নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ১০

দশ

‘আরেকটা খাও, স্পাইডার।’ বারটেণ্ডার একটা গ্লাসে হুইস্কি ঢালল। তারপর সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে বুড়ো মাইনারের দুই চুমুকে ড্রিঙ্ক শেষ করা দেখল। বারে শহরের আরও লোক ভিড় করে আছে। বারের শক্ত কাঠের তক্তার ওপর রাখা সোনার তাল, আর তার মাতাল মালিককে ওরা ঈর্ষার চোখে চোরা চাহনিতে দেখছে।

‘ওটা দেখেছ!’ একজন কৃষক ফিসফিস করে বলল।

‘ওটার দাম কত হাজার হতে পারে?’ প্রশ্ন করল কেউ।

‘দশ হাজারের কিছু বেশি,’ মন্তব্য করল একজন সবজান্তা।

‘বিশও হতে পারে,’ পাশের পাতলা গড়নের লোকটা নিজের মত প্রকাশ করল।

ওদের দিকে ফিরে দাঁত বের করে হাসল স্পাইডার। ‘ঠিক বলেছ! বিশ বছর অন্যের ক্লেইমে খেটেছি। তারপর সাত বছর ওই ক্যানিয়নে কাজ করার পর ওটা আমি পেয়েছি। আমি! স্পাইডার পারসি স্মিথ!’ মাতাল অবস্থায়, সোনা পাওয়ার খুশিতে পিতৃদত্ত নামটা স্বীকার করতে আজ ওর বাধল না।

দুবার বোতলটা ধরার চেষ্টায় বিফল হয়ে তৃতীয়বারে ওটাকে আঁকড়ে ধরল স্পাইডার। তারপর বারে হেলান দিয়ে সোজা হয়ে অন্য হাতে সোনার তালটা তুলে টলতে টলতে দরজার দিকে এগোল।

লাফিয়ে রাস্তায় নেমে দুবার পড়তে পড়তেও টাল সামলে নিল। চোখে এখন ঝাপসা দেখছে ও। কিন্তু জানে কোথায় যাচ্ছে। এই দিনটার জন্যে অনেক প্রার্থনা আর অনেক অপেক্ষা করেছে স্পাইডার। এই দিনটাকে আজ পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করবে ও।

‘এই, স্পাইডার,’ দুশ্চিন্তা প্রকাশ করল একজন গ্লাসফ্রেণ্ড। ‘তোমার এখন একটু···’

লোকটার কথা শুনতে পেল না স্পাইডার। মাথার ভিতর যেসব স্বর কথা বলছে কেবল সেগুলোই শুনতে পাচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে এসে ডার্বির দালানের দিকে মুখ করে দাঁড়াল মাইনার।

‘ডার্বি! আমি স্পাইডার-স্পাইডার স্মিথ! আমার কথা মনে আছে? মনে থাকা উচিত-ব্যাটা, বেজন্মা! বেরিয়ে এসো-সৎ মাইনারের সাথে একটা বোতল খাও, হতচ্ছাড়া খট্টাস! দেখব পাল্লা দিয়ে তুমি কত হুইস্কি গিলতে পারো।

মাথা পিছনে হেলিয়ে বোতল উলটে গলায় মদ ঢালল স্পাইডার। গলা জ্বালিয়ে তরল পদার্থটা পেটে পৌঁছে গরম একটা অনুভূতি জাগাল। প্রত্যেকটা ফোঁটাই ওকে আনন্দ দিচ্ছে। সেকেলে যোদ্ধা যেন যুদ্ধ জয় করে শত্রুর রক্তপান করছে।

দালানটার সামনে হিচিঙ রেইলে বাঁধা সাতটা ঘোড়ার ওপর ওর চোখ পড়ল বটে, কিন্তু দেখেও দেখল না।

স্পাইডারের দেহ বুড়ো হয়েছে, কিন্তু ফুসফুস এখনও সতেজ। ওর বারংবার চিৎকার ডার্বির দালানের দোতলায় বসা লোক দুজনের কানে গেল।

ভুরু কুঁচকে হুইস্কির গ্লাসটা নামিয়ে রাখল জিম ডার্বি। উলটো পাশে বসা লোকটা চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীর গতিতে জানালার কাছে এগিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে ফিরে তাকাল।

‘লোকটা তোমার নাম ধরে ডাকছে, মিস্টার ডার্বি।’

‘আমি জানি।’ চরম বিরক্তির ভাব ফুটে উঠেছে ডার্বির চেহারায়। জানালার ধারে স্টকবার্নের পাশে এসে দাঁড়াল সে। দুজনে বাইরে তাকিয়ে কয়েক সেকেণ্ড রাস্তার মাঝখানে মাতাল লোকটার টলমল পায়ের নাচ দেখল।

‘লোকটা কি ওদেরই একজন?’ নরম সুরে প্রশ্ন করল স্টকবার্ন।

‘হ্যাঁ। ওর নাম স্মিথ। হ্যাঁকড়া লোক।’

স্টকবার্ন কৌতূহলী চোখে ডার্বির দিকে তাকাল। ‘ওর কথায় মনে হচ্ছে লোকটা তোমাকে ভালভাবেই চেনে।’

চেহারা বিকৃত করল জিম। ‘লোকটা এই পেশায় বহুদিন আছে বলে ওর সাথে আমার কিছুটা জানাশোনা হয়েছে। পুরোনো লোক আর এখন বেশি নেই। কঠিন পরিশ্রম ছাড়া সোনা পাওয়া যাচ্ছে না দেখে বেশিরভাগই অন্য পেশায় সরে গেছে। কিন্তু ও যাবে না-সেটা ওর দুর্ভাগ্য।’

‘দুর্ভাগ্য বলছ কেন?’

‘আমরা ওদের চাপের মুখে ফেলে এমন অবস্থা করেছিলাম যে অনেকেই চলে যাওয়ার জন্যে তৈরি ছিল। কিন্তু স্মিথ নয়। অবশ্য ও একা হলে ওকে তাড়ানো কোন সমস্যা ছিল না-মাঝখান থেকে এক প্রীচার এসে জুটেছে—ওই লোকই মাইনারদের সাহস যোগাচ্ছে।’

ভুরু কুঁচকে বিস্মিত চোখে বয়স্ক লোকটার দিকে তাকাল মার্শাল। ‘একজন প্রীচার?’

‘হ্যাঁ। শুনতে ঠাট্টার মত শোনালেও, কথাটা সত্যি। মাইনারদের মাথায় নতুন সব আইডিয়া ঢুকাচ্ছে ও। লোকটা যে ওদের কি বলে খেপিয়ে তুলেছে জানি না-কিন্তু প্রীচারের কথাতেই ওরা আমার ক্লেইম কিনে নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রতি ক্লেইমের জন্যে এক হাজার ডলার!’ কথাটা যেভাবে বলল তাতে মনে হলো ব্যাপারটা এখনও তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

‘আমার মনে হয় তোমার পজিশনে তুমি ওদের জন্যে অনেক বেশি করেছ। একটা মানুষ আর কত করবে? তাছাড়া তোমাকে মান-সম্মান আর নিজের ব্যবসার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’

‘ঠিক বলেছ। আসলে আমার মনটাই খুব নরম। অথচ এই লোকগুলো আমার টাকা আর সময় অযথা নষ্ট করছে।’ মুখ তুলে তীক্ষ্ণ চোখে সঙ্গীর দিকে তাকাল ডার্বি। ‘ওদের সাথে ওই প্রীচারকেও তোমার ঢিট করতে হবে। লোকটা লোকজনের সামনে আমাকে অপমান করেছে-আমার তিনজন কর্মচারীকেও পিটিয়েছে।’

সন্দিগ্ধ চোখে জিমের দিকে তাকিয়ে আছে স্টকবার্ন। ‘একজন প্রীচার এটা করেছে? একা?’

মাথা ঝাঁকাল ডার্বি। ‘হ্যাঁ, তাই করেছে। না করলে কি আমার লোকজন মার খাওয়ার কথা স্বীকার করত?’

স্টকবার্নকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে। তথ্যটা ঠিক হজম করতে না পেরে বিব্রত বোধ করছে।

‘আচ্ছা, এই প্রীচার লোকটা দেখতে কেমন?’

সবার দিকে তাকিয়ে দেখল জিম। ওদের কথার ফাঁকে আরও লোক প্রবেশ করেছে ঘরে। মার্শালের ডেপুটি। ওরা নিজেদের মধ্যেও খুব কমই কথা বলে, কিন্তু মার্শালের সামান্যতম ইশারায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রত্যেকেই বিশাল। কারও চেহারাই প্রিয়-দর্শন নয়। ওদের উপস্থিতিতে ডার্বি অত্যন্ত নার্ভাস বোধ করে। স্টকবার্ন পাশে না থাকলে ওই লোকগুলোর সামনে দাঁড়ানোর সাহস ওর হত না।

‘সত্যি কথা বলতে কী, শেষে মার্শালের প্রশ্নের জবাব দেয়া শুরু করল ডার্বি, ‘ভাল করে খেয়াল করিনি। লোকটা লম্বা, হয়তো গড়নটা পাতলাই বলা যায়-কিন্তু শুকনো নয়। আকারে বিরাট হলেও ওর চলাফেরা খুব মসৃণ।’ একটু ইতস্তত করল ধনী মাইনার, মনে করার চেষ্টা করছে। ‘হ্যাঁ, আর একটা কথা, ওর চোখ দুটো অদ্ভুত। কেন যেন চোখ দুটোর কথাই বারবার মনে পড়ে।’

ডার্বির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনল স্টকবার্ন। শুনতে শুনতে ওর আড়ষ্ট হওয়া লক্ষ করল ডার্বি।

‘ওই লোককে তুমি চেনো?’

কাঁধ উঁচাল মার্শাল। ‘হয়তো। ওই রকম বর্ণনার একটা মানুষকে আমি চিনতাম।’

‘সম্ভবত সে-ই। মনে হলো তোমার নাম শুনেই সে তোমাকে চিনল।’

অফিস কামরাটা নীরব। বাইরে স্পাইডারের চিৎকার আর গালমন্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ডার্বির আর সহ্য হচ্ছে না, কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।

‘কিন্তু তা অসম্ভব,’ মৃদু স্বরে বলল স্টকবার্ন। ‘আমি যার কথা ভাবছিলাম সে মারা পড়েছে।’ কথাটা বলে নিজের মনকেই যেন শক্ত করল মার্শাল। তারপর ঘুরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ডেপুটিরা একটা কথাও না বলে ওকে অনুসরণ করল।

স্পাইডারের নেশা এখন তুঙ্গে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দালান লক্ষ্য করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ও।

‘আমি জানি তুমি ভিতরেই আছ, জিম!’ ধুলোয় থুতু ফেলে বাম হাতের সোনার তালটা দালানের দিকে তুলে ঝাঁকাল সে। ‘তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। বেরিয়ে এসে একটা ড্রিঙ্ক খাও!’

দড়াম করে সামনের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। প্রথমে ডার্বির তিনজন লোক বেরোল। ওদের দেখে মনে হচ্ছে পিছন থেকে তাড়া খেয়েই যেন পালাচ্ছে। ওদের পেছনে সদর্পে বেরিয়ে এল স্টকবার্নের ডেপুটির দল। ছয়জন সামনের বারান্দায় সার বেঁধে দাঁড়াল। ওদের কেউ রাস্তার বুড়ো লোকটাকে কিছুই বলল না।

স্পাইডার স্মিথ নেশার ঘোরে চোখ সরু করে চেহারা চেনার চেষ্টা করল। কিন্তু একজনকেও চিনতে পারল না। ডার্বির লোকজন সবাই ওর মুখ-চেনা। মাতাল অবস্থাতেও বুঝল এই লোকগুলো একটু ভিন্ন ধরনের-ভিন্ন আর বিপজ্জনক। নেশায় আচ্ছন্ন অবস্থাতেও স্মিথের ভিতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল।

টলতে টলতেই দেখল ওখানে একজন সপ্তম মানুষের আবির্ভাব ঘটল। বয়স পয়তাল্লিশ হবে-লোকটা বারান্দার কিনারে দাঁড়িয়ে সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে। ডান হাতের আঙুলগুলো কিছু করার প্রস্তুতিতে যেন আড়মোড়া ভাঙছে।

‘ডার্বি কোথায়?’ মদের প্রভাবে জমাট বাঁধা আত্মবিশ্বাস তরল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

‘ভিতরে।’ স্বরটা মসৃণ-প্রায় নিরুত্তাপ। ‘তোমার কি সমস্যা?’

এতক্ষণে আসল কথাটা নেশার জাল ভেদ করে স্পাইডারের মাথায় ঢুকল। কাঁপা আঙুল মার্শালের দিকে তুলে সে বলল, ‘চিনেছি! তুমি স্টকবার্ন।’

লোকটা হাসল। ‘হ্যাঁ, আমি স্টকবার্ন। আর এরা,’ হাতের ইশারায় সঙ্গীদের দেখাল সে, ‘এরা আমার ডেপুটি। হয়তো ওদের কথাও তুমি শুনেছ। বয়েজ, তোমরা লৌকিকতা ভুলে যেয়ো না, মিস্টার স্মিথকে হ্যালো বলো।’

ওদের ছয়জনের কেউ একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। কেবল দুএকজনের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটল।

মনের অনুভূতিগুলোকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে স্পাইডার। সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা পরিষ্কার করার জন্যে বোতলে একটা চুমুক দিল। ‘তোমার, বা তোমার লোকজনের সাথে আমার কোন বিবাদ নেই, স্টকবার্ন- আমি ডার্বির সাথে কথা বলতে চাই।’

দেঁতো হাসি হাসল লোকটা। তারপর মোলায়েম স্বরে বলল, ‘বেশ তো, বলো, মিস্টার স্মিথ।’ মাথা ঝাঁকি দিয়ে দোতলার জানালাটা দেখাল সে। ‘ওখানে আছে ও। তোমার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।’

একটু ইতস্তত করে শেষে চিৎকার করল স্পাইডার। ‘ডার্বি! এই, বাঁকা ঠ্যাঙওয়ালা গিরগিটি, বেরিয়ে এসো। তোমার সাথে…’

ওর কথা মাঝপথেই ধীরে মিলিয়ে গেল। মার্শালের হাতের ওপর ওর চোখ আটকে গেছে। লোকটার আঙুল আবার নড়াচড়া শুরু করেছে। সম্মোহিতের মত চেয়ে রইল স্পাইডার। অশুভ একটা নাচ নাচছে ওগুলো।

চোখের পাতা ফেলে টাল সামলে আবার সিধে হয়ে দাঁড়াল স্মিথ। হঠাৎ তার খেয়াল হলো রাস্তার মাঝখানে সে একাই দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশে গাড়ি, ঘোড়া বা লোকজন কেউ নেই-সব ফাঁকা। সে সম্পূর্ণ একা।

জুড ব্ল্যাকেনশিপ দোকানের, বাকির খাতা দেখতে দেখতে মুখ তুলে কান পেতে শুনে বাইরের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। তারপর স্পাইডারের ছেলে দুটোর দিকে তাকাল। ওরা অভিভূত হয়ে ফিলাডেলফিয়া থেকে আমদানি করা কারখানায় তৈরি একটা গুলতি দেখছে।

আবার কিছুক্ষণ শুনে, রাস্তা থেকে আর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে বলল, ‘মনে হচ্ছে তোমাদের ড্যাডির স্টীম ফুরিয়ে এসেছে। এবার ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভাল, কি বলো?’

‘ওকে নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তা কোরো না, মিস্টার ব্ল্যাকেনশিপ,’ জবাব দিল এডি ‘আমরা শহরে আসার সুযোগ বছরে একবার পাই। ড্যাডি ঠিকই আছে। ওর সাথে পাল্লা দিয়ে মদ খেতে পারে এমন লোক প্লেসারভিলের এপাশে কেউ নেই।’

‘হ্যাঁ,’ সায় দিল টেডি, ‘ও ঠিকই থাকবে। বলেছে সাধ মিটিয়ে মদ খেয়ে সেলিব্রেট করা হলে সোনা বিক্রি করতে এখানে আসবে।’

কাঁধ উঁচাল জুড। স্পাইডার কি করে না করে সেটা দেখা তার দায়িত্ব নয়। এখানে নিজের মতামত ব্যক্ত করার চেয়ে বেশি কিছুই করার নেই। আবার নিজের খাতায় মন দিল সে।

রাস্তায়, স্পাইডারের মদের সাহস ছাপিয়ে একটা অজানা ভয় ওকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ভয়ে নেশা যত কাটছে, অস্বস্তি বাড়ছে। এতক্ষণে মুখোমুখি দাঁড়ানো লোকটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ও। সত্যিই ভয় পেয়েছে। নার্ভাস ভাবে ঢোক গিলে চারপাশে দেখল। মদের বোতল আর সোনার তাল ছাড়া ওকে সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই।

ওর ভাবের পরিবর্তন উপভোগ করছে স্টকবার্ন। ‘তোমার মত ছিঁচকে মাইনারের সাথে ডার্বি কথা বলতে চায় না। তুমি বরং আমাদের একটা নাচ দেখাও, কেমন? তাতে ডার্বিকে গালাগাল করার অপরাধটা আমরা ধরব না। আমার মনে হয় এটাই ন্যায্য।’ আড়চোখে নীরব ডেপুটিদের দিকে তাকাল সে। ‘তোমরা কি বলো, বয়েজ?’

ডেপুটিরা মার্শালের কথার কোন জবাব না দিয়ে নীরবেই দাঁড়িয়ে রইল। তবে এতে স্টকবার্নের উৎসাহে কোন ঘাটতি দেখা গেল না। ওর চোখে নিষ্ঠুর একটা দীপ্তি জ্বলে উঠতে দেখেই স্পাইডার বুঝে নিয়েছে লোকটা কিসের কথা বলছে।

‘আমি নাচতে জানি না।’

‘কী?’ অবাক হওয়ার ভান করল স্টকবার্ন। ‘তিনকাল পেরিয়ে গেছে এখনও নাচই শেখোনি? মিছে কথা!’

বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই চোখের নিমেষে মার্শালের পিস্তলটা গুলি ছুঁড়ল। লাফিয়ে উঠল মাইনার। বুলেটটা ওর পায়ের কাছে ধুলো ওড়াল। সরাসরি লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকলেও ও যে কখন ড্র করেছে দেখতেই পায়নি স্পাইডার।

ডেপুটির দল নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছে।

ধুলো পরিষ্কার হলো। স্পাইডার দাঁড়িয়ে আছে-ভয়ে কাঁপছে ও।

‘এই তো, বেশ নাচতে পারো।’ আরও মোলায়েম শোনাল স্টকবার্নের কণ্ঠস্বর। ‘আমি জানতাম দুএক কদম নাচ নিশ্চয়ই শিখেছ। কত সহজ দেখেছ? তোমাকে কেবল তালে-তালে পা ফেলতে হবে-ব্যস।’

পিস্তলটা আবার গর্জাল। দুবার। কিন্তু একটার মতই শোনাল। স্পাইডার আবার চমকে লাফিয়ে উঠল। এবার বুলেটগুলো পায়ের আরও কাছ-ঘেঁষে পড়েছে।

গুলির আওয়াজ শুনে জুড আর স্পাইডারের দুই ছেলে দোকান থেকে ছুটে বেরিয়ে এল রাস্তায়।

‘হায়, আল্লা! না!’ বলে উঠল আতঙ্কিত ব্যবসায়ী। এক নজরেই সে পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছে।

‘ড্যাডি!’ চিৎকার করে এগোল এড। কিন্তু এক পা না যেতেই পিছন থেকে ওকে কলার চেপে ধরল দোকানি। টেডকেও শক্ত করে ধরে রেখেছে ও।

স্পাইডার স্মিথের জমজমাট নেশার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও এখন কেটে গেছে। বুঝতে পারছে এখন আর সে একা নেই। স্টকবার্নের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েও ওর চোখের কোণে ব্ল্যাকেনশিপের দোকানের সামনে নড়াচড়া ধরা পড়েছে।

‘তোমরা ওখানেই থাকো, বাছা! যাই ঘটুক, তোমরা দুজন এগিয়ো না। শুনছ?’ চিৎকার করল স্পাইডার।

‘তোমাদের ড্যাডির কথা শোনো,’ সমর্থন জানাল জুড। কিন্তু মুঠো আলগা করল না।

‘নাচের জন্যে এখন কিছু মিউজিক দরকার,’ অলস ভাবে ডেপুটিদের বলল মার্শাল। ‘শো মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে, কিন্তু আমার হাত এখন ক্লান্ত।’

ছয়টা পিস্তল একসঙ্গে খাপ ছেড়ে বেরোল। সেকেণ্ডে একটা করে গুলি ছুঁড়ছে ডেপুটির দল। স্টকবার্নের নেতৃত্বে ডেপুটিরা এক হয়ে কাজ করছে। একের পর এক গুলি রাস্তার মাটি ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। প্রত্যেকটাই ঠিক ওর পায়ের কাছে পড়ছে, আর স্পাইডার পাগলের মত লাফাচ্ছে।

নাপিত-ডেনটিস্ট গুলির শব্দ শুনে জানালার পর্দা ফাঁক করে বাইরে তাকাল। মহিলা পোস্টমাস্টারও তাই করল। টমাসের সাহস বেশি-উৎসাহ নিয়ে কতজন মরল দেখার জন্যে দরজা খুলে মাথা বের করল। লোকটা মৃতের সৎকার করে। কিন্তু লেহুডের বাকি লোকজন হঠাৎ একসাথে কালা হয়ে গেল। সবাই বাড়িতে বা কাজের জায়গায় লুকিয়ে রইল। উঁকি দিয়ে একটু দেখার সাহসও ওদের নেই।

দোতলার জানালা দিয়ে নিচে রাস্তার খেলা দেখছে ডার্বি। শেষে একঘেয়েমির বিরক্তিতে সরে এল। নিচে কি ঘটছে তা জানে ও। এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু ওর কাছে একটা চিঠির জবাব দেয়া বা কিছু মেরামত করার চেয়ে বেশি গুরুত্ব এর নেই। ওর সময়ের দাম অনেক। ডেস্কে ফিরে পাঁচ নম্বর শাটের রিপোর্ট দেখায় মন দিল সে।

ধুলো আর পিস্তলের ধোঁয়ায় স্পাইডারকে এখন অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। গুলির শব্দের তালে তালে লাফাচ্ছে ও। মদ খাওয়ার পর এত পরিশ্রমে ঘেমে উঠেছে। কিন্তু মদের বোতল বা সোনার খণ্ডটা ছাড়েনি।

ধুলো আর ধোঁয়ার মেঘের ভিতর স্পাইডারকে তাক করে দুটো গুলি ছুঁড়ল স্টকবার্ন। প্রথমটায় বোতল, আর দ্বিতীয়টায় সোনার তালটা ভেঙে চুরমার হলো। বোতলের মদে মাইনারের বুট আর জামা ভিজল। সোনার নাগিটগুলো ধুলোয় লুটাচ্ছে।

‘এবার দ্রুত তালে,’ ডেপুটিদের নির্দেশ দিল মার্শাল। বিকারহীন লোকগুলো আদেশ পালন করল।

বুড়ো বয়সে লাফালাফি করে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে স্মিথ। থেমে পায়ে গুলি খাওয়ার ঝুঁকি নেয়া বা ছুটে পালানোর চেষ্টা করতে পারে ও। কিন্তু তাতেও হাঁটুর পিছনে গুলি লাগতে পারে। এর একটাও করল না। পুরোনো মাইনার সম্মান বাঁচানোর একটা পথই জানে-পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল সে।

ধুলো একটা হালকা পর্দার সৃষ্টি করেছে। আবছা ভাবে ওর ভঙ্গিটা কেবল দেখা গেল; এবং যা ঘটার তাই ঘটল। সাতটা পিস্তল একসাথে গর্জে উঠল।

বুলেটের আঘাতে শুকনো বুড়োর দেহটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এতগুলো ভারি গুলির ধাক্কায় ছিটকে ন্যাকড়ার পুতুলের মত মাটিতে আছাড় খেয়ে নেতিয়ে পড়ল মাইনার। একটা হাত তুলল স্টকবার্ন। ওর গলার স্বরটা আগের থেকেও শান্ত।

‘যথেষ্ট হয়েছে, বয়েজ। ধন্যবাদ।’

ব্ল্যাকেনশিপ ছেলে দুটোকে আর আটকে রাখতে পারল না। জোর করে নিজেদের ছাড়িয়ে ওরা ছুটে এগোল স্পাইডারের অসাড় দেহটার দিকে।

গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দের পর এখন সব নীরব। বারান্দার কাঠের মেঝেতে খালি কার্তুজগুলো পড়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ডেপুটিরা তাদের পিস্তলে তাজা বুলেট ভরছে। স্টকবার্ন বিরূপ চোখে ছেলে দুটোকে বাপের লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে দেখে শার্টে নিজের হাত মুছল।

কান্না চেপে বোবা-প্রতিবাদে স্টকবার্নের দিকে চেয়ে রক্ত মাখা একটা হাত তুলল এডি। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে একটু পিছিয়ে গেল লোকটা।

‘ওকে কার্বন ক্যানিয়নে নিয়ে যাও,’ ছেলে দুটোকে নির্দেশ দিল মার্শাল ‘আর তোমাদের প্রীচারকে কাল সকালে আমার সাথে দেখা করতে বোলো। সে না এলে আমরাই ওকে খুঁজতে যাব। তাতে অযথা আরও মাইনার হয়তো মারা পড়বে।’

গোড়ালির ওপর ঘুরে ভিতরে চলে গেল স্টকবার্ন। ডেপুটিরা নীরবে ওকে অনুসরণ করল। অবুঝ ছেলে দুটো ড্যাডির লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে দুলেদুলে কাঁদছে।

.

কার্বন ক্যানিয়নে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অল্প আলোয় ক্ষীণ ঝর্নাটা চিকচিক করছে। কাছেই ঝোপ আর পাথরের আড়ালে কাঠবিড়ালির দল মহা আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে।

কয়েকটা কেবিনের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। পানির অভাবে আজ দুপুরের পর মাইনাররা কেউ কাজে আসেনি। বাড়িতে বসে সবাই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবণ-চিন্তা করছে। প্রীচার নেই, ঝর্নাও শুকিয়ে গেছে, এখন ওরা কে কি করবে সেটাই প্রধান সমস্যা।

মারিয়া ফিশারের সমস্যা একটু ভিন্ন ধরনের। ওয়ানিতাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা দুপুরের খাওয়াও খেতে আসেনি। প্যাটের অনুমতি নিয়ে সেই যে বেরিয়েছে, আর ফেরেনি। খবর পেয়ে প্রতিবেশী যারা ওকে খুঁজতে বেরিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছে। কার্বন ক্যানিয়নে কোথাও নিতা নেই। দুশ্চিন্তায় কেঁদে-কেঁদে মারিয়ার চোখ লাল হয়ে গেছে। সারাদিন ওরও কিছু খাওয়া হয়নি—কেবল কেঁদেছে। যতক্ষণ দিনের আলো ছিল, আশার আলোও ছিল-কিন্তু লোকজন বিফল হয়ে খোঁজাখুঁজি ছেড়ে ফিরে আসার পর মিসেস ট্রেভার আর ওকে সামলাতে পারছে না।

‘এই চা-টুকু খেয়ে নাও, মারিয়া,’ বলল বিয়েট্রিস। ‘এতে স্যাসাফ্র্যাস আছে, একটু ভাল লাগবে।’

মারিয়া কাপটা নিল, কিন্তু কোন কথা বলল না।

‘মিছে দুশ্চিন্তায় শরীর খারাপ করে লাভ নেই-উপরওয়ালাই নিতাকে দেখবেন।’ সান্ত্বনা দেয়ার মত আর কোন কথা খুঁজে পেল না বিয়েট্রিস।

হঠাৎ সশব্দে কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। পাঁজাকোলা করে নিতাকে নিয়ে ঘরে ঢুকল প্রীচার।

মুহূর্তে মেয়েটার নোঙরা জামা আর ছেঁড়া ব্লাউজ দেখে নিয়ে স্ট্রেঞ্জারের দিকে তাকাল মারিয়া। ওর চোখে একটা অব্যক্ত প্রশ্ন।

‘ও ঠিকই আছে,’ আশ্বাস দিল লোকটা। ‘ক্ষতি হয়নি। শুধু একটু বিশ্রাম দরকার।’

নিতাকে নিয়ে সোজা পিছনের শোবার ঘরে ঢুকে গেল প্রীচার। এতক্ষণে সংবিৎ ফিরল মারিয়ার। একটা অস্ফুট কান্নার শব্দ করে পিছন পিছন ছুটল নিতার মা। মেয়ের গালে আদর করে হাত বুলিয়ে দিল ও।

ওয়ানিতাকে তার বিছানায় সাবধানে শুইয়ে বালিশটা মাথার নিচে ঠেলে দিল প্রীচার। শূন্যদৃষ্টিতে ছাদের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা। কথা বলছে না। ওর মনটা যেন আতঙ্ক আর বিভ্রান্তির মাঝে আর কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সতর্ক হাতে নিতার ছেঁড়া ব্লাউজটা দিয়েই ওর গা ঢেকে দিল স্ট্রেঞ্জার।

‘কি হয়েছিল?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করল মারিয়া। মেয়ের দিকেই চেয়ে রয়েছে ও।

‘টিম ডার্বির কাজ। মুখের ওপর থেকে এক গোছা চুল সরিয়ে দিল প্রীচার। ‘লোকটা-লোকটা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি।’

পরপর দ্রুত কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে বাস্তবে ফিরে এল নিতা। এবার স্ট্রেঞ্জারের দিকে চেয়ে ওকে চিনতে পারল।

‘সব ঠিক আছে, নিতা। কামরায় নিজের বিছানাতেই তুমি আছ। তোমার মা-ও এখানে আছে।’

ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। শব্দটা বুকের ভিতর থেকে এল-কৃতজ্ঞতার নির্ভেজাল স্বীকৃতি। সব ভুলে দুহাতে প্রীচারের গলা জড়িয়ে ধরল নিতা।

মেয়ের চোখের ভাষায় মারিয়ার কাছে সবকিছু দিনের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত, আর বিস্ময়কর। গত কয়েকদিন নিতার অদ্ভুত আচরণ, কম কথা বলা, এবং মাঝেমাঝে আনমনা হয়ে যাওয়ার কারণ এখন সে বুঝতে পারছে।

বলতে চাইছে, কিন্তু মারিয়ার মুখ দিয়ে কথা সরছে না। এই নতুন উপলব্ধি ওকে বোবা করে দিয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ নয়, আজ রাতে ওকে আরও কয়েকটা ধাক্কা খেতে হবে।

মেয়েকে নিরাপদে ফিরে পেয়ে আশ্বস্ত মারিয়া এবার প্রীচারের দিকে নজর দেয়ার অবসর পেল। সাদা কলার ছাড়া শার্ট, আর কোমরে ঝোলানো পিস্তলটা এতক্ষণে ওর চোখে পড়ল। লোকটার দিকে তাকাল-সেই একই পরিচিত মুখ, কিন্তু ভিন্ন চেহারা।

কেবিনের বাইরে পায়ের আওয়াজের সাথে প্যাটের উদ্বিগ্ন স্বর শোনা গেল।

‘প্রীচার! তুমি একটু বাইরে এসো!’

লম্বা লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুহূর্তের জন্যে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝল মেয়েটার মনে প্রচণ্ড ঝড় বইছে। বেরোবার জন্যে পা বাড়াল সে।

ওকে দেখার সাথে সাথেই হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করল মাইনার।

‘ট্রেভার সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তুমি নাকি ওয়ানিতাকে নিয়ে ফিরেছ? কেমন…?’ প্রীচারের কোমরে পিস্তল ঝুলতে দেখে মাঝপথেই প্যাটের কথা থেমে গেল।

‘একটু বিধ্বস্ত অবস্থা। কিন্তু বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

একটু ইতস্তত করল প্যাট। একদিনে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে যে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না। শেষে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমিই নিতাকে দেখতে যেতাম, কিন্তু এদিকে সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছে। স্পাইডার খুন হয়ে গেছে!’

দুজনে ক্রীকের ধারে রাখা ওয়্যাগনটার দিকে এগোল। ক্যানিয়নের সবাই জড়ো হয়েছে ওখানে। বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন স্পাইডারের লাশটার দিকে অনেকক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইল স্ট্রেঞ্জার। ওর চেহারায় ভাবের কোন পরিবর্তন এল না। দেখা শেষ হলে রক্ত মাখা তেরপল টেনে দেহটা ঢেকে দিল।

এডি স্মিথ কান্না চেপে রেখে যা ঘটেছে তার বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করছে। ‘তারপর সে আর তার লোকজন ড্যাডিকে গুলি করে মেরে ফেলল। বারবার গুলি ছুঁড়েই চলল। যেন আর থামবে না।’ শোকে ছেলেটার স্বর বুজে এল।

‘ওরা এমন কেন করল?’ ওর ভাই অনেকটা নিজের মনেই বিড়বিড় করল। উদাস ভাবে একদৃষ্টে তেরপলটার দিকে চেয়ে আছে টেডি। ‘ড্যাডি ওদের কি ক্ষতি করেছিল? জীবনে কারও কোন ক্ষতি সে করেনি। তবু কেন? কেন, কেন, কেন?’

সরল প্রাণ টেডির প্রশ্নের জবাব নীরব মাইনারদের জানা নেই। এর আগে পর্যন্ত ডার্বি ওদের ভয় দেখিয়েছে, মুরগী মেরেছে, জামা-কাপড় নোঙরা করেছে, কাজের জিনিসপত্র ভেঙেছে। ওদের জন্যে ক্ষতিকর হলেও ব্যাপারটা প্রায় খেলার পর্যায়েই ছিল। কিন্তু স্পাইডারের লাশ প্রমাণ দিচ্ছে লোকটা এখন আর খেলছে না। খেলা শেষ।

স্পাইডার স্মিথই ছিল কার্বন ক্যানিয়নের সবথেকে পুরোনো বাসিন্দা। কাউকে কখনও হিংসা করেনি লোকটা; বরং নতুন মাইনারদের সে সাদরে গ্রহণ করেছে-উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের মত অটল স্পাইডার আজ আর নেই।

‘ওটা সেই লোক, তাই না?’ ট্রেভার মুখ তুলে প্রীচারের দিকে চাইল। ‘ওই মার্শালের ব্যাপারেই তুমি আমাদের সাবধান করেছিলে না?’

লম্বা লোকটা ওয়্যাগন থেকে চোখ সরিয়ে ঝর্নার উপরের দিকে তাকাল। ‘হ্যাঁ। স্টকবার্ন। স্টকবার্ন আর তার ডেপুটির দল। আমি জানতাম জিম ডার্বি ওকেই ভাড়া করে আনাবে।’ ওয়্যাগনের ওপর স্পাইডারের লাশটার দিকে তাকাল সে। ‘কিন্তু আমি বুঝিনি ও আজই মদ খেয়ে সেলিব্রেট করতে শহরে যাবে।’

হঠাৎ এডি বলে উঠল, ‘কাল সকালে প্রীচারকে দেখা করতে বলেছে মার্শাল। না গেলে, লোকজন নিয়ে সে নিজেই খুঁজতে আসবে।’

সবাই চুপ করে আছে। ভুরু কুঁচকে বন্ধুর দিকে তাকাল প্যাট।

বুঝলাম না। তোমাকে যেতে বলেছে কেন? ক্লেইম তো আমাদের।’

সবার চোখ স্ট্রেঞ্জারের ওপর। সাদা কলার ছেড়ে কোমরে সিক্স গান ঝোলানোতে ওরা এখন প্রীচারকে একটু ভিন্ন চোখে দেখছে।

জেক হেণ্ডারসন প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি স্টকবার্নকে চেনো? সেই রাতে তুমি যখন আমাদের সাবধান করেছিলে তখন কিন্তু তাই মনে হয়েছিল। সত্যিই কি তাই?

প্রত্যেকে ওর জবাবের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল স্ট্রেঞ্জার।

‘ওই রাতে তোমরা যা স্থির করেছিল, তাতে সাহসের পরিচয় আছে। ভোটে তোমরা একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। সেটাই তোমাদের করতে হবে। তোমরা এখানে যা কিছু গড়েছ তা রক্ষা করতে হলে কেবল শুকনো কথায় কাজ হবে না, দরকার হলে তোমাদের লড়তে হবে। তোমরা কি করবে, সেটা তোমরাই বিচার করে বুঝে ঠিক করবে-ওখানে আমার বলার কিছু নেই।

‘স্পাইডার একা গিয়েছিল, সেটা ওর ভুল। সে মাতাল ছিল, সেটা আরও খারাপ। তোমাদের এখনই ভাল করে বুঝতে হবে, ডার্বির মত লোকজনের বিরুদ্ধে জিততে হলে তোমাদের একজোট হয়ে থাকতে হবে। নইলে টিকতে পারবে না। আগামীকাল যা-ই ঘটুক, একতা না থাকলে টাকার কাছেই তোমাদের আত্মা বিকিয়ে দিতে হবে।’ একে একে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে স্ট্রেঞ্জারের নজর তেরপলে ঢাকা লাশটার ওপর স্থির হলো।

‘লোকটার বুকের পাটা ছিল বটে। যোগ্য মর্যাদার সাথে ওকে কবর দেয়া উচিত।’

পিছন থেকে অনিশ্চিত একটা স্বর শোনা গেল।

‘আমাদের এখানে মানানসই কোন কবরখানা নেই, প্রীচার।’

‘এই ক্যানিয়নে আর কাউকে কবর দেয়া হয়নি?’

‘হয়েছে।’

‘মানুষই মাটিকে পবিত্র করে-মাটি মানুষকে নয়। এই জমির জন্যেই সে প্রাণ দিয়েছে, তাই এখানেই ওর কবর হওয়া উচিত।’ লম্বা লোকটা ঘুরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল।

‘প্রীচার?’ পিছন থেকে চট করে ডাকল ট্রেভার। থেমে ঘুরে দাঁড়াল স্ট্রেঞ্জার। ট্রেভারকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। ‘তুমি কাল সকালে শহরে যাচ্ছ তো?’

কতক্ষণ মাইনারের চোখের দিকে চেয়ে থেকে কোন জবাব না দিয়েই আবার ঘুরে চলে গেল প্রীচার। রেগে উঠে প্রতিবেশীর কাছে কৈফিয়ত দাবি করল প্যাট্রিক।

‘এমন কথা তুমি মুখে আনতে পারলে? ও এতক্ষণ যা বলল তার একটা কথাও কি তোমার কানে যায়নি?’ বাকি সবার দিকে তাকাল মাইনার। ‘তোমরাও কি শোনোনি প্রীচার কি বলেছে?’

কেউ ওর কথার জবাব দিল না। ওর চোখের দিকেও তাকাতে পারল না কেউ। একে একে সবাই বাড়ির পথ ধরল।

নিরাশ ভাবে মাথা নেড়ে নিজেই কবর খোঁড়ার জন্যে একটা কোদাল তুলে নিল প্যাট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *