নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী – ৭

সাত

খোলা জায়গায় একটা বড় আগুন জ্বলছে কার্বন ক্যানিয়নে। আগুন ঘিরে জড়ো হয়েছে ক্যানিয়নের প্রত্যেকটা মাইনার। সবাই উপস্থিত। গ্রীষ্মের রোদে শুকানো জুনিপারের গনগনে আগুনে সবার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ক্যানিয়নের বাসিন্দাদের মাঝে দৈবচক্রে এসে জোটা স্ট্রেঞ্জার কথা বলছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে ওরা। ডার্বির সবগুলো ক্লেইম কিনে নেয়ার শর্তগুলো বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করে কথা শেষ করল প্রীচার।

বিক্রি করে দেয়ার পক্ষে কার-কার মত আছে জিজ্ঞেস করায় অনেকগুলো হাত আকাশমুখী হলো। কেউ কেউ খুশিতে দুই হাতই তুলল। প্যাট তাড়াতাড়ি গুনে ফেলল ওদের সংখ্যা।

‘প্রস্তাবের বিপক্ষে কে-কে আছে?’ প্রশ্ন করল স্ট্রেঞ্জার।

‘আমি!’ জোর গলায় একক একটা চিৎকার শোনা গেল।

বিরোধিতা কে করল দেখার জন্যে সবাই মুখ ফেরাল। বুড়ো স্পাইডার স্মিথ জায়গা ছেড়ে উঠে আগুনের ধারে এগিয়ে এল। প্রত্যেকটা প্রতিবেশীকে একে একে বিষাক্ত দৃষ্টিতে দেখছে ও।

‘ওহ, ছাড়ান দাও, স্পাইডার, রাত হয়ে যাচ্ছে,’ ক্লান্ত সুরে বলল একজন।

‘হ্যাঁ, আমরা তো ভোট নিয়েছি,’ আরেকজন বলল।

‘আমার কথা আমি বলবই! এখানে সবার প্রথম আমিই এসেছিলাম, এখন দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত একা আমিই থাকব। তাই এই ব্যাপারটায় আমার কি মত তা বলার অধিকার আমার আছে, এবং কথাগুলো শুনতে তোমাদের ভাল না লাগলেও শুনতে হবে।’

কয়েকজন ককিয়ে ওঠার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাল। আবার কিছু লোক খোলা মন নিয়ে পুরোনো লোকের বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় রইল।

আগুনের চারপাশে ঘুরেঘুরে কথা বলে নিজের অনুভূতি আর যুক্তি শ্রোতাদের সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে স্পাইডার।

‘সেই ‘৫৫ থেকে শুরু করে ডার্বি আর আমি মাইনিঙের কাজ করছি। ওর চিন্তাধারা কোন্ পথে চলে তা আমি যতটা জানি, ওর ছেলেও ততটা জানে না। আমাদের ক্লেইমগুলো ও কেন কিনতে চাচ্ছে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ডার্বি লোভী হতে পারে, কিন্তু বোকা নয়।’

‘তা আমরা সবাই জানি,’ বিরক্ত হয়ে স্যাম বলে উঠল। ‘তোমার যদি সত্যিই কিছু বলার থাকে, তবে সেই কথায় আসো।’

ঘুরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বক্তার দিকে তাকাল বুড়ো। ‘তুমি কাজের কথা শুনতে চাও? তাহলে শোনো। ডার্বি যদি প্রত্যেকটা ক্লেইমের জন্যে এক হাজার ডলার দিতে রাজি থাকে-যেগুলো থেকে দুএক আউন্সের বেশি সোনা পাওয়া যায়নি সেগুলোও বুঝতে হবে দয়া করে সে টাকা দিচ্ছে না। ওর হৃদয়ে দয়ামায়ার কোন স্থান নেই। কেবল একটা কারণেই লোকটা টাকা হাতছাড়া করতে পারে, যদি ও জানে যা দিচ্ছে তার দশগুণ ফেরত পাবে!’

শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে ওরা। বোঝা যাচ্ছে ওদের কারও মাথায় এই চিন্তাটা আসেনি। কথাটা নিঃসন্দেহে যুক্তিসঙ্গত।

‘তোমার যুক্তিটা আমি অস্বীকার করছি না, স্পাইডার,’ বলে উঠল হেণ্ডারসন। ডার্বি যেভাবে মনিটর দিয়ে কাজ করে তাতে ওর জন্যে প্রত্যেকটা ক্লেইমের দাম হাজার ডলারের বেশিই হবে।

‘কিন্তু আমরা যেভাবে মাইনিঙ করি তাতে সারা বছরেও এত টাকা পাই না। পেলেও একসাথে হাতে আসে না। বেলচা চালাতে চালাতে ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে পড়েছি আমি। শীত খুব কষ্টে কাটে-টেবিলে মাংস দিতে পারি না। এখানে আগামী শীত কাটানোয় আমার মোটেও আগ্রহ নেই। আমি বলি প্রস্তাবটা আমাদের গ্রহণ করাই ভাল। অন্য কোথাও গিয়ে আমরা আবার চেষ্টা করার সুযোগ পাব।’

ক্যাম্পের অনেকেই হেণ্ডারসনের সাথে একমত। কিন্তু স্পাইডার হাল ছাড়তে নারাজ।

‘নতুন করে শুরু করার কথা বলছ? কোথায় যাবে? বর্তমানে দেশের প্যাস্যার সোনা প্রায় সবই ফুরিয়ে এসেছে, যা আছে তাও আর কেউ ক্লেইম করে নিয়েছে। এখন সোনা যা আছে তা এইসব পাথরের ভিতরেই আছে। একটু কষ্ট করে পেতে হবে।

‘তোমরা নিজের ক্লেইমের দাম ঠিক বুঝতে পারছ না। আজ সকালে প্যাট যে বড় নাগিটটা পেল, সেটা কি?’

‘দৈবাৎ ঘটনা,’ বলে উঠল হেণ্ডারসন। ‘ওর পাশের ক্লেইমটাই তো তোমার-তুমি কী পেয়েছ?’

‘মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ,’ জবাব দিল স্পাইডার। শ্রোতাদের মধ্যে দুজন শব্দ করে হেসে উঠল। ‘তোমাদের আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি-সোনা এইখানেই আছে। প্যাট্রিক যেমন পেয়েছে, ঠিক ওই রকম। উপরের আস্তরটা সরিয়ে আমাদের কেবল নিচে ঢুকতে হবে। তবেই আমরা সোনা পাব।’

‘ঘোড়ার ডিম পাব!’ মন্তব্য করল একজন।

‘ঠিক আছে।’ এবার অন্য লাইনে কথা শুরু করল স্মিথ। ‘তাহলে আমার একটা কথার জবাব দাও—তুমি যদি হঠাৎ হাজার ডলারের নাগিট তোমার ক্লেইম থেকে পেয়ে যাও; তুমি কি ওই টাকা নিয়েই ক্লেইম ছেড়ে চলে যাবে? নাকি পাওয়ার আশায় আরও খুঁড়বে?’

মাইনাররা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত হলো। জেক হেণ্ডারসনের মত আরও কিছু লোক চলে যাওয়ার পক্ষপাতী। ওরা কঠিন পরিশ্রম করেও প্রতিদানে তেমন কিছুই পায়নি তাই নিরাশ হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় দলের কাছেও ডার্বির প্রস্তাবটা লোভনীয় ঠেকছে, কারণ একদিকে ক্যাশ টাকা, অন্য দিকে নিছক অনিশ্চিত আশা। দাঁড়িপাল্লায় কোন্ দিক ভারি হবে বোঝা কঠিন।

স্পাইডার কান পেতে ওদের যুক্তিতর্ক শুনে হাওয়া কোন্ দিকে বইছে অনুমান করার চেষ্টা করছে। একটা নতুন চিন্তার উদয় হওয়ায় লম্বা স্ট্রেঞ্জারের দিকে চেয়ে সে বলল, ‘তুমি তো আমার বক্তব্য শুনেছ, ওদের যুক্তিও শুনলে- এখন তোমার কি মত? আমাদের কি করা উচিত?’

প্রশ্নটা শুনে জবাবের প্রতীক্ষায় প্রত্যেকে মুখ তুলে প্রীচারের দিকে তাকাল। গাছের গুঁড়ির ওপর বসা লোকটা অল্পক্ষণ ভেবে নিয়ে প্রথমে স্পাইডার আর জেককে একবার দেখে নিয়ে পরে বাকি মাইনারদের দিকে ফিরল।

‘এখানে আমার মতামতের কানা-কড়িও দাম নেই। ডার্বি তোমাদের জমি কিনছে। আমি বাইরের মানুষ, ক্যানিয়নে এক চিলতে জমিও আমার নেই। তাই এই ব্যাপারে কথা বলতে যাওয়া আমার সাজে না।’

কিন্তু মাইনাররা প্রীচারের কাছে এই উত্তর শুনতে চায়নি। নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই চাইছে আর কেউ ওদের সমস্যার সমাধান দিক

‘তুমি যিশুর মানুষ, তুমিই আমাদের পথ দেখাও,’ দাবি জানাল ওরা।

‘আজকের রাতটা ভেবে দেখে আগামীকাল সকালে সিদ্ধান্ত নেয়াই হয়তো তোমাদের উচিত। নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চট করে একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলা ঠিক হবে না।’

কিছু লোক প্রীচারের উপদেশ শুনতে রাজি হলেও স্পাইডার মানল না।

‘আমরা যদি কাল সকালেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারি?’ বলল সে। ‘ইদানীং আমাদের কপাল মন্দ যাচ্ছে। আমরা হয়তো অনন্তকাল কেবল যুক্তিতর্কই চালিয়ে যাব। কিন্তু এত সময় আমাদের হাতে নেই।’

‘হ্যাঁ, তোমাদের সময় সত্যিই কম,’ স্বীকার করল প্রীচার।

‘কালও আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলে কি ঘটবে? রাইডার পাঠিয়ে আরও ভাঙচুর করবে ডার্বি?’ প্রশ্ন করল জেক।

অন্যমনস্ক ভাবে একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটছে প্রীচার। একটু ইতস্তত করে শেষে বলল, ‘না, আরও খারাপ কিছু করবে। ও বলেছে, তোমরা চলে না গেলে ইউ এস মার্শালকে খবর দিয়ে আনাবে।’

‘আমরাও তো তাই চাই,’ বলে উঠল প্যাট। ‘আইনের লোক এলে আমরা তার কাছে নালিশ জানাতে পারব। এটা আবার কেমন হুমকি? আইনকে ভয় পাব কেন?’

‘তুমি বুঝতে পারছ না।’ প্রীচার মুখ তুলে বন্ধুর দিকে তাকাল। ‘আইন দুরকম। একটা লিখিত আইন, অন্যটা বড়লোক আর ক্ষমতাশালী লোকের সুবিধার জন্যে তৈরি বাঁকা আইন। যে বেশি গরীব, তার জন্যে ওই আইন তত বেশি বাঁকা। যেকোন সাধারণ মার্শালকে আনার কথা ভাবছে না ডার্বি।’

স্ট্রেঞ্জারের গলার স্বর উদ্ধত স্পাইডারকেও দমিয়ে দিল।

‘তুমি কি বলতে চাও?’ প্রশ্ন করল মাইনার। ‘ডার্বি কেমন মার্শাল আনাতে চাচ্ছে?’

‘লোকটার নাম স্টকবার্ন। কিন্তু ওর সম্পর্কে যে না জানে সে বুঝবে না ও কি ধরনের জঘন্য মানুষ। জানি না ও কিভাবে ইউ এস মার্শালের পদ পেল।

পৃথিবীতে সব কিছু ভালর জন্যে ঘটে না।

‘মার্শালকে এখানে আনালে সে একা আসবে না, সাথে ওর ছয়জন ডেপুটিও আসবে। ওরা টাকা পেলে করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। খুনই ওদের পেশা।’ নীরবে কিছুক্ষণ লোকজনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে স্ট্রেঞ্জার আবার বলল, ‘আমি কথাটা তোমাদের জানালাম, কারণ ডার্বির প্রস্তাব তোমরা গ্রহণ না করলে ওই লোকগুলোর মোকাবিলা তোমাদেরই করতে হবে।’

প্রীচারের কথা শুনে সবাই একেবারে চুপ হয়ে গেছে। ওদের সমস্যার সাথে আরও একটা নতুন উপাদান যোগ হয়েছে-ভয়।

অন্যান্য মাইনারদের মত স্পাইডারও হতভম্ব হয়ে গেছে। এই ধরনের একটা পরিস্থিতি যে দাঁড়াতে পারে, তা ও কল্পনাও করতে পারেনি।

‘তুমি এমন ভাবে কথা বলছ যেন ওই লোকটা সম্পর্কে তোমার মনে কোন সন্দেহ নেই। স্টকবার্নকে তুমি চেন?’

‘ওর কথা আমি শুনেছি,’ নরম সুরে বলল স্ট্রেঞ্জার।

আগুনের চারপাশে মাইনাররা ব্ধ হয়ে বসে আছে। এবার প্যাট্রিক সবার মাঝখানে এসে দাঁড়াল।

‘ঠিক আছে, এখন আমরা জানি কিসের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। আমার মতে ডার্বির অফারটা অত্যন্ত নীচ। ও কেবল প্রস্তাব দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বলছে, প্রস্তাবটা গ্রহণ করো, নইলে! মানুষকে জমি কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া এক কথা, আর ঘাড় চেপে ধরে বাধ্য করা-না, এটা মোটেও ঠিক না।’

শ্রোতাদের অনেকেই প্রতিবাদ করে উঠল। একজন বলল, ‘আমরা সংসারী মানুষ, প্যাট।’

‘হ্যাঁ,’ আরেকজন সায় দিল, ‘সাতজন গানম্যানের বিরুদ্ধে আমরা কোন্ ভরসায় দাড়াব?’

‘বুলশিট!’ সবার দিকে ঘুরেঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে দেখল জনসন। আগুনের কাঁপা আলোয় ওকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। আগের সেই পরিচিত নম্রতা আর সদা হাসিখুশি ভাবটা এখন আর নেই। স্বরে আত্মপ্রত্যয় আর হাবভাবে অপ্রত্যাশিত দৃঢ়তা এসেছে।

‘আমরা এখানে কতজন আছি? ছাব্বিশ! তোমাদের আর সবার মত আমিও প্রীচারের বক্তব্য শুনেছি। আমি জানি যাদের কথা ও বলেছে তারা পেশাদার। আমি বুল্ রান আর শাইলোতে লড়েছি। তোমাদের মধ্যে সবাই কোন না কোন যুদ্ধে লড়েছ। একজন মার্শালের ভয়ে তোমরা কি নিজের ঘরদোর ছেড়ে পালাবে? জেক, তুমি তো ম্যানাসাসে লড়েছ, তাই না?’ ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে কথাটা স্বীকার করল হেণ্ডারসন।

‘আর বাড—তুমি ছিলে মোবাইলের ফ্যারাগাটে। তুমি কি সামান্য কয়েকজন ভাড়াটে পিস্তলবাজের ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালাবে?’ বাড ট্রেভার কোন মন্তব্য করল না। মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইল। ‘তোমরা সবাই জ্যাকসন, গ্রান্ট আর লীর জন্যে লড়েছ। এবার নিজের জন্যে লড়ার সময় এসেছে।’

‘ওটা অনেকদিন আগের কথা, প্যাট, শান্ত স্বরে বলল বাড। ‘তখন আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে ছিল না-তাছাড়া আমাকে কি করতে হবে বলে দেয়ার জন্যে গ্রান্ট এখানে আসবে না। আর আমাদের পিছনে কামান আর ঘোড়-সওয়ার দলের সহায়তাও থাকবে না।’

‘ভিক্সবার্গে আমাদের কামান ছিল না,’ বলে উঠল একজন। ‘কোন ব্যাকিঙ ছাড়াই আমরা সোয়াম্পের ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এগিয়েছি।’

অনেকেই কথাটাকে সমর্থন করল। উত্তর আর দক্ষিণের যুদ্ধে ওরা সবাই অস্ত্রের ব্যবহার শিখেছে। এখন বয়স বেড়েছে, অনেকে সংসারীও হয়েছে-কিন্তু যা শিখেছে তা কেউ ভোলেনি।

ওরা ছিল সাধারণ পদাতিক সৈনিক। কিন্তু এখন ওদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে দক্ষ পেশাদার দাঙ্গাবাজ।

বাড ট্রেভার হাত তুলে মাইনারদের চুপ করাল। ‘আমার ক্লেইম থেকে যদি কেউ আমাকে গায়ের জোরে তাড়াতে চায় তবে আমি যাওয়ার আগে শেষ পর্যন্ত লড়ব। কিন্তু ডার্বি আমাদের ঠিক তাড়াচ্ছে না, ন্যায্য দাম দিয়েই ক্লেইম কিনে নিতে চাচ্ছে। কেবল নিজের কথা ভাবলে আমার চলবে না, বউ ছেলেমেয়ের কথাও ভাবতে হবে। ওরা যুদ্ধে যায়নি। তাই আমি টাকা নিয়ে অন্যখানে নতুন করে শুরু করারই পক্ষপাতী।’

ট্রেভারের যুক্তি মাইনারদের মধ্যে নতুন করে বিতর্কের ঝড় তুলল। নিজের কথা সবার কানে পৌছাতে জনসনকে চিৎকার করতে হলো।

‘আমরা এখানে কেন এনেছি? পরের গোলামি না করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই বলেই এসেছি। টাকাই যদি আমাদের মূল উদ্দেশ্য হয় তবে ডার্বির থেকে আমরা ভাল হলাম কিসে?’ কথাটা সবার মনে বসার জন্যে একটু থামল প্যাট।

আগুনের খুব কাছে বসেছে স্পাইডার। একটা জুনিপারের ডাল আগুনে ছুঁড়ে দিল সে। কিছু ফুলকি উড়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। বয়সের দিক থেকে ওকে জরায় ধরার সময় এসে গেছে। কিন্তু মনের দিক থেকে ও এখনও যুবক।

হাত তুলে বুড়োকে দেখিয়ে জনসন আবার বলল, ‘স্পাইডার প্রশ্ন করেছিল হঠাৎ হাজার ডলারের সোনা পেলে আমরা কি করব। না, কেউই ক্লেইম ছেড়ে চলে যাব না। ভাল বাড়ি বানাব, বাচ্চাদের জন্যে নতুন জামা-কাপড় কিনব। হয়তো,’ আড়চোখে প্রীচারের দিকে তাকাল প্যাট, ‘একটা স্কুল বা চার্চ তৈরি করব। সোনা আমরা তুলব বটে, কিন্তু সোনাই আমাদের সব নয়। সবাই মিলে সুন্দর একটা সুস্থ পরিবেশে বাঁচতে চাই।’

বাড, হেণ্ডারসন, মরিস আর অন্যান্য মাইনাররা নীরবে প্যাটের কথা শুনছে। বুঝতে পারছে ওরা আলাপের যেদিকটা এড়িয়ে গেছে বক্তা এখন সেটার কথাই বলবে।

‘এই ক্যানিয়নটাই আমাদের বাড়ি, আমাদের স্বপ্ন,’ বলে চলল জনসন। এখানে আমরা সোনার খোঁজে এসেছি বটে, তবে এখানে আমাদের বাসও করতে হবে। এখানেই আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হবে। জানি, এটা এমন কিছু ভাল জায়গা নয়, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে আমাদের আগে যা ছিল তারচেয়ে এটা অনেক ভাল।

‘এই মাটিতেই প্রিয়জনদের আমরা কবর দিয়েছি। এটা ওদেরও স্বপ্ন ছিল। আমরা কি হাজার ডলারের বিনিময়ে ওদের এখানে অনাদরে ফেলে রেখে চলে যাব? আমাদের মর্যাদার দাম কত? এক হাজার, দুহাজার, নাকি যা পাওয়া যায় তাই?

‘বাড ট্রেভারের কথা যদি ঠিক হয়, এবং এর থেকে ভাল জায়গা যদি আমরা আর কোথাও খুঁজে পাই-সেখানেও ডার্বির মত লোভী আর কারও চোখ পড়বে-তখন আমরা কি করব? আমার মতে ডার্বির মত লোকজনের বিরুদ্ধে এখনই আমাদের রুখে দাঁড়ানো উচিত।’

প্যাট স্বল্পভাষী মানুষ। ভাবাবেগে এতগুলো কথা বলার পর নিজেকে সবার মাঝখানে আবিষ্কার করে অপ্রস্তুত হলো।

এবার স্পাইডার লাফিয়ে উঠে ওর পাশে এসে দাঁড়াল।

‘আমি বলব জাহান্নামে যাক ডার্বি!’ ঘুরে সবার দিকে তাকাল সে। ওদের সবাই বয়সে বুড়োর চেয়ে অনেক ছোট, শক্তিও বেশি। এটা স্পাইডারের মত ওরাও জানে—তাই লজ্জা পাচ্ছে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাড ট্রেভার মাঝখানে এগিয়ে এল।

‘আমি সাহসী নই, কিন্তু তাই বলে কাপুরুষও নই। পিকেটের যুদ্ধ থেকে আমি পালাইনি, ডার্বির মত লোকের ভয়েও পালাব না। আমরা ঝুঁকি নিয়ে চলে বর্তমানে মোটামুটি ভালই আছি। এখন সব হারাতে চাই না।’ প্রতিবেশী আর বন্ধুবান্ধবের মাথার ওপর দিয়ে দূরে পাহাড়গুলোর দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে চেয়ে সে বলে চলল, ‘প্যাট যা বলেছে সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। দেড় বছর হলো আমি -এখানে এসেছি, কিন্তু কার্বনকে আমি ভালবাসি। ডার্বির মনিটর জমির কতটা ক্ষতি করছে তা আমি দেখেছি। কার্বন ক্যানিয়নকে ওই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে আমি পারব না।

‘তাই আমি ডার্বির প্রস্তাবের বিপক্ষে রায় দিচ্ছি। প্যাট ঠিকই বলেছে, জমি বেচে দিলে সোনার চেয়েও দামী জিনিস আমরা হারাব। ক্যানিয়ন রক্ষা করার জন্যে আমাদের চেষ্টা করা উচিত।’

‘লাথি মারো ওর টাকায়, ডার্বির টাকা আমি চাই না,’ চেঁচিয়ে উঠল মরিস।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সবথেকে কম বয়সী মাইনার ডোনাল্ড। বয়সে ওয়ানিতার চেয়ে বেশি বড় হবে না ও। উত্তেজিত চোখে সবার দিকে একবার চেয়ে সে বলল, ‘আমি কক্ষনো আমার ক্লেইম ছাড়ব না! নিজস্ব বলতে আমার কেবল এটাই আছে। এখান থেকে কেউ আমাকে তাড়াতে পারবে না!’

‘জাহান্নামে যাক ডার্বি!’ সমস্বরে সবাই বলে উঠল।

‘হ্যাঁ…আমার একটা রাইফেল আছে! আসুক ওরা…আমরা কুকুরগুলোকে স্যাকরেমেন্টো পাঠিয়ে দেব!’

উল্লসিত হয়ে উত্তেজিত লোকজন আগুন ঘিরে নাচতে শুরু করল। কেবল একজন কাঠের গুঁড়ির ওপরই বসে রইল। একে একে সবাইকে লক্ষ করছে প্রীচার। মাইনাররা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে-নেচে মনের ভয় কাটাবার চেষ্টা করছে ওরা।

কিন্তু স্ট্রেঞ্জার জানে, কেবল উৎসাহ দিয়ে স্টকবার্ন আর তার ডেপুটিদের ওরা ঠেকাতে পারবে না। বেদনায় ভরে উঠল প্রীচারের চোখ। এই সরল লোকগুলো বুঝতে পারছে না কী ভয়ানক বিপদে ওরা জড়িয়ে পড়ছে।

নাচে উন্মত্ত মাইনাররা কেউ খেয়াল করল না কখন আগুনের পাশ থেকে দূরে সরে গেল প্রীচার। কোন বিশেষ গন্তব্য ওর নেই। চাঁদের আলোয় পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছে না। মাথার উপরে একটা প্যাঁচা উড়ছে। শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে ওটা তীক্ষ্ণ চোখে নিচের দিকে চেয়ে আছে। একটা শিয়ালের গোলগোল দুটো চোখ ঝোপের আড়াল থেকে স্থির দৃষ্টিতে লম্বা লোকটার গতিবিধি লক্ষ করছে।

শিয়ালটা ভেবেছিল ঝোপের আড়ালে ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ আবিষ্কার করল লম্বা লোকটা সরাসরি ওরই চোখের দিকে চেয়ে আছে। ভীষণভাবে আঁতকে উঠে চোখের পলকে ঝোপের ভিতর দিয়ে জঙ্গলের আরও গভীরে ছুটে পালাল।

একটা পাইন-কোন্ পাথরের সাথে ঘষা খেলো। শব্দটা খুব হালকা হলেও প্রীচারের কানে ধরা পড়ল। ঢালের মাথায় পাইন গাছে ঘেরা একটা ছোট ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছেচে ও। ঘুরে দেখল একজন ওকে অনুসরণ করছে।

পিছন থেকে চাঁদের আলোয় একটা মেয়েলি আকৃতি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মেয়েটা মাথার ওপর উঁচু করে চুল বেঁধেছে। ওকে চিনতে পেরে অবাক হলো প্রীচার।

ওর থেকে মাত্র দশ ফুট দূরে থেমে দাঁড়াল মেয়েটা। সবথেকে উঁচু পাইন গাছটার গোড়ার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।

‘আমার কুকুরটাকে ওইখানে কবর দিয়েছি,’ অস্ফুট স্বরে জানাল নিতা।

‘তাহলে তো এটা এখন পবিত্র-ভূমি,’ সরল একটা হাসি দিল প্রীচার। ‘তাই না?’

একটু ইতস্তত করল ওয়ানিতা। লোকটা ঠাট্টা করছে না বুঝে আরও কাছে এসে সে বলল, ‘কবর দিয়ে ওর জন্যে আমি প্রার্থনা করেছিলাম। ও খুব ভাল ছিল, কখনও কাউকে বিরক্ত করেনি।’ চাঁদের আলোয় মেয়েটার ভেজা চোখ চকচক করছে। ‘বাইবেলে বলে জন্তুরা স্বর্গে যায় না। জীবজন্তু না থাকলে স্বর্গে থাকতে আমার ভাল লাগবে না।’

‘বাইবেলের কথা অনেক রকম ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমার বিশ্বাস কুকুরটা ভাল হলে ওখানে একদিন তুমি ওর দেখা পাবে। কি হয়েছিল ওর?’

‘ডার্বির লোকজন ওকে মেরেছে। মারার কোন কারণ ছিল না-ছোট্ট একটা বাচ্চা কুকুর ওদের কি ক্ষতি করতে পারত? বিকৃত একটা আনন্দ পাওয়ার জন্যেই ওরা পাপিকে মেরেছে। ওরা কেন এমন করল, প্রীচার?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দূরের টিলাটার দিকে তাকাল স্ট্রেঞ্জার। ‘কিছু মানুষ ভুলে যায় তারা এই পৃথিবীরই মানুষ। ভাবে, উপরের একটা স্তরে বাস করছে ওরা। ভুল যখন ভাঙে তখন টের পায় অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওটা কবেকার ঘটনা?’

‘গত রেইডে। ওই দিনই পাপিকে কবর দিতে এসে আমি একটা মিরাকলের জন্যে প্রার্থনা করেছিলাম।’

প্রীচারের দৃষ্টি নিতার ওপর ফিরে এল। ‘হয়তো যা চেয়েছিলে তা তুমি একদিন পাবে। মির‍্যা চোখের সামনে দেখেও অনেকে চিনতে পারে না। সারাজীবন খুঁজেও তারা মির‍্যা দেখতে পায় না। তাই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে দৈবের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে, নিজের যা ক্ষমতা আছে সেটা সম্বল করেই জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া ভাল।’

‘আমি যেদিন প্রার্থনা করেছিলাম সেদিনই তুমি ক্যানিয়নে এসেছ।’

প্রীচারের হাসিটা বিশদ হলো। ওয়ানিতা বুঝতে পারছে লজ্জায় ওর মুখ আরক্ত হয়ে উঠছে। লম্বা লোকটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কথাটা সে বলেই ফেলল।

‘আরও একটা কথা আছে।’

‘কি, নিতা?’

‘আমার মনে হয় তোমাকে আমি ভালবাসি।’

কথাটা শুনে প্রীচার একটুও অবাক হলো না। ‘এতে দোষের কিছু নেই। এই পৃথিবীতে যদি আরও ভালবাসা থাকত তবে মানুষের জীবন অনেক সুন্দর হতে পারত। অনেকেই কথাটা বুঝতে চায় না।’

‘ভালবাসা যদি দোষের কিছু না হয়, তাহলে মিলনেও নিশ্চয় দোষ নেই?’

ওই প্রশ্নে থমকে, জবাবটা সাবধানে মনেমনে গুছিয়ে নিল প্রীচার।

‘আমার মনে হয় ভালবাসাটাই আগে ভাল করে আয়ত্ত হওয়ার পর দ্বিতীয়টার কথা ভাবা উচিত। অনেকেই কথাটা বোঝে না, তাই যখন দেখে সবকিছু মনের মত করে এগোচ্ছে না তখন ভীষণ আঘাত পায়। আপাত দৃষ্টিতে যত সহজ মনে হয়, ব্যাপারটা আসলে তত সহজ নয়।’

‘তাহলে আমি কিছুদিন প্রথমটা প্র্যাকটিস করলে, তুমি দ্বিতীয়টা আমাকে শেখাবে?’

‘বেশির ভাগ মানুষই ওটার জন্যে বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করে।’

‘কিন্তু আমার বয়স সতেরো। আমার মা ষোলো বছর বয়সেই বিয়ে করেছিল।’

লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে গাছের দিকে তাকাল সে। ‘সামনের মাসে আমি এখানে থাকব না।’

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল নিতার মুখ। ‘কেন?’

যতটা সম্ভব নরম করে কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করল প্রীচার। ‘আমার যেতেই হবে, নিতা। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।’

এক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা। অবিশ্বাসে মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়ছে। চোখ দুটো পানিতে ভরে উপচে গাল বেয়ে গড়িয়ে নামল।

‘তুমি যেয়ো না। আমি-আমি তোমাকে হারাতে চাই না!’

‘আমিও যেতে চাই না। কিন্তু তবু যেতে হবে। এটাই নিয়ম। তোমাকে বুঝতে হবে মানুষ যা চায়, আর মানুষকে জীবনে যা করতে হয়-দুটো পুরোপুরি ভিন্ন জিনিস। এটা মানুষের পরিণত হয়ে গড়ে ওঠার একটা অঙ্গ।’

ফুঁপিয়ে উঠে মেয়েটা ওকে শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।

‘তোমাকে যেতে দেব না!’

চোখ নামিয়ে নিতার দিকে তাকিয়ে হাসল প্রীচার। ‘এমন করলে তুমি কোনদিন পরীক্ষায় পাস করবে না।’

‘কিসের পরীক্ষা?’

‘তোমাকে বলিনি?’ মাথা নাড়ল নিতা। কথা বলার সময়ে কোমল ভাবে মেয়েটাকে ধরে থাকল স্ট্রেঞ্জার। ‘যদি কাউকে সত্যি ভালবাস, তবে তাকে মুক্ত করে দাও। তোমার কাছে আবার ফিরে এলে ও তোমার। যদি না ফেরে তবে সে কোনদিনই তোমার ছিল না। ভালবাসা যাচাই করার অনেক উপায় আছে, তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভালবাসা যাচাই করার এটাই সবথেকে ভাল উপায়।’ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু পিছনে সরে দাঁড়াল প্রীচার।

‘তোমার বয়স যত বাড়াবে তুমি টের পাবে অনেক ভালবাসার ধনকেই তোমার মুক্তি দিতে হচ্ছে। ছাড়তে মন চাইবে না, কারণ হারাতে ব্যথা লাগে। কিন্তু সত্যিকার ভালবাসার এটাই চূড়ান্ত পরীক্ষা। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু জরুরী। তাই এটা তোমাকে শিখতে হবে।’

‘কিন্তু আমি তোমাকে যেতে দিতে চাই না! আমি চাই তুমি চিরদিন আমার সাথে থাকো।’

‘বিশ্বাস করো, নিতা, আমি বুঝি। কিন্তু এ হবার নয়। আমরা যত একান্ত . ভাবেই চাই না কেন, সবকিছু আমরা ধরে রাখতে পারব না। এখন ব্যথা লাগবে বটে, কিন্তু আমি জানি একদিন সব সয়ে যাবে। তখন এসব আর বড় বলে মনে হবে না।

‘আমার কাছে তুমি ভালবাসা শিখতে চেয়েছিলে-জীবনে আরও অনেক শিক্ষার মত এখন যা শেখালাম সেটা তোমার ভাল লাগবে না। কিন্তু এটাই বাস্তব।’ হেসে মেয়েটার পিছনে গাছগুলোর দিকে তাকাল প্রীচার।

‘আমি তোমার মা হলে কোথায় আছ ভেবে এতক্ষণে চিন্তায় পড়ে যেতাম।’ নিচু হয়ে নিতার কপালে সস্নেহে একটা চুমো খেলো লম্বা লোকটা। কিন্তু ওয়ানিতা অন্য উদ্দেশ্যে ওকে অনুসরণ করে এখানে এসেছিল। আরও কিছু চেয়েছিল। ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর-কিন্তু কার ওপর বা কেন রাগ হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।

হঠাৎ ঘুরে ছুটে পালাল নিতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *