নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ১২

বারো

চমৎকার রোদ-ঝলমলে উজ্জ্বল একটা দিন। ডার্বির ফোরম্যান আয়েশ করে দালানের সামনের বারান্দায় বসে দিনটাকে উপভোগ করছে। বর্তমানে সবকিছু ওর পছন্দ মত চলছে। ওখানে জেগু আর টাইসনের সাথে আরও দুজন কর্মচারী রয়েছে। মনের আনন্দে ওদের সাথে আড্ডা মারছে ম্যাগিল। গত সপ্তাহের ঝামেলা নিয়ে এখন আর কোন চিন্তা নেই ওর। স্টকবার্ন আর তার ডেপুটিরা সব সামলাবে।

ম্যাগিলকে স্বয়ং ডার্বি আশ্বাস দিয়েছে, সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই কার্বন ক্যানিয়নে কাজ শুরু হবে। তখন লাভের সাথে তার বোনাসও বাড়বে।

শহরের কিছু লোকজন নিজেদের কাজে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করছে। বেশিরভাগ লোকই এখন কাজে ব্যস্ত। ম্যাগিল আর তার সঙ্গীরাও কিছুক্ষণ পর কাজে রওনা হবে। ওয়্যাগন বোঝাই করে সাপ্লাই নিয়ে ক্যাম্পে যাবে ওরা।

হঠাৎ চোখ কুঁচকে দূরে তাকাল ম্যাগিল। তারপর চোখ মুছে আবার তাকাল। উজ্জ্বল আলোয় ধুলোবালির মধ্যে সে কি ভুল দেখছে? কিন্তু কাঠামোটা খুব পরিষ্কার আর স্পষ্ট।

‘আশ্চর্য ব্যাপার,’ বিড়বিড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ফোরম্যান। এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ বুঝতে না পেরে সবাই অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চাইল। পরে একে একে সবাই দেখল ম্যাগিল কেন উত্তেজিত হয়েছে।

রাস্তার শেষ মাথায় মোড় নিয়ে শহরে ঢুকছে একজন অশ্বারোহী। মাপা ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে ঘোড়াটা। আরোহীর কোন তাড়া নেই।

এর পরে শহরের নাপিত ওকে দেখল। জানালার পাশ দিয়ে লোকটাকে যেতে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। পোস্টমিস্ট্রেস ওকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে দরজা বন্ধ করল।

কেবল মৃতের সৎকারক টমাসের মধ্যে বিশেষ কোন চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল না। তবে জানালার খড়খড়ি বন্ধ করতে সে ভুলল না। জানালার রঙিন কাঁচ দুষ্প্রাপ্য।

খবরটা পেয়ে জিম ডার্বি নীরবে হাত নেড়ে সংবাদদাতাকে বিদায় করল। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। স্টকবার্ন এসে দাঁড়াল ওর পাশে। একক ঘোড়সওয়ারের এগিয়ে আসা দেখছে।

‘ওই যে,’ উত্তেজিত স্বরে বলল জিম, ‘ওকেই এখানকার সবাই প্রীচার বলে জানে।’

মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে লম্বা লোকটাকে লক্ষ করছে মার্শাল।

‘হুম্।’

‘আগে কখনও ওকে দেখেছ?’

ঝুঁকে একটু নিচু হয়ে হ্যাট ব্রিমের তলায় ঢাকা মুখটা দেখার চেষ্টা করল মার্শাল। ‘এখান থেকে দেখে ঠিক বুঝতে পারছি না।’

জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে ওরা দেখল আরোহীর ঘোড়াটা ধীর কদমে এগিয়ে ব্ল্যাকেনশিপের দোকানের সামনে থামল। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিচে নেমে ঘোড়াটাকে হিচ-রেইলের সাথে বেঁধে দোকানে ঢুকল লোকটা। ডার্বির বারান্দা থেকে পাঁচ-জোড়া চোখ যে বদ মতলব নিয়ে ওকে লক্ষ করছে তা দেখেও দেখল না।

ভিতরে কোন খদ্দের নেই দেখে আশ্বস্ত হলো স্ট্রেঞ্জার। পিছন দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে লেজার খাতা দেখছে জুড।

‘মর্নিঙ, মিস্টার ব্ল্যাকেনশিপ।’ অভিবাদন জানাল বটে, কিন্তু লোকটার দিকে তাকাল না স্ট্রেঞ্জার। সোজা উলটো দিকের খাবার কাউন্টারে গিয়ে হাজির হলো। অভিবাদনের জবাব দিল না জুড, কেবল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।

ব্যবসায়ী জানে দোকানে কে ঢুকেছে। স্ট্রেঞ্জার মাত্র কয়েকদিন আগেই তার দোকানে প্রথম এসেছিল। সেদিনের ঘটনা ওর স্পষ্ট মনে আছে। এরপর এই এলাকায় অনেক কিছু ঘটে গেছে। এবং সবগুলোর সাথেই ওই লোকটা কোন না কোনভাবে জড়িত। এখন কি ঘটবে সেটাই ভাবছে ও।

লাঞ্চ কাউন্টারে একটা টুলে বসে ওপাশের মহিলাকে সুন্দর একটা হাসি উপহার দিল প্রীচার।

‘মর্নিঙ, ম্যাম।’

‘মর্নিঙ, বাছা। কফি?’ স্ট্রেঞ্জারকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে ফুটন্ত কেতলি থেকে কফি ঢেলে কাপটা এগিয়ে দিল কার্লা।

‘ধন্যবাদ।’ কফিতে চুমুক দিল সে। অত্যন্ত গরম, এবং চমৎকার স্বাদ। তরল পদার্থটা গলা পুড়িয়ে নিচে নেমে দারুণ একটা অনুভূতি জাগাল। কাপের উপর দিয়ে আড়চোখে বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে অর্ধেক কাপ কফি কাউন্টারে নামিয়ে রাখল ও।

‘চমৎকার দিন,’ আলাপ জমাবার চেষ্টা করল কার্লা। কোন জবাব না পেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। দেখল ডার্বির বারান্দায় পাঁচজন লোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছে। মাঝে মাঝে আঙুল তুলে দোকানটার দিকেই নির্দেশ করছে।

‘এমন সুন্দর একটা দিন নষ্ট হতে চলেছে দেখে খারাপ লাগছে।’ কার্লার স্বরে উদ্বেগ প্রকাশ পেল।

‘মাঝে মাঝে এটা এড়ানো যায় না।’

বিষণ্নমুখে মাথা ঝাঁকাল মহিলা। ‘আরও কফি দেব?’

কাপটা বাড়িয়ে দিল প্রীচার। ‘ধন্যবাদ।’ কফিতে চুমুক দিয়ে কার্লার দিকে তাকাল লোকটা। ‘এমন সুন্দর দিনে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে একটু অবসর নিলেই হয়তো ভাল হবে।’

আবার মাথা ঝাঁকিয়ে এপ্রোনে হাত মুছল কার্লা। তারপর দ্রুত হাতে সব গুছিয়ে রাখতে শুরু করল।

পাঁচজনের মধ্যে একজন চেয়ার ছেড়ে উঠে রাস্তায় নেমে এগোল। লোকটা ঝুঁকে মাথা নিচু করে এঁকেবেঁকে ছুটছে। সঙ্গীরা উৎকণ্ঠা নিয়ে ওর অগ্রগতি লক্ষ করছে। রাস্তা পার হয়ে কাছে এসে জেগু সন্তর্পণে মাথা তুলে দোকানের ভিতর উঁকি দিল। যা দেখল তাতে বিস্ময়ে ওর চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো।

আবার মাথা নিচু করে যেভাবে এসেছিল একই ভঙ্গিতে বন্ধুদের কাছে ফিরে গেল।

‘কি করছে ও?’ জানতে চাইল ম্যাগিল।

‘হ্যাঁ, কোথায় আছে লোকটা?’ টাইসন প্রশ্ন করল।

হতবুদ্ধি জেগু ফিসফিস করে বলল, ‘বললে বিশ্বাস করবে না- হারামজাদা ওখানে বসে দিব্যি কফি গিলছে। তাও আবার দরজার দিকে পিঠ!’

পাঁচজন নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। ম্যাগিল ঠোঁট চেটে ওপাশের দোকানটার দিকে তাকাল। দুরভিসন্ধি খেলছে ওর মাথায়।

‘তোমরা কি বলো? আমরা যাব?’ সঙ্গীদের বাজিয়ে দেখতে চাইল ফোরম্যান।

‘বস্ নিশ্চয় খুশি হবে,’ মন্তব্য করল টাইসন।

‘হ্যাঁ,’ আরেকজন বলে উঠল, ‘স্যাকরেমেন্টোতে আমাদের এক সপ্তাহ ছুটি কাটাবার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।

‘দুই সপ্তাহও হতে পারে,’ জেগুর চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠল। ‘বেতন-সহ।’

‘তাহলে আর আমরা খামোকা বসে আছি কেন, ম্যাগিল?’ উস্কাল টাইসন। ভাবছে ম্যাগিল। স্টোরের দিক থেকে কোন নড়াচড়ার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সে জানে প্রীচার সারাদিন ওখানে বসে কফি খাবে না। লোকজন ছুটি আর বোনাসের কথা যা বলেছে তা পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত। ডার্বি শক্ত লোক বটে, তবে ভাল কাজ দেখালে পুরস্কৃত করতে কার্পণ্য করে না।

জিম ডার্বি নিজেই না ওকে একবার বলেছিল, যারা সক্রিয় হয়ে কাজে নামে, তারাই কেবল জীবনে উন্নতি করে?

লোভনীয় প্রস্তাব। এমন একটা সুন্দর সুযোগ নাকের ডগা দিয়ে ফস্কে যেতে দেয়া যায় না।

‘আমাদের কোন মার্শালের সাহায্য লাগে না, লাগে?’

সবাই একমত। চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল পাঁচজন। হাত নামিয়ে নিজের পিস্তল ছুঁয়ে নিশ্চিত হলো ওটা কোথায় আছে।

কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করার জন্যে একে একে রাস্তা পার হলো ওরা। প্রত্যেকেই মাথা নিচু করে দ্রুত ছুটে পেরিয়েছে। ব্ল্যাকেনশিপের দোকানটার সামনে আবার সবাই একত্রিত হলো। পিস্তল হাতে প্রস্তুত। প্রত্যেকে তৈরি আছে কিনা চেক করে নিয়ে শূন্যে তোলা বাম হাতটা এক ঝটকায় নিচে নামিয়ে সিগন্যাল দিল ম্যাগিল।

একসাথে ঝাঁপিয়ে দোকানে ঢুকল ওরা। সবক’টা পিস্তল গজাচ্ছে। বুলেটের আঘাতে ক্যাণ্ডির বয়মগুলো চুরমার হলো। ভাঙা কাঁচ আর ক্যাণ্ডি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কার্লার খাবার জিনিসপত্র, কফি, স্যূপ, দুধ ছিটকে দেয়ালে দাগ ফেলল। হাঁড়ি-পাতিল, মগ, সবকিছু ঝাঁঝরা হলো। সিরকায় ডুবানো আচারও রক্ষা পেল না-ব্যারেল ফেটে চৌচির হয়ে মেঝে ভেসে গেল।

গোলাগুলির শব্দে ডার্বি আর স্টকবার্ন আবার জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অবিরাম গুলি বর্ষণ চলছে। ডার্বির চেহারা আশ্বস্ত।

‘ভালই হয়েছে, মার্শাল। প্রীচারকে নিয়ে এখন আর তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। মনে হচ্ছে ম্যাগিলই তার লোকজন নিয়ে তোমার কাজটা শেষ করে ফেলেছে। ও যে নিজেই এটা সামলাতে পারবে তা আমি ভাবতে পারিনি। যাক, তবু তোমার ফী তুমি পাবে।’

স্টকবার্নের মুখের ভাব একটুও বদলাল না। ডার্বির কথা ওর কানে গেছে বলে মনে হলো না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকেই চেয়ে আছে ও।

‘দেখা যাবে,’ শেষ পর্যন্ত বিড়বিড় করল মার্শাল। ‘ঘটনা এখনও শেষ হয়নি।’

সদয় ভাবে হাসল ডার্বি। ‘ম্যাগিল একটু বোকা হলেও পাকা কাজই করে। এই জন্যেই তাকে আমি ফোরম্যান করেছি।’

কোন মন্তব্য করল না স্টকবার্ন।

ওদিকে স্টোরের ভিতর ম্যাগিল আর তার লোকজনের টার্গেট আর গুলি, দুটোই ফুরিয়ে আসছে। গোলা-বারুদের ধোঁয়া ভেদ করে কিছু দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কাউকে আদেশ দিতে হলো না; ওরা নিজে থেকেই শেষে – গুলি ছোড়া বন্ধ করল। ধীরে ধোঁয়া কেটে যাচ্ছে। এখন ভাঙা কাঁচের টুকরো, আর বিভিন্ন রঙের তরল মিশ্রণে সৃষ্টি পিছল পদার্থ দেখা যাচ্ছে মেঝের ওপর।

সবই দেখতে পাচ্ছে ওরা, কেবল প্রীচারের লাশটাই দেখা যাচ্ছে না।

বাতাসে হাত নেড়ে ধোঁয়া সরাবার চেষ্টা করছে জেগু আর টাইসন। ম্যাগিল একটু এগিয়ে সতর্ক ভাবে কাউণ্টারের পিছনে উঁকি দিল। লোকটার লাশ এখানেই কোথাও আছে, হয়তো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে কোনকিছুর পিছনে উলটে পড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে না। মিনিট খানেকের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে প্রীচারকে।

ঠিকই পাওয়া গেল।

‘তোমরা কাউকে খুঁজছ?’ শান্ত স্বরে কেউ প্রশ্ন করল।

সবাই একসাথে ঘুরে দাঁড়াল। ভয় আর বিস্ময়ে ওদের চোখ বিস্ফারিত। গুলি করার জন্যে পিস্তল তুলল ওরা।

দোকানের ভিতর আবার গোলাগুলি শুরু হলো। ডার্বি আর স্টকবার্ন কান পেতে শুনল। হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে আওয়াজটা উঠেছে। কিন্তু এটা আগের মত দীর্ঘস্থায়ী হলো না। যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল। শেষ একটা গুলির শব্দ-তারপর সব নীরব।

কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল। স্টোর থেকে একজন বেরিয়ে এল। লোকটা একবার ক্ষণিকের জন্যে ডার্বির দালানটার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত ধীর পায়ে এগোল। কোন তাড়া নেই ওর।

জিমের চেষ্টার্জিত ভালমানুষির মুখোশ খুলে গেল। লম্বা লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে চোয়াল ঝুলে হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখ।

‘যীসাস্! লোকটা এখন আবার কি করছে?’

ওরা তাকিয়ে আছে। দেখল স্ট্রেঞ্জার ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামল। ডার্বি ভেবেছিল লোকটা রাস্তার এপারে আসছে। কিন্তু ঠিক মাঝখানে থেমে পিস্তলে গুলি ভরতে শুরু করল ও।

স্টকবার্নের চেহারা অত্যন্ত গম্ভীর। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পর্দাটা ছেড়ে দিল সে।

‘ও আমাদের বেরিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।’

‘লোকটার মাথা খারাপ!’ ডার্বি চোখের সামনে যা দেখছে তা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। স্টকবার্নের ব্যাখ্যাও ওর কাছে অবাস্তব মনে হচ্ছে। ‘লোকটা সত্যিই বদ্ধ পাগল, তাই না?’ জানালার থেকে ঘুরে দাঁড়াল সে।

মার্শাল কামরায় নেই। অফিসের দরজাটা খোলা। এক মুহূর্ত ভেবে কপাট লাগিয়ে আবার জানালার কাছে ফিরে গেল ডার্বি। দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই, বিন্দুমাত্র না। ডেপুটিদের নিয়ে স্টকবার্নই কাজটা শেষ করবে।

কিন্তু দুশ্চিন্তায় না পড়লে হঠাৎ সে এভাবে ঘামতে শুরু করেছে কেন? উন্মাদ-বোকার হদ্দ ছিল ওই ম্যাগিল। মাথায় বুদ্ধি বলতে কিচ্ছু ছিল না। ভালমত প্ল্যান না করেই কাজে নেমেছিল। পেশাদার লোককেই কাজটা করতে দেয়া উচিত ছিল ওর। আনাড়ি লোক কাজে নামলে এমনই হয়।

না, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।

ডার্বির দালানের দরজাটা খুলে গেল। ডেপুটির দল বেরিয়ে এসে ছক বাঁধা নিয়মে দাঁড়াল। তিনজন দরজার ডাইনে, তিনজন বাঁয়ে। সবার শেষে বেরোল স্টকবার্ন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে রাস্তার দিকে চাইল সে।

স্টকবার্নের আবির্ভাবের সাথেই স্ট্রেঞ্জারের পিস্তলে গুলি ভরা শেষ হলো। সিলিণ্ডার বন্ধ করে .৪৪ পিস্তলটা খাপে ভরল ও। একা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লোকটা। নির্লিপ্ত চেহারা। কোন রকম উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছে না। স্টকবার্ন, আর তার ডেপুটিদের সাথে ওর দূরত্ব বেশি নয়। সূর্যটা মাথার উপরে-তাই মাটিতে ছায়া পড়ছে না।

স্থির দাঁড়িয়ে আছে স্ট্রেঞ্জার।

স্টকবার্নের ডেপুটিরা তাদের টার্গেটকে ঠাণ্ডা চোখে যাচাই করছে। রাস্তার মাঝখানে আড়াল নেই। লোকটা কোন কিছুর পিছনে লুকোবে, বা পালাবে, তার উপায় নেই। প্রতিপক্ষকে অতি সাহসী বা বীর ভাবছে না। ওদের কাছে এটা নিছক আর একটা কাজ, যা এখনই শেষ করা দরকার।

বারান্দা থেকে রাস্তায় নামল ওরা। পুরো রাস্তা জুড়ে দাঁড়াল। তারপর স্টকবার্নের সঙ্কেত পেয়ে লোকগুলো আগে বাড়ল।

মার্শালের আঙুল লাফাচ্ছে। হাত পিস্তলের হাতলটার কাছে। একদৃষ্টে শিকারের দিকে চেয়ে আছে ও। প্রীচারও এগোতে শুরু করল। ওদের মাঝে দূরত্ব কমে আসছে।

তেইশ গজের মাথায় ডান পাশের ডেপুটি পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল। প্রীচারের হাতও সচল হলো। স্টকবার্ন আর বাকি ডেপুটিরাও পিস্তল বের করে ফেলেছে। আটটা পিস্তল যত দ্রুত সম্ভব গুলি ছুঁড়ে চলল।

আটচল্লিশটা গুলি খরচ হওয়ার পর শব্দ থামল। ধোঁয়া কেটে যাচ্ছে।

স্টকবার্নের তিনজন লোক মরে পড়ে আছে মাটিতে। ওদের উলটো পাশে ধুলোর ওপর নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে চওড়া ব্রিমের একটা কালো হ্যাট। ওতে দুটো ফুটো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওটার মালিককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

একটা সবজান্তা হাসি ফুটে উঠেছে মার্শালের মুখে। লাশ তিনটার দিকে সে একবার চেয়েও দেখল না। ওর চোখ রাস্তার দুপাশে দালানগুলোর ওপর ঘোরাফেরা করছে। হাত দ্রুত রিলোড করায় ব্যস্ত।

‘ছড়িয়ে পড়ো,’ আদেশ দিল স্টকবার্ন। ‘ওকে খুঁজে বের করতে হবে।’

দৌড়ে এগোল তিনজন ডেপুটি। ছুটতে ছুটতেই পিস্তলে গুলি ভরছে।

একটা অদ্ভুত ধরনের নীরবতা বিরাজ করছে শহরে। রাস্তায় কিছুই নড়ছে না। বাড়ির ভিতরেও যেন নড়াচড়া বন্ধ। শহরবাসীরা সবাই বেডরূমে গিয়ে ঢুকেছে। জোরে শ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। ঘাপটি মেরে বসে আছে ওরা। চাইছে বাইরে যা ঘটছে তা আপনা-আপনি শেষ হয়ে যাক।

একজন ডেপুটি ছুটে মাটিতে পড়া হ্যাটটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওখান থেকে তীক্ষ্ণ নজরে ডাইনে-বাঁয়ে দেখে দুটো বাড়ির ফাঁকে সরু গলিটার ভিতর ঢুকল। সরে পড়ার ওটাই সবথেকে যুক্তিসঙ্গত রাস্তা। পিস্তল হাতে প্রত্যেকটা দরজা জানালা চেক করছে ও। সামান্য নড়াচড়া দেখলেই গুলি করার জন্যে প্রস্তুত।

ডান দিকে একটা আধ-খোলা দরজার ওপর ওর চোখ আটকে গেল। ডেপুটির চোখের সামনেই দরজাটা কব্জার ওপর সামান্য নড়ল, যেন বাতাসে নড়েছে। কিন্তু দুপুর বেলার বাতাস একেবারে স্তব্ধ।

ডেপুটির চেহারার কোন পরিবর্তন হলো না। একটা লম্বা লাফে বামে সরে কুঁজো হয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল সে। দরজায় বুক সমান উঁচুতে ছয়টা ফুটো হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি পিস্তলে গুলি ভরে দরজার দিকে এগোল ডেপুটি। পা দিয়ে ঠেলে ওটা খুলে অল্পক্ষণ কান পেতে শুনে ভিতরে ঢুকল।

একক একটা গুলির শব্দ ওকে অভ্যর্থনা জানাল। অত্যন্ত আশ্চর্য হওয়ার ভাব ফুটে উঠল ওর চেহারায়। কপালে একটা গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। উলটে চিত হয়ে বাইরে পড়ল সে।

পরপর ছয়টা গুলির পর একটা গুলির শব্দ স্টকবার্নের কানে পৌঁছেচে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ডান দিকে চেয়ে সামনে এগোল ও।

ডেপুটি কোবল্ড ছুটতে ছুটতে পিছনের মাথা দিয়ে গলিতে ঢুকল। সহকর্মীর লাশটা দেখে থমকে দাড়াল। চট করে একটা বাড়ির আড়াল নিয়ে খুব সাবধানে উঁকি দিল।

অল্প দূরে রাস্তার অন্যপাশে একটা বিশাল আস্তাবল। ওটার পিছনের দরজাটা খোলা। সময় মতই উঁকি দিয়েছে ডেপুটি। একটা লম্বা আকৃতির লোককে ওই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখল। লোকটা পিছন ফিরে তাকায়নি, তাই ওকে দেখতে পায়নি। খুশিতে নিষ্ঠুর একটা হাসি ফুটল কোবল্ডের মুখে-নিঃশব্দে আস্তাবলের দিকে ছুটল সে।

দরজার কাছে পৌঁছে মাথা গলিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়েই আবার মাথাটা সরিয়ে নিল। ক্ষণিকের জন্যে এই দেখা দেয়ায় ওদিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। বাইরের দেয়ালে পিঠ সেঁটে ভিতরটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল।

ছাদের ফাঁকগুলো দিয়ে কয়েক চিলতে রোদ ঢুকছে। ঘোড়াগুলো নিজেদের স্টলে তৃপ্তির সাথে খাবার চিবাচ্ছে। তিন দেয়ালে ঘেরা একটা জায়গায় ঘোড়ার জিন আর অন্যান্য জিনিসপত্র রাখা আছে। ওখানে একটা জিনিস ডেপুটির দৃষ্টি অ কর্ষণ করল। মাথা নিচু রেখে ওদিকে ছুটল। লুকোবার জায়গাগুলোর ওপর সতর্ক নজর রেখেছে ও।

শেলফের ওপর একটা শটগান রাখা আছে। পুরোনো হলেও নিয়মিত যত্ন নেয়া হয় বোঝা যাচ্ছে। ভাল ভাবে তেল মাখা থাকায় গুলি ভরার জন্যে খোলার সময়ে কোন শব্দ হলো না। গুলি ভরে বন্ধ করে দুটো হ্যামারই একসাথে টেনে ওটাকে তৈরি রাখল। বাড়তি গুলিও সাথে নিয়েছে ও।

তিন দেয়ালের কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এল কোবল্ড। সম্ভাব্য লুকোবার জায়গাগুলো শটগানের গুলিতে একে-একে ছিন্নভিন্ন করছে লোকটা। প্রচণ্ড শব্দে ভয় পেয়ে ঘোড়াগুলোর চোখের সাদা অংশ বেরিয়ে এসেছে। অস্থির ভাবে মাটিতে পা ঠুকছে ওরা। দ্রুত হাতে গুলি ভরে ফায়ার করছে ডেপুটি। খড়ের গাদা, চিলেকোঠা, খালি স্টল, কিছু বাদ পড়ল না।

পঞ্চাশ পাউণ্ডের ওটের ছালা ফেটে ওট বেরিয়ে ছিটিয়ে পড়ল। পুরোনো আংশিক পচা কাঠের চিলেকোঠা ধসে পড়ল। ওখানে গাদা দিয়ে রাখা খড় ঢেউয়ের মত নিচে নামল।

গুলি ফুরিয়ে এল। নতুন টার্গেটও আর কিছু নেই। শটগানটা আবার শেলফে রাখার জন্যে হাত বাড়াল কোবল্ড। লাশটা খুঁজে বের করতে ওর দু’মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। উপরের দিকে তাকাল সে। সম্ভবত ওখানেই কোথাও মরে পড়ে আছে লোকটা।

ক্ষুরধার একটা দুমুখো ভারি কুঠার টোমাহওকের মত ঘুরতে ঘুরতে বাতাস কেটে উড়ে এল। ডেপুটির চোখ বিস্ফারিত হওয়ারও সময় পেল না। শটগান রাখতে বাড়ানো হাতটা কনুইয়ের তিন ইঞ্চি উপর থেকে কেটে শটগান সুদ্ধ মাটিতে পড়ল। এক সেকেণ্ড ওদিকে চেয়ে থাকল ডেপুটি।

তারপর চিৎকার করল।

চোখের পাতা ফেলে আওয়াজটার দিকে মুখ ফেরাল স্টকবার্ন। চেহারার পরিবর্তন হলো না। ওর গ্র্যানিট পাথরের মত চেহারায় ভাবের পরিবর্তন খুব কমই হয়।

আরও একজন চিৎকারটা শুনল। দোতলায় নিজের কামরায় দাঁড়িয়ে ডার্বি টের পেল ওর হাত কাঁপতে শুরু করেছে। হুইস্কির বোতল থেকে তিন আউন্স পানীয় গ্লাসে নিয়ে নির্জলা মদ গলায় ঢেলে দিল। এক ফোঁটা মদ চিবুক বেয়ে নেমে ওর দামী শার্টটার ওপর দাগ ফেলল।

ছায়ার ভিতর থেকে পিস্তল হাতে বেরিয়ে এল স্ট্রেঞ্জার। কোবল্ডের যন্ত্রণায় পাক খাওয়া দেহটা টপকে দরজার দিকে এগোল। পিছনের রক্তাক্ত লোকটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল।

দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে কেন যেন থমকে দাঁড়াল। একটা বুলেট ওর মুখের এক ইঞ্চি দূরে কাঠের কুচি ছিটাল। ঘুরে ঝাঁপিয়ে মেঝের ওপর পড়ল প্রীচার। ভিতরের দেয়ালের সাথে দেহ সাঁটিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল শেষ ডেপুটিটা কোথায় আছে।

দ্বিতীয় একটা গুলি অল্পের জন্যে ওকে মিস করল। দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে দুই তক্তার মাঝে একটা ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল ও।

দৃষ্টি বেশ সীমিত হলেও আস্তাবলের সামনে গলির কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আততায়ীর কোন চিহ্ন দেখা গেল না। লোকটা যে-ই হোক, অত্যন্ত সাবধানী। তার শিকারের মত সেও অদৃশ্য হতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রথম যে নড়বে তারই বিপদ ঘটবে। একটুও অসাবধান হওয়ার উপায় নেই।

এক মিনিট সময় পেরিয়ে গেল। মনে মনে সম্ভাবনাগুলো একে একে যুক্তি দিয়ে বিচার করে মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল প্রীচার। পিস্তল তুলে পরপর ছয়টা গুলি করল ঘোড়াকে পানি খাওয়াবার টব লক্ষ্য করে। সারিবদ্ধ ছয়টা ফুটো দিয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। প্রথমে পরিষ্কার-পরে গাঢ় লাল হলো পানি।

পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে টবটার দিকে এগোল স্ট্রেঞ্জার। ডেপুটির লাশটা ভিতরে ভাসছে। লোকটার মুঠোয় পিস্তলটা এখনও ধরা আছে। মুখ তুলে তাকাল সে।

আর মাত্র একজন বাকি।

রাস্তার মাঝখানে চোখ সরু করে শব্দের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টকবার্ন। ওর মুখের ভাব দুর্বোধ্য, মনোভাব, হিংস্র।

দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এল লম্বা একটা লোক। অ রাস্তার মাঝখানে এগিয়ে গেল ও। ওখানে মাঝরাস্তায় আরও একটা জিনিস রয়েছে। একটা হ্যাট। ওটা তুলে চিন্তাযুক্ত ভাবে গর্ত দুটো পরীক্ষা করল। তারপর ধুলো ঝেড়ে হ্যাটটা মাথায় পরে টেনে চোখের ওপর নামিয়ে আনল।

পঞ্চাশ গজ দূরে স্টকবার্নকে দেখা যাচ্ছে। হাসল মার্শাল। কৌতুকহীন হাসি। হাসিতে ওর মুখের ভাব বিন্দুমাত্র নরম হলো না। রাস্তার মাঝখানে এসে পিস্তল বের করে অভ্যাস মত গুলি ভরা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখল। ওদের দুজনের মাঝে আছে পঞ্চাশ গজ, আর তিনজন ডেপুটির লাশ।

এগোচ্ছে স্টকবার্ন। একটুও দেরি না করে লম্বা লোকটাও ওর মোকাবিলা করতে এগোল। দুজনই ধীর পায়ে হাঁটছে। পরস্পরের ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাচ্ছে না কেউ। দূরত্ব কমে আসছে। অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে স্টকবার্ন নিজের পিস্তলের মুখটা একটু একটু করে ওঠাচ্ছে। চুরি করে যতটুকু ওঠানো যায় ততটুকুই লাভ। আরও দ্রুত গুলি ছুঁড়তে পারবে ও। তাক করে গুলি ছুঁড়তে সময় কম লাগবে।

ওর প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু তার পিস্তল এক চুলও ওঠায়নি। তার বদলে স্ট্রেঞ্জার কেবল তার মুখটা একটু ওপরে তুলল। এই প্রথম সূর্যের আলোয় ওর মুখটা পরিষ্কার দেখতে পেল মার্শাল।

স্ট্রেঞ্জারের চোখের দিকে চেয়ে এই প্রথম স্টকবার্নের মুখের ভাব বদলাল।

‘তুমি। তুমি!’

দ্রুত পিস্তল তুলে গুলি ছুঁড়ল স্টকবার্ন। বিস্ময়ের ধাক্কা ওকে একটুও স্লো করতে পারেনি। ওর প্রতিক্রিয়া স্বভাবজাত, হিসেব করা নয়। বহু বছরের অনুশীলন, হত্যায় আর খুনে ওর হাত পেকেছে।

কিন্তু এতে কোন পার্থক্য হলো না। স্ট্রেঞ্জারের পাঁচটা গুলি একটার মত শব্দ তুলে মার্শালের বুকে আট ইঞ্চি একটা বৃত্ত আঁকল। ষষ্ঠ গুলিতে ওর মাথার পিছন দিকটা উড়ে গেল। পড়ে গেল স্টকবার্ন। শেষবারের মত প্রতিপক্ষকে দেখার সুযোগও সে পেল না। বাম হাতের আঙুলগুলো একবার কুঁকড়ে স্থির হয়ে গেল।

পিস্তলের কার্তুজের খালি খোলগুলো রাস্তায় ফেলে পিস্তলে আবার গুলি ভরে নিল স্ট্রেঞ্জার। ওর চোখ এখনও হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়া মার্শালের লাশের ওপর। স্টকবার্নের দুটো হাতই এখন স্থির। হাতের আঙুলগুলো আর কোনদিন নার্ভাস ভাবে নাচবে না।

সিলিণ্ডার বন্ধ করে পিস্তল খাপে ভরে নিজের ঘোড়ার দিকে এগোল স্ট্রেঞ্জার।

দোতলার জানালা দিয়ে ছাইয়ের মত সাদা মুখে লম্বা লোকটার গতিবিধি লক্ষ করছে ডার্বি। ওর ডান হাতে একটা কালচে-নীল লম্বা নলের ডেরিঞ্জার। ওটা তাক করছে ও-নিজের দিকে।

পাদানিতে একটা পা ঢুকিয়ে ইতস্তত করল লম্বা লোকটা। ঘুরে চোখ তুলে দোতলার বিশেষ একটা জানালার দিকে তাকাল। জানালার পিছনে পর্দাটা সামান্য নড়ে উঠল। দূর থেকে একটা গুলি আর কাঁচ ভাঙার শব্দ ভেসে এল। ডার্বির দেহটা মেঝের পুরু কার্পেটে পড়ায় আওয়াজটা শুনতে পেল না প্রীচার। শোনার প্রয়োজনও নেই।

ডার্বিই কাজটা শুরু করেছিল, এবং ডার্বিই তা শেষ করল।

সবকিছুর সমাপ্তি ঘটল।

ঘোড়ার পিঠে বসে লাগামে ঝাঁকি দিল স্ট্রেঞ্জার।

.

বাকবোর্ডের ঘোড়াটা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে শহরে ঢুকে ব্যাঙ্কের সামনে থেমে দাঁড়াল। পাতলা গড়নের আরোহী নির্দয়ভাবে ঘোড়াটাকে সারা পথ দাবড়ে এনেছে। শহরবাসীদের কেউ কেউ মুখ তুলে ওকে দেখল বটে কিন্তু শহরের রাস্তায় লাশগুলোর দিকেই সবার মনোযোগ।

বাকবোর্ড থেকে লাফিয়ে নিচে নামল ওয়ানিতা। মেয়েটাও মৃতদেহগুলো দেখেছে এবং উৎকণ্ঠার সাথে প্রত্যেকটা চেহারা লক্ষ করেছে। সবাই ওর অপরিচিত।

‘কোথায় সে?’

কারও কাছে জবাব নেই। শহরের লোকজন সকালের অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর বোবা হয়ে গেছে। ধাক্কাটা এখন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু খুব ধীরে। এমনকি টমাস, যে মৃতের সৎকার করে, সেও এমন হতবুদ্ধি হয়ে গেছে যে এখনও কাজে হাত দিতে পারেনি।

নিতা সবাইকে একই প্রশ্ন করছে, কিন্তু শূন্যদৃষ্টির চাহনি ছাড়া আর কোন জবাব পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত জুড ব্ল্যাকেনশিপের পরিচিত চেহারা দেখতে পেয়ে ওর কোটের হাতা খামচে ধরল।

‘কোথায় সে?’

চোখের পাতা ফেলে ঘোর কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে এল দোকানি।

‘কে কোথায়, বাছা?’

‘প্রীচার!’

‘ওহ, প্রীচার।’ রাস্তার দিকে তাকিয়ে নড করল সে। ‘চলে গেছে।’

‘চলে গেছে? কোথায়?’

‘কে জানে?’ কাঁধ উঁচাল ব্ল্যাকেনশিপ।

দোকানির কোটের হাতা ছেড়ে শহরের লোকজনের মাঝে লম্বা আকৃতির মানুষটাকে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরল নিতা। কিন্তু কোথাও ওকে দেখতে পেল না। শেষে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ওয়্যাগনে উঠে বসল মেয়েটা।

‘বাছা!’ ব্ল্যাকেনশিপ তাড়াতাড়ি হাত তুলে ওকে ঠেকাতে ছুটে এল। ‘তোমার ঘোড়াটার দিকে একবার চেয়ে দেখো। ওর মুখে ফেনা উঠে গেছে। আরও খাটালে নির্ঘাত মারা পড়বে। ওর বিশ্রাম দরকার। আমাদের সবারই এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। প্রীচার চলে গেছে, নিতা।’

ওয়ানিতার দিকে চেয়ে পিতৃসুলভ একটা হাসি দিয়ে ঘুরে নিজের দোকানের দিকে ফিরে গেল জুড। দোকানের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবনিকাশ করতে প্রচুর খাটুনি আর সময়ের দরকার হবে। কিন্তু তাতে ওর আপত্তি নেই। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীই সরে গেছে। সে জানে আগামীতে ব্যবসায় যা লাভ হবে তার তুলনায় আজকের ক্ষতি কিছুই না।

ওয়ানিতাকে বাকবোর্ডে একা ছেড়ে চলে গেল দোকানি। মেয়েটার নিজেকে পরিত্যক্ত আর প্রতারিত মনে হচ্ছে-কান্না পাচ্ছে ওর। খানিকক্ষণ চুপ করে ওখানে বসে থাকার পর হঠাৎ সে খেয়াল করল এখন আর শহরবাসীর পুরো মনোযোগ লাশের প্রতি নেই-তাকেও অনেকে লক্ষ করছে।

সোজা হয়ে বসে নিজেকে সামলে নিল ও। সে ফিশার। জুড ব্ল্যাকেনশিপের কথাটা ওর কানে এখনও বাজছে। ‘চলে গেছে।’

‘না, যায়নি,’ জোরেই বলে উঠল নিতা। ‘অন্তত সত্যিকার অর্থে না।’

বাকবোর্ড থেকে নেমে ঘোড়াটাকে খুলে আস্তাবলের দিকে এগোল মেয়েটা। মেয়ারটা এখনও হাঁপাচ্ছে। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর থেমে দাঁড়াল নিতা। দূরে সিয়েরার চূড়ার ওপর ওর চোখ।

‘প্রীচার!’ চিৎকার করল সে। এখন আর ওর চোখে জল নেই, না, আর না। ‘আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম, প্রীচার! তুমি শুনছ?’

কয়েকজন শহরবাসী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ওদের উপেক্ষা করল নিতা। তার কাছে বর্তমানে ওদের কোন অস্তিত্ব নেই। আছে শুধু সে, আর ওই দূরের পাহাড়গুলো।

‘আমি তোমাকে মুক্তি দিচ্ছি!’ ওর স্বর কিছুটা নামল। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, প্রীচার! গুডবাই!’ ঘোড়ার পিঠটা আদর করে চাপড়ে দিল নিতা। ‘ও আবার ফিরে আসবে,’ নিজেকেই ফিসফিস করে শোনাল মেয়েটা। ‘আমি প্রার্থনা করলে ও ঠিকই ফিরে আসবে। ওকে কাছে পেতে চাইলে, আমি আবার একটা মিরাকলের জন্যে প্রার্থনা করব।’

নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী আবার ফিরবে কি?

***

2 Comments
Collapse Comments

next part ace?
please ……………..

ইশতিয়াক December 4, 2023 at 10:28 pm

অনেক প্রশ্নেরই তো জবাব মিললো না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *