দুর্গম পথের যাত্রী – ৪

মদিনাবাসী যখন উল্লাস করছিল, মদিনার বাইরে বনু কুরায়জার সরদারের ঘরে তখন চলছিল ভিন্ন এক তৎপরতা, অন্য এক আয়োজন। বনু কুরায়জার প্রভাবশালী নেতারা বসা ছিল কাব বিন আসাদের বৈঠকখানায়। কাব বিন আসাদ বলছিল—’নইম যদিও কুরাইশ বংশের, কিন্তু তার পরামর্শের কারণেই আমরা বেঁচে গেলাম এক অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে। কুরাইশদের সাথে সন্ধি ছিন্ন না করলে আজ মহা বিপদে পড়ে যেতাম। ভাগ্য ভালো যে, আমরা কুরাইশদের সাথে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিইনি।’

এক ইহুদি বলল—’কে বলল নইম কুরাইশ?’ নইম এখন মুহাম্মদের শিষ্য হয়ে গেছে। কুরাইশরা চলে যাওয়ার পর তাকে মদিনায় দেখে এক মুসলমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নইমের ঘটনাটা কী? সে বলল—’নইম আগেই মুসলমান হয়েছিল, কিন্তু মহানবি (সাঃ) এ কথা তাকে প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন।’ সে কারণেই ঘটনাটা এতদিন জানাজানি হয়নি। এখন কুরাইশরা মক্কার পথ ধরায় তাঁর পরিচয় গোপন করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে, তাই সে মক্কা না গিয়ে এখানেই রয়ে গেছে।’

‘তার মানে সে যুদ্ধের সময় মুসলমানদের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছিল!’ কাব বিন আসাদের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘তবে আর বলছি কি! মুহাম্মদের চর কুরাইশ, গাতফান এমনকী আমাদের মাঝেও থাকা অসম্ভব নয়। আর সে জন্যই মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে যখন যেখানে যা-ই ঘটুক, সঙ্গে সঙ্গে সব খবর পেয়ে যায়।’

এক বৃদ্ধ ইহুদি বলল—’কাব, মুসলমানদের সংখ্যা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। এ সয়লাব এক্ষুনি ঠেকাতে না পারলে আরবের সব ধর্মমত তাদের মতবাদের কাছে ভেসে যাবে। প্রভু সহায় হোন, একটা কিছু করো।’

‘কী করব, কী করতে পারি আমরা?’ আক্ষেপের সুরে বলল কাব বিন আসাদ।

সেই বুড়ো ইহুদি রায় ঘোষণার মতো করে বলল—’মুহাম্মাদকে হত্যা করতে হবে। এ ছাড়া পরিত্রাণের আর কোনো পথ নেই। বিষবৃক্ষের শিকড় উপড়ে না ফেললে নতুন করে আবার চারা গজাবে।’

কাব আরও বিস্মিত হয়ে বলল—’কী বললে তুমি! মুহাম্মাদকে হত্যা করতে হবে! কিন্তু কে করবে এ কাজ? কার এত বড়ো বুকের পাটা যে উদীয়মান সূর্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়?’

বুড়ো ইহুদি বলল—’সে জন্য তোমার ভাবতে হবে না। এ জন্য লোক তৈরি হয়েই আছে।’

এবার কাবের বিস্ময়ের মাত্রা আরও বাড়ল। বলল—’আমি তোমাদের গোত্রপ্রধান, অথচ এমন একটি বিস্ময়কর ঘটনার খবর আমার জানা নেই?’

বুড়ো ইহুদি বলল—’তোমার যখন জানার সময় হবে তখন অবশ্যই জানবে, এই যেমন এখন জানতে পারছ। কাজ সে-ই করবে, তোমার শুধু ইশারা দরকার।’

‘কিন্তু তুমি বললেই আমি ইশারা করব—এমনটি কেন মনে হলো তোমার? কে সেই লোক, এ কাজে কতটা দক্ষ আর আন্তরিক, অভিযান সফল করার কতটুকু নিশ্চয়তা আছে, এসব না জেনেই এমন সিদ্ধান্তে সায় দেবো আমি? কক্ষনোই না। বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা সরদার হওয়ার জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এই যে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেল, যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে এর মোকাবিলা না করতাম, তবে আমরা এতক্ষণে মুসলমানদের শত্রু বলে গণ্য হয়ে যেতাম। মুসলমানরা আমাদের সাথে সেই ব্যবহারই করত, যেমনটি করেছিল বনু নাজির গোত্রের সাথে। এতক্ষণে তারা আমাদের মেরে-কেটে সাফ করে ফেলত, আর নাহয় আমাদের পালিয়ে যেতে হতো অজানা গন্তব্যে। এমন কিছুর অনুমতি আমি দেবো না, যাতে আমাদের তাদের বিরাগভাজন হতে হয়। বন্ধুত্বের বিনিময়ে শত্রুতা কেউ বরদাশত করবে না। মুসলমানরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দিচ্ছে, রুটি-রুজির নিরাপত্তা দিচ্ছে, ধর্ম-কর্মের নিশ্চয়তা দিচ্ছে, সব ধরনের স্বাধীনতা দিচ্ছে, এর বিনিময়ে বলতে গেলে আমাদের কিছুই দিতে হচ্ছে না। কথায় বলে না, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। তোমাদের হয়েছে সেই অবস্থা। খবরদার! এমন কিছু করবে না, যা মুসলমানদের ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে। অন্যান্য ইহুদি গোত্রের মতো আমাদের যে পালিয়ে যেতে হয়নি, তার অন্যতম কারণ বিশ্বস্ততা। নিশ্চিত না হয়ে এই বিশ্বস্ততার দেয়াল আমি ভাঙতে চাই না।’ বলল কাব।

বুড়ো ইহুদি বলল—’তোমাকে আমাদের সরদার করেছি কি মুসলমানদের গুণগান করার জন্য? কুরাইশদের সাথে সন্ধি ছিন্ন করে তুমি যে ভুল করেছ, তার জন্যই মুসলমানরা ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেছে। এখন আঁবার তাদের পক্ষে সাফাই গাইছ?’

‘যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে যেয়ো না। আমাদের কয়েকজন সৈন্য কুরাইশদের সাথে শরিক হলেই কুরাইশরা জিতে যেত—এমনটা কেবল কোনো আহাম্মকই বলতে পারে। আরবের দশ হাজার সৈন্য যাদের কিছুই করতে পারেনি, আমার কয়েকজন সৈন্য শামিল হলে তারা জিতে যেত—এমনটা তুমি ভাবলে কী করে? শোনো, আমি তাদের কপালের পরাজয় লেখা পড়তে পেরেছিলাম, তাই উপযুক্ত সময়ে তাদের সাথে চুক্তি ছিন্ন করে তোমাদের রক্ষা করতে পেরেছি, নইলে এতক্ষণে এখানে তোমাদের লাশ জমে যেত। এসব বড়ো বড়ো কথা বলার মওকা পেতে না।’ রাগের স্বরে বলল কাব

বুড়ো কিছুটা কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলল-’সরদার! মুসলমানরা এত বড়ো বিপদ কাটিয়ে উঠছে দেখে আমার বুদ্ধি বিগড়ে গেছে। কিন্তু এটা তো ঠিক, মুসলমানদের এই অব্যাহত অগ্রযাত্রা থামাতে না পারলে আমাদের ধর্ম মহাসংকটে পড়ে যাবে। আর এই আপদ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ মুহাম্মাদকে হত্যা করা। সেজন্যই আমার এ পেরেশানি।’

বৈঠকখানায় বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ইহুদি ছাড়াও উপস্থিত ছিল এক ইহুদি যুবতি, নাম ইউহাদা। যেমন রূপসী তেমনি বুদ্ধিমতী। পুরুষ মানুষ তার কাছে তৃষ্ণার্ত ভেড়ার পাল। সারা জীবন তাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো যায়। মেয়েটির চোখের তারায় জড়িয়ে ছিল সম্মোহনী জাদু। মেয়েটি সেই জাদুমাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল বুড়োর দিকে। বুড়ো ইউহাদার দিকে তাকিয়ে বলল— ‘ইউহাদা, সব কথা সরদারকে খুলে বলো।’

‘আমি এ কথা জাদুসম্রাট লায়েস বিন মোশানের সামনে বলতে চাই। আমার কথার গুরুত্ব সে বুঝতে পারবে, আর আপনারাও তার কথায় গুরুত্ব দেবেন। ইউহাদা বলল।

কাব বিন আসাদ বলল—’কিন্তু সেই জবরদস্ত জাদুকরকে আমি কোথায় পাব? তার মতো গুণী ব্যক্তি তো আর পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায় না যে যখন-তখন যাকে—তাকে ধরে আনলেই সে লায়েস বিন মোশান হয়ে যাবে! তুমি বলো! তোমার কথা আমার মনে ধরলেই চলবে।’

বুড়ো ইহুদি বলল—’এটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি সে ব্যবস্থা করেই এসেছি। লায়েস বিন মোশান এখন ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে। আপনার অনুমতি পেলেই সে আপনার সামনে হাজির হয়ে যাবে।’

এ কথা শুনে কাব বিন আসাদ বিস্ময় ও অস্বস্তির কারণে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। বুঝতে পারল, এই বুড়ো সবদিক আঁটঘাট বেঁধেই এখানে এসেছে, নইলে এই আসরে ইউহাদারও থাকার কথা নয়। ইউহাদার উপস্থিতির কারণে এমনিতেই তার মনে খটকা লেগেছিল, এবার লায়েস বিন মোশানের বিষয় জানতে পেরে সেই খটকা আশঙ্কায় পরিণত হলো।

কাব বিন আসাদ বিস্মিত কণ্ঠে বলল—’কী বলছ তুমি! লায়েস বিন মোশান এখানে? ভেতরে না এনে তাকে তোমরা ঘরের বাইরে বসিয়ে রেখে এসেছ? জলদি যাও, তাকে সসম্মানে এখানে নিয়ে এসো।’

বুড়ো ইহুদি তার এক সঙ্গীকে ইশারা করলে সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। বুড়ো বলল—’তার সাথে আরও এক লোক আছে, তাকেও নিয়ে আসবে।’ তারপর কাব বিন আসাদের দিকে ফিরে বলল—’যে লোক মুহাম্মাদকে হত্যা করবে, তাকেও আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আপনি তাদের দেখুন, তাদের সাথে আলাপ করুন, তাদের পরিকল্পনা শুনুন। যদি মনে করেন পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন আনা দরকার, তবে তা-ও তাদের খুলে বলুন। মোটকথা মুহাম্মাদকে হত্যার পরিকল্পনা আজই চূড়ান্ত করুন।’

বুড়োর কথা শেষ হওয়ার আগেই সঙ্গীকে নিয়ে কামরায় প্রবেশ করল লায়েস বিন মোশান। লোকটির বয়স আশির বেশি। থাকেন মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী এক গ্রামে। মাথার চুল ও দাড়ি ফকফকে সাদা। চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ছে ব্যক্তিত্বের আভা। বয়সের তুলনায় শরীর যথেষ্ট মজবুত। চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। হাতে তার জাদুর লাঠি। লাঠিটিতে তেল দিয়ে এমন চকচকে করা হয়েছে যে, লাঠিতে চোখ দিলে নিজের চেহারা দেখা যায়। লাঠিটি কোমরের একটু ওপরে উঠে সাপের মতোই তোই বেঁকে গেছে। একটি নয়, দুটি নয়; সেই লাঠির মাথায় ফণা তোলা সাপের তিন-তিনটি মাথা। সেই সাপের মাথার ফাঁক দিয়ে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন তার ডান হাতের পাঁচটি আঙুল। তিন সাপের ছোট্ট লেজের ওপর তার হাতের তালু।

লাঠিতে ভর দিয়ে কামরায় ঢুকলেন তিনি। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল কাব বিন আসাদ ও কামরার অন্যান্যরা। সহাস্যে কাব বলল—’সম্মানিত জাদুসম্রাট লায়েস! আপনাকে এখানে ডেকে আনার অধিকার এখানকার কারও নেই। এটা শুধু দুঃসাহস নয়; বেয়াদবিও। এরা আপনাকে এখানে ডেকে এনে যে বেয়াদবি করেছে, সেজন্য সত্যি আমি লজ্জিত। আসুন, বসুন।’

মিষ্টি করে হাসলেন লায়েস বিন মোশান। বললেন—’না না, এতে বেয়াদবির কিছু নেই, আপনার লজ্জিত হওয়ারও কিছু নেই। আপনি, আমি, আমরা সবাই একই ধর্মের অনুসারী। আপনি ইহুদি সম্প্রদায়ের অত্যন্ত সম্মানিত গোত্র বনু কুরায়জার গোত্রপ্রধান। প্রভুর সন্তানদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আপনার। আমিও ধর্মের এক নগন্য খাদেম। ধর্মের জন্য আমি যা খুশি তা করতে পারি, যেখানে দরকার সেখানেই যেতে পারি। আমি এখানে এসেছি ধর্মের পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে।’

বলল কাব বিন আসাদ—’কিন্তু সম্মানিত জাদুসম্রাট! এক বিপদজনক মিশন নিয়ে আপনি এখানে এসেছেন। মুহাম্মাদকে হত্যা করা মুখের কথা নয়। এতে বিফল হলে কি পরিণতি হবে ভেবে দেখেছেন?’

‘আপনাকে আমি বীরপুরুষ বলেই জানতাম।’ লায়েস বিন মোশান বলল— ‘কিন্তু এখন কথা বলছেন ভীতুদের মতো। মুহাম্মাদ (সাঃ) খোদা নয় যে তাকে হত্যা করা যাবে না। যদি কুরাইশরা মুসলমানদের পরাজিত এবং তাঁকে হত্যা করতে পারত, তবে আমাদের আর জটিল পথে পা বাড়াতে হতো না। কিন্তু তারা বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে কাপুরুষের মতো বসে রইল, কোনো আক্রমণই করল না। আফসোস! তারা মাথা নিচু করে আবার মক্কায় ফিরে গেছে। এখন যা কিছু করার আমাদেরই করতে হবে।’

লায়েস বিন মোশান সম্পর্কে আরব ভূখণ্ডে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল। জাদুবিদ্যায় তিনি ছিলেন অসম্ভব পারদর্শী। তিনি জীবিত মানুষকে সবার সামনে দুই টুকরা করে আবার তাদের জোড়া লাগিয়ে দিতে পারতেন। মৃত মানুষকে কিছু সময়ের জন্য হলেও জীবিত করতে পারতেন। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য হলে মন্ত্রবলে তাদের বিবাদ মিটিয়ে দিতে পারতেন। হাতের লাঠিকে সাপ বানিয়ে ফেলতে পারতেন। এ রকম আরও নানা চমকপ্রদ কাহিনির নায়ক তিনি।

‘সম্মানিত জাদুসম্রাট! জানি, আপনি জাদুবলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারেন। কিন্তু মুহাম্মদের নিজেরও কিছু জাদু আছে। যদি আপনার জাদু তাঁর কাছে হেরে যায়? যদি তিনি বেঁচে যান? যদি জানতে পারেন তাকে আমরা হত্যার চেষ্টা করেছিলাম? তার পরিণাম কত ভয়াবহ হবে আপনি কি তা আন্দাজ করতে পারছেন?’ বলল কাব বিন আসাদ।

‘সরদার কাব! আপনি অযথাই এত ভয় পাচ্ছেন। আমার জাদু কখনো ব্যর্থ হয় না। আর এবারের জাদুর জন্য আমি বেছে নিয়েছি আসেম ও ইউহাদাকে। ইউহাদা নিজেই একটি মারাত্মক মারণাস্ত্র। আপনি যদি একশো ঘোড়া আর একশো উট একপাশে রাখেন আর অন্যপাশে রাখেন ইউহাদাকে, শতকরা একজন লোকও পাবেন না, যে ইউহাদাকে রেখে উট ও ঘোড়ার দিকে হাত বাড়াবে। তা ছাড়া আমি তাকে জাদুবিদ্যার ট্রেনিং দিয়েছি। হাজারও লোকের মাঝখান থেকে সে বেমালুম গায়েব হয়ে যাবে, কেউ তাকে খুঁজেও পাবে না।’

‘কিন্তু মুহাম্মাদকে কীভাবে তোমরা হত্যা করতে চাও?’ বুড়ো ইহুদির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কাব।

বুড়ো ইহুদি বলল—’সেটা আপনাকে বলবেন জাদুসম্রাট লায়েস। তবে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আছে, অভয় দিলে বলতে পারি।’

‘বলো।’ অভয় দিয়ে বললেন কাব।

‘ইউহাদা কোনো মশহুর মুসলিম যোদ্ধাকে বিয়ে করবে। কিছুদিন খাঁটি মুসলমানের মতো জীবনযাপন করবে। একদিন মুহাম্মাদকে দাওয়াত দেবে তাদের বাসায়। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে সেই খানা খাওয়াবে মুহাম্মাদকে। তারপর পালিয়ে আসবে সেখান থেকে।

এবার ইউহাদার দিকে তাকালেন বনু কুরায়জার গোত্রের প্রধান কাব বিন আসাদ। বললেন—’তুমি কী বলো?’

ইউহাদা তার পটলচেরা চোখ তুলে তাকাল সরদারের দিকে। বলল—’পরিকল্পনা আপনারা নেবেন। আমাকে যে দায়িত্ব দেবেন, নিষ্ঠার সাথে পালন করব। তবে পুরুষ ঘায়েল করার বিদ্যা আমার ভালোই জানা আছে। আমার বিদ্যা কতটা কার্যকর, তা পরখ করার জন্য একবার আমি আবু সুফিয়ানকে টার্গেট করেছিলাম। প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী হয়ে যায় আবু সুফিয়ান। আমার সামান্য চোখের বাণও সে সহ্য করতে পারেনি। আরেকবার খালিদ বিন ওয়ালিদকে টার্গেট করেছিলাম। খালিদ একটা ভীতুর ডিম। আমার বাণে আহত হওয়ার ভয়ে সে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি বলতে চাচ্ছি, কাউকে টার্গেট করলে বিফল হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই আমার।’

‘কিন্তু এ তো অনৈতিক কাজ, পাপের পথ। জেনে-শুনে জাতির এক কন্যাকে কী করে আমি এই পথে ঠেলে দিই?’ বললেন কাব।

এবার মুখ খুললেন লায়েস বিন মোশান। বললেন—’আমি কেবল জাদুকর নই; একজন ধর্মগুরুও বটে। আমি আপনাকে বলছি, পাপ আর পুণ্য নির্ধারিত হয় কাজের উদ্দেশ্য দেখে। একটা খারাপ কাজও পুণ্যের হতে পারে, যদি তার উদ্দেশ্য হয় মহৎ। আবার একটা ভালো কাজও পাপের হতে পারে, যদি তার উদ্দেশ্য থাকে খারাপ। ইউহাদা যা করছে, তা জাতির এক মহান স্বার্থের জন্যই করছে। অতএব, এখানে পাপের কোনো প্রশ্নই আসে না; বরং এ এক মহাপুণ্যের কাজ। এমন পুণ্যময় কাজ থেকে আপনি তাকে বিরত রাখতে পারেন না।’

কাব নিজেও জানে, তার চরিত্রে অনেক দোষ আছে। কিন্তু এমন প্রকাশ্য নির্লজ্জতার কথা তিনি ভাবতে পারেন না। তিনি নিজেকে সংযত করে বললেন—’গুরুজি, আপনি আসলে কাজটি কীভাবে করার কথা ভাবছেন জানি না। আপনি কি আপনার পরিকল্পনাটা আমাকে বলবেন?’

লায়েস বিন মোশান বলল—’অবশ্যই বলব। তবে তার আগে আপনাকে একটি গল্প শোনাতে চাই। এই যে ইউহাদাকে দেখছেন, তার জীবনের ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। আমার মনে হয় গল্পটা আমি না বলে ইউহাদা বললেই বেশি ভালো হবে। কি বলো ইউহাদা?’

ইউহাদা মুচকি হাসল। বলল—’আপনার যেমন মর্জি।’

‘তাহলে শুরু করো।’ বলল লায়েস বিন মোশান।

ইউহাদা স্বপ্নে দেখা ঘটনাটি বলতে শুরু করল। এই গল্প কয়েক মাস আগে মক্কা থেকে শুরু হয়েছিল। ইউহাদা তার রূপ ও যৌবন দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিল আবু সুফিয়ান, খালিদ ও আকরামাকে। ইচ্ছে ছিল তাদের একজনকে দিয়ে আরেকজনকে ঘায়েল করা। কিন্তু যখন সে শুনল, এই তিনজনই মুসলমানের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিলো।

ইউহাদা গল্প বলছে। বলল—’একদিন মক্কা থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরের এক গ্রামে গিয়েছিলাম বিশেষ একটি কাজে। দিন শেষে সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার সাথে আরও দুটি মেয়ে ছিল। আমাদের তিনজনের সাথে ছিল তিন পুরুষ। আমরা সবাই ছিলাম ইহুদি। ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পথ চলছিলাম আমরা। যখন আমরা অর্ধেক পথ পেরিয়েছি, তখন হঠাৎ করেই মরু ঝড়ের কবলে পড়লাম। সেই ঝড়ের বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। চারদিক নিকষ আঁধারে ছেয়ে গেল। তিরের বেগে বালুর কণা এসে বিধঁছিল গায়ে। মনে হচ্ছিল শরীরে সুঁই ফোটাচ্ছে কেউ। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বালুর পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে সমতল হয়ে যাচ্ছিল সমতল জায়গায় মুহূর্তেই সৃষ্টি হচ্ছিল পাহাড়ের অবয়ব। এমন ভয়ংকর মরু সাইমুম আমি আর জীবনে কোনোদিন দেখিনি। আগেই সঙ্গীদের হারিয়ে ছিলাম। সামনে-পেছনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। প্রাণ বাঁচানোর আশায় চোখ বন্ধ করে ঘোড়ার পিঠের সাথে লেপটে ছিলাম। ঘোড়ার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঘোড়া ছুটছিল পাগলের মতো। তার দুরন্ত ছুটে চলা আর উলটা-পালটা ডিগবাজির ফলে একসময় ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়লাম আমি। ঘোড়ার ওপর বালু জমে দেখতে দেখতে একটি টিলা তৈরি হয়ে গেল সেখানে। বালি চাপা পড়ে মারা গেল ঘোড়া। আমার বেঁচে যাওয়াটা এক অলৌকিক ব্যাপার। ঝড় আমাকে উড়িয়ে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানি না। কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। একসময় টের পেলাম, ঝড় আমাকে কোনো দেয়ালের গায়ে আছড়ে ফেলেছে। অবাক হলাম আমি।

এই মরুভূমিতে এমন নিরেট দেয়াল এলো কোত্থেকে? আমি দেয়াল হাতড়ে একটু একটু করে এগোচ্ছিলাম। আমার চোখ-মুখ পুরোটাই কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এ ছাড়া বালির ঝাপটা থেকে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। কখনো এক পা, দুই পা এগোতাম, ঝড়ের ঝাপটা এলে দেয়াল আকড়ে স্থির হয়ে থাকতাম। ঝড়ের তাণ্ডবে কান স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার মাঝেই আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কোনো উটের ডাক। পাহাড়ের গায়ে ঝড়ের দাপট আছড়ে পড়ার কারণে বিচিত্র রকমের শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো অসুর দানব হুংকার দিচ্ছে। কখনো মনে হতো—একদল ভূত তারস্বরে চিৎকার করছে।

আমি নিজেকে খুব সাহসী মনে করতাম, কিন্তু ঝড়ে আমার সব সাহস যেন কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। একসময় ঝড়ে থামল, কিন্তু আমি আমার হারিয়ে যাওয়া সাহস আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। ভয় এসে যেন আমাকে জাপটে ধরেছে। রাত হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে নেমে এসেছে নিকষকালো আঁধার। ভয়ের স্রোত যেন বয়ে চলেছে আমার ওপর দিয়ে।

প্রথমে মনে জাগল মরু শিয়ালের ভয়। এরা অসম্ভব রকমের হিংস্র প্রাণী। একবার ওদের পাল্লায় পড়লে আর বাঁচার আশা নেই। দ্বিতীয় ভয় ছিল নিঃসঙ্গতা। সঙ্গীরা কে কোথায় জানা নেই আমার। বেঁচে আছে না সবাই মারা গেছে, তা-ও জানি না। আশপাশে কোনো জনমানবের চিহ্নও কোথাও নেই। তখন আমার মনে পড়ল, মানুষ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। এখন কোনো মরু বেদুইন আমাকে পেলে সে কিছুতেই আমাকে নিজের ঘরে ফিরতে দেবে না। সে আমাকে নিয়ে যাবে তার ডেরায়। সেখানে সে আমাকে ভোগ করবে যতক্ষণ তার মন চায়। লোকটি ভালো হলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভোগের স্বার্থে, নইলে মেরে ফেলবে। সবচেয়ে বড়ো ভয়, ঝড় মরুভূমির রাস্তা-ঘাটের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে। কোনদিকে মক্কা বোঝারও উপায় নেই। এখন পথচলা মানে অনিশ্চিত বিপদে ঝাপিয়ে পড়া। যদি দিক ভুল করে হাঁটতে থাকি, তবে দেখা যাবে—মক্কা না গিয়ে মরুভূমির আরও গভীরে চলে গেছি। এমন চক্করে পড়ে গেছি যে, লোকালয়ে আর কোনোদিন যাওয়া হবে না।

দেয়াল ধরে একটু একটু করে এগোচ্ছি আমি। অন্ধকারের জন্য দেখতে পাচ্ছি না কিছু। মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল ধরে এভাবে পথ চলছি আমি। একসময় মনে হলো—দেয়াল বেঁকে গেছে। বাঁক ঘুরে আরও একটু এগিয়ে গেলাম। এ সময় আমার কানে এলো উটের ডাক। আমি এটাকে ভাবলাম স্মৃতির বিভ্রম। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি দাঁড়িয়ে কান খাঁড়া করলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, আবারও ডেকে উঠল উট। আমি বুঝলাম, এটা কোনো বিভ্রম নয়, সত্যি সত্যি উটের ডাক। আমি আবারও চলতে শুরু করলাম।

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ খুব কাছেই আবারও উটের ডাক শুনলাম। ভয়ে জমে গেলাম আমি।’

ইহুদিকন্যা ইউহাদা এক ভয়ংকর ও অবিশ্বাস্য গল্প বলে চলেছে। সে বলল— ‘তার রাগ হলো নিজের সঙ্গীর ওপর। লোকটা মরার আর সময় পেল না। উট নিশ্চয়ই একা নেই; এক বা একাধিক আরোহী আছে তার সঙ্গে। এখন যদি তারা তার সন্ধান পায়, তবে কী ঘটতে পারে তা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল ইউহাদা। সে লোকগুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওখান থেকে পালাতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন আটকে আছে মাটির সাথে। পালাতে চাইলেও পালাতে পারছে না সে। আর যাবেই-বা কোন দিকে? উট কোনদিকে, কোনদিকে তার আরোহী—অন্ধকারের কারণে কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। পালাতে গিয়েও আবার ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ল ইউহাদা। আবার সব সুনসান। উটের ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার সে দেয়াল হাতড়ে চলতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো-সামনে একটি উট দাঁড়িয়ে আছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ইউহাদা। উটটি দেয়ালের সাথেই বাঁধা। এরপর আর দেয়াল নেই। সামনে একটি গুহামুখ। একবার ভাবল ভেতরে ঢুকবে, কিন্তু গুহার ভেতর জমাট অন্ধকার দেখে সেখানে ঢোকার সাহস করল না। গুহামুখের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছিল-এখন কী করবে। এ সময় গুহার ভেতর থেকে কেউ তাকে ডাক দিলো—’কে ওখানে, ভেতরে এসো।’

এ ডাক আবারও তার শরীরে ভয়ের শিহরন বইয়ে দিলো। লোকটি আবার ডাকল— ‘কই, ভেতরে এসো।’ ইউহাদার কী মনে হলো, সে ধীর পায়ে গুহার মুখে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটি ভেতর থেকে বলল—’আরে, এ যে দেখছি মেয়ে মানুষ! ‘

ইউহাদার মনে হলো—সে এখান থেকে পালিয়ে যায়, কিন্তু তার পা জমে যাওয়ায় পালানোর চেষ্টা ত্যাগ করতে হলো তাকে। লোকটি ভেতর থেকে বাইরে এসে হাত ধরল ইউহাদার।

‘তুমি একা?’

‘না, আমার সাথে আরও চারজন আছে। তাদের সাথে ঘোড়া আছে, তলোয়ার আছে।’

‘কোথায় তারা? কাউকে দেখছি না যে!’

‘ঝড়ের কারণে তাদের হারিয়ে ফেলেছি।’ সত্যি কথাই বলল ইউহাদা।

ইউহাদা বলে চলেছে—’লোকটি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল—’চলো।’ এটুকু বলেই সে গুহার ভেতর ঢুকে গেল। আমি তার পেছনে চলতে লাগলাম। অল্প একটু গিয়েই গুহাটি বামদিকে মোড় নিয়েছে। সেখানে জ্বলছে আলোর শিখা। জায়গাটা বড়োসড়ো কামরার মতো। লোকটির পিছে পিছে আমিও সে কামরায় ঢুকে গেলাম।

এখানে ঝড়ের কোনো আলামত নেই। সব কেমন পরিপাটি, গোছানো। কামরায় ঢুকে লোকটি ফিরল আমার দিকে। বলল—’বসো। আমার নাম জারিদ’। তোমাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি?’

কামরার চারদিকে তাকালাম আমি। এমন ভয়ংকর জায়গা জীবনে দেখিনি আমি। কামরায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কটি নরকঙ্কাল। কঙ্কালের দাঁতগুলো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, যেন তারা বলতে চাইছে—দেখ হে রূপের গরবিনী, বয়স গেলে এই হয় জীবনের পরিণতি! কামরায় ঢুকে ভয় ও আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠলাম। লোকটি এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। বলল—’ভয় পাচ্ছ? ভয়ের কিছু নেই। এটাই মানুষের স্বাভাবিক পরিণতি। জীবনের লেনদেন শেষ করে এই বেশই পরতে হয় সবাইকে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের এই পরিণতি হয়েছে, এখন যারা জীবিত আছে এবং যারা আগামীতে দুনিয়ায় আসবে, মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে তাদেরও। মানুষের সব দম্ভ-অহমিকা এভাবেই একদিন কঙ্কাল হয়ে যায়। কঙ্কাল হয়ে যায় ক্ষমতার দাপট, যৌবনের উন্মাদনা।’

আমি ছুটে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলাম। লোকটি আমাকে ধরে ফেলল আর বলল—’কোথায় পালাবে নারী, এই অন্ধকারে পালিয়ে তুমি যাবে কোথায়?’

আমি থেমে গেলাম। জারিদকে খুলে বললাম সব কথা। বললাম—’আমি মক্কা যেতে চাই। এই কামরায় থাকলে আমি মরে যাব। তুমি আমাকে মক্কা পৌঁছে দাও, বিনিময়ে যা চাও তা-ই পাবে।’

জারিদ খানিক ভেবে নিয়ে বলল—’ঠিক আছে, আমি তোমাকে মক্কা পৌঁছে দেবো।’

খানিক পর। উটের পিঠে চড়ে বসল জারিদ। আমাকে তার পেছনে বসাল। আমি জারিদের কোমর জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভয় একটু একটু করে কমতে লাগল। সেখানে এসে আসন নিল সাহস।

অনেক দূর চলে এসেছি আমরা। তারার আলোয় মরুভূমির অন্ধকার কিছুটা ফিঁকে হয়ে এসেছিল। জারিদ এখন আমার রক্ষক। আমার দিক থেকে তার ভয়ের কিছু ছিল না। সে হয়তো ভাবছিল, আমি এক অবলা নারী। শুধু অবলা নয়; এক পথহারা অসহায় মুসাফির। জারিদ যখন এসব ভাবছিল, আমার মনে তখন খেলা করছিল এক অশুভ চিন্তা। আমি ভাবছিলাম, জারিদের এই ভালোমানুষির পেছনে লুকিয়ে আছে তার লালসা। আমি তার লালসা চিরতরে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে খুন করার শপথ নিলাম।

একসময় দূর-দিগন্তে ভেসে উঠল আলোর রেখা। বুঝলাম, আমরা মক্কার সন্নিকটে চলে এসেছি। আমি কোমর থেকে খঞ্জর বের করলাম। জারিদ পথ চলছিল আর গুনগুন করে গান গাইছিল। সে ভাবতেও পারেনি—পৃথিবীর রূপ-রস উপভোগের যখন সুবর্ণ সময়, তখন তাকে ছেড়ে যেতে হবে পৃথিবীর সব বন্ধন। মক্কা কাছে চলে এসেছিল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে আমার হাতের খঞ্জর জারিদের পিঠে বসিয়ে দিলাম। এরপর সে কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে তাকে উট থেকে ফেলে দিলাম।’

ইউহাদা বলল—’এই ঘটনাবৃত্তান্ত যখন জাদুসম্রাট লায়েস বিন মোশানকে বললাম, তিনি বললেন—’তুমি এক যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী হয়েছ, ইউহাদা। তুমি জাতির খুব বড়ো খেদমত করবে। তুমি যে ঝড়ের কথা বলেছ, সেটা হচ্ছে ইসলাম। ইসলামের এই ঝড় আরব ভূখণ্ডকে তছনছ করে ফেলবে। তুমি বাধ্য হবে তাদের আশ্রয়ে যেতে। তারপর তুমি ইসলামের প্রবর্তককে হত্যা করবে, এই হচ্ছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা।’

এবার কথা বললেন লায়েস বিন মোশান—’ইউহাদার ঘটনাবৃত্তান্ত শুনে আমি চমকৃত না হয়ে পারলাম না। ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদের নেতৃত্বে যে প্রবল শক্তি মাথা তুলছিল, সেটা নিয়ে আমরা গভীর দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ইউহাদার কথা শুনে বুঝলাম, মহান প্রভু এবার আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। যে সমস্যা আমাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল, তার সমাধানের জন্য খোদা বেছে নিয়েছেন এক নারীকে। আর ইউহাদাই সেই নারী।

আমি তার বাপের সাথে দেখা করলাম। তার পিতা একজন কট্টর ইহুদি। তাকে বললাম, ধর্মের সেবার জন্য আপনার কন্যাকে আমাদের দরকার। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিলেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *