দুর্গম পথের যাত্রী – ৬

মক্কার চারদিকে সাজসাজ রব পড়ে গেল। প্রতিটি যুবক ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো অস্ত্র হাতে। তাদের অন্তরে মক্কার মর্যাদা রক্ষার সংকল্প। আপন ধর্মের সম্মান রক্ষার সংকল্প। সর্বোপরি নিজেদের সহায়-সম্পদ এবং আপন নারীদের ইজ্জত রক্ষার দৃঢ় সংকল্প। ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) আসছে’ এ খবর বিদ্যুতের মতো সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। আবু সুফিয়ান ও মক্কার বিভিন্ন গোত্রের নেতারা বৈঠকে বসল আসন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার উপায় ঠিক করার জন্য। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় বৈঠক করার মতো ধৈর্য অনেকেরই ছিল না। যুবকরা নেতাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে নিজেরাই সংগঠিত হতে লাগল। নেতাদের একজন বলল—’এটা কী করে হয়? মুহাম্মদের এত সাহস, সে মক্কা আক্রমণ করতে আসছে।’

অন্য একজন বলল—’এতে অবাক হওয়ার কী আছে! তাঁর জন্মভূমি থেকে তাকে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন সে হয়তো মনে করছে, তাঁর এমন শক্তি হয়েছে যে, সে আমাদের সাথে টক্কর দিয়ে এখানে থাকতে পারবে।’

‘তোমাদের এমন পণ্ডিতি আলাপ রাখো। কী করে তাঁর মোকাবিলা করবে সে কথা বলো।’ বলল আবু সুফিয়ান।

এক প্রবীণ সরদার দাঁড়িয়ে বলল—’সৈন্যদের দুর্গ থেকে বের করে শহরের চারদিকে অবস্থান নিতে বলুন আর সারা শহরের শিশু ও মহিলাদের দুর্গে ঢুকিয়ে তাদের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখুন।’ আবু সুফিয়ান বৈঠক দীর্ঘায়িত না করে মক্কার সব শিশু ও মহিলাদের দুর্গে ঢুকিয়ে দিলো। কিন্তু যুবতিরা দুর্গে ঢুকতে অস্বীকার করে বসল। তারা দলবেঁধে মক্কার অলিগলিতে যুদ্ধের গান গাইতে লাগল। মহল্লার প্রতিটি গলিতে, গলির মোড়ে মোড়ে জটলা করে যুবতিরা উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে যুবকদের মনে আগুন ধরিয়ে দিতে চাইল। মক্কার প্রতিটি ঘর খালি হয়ে গেল। শিশু ও মহিলারা সবাই দুর্গে অবস্থান নিয়েছিল। যুবতিরা গান গাইছিল রাস্তায়। যুবকরা অস্ত্র হাতে নেমে পড়ল মক্কার নিরাপত্তায়। যারা অস্ত্র হাতে নিতে পারল না, বসে রইল না তারাও। তারা নানা রকম খাদ্যদ্রব্য এনে রাস্তার যুবতিদের ও সৈনিকদের খাবার ও পানি সরবরাহ করছিল।

খালিদের মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত ও তৎপর হতে হয়েছিল খালিদকে। সে তাঁর বন্ধু আকরামাকে বলল—’আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্ত শোনার দরকার নেই। বংশানুক্রমে মক্কার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব আমাদের পরিবারকেই পালন করতে হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের কারও গায়ে কলঙ্কের কালি নেই। সর্বশেষ এ দায়িত্ব পালন করেছেন আমাদের পিতা। এখন এ দায়িত্ব আমার কাঁধে বর্তেছে। আমি আমার বংশের মুখে ছাই পড়তে দেবো না। আচ্ছা আকরামা, মদিনার মুসলমানদের মতো আমরাও মক্কার চারদিকে পরিখা খুঁড়লে কেমন হয়?’

‘না খালিদ, খন্দকের কথা ভুলে যাও। মুহাম্মাদের হাজার দেড়েক সৈন্যকে নিয়ে এত পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। তাঁরা পথশ্রমে ক্লান্ত, অস্ত্রশস্ত্রও তাঁদের নিতান্তই অল্প। সামনাসামনি লড়াই করে তাঁদের নিশ্চিহ্ন করার মওকা আমি নষ্ট করতে চাই না।’

‘আকরামা, মুহাম্মাদের মনে কী আছে জানা নেই আমার? তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশলকে আমি খাটো করে দেখতে চাই না। তুমি যদি খন্দক খোঁড়ার পক্ষে মত না দাও, তবে আমি ভিন্ন পথে এগোব। সামনাসামনি লড়াই করে তাদের কাবু করার তোমার চিন্তার চাইতে এ পথ অনেক নিরাপদ ও ফলপ্রসূ হবে।’

‘সেটা কী রকম?’ প্রশ্ন করল আকরামা।

খালিদ বলল—’আমি আমার এক দল সৈন্যকে এক্ষুনি শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেবো। তারা ওত পেতে মুহাম্মাদের আগমনের অপেক্ষা করবে। মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের ওপর আক্রমণ করলে পেছন থেকে তারা হামলে পড়বে মুহাম্মাদের ওপর। কিন্তু তারা যুদ্ধ করবে না, মুহাম্মাদের বাহিনীর মনোযোগ আকর্ষণ করে তারা পিছিয়ে যাবে এবং পালিয়ে যাবে। এভাবে তারা বারবার মুহাম্মাদের ওপর আক্রমণ করবে এবং সরে পড়বে। মুহাম্মাদের বাহিনী এর ফলে আমাদের ওপর জোরাল আক্রমণ চালাতে পারবে না। এই সুযোগটাই নেব আমরা। এই সুযোগে তাদের কচুকাটা করে নিঃশেষ করে দেবো।’

‘খালিদ, সত্যি তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। এই না হলে সেনাপতির ছেলে!’

খালিদ আর কথা বাড়াল না। আকরামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাহিনীর কাছে গেল। সেখান থেকে একটি দল বাছাই করে তাদের কী করতে হবে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো। তারপর তাদের বলল—’যাও, যেভাবে বলেছি সেভাবেই কাজ করবে। আমার পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তোমরা এ কাজ চালিয়ে যাবে।’

খালিদের সৈন্যরা শহর থেকে বেরিয়ে গেল। সে নিজ দলের সৈনিকদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যুবকদের দিকে মনোযোগ দিলো। যুবকরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দূর দিগন্তে দৃষ্টি মেলে খুঁজছিল মদিনার বাহিনী। মেয়েরা ছাদে উঠে তাকিয়েছিল মরুভূমির দিকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। যুবকদের কয়েকটি দল ঘোড়া ও উটে চড়ে শহর থেকে বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য, পথেই মুসলিম বাহিনীকে মোকাবিলা করা। সন্ধ্যার রক্তিম আকাশ আর লাল সূর্য ওদের যেন বলছিল—মুহাম্মাদ (সাঃ) আসছে। ওর ওপর তোমরা যে অত্যাচার করেছ, তার বদলা নিতে এগিয়ে আসছে সে। এবার রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে মক্কার ওপর দিয়ে। তলোয়ারে ঠোকাঠুকি হবে। রক্তের বদল রক্ত। হয় রক্ত দিতে হবে, নয়তো নিতে হবে। তোমাদের প্রমাণ দিতে হবে তোমরা এ শহরকে ভালোবাসো কি না, আপন ধর্মকে ভালোবাসো কি না, তোমাদের সন্তান ও নারীদের ভালোবাসো কি না।

লোকজন বলাবলি করছিল—’কই, মুহাম্মাদের বাহিনীর তো কোনো খবর নেই। কোনো কাফেলা এগিয়ে এলে যে ধূলিঝড় সৃষ্টি হয়, তেমন কোনো ধূলিঝড়ও তো নজরে আসছে না। খালিদ তো বলেছিল, অনেক আগেই তারা পাহাড় অতিক্রম করেছে। বলেছিল, তীব্র গতিতে তারা ছুটে আসছে।’

‘শেষ মুহূর্তে হয়তো সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেছে মুসলিম বাহিনী।

‘আরে না, মুহাম্মাদ (সাঃ) সে রকম লোকই না। মদিনা থেকে এত দূর এসে হামলা না করার কোনো কারণই নেই। সে অবশ্যই হামলা করবে। হয়তো আমাদের দৃষ্টির বাইরে এসে সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্য কোথাও থেমেছে। হয়তো রাতের জন্য অপেক্ষা করছে। ভাবছে, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকব, তখন অতর্কিত হামলে পড়বে। সে তো আমাদের শক্তি সম্পর্কে জানে। জানে, সামনাসামনি লড়তে এলে টিকতে পারবে না।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এলো মক্কা শহরে। মেয়েরা বাড়ির ছাদে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে গান গেয়েই চলেছে। যুবকরা টহল দিয়ে ফিরছে। যারা শহর ছেড়ে বাইরে গেছে, তাদের কাউকেই এখন আর দেখা যাচ্ছে না। খালিদের বাহিনী ওত পেতে আছে মদিনার পথে। আকরামা ও খালিদ অপেক্ষা করছে কখন তাঁরা আসবে, কখন তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা।

রাত ক্রমেই গভীর হলো। দিনের উত্তাপ কমে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে, কিন্তু মুহাম্মাদের বাহিনীর হদিস নেই; আক্রমণ তো পরে, তাদের অস্তিত্বই নেই কোথাও। অপেক্ষার পালা বাড়তেই লাগল। রাত আরও গভীর হলো। ক্লান্ত যুবতিদের কারও কারও চোখে নেমে এলো ঘুম। কিন্তু তাতে জটলা ও হট্টগোল বিন্দুমাত্র কমেনি। কমেনি যুবকদের উত্তেজনাও। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল মুহাম্মাদের বাহিনীর।

দুর্গের ভেতরে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়েছে। নারী ও বুড়োরা কান পেতে শুনছে বাইরের হট্টগোল। অর্ধেক রাত অতিবাহিত হয়ে গেল, মুহাম্মাদের বাহিনীর কোনো আক্রমণের শিকার হলো না তারা। উত্তেজনা ও অপেক্ষার মধ্য দিয়ে রাতটি কেটে গেল যুদ্ধ ছাড়াই।

আবু সুফিয়ান বলল—’খালিদ, তারা কোথায়? মুহাম্মাদ (সাঃ) কি হাওয়া হয়ে গেছে? নাকি তুমি ভুল দেখেছ?’

খালিদ বলল—’আবু সুফিয়ান, তুমি যদি ভেবে থাকো তারা আসবে না, তবে তা হবে একটা ভয়াবহ ধোঁকা; যা তুমি নিজেই নিজেকে দিচ্ছ। মুহাম্মাদের বুদ্ধির ধারের কাছেও তুমি নও। সে যা চিন্তা করে, তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। তারা আসবে, অবশ্যই আসবে।’

আবু সুফিয়ানের বুদ্ধি নিয়ে ব্যঙ্গ করার পরও সে ক্ষিপ্ত না হয়ে বলল—’মানছি মুহাম্মাদের বুদ্ধি আছে। এ পর্যন্ত যে কয়টা যুদ্ধ হয়েছে, তাতে সে বুদ্ধির জোরেই বেঁচে গেছে।’

খালিদ বলল—’যুদ্ধ করে করে তারা এখন পরিপক্ব হয়েছে। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা যে ভুল করেছিল, তেমন ভুল তারা আর করবে না। খন্দকের যুদ্ধে মুহাম্মাদ (সাঃ) যে অসাধারণ নৈপুণ্য ও কৌশল প্রদর্শন করেছে, তাতেই বলা যায়— প্রচলিত কৌশলের ওপর ভর করে সে চলে না। নিত্য-নতুন কৌশল উদ্ভাবনে সে ওস্তাদ। তাঁর এই হাওয়া হয়ে যাওয়াটাও একটা কৌশল। সে আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। অপেক্ষা করতে করতে আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ব, ক্লান্তিতে আমাদের বাহুগুলো শিথিল হয়ে পড়বে, তখন সে আঘাত হানবে।’

আবু সুফিয়ান কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় সে দেখতে পেল একজন ঘোড়সওয়ার দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে তাদের দিকে। খালিদকে বলল—’ওই দেখ! কেউ আসছে।’

তারা আগন্তুককে স্বাগত জানানোর জন্য উভয়েই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আগন্তুক কাছে এসে লাফিয়ে নামল ঘোড়া থেকে। বলল—’আমার চোখ যা দেখেছে, তা তোমরা বিশ্বাস করবে না। আমি মুসলমানদের হুদাইবিয়াতে তাঁবু গেঁড়ে বসে থাকতে দেখেছি।’

আবু সুফিয়ান বলল—’না, তারা মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর বাহিনী হতে পারে না। আমি মুহাম্মাদকে খুব ভালো করেই চিনি। খোদার কসম! মুহাম্মাদ (সাঃ) কোনো আহাম্মক নয় যে, সে আমাদের এত কাছে এসে এভাবে তাঁবু গেড়ে জাবর কাটবে।’

‘এটা আমারও মনে হয়েছিল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি তাদের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে এমন কিছু লোকের সাথে আমার দেখা হয়েছে, যারা কিছুদিন আগেও মক্কার অধিবাসী ছিল। আমি তাদের সঙ্গে দেখা করেছি এবং কথা বলেছি। মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজেও তাদের সাথেই আছে।’

হুদাইবিয়া মক্কা থেকে মাত্র তেরো মাইল পশ্চিমের একটি গ্রাম। রক্তপাত এড়ানোর জন্য এ গ্রামে তাঁবু টানিয়েছেন মহানবি (সাঃ)। উদ্দেশ্য, এখান থেকে মক্কার কাফিরদের সাথে যোগাযোগ করে কাবা শরিফ তাওয়াফের অনুমতি নেওয়া।

খালিদ বলল—’আমরা রাতের আঁধারে আক্রমণ চালাব। আমার বাহিনী মদিনার পথে পথে ওত পেতে বসে থাকবে, কাউকে পালিয়ে যাওয়ার মওকা দেবো না। যাদের ইচ্ছা লড়াই করে মরুক, নাহয় পালিয়ে যাওয়ার পথে আক্রান্ত হয়ে মরুক। মৃত্যুই তাদের একমাত্র বিধিলিপি।’

এর ওপর কোনো ফয়সালা হয় না। রাতের আঁধারে আক্রমণ করার স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে তারা। স্বপ্নটা ঠিকই থাকবে, তবে জায়গা বদল করে। আক্রমণ করার বদলে তারা হবে আক্রান্ত আর আক্রমণটা করব আমরা। সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হতে বলো।’

মক্কায় আবার সাজ সাজ রব পড়ে গেল। বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।

হুদাইবিয়া। মহানবি (সাঃ) তাঁবুর চারপাশে মজবুত পাহারা বসালেন। সবাইকে বিশ্রামের অনুমতি দিয়ে উসমান-কে ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন— ‘আমার দূত হয়ে তুমি মক্কায় যাও। আবু সুফিয়ানকে বলবে, আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি, আমরা এসেছি উমরা করতে। তোমরা আমাদের উমরা করার অনুমতি দাও। আমরা উমরা শেষ করেই ফিরে যাব।’

উসমান রওয়ানা করার আগেই আরেক ঘটনা ঘটল। মক্কার আরেকটি টহল দলের চোখে পড়ল মুসলমানদের তাঁবু। দূর থেকে চক্কর দিয়ে চলে গেল তারা। একটু পরে আবার ফিরে এলো। তাঁবুরক্ষীদের শক্তি পরীক্ষার জন্য তাদের ওপর হামলা করে বসল দলটি। মামুলি লড়াইয়ের পর ফিরে গেল তারা। ফিরে গেল মানে, নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে মুসলমানদের তৎপরতার দিকে নজর রাখল। আশা করল—মুসলমানদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে একসময় না একসময় কিছুটা ঢিল তো অবশ্যই পড়বে, তখন আবার হামলা করবে তারা। এই হট্টগোলের মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় উসমান-এর আর বের হওয়া হয়ে উঠল না। মহানবি (সাঃ) বললেন—’আজ বাদ দাও, আগামীকাল যেয়ো। ‘

কাফিরদের দলটি মক্কায় ফিরে যেতে পারত, কিন্তু মুসলমাদের তারা চোখের আড়াল করতে চাইল না। ফলে ওখানেই অপেক্ষা করতে লাগল তারা।

পরের দিন আরও একটি কুরাইশ বাহিনীর নজরে পড়ল মুসলমানদের তাঁবু। তারা নিরাপদ দূরত্ব রেখে তাঁবুর চারদিকে চক্কর দিলো। এরপর শিকারি বিড়ালের মতোই ওত পেতে অপেক্ষা করতে শুরু করল। দলটি থেকে একজন বীর যোদ্ধা আরও কাছ থেকে মুসলমানদের অবস্থা দেখার জন্য পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল, কিন্তু টহল বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গেল সে। তাকে কমান্ডারের কাছে নেওয়া হলে কমান্ডার বলল—’একে ছেড়ে দাও। আমরা এখানে লড়াই করার জন্য আসিনি। লড়াই করতে চাইলে এদের কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পারত না।’

ছাড়া পেয়ে সে তার দলবল নিয়ে ফিরে এসে আবু সুফিয়ানকে বলল- ‘হুদাইবিয়ায় আমি মুসলিম বাহিনীকে দেখেছি। আমি গোপনে তাদের খবরাদি নেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলে ওরা আমাকে বন্দি করে তাদের কমান্ডারের কাছে নিয়ে গেল। কমান্ডার আমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলল। বলল—’আমরা এখানে লড়াই করার জন্য আসিনি। লড়াই করতে চাইলে এদের কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পারত না।’’

আবু সুফিয়ান বলল—’তাহলে ওরা কেন এসেছে, তামাশা দেখার জন্য? তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না! লড়াই করতে না চাইলে ওরা হুদাইবিয়ায় এসে তাঁবু গেড়েছে কেন? ওরা তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে, যাতে আমরা লড়াইয়ের প্রস্তুতি না নিই। আর সেই সুযোগে ওরা এসে আমাদের পরাজিত করতে পারে। কিন্তু খোদার কসম! আমি মুহাম্মাদের এ চাল সফল হতে দেবো না। আজ রাতেই আমাদের বাহিনী তাদের এ দুঃসাহসের ফল কী হতে পারে তা বুঝিয়ে দেবে।’

এ ঘটনার একটু পর। হুদাইবিয়ার দিক থেকে এক আগন্তুককে আসতে দেখল মক্কাবাসী। লোকটি এসে আবু সুফিয়ানকে কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইল। লোকজন দলবেঁধে তাকে ধরে আবু সুফিয়ানের কাছে হাজির করল। আবু সুফিয়ান বলল—’বলো, তুমি কী জন্য এসেছ? আমাকেই-বা খুঁজছিলে কেন?’

‘আমি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছ থেকে দূত হিসেবে এসেছি। আপনার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে একটি পয়গাম আছে।’

‘কী পয়গাম?’

‘আমরা যুদ্ধ করার জন্য মক্কা আসিনি; এসেছি উমরাহ করতে। উমরা করেই আমরা চলে যাব।’

‘যদি আমরা তাঁর অনুমতি না দিই? তুমি ভালো করেই জানো, আমাদের অনুমতি ছাড়া তোমরা উমরাহ সম্পন্ন করতে পারবে না।’

‘হ্যাঁ, জানি বলেই আপনার অনুমতি নিতে এসেছি। কিন্তু যদি অনুমতি না দেন, তাহলে শুনে রাখুন, আমরা মক্কার লোকদের আদেশ-নিষেধ মানতে এখানে আসিনি। আমরা একমাত্র আল্লাহর হুকুমই মান্য করি।’ আগন্তুক বলল—’কাবা আমাদের কিবলা। কাবার তাওয়াফ আমাদের দ্বীনের অঙ্গ। আমাদের ইবাদতে কেউ বাধা দিক তা আমরা চাই না। দিলেও সে বাধা আমরা গ্রাহ্য করি না। যদি মক্কার জনগণ আমাদের ইবাদতে বাধার সৃষ্টি করে, তবে অহেতুক রক্তপাত ঘটবে। মক্কার জনগণের রক্তে সিক্ত হবে কাবার মাটি। আমরা এমনটি চাই না। কিন্তু বাধ্য করলে আমরা এই জনপদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতেও পিছপা হব না। আমি শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছি। আমাদের শান্তিতে উমরাহ করতে দাও, আমরা তোমাদের দিকে চোখ তুলেও তাকাব না। আর যদি বাধা দাও, মক্কার অলিগলিতে রক্তের স্রোত বয়ে যাবে। অস্ত্র ও জনবলকে আমরা ভয় পাই না। তুমি জানো, ভয় আমাদের অভিধানে লেখা নেই। জীবন আমাদের কাছে যতটা প্রিয়, দ্বীনের জন্য জীবন দেওয়া আমাদের কাছে তার চেয়েও বেশি প্রিয়।’

আবু সুফিয়ান আগন্তুককে থামিয়ে দিয়ে বলল—’থামো! তুমি কি আমাদের ভয় দেখাচ্ছ? এত বড়ো শহর, বিশাল বাহিনী, আমাদের নিরাপত্তাবেষ্টনী, সর্বোপরি মক্কার বিপুল জনগণ যার পক্ষে, তাদের কি গুটিকয়েক আগন্তুককে দেখে ভয় পাওয়া উচিত?’ আবু সুফিয়ান উপস্থিত লোকজনের চিৎকার ও চেঁচামেচির কারণে কথা বলতে পারছিল না। মক্কার লোকজন তখন তারস্বরে চিৎকার করে বলছিল—’এই উদ্ধত লোকটিকে হত্যা করো, কতল করো ওকে।’ খালিদের রক্তও গরম হয়ে উঠেছিল। আবু সুফিয়ান লোকদের দিকে ফিরে হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল। বলল—’দুর্বলরা সব সময় বড়ো বড়ো কথা বলে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে চায়। নিজেদের মনে সাহস সঞ্চয় করতে চায়। এ লোক একজন দূত। দূতকে হত্যা করে দুনিয়াবাসীর সামনে নিজেদের কলঙ্কিত করতে চাই না। তোমরা থামো। এখানে খালিদ আছে, বিভিন্ন গোত্রের নেতারা আছেন। আমাদের ওপর আস্থা রাখো। আমরা মক্কাবাসীর সম্মান ও মর্যাদার কথা মনে রেখেই এর ফয়সালা করব।’ তিনি খালিদকে ইশারা করলেন জনতাকে শান্ত করতে।

আগন্তুকের কথা শুনে খালিদের রক্তও গরম হয়ে উঠেছিল। কিন্তু জটিল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খালিদের ইশারায় তাঁর রক্ষীরা লোকজনকে শান্ত করল এবং একটু দূরে সরিয়ে দিলো।

আবু সুফিয়ান উপস্থিত নেতৃবৃন্দের দিকে তাকিয়ে বললেন—’এ লোক এখন আমাদের মেহমান। একজন দূতকে এভাবেই গ্রহণ করা দুনিয়ার নিয়ম। ইচ্ছে করলে এ লোককে আমরা অবশ্যই হত্যা করতে পারি, কিন্তু দূতকে কোনো বীর জাতি হত্যা করে না, এটা কাপুরুষতার নামান্তর। আমার মনে হয় তাকে আমরা আমাদের পছন্দমত শর্তে সন্ধি করার জন্য বলতে পারি। যদি ওরা আমাদের শর্ত মানতে রাজি না হয়, তখন তাদের হত্যা করলে অন্যায় কিছু করা হবে না। কি বলো তোমরা, আমরা কি তাদের সন্ধির প্রস্তাব দিতে পারি?’

উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সম্মতি পেয়ে আবু সুফিয়ান আগন্তুককে বলল – – ‘তুমি মুহাম্মাদকে গিয়ে বলো, সে যদি আমাদের পছন্দমতো শর্তে সন্ধি করতে রাজি থাকে, তাহলে সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে এর ফয়সালা হতে পারে। দুই পক্ষের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একত্রে বসে এই সন্ধিচুক্তির শর্ত নির্ধারণ করবে।’

খালিদের ঘোড়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মদিনার দিকে। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে খালিদ, মনে তোলপাড় করছে পুরোনো দিনের অসংখ্য ঘটনা। খালিদ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই আগন্তুককে। কী নির্ভীক তাঁর চাহনি! কথা বলার ভঙ্গিতে অনমনীয় দৃঢ়তার কী অপূর্ব ছাপ! চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়েও কী অদ্ভুত সাহসে উচ্চারণ করছে আপন বিশ্বাসের স্বপক্ষে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *