নিরুদ্দেশের দেশে – ৪

দিকশূন্যপুরে কোনো মন্দির–মসজিদ বা গির্জা নেই, অন্তত আমি দেখিনি, সেরকম আছে বলে শুনিও নি। কারুর বাড়িতে কেউ সেরকম কিছু একটা বানাতেও পারে হয়তো! তবে এখানে তো ধর্মসন্ধানীরা আসে না, তারা কোনো তীর্থস্থানে বা হিমালয়েই যেতে পারে। এখানে যারা আসে তারা স্রেফ পলাতক। নিরুদ্দিষ্ট। প্রায় প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো সময়ে খবরের কাগজে ছবি বেরিয়েছে।

এখানে দুটো মোড়ে দুটো পেল্লায় সাইজের ব্ল্যাক বোর্ড আছে। তাতে চকখড়ি দিয়ে যার যা খুশি লিখতে পারে। কেউ কেউ সেখানে ধর্মের বাণী পড়ে, আবার পাশেই থাকে হয়তো কোনো নাস্তিকের কৌতুক। আগের বার আমি কয়েক ঘণ্টা ধরে সব লেখা পড়েছিলুম। আমার সব চেয়ে ভালো লেগেছিল ঐ খড়ি দিয়ে লেখার ব্যাপারটা, অর্থাৎ সব বাণীই ক্ষণস্থায়ী, একজন অন্যেরটা অনায়াসেই মুছে দিতে পারে। বৃষ্টি হলে সবই ধুয়ে যায়।

ঐ রকমই একটা ব্ল্যাক বোর্ডের পাশে মস্ত বড় একটা অশ্বত্থ গাছ, তার পেছনেই বিজনের বাড়ি। মনে আছে। এ পথ সে পথ ঘুরে আমি সেই মোড়ে পৌঁছলুম। গতকালই বৃষ্টি হয়েছে বলে আজ ব্ল্যাক বোর্ডে প্রায় কিছুই লেখা নেই। নিচের দিকে শুধু একজনের হাতের লেখা কয়েকটি লাইন :

প্রশ্ন

মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছেন, অঋণী ও অপ্রবাসী হয়ে যে ব্যক্তি নিজের বাড়িতে বিকেলবেলা শাকান্ন খায়, সেই সুখী।

তা হলে প্রশ্ন এই যে, আমরা এখানে প্রবাসী না অপ্রবাসী? আমাদের কি এখানে কারুর কাছে ঋণ আছে, না নেই?

বাব্বা, বেশ কঠিন প্রশ্ন! কাল এসে দেখে যাব কেউ উত্তর দেয় কি না!

বিজনের বাড়ির কাছে এসে তাকে ডাকার আগেই একটু দূরের আর একটি বাড়ির দাওয়ায় আমি দেখতে পেলুম দুপুরে–দেখা সেই কৃষ্ণবসনা রমণীকে। তিনি আকাশের দিকে চেয়ে কিছু একটা খুঁজছেন।

কথা বলতে সাহস হলো না। আমি তাড়াতাড়ি বিজনের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়লুম।

বিজনের বাগান নেই, তার আছে পোলট্রি। প্রায় শ’খানেক মুরগি পোষে সে। সুতরাং সব সময়েই সে ডিমের সাপ্লাই দিতে পারে।

দু’তিনবার ডেকেও কোনো সাড়া পেলুম না। বিজন বাড়িতে নেই। এখানে চুরি–ডাকাতি প্রায় হয়ই না বলতে গেলে, দু’একবার মাত্র হয়েছে ছিঁচকে ধরনের। কোনো কিছুর অভাব না থাকলেও বোধহয় কোনো কোনো মানুষের মধ্যে চুরির প্রবৃত্তি থেকেই যায়। যাই হোক, এখানকার বেশির ভাগ মানুষই চুরি–টুরি নিয়ে মাথা ঘামায় না বলে সব কিছু এরকম খোলা ফেলে রেখে চলে যেতে পারে।

একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলুম বারান্দায়। একা হওয়া মাত্র খুব সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে। ডান হাতটা পকেটে ঢুকেও থমকে গেল। এখানে কেউ নেই বটে তবু এখানকার নিয়ম ভাঙা ঠিক নয়। দেখা যাক, এই জায়গায় কয়েকদিন থেকে আমিও সিগারেটের নেশাটা ছাড়তে পারি কিনা! আজকাল সব দেশেই সিগারেটের বিরুদ্ধে খুব হৈ চৈ। এমনকি সরকার থেকেও হুকুম দেওয়া হচ্ছে যে প্রত্যেক প্যাকেটের গায়ে লিখে দিতে হবে যে সিগারেট টানা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। বেশ তো, সিগারেট যদি এতই খারাপ জিনিস হয়, তাহলে বিড়ি– সিগারেট তৈরি করাটাই একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয় না কেন? ও, তাতে বড় বড় ব্যবসায়ীদের আঁতে ঘা লাগবে!

এখান থেকেও সেই কৃষ্ণবসনা সুন্দরীকে দেখা যাচ্ছে। সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। নতুন এসেছে, তাই বোধহয় কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না।

কে যেন বিজনদা, বিজনদা বলে ডাকল।

তাকিয়ে দেখি গেটের সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তার বয়েস বোধ হয় সতেরো–আঠারোর বেশি হবে না। কিন্তু তার মাথায় একটাও চুল নেই। প্যান্ট ও গেঞ্জি পরা। এক হাতে ঝুলছে একটা লাউ।

—বিজনদা নেই?

–না, এখন বাড়িতে নেই।

ছেলেটি ভেতরে এসে বলল, আমার কয়েকটা ডিম দরকার। নেব?

আমি উদারভাবে বললুম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, নিতে পার।

ছেলেটি জানে কোথায় ডিম রাখে বিজন। সে বারান্দায় ঢুকে এসে দ্বিতীয় ঘরটির দরজা খুলল। কয়েকটা ডিম নিয়ে বেরিয়ে এসে লাউটা রাখল রান্নাঘরের সামনে। আমার দিকে চেয়ে বলল, এটা রেখে গেলাম।

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বললুম, আচ্ছা।

বিজনের বাড়িতে আমার মতন একজন অচেনা মানুষ কেন বসে আছে, সে সম্পর্কে ছেলেটির কোনো আগ্রহ নেই। আর কিছু না বলে সে চলে গেল। বিজনের কি লাউয়ের দরকার আছে? যদি একই দিনে দু’তিনটে লাউ জমা পড়ে, তাতে কী হয়? কিছু একটা হয় নিশ্চয়ই।

এক ঝাঁক টিয়া পাখি উড়ে গেল আকাশ দিয়ে। এবারে সত্যিই সন্ধে হয়ে আসছে। প্রভাস নামের লোকটার সঙ্গে বন্দনাদির কী এমন কথা থাকতে পারে যা আমাকে শোনানো যায় না?

মুরগিগুলো খাঁচার মধ্যে ঝটাপটি করছে। কে একজন রাস্তা দিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেল। এই কলোনিতে বিদ্যুৎ নেই, কেরোসিনের বাতিও বিশেষ চোখে পড়ে না, কেউ কেউ ঘরের মধ্যে মোম জ্বালে। রাত্রিগুলি এখানে নিখাদ রাত্রি।

বিজন ফিরল মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে। তাতে বালি ভর্তি। আমায় দেখে অবাক হলো না, হাসিমুখে বলল, নীলু, তুই এসেছিস আগেই খবর পেয়ে গেছি। কেমন আছিস?

-ভালো আছি রে বিজন। তুই কার কাছ থেকে খবর পেলি?

—নদীর ধারে বালি আনতে গিয়েছিলাম। বসন্ত রাও–এর সঙ্গে দেখা, সে বলল তোর কথা।

–বালি আনতে গিয়েছিলি কেন?

—মুরগির ঘরে দিতে হবে। বালির মধ্যে মুরগিগুলো ভালো খেলা করে। তাতে ওদের তাড়াতাড়ি গ্রোথ হয়।

কলকাতায় আমি যখন বিজনকে চিনতুম, তখন সে ছিল বই–মুখো। খেলা– ধুলো বা শারীরিক পরিশ্রম করতে দেখিনি কক্ষনো। আজ সে এক ঝুড়ি বালি মাথায় করে এনেছে। নদীটা এখান থেকে কম দূর নয়। বিজনের মুখখানা তামাটে হয়ে গেছে।

–তুই এবারে এখানে থেকে যাবি তো, নীলু?

-থেকে যাব? না, তা নয়। তোরা সব ছেড়ে কেন এখানে চলে আসিস তা তো আমি জানি না। আমার সেরকম কোনো কারণ ঘটেনি। আমি তোদের দেখতে আসি।

—বন্দনাদির সঙ্গে দেখা হয়েছে? ওখানেই উঠেছিস নিশ্চয়ই?

—হ্যাঁ, বন্দনাদির সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবে আমি তোর এখানেও থাকতে পারি।

—আমি জানি, বন্দনাদি তোকে মাথার দিব্যি দিয়ে রেখেছে যে তুই এখানে এলে প্রথমেই ওর বাড়ি যাবি।

—যাঃ, মাথার দিব্যি–টিব্যি কিছু নয়। এমনিই উনি রূপসার খবর জানবার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন তো!

—তুই চা খাবি, নীলু? আমার কাছে চা আছে। তোর জন্য বানাতে পারি।

আমি কাঁধের ঝোলাটা থেকে একটা বড় চায়ের প্যাকেট বার করে বললুম, আমিও তোদের জন্য চা এনেছি। আর টিনের দুধ।

—তুই টিনের দুধ না আনলেও পারতিস। এখানে খাঁটি গোরুর দুধ পাওয়া যায়। আমার টিনের দুধ ভালো লাগে না। এখানে সব কিছু টাটকা জিনিস খাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে তো!

বিজন রান্নাঘরে ঢুকে কাঠের জ্বালের উনুন ধরিয়ে ফেলল। তারপর এক কেটলি জল বসিয়ে বেরিয়ে আসতেই আমি ঝোলা থেকে গরদের জামাটা বার করে বললুম, এই দ্যাখ তোর একটা জামা এনেছি। চিনতে পারিস?

অমনি বিজনের চোখ সরু হয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে অপ্রসন্ন গলায় বলল, কেন ওটা এনেছিস? জানিস না, আমি আগেকার পুরোনো কিছুই চাই না।

আমিও রেগে গিয়ে বললুম, তোদের বড্ড অহংকার, তাই না? জামাটা কোথা থেকে পেলুম তা জিজ্ঞেস করলি না কেন? নিজের মা–ও কি আগেকার পুরোনো জিনিস?

বিজন মাথা নিচু করে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তুই এখানে আসবার আগে মনোহরপুকুর গিয়েছিলি, তা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুই যে এখানে আসছিস, তা কি আর কেউ জানে? নীলু, তোকে আমরা সবাই বিশ্বাস করি।

–না, সেকথা কেউ জানে না।

—তবে আমার মা কেন ঐ জামাটা তোর হাত দিয়ে পাঠাল?

-লীলা কাকিমা এই জামাটা তোর জন্য পাঠাননি। এটা আমাকে পরতে দিয়েছেন।

ও, সেটা বুঝিনি। যাক, তবে ঠিক আছে। ও জামাটা তুই–ই পরবি। ওরকম শৌখিন জামা নিয়ে আমি কী করব এখানে?

—ঠিক আছে, তাহলে এটা আমারই হয়ে গেল।

—চায়ের সঙ্গে তুই আর কী খাবি? বিস্কিট–টিস্কিট নেই, তবে নারকোল নাড়ু আছে। শোভাদি খুব সুন্দর নাড়ু বানান। আমাকে দিয়ে গেছেন অনেকগুলো।

—আমি চায়ের সঙ্গে মিষ্টি কিছু পছন্দ করি না।

—তা হলে তোকে কী দিই? শুধু চা খাবি?

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বিজনের দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে রইলুম। কী ভাবে মানুষ এমন করে বদলে যায়? লীলা কাকিমাকে শুধু ছেড়েই চলে আসেনি বিজন, সে লীলা কাকিমা সম্পর্কে কোনো খবর জানতেও আগ্রহী নয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললুম, একটা ছেলে এসেছিল ডিম নিতে, ন্যাড়া মাথা

–ও বুঝেছি, ওর নাম কুলদীপ। ন্যাড়া নয়, ওর মাথার সব চুল উঠে গেছে। গোঁফ–দাড়িও গজায়নি।

–আচ্ছা বিজন, তোর বাড়ির কাছেই যে আর একজন কালো শাড়িপরা মহিলাকে দেখলুম, উনি কে?

–আমরা কেউ ওর নাম জানি না। উনি এখনো কারুর সঙ্গে কথা বলেন না।

–আর তোদের তো কৌতূহল দেখাতে নেই, তাই তোরা কেউ নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেসও করিসনি!

এতক্ষণ বাদে হা–হা করে হেসে উঠল বিজন। চা ছলকে গেল ওর হাত থেকে। কাপটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে ও বলল, তুই আমাদের ওপর রেগে আছিস মনে হচ্ছে! তাহলে তুই বারবার আমাদের দেখতে আসিস কেন?

—কী জানি কেন আসি! আমার মাথায় পোকা আছে বোধহয়।

–আমার মনে হয়, তুই–ও একদিন আমাদের দলে ভিড়ে যাবি। তোর আর ফিরতে ইচ্ছে হবে না। শোন, নীলু, তুই এক কাজ কর। তুই ঐ কালো শাড়ি পরা ভদ্রমহিলার কাছে চলে যা! তুই তো বাইরের লোক, তুই যা ইচ্ছে প্রশ্ন করতে পারিস!

–ওকে দেখলে কী রকম যেন ভয় ভয় করে।

—একজন মহিলাকে দেখে ভয় করার কী আছে? হয় উত্তর দেবেন, নয় দেবেন না। গিয়েই দ্যাখ না!

—অর্থাৎ তুই আমাকে এখন চলে যেতে বলছিস? কেউ আসবে বুঝি?

–তুই সব কথার উল্টো মানে বুঝছিস। থাকতে চাস থাক না যতক্ষণ ইচ্ছে। তুই ঐ মহিলা সম্পর্কে জানতে চাইছিলি।

আমি উঠে পড়লুম। বিজনের সঙ্গে আমার মন মিলছে না। এর চেয়ে একলা একলা হেঁটে বেড়ানোও ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *