডাকছে নাকি?

বন্দনাদি চিন্তিত ভাবে বলল, না। একদিনে দু’বার মিটিং হবে না। কেউ সাহায্য চাইছে। এখানে তো আর অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই, কারুর কোনো বিপদ হলে এই ভাবে অন্যদের ডাকে।

—প্রত্যেক বাড়িতে মাদল আছে নাকি?

-সব বাড়িতে না থাকলেও প্রত্যেক পাড়ায় একটা দুটো করে আছে। আমি টিলার ওপরে থাকি, আমার বাড়িতে একটা রেখেছি।

—চলো, তা হলে যাই।

–থাক, আমাদের যাবার দরকার নেই। শব্দটা অনেক দূরে। ওদিককার পুরুষরা যাবে।

ঘন, নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতার মধ্যে সেই মাদলের শব্দটা অত্যন্ত গম্ভীর, মনে হয় যেন নিয়তির সঙ্কেত। আমরা একটুক্ষণ চুপ করে শুনলাম সেই শব্দ। কী হয়েছে ওখানে? কাল রাতে জ্যোৎস্না নামে মেয়েটির যা হয়েছিল, সেইরকম কিছু? জয়দীপ?

আওয়াজটা একটু পরেই থেমে গেল।

রোহিলা বলল, আমার ভয় করছে!

বন্দনাদি বলল, সেরকম ভয়ের কিছু নেই। হয়তো কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

—এখানে অসুখ করলে তোমরা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আস?

-ধ্যাৎ! কে বলেছে তোমাকে এসব কথা? ফেলে দিয়ে আসা হবে কেন! এখানে কারুর ওপরেই কোনো ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করা হয় না! কেউ যদি চায়, ঘরে শুয়েই মরতে পারে। তবে বেশি অসুখ হলে, হাঁটা চলার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেলে অনেকেই চায় জঙ্গলে গিয়ে শুয়ে থাকতে। আগেকার দিনেও তো লোকে মৃত্যুর আগে বনে চলে যেত।

–আমার একলা থাকতে বড্ড ভয় করে।

–তুমি এক কাজ করো। তুমি এই নীলকে ধরে রেখে দাও তোমার কাছে ওকে আর ফিরে যেতে দিও না!

এবারে আমি বললুম, তোমার ব্যাপার কী বলো তো বন্দনাদি? আমি তোমার বাড়িতে থাকলে তোমার কোনো অসুবিধে হবে মনে হচ্ছে!

বন্দনাদি হেসে উঠল।

—তুই ভাবছিস বুঝি রাত্তিরবেলা গোপনে গোপনে আমার কোনো প্ৰেমিক আসবে, তুই থাকলে অসুবিধে। সেই রকম কারুর আসবার কথা থাকলেও আমি তা তোর কাছে গোপন করব কেন? তুই কি আমার গার্জেন? আমি জীবনে কোনোদিনই কিছু গোপন করিনি।

—হ্যাঁ, একটা ব্যাপার গোপন করেছ।

–কী!

–বলব? আজও কেউ জানে না, রূপসার বাবা কে!

—নীলু! তোকে বারণ করেছি না কোনোদিন তুই আমার কাছে ঐ প্ৰসঙ্গ তুলবি না!

—অত রেগে যাচ্ছ কেন? এই হাসছ, এই রাগ করছ, ব্যাপারটা কী তোমার?

রোহিলা বন্দনাদির পক্ষ নিয়ে আমার প্রতি ভর্ৎসনার সুরে বলল, এই নীলু, তুমি কেন বন্দনাদির মনে দুঃখ দিচ্ছ? বন্দনাদি খুব সাচ্চা মেয়ে, আমি এক নজর দেখেই বুঝে নিয়েছি।

আমি বললুম, না, আমি কষ্ট দিতে চাইনি। তবে মানুষের কৌতূহল প্রবৃত্তিটা বড্ড স্ট্রং। কৌতূহল আছে বলেই তো মানুষ জাতি এত কিছু আবিষ্কার করেছে।

রোহিলা বলল, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নিজের সর্বনাশও ডেকে এনেছে।

বন্দনাদি ঝাঁঝাল গলায় বলল, অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখানোটা সভ্যতার লক্ষণ নয়। আমরা এখানে ঐ রকম কৌতূহল প্রবৃত্তির প্রশ্রয় দিই না!

–তুমি তো জানোই, আমি সভ্য নই। যাই হোক, আজ রাত্তিরে এখানে আর কারুর আসবার কথা আছে কি নেই?

—যে–কেউ এসে পড়তে পারে। কোনো বাধা তো নেই। তুই ঠিক বুঝবি না, নীলু। এখানে যারা আসে তারা সবাই পোড় খাওয়া মানুষ। তাই কেউ আর এখানে চট করে প্রেমে পড়তে চায় না। আমার অনেক বন্ধু আছে এখানে, কিন্তু প্রেমিক–ট্রেমিক কেউ নেই।

রোহিলা বলল, আমার কিন্তু খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করে। জীবনে আমি কখনো প্রেম পাইনি। শুধু লোভ, শুধু লোভ। ও বন্দনাদি, আমার প্রেম হবে, নাকি এমনি এমনি মরে যাব?

বন্দনাদি আবার হাসল। রোহিলার থুতনি ছুঁয়ে বলল, এই মেয়েটা সত্যি একেবারে বাচ্চা! হ্যাঁ, তোমার প্রেম হবে। কেন হবে না? তবে ঐ নীলুটার ওপর বেশি ভরসা করো না।

–কেন, ও বুঝি ডরপুক?

–ওকে দু’ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে গেলেই ও ফুরুৎ করে উড়ে পালিয়ে যায়।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, হায় রে, সেরকম বাহুবন্ধন পেলাম কোথায় যে পালাব?

হঠাৎ একটা শব্দ হতেই আমরা তিনজন সচকিত ভাবে তাকালুম বাইরের দিকে। কেউ একজন আসছে। অন্ধকারের মধ্যে, একজন মানুষ বাগানের প্রান্তে এসে দাঁড়াল।

গা–টা ছমছম করে ওঠে। মনে পড়ে মাদলের ডাক।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, কে? কে ওখানে?

উত্তর না দিয়ে লোকটি ছুটে এলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালুম, এখানে আমি একমাত্র পুরুষমানুষ, প্রতিরক্ষার দায়িত্ব আমারই নেওয়া উচিত।

কাছে আসতে জয়দীপকে চেনা গেল। হাত জোড় করে বলল, বন্দনা, আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। ছি–ছি, আমি কী খারাপ ব্যবহার করেছি তোমাদের সঙ্গে। তুমি কত যত্ন করে খেতে দিলে, আমি ভেঙে ফেললুম সেই প্লেটটা। তোমরা কি আমায় ক্ষমা করবে?

বন্দনাদি বলল, বৃষ্টিতে ভিজছ কেন, ওপরে উঠে এসো, জয়দীপ!

জয়দীপ রোহিলা আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা…ওরা কি আমায় মারবে? ওরা নিশ্চয়ই আমাকে খুব খারাপ লোক ভেবেছে? মাঝে মাঝে আমার মাথার ঠিক থাকে না।

জয়দীপ অনেকক্ষণ থেকেই ভিজছে। তার পোশাক ভিজে শপশপে। বন্দনাদি একটি তোয়ালে এনে নিজেই জয়দীপের মাথা মুছে দিতে লাগল। দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা সৌন্দর্য আছে যা বুকে এসে ধাক্কা মারে। জয়দীপ বন্দনাদির চেয়ে বয়েসে বেশ বড়ই হবে, কিন্তু এখন তাকে শিশুর মতন লাগে।

বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল, কোথায় মাদল বাজছিল, জয়দীপ? কী হয়েছে। তুমি কি জানো?

জয়দীপ বলল, না, জানি না। আমি তো টিলার নিচে কুয়োর ধারে বসেছিলাম। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গিয়েছিল কেন কে জানে? তারপর বৃষ্টি যেই পড়ল, তখন মনে হলো, আমি কী অন্যায় করেছি। এদের সঙ্গে প্রথম দিন মাত্ৰ আলাপ।

রোহিলা বলল, আমরা কিন্তু খিচুড়ি সব খেয়ে ফেলেছি।

বন্দনাদি বলল, হ্যাঁ, যেমন রাগ করেছিলে, এখন তোমার আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে। ঘরের মধ্যে গিয়ে প্যান্ট আর পাঞ্জাবিটাও ছেড়ে ফ্যালো।

জয়দীপ বলল, অ্যাঁ? এগুলো ছেড়ে কী পরব?

—আমার একটা শাড়িই পরতে হবে। তা ছাড়া উপায় কী? এগুলো পরে থাকলে তোমার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।

আমি বললুম, আমার কাছে এক্সটা পাজামা আছে, দিতে পারি।

জয়দীপ আমার দিকে তাকিয়ে বিহ্বল ভাবে বলল, তুমি…তোমার পাজামা… আমাকে দেবে?

আমি সেটা বার করে দিলুম। জয়দীপ আমার চেয়ে লম্বা ও চওড়া। পাজামাটি তার আঁট হলো ও পায়ের কাছে অনেকখানি উঠে রইল। খালি গায়ে সেই ঠেঙো পাজামা পরে জয়দীপ যখন বেরিয়ে এলো, তাকে দেখে খিল খিল করে হেসে উঠল রোহিলা।

বন্দনাদি বলল, এ বৃষ্টি তো থামবে না মনে হচ্ছে। তোমরা বাড়ি ফিরবে কী করে? ফেরার দরকার কী, এখানেই সবাই শুয়ে থাকো। ঘরের মধ্যে গরম হবে, এই বারান্দাতেই তো ভালো।

রোহিলা বলল, আমার খুব বারান্দায় শুতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একলা শুতে ভয় করে। আজ কী চমৎকার দিন। আচ্ছা বন্দনাদি, তোমার এক সময় রাত্তিরে ঘুমের আগে মুখে ক্রিম মাখার অভ্যেস ছিল না? আমার তো খুব ছিল। জঙ্গলে শুটিং করতে যেতাম, তখনও ক্রিম ঠিক সঙ্গে থাকত। অথচ এখন দিনের পর দিন ক্রিম মাখি না, তাতে কোনোই ক্ষতি হয় না!

বন্দনাদি বলল, ওসব ক্রিম ট্রিমের কথা আমি ভুলেই গেছি!

আমি বললুম, বন্দনাদি, আমার গলায় সুর নেই তাই, নইলে এখন একটা গান খুব গাইতে ইচ্ছে করছে!

—কোন গানটা রে?

সুরের অভাবে আমি হাত–পা নেড়ে চেঁচিয়ে উঠলুম, এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *