নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ৮

আট

পুব আকাশে এখনও সূর্য ওঠেনি। ঘোড়ার পিঠে প্রীচার কোবল্ট ক্যানিয়নে পৌঁছল। বিকট শব্দ তুলে কাজ করে চলেছে মনিটর। পানির প্রচণ্ড তোড়ে পুরো ক্যানিয়নটাই প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে। কোম্পানি পরিচালিত বড় ধরনের মাইনিঙের বিরোধী সে নয়, কিন্তু মনিটরের ব্যবহার সত্যিই অমার্জনীয় অপরাধ।

চোখ তুলে ছোট টিলাটার ওপর একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পেল টিম। লোকটাকে চিনতে পেরে নিজের অজান্তেই ওর হাত পিস্তলের দিকে নামল। বাঁটের কাছে ছড়ানো আঙুলগুলো শূন্যে ঝুলছে। কিন্তু একটু পরেই বুঝল প্রীচার কোন বদ মতলব নিয়ে আসেনি।

মনিটরের গর্জন ছাপিয়ে মেসেজটা শোনাবার জন্যে স্ট্রেঞ্জারকে চিৎকার করতে হলো।

‘তোমার বাবাকে বোলো ওরা জমি বিক্রি করবে না!’

মেসেজটা ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ। রোষের চোখে তাকিয়ে রইল টিম ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল আরোহী। মাটিতে থুতু ফেলে চিৎকার করল ডার্বি।

‘ম্যাগিল!’

.

দুপুরের স্তব্ধ বাতাস কাঁপিয়ে লম্বা একটা হুইসেল দিয়ে লেহুড ছেড়ে রওনা হয়ে গেল ট্রেন। চিঠি আর পার্সেলের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিজের কামরায় ঢুকল স্টেশনমাস্টার। ওগুলো বাছাই করে বিলির ব্যবস্থা করতে হবে।

ডার্বির ফোরম্যানকে অফিসে ঢুকতে দেখে খুশি হয়ে উঠল স্টেশনমাস্টার। তার কাজ কিছুটা বেঁচে গেল। বেশিরভাগ চিঠিপত্রই ওদের।

‘গুড ডে, ম্যাগিল। ডাক নিতে এসেছ?’

‘ওসব রাখো-তুমি আগে বসের এই টেলিগ্রামটা পাঠাও।’

ভাঁজ করা কাগজটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ওটা খুলে মেসেজটা পড়ে পকেটে রাখল সে। ‘চিঠিপত্রগুলো আগে-’

ঝুঁকে স্টেশনমাস্টারের মুখের কাছে মুখ এনে ধমকে উঠল ম্যাগিল।

‘বস্ বলেছে, এক্ষুণি!’

হাতের কাজ সরিয়ে টেলিগ্রাফের টরেটক্কা নিয়ে বসল স্টেশনমাস্টার।

দূরে, ইউবা সিটির টেলিগ্রাফ যন্ত্রটা সচল হয়ে উঠল। ওখানকার বুড়ো অপারেটর খাতা-পেনসিল নিয়ে বসল। এত বছর টেলিগ্রাফারের কাজ করার পর লোকটার কাছে এখন ‘ডিট্‌ ডা’ সঙ্কেতগুলো সামনা-সামনি কথা শোনার মতই পরিষ্কার।

মেসেজটা শেষ হওয়ার পর নতুন একটা কাগজে গোটাগোটা অক্ষরে সবটা লিখে নিয়ে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়াল সে। রাস্তায় নেমে প্রায় ছুটতে- ছুটতে ইউ এস মার্শালের অফিস দালানটার সামনে এসে দাঁড়াল।

হিচিঙ রেইলে সাতটা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। প্রত্যেকটা ঘোড়ার পিঠেই কালো স্যাডল। ডান দিকে, একটু কাত করে ঝোলানো কালো খাপে শোভা পাচ্ছে সাতটা উইনচেস্টার রাইফেল। দামী অস্ত্রগুলোর তেলমাখা সুদৃশ্য বাঁট রোদে চকচক করছে। কোন পাহারা না থাকলেও ওগুলো ছোঁয়ার সাহস কারও নেই।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেণ্ড ইতস্তত করল টেলিগ্রাফার। তারপর সাহস সঞ্চয় করে দরজায় টোকা দিল। মার্শালের অফিসে আসাটা সে মোটেও পছন্দ করে না। কিন্তু মেসেজ বিলি করাটা তার কাজেরই একটা অংশ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার নক করল।

এবার দরজা খুলল।

.

দ্বিতীয়বার দরজায় নক করল প্যাট।

‘প্রীচার? তুমি উঠেছ?’ কোন জবাব নেই। দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিল সে। এটা ঠিক যে অতিথির সাথে তার মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়-কিন্তু এরই মধ্যে ও বুঝে নিয়েছে স্ট্রেঞ্জার বেশি ঘুমানোর পাত্র নয়।

ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল প্যাট। পরিচ্ছন্ন-এবং খালি।

বিভ্রান্ত আর উদ্বিগ্ন হয়ে তাড়াতাড়ি কেবিনটাকে ঘুরে পিছনে চলে এল ও। পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে তৈরি আস্তাবলে অতিথির ঘোড়াটা নেই। বোকার মত কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মারিয়ার কেবিনের দিকে এগোল প্যাট।

মারিয়ার বসার ঘরে ঢুকে অতিথিকে খুঁজল মাইনার।

‘হ্যালো, প্যাট। তোমার আবার কি হলো?’ প্রশ্ন করল মারিয়া।

‘ও চলে গেছে।’

‘কি? কে চলে গেছে?’ প্রশ্ন করল নিতা। চারজনের জন্যে টেবিল পেতে নিজের চেয়ারটা দখল করে বসে আর সবার জন্যে অপেক্ষা করছিল মেয়েটা।

‘প্রীচার। পুরো ক্যাম্প খুঁজে দেখেছি-কোথাও নেই। গতরাতের পর থেকে কেউই ওকে দেখেনি। ঘরে ওর কোন জিনিসপত্র নেই-আস্তাবলে ঘোড়াটাও নেই।’ প্যাটের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে নিজের কথাগুলোই ওর কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না। ‘সব গুছিয়ে নিয়ে ও চলে গেছে।’

মারিয়ার চোখে অবিশ্বাস ফুটে উঠল। ‘কিন্তু কেন? কাউকে কিছু না বলে লোকটা কোথায় গেল?’

দরজাটা বন্ধ করল জনসন। ‘জানি না;’ হতাশ সুরে বলল ও। ‘আমাকে কিছুই বলেনি-একটা কথাও না। কেউ ওকে যেতেও দেখেনি। নিশ্চয় সূর্য ওঠার আগেই চলে গেছে।’

নিতা একটা কথাও বলল না। চুপ করে শূন্য প্লেটটার দিকে চেয়ে বসে আছে। কিছুই ওর ভাল লাগছে না। বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড়াচ্ছে।

‘হয়তো-হয়তো সে ডার্বিকে গতরাতের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গেছে,’ নিজের মনকে বুঝ দিতে চাইল মারিয়া।.

‘কোট আর বেডরোল নিয়ে?’

সঙ্গেসঙ্গে এর কোন জবাব দিতে পারল না মারিয়া। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ও এমন হঠাৎ করে চলে যেতে পারে। লোকটা আমাদের বন্ধু ছিল, কাউকে কিছু না বলে-’

বাইরে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেবিনের দরজা-জানালা কেঁপে উঠল। ক্যানিয়নের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে আওয়াজটা দূরে মিলিয়ে গেল।

দরজা খুলে চট করে বারান্দায় বেরিয়ে এল মাইনার। ওর পিছন পিছন মারিয়া আর ওয়ানিতাও বেরোল। শব্দটা ক্যানিয়নের উপরের দিক থেকে এসেছে। সবার চোখ ওই দিকে। ওরা একা নয়, কার্বন ক্যানিয়নের সবাই শঙ্কিত চোখে একই দিকে চেয়ে আছে।

বিরাট একটা ধুলোর মেঘ উঁচুতে উঠছে। ভয়ে ছেলেমেয়েরা খেলা ছেড়ে ছুটে যার-যার ঘরে গিয়ে ঢুকেছে।

বিস্ফোরণটা কিসের পূর্বলক্ষণ তা সম্ভবত স্পাইডারের চেয়ে ভাল করে ক্যানিয়নের আর কেউ বোঝেনি। ধোঁয়ার মত ধুলোর ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে ক্রীকের পানির দিকে তাকাল সে। পানির তোড় এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। ওর চোখের সামনে ক্রীকের গভীরতা ধীরে কমে যাচ্ছে।

ক্রীকে পানি না থাকার মানেই হচ্ছে প্যানিঙ, সুইসিঙ বা পাথর ধোয়া, কিছুই করা যাবে না। পানি ছাড়া বালু, কাঁকর আর নুড়ির ভিতর থেকে খুঁটে খুঁটে সোনা বের করা একেবারে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

মুখ থেকে পিচকারির মত তামাকের পিক ফেলল স্মিথ। ‘ড্যাম! এটাই বাকি ছিল!’ আপন মনে বিড়বিড় করে বলল সে।

প্যাট্রিক জনসনও অল্পক্ষণ পরে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছল। ‘শেষ হয়ে গেল— সব শেষ।’ ক্লান্ত শোনাল ওর স্বর। ‘ক্রীকের উপর দিকে পাথর ধসিয়ে বাঁধ দিয়েছে ডার্বি। হয়তো পানির ধারা এখন অন্য একটা ক্যানিয়ন দিয়ে বইছে। আমাদের কিছুই করার নেই, কারণ বাড ট্রেভারের ক্লেইম ছাড়িয়ে ওপাশের জমির ওপর আমাদের কোন অধিকার নেই।’

‘তুমি, বাড আর অন্যান্য সবাই মিলে বাঁধটা সরিয়ে ফেললে হয় না?’ প্রশ্ন করল ওয়ানিতা।

হাসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো প্যাট। ‘সেটা সম্ভব হত, যদি ডার্বির লোকজন বন্দুক হাতে ওটা পাহারা না দিত। আমাদের মত ওদেরও ওখানে যাবার সমান অধিকার আছে। ওখানে লড়াই বাধলে আইনের আড়াল আমরা পাব না। বাঁধ ভাঙতে গেলে ডার্বির লোকজন বাধা দেবেই।

‘স্যাকরেমেণ্টোর মাইনিঙ কমিশন হয়তো আমাদের পক্ষেই রায় দেবে, কিন্তু তাতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। শয়তান ডার্বি এবার আটঘাট বেঁধেই আমাদের পিছনে লেগেছে।’

মারিয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। অভিযোগ নিয়ে প্যাটের দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘তোমারই তো দোষ! তুমি ডার্বির প্রস্তাবটা মেনে নিলে কারও এত দুর্ভোগ পোহাতে হত না। এসব ক্লেইমের জন্যে জিম এখন তোমাদের কোন টাকা সাধবে মনে করেছ?’ ফুঁপিয়ে উঠে কেবিনের ভিতরে চলে গেল মারিয়া। প্যাটের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না নিতা। ভাবশূন্য চেহারা নিয়ে সেও মায়ের পিছু নিল।

কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থেকে ক্রীকের দিকে রওনা হলো মাইনার। পানির ধারা এখন এত সরু হয়েছে যে পানিতে নিজের চেহারাও পুরো দেখতে পাবে না প্যাট।

.

অভিজাত ব্যাঙ্ক। তেল-পালিশ করা কাঠের প্যানেলিঙ দেখেই তা বোঝা যায়। কাস্টমারদের ক্লান্ত পা আরাম করে রাখার জন্যে রয়েছে ব্রাসের রেইল। লোকজনের মনোরঞ্জনের জন্যে অনেকগুলো গোলাকার স্বচ্ছ কাচের থালার ওপর ঘুরেঘুরে প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন রুচিশীল দামী শিল্পকর্ম। এই ব্যাঙ্ক সবার

জন্য নয়।

ব্যাঙ্ক টেলারের পরনে সদ্য লষ্ট্রি করা থ্রী পীস স্যুট। ধবধবে সাদা শার্টের কলারে নিখুঁতভাবে বাঁধা বো টাই। বর্তমানে সে সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা এক মহিলা কাস্টমারকে নিয়ে ব্যস্ত। এই ব্যাঙ্কে সোনার মুদ্রা আর কাগজের টাকায় কোন পার্থক্য নেই।

‘তেইশ, চব্বিশ, পঁচিশ। ধন্যবাদ, মিসেস গ্রীন। আশা করি তোমার মা এখন সুস্থ বোধ করছে। তাকে আমার শুভেচ্ছা দিয়ো।’

‘নিশ্চয়, মিস্টার র‍্যাদার।’

নিজের ড্রয়ারটা চেক করে যন্ত্রচালিতের মত সে বলল, ‘নেক্সট, প্লীজ।’ চোখ তুলে তাকিয়ে সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে নিজের বিস্মিত ভাবটা ঢাকার চেষ্টা করল।

‘গুড আফটারনুন, রেভারেণ্ড। তোমার জন্যে আমি কি করতে পারি?’

বিনা বাক্যব্যয়ে লম্বা লোকটা গ্রিলের তলা দিয়ে একটা চাবি ঠেলে দিল। যুবক টেলার ত্রস্তে মাথা ঝাঁকাল।

‘আমাকে অনুসরণ করো, রেভারেণ্ড। ওটা-’

‘পথটা আমি চিনি,’ শান্ত স্বরে জানাল কাস্টমার।

হাসল ক্লার্ক। ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়।’ অন্যান্য টেলারদের পিছন দিয়ে এগিয়ে ভাইস্ প্রেসিডেন্টের ডেস্ক ছাড়িয়ে দরজার সামনে কাস্টমারকে অভ্যর্থনা জানাল সে। দুজনে লম্বা একটা করিডর দিয়ে গার্ডকে পাশ কাটিয়ে ভল্টে ঢুকল।

নির্দিষ্ট সেফটি ডিপজিট বক্সের সামনে থেমে হাতের চাবিটা গর্তে ঢুকাল টেলার। তারপর নিজের পকেট থেকে আরেকটা চাবি বের করে পাশের গর্তে ঢুকিয়ে দুটোই একসাথে ঘোরাল। ক্লিক শব্দে দরজাটা খুলে গেল। নিজের চাবিটা পকেটে ভরে অন্যটা মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিল। তারপর ভিতর থেকে স্টীলের কালো বাক্সটা টেনে বের করে বাড়িয়ে ধরল। ‘এই নাও, রেভারেণ্ড।’

বাক্স নিয়ে লম্বা লোকটা পর্দা টানা ছোট কামরায় ঢুকল। বাক্স খুলে টুলের ওপর রেখে, ভিতর থেকে নরম চামড়ার মোড়ক খুলে ৪৪ পিস্তল বের করল। বহুল ব্যবহৃত পিস্তলের বাঁট হরিণের শিঙের তৈরি। হাতলটা ওর হাতে ঠাণ্ডা অনুভূতি জাগাল।

চামড়ার মোড়কটা বাক্সের মধ্যেই রইল। কিন্তু মোড়াবার কিছু থাকল না। সাদা কলারটা খুলে বাক্সে রেখে তালা বন্ধ করল প্রীচার।

.

ক্রীকের ধারে এসে স্পাইডারের দেখা পেল প্যাট। কিছুক্ষণ আগেও যেটা প্রবল স্রোতস্বিনী কার্বন ক্রীক ছিল, তা এখন সামান্য একটা ক্ষীণ ধারায় পরিণত হয়েছে। আরও দুজন পুরোনো মাইনার, রসি আর বেক ওদের সাথে এসে যোগ দিল। একটু পরে বাড় আর হেণ্ডারসনও এল।

ডার্বির বিরুদ্ধে লড়বে বলে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু চতুর জিম এমন একটা চাল চেলেছে যে ওরা এখন অসহায় বোধ করছে।

‘শিট!’ পানি সরে জেগে ওঠা মাটির দিকে চেয়ে গালি দিল রসি। ছয় বছর আগে অনেক আশা নিয়ে কার্বন ক্যানিয়নে এসেছিল ও। কিন্তু এত বছর পর এখন সে কোনমতে থাকা খাওয়ার জোগাড় করতে পারলেই খুশি। জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছে রসি, আশা আর মাইনিঙ করার উৎসাহ হারায়নি। এই শেষ ধাক্কাটা ওর মন একেবারে ভেঙে দিয়েছে।

হেণ্ডারসনও নিরাশ। ‘এখন আর কি? পাত্তাড়ি গুটিয়ে বৌকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে।’

সঙ্গেসঙ্গে ওর কথায় সায় দিল বাড। ‘হ্যাঁ, আর কোন উপায় তো আমি দেখছি না। তুমি কি বলো, প্যাট? আর কোন পথ আছে?’

থাকার সপক্ষে বলার মত কিছু খুঁজে না পেয়ে হতাশ চেহারায় ক্রীকের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল প্যাট।

স্পাইডার স্মিথ প্যাটের কেবিনের দিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘প্রীচার কোথায়? ও জানবে আমাদের কি করা উচিত। বাইবেল ছাড়াও লোকটা অনেক কিছু জানে। চলো, দেখি ও কি বলে।’ রওনা হলো স্পাইডার।

‘প্রীচার কেবিনে নেই,’ বলল প্যাট।

‘কোথায় গেছে? শহরে?’ জানতে চাইল স্পাইডার।

‘জানি না। কিন্তু যাওয়ার আগে বলে গেছে ও না ফেরা পর্যন্ত আমরা যেন সে আমাদের মাঝেই আছে মনে করে একত্রে কাজ করে যাই,’ মিথ্যা বলল প্যাট। সবার মনোবল ধরে রাখার আর কোন উপায় ওর মাথায় খেলছে না।

‘শি।’ রসির শব্দের ভাণ্ডার খুব সীমিত। তাই অসন্তোষ প্রকাশ করার জন্যে ওই একটা শব্দই সে বারবার ব্যবহার করে।

প্রীচার ফিরে আসবে শুনে উৎসাহিত হয়ে বাড প্রস্তাব দিল, ‘আমরা কয়েকদিন ড্রাই প্যানিঙ করে কাটালেই তো পারি?’

‘নিশ্চয়,’ সমর্থন জানাল হেণ্ডারসন। ‘কোমর পানিতে প্যানিঙ করা যায় না। এই সুযোগে আমরা গভীর পানিতে কি জমা পড়েছে তা দেখার সুযোগ পাব। বলা যায় না, এতে কারও হয়তো কপাল খুলে যেতে পারে।’

‘ঠিক বলেছ!’ কপট উৎসাহ দেখিয়ে বলল প্যাট। ‘আমি জানি প্রীচার এখানে থাকলে বলত সব রকম চেষ্টা করার আগে হাল ছাড়া উচিত হবে না।’

‘হয়তো,’ বলল বেক। লোকটা স্পাইডার ছাড়া আর সবার চেয়ে বয়সে বড়। অনেক পোড় খেয়ে ওর উদ্যম ঝিমিয়ে পড়েছে। ‘কিন্তু ড্রাই প্যানিঙ খুব শক্ত কাজ। আমি বহু লোককে জানি যারা ওই কাজ করেছে-কেউই সুবিধা করতে পারেনি।’

‘নিরাশ হয়ো না, বেক,’ বলল হেণ্ডারসন। ‘দুদিন এটা চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? প্রীচার এলে সে একটা উপায় বের করবেই। তাই না, প্যাট?’

‘নিশ্চয়,’ বলে ওদের মনোবল যোগাল জনসন।

স্পাইডার আর প্যাট ছাড়া বাকি সবাই সিদ্ধান্তটা স্ত্রীকে জানাতে নিজেদের কেবিনে ফিরে গেল।

স্পাইডার স্মিথ কিন্তু প্যাটের মিথ্যা আশ্বাসে ধোঁকা খায়নি। বাড আর হেণ্ডারসনের মত সহজে কিছু বিশ্বাস করে না, কিংবা রসি আর বেকের মত হুজুগেও সে চলে না। সবাই চলে যাওয়ার পর প্যাটের দিকে ফিরল স্মিথ।

‘তোমার সাহস আছে বলতে হবে। মিথ্যা কিভাবে বলতে হয় তা তুমি রপ্ত করতে পারোনি। কপাল ভাল মেয়র পদের জন্যে তুমি দাঁড়াচ্ছ না।’

অপ্রস্তুত ভাবে একটু হাসল প্যাট। ‘তুমি কি বলছ ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ একটা পাথর তুলে নিয়ে ওটা পরীক্ষা করে দেখার ভান করল সে।

‘তাই নাকি? শোনো, প্যাট, তুমি ভালমানুষ। এসব লোকজনের জন্যে নিজের জীবনটাকে তুমি নষ্ট কোরো না। আমার মত বুড়ো হাবড়ার কথা আলাদা।

‘প্রীচার চলে গেছে, ওদিকে ডার্বি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামীতে কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা আমিও বুঝছি, তুমিও বোঝো। ওদের কাছে তোমার কোন দেনা নেই। তাই আমার মতে মেয়ে দুজনকে নিয়ে এখান থেকে তোমার সরে যাওয়াই ভাল।’

‘আমি প্রাণ নিয়ে পালাবার লোক নই।’

‘বুঝছ না কেন? এটা ঠিক পালানো হচ্ছে না-গ্রান্টও লোকজন নিয়ে যুদ্ধ ছেড়ে পিছিয়ে গেছিল পশ্চিমে গিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। এটা কমন সেন্স। তোমার জায়গায় থাকলে আমি তাই করতাম।’

প্যাট ইতস্তত করছে। ‘যদি…যদি ও ফিরে না আসে, তুমি কি করবে?’

বালুর ওপর থুতু ফেলল মাইনার। ‘আমার হাত-পায়ের চেয়ে মুখ বেশি চলে। যা-ই ঘটুক আমি নড়ছি না। কিন্তু একটা মাথা মোটা হ্যাঁকড়া বুড়ো যা করবে তোমাকেও তাই করতে হবে, এর কোন মানে নেই।’

কথা শেষ করে গটমট করে হেঁটে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেল স্পাইডার। ওদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঢাল বেয়ে মারিয়ার কেবিনের দিকে এগোল প্যাট।

একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে প্যাটকে ঢাল বেয়ে উঠতে দেখল নিতা। কিন্তু আগের মত ছুটে এগিয়ে গেল না। জনসন লোকটা ভাল, তবে ওর সঙ্গ এখন আর তাকে সান্ত্বনা জোগাতে পারবে না। ওর মনটা বড্ড ভারি হয়ে আছে।

মায়ের কাছে গিয়েও লাভ নেই। এমন একটা সময় ছিল, যখন মায়ের আদর-মাখা কথা তাকে সব দুঃখ-দুর্দশা ভুলিয়ে দিত। কিন্তু এখন সে বড় হচ্ছে, তাই হয়তো আগের মত সেই আদর আর তাকে ভোলাতে পারে না। বড় হওয়ার এই দিকটা তার ঠিক ভাল লাগে না।

পায়ের কাছে একটা ড্যাণ্ডিলায়ন ফুল দেখতে পেয়ে ওটা ছিঁড়ে নিয়ে মুখের খুব কাছে ধরল নিতা। অন্য সময় হলে ওই ফুলের কোমল সৌন্দর্য ওকে মুগ্ধ করত। কিন্তু এখন ওর মনটা ভাল নয়, আজ কোন কিছুই ওকে আনন্দ দিতে পারছে না। জোরে ফুঁ দিয়ে সুন্দর হালকা পাপড়িগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দিল ওয়ানিতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *