নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ১

এক

পার্সি স্মিথকে লোকে ‘স্পাইডার’ নামেই ডাকে। কারণ ওর বাপ-মায়ের দেয়া নামে ওকে ডাকার সাহস কারও নেই। ‘পার্সি’ নামটাকে আমেরিকার লোকজন অপমানজনক বলে মনে করে-তাই ওটাকে নিজের নাম বলে স্বীকার করে না স্পাইডার।

ডাক-নামের সাথে ওর চলাফেরার অনেক মিল আছে। স্পাইডারের জাল বোনার মতই ব্যস্ত ভাবে সে সারাদিন নিজের ক্লেইমের ওপর ছোটাছুটি করে বেড়ায়। আর পাঁচজনের মত ধৈর্য ধরে কার্বন ক্রীকের ধারে বসে প্যান করা বা লঙ্ টম্ (ছয় ফুট লম্বা সোনা বাছাই করার বাক্স) নিয়ে কাজ করা ওর ধাতে সয় না। ছোট গড়নের ছটফটে লোকটা কখনও প্যান করছে, পরক্ষণেই আবার বেলচা দিয়ে ঝর্নার তলা থেকে নুড়ি ওঠাচ্ছে, কিংবা বড়বড় পাথর পরীক্ষা করে ওর ভিতর সোনা পাওয়া যায় কিনা দেখছে। সিয়েরার রোদে পোড়া ওর বাদামী হাত প্যানের গ্র্যানিট আর শি দ্রুত আঙুলে সরিয়ে সোনা খোঁজে। কিন্তু তারই ফাঁকে মাঝেমাঝে নিজের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে দুজনকে হাত নেড়ে আশ্বস্ত করে।

স্পাইডারের মত একহাতে প্যানিঙ করার দক্ষতা এ তল্লাটে আর কারও নেই। একবেলা খাওয়ার বিনিময়ে আগ্রহের সাথেই কার্বন ক্রীকের নবাগত মাইনারদের সে তার প্যানিঙের কৌশল দেখাত। এখন আর তা পারছে না। বেশ কয়েক মাস হলো, কার্বন ক্রীকে নতুন মাইনার কেউ আসছে না। অবশ্য এর পিছনে বিশেষ একটা কারণও আছে।

সিয়েরা নেভাডা এলাকায় লোলা মন্টেজ পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে বেশকিছু সোনা পাওয়া যাচ্ছে জেনেও এখন আর নতুন মাইনার এদিকে আসছে না। সোনা পাওয়ার খবরের সাথে মাইনারদের ওপর এলাকার একজন প্রতাপশালী লোকের অত্যাচারের খবরও ওরা পেয়েছে।

এই সময়ে একটু তামাক ফুঁকলে মন্দ হত না, ভাবল স্পাইডার। কিন্তু ক্রীকের ধারে কেউ ধূমপান করে না। ওটা অবসর সময়ের আয়েশ। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা ক্রীকের ধারে দিনের আলো কম সময়ের জন্যেই থাকে। তাই দিনের আলো হেলায় নষ্ট করার জিনিস নয়। দিনের আলো কেবল সোনা সংগ্রহের কাজেই লাগানো উচিত। পায়ের ওপর পা তুলে ধোঁয়া গিলতে বসলে হয়তো পায়ের তলা দিয়েই সোনার নুড়ি গড়িয়ে নিচে নেমে যাবে, সে টেরও পাবে না।

তবে কঠিন পরিশ্রম করলেই যে কার্বন ক্রীকের মানুষ বড়লোক হয়ে যাবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। সবই ভাগ্য। এখানে সোনা পাওয়ার একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা যে আছে তা সবাই জানে। মোটামুটি পেট চালাবার মত সোনা এখানে সবাই পেয়েছে। হঠাৎ ভাগ্য খুলে যাওয়ার আশায় কেউ আর যেতে পারছে না।

ক্রীকের পাথরে বাড়ি খেয়ে শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছে ঝর্নার পানি। হঠাৎ পানির শব্দ ছাপিয়ে একটা গুড়গুড় আওয়াজ স্পাইডারের কানে পৌঁছল। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল সে। গ্রীষ্মে বজ্রবৃষ্টি এই এলাকায় নতুন কিছু নয়। কিন্তু আকাশটা একেবারে পরিষ্কার-এক টুকরো মেঘও নেই। তবে তাই বলে বৃষ্টি হবে না, একথা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না। যেকোন মুহূর্তে পাহাড়ের ওপাশ থেকে মেঘ উপচে এসে বৃষ্টি ঘটাতে পারে। সিয়েরার আবহাওয়াই এমন।

কোথাও একটা মর্কিঙ বার্ড তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠল। পাইন পাতার ফাঁকে দুটো স্টেলার জে পাখি পরস্পরকে তাড়া করার খেলায় মেতেছে। গুড়গুড় শব্দটা বাড়ছে। শব্দটা যেন মেঘের গর্জনই হয়, মনেমনে এই প্রার্থনা করে চোখ দুটো সরু করে ক্যানিয়নের নিচের দিকে তাকাল স্পাইডার। তার আশঙ্কাটাই সত্যি- ওখানে শব্দের সাথে ধুলো উড়ছে।

ওয়ানিতা ফিশারও শব্দটা শুনেছে। ক্যানিয়ন বরাবর নিচের দিকে তাকাল মেয়েটা। পনেরো ছেড়ে ষোলোতে পা দিয়েছে ও। কিন্তু বাড়ন্ত গড়ন দেখে ওর বয়স বিশ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিতে আছে সে। মায়ের দেহের আকর্ষণীয় গড়ন আর বাপের সুদর্শন চেহারা পেয়েছে মেয়েটা। অপরূপ সুন্দরী।

দুহাতে ধরে পানির ভারি বালতিটা বয়ে নিয়ে বাসায় ফিরছিল ওয়ানিতা। শব্দ শুনে থামতেই কিছুটা পানি চলকে মাটিতে পড়ল। ছোট্ট কুকুরটা পায়ের কাছে খেলতে খেলতে ওকে অনুসরণ করছিল। মালিককে থেমে দাঁড়াতে দেখে থমকে ওয়ানিতার দিকে মুখ তুলে তাকাল পাপি। চোখে কৌতূহলী প্রশ্ন। পরিণত বয়সেও পাপি আকারে বেশি বাড়বে না। এই যুক্তি দেখিয়েই মায়ের কাছ থেকে ওকে রাখার অনুমতি পেয়েছে সে। ওয়ানিতার মত কুকুরটাও প্রাণ-প্রাচুর্য আর কৌতূহলে ভরপুর। ক্যানিয়নের দিকে তাকায়নি কুকুরটা-কিন্তু ওর কান দুটো যেভাবে খাড়া হয়ে উঠেছে তাতে বোঝা যায় শব্দটা ওর কানেও ঢুকেছে।

প্যাট জনসন তার ক্লেইমের মাঝখানে জায়গা দখল করে বসা বিশাল পাথরটার ছায়ায় লঙ টমে কাজ করছিল। ক্রীকের পানি ওই ভারি পাথরটাকে নিজের পথ থেকে নড়াতে না পেরে ঘুরে এগিয়েছে। লঙ টম বসাবার সবথেকে ভাল জায়গাটাই দখল করে বসে আছে ওই পাথর। কিন্তু বর্তমানে ওর কিছুই করার নেই। ওই পাথর সরাতে হলে অনেক টাকা আর সময়ের প্রয়োজন। দুটোর কোনটাই প্যাটের নেই। ওটার পিছনে সাধ্যমত শ্রম আর প্রচুর গালি দিয়েও কোন ফল হয়নি। সব উপেক্ষা করে প্যাটকে ব্যঙ্গ করার জন্যেই যেন ওটা নিজের জায়গাতেই ঠায় বসে আছে।

দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে প্যাটের চেহারায়। সুইস রকারটা ছেড়ে দিয়ে শব্দের উৎসটা ভাল করে দেখার জন্যে ঢাল বেয়ে কিছুটা উপরে উঠল সে। ওর বয়স এখন চল্লিশের কাছাকাছি। সারাটা জীবন পরের জন্যে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও ওর চেহারায় বাড়তি বয়সের ছাপ পড়েনি। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে সব কিছু ছেড়ে পুরো দেশ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কার্বন ক্রীকে হাজির হয়েছে সে। এখানে এসে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে বটে, কিন্তু কাউকে তার তোয়াজ করে চলতে হচ্ছে না, এতেই সে খুশি। এখন প্যাট নিজেই নিজের বস্। ক্রীক থেকে পরিশ্রম করে সে যা কিছু পায় তাতে আর কারও কোন অধিকার নেই—সব একা তারই।

এ-মুহূর্তে কার্বন ক্যানিয়নের সব ক’জন বাসিন্দা ক্রীকের ভাটির দিকে আশঙ্কা নিয়ে চেয়ে আছে। ঘোড়ার খুরের শব্দ পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে এখন আরও জোরাল হয়ে উঠেছে। শখ করে দু’একটা কেবিনে যারা কাঁচের জানালা বসিয়েছে, প্রচণ্ড শব্দে সেগুলো কাঁপছে।

প্যান খালি করে পাথর আর বালু মাটিতে ফেলে ছুটে উঁচু জমিতে আশ্রয় নেয়ার জন্যে তৈরি হয়েছিল স্পাইডার। হঠাৎ প্যান থেকে ফেলা কাঁকর আর পাথরের ভিতরে একটা আলোর ঝিলিক ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ছোট্ট একটা নাগিট্। কিন্তু ছোট হলেও ওটা সোনার একটা দলা। উপুড় হয়ে ঝুঁকে নাগিটা হাতে তুলে ঝাঁকিয়ে ওটার ওজন পরীক্ষা করে দেখল। তারপর ওটা পকেটে পুরে নিজের ছাপরার দিকে ছুটল।

পরক্ষণেই দেখা গেল দশ-বারোজন আরোহী দ্রুত বেগে ক্রীক ধরে ছুটে আসছে। খুরের আঘাতে সহস্র পানির কণা শূন্যে ছিটকে উঠছে। সূর্যের আলো পড়ে ওখানে অজস্র রামধনুর সৃষ্টি হয়েছে। দৃশ্যটা সুন্দর হলেও ওদিকে কারও লক্ষ নেই। সবার নজর আরোহীদের ওপর। ওরাই এখানকার শান্ত বিকেলের পরিবেশটাকে তছনছ করে দিয়েছে।

‘গড্‌ড্যাম্ ইট্‌!’ গর্জে উঠল স্পাইডার স্মিথ। অশ্বারোহীদের দিকে চেয়ে নিষ্ফল আক্রোশে ওর আঙুলগুলো বারবার মুঠি পাকাচ্ছে, আবার খুলছে।

মাইনারদের মাঝে ছোটাছুটি পড়ে গেছে। সবাই নিজেদের মাইনিঙের সামগ্রী আর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে ছুটছে। ওরা অসহায়-এই ধরনের বিপর্যয় আগেও ঘটেছে—ওদের কিছুই করার নেই।

কিন্তু ঘোড়সওয়ারদের ভয়ে সবাই পালায়নি। একটা ছোট্ট ফুটিওয়ালা কুকুর ওদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বিশাল আকারের ঘোড়াগুলো যে ওর দিকে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন একাই ওদের মোকাবিলায় সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

‘পাপি!’ ওর দিকে ফিরে চিৎকার করল ওয়ানিতা।

কিন্তু ওর ডাকে কুকুরটা সাড়া দিল না। আক্রমণকারীদের ঝড়ের বেগে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে কুকুরটা হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। বালতি ফেলে দিয়ে পাপিকে বাঁচাতে ছুটে গেল মেয়েটা।

ক্রীকের দুটো ধারই কাভার করার জন্যে আরোহীরা ছড়িয়ে পড়েছে। বিকট চিৎকারের সাথে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে লোকজনকে আরও আতঙ্কিত করে তুলছে ওরা। ওই ধরনের মানুষকে কেউ পারিবারিক পার্টিতে দাওয়াত দেবে না-এটা নিশ্চিত। ওরা ভাঙচুর করে নিজেরাই একটা পার্টিতে মেতে উঠেছে। হাসছে ওরা, স্থানীয় লোকজনই কেবল হাসতে পারছে না।

দড়াম করে দরজা খুলে একটা পুরোনো ছাপরা থেকে বেরিয়ে এল মারিয়া ফিশার। পাহাড়ী ঢালের বেশ উঁচুতে ওর বাড়ি। উদ্বিগ্ন ভাবে নিচের বিশৃঙ্খলা লক্ষ করছে মহিলার নীল দুটো চোখ। তীক্ষ্ণ নজরে ঢাল, ক্রীক বেড, আর ওপাশের ঢালে একটা পরিচিত আকৃতি খুঁজে বেড়াচ্ছে সে।

‘ওয়ানিতা? নিতা!’ ফ্যাকাসে চেহারায় চোখ বিস্ফারিত করে চিৎকার করল মারিয়া। তার মনে হলো যাকে খুঁজছে তাকেই সে দেখতে পেয়েছে বিশৃঙ্খলার ঠিক মাঝখানে। এত হট্টগোলের মধ্যে মারিয়ার চিত্কার কারও কানে পৌঁছল না।

এত গোলাগুলির ভেতরেও একটা বুলেটও কারও গায়ে বেঁধেনি। কাউকে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে লোকগুলো হামলা করেনি। ওরা এসেছে মাইনারদের স্পিরিট গুঁড়িয়ে দিতে, দৈহিক ক্ষতি করার অনুমতি তারা পায়নি। দুঃখজনক—ওদের কেউ কেউ ভাবছে। এতগুলো সহজ টার্গেট ওদের সামনে; প্রতিপক্ষ পালটা আঘাত হানার চেষ্টাও করছে না। ভেড়ার পালের মত পালাচ্ছে সবাই। পিস্তলবাজ লোকগুলো অনেক কষ্টে নিজেদের সংযত রেখে প্রভুর আদেশ পালন করছে।

ঢাল বেয়ে ঘোড়ার যতদূর ওঠা সম্ভব ততদূর বিক্ষিপ্ত মাইনারদের তাড়িয়ে নিয়ে ওরা আবার ফিরে এল। এবার নজর দিল মাইনারদের ফেলে যাওয়া যন্ত্রপাতির দিকে। এত কিছুর মাঝে একটা স্বরই কেবল ওদের বিরুদ্ধে একটানা প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে। ও ছাড়া কার্বন ক্যানিয়নে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মত সাহস আর কারও নেই। এবং সে হচ্ছে ওয়ানিতার ফুটকিওয়ালা ছোট্ট পাপি।

সবাই ছুটে জঙ্গলে পালায়নি। স্পাইডার স্মিথ নিজের ছাপরা পর্যন্ত পৌঁছে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি থেকে পালাতে সে রাজি নয়। প্যাট জনসন তার লঙ টম আর রাইডারদের মাঝে দুহাতে একটা বেলচা ধরে অপেক্ষায় আছে।

একজনকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে কষে বেলচা ঘোরাল প্যাট। কিন্তু লাগাতে পারল না। ঘোড়াটা আগেই দ্রুত গতিতে ওকে পার হয়ে গেছে। লক্ষ্য মিস করে টাল সামলাতে পারল না প্যাট, ডিগবাজি খেয়ে ক্রীকের ঠাণ্ডা পানিতে গিয়ে পড়ল। যাকে লক্ষ্য করে বেলচা চালিয়েছিল সেই লোকটা পিছন ফিরে ওর অবস্থা দেখে দাঁত বের করে হাসল।

লোকটার পেছনে যে দুজন আরোহী ছিল তারা প্যাটের লঙ টমটা ঘোড়ার খুরের তলায় পিষে দিয়ে গেল। পিছন ফিরে ওটা ভেঙেছে কিনা দেখে নিশ্চিত হলো। ক্রীকের মাঝখানে বসে অসহায়ভাবে সব দেখল প্যাট। প্রতিবাদে কিছুই করার ক্ষমতা নেই।

একজন আরোহী ল্যারিঅ্যাটে তার দক্ষতা দেখাবার সিদ্ধান্ত নিল। দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে কেবিনের একটা খুঁটির সাথে বাধাল, অন্য প্রান্ত পেঁচাল স্যাডলহর্নের সাথে। কয়েকবার ‘গিড়ি আপ’ উচ্চারণের পর পেটে স্পারের খোঁচা খেয়ে আসল কাজটা ঘোড়াই করল। খুঁটিটা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেবিনটা তাসের ঘরের মত ধসে পড়ল। শক্ত করে গড়া কেবিন এভাবে ভাঙত না-কিন্তু কার্বন ক্রীকের বেশিরভাগ বাড়িই ঠেকা কাজ চালাবার জন্যে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি। তবু আরোহী লোকটা বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে ভাঙার আগে ওটাই ছিল একজনের বাসস্থান।

ক্রীকের ধারে মাইনাররা যা কিছু ফেলে পালিয়েছিল তা ভেঙেচুরে আবর্জনার স্তূপে পরিণত করেছে পিস্তলবাজ গুণ্ডার দল।

বাড়ির বারান্দা থেকে নিচে নামল মারিয়া। দেখল কয়েকজন ঘোড়সওয়ারের ভিতর ছুটাছুটি করছে ওয়ানিতা।

‘ওয়ানিতা! এখানে ফিরে এসো!’ স্পষ্ট ভয় ফুটে উঠেছে মারিয়ার স্বরে। দৌড়ে মেয়ের দিকে এগোতে গিয়ে ছুটন্ত একটা ঘোড়ার সামনে পড়ে গেল। কোনমতে পাশ কাটিয়ে সে নিজে বাঁচল। কিন্তু ঘোড়াটা কাপড় টাঙানোর দড়ি ছিঁড়ে ফেলায় কষ্ট করে ধোয়া ভেজা কাপড়গুলো সব ধুলোয় লুটিয়ে নোঙরা হলো।

অপ্রত্যাশিত ব্যথায় চিৎকার করে উঠল পাপি। শব্দটা তীক্ষ্ণ আর চড়া। এত ছোট প্রাণীর গলা থেকে যে এমন জোরাল তীক্ষ্ণ শব্দ বের হতে পারে ভাবাই যায় না।

– শেষ পর্যন্ত আরোহীরা সবাই একত্রিত হলো। নিজেদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে স্থূল রসিকতা আর হাসাহাসি করতে করতে ওরা চলে গেল। মাইনাররা সবাই তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। ওদের সহ্য শক্তি প্রায় অসীম। কিন্তু ওই লোকগুলোর অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম করেছে। এই ঘটনা এখন ঘনঘন ঘটতে শুরু করেছে। এবং আজই এর শেষ নয়, এটা ওরা ভাল করেই জানে।

ক্রীকের ধারে ছেঁড়া পুরোনো জুতোর মত একটা জিনিসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল ওয়ানিতা। প্রাণহীন ছোট্ট দেহটাকে কোলে তুলে নিল। নিঃশব্দ কান্নায় ওর চোখ থেকে পানি গড়াচ্ছে। দেহটা অত্যন্ত হালকা, মৃত্যুর পরে ওকে আরও ছোট দেখাচ্ছে। নিতার দম আটকে আসছে, কান্নায় নয়-প্রচণ্ড রাগে। জামা আর হাত রক্তে লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেদিকে ওর খেয়াল নেই। .

উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী আর পরিচিত লোকজনের দিকে তাকাল মেয়েটা। ওদের থেকে সহানুভূতি আর সমবেদনা আশা করেছিল-কিন্তু ওকে নিরাশ হতে হলো। ওরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। একটা কুকুরের মৃত্যুতে ওদের কিছু যায়- আসে না।

ওয়ানিতার এটুকু বোঝার মত বয়স হয়েছে যে তার যা ক্ষতি হয়েছে তা কোন মানুষই এখন আর পূরণ করতে পারবে না। যে যা-ই বলুক, কোন সান্ত্বনাই তার পাপিকে হারানোর ব্যথা ভুলাতে সক্ষম হবে না। কার্বন ক্যানিয়নের মাইনাররা এখন প্রায় পরাজিত। এরকম আরেকটা আঘাত সবাইকে একেবারে শেষ করে দেবে।

ধীর পায়ে পাহাড় বেয়ে উপরে গাছের সারির দিকে এগোল ওয়ানিতা। খেলার সাথী ছোট্ট পাপিকে সে খুব ভালবাসত। ওকে হারিয়ে নিতার কতটা কষ্ট হচ্ছে তা কেউ বুঝবে না।

ওয়ানিতাকে উপরে উঠতে দেখল মারিয়া। নিচে কি ঘটেছে এটা সে বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু হারানোর ব্যথা সে জানে। মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা মারিয়ার জানা নেই। ওকে এখন একা থাকতে দেয়াই ভাল। ধুলোয় লুটানো জামাকাপড়ের দিকে নজর দিল সে। ঘোড়ার খুরের তলায় তার সব্জী বাগানটাও নষ্ট হয়েছে।

ভারাক্রান্ত মনে পায়ে-পায়ে এগোচ্ছে নিতা। পাপিকে সে যোগ্য মর্যাদার সাথে কবর দেবে। জঙ্গলটা একেবারে নীরব-পরিবেশটা শান্ত। ঢালের ওপর পাইন আর দেবদারু গাছের ভিতর ক্রীকের পানির শব্দ পৌঁছাচ্ছে না। নিচে ক্রীকের ধারে আজকের হামলা সম্পর্কে উত্তেজিত কথাবার্তার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। এই নীরবতাই নিতার পছন্দ-ওদের অভিযোগ আর অজুহাত শোনার সময় ওর নেই। আজকে দুঃখজনক যা কিছু ঘটেছে, সবকিছু ম্লান করে দিয়েছে পাপিকে হারানোর ব্যথা।

অল্পক্ষণ খোঁজার পরেই পছন্দ মত একটা জায়গা দেখতে পেল মেয়েটা। পাইন শিকড়ের ফাঁকে একটা ছোট গর্ত। পাইনের কাঁটা আর পাতায় গর্তটা আংশিক ভাবে ভরাট হয়েছে। ওগুলো সরিয়ে গর্তটা পরিষ্কার করে ফেলল নিতা। পাপির ছোট্ট দেহের জন্যে বেশি জায়গার প্রয়োজন নেই।

কিছু পাতা গর্তের তলায় বিছিয়ে নরম বিছানা তৈরি করল নিতা। তারপর গর্তের ভিতর পাপির ছোট্ট দেহটা শুইয়ে দিল। ওর চোখ থেকে গাল বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। চেষ্টা করেও পাপিকে সে রক্ষা করতে পারেনি-নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। পাইনের নরম কাঁটা আর পাতা দিয়ে কবরটা ঢেকে উপরে কয়েকটা পাথর চাপিয়ে দিল।

নিস্তব্ধ বনের ভিতর নীরবে পাশে বসে কবরটার দিকে চেয়ে রইল সে। তারপর কবর দেয়ার সময়ে বলার মত কথা যা শিখেছে সেগুলোই আউড়ে গেল। বড়দের কাছ থেকে শেখা কথাগুলো শেষ হলে আকাশের দিকে চেয়ে নিজের মনের কথা বলতে শুরু করল নিতা।

‘ঈশ্বর, ওরা আমার পাপিকে মেরে ফেলেছে! কেন? কেন তুমি বাধা দিলে না? ওদের ওই ছোট্ট অবুঝ কুকুরটাকে কেন হত্যা করতে দিলে? ওর আর কতটুকু বয়স হয়েছিল? ওকে বাঁচতে দিলে তোমার কি এমন ক্ষতি হত?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল নিতা। কিন্তু কোন জবাব এল না। একটা ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, তোমার কথা মত আমি মৃত্যুর ছায়া ঘেরা উপত্যকা দিয়ে হেঁটে এগিয়ে যাব। পাপী আর অসৎকে ভয় পাব না-কিন্তু আমার ভয় করছে। ওরা আবার ফিরে আসবে। আমি জানি ওরা আসবে। আগেও এসেছে, আবারও আসবে। আমরা এখন কি করব?’

জবাবের প্রত্যাশায় আকাশের দিকেই চেয়ে রইল নিতা। কিন্তু এবারেও কোন জবাব এল না। তবু বাকি কথাগুলো সে বলে ফেলল।

‘তুমি আমাদের সাথেই আছ-আমাদের ছায়া দিচ্ছ। কিন্তু এতে কাজ হচ্ছে না। অলৌকিক কিছু না ঘটলে আমাদের রেহাই নেই। আমাদের রক্ষা করার জন্যে তুমি কাউকে পাঠাও।’

ধীরে উঠে দাঁড়াল ওয়ানিতা। কবরটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখনা।। কোন চিহ্ন রাখার দরকার নেই-যখন খুশি জায়গাটা সে আবার খুঁজে বের করতে পারবে।

চোখের পানি মুছে বাড়ির পথ ধরল নিতা। পিছন ফিরে কবরটার দিকে আরেকবার তাকাতে ইচ্ছে করছে-কিন্তু নিজেকে সংযত রাখল মেয়েটা। ফিরে তাকালে ঘোড়ার পিঠে বসা একজন নবাগত লোককে সে দেখতে পেত।

লোকটার পরনে একটা ভাঁজ ভাঙা ওভারকোট। মাথায় চওড়া-ব্রিমের হাট। ঘোড়া আর আরোহী ক্লান্ত। অনেকদূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে ওরা। মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। খাবার আর বিশ্রামের দরকার ওর। তাই শহরের খোঁজে এগোল রাইডার। লাগামটা সামান্যই নড়ল, কিন্তু ঘোড়াটা ঠিকই সঙ্কেত বুঝে সামনে পা বাড়াল।

কার্বন ক্যানিয়নের সবাই ক্ষয়ক্ষতি মেরামতে ব্যস্ত নয়। যাদের ক্ষতি কম হয়েছে, তাদের অন্য অনেক কাজ রয়েছে। প্যাট জনসন তার বাকবোর্ডের সাথে ঘোড়া জুড়ে রাস্তা ধরে এগোচ্ছে।

এডি স্মিথ ব্যাপারটা খেয়াল করে নিজের কাজ ফেলে ছুটে এল। স্পাইডারের ছেলে এডির বয়স বিশ। দেহের দিক থেকে সে বেড়েছে বটে, কিন্তু মানসিক দিক থেকে এডি এখনও কিশোর।

‘কার্বন ক্রীক ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ, মিস্টার জনসন?’ প্রশ্ন করে লে আড়চোখে ক্রীকের দিকে তাকাল। তারপর জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বলল, ‘এবার ওরা সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে, তাই না?’

‘না, পালিয়ে যাচ্ছি না,’ দৃঢ় স্বরে জবাব দিল প্যাট। ‘কিছু দরকারী জিনিসপত্র আনতে শহরে যাচ্ছি। মেরামতের কাজে আমাদের বেশ কিছু জিনিস লাগবে।’

সরল ভাবে হেসে সে বলল, ‘শহরে যাওয়াটা তোমার বোকামি হবে না, মিস্টার জনসন? মনে আছে গতবার কি ঘটেছিল? আবার তাই ঘটুক এটা নিশ্চয়ই চাও না তুমি?’

‘সেটা আমি বুঝব, এডি। তুমি তোমার কাজে যাও।’ লাগাম ঝাকিয়ে আবার এগোল প্যাট। বন্ধুবান্ধব কেউ দেখে ফেললে ওকে বাধা দেবে এই ভবেই সে তাড়াতাড়ি সরে পড়তে চাইছে।

পথ থেকে সরে দাঁড়াল এডি। ‘যাচ্ছি, মিস্টার জনসন।’

ঝর্নার একটু ভাটিতে এডির জমজ ভাই টেডি ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে বলেছে। ওখানে পানি কিছুটা গভীর। বাকবোর্ড চলার শব্দে সে মুখ তুলে চাই।

‘চলে যাচ্ছ, মিস্টার জনসন?’ ওরা দুই ভাই একই রকম। সত্যিকার অর্থেই জমজ।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্যাট। স্মিথ ছেলেদের হার্ট খুব বড়, কিন্তু বুদ্ধি এত কম যে দুজনে মিলে একটা জুতোর ফিতেও বাঁধতে পারবে না। তাই বাড়ির খুঁটিনাটি কাজ ওদের বাবাকেই সামলাতে হয়। মাইনিঙের কাজের ফাঁকে স্পাইডার সেটাও ম্যানেজ করে। এডি আর টেডির জন্ম দিতে গিয়ে ওদের মা মারা যায়। সেই থেকে স্পাইডারকে ওদের বাবা আর মা হতে হয়েছে। এইজন্যেই একআধবার বুড়ো স্মিথ যখন পাঁড় মাতাল হয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, কার্বনের লোকজন সেটাকে ক্ষমার চোখে দেখে।

‘না, আমি শহরে যাচ্ছি, টেডি,’ কঠিন স্বরে জবাব দিল প্যাট। কিন্তু এতে কোন ফল হলো না।

‘এটা নেহাত বোকামি হচ্ছে না?’ সরল মনেই প্রশ্ন করল টেড।

রুষ্ট দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল প্যাট। তবে এই ছেলেটা গতবার কি ঘটেছিল সেটা মনে করিয়ে দেয়নি। ওই অপ্রীতিকর ঘটনার কথা সে ভুলে যায়নি। আসলে এড আর টেড সরল মনে সত্যি কথাই বলেছে। শহরে যাওয়াটা তার বোকামি হচ্ছে—বিশেষ করে আজকের হামলার পর। কিন্তু সাপ্লাই আনতে একজনকে শহরে যেতেই হবে। নইলে সব গুটিয়ে ওদের কার্বন ক্রীক ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু এডিকে সে আগেই জানিয়েছে হাল ছেড়ে দিয়ে সে ওদের ভয়ে পালাবে না।

বড় গাখরটার পাশ দিয়ে ঘুরে এগোবার সময়ে পিঠের ওপর দুই ভাইয়ের __ -বশ অনুভব করতে পারছে মাইনার।

ব্লাউজটার অবস্থাই সবচেয়ে শোচনীয়। ওটা কেবল ধুলো মেখে নোঙরাই হয়নি, খুরের তলায় পড়ে ছিঁড়েও গেছে। সেলাই করতে হবে। ধুলো আর মাটি আবার ধুয়ে নিলেই চলে যাবে। খুব ক্ষতি হয়নি, কেবল মারিয়ার কাজ একটু বাড়ল। কপাল ভাল আরও খারাপ কিছু হয়নি। জামাকাপড় তুলে নিয়ে কেবিনে ফেরার সময়ে ঢালের নিচে বাকবোর্ডটা ওর চোখে পড়ল।

‘প্যাট? প্যাট, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

ডাকটা শুনেছে প্যাট। কিন্তু ফিরে না তাকিয়ে সোজা এগিয়ে চলল সে। মারিয়াকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া সম্ভব হলো না। কাপড়ের বাস্কেটটা ফেলে জামার প্রান্ত একটু উঁচিয়ে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে ছুটল মারিয়া।

‘প্যাট জনসন! থেমে দাঁড়াও বলছি! আমি জানি তুমি সব শুনতে পাচ্ছ। এই মুহূর্তে থেমে দাঁড়াও!’

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই কোনাকুনি ছুটে বাকবোর্ডের পাশে পৌছে গেল মারিয়া। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, ‘প্যাট, তুমি শহরে যাবে না। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না।’

প্যাটের গম্ভীর মুখে সামান্য একটু হাসি ফুটে উঠল। শান্ত স্বরে সে বলল, ‘আমার জন্যে তোমাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখে খুশি হলাম, মারিয়া।‘

‘এটা তো সহজ সরল কথা-তুমি কি আবার ওদের হাতে মার খেতে চাও?’

‘এডি আর টেডি আমাকে কথাটা আগেই স্মরণ করিয়েছে। তুমিও এখন আমার ওপর চড়াও হচ্ছ?’

‘প্যাট, তোমার শহরে যাওয়া ঠিক হবে না। জিম ডার্বির লোকজন ওখানে থাকবে।’

‘কাউকে তো এটা করতেই হবে?’

‘কিন্তু তুমি কেন?’ ওয়্যাগনের পাশেপাশে হাঁটছে মারিয়া।

‘হয়তো আমি গোয়ার্তুমি করছি, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত লেগে থাকব বলে ঠিক করেছি,’ সহজ সুরে বলল মাইনার। ‘মনে হচ্ছে সবাই হার স্বীকার করে নিয়েছে। আমি যদি আমাদের প্রয়োজনীয় সাপ্লাই নিয়ে না আসি, তবে সকালের আগেই সবাই এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাবে।’

‘ওরা যাক!’ রোষের সাথে বলল মারিয়া। ‘গেলেই ওরা ভাল করবে। আমাদের সবারই চলে যাওয়া উচিত। ডার্বি যা চায় তা আমাদের সময় থাকতে ছেড়ে দেয়াই ভাল। শেষ পর্যন্ত সে এখান থেকে আমাদের তাড়িয়েই ছাড়বে। সামান্য এই কাদামাটির জমিটার জন্যে তোমার আবার জখম হয়ে ফেরার কোন মানে হয় না। এই সত্যটা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ?’

‘না, পারছি না। কারণ তুমি যাকে কাদামাটি বলছ, এটাই আমার সর্বস্ব। এর আগে কোনদিন নিজস্ব বলতে আমার কোন জমি ছিল না। সবসময়ে পরের দোকানে বা পরের জমিতেই কাজ করেছি।’ মাথা ঝাঁকিয়ে ক্রীকের ধারে ছাপরা আর কেবিনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘ওদেরও বেশিরভাগ লোকের জন্যে এটাই সত্যি। সেজন্যেই ওরা এখনও এখানে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে।’ মারিয়ার দিকে চেয়ে আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল সে। ‘ডার্বি আমাদের মচকে দিয়েছে বটে, কিন্তু ভাঙতে পারেনি।’

‘শেষ পর্যন্ত সেটাও ঘটবে,’ পালটা জবাব দিল মারিয়া। ‘সত্যি বলছি, প্যাট, শহরে তোমার যদি কিছু হয়, তাহলে কোনদিন আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না!’ পাথরে হোঁচট খেয়ে নিজেকে আবার সামলে নিল মেয়েটা। বাকবোর্ড ওকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে দেখে আক্রোশে পাশের ছোট ঢিবিটায় লাথি মারল সে।

লাগাম টেনে ওয়্যাগন থামাল মাইনার। মারিয়াকে আবার ওয়াগন ধরে ফেলার সুযোগ দিয়ে অপেক্ষা করছে। সুন্দর একটা হাসি ফুটে উঠেছে ওর মুখে।

‘যে মেয়ে আজ পর্যন্ত আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো না, প্রতিজ্ঞাটা তার পক্ষে একটু কড়া হয়ে গেল না?’

উপযুক্ত একটা জবাব খুঁজছে মারিয়া। কিন্তু বলার মত কিছুই খুঁজে পেল না। সরাসরি প্রশ্নটা করে ওকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে প্যাট। চোখ নিচু করে ওয়্যাগন থেকে পিছনে সরে গেল মেয়েটা।

‘তোমার জন্যে শহর থেকে কিছু আনতে হবে?’ হ্যাটটা মাথার পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে প্রশ্ন করল জনসন।

মারিয়ার স্বরটা খুব মৃদু শোনাল। ‘না। নিতা বা আমার আপাতত কিছু লাগাবে না।’ প্যাটের দিকে মিনতি ভরা চোখে সমঝোতা চেয়ে সে আবার বলল, ‘তুমি নিভা আর আমার জন্যে যা করো তার মর্যাদা আর মূল্য আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করি। কিন্তু আমি–‘

‘উপলব্ধি করা খুব ভাল জিনিস,’ বাধা দিয়ে বলল প্যাট। ‘কিন্তু তাতে শীতের লম্বা রাতে একটা নিঃসঙ্গ মানুষের বিছানা গরম হয় না।’ কথার শেষে মারিয়ার দিকে কয়েক সেকেণ্ড একদৃষ্টে চেয়ে অপেক্ষায় থাকল প্যাট। যখন বুঝল কথাটার জবাব সে পাবে না, তখন অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ দুটো সামান্য একটু উঁচিয়ে লাগাম ঝাঁকি দিয়ে সামনে এগোল। মারিয়াকে ক্রীকের ধারে একা ছেড়ে, ঢালা বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে চলল ওয়্যাগন।

এটা ঠিক হলো না, ভাবছে মারিয়া। এই মুহূর্তে এভাবে চ্যালেঞ্জ করে তার মনটাকে ভারি করে তুলে প্যাট্রিক ঠিক করেনি। এখনও তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়য় আসেনি। জনসনের সাথে পরিচয় হওয়ার আগে জীবনে যা ঘটেছে সেটা ওর মনকে বিষিয়ে তেতো করে রেখেছে। তাই এখনই ওর পক্ষে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব। এতে তার করার কিছু নেই। এটা প্যাটকে বুঝতেই হবে। যদি না পারে, সেটা প্যাট্রিকেরই দোষ।

কিন্তু তবু ওয়্যাগনটা চোখের আড়ালে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল মারিয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *