নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ৩

তিন

কথা বলেনি লোকটা, কিন্তু প্যাটের মনে হলো পথে প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ করছে স্ট্রেঞ্জার। এমন নয় যে এখানে দেখার মত কিছু আছে। সিয়েরা নেভাডায় এমন হাজার-হাজার ক্যানিয়ন আছে। দেখতে সব একই রকম। সন্দেহ নেই তার সঙ্গী এমন ক্যানিয়ন আরও অনেক দেখেছে।

ঢালের ওপর একটা জায়গা দেখাল প্যাট। ‘ওই যে, ওটাই আমার কেবিন। আমি জানি না তুমি কতদূর থেকে আসছ, নিশ্চয় তুমি এখন খুব ক্লান্ত।’

‘লম্বা সময় ট্রেইলে কাটিয়েছি আমি,’ প্যাটের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল স্ট্রেঞ্জার। মনে হলো চারপাশে তাকিয়ে ক্যানিয়নের খুঁটিনাটি সে মনে গেঁথে নিচ্ছে।

‘কত দিন?’ বা ‘কোথা থেকে?’ এসব প্রশ্ন তুলল না প্যাট। ‘কেবিনে তুমি পানি আর শেভ করার সরঞ্জাম পাবে। আমি মারিয়াকে বলে আসছি আজ আমাদের সাথে আরও একজন খাবে। তারপর শহর থেকে আনা জিনিসপত্রগুলো আলো থাকতেই বিলি করে ফিরব।’ হাসল প্যাট। ‘এখানকার অনেকে ভাবতেই পারবে না এসব জিনিসের মুখ তারা দেখতে পাবে। অবশ্য সেজন্যে ধন্যবাদ তোমারই প্রাপ্য। ফিরতে আমার বেশি দেরি হবে না। তুমি এটাকে নিজের বাড়িই মনে করতে পারো।’

আরও অনেক কথাই প্যাট তার নতুন সঙ্গীকে বলতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন সময় নেই। পরে সময় করে বলবে। সাধারণত বেশি কথা বলে না সে। তবে স্ট্রেঞ্জার এত ভাল শ্রোতা যে ফোয়ারার মত কথা আপনা থেকেই বেরিয়ে আসতে চায়। লোকটার ভিতর এমন কিছু আছে যে ওকে নিজের গোপন কথা বলতেও মানুষ দ্বিধা করবে না।

একটা লোক খচ্চরের পিঠে উঁচু করে মাল চাপিয়ে ক্রীকের ধার দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওদের সামনে থামল। ওর মাথার চুল অর্ধেক সোনালি আর বাকি অর্ধেক পাকা। বয়সের তুলনায় ওকে বেশি বুড়ো দেখাচ্ছে।

‘গুড বাই, প্যাট,’ জনসনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে একটুও অপ্রতিভ না হয়ে বলল লোকটা।

‘তুমি কোথায় চলেছ, উলরিক?’ মুখ কুঁচকে আকাশের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল প্যাট। ‘এই অবেলায় শহরে যাচ্ছ?’

‘শহরে যাচ্ছি না। সময় থাকতে সরে পড়ছি।’

লাগাম টেনে ওয়্যাগন থামাল প্যাট। ‘চলে যাচ্ছ? এই অসময়ে তুমি কোন্ চুলোয় যাবে?’

‘জানি না। তবে এমন জায়গায় যাব, যেখানে আমাকে দিনের পর দিনা অত্যাচার আর ক্ষতি সহ্য করতে হবে না। যেখানে রাতে শান্তিতে একটু ঘুমানো যাবে। আমার আর লড়ার ক্ষমতা নেই, প্যাট। আমি একা নই, আরও লোক চলে যাওয়ার কথা ভাবছে।’ পাথরটার পাশ দিয়ে ঘুরে খচ্চর নিয়ে এগোল সে।

ঘুরে প্রস্থানরত মাইনারের দিকে তাকাল প্যাট। ‘আহা, উলরিক, তুমি এত হতাশ হচ্ছ কেন? কথায় বলে: অবস্থা ভাল হবেই, কারণ আর খারাপ হওয়া অসম্ভব।’

বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকাল বুড়ো। ‘যে লোক ওই কথা বলেছে সে কার্বন ক্যানিয়নে বাস করেনি। গুড বাই, প্যাট্রিক জনসন, এবং গুড লাক। ৰুদ্ধি থাকলে তুমিও সরে পড়বে।’

প্যাট নীরবেই লোকটার যাওয়া দেখল। তারপর হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে মেয়ারটাকে আগে বাড়াল।

‘অত্যাচারের কথা কি বলছিল লোকটা?’ জানতে চাইল স্ট্রেঞ্জার।

প্যাটের চেহারা গম্ভীর। স্বরটা নিচু। ‘মনে আছে তোমাকে একটা ফিউডের কথা বলেছিলাম? উলরিকের যাওয়ার পিছনে ওটাই কারণ। পরে তোমাকে সৰা বলব। তবে ওসবের সাথে তোমার না জড়ানোই ভাল।’ কথাটা বলে আড়চোখে প্রশ্নকর্তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করল। কিন্তু ওকে নিরাশ হতে হলো। আশা করেছিল, লোকটা হয়তো আরও প্রশ্ন করবে বা কিছুটা আগ্রহ দেখাবে। সেরকমা কিছুই করল না স্ট্রেঞ্জার-নির্বিকারভাবে সোজা সামনের দিকে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে প্যাটের জবাবটাই সে মেনে নিয়েছে।

কাঁধ উঁচাল জনসন। সাপ্লাই বাঁটার কাজটা ওকে অন্ধকার হওয়ার আগেই সারতে হবে।

কেবিনটা খুঁটিয়ে দেখল স্ট্রেঞ্জার। দুটো কামরা, পিছন দিকে বাথরূম। সাধারণ মাইনারের ঘর যেমন হয়, এটা তেমন নয়। শক্ত করে তৈরি করা হয়েছে সারা বছর থাকার জন্যে। ভিতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাঁচ বসানো জানালা, বিছানার ওপর চাদর বিছানো রয়েছে। পুরো কেবিন জুড়েই রয়েছে প্যাট জনসনের সুন্দর রুচির ছাপ।

পাশের কামরায় গিয়ে নিজের জিনিসপত্র রাখল সে। মাইনার ঠিকই বলেছিল, অনেকদূর পথ ও পাড়ি দিয়েছে। শুধু একটু নয়, বেশ ক্লান্ত স্ট্রেঞ্জার। কিন্তু সাপারে মহিলারা উপস্থিত থাকবে। মুখের ঘন খোঁচাখোঁচা দাড়ি হাতিয়ে __ লোকটা। ভাবল, কিছুটা পরিচ্ছন্ন হওয়া তার উচিত।

সামনের কামরায় দক্ষিণের জানালার পাশে একটা গামলা আর জগে পানি রাখা রয়েছে। সারাদিন রোদ পেয়ে পানি বেশ গরম হয়ে আছে। অল্প খুঁজতেই সাবান আর ক্ষুর পাওয়া গেল। সাবানটা বাড়িতে তৈরি সস্তা জিনিস না, আমদানি করা দামী সাবান। চমৎকার ফুলের গন্ধ আছে। প্রশংসার দৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকাল অতিথি। বিলাসদ্রব্য বাকিতে বিক্রি করবে না ব্ল্যাকেনশিপ–তাহলে এই উপত্যকায় সত্যিই কিছু সোনা আছে।

কোট আর শার্ট খোলার পর গেঞ্জিটাও খুলে খাটের ওপর রাখল সে। ওর বুকে চোখে পড়ার মত কোন ক্ষতচিহ্ন নেই। পিঠের দাগগুলো চোখে না পড়ে উপায় নেই। মোট পাঁচটা। প্রত্যেকটার ব্যাস আধইঞ্চি, একটার থেকে অন্যটার দূরত্ব সমান। পাঁচটা চিহ্ন চমৎকার একটা ছোট বৃত্ত তৈরি করেছে। ক্ষত অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে বটে, কিন্তু ওগুলো কিসের ক্ষত তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

বুলেটের গর্ত।

জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে পড়েছে স্ট্রেঞ্জারের মুখে। আয়নার দিকে চেয়ে দক্ষ হাতে দাড়ি কামাচ্ছে ও। মুখ থেকে সাবানের ফেনা আর দাড়ি সরে গিয়ে আয়নায় ফুটে উঠছে পরিষ্কার একটা চেহারা। একটু রুক্ষ দেখালেও ওর চেহারায় পৌরুষ আছে।

একটা স্বর শুনে শেভ করার মাঝেই লোকটা থামল। মেয়েলী স্বরটা বাইরে থেকে এসেছে। ঝুঁকে জানালা দিয়ে উঁকি দিল। দেখল দুটো মেয়ে প্যাটের কেবিনের পাশ দিয়ে খোলা জায়গা পেরিয়ে আরেকটা কেবিনে যাচ্ছে। বুঝল ওরাই প্যাটের প্রেমিকা আর তার মেয়ে। কালো একটা বড় লোহার কেতলি দুজনে মিলে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। টেরও পেল না কেউ ওদের লক্ষ করছে।

ওরা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ওদিকেই তাকিয়ে রইল স্ট্রেঞ্জার। এই বুনো গাছ আর পাথর ঘেরা পরিবেশে মেয়ে দুটো একেবারে বেমানান। ওদের উপস্থিতিতে এই এলাকার রুক্ষতা যেন কিছুটা কোমল হয়েছে। কিন্তু তাড়াহুড়া না করলে তার নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে, ভাবল লম্বা লোকটা।

দাড়ি কামানো শেষ করতে আয়নার দিকে ফিরল সে।

.

টেবিলের ওপর প্লেট আর ছুরি-কাঁটা সাজাচ্ছে ওয়ানিতা। সাজানো শেষ করে একটু পিছিয়ে সমালোচকের দৃষ্টিতে নিজের কাজটা যাচাই করে দেখল। মনমত হয়নি। তৃতীয়বারের মত নতুন করে আবার টেবিল সাজাতে ব্যস্ত হলো সে।

ওর মা টেবিলের পিছনে ঢালাই করা লোহার চুলোয় কাঠের আগুনে রান্নায় ব্যস্ত। একটা কাঠের হাতা দিয়ে প্যানের খাবার নাড়ছে ও। মাঝেমাঝে চোখ তুলে ডানদিকের বন্ধ দরজাটার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু পিছনের কামরার দরজা বন্ধই।

মারিয়ার নিজের কেবিনে খাবার পরিবেশন করাটা অনেক সহজ হত। কিন্তু প্যাট গোঁ ধরেছে, ‘অতিথির সম্মান রাখতে তার কেবিনেই সবাইকে সাপার খেতে হবে। প্যানের ভিতর হাতা ডুবিয়ে খাবার নাড়তে নাড়তে ওর মেজাজ আরও গরম হয়ে উঠছে। অতিথি না ছাই! কিন্তু প্যাট অটল। যাক, একবার রাজি হয়ে যাওয়ার পর এখন আর কথা ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। ঝামেলাটা পোহাতেই হবে।

টেবিল থেকে চুলো পর্যন্ত পায়চারি করছে প্যাট। উত্তেজনায় কথা না বলে থাকতে পারছে না বলে নিচু স্বরে কথা বলছে।

‘তুমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না, মারিয়া। মাটিতে পড়ে ছিলাম আমি, ডার্বির পোষা গুণ্ডা তিনজন আমার ওপর চড়ে বসেছে। তারপর মুহূর্তে ওরা নাই হয়ে গেল। ঠিক যাদুমন্ত্রের মত। দেখলাম ওরা মাটিতে গড়াগড়ি করে ককাচ্ছে। ওদের মাথার ওপর পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে বিশাল লোকটা।’ কল্পনার চোখে দৃশ্যটা আবার দেখে শিউরে উঠল মাইনার। ‘একেবারে নির্বিকার-জোরে শ্বাসও ফেলছে না। যেন সামান্য কয়টা তেলাপোকা চেপটা করেছে।’

মারিয়ার চোখ আর মনোযোগ দুটোই বাষ্প ওঠা প্যানের ওপর। প্যাটের | এই অপাত্রে ভক্তি ওর সহ্য হচ্ছে না।

‘তোমার কথা শুনে ম্যাগিল বা টাইসনের চেয়ে ওকে কোন অংশে ভাল মনে হচ্ছে না। চুলোর থেকে প্যানটা তুলে টেবিলের ধারে নিয়ে বাটিতে বাড়তে শুরু করল মেয়েটা।

পায়চারি থামাল প্যাট। ‘অন্তত ওদের সে ভয় পায়নি। ওদের দিকে পিছন ফিরে আমাকে নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে এল ভাবটা এমন যে ওরা যা-ই করুক তোয়াক্কা করে না সে। এখানে আমাদের এমন একজনই দরকার যে ওদের ভয় পায় না।’

শেষ পর্যন্ত টেবিল সাজানোয় সন্তুষ্ট হয়ে মায়ের বন্ধুর দিকে তাকাল ওয়ানিতা। প্যাট জনসনকে ওর ভাল লাগে। লোকটা তারও বন্ধু। যখন থেকে বাবাকে…ঢোক গিলল সে।

‘তুমি ওদের ভয় পাও, প্যাট? আমি জানতাম তোমার ভয় বলে কিছু নেই।’

‘ভয় পাওয়া ওর উচিত,’ প্যাট জবাব দেয়ার আগেই বলে উঠল মারিয়া ‘কিন্তু ও একটা ঢিট লোক।’

‘কিন্তু আমিও ভয় পেয়েছিলাম, মারিয়া। বলতে লজ্জা নেই, ওরা তিনজনই ছিল আমার থেকে বড়, তাছাড়া সাপ্লাই নিয়েও আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু ওদের নয়, আসলে এটা ডার্বির কাজ। সে-ই আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।’ জানালার কাছে গিয়ে বাইরে ক্যানিয়নের দিকে তাকাল মাইনার। প্রায় অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, তবু এখনও কিছু নাছোড়বান্দা লোক ক্রীকের ধারে কাজ করছে। এছাড়া ক্যাম্পের পুরোটাই নীরব। বাম দিকে ঢালের কিছুটা নিচে থেকে স্কিপি স্যামের ব্যাঞ্জোর ঝঙ্কার অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছে। শান্ত আর সুন্দর একটা ক্যানিয়ন।

কেবল ডার্বিই বাগড়া বাধাচ্ছে।

‘হ্যাঁ, একটা কথা তোমাদের বলা হয়নি। শহর থেকে ফেরার পথে উলরিকের সাথে দেখা হলো। এই উপত্যকা ছেড়ে চলে গেল সে। শুধু বলল, ‘যাচ্ছি’, কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা নিজেও জানে না। প্রথম যখন এসেছিল ওর কত স্বপ্নই না ছিল-এখান থেকে সোনা তুলে তা কিভাবে স্যান ফ্র্যানসিসকোতে খরচ করবে, কেবল সেই কথাই বলত। সবচেয়ে দুঃখের কথা ওকে ঠেকাবার মত কোন কথাই আমি খুঁজে পেলাম না।’

‘কীই বা বলতে পারতে?’ মারিয়ার স্বরটা হতাশ। ‘শুধু উলরিক নয়, এই কলোনির সবাই হেরে গেছে। একমাত্র তুমিই তা মানতে চাও না।’

‘আমিও মানি না।’ উদ্ধত ভঙ্গিতে বাইরে উপত্যকার দিকে চেয়ে আছে নিতা। ‘ওরা আমাকে তাড়াতে পারবে না। ডার্বি আর তার লোকজনের শেষ না দেখে আমি যাব না।’

‘চুপ, নিতা!’ প্যাটের দিকে তাকাল মারিয়া। ওর চোখে অভিযোগ। ‘দেখেছ, তুমি কি করছ? যেন আমার নয়, তোমারই মেয়ে। দিনদিন ঠিক তোমার মত কথা বলতে শিখছে। ওকে বোঝাও ডার্বির বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া পাগলামি।’

‘লড়াইয়ের কথা কে বলল?’

‘তুমি বলেছ! তুমিই তো ওই স্ট্রেঞ্জারের লড়ার কথা বলছিলে।’ হাতের চামচটা তুলে বন্ধ দরজাটা দেখাল মারিয়া। ‘কে ও, পিস্তলবাজ? নাকি আরও খারাপ?’

অত্যন্ত রেগে গেলেও প্রেমিকার ওপর চোটপাট করতে পারল না প্যাট। শেলফ থেকে হুইস্কির বোতলটা নামাল। ওটা আসল হুইস্কি-স্যাকরেমেন্টে থেকে আমদানি করা জিনিস। মারিয়াকে ও খুব ভালবাসে বটে, কিন্তু দেখেছে মাঝেমাঝে হুইস্কিও তাকে সমান আনন্দ আর সান্ত্বনা দেয়।

দুটো ছোট গ্লাস বের করে মদ ঢালল সে।

‘ও পিস্তলবাজ হলে আমি খুশিই হব। একটু নিরাপত্তার জন্যে এক তোল সোনা আমি আগ্রহের সাথেই দেব।’

‘নিরাপত্তা? একজন ভাড়াটে খুনীর কাছে তুমি নিরাপত্তা আশা করো?’ অবজ্ঞার সাথে নাক টানল মারিয়া।

ঝট করে ঘুরে তাকাল প্যাট। ‘তুমি কি করে জানো সে খুনী?’

‘তুমিই বা কিভাবে জানো সে তা নয়?’ কথাটা বলে মেয়ের দিকে ফিরল। ‘চলো, নিতা, আমরা বাড়ি যাচ্ছি।’ ভীষণ রাগে বাটিতে বাড়া স্ট্যু আবার প্যানে ঢেলে রাখল মারিয়া।

হুইস্কির বোতল সরিয়ে রেখে মেয়েটার সাথে আপোষ করতে ওকে জড়িয়ে ধরল প্যাট। ‘মারিয়া, আমি বলিনি সে-

‘তাহলে ওকে বিদেয় করো! ডার্বি পাঠালে হয়তো এই ধরনের লোকের সাথে আমাদের যুঝতে হবে, কিন্তু অন্তত এসব আবর্জনার সাথে আমাদের বাস করতে হয় না। ওকে বিদেয় করো।’

‘করব। আমি কথা দিচ্ছি-’

‘আজই!’

‘নিশ্চয়, সাপারের পর ওকে আমি বলব যেন কাল-’

‘কালকে নয়, আজ!’

‘মারিয়া।’ যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল প্যাট। ‘লোকটা আমাকে ডার্বির গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। নইলে এতক্ষণে আমাকে ভাঙা হাড়গোড় নিয়ে ব্ল্যাকেনশিপের পিছনের কামরায় পড়ে থাকতে হত। লেহুডের নাপিত আমার হাড় জোড়া লাগাবার চেষ্টা করত। স্ট্রেঞ্জারকে থাকার দাওয়াত দিয়ে বাসায় এনে কি করে বলি আজ রাতেই বেরিয়ে যাও?’

‘জানি না। অমন লোকের সাথে এক টেবিলে বসে খাওয়াও পাপ! তোমাকে সাহায্য করেছে, ভাল কথা, তবে এর পেছনে নিশ্চয় তার কোন মতলব আছে। সোজা ওর মুখের ওপর-’

পাশের কামরার দরজা খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে স্ট্রেঞ্জার। মৃদু হেসে শান্ত স্বরে সে বলল, ‘উত্তেজিত কথাবার্তা নিশ্চয় আমাকে নিয়ে নয়?’

কামরার ভিতরে ঢুকল বিশাল লোকটা। কেউ কোন কথা বলল না। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। টেবিলের ওপর হুইস্কি ভরা গ্লাস দুটো দেখতে পেয়ে ওদিকে এগিয়ে ধন্যবাদ জানাতে নড করল।

‘আমার আপত্তি নেই।’

একটা গ্লাস তুলে নিয়ে সবটুকু নির্জলা মদ একবারে গলায় ঢেলে দিল। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁটও মুছল না।

কামরার মানুষগুলোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেবিনে যেন হঠাৎ একটা ভালুক ঢুকে পড়েছে। মারিয়া আর নিতার মত প্যাটও একেবারে বোবা হয়ে গেছে। কেবিনে ভালুক ঢুকলেও কি করা দরকার বুঝতে পারত প্যাট-কিন্তু শহরে দেখা স্ট্রেঞ্জারের এই রূপ অকল্পনীয়!

বিশাল লোকটার কোমরে কোল্ট ঝুলাতে দেখবে আশা করেছিল ওরা। কিন্তু একটা ছুরিও নেই। ওর পরনে রয়েছে একটা কালো রঙের শার্ট। ওটার ওপর চড়ানো আছে ধর্মযাজকের কড়া মাড় দেয়া ধবধবে সাদা কলার।

কামরার নীরবতা ভেঙে ধর্মযাজকই আবার কথা বলল।

‘মানুষের খিদে চাঙা করতে এক চুমুক হুইস্কির জুড়ি নেই। আজকের রাতটাও ঠাণ্ডা হবে। শীত আসছে।’ আঙুল তুলে প্যানটা দেখাল ও। ‘চমৎকার স্ট্যু তৈরি করেছ, ম্যাম। ওটা ঠাণ্ডা হতে দেয়া ঠিক হবে না।’

একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছে মারিয়া। রাগের মাথায় চিৎকার করে বলা কথাগুলো সব ধর্মযাজকের কানে গেছে বুঝেই লজ্জায় নড়তে পারছে না। শেষে প্যাটের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সংযত হলো।

‘আমি যা বলেছি সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। আমি…আমি বুঝতে পারিনি-’

‘আশ্চর্য!’ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলে উঠল প্যাট। ধর্মযাজককে গানম্যান বলে ভুল করায় সেও মনেমনে কম লজ্জা পায়নি।

দেখা গেল ওদের মধ্যে কেবল ওয়ানিতারই নড়ার ক্ষমতা আছে। এগিয়ে কাঠের হাতা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি চারটে বাটিতে বেড়ে ফেলল। সবথেকে বেশি স্ট্য ভরা বাটিটা প্রীচারের দিকে এগিয়ে দিল মেয়েটা। দ্রুত হাতে কাজ করছে ও-সাথে ওর মুখটাও সমানে চলছে।

‘এই যে-বিস্কিট,’ বলে প্রায় উড়ে গিয়ে আরও কিছু জিনিস নিয়ে এল। ‘এখানে নুন, আর বিস্কিটের জন্যে মধু। তোমার আর কিছু চাই?’ দম নিতে একটু পাশে সরে দাঁড়িয়ে স্ট্রেঞ্জারের দিকে প্রত্যাশা নিয়ে চেয়ে রইল নিতা।

সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মেয়েটার মন ভরে দিল প্রীচার।

‘হ্যা, একটু সঙ্গ চাই। গত একমাসের মধ্যে ঘোড়া ছাড়া আর কারও সাথে সাপার খাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি।’ দুষ্টুমি ভরা চোখে প্যাট আর মারিয়ার দিকে তাকাল সে। ‘তোমরা আমাদের সাথে যোগ দেবে না?’

নিতার যা যা মনে পড়ছে সব এনে প্রীচারের প্লেটের পাশে জড়ো করছে, অথচ লোকটা খাওয়াই শুরু করেনি।

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়।’ মারিয়ার বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটেছে বটে, কিন্তু নার্ভাস বোধ করছে ও। বহুদিন মাইনার ছাড়া আর কারও সাথে খেতে বসেনি, তাই ভয় পাচ্ছে, মুখ থেকে বেমানান কিছু বেরিয়ে না যায়।

কিন্তু সেই কাজটা তো সে আগেই করে ফেলেছে, তাই না? কথাটা ভেবে আর একবার লজ্জা পেল মেয়েটা।

‘প্যাটকে সাহায্য করার জন্যে আমাদের সবার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আমি মারিয়া ফিশার, আর ও আমার মেয়ে ওয়ানিতা।’

‘তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।’

মারিয়া শুধু লজ্জা পেয়েছে, কিন্তু প্যাট অপ্রস্তুত হওয়ার সাথে বিভ্রান্তও হয়েছে।

‘আমি বুঝতে পারিনি-শহরে ওই লোকগুলোকে তুমি যেভাবে ঘায়েল করলে, তাতে আমি ভাবতেই পারিনি তোমার পেশা-

‘তুমি আমাদের হয়ে গ্রেইস বলবে না?’ বাধা দিয়ে বলল নিতা। অতিথির পাশে বসে নিজের আঙুলগুলো পরস্পরের সাথে আবদ্ধ করে মাথা নোয়াল সে। প্রীচার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মারিয়া আর প্যাটের দিকে তাকাল। বাকি দুটো আসনে বসে ওরাও শ্রদ্ধার সাথে প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাথা নত করল।

‘ঈশ্বর, এই সুন্দর পৃথিবীতে তুমি আমাদের যা দিয়েছ সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। ভাল বন্ধু, শস্য, পানি, গাছপালা, জীবজন্তু, সব তোমারই দান। আজ আমাদের টেবিলে তুমি যা দিয়েছ সেজন্যে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ।’

প্রার্থনা শেষ করল প্রীচার। ওয়ানিতা উজ্জ্বল চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে। চামচের দিকে হাত বাড়াল অতিথি।

‘এমেন!’ দৃঢ় স্বরে বলল নিতা।

হয়তো মারিয়া লজ্জা পেয়েছে, প্যাট হতাশ হয়েছে, কিন্তু ওয়ানিতা জানে ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেছেন। স্ট্রেঞ্জারই কার্বন ক্যানিয়নের মির্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *