নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ১১

এগারো

একা থাকতে চায় ও। জনসনের তীব্র প্রতিবাদ আর সবিনয় অনুরোধেও কাজ হলো না। অতিথি ব্যাখ্যা দিল আতিথেয়তার কোন ত্রুটি হয়নি। সে কেবল একটু একা থাকতে চায়।

তাই উলরিকের পরিত্যক্ত কেবিনেই তাকে থাকার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। টেবিলের ধারে বসে ৪৪ পিস্তলে একটা-একটা করে গুলি ভরছে। প্রত্যেকটা কার্তুজ চেম্বারে ঢুকাবার আগে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে। টেবিলের ওপর উস্কে দেয়া তেলের বাতিটা সোনালি আলো ছড়াচ্ছে। পিছনে প্যাট্রিকের দেয়া পটে কফি ফুটছে।

বারান্দায় কাঠের তক্তা ককিয়ে উঠল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া। এক মুহূর্ত স্ট্রেঞ্জারের দিকে চেয়ে থেকে, ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করল মেয়েটা।

আবার নিজের কাজে মন দিল প্রীচার। ওর হাতের পিস্তলটা বাতির কোমল আলোয় চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে নীল ইস্পাত থেকেই যেন নিজস্ব একটা আলো বেরোচ্ছে। মারিয়ার দিকে না চেয়েই সে কথা বলল।

‘ওয়ানিতা কেমন আছে?’

‘ও ঘুমাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ।’

‘বাড়তি ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। আমি সময় মত পৌঁছতে পেরেছিলাম, এতেই আমি খুশি।’

নীরবে দাঁড়িয়ে নিপুণ হাতে স্ট্রেঞ্জারের মারণাস্ত্র নাড়াচাড়া লক্ষ করছে মারিয়া। প্রথমে সুশৃঙ্খল ভাবে বাকি গুলিগুলো চেম্বারে ভরল। তারপর একটা পুরোনো নেকড়া দিয়ে আগেই পালিশ করা অস্ত্রটাকে আবার যত্ন করে মুছল। স্ট্রেঞ্জারকে এমন অভ্যস্ত হাতে পিস্তল সামলাতে দেখে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা।

‘প্রথম দিন প্যাটের মুখে শহরে কি করেছ শুনেই আমি বুঝেছিলাম তুমি একজন গানফাইটার।’

একটু হাসল প্রীচার। ‘তাই নাকি? কি করে বুঝলে?’

‘দক্ষ পিস্তলবাজ ছাড়া এদেশে তিনজনের বিরুদ্ধে কেউ একা লড়তে যায় না।’

‘তাই?’

‘ঠাট্টা কোরো না।’ নড করে পিস্তলটা দেখাল মারিয়া। ‘ওটা তাহলে কি?’

‘অনেকেরই পিস্তল আছে। তাই বলে ওরা সবাই কি গানম্যান?’

জবাব দেয়ার আগে কথাটা নিজের মনেই একটু ভেবে দেখল মারিয়া।

‘তুমি টিম ডার্বির কি অবস্থা করেছ তা আমি ওয়ানিতার কাছে শুনেছি। ওখানে, ওরই ক্যাম্পে, ওরই লোকজনের সামনে। গানফাইটার ছাড়া আর কেউ কি ওই কাজ করে পার পেত?

ওর কথার কোন জবাব দিল না স্ট্রেঞ্জার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কফি পটটা দেখিয়ে বলল, ‘বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। কফি খাবে?’

নড়ল না মারিয়া, কথাও বলল না। কেবিনের বন্ধ দরজার ফাঁক গলে বাতাস ঢুকছে ভিতরে।

‘কার্বনের লোকজন বলাবলি করছে, তুমি নাকি আগামীকাল মার্শাল আর তার ডেপুটিদের মোকাবিলা করতে শহরে যাচ্ছ। একা।’

টেবিলের ওপর রাখা খাপে পিস্তলটা ঢুকিয়ে রাখল স্ট্রেঞ্জার। ‘ওরা তাই বলছে?’

‘কথাটা কি সত্যি?’

‘হ্যাঁ।’

‘প্লীজ, যেয়ো না।’

কাঁধ উঁচাল সে। ‘এটা একটা পুরোনো দেনাপাওনার হিসাব। কার্বন ক্যানিয়নের সমস্যার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। শেষ বোঝাপড়ার সময় এসেছে এখন।’

‘কোন কিছুতেই কি তোমাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না?’

জবাব দিল না স্ট্রেঞ্জার। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মারিয়া অনেকটা নিজের মনেই কথা বলে চলল।

‘তোমার কাউকে কিছু না বলে এভাবে চলে যাওয়া আমাকে পুরোনো একটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আরও একজন এমনি কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছিল।

‘মাঝেমাঝে মানুষের জীবনে এই ধরনের ঘটনা ঘটা ভাল। এতে মানুষ কি হারাল তা বড় করে না দেখে তার কি আছে সেটা ভাল করে উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। আমারও চেতনা ফিরছে-ঠিক করেছি কল্পনার রাজ্যে আর বাস করব না, প্যাটকেই আমি বিয়ে করব।’

‘চমৎকার সিদ্ধান্ত,’ সায় দিল প্রীচার। ‘প্যাট খুব ভাল লোক। আদর্শ স্বামী হবে ও।’

‘তাতে আমারও সন্দেহ নেই। কিন্তু এর আগে আমি নিশ্চিত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।’

কাছে সরে এসে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে লম্বা লোকটার গালে একটা চুমো খেয়ে দরজার দিকে এগোল মারিয়া।

‘গুডবাই, স্ট্রেঞ্জার,’ দরজা খুলে কোমল স্বরে বলল ও।

‘গুডবাই, মারিয়া।’

.

খুব ভোরে উঠেছে স্ট্রেঞ্জার। আজ ওর অনেক কাজ। নষ্ট করার মত সময় মোটেও নেই। শেভ করে হাতমুখ ধুয়ে সামান্য কিছু নাস্তা সেরে নিল। পিস্তল আর কার্তুজ আর একবার চেক করে দেখল। বেরোবার আগে একটা কাজই কেবল বাকি।

বাক্সের ভিতরে কি আছে তা সে জানে। ডালা খুলে দেখল ছ-ইঞ্চি লম্বা লাল সিলিণ্ডারগুলো সুন্দর করে থরেথরে সাজিয়ে রাখা আছে। ডিনামাইট আর সলতে স্যাডলব্যাগে ভরে বেরিয়ে এল প্রীচার

ঘোড়ার পিঠে চেপে কেবিন আর কার্বন ক্যানিয়নের পরিবেশটা শেষবারের মত একবার দেখে নিয়ে রওনা হলো। আজ ওভারকোট পরেনি ও। ওটা বেডরোলের ভিতর ঘোড়ার পিছন দিকে বাঁধা আছে।

চমৎকার একটা সকাল। শীত তেমন নেই-বাতাসে কেবল শীতের সামান্য একটু পূর্বাভাস রয়েছে। হঠাৎ আলোর একটা ঝিলিক দেখে পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়েছিল ও-কিন্তু পরক্ষণেই ওর পেশীগুলো আবার ঢিলে হলো।

প্যাট্রিক ঘোড়ার পিঠে বেরিয়ে এসেছে কেবিনের আড়াল থেকে। কোলের ওপর রাখা পুরোনো শার্পস্ .৫৯-৯০ রাইফেলের নল থেকেই আলো প্রতিফলিত হয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে, কেবিনের আড়ালে স্ট্রেঞ্জারের প্রতীক্ষাতেই ছিল সে। দাঁত বের করে হাসছে মাইনার।

ওর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল স্ট্রেঞ্জার।

‘মর্নিঙ, জনসন। আজ খুব সকালে উঠেছ মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, একটু সকালেই উঠেছি।’ আকাশের দিকে চাইল লোকটা। ‘চমৎকার দিন। এমন একটা দিন বিছানায় শুয়ে নষ্ট না করে একটু বেড়ানো ভাল। দেখছি তোমারও একই ইচ্ছা।’

‘কিছু কাজ আছে আমার।’ বিশাল আকৃতির রাইফেলটার দিকে তাকিয়ে নড করল প্রীচার। ‘ভারি যন্ত্র। পেরেক ঠোকা বা মোষ শিকারের জন্যে ভাল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এদিকে হাজার মাইলের মধ্যে কোন মোষ নেই।’

‘কি শিকার করতে চাও তার ওপর নির্ভর করে। যাক, এমন দিনে বেড়ানো সঙ্গী ছাড়া ঠিক জমে না। চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’

বন্ধুকে খুঁটিয়ে লক্ষ করল লম্বা লোকটা। প্যাট নার্ভাস, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল।

‘আমি যেখানে যাচ্ছি, সেখানে কিন্তু মোষ নেই।’

‘আমি জানি।’ জিনের ওপর নড়েচড়ে বসল মাইনার। ভাবটা এমন যে ঠিক হয়ে বসাতেই যেন রাইফেলের নলটা প্রীচারের দিকে ফিরেছে। শক্তিশালী অস্ত্র, কিন্তু সাইজে বেঢপ। তাড়াহুড়া করে তাক করা কঠিন। তাছাড়া একবারে কেবল একটাই গুলি ছোঁড়া যায়।

‘ওই কামান দিয়েও তুমি সুবিধা করতে পারবে না।’

পিছু হটার পাত্র নয় ও। ‘সেটা আমি বিচার করব।’

একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে আছে প্রীচার। কিন্তু কোন লাভ হলো না। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্যাট চোখ সরিয়ে নিল না, নীরবে তাকিয়ে রইল। শেষে কাঁধ উঁচাল স্ট্রেঞ্জার।

‘যেমন তোমার খুশি।’

লাগামে ঝাঁকি দিয়ে আগে বাড়ল অতিথি। পাশাপাশি এগোচ্ছে জনসন। কেউ কথা বলছে না। প্রয়োজন নেই। যা বলার সব বলা হয়ে গেছে।

.

কোবল্ট ক্যানিয়নের তলায় সকালের রোদ পৌছেনি। বাঙ্কহাউসের দরজা এখনও বন্ধ। রান্নাঘরের চিমনি দিয়ে ধোঁয়ার সাথে ভাজা বেকন আর টাটকা রুটির গন্ধ বাতাসে ভাসছে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে।

একটা স্টেলার জে পাখি কোথাও কিচির-মিচির করছে। ভোরের আগমন বার্তা জানাচ্ছে। হঠাৎ আঁৎকে উঠে কর্কশ চিৎকার দিয়ে আকাশে উড়ল ও। একই সাথে মনিটর প্ল্যাটফর্মের গোড়ায় একটা কমলা রঙের আলো বিচ্ছুরিত হলো। পরক্ষণেই মাটি-কাঁপানো প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল। কাঠের প্ল্যাটফর্মটা ফেটে চৌচির হয়ে চারপাশে ছিটকে পড়ল। মনিটরটা শূন্যে উঠে কিছুক্ষণ যেন স্থির হয়ে রইল, তারপর আছড়ে পাথরের ওপর পড়ে ভেঙে চুরমার হলো।

পিছল আর অসমান জমির ওপর দিয়ে ছুটে বিস্ফোরণের ধুলোর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল প্রীচারের ঘোড়া। স্ট্রেঞ্জার তার দাঁতের ফাঁকে শক্ত করে কামড়ে ধরে আছে লম্বা একটা জ্বলন্ত চুরুট। ডান হাতে রয়েছে ছ-ইঞ্চি দুটো লাল ডিনামাইট। এবার চল্লিশ-ফুট সুইসের দিকে ঘোড়া ছুটাল সে। চুরুটের ছোঁয়ায় তারা-বাজির মত জ্বলে উঠল ডিনামাইটের ফিউজ। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময়ে ওগুলো সুইসের তলায় ছুঁড়ে ফেলল প্রীচার।

পরপর দুটো বিস্ফোরণের সাথে সুইসের টুকরোগুলো আকাশে উড়ল। পাথরে বাড়ি খেয়ে আগুনের ফুলকি তুলে নিচে পড়ল তোবড়ানো লোহা।

ওই সময়ে জনসনও বসে নেই। সেও কাজে ব্যস্ত। একটা জ্বলন্ত ডাইনামাইট স্টিক যন্ত্রপাতি রাখার শেডের পাশে ফেলে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটাল। উড়ে যাওয়ার ভয়ে এক হাতে নিজের হ্যাটটা ধরে রেখেছে। শো উপভোগ করার জন্যে অপেক্ষা করতে মোটেও রাজি নয় প্যাট।

বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনি ক্যানিয়নের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরছে। যন্ত্রপাতির শেডটা ম্যাচ বাক্সের মত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পেরেক, গাঁইতি, বেলচা আর কাঠের টুকরো চারপাশে ছিটিয়ে পড়ল।

দড়াম করে বাঙ্কহাউসের দরজা খুলে গেল। দরজার মুখে বিশাল আকারের বাম্বা এসে দাঁড়াল। মনিটর, সুইস আর যন্ত্রপাতির শেডের অবস্থা দেখে ওর চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো। যে এই তাণ্ডবলীলা ঘটিয়েছে তাকে মাত্র দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর বিস্ময় আরও বাড়ল।

স্বয়ং প্রীচার। সহজ ভঙ্গিতে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে লম্বা লোকটা। ওর হাতে একটা ডিনামাইটের জ্বলন্ত সলতে ঝলকাচ্ছে। কিন্তু ওটা বাঙ্কহাউসের দিকে ছুঁড়ে না দিয়ে শক্ত করে ধরে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে বাম্বার দিকে তাকাল।

বাম্বা বুদ্ধিমান না হলেও সে হাঁদা নয়। মুহূর্তে বুঝে নিল প্রীচার কি বোঝাতে চাইছে। ঘাড় ফিরিয়ে চিৎকার করে বাঙ্কহাউসের সবাইকে সাবধান করল ও। এক সেকেণ্ডে ফাঁকা হয়ে গেল ওটা। ঘুমের চোখে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে লোকগুলো কাভার নিতে ঝাঁপ দিল।

শেষ লোকটা বেরিয়ে যাবার পর প্রীচার ডিনামাইটটা ভিতরে ছুঁড়ে মারল। ফিউজের কেবল মাত্র আধইঞ্চি বাকি ছিল। দ্রুত ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ছুটল স্ট্রেঞ্জার। বাম্বার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে তর্জনী তুলে হ্যাট ছুঁয়ে ওকে স্যালিউট জানাল প্রীচার। জবাবে দাঁত বের করে হেসে মাটিতে মাথা গুঁজল সে।

সেকেণ্ড তিনেক পরে বিস্ফোরণ ঘটল। কাঠ, জামা-কাপড়, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব আকাশের দিকে উড়ল। কিছু একটা জিনিস দৈত্যের পিঠে বাড়ি খেয়ে ওর মুখের কাছেই পড়ল। চোখ খুলে দেখল ওটা শেভ করার তোবড়ানো একটা টিনের বাটি। কেন যেন ওর মনে হলো কাভার ছেড়ে ওঠার সময় এখনও হয়নি।

সিদ্ধান্তটা ভাল নিয়েছে বাম্বা। কারণ কোবল্ট ক্যানিয়ন ক্যাম্পে প্যাট আর প্রীচারের কাজ তখনও শেষ হয়নি। একের পর এক আরও অনেকগুলো বিস্ফোরণ ঘটল। বেছে-বেছে যা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল, সবই ধ্বংস করল ওরা। সবগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামল না। ওখানে এখন একটা কাঠামোও আর দাঁড়িয়ে নেই। ধুলোয় ভরে উঠেছে ক্যানিয়নের বাতাস।

কাজ শেষ করে ধুলো-বালির ভিতর দিয়ে দক্ষিণ ঢালের মাথায় উঠে এল ওরা। ওখানে থেমে নিচের দিকে তাকিয়ে নিজেদের কীর্তি দেখল। বাঙ্কহাউসের ধ্বংসাবশেষে আগুনের ছোট ছোট শিখা খেলে বেড়াচ্ছে। আজ আর ওদের রান্নাঘরে কোন নাশতা পরিবেশন করা হবে না। এতক্ষণে লোকজনকে নড়াচড়া করতে দেখা যাচ্ছে। পুরোপুরি ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের জিনিসপত্র বাঁচাবার চেষ্টা করছে ওরা। ওদের কারও মধ্যে পালটা আক্রমণ করার মনোভাব দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া করালের মুখ খুলে দিয়েছিল প্রীচার। বিস্ফোরণের শব্দে ঘোড়াগুলো ভয়ে ছুটে পালিয়েছে

বিদায় জানাতে চুরুটে সলতে ঠেকিয়ে একটা ডিনামাইট ধরাল প্রীচার। নিচে ছুঁড়ে দেয়ার সময়ে হাত থেকে ফস্কে জ্বলন্ত ডিনামাইট প্যাটের ঘোড়ার তলায় গিয়ে পড়ল।

‘আহ্ হা,’ দুঃখ প্রকাশ করল লম্বা লোকটা।

আতঙ্কগ্রস্ত প্যাট লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ডিনামাইটটা তুলে নিচের দিকে ছুঁড়ে দিল। আবার বিস্ফোরণের শব্দে লোকজন কাভার নেয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বিস্ফোরকটা ফাটার আগেই একটু ঝুঁকে প্যাটের ঘোড়ার পাছায় জোরে একটা চাপড় বসাল প্রীচার। আরোহী বিহীন মেয়ার আচমকা চাপড়ের সাথে নিচে থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দিশেহারার মত ছুটে পালাল। অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল জনসন।

‘ব্যাপারটা কি?’ কৈফিয়ত দাবি করল সে।

লম্বা লোকটা হেসে নিজের ঘোড়া নিয়ে রওনা হলো। ‘তুমি ভাল লোক, প্যাট্রিক। তোমার কপাল দেখে হিংসে হয়। মারিয়া আর ওয়ানিতাকে নিয়ে তুমি সুখে থাকো।’

‘এই, এক মিনিট! তুমি এভাবে-!’

কিন্তু তাই করল স্ট্রেঞ্জার। পরবর্তী ঢাল বেয়ে দ্রুতবেগে শহরের দিকে ছুটে চলেছে ওর ঘোড়া। অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইল প্যাট।

পরিস্থিতিটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখার চেষ্টা করছে ও। শেষ পর্যন্ত ঘোড়াটা থামবে। কিন্তু থামার পর দিব্যি আনন্দে তাজা ঘাস খাওয়া শুরু করবে। ঘোড়া খুঁজে বের করে শহরে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তখন আর ওর সাহায্য কারও কাজে আসবে না।

ওকে সম্পূর্ণ বোকা বানিয়েছে প্রীচার। বুঝতে পারছে লোকটা কেন এই কাজ করেছে। ওর বিপদ ঘটতে পারে মনে করে স্ট্রেঞ্জার শুরু থেকেই ওকে সঙ্গে নিতে চায়নি। বন্ধুর আচরণে প্রথমে ভীষণ রেগে গেলেও কারণ বুঝতে পেরে ওর মনের ভাব বদলাল। মুখ তুলে দূরে ঢালের মাথায় ঘোড়ার পিঠে স্ট্রেঞ্জারকে অদৃশ্য হতে দেখে হাত নাড়ল প্যাট।

‘বিদায়-প্রীচার।’ এবার ঘুরে তার মেয়ারটা যেদিকে গেছে সেদিকে হাঁটতে শুরু করল।

.

কেবিনের সামনে সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে। ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়াতে- আঁচড়াতে নিজের কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এল ওয়ানিতা। আজ সকালে সে চার বার চুল ধুয়েছে, কিন্তু তবু নিজেকে ওর পুরোপুরি কলুষমুক্ত মনে হচ্ছে না।

নাস্তা তৈরির কাজে ব্যস্ত মারিয়া। তাই কামরায় মেয়ের উপস্থিতি একটু দেরিতে টের পেল।

‘আমি ভেবেছিলাম তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ।’ মেয়ের সাজ-সরঞ্জাম লক্ষ করে সে আবার বলল, ‘সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। বাইরে কোথাও যাচ্ছ?’

‘না, বাইরে কোথাও যাচ্ছি না,’ নরম স্বরে জবাব দিল নিতা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চুল ব্রাশ করছে ও। ‘প্রীচার চলে গেছে, তাই না?’

মেয়ের কথায় কিছুটা অবাক হলো মারিয়া।

‘হ্যাঁ, চলে গেছে।’

‘ওকে বিদায় জানিয়েছ তুমি?’

‘হ্যাঁ। তোমাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্যে গতরাতে আমি ওকে ধন্যবাদ জানাতে গেছিলাম। তখনই বিদায় জানিয়েছি।

মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। গম্ভীর চেহারায় ওকে এখন পরিণত বয়স্ক দেখাচ্ছে।

‘আমি বিদায় দিতে পারলাম না। খুব খারাপ লাগছে।’

দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল নিতা। ওদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মন দিল মারিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *