দুর্গম পথের যাত্রী – ৩

খালিদ আবু সুফিয়ানের দরবার থেকে বেরিয়ে গেল। অন্যরা তখনও ওখানেই বসা। আবু সুফিয়ান কিছুটা সংযত হয়ে নইমকে লক্ষ করে বলল—’নইম, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কাব বিন আসাদ এভাবে চোখ উলটে ফেলবে। সে হয়তো মাতাল অবস্থায় তোমাকে কিছু বলে থাকবে।’

‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি অন্য কাউকে পাঠিয়ে যাচাই করতে পারেন।’

আবু সুফিয়ানের দিকে তাকিয়েছিল সবাই। আকরামা বলল—’আমি যেতে চাই আসাদের কাছে।’

‘তুমি যাবে?’ একটু ভেবে নিয়ে আবু সুফিয়ান বলল—’যেতে পারো। সে যদি এখনও আমাদের পক্ষে আছে মনে করো, তবে জামানত হিসেবে কয়েকজনকে তার কাছ থেকে চেয়ে নেবে। একবার জামানত হাতে পেলে সে আর মত পালটাতে পারবে না। ‘

‘যদি জামানত দিতে রাজি না হয়?’ জানতে চাইল আকরামা।

‘রাজি না হলে বুঝতে হবে তার মতলব ভালো নয়।’

নইম বলল—’আমি তার কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা করছি।’

আবু সুফিয়ান আকরামাকে বলল—’নইমের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইহুদিদের বিশ্বাস করা আসলেই কঠিন। তুমি এক কাজ করো, তোমার কিছু সৈন্য সঙ্গে নিয়ে যাও, বিপদ দেখলে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রইল তোমার।’

সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেল আকরামা। কয়েকজন সুঠামদেহী সৈনিককে সাথে নিল। তাদের পথ দেখানোর জন্য সঙ্গে গেল নইম। সে সোজা পথে না নিয়ে তাদের ঘোরানো পথে নিয়ে চলল। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে অবশেষে ওরা বনু কুরায়জার মহল্লায় ঢুকল।

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মার্চ। দিনটি ছিল শুক্রবার। তাতানো রোদের তীব্রতা মাড়িয়ে ওরা যখন কাব বিন আসাদের বাড়ির সামনে পৌঁছাল, বাড়ির মালিক তখনও মদে মাতাল। কিন্তু যেই শুনল আকরামা এসেছে, তার মাতাল ভাব পুরোপুরি কেটে গেল। সে জানে-আকরামা কেন তার কাছে এসেছে।

‘এসো আকরামা।’ দরজার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে কাব বিন আসাদ বলল- ‘তোমার আসার কোনো দরকার ছিল না। আমি জানি তুমি কেন এসেছ, কিন্তু আমার সাথে এখন আলোচনা করে লাভ নেই। আমি দায়িত্ব থেকে ১০ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছি।’

আকরামা ঘরে ঢুকে বলল—’আগে আমার কথা শোনো। পরিস্থিতি এখন খুবই জটিল। অলস বসে থাকার সময় আমাদের হাতে নেই। আমরা হামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

আকরামার দিকে তাকিয়ে কাব বিন আসাদ বলল—’বসো।’ তারপর চাকরের দিকে ফিরে ইশারায় কিছু বলল। চাকর কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। আসাদ বলল—’শোনো আকরামা, মুসলমানদের সাথে চুক্তি করেছি ইহুদিদের নিরাপত্তার স্বার্থে আর তোমাদের সাথে চুক্তি করেছি মুসলমানদের পরাজিত করার জন্য। আমরা তো চাই মুসলমানরা শেষ হয়ে যাক। ‘

কাব বিন আসাদের কথার মাঝখানে কামরায় প্রবেশ করল এক সুন্দরী চাকরানি। তার হাতে ফলমূল ও মদের পেয়ালা। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ। আকরামার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। কাব বিন আসাদ বলল—’এসো দোস্ত, সামান্য পান না করলে কি আলোচনা জমে? আগে কিছু পেটে দাও, তারপর কথা বলো।’

‘না।’ আকরামা বলল—’পানাহারের সময় নেই আমার। আগামীকালই আমরা মুসলমানদের ওপর হামলা করব। হামলার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব তোমাদের। তুমি তোমার লোকদের রেডি করো। চুক্তি অনুযায়ী তুমি তোমার জিম্মা পূরণ করো, আমরাও আমাদের ওয়াদা পূরণ করব।’

‘প্রিয় আকারামা! তোমার চোখে আমি রাগ দেখতে পাচ্ছি। তুমি এমনভাবে কথা বলছ, যেন আমরা তোমাদের গোলাম। তোমাদের কাজ হুকুম করা আর আমাদের কাজ তা পালন করা। কিন্তু আমরা একটি স্বাধীন জাতি। তোমাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আমরা তোমাদের গোলাম হয়ে যাইনি। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা ধর্মের দাবি। তাদের বাড়তে দিলে আমাদের ধর্ম হুমকির সম্মুখীন হবে। আমরা ধর্মের খাতিরে তোমাদের সহযোগী হতে রাজি হয়েছি, কিন্তু সহযোগিতার মানে তো গোলাম হওয়া নয়। বসো, মাথা ঠান্ডা করো। তোমার নির্দেশে তো আমরা তলোয়ারের নিচে মাথা পেতে দিতে পারি না। আমরা কী করব, কী করতে পারব—সেটা আমাদের বলতে দাও।’

‘কাব, আমি কোনো অযাচিত হুকুম করছি না। তোমরা কী করবে সে চুক্তি আগেই হয়েছে। এখন তোমার কাজ দুটি। এক. চুক্তি অনুযায়ী তোমাদের দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া আর তোমার ধর্মের হুকুম মেনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা। আর রাগের কথা বলছ? আমরা এমন সংবাদ পেয়েছি যে, তোমরা মুসলমানদের সাথে করা চুক্তি রক্ষায় যতটা আন্তরিক, আমাদের সাথে চুক্তির ব্যাপারে ততটা আন্তরিক নও।’

‘তার মানে তোমরা আমাদের অবিশ্বাস করছ?’

‘তোমার ভূমিকা আমাদের এমনটা ভাবতেই বাধ্য করছে।’

কাব বিন আসাদের চেহারা রাগে লাল হয়ে গেল। বলল—’অবিশ্বাস থাকলে তো একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। তোমরা কি তবে আমাদের সাথে চুক্তি বাতিল করতে চাও?’

‘না, চুক্তি রক্ষার জন্য নিরাপত্তা জামানত চাই। ‘

‘সেটা কীরকম?’

‘তোমাদের গোত্রের দশজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমাদের হাতে দিয়ে দেবে-যাতে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। চুক্তি ভঙ্গ করলে ওদের আমরা হত্যা করব।’

কাব বিন আসাদের ঠোঁটে ফুটে উঠল কুটিল হাসি। আকরামার কথা শেষ হলে তার দিকে তাকিয়ে বলল——দোস্ত, খুবই উত্তম প্রস্তাব দিয়েছ তুমি। আমি রাজি তোমার প্রস্তাবে।’

এত সহজে কাব আকরামার প্রস্তাব মেনে নেবে ভাবেনি আকরামা। আকরামা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাব বলল—’তবে একটা কথা আছে।’

আকরামা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল—’কী কথা?’

‘তোমাদের যেমন জামানত দরকার, তেমনি আমারও তো জামানত প্ৰয়োজন। আমার দশজনের বিনিময়ে তোমরা বনু গাতফান গোত্রের পাঁচজন ও কুরাইশ বংশের পাঁচজনকে পাঠিয়ে দেবে।’

রাগে আকরামার চেহারা লাল হয়ে গেল। বলল—’কী বললে? জামানতের বদলে জামানত দিতে হবে? আমরা কি তোমার মতো দুমুখো সাপ? একদিকে সন্ধি করবে আমাদের সাথে, অন্যদিকে সন্ধি করবে মুসলমানদের সাথে? আমরা খবর পেয়েছি, তুমি জুহাইয়া বিন আফতাবের সাথে করা ওয়াদার বরখেলাপ কাজ করছ, সে জন্যই জামানতের প্রশ্ন উঠেছে।’

‘রাগ করো কেন বন্ধু। একটু মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করো। জামানতের বদলে জামানত চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?’

‘না, কিছুতেই তা সম্ভব নয়। তোমরা ওদের মুসলমানদের হাতে হাওলা করে দেবে। জেনেশুনে এমন কাজ আমরা করতে পারি না।’

‘শোনো আকরামা! আমি ওয়াদা করছি ওদের আমরা মুসলমানদের হাতে তুলে দেবো না। কিন্তু তোমরা যদি পরাজিত হও, তখন আমরা মুসলমানদের বলতে পারব, আপনারা ছিলেন শহরে। আমরা শহরের বাইরে ছিলাম আর আমাদের পাশে ছিল আপনাদের দশ হাজার দুশমন। ওরা আমাদের বাধ্য করেছিল আপনাদের সাহায্যে না যেতে। জামানতস্বরূপ এই দশজনকে রেখে গেছে প্রমাণ হিসেবে। আমরা ছিলাম নিরুপায়। আমাদের এই অক্ষমতার জন্য আপনাদের কাছে করুণা ভিক্ষা করছি। আমরা আপনাদের সাহায্যে যেতে না পারলেও আমাদের অন্তরগুলো ছিল আপনাদের সাথে। এভাবে বললে হয়তো আমরা মুসলমানদের রোষানল থেকে বেঁচে যেতে পারব। আমাদের বিষয়টা ভেবে দেখ।’

‘না, এখানে দেখাদেখির কিছু নেই। তোমার হাতে জামানত হিসেবে আমরা একজনকেও দেবো না। মানুষতো দূরের কথা, একটা ঘোড়াও তোমরা জামানত হিসেবে পাবে না।

‘তাহলে আমিই-বা জামানত হিসেবে তোমাদের হাতে কাউকে কী করে তুলে দিই? তোমরা জামানত না দিলে আমিও দিতে পারব না। এমন সিদ্ধান্ত আমার গোত্রের লোকেরা মেনে নেবে না।‘

‘সেটা তোমার ব্যাপার। তবে নিজের ভালো চাইলে কাল তোমার ওপর দেওয়া দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করবে; নইলে পরে পস্তাতে হবে তোমাকে।’

আকরামা রাগ করে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। কাব বিন আসাদ বলল—’আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আরে যাও, যাও। তোমাদের মুরোদ আমার জানা আছে। আমার তো মনে হয় তোমরা মুসলমানদের চুলও স্পর্শ করতে পারবে না।’ কাব গলা নামিয়ে বলল—’হুকুম যদি মানতে হয়, তবে মুহাম্মাদের হুকুম মানাই ভালো। তাঁরা ওয়াদার খেলাফ করে না। আমরা যেমন তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট, তেমনি তাঁরাও আমাদের ওপর সন্তুষ্ট।’

আকরামা রাগে গজরাতে গজরাতে কাব বিন আসাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সফল হলো নইমের চেষ্টা। বনু কুরায়জা ও কুরাইশদের মধ্যে দেখা দিলো ফাটল। অবিশ্বাসের দেয়াল তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দিলো। ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম লিখেছেন—’নইমের এ চেষ্টা সফল না হলে মুসলমানরা মহা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যেত। কুরাইশরা সাহসী হয়ে অবরোধ আরও দীর্ঘ করলে খাদ্যসংকটে পড়ে মদিনাবাসী নাস্তানাবুদ হয়ে যেত।’

আকরামা কাব বিন আসাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর নইম বিন মাসউদ গেল গাতফান গোত্রের কাছে। গাতফানের সরদারকে বলল—’শুনেছেন, বনু কুরায়জা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আগামীকালের আক্রমণের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিল আকরামা। কাব বিন আসাদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। আগের চুক্তি বাতিল করে সে নতুন শর্ত দিয়েছে। সে বলছে—যদি বনু গাতফান ও কুরাইশদের পাঁচজন করে দশজনকে তার কাছে জামানত রাখা হয়, তবে সে যুদ্ধে যাবে; নইলে যাবে না।’

গাতফান এ খবরে অবাক হয়ে বলল—’তার এত বড়ো সাহস! কী আছে তার যে সে আমাদের কাছে জামানত চায়?’ গাতফান নিজ গোত্রের সেনাপতিকে ডেকে পাঠাল। নইমের দিকে ফিরে বলল—’আবু সুফিয়ান শুনেছে এ খবর?’

নইম মাথা নেড়ে বলল—’হ্যাঁ।’

‘এ খবর শুনে আবু সুফিয়ান কী বলল?’

‘আবু সুফিয়ান বনু কুরায়জাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চায়। বলেছে, কাব বিন আসাদকে আমি ঘোড়ার পেছনে বেঁধে মক্কা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাব।‘

গাতফান বলল—’কাবকে শাস্তি দেওয়াই উচিত।’

সেনাপতি আয়নাল এলে গাতফান তাকে বলল—’শুনেছ, কাব আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। সে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য নতুন শর্ত আরোপ করে বলেছে, আমাদের পাঁচজনকে তার কাছে জামানত রাখতে হবে।’

সেনাপতি আয়নাল বলল—’আমি আগেই বলেছিলাম ওকে বিশ্বাস করবেন না। ইহুদিরা লড়াইয়ের ময়দানে যুদ্ধ করতে জানে না; ওরা জানে ষড়যন্ত্র। কোনো ষড়যন্ত্রকারীকে আমি পছন্দ করি না। জামানত? খোদার কসম! ওকে আমি একটা মেষও দেবো না।’

গাতফান বলল—’কোন সাহসে সে আমাদের কাছে জামানত দাবি করে?’

আয়নাল হাসল। বলল-’এটা সাহসের বিষয় নয়; ভীতুর পালানোর কৌশল 1 ওকে নিয়ে ভাববেন না; দেখবেন, সে আমাদের ও মুসলমানদের মাঝে পড়ে পিষে মারা গেছে।’

গাতফানদের উসকে দিয়ে নইম সেখান থেকে সরে পড়ল।

খালিদ-এর ঘোড়া এগিয়ে যাচ্ছে মদিনার দিকে। তাঁর মনের পর্দায় ভাসছে যুদ্ধদিনের স্মৃতি। বদরের পর উহুদ, উহুদের পর খন্দক। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। বদর, উহুদে খালিদ দেখেছে মুসলমানদের সাহস ও বলিষ্ঠতা, আর খন্দকে দেখল মুসলমানদের অসাধারণ রণনীতি ও অপূর্ব রণকৌশল। মদিনায় ফিরে যাওয়ার বেদনাময় স্মৃতি খালিদ-এর মনে পড়ল।

বনু কুরায়জার ওখান থেকে আকরামার ফিরে এলো। আকরামার ফিরে আসার খবর পেয়েই খালিদ ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। রাগে, ক্ষোভে, ক্লান্তিতে আকরামার চেহারা ছিল বিধ্বস্ত। আবু সুফিয়ানসহ সবাই তাকে ঘিরে ধরেছিল। আবু সুফিয়ান, খালিদ ও অন্যান্য সবাই উদ্‌দ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল—’কী খবর নিয়ে এলে আকরামা?’

আকরামা ক্লান্ত পায়ে নামল ঘোড়া থেকে। খালিদ-এর দিকে তাকিয়ে বলল—’বিশ্বাস করো, কাবের মতো বদ লোক আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।’ একটু বিরতি নিয়ে আকরামা আবু সুফিয়ানকে বলল—’আমার ইচ্ছে করছিল তাকে খুন করে ফেলি, কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক কষ্টে নিজেকে দমন করেছি আমি।’

‘সে কি জামানত হিসেবে কয়েকজনকে আমাদের হাতে সোপর্দ করতে অস্বীকার করেছে?’ জানতে চাইল আবু সুফিয়ান।

‘না, তবে বিনিময়ে আমাদের ও গাতফান গোত্রের কিছু লোককে নিজের জিম্মায় রাখার শর্ত জুড়ে দেয়।’

খালিদ বিস্মিত কণ্ঠে বলে—’তুমি কি তাকে কিছুই বলোনি! এতটা সাহস সে পায় কী করে? কুরাইশ গোত্রের তুলনায় বনু কুরায়জা তো হাতির পাশে ইঁদুর!’

আকরামা বলল—’তুমি ভাবতেও পারবে না ও কতটা খারাপ। সে আমাকে দেখেই এক সুন্দরীকে ডাকল। তাকে দিয়ে মদ আনিয়ে পরিবেশন করাল আমার সামনে। তারপর এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল, যেন আমি তার করুণা ভিখারি।’

‘তুমি তাকে শেষ কথা কী বলে এসেছ?’ জানতে চাইল আবু সুফিয়ান।

‘আমাদের সাথে যে চুক্তি ছিল, আমি তা ছিন্ন করে এসেছি। শুধু এতটুকু বলেছি, তুমি যা করলে এর পরিণতি ভালো হবে না।’ আবু সুফিয়ানের দিকে ফিরে বলল—’নেহায়েত একটা যুদ্ধে আছি, তাই বেশি কিছু বললাম না।’

‘তুমি ঠিক কাজ করেছ।’ আবু সুফিয়ান বলল—’দুইমুখো সাপের সাথে চুক্তি বাতিল করা, চুক্তি বজায় রাখার চাইতে উত্তম। এখন আর ওদের ছোবল খাওয়ার ভয় রইল না।’

খালিদ চিন্তিত মনে বলেছিল, ‘কিন্তু রণকৌশলের দিক দিয়ে মুসলমানরা সুবিধা পেয়ে গেল। যুদ্ধের সময় কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। দৈহিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে কারও না কারও সমর্থক সে হয়েই যায়। আমাদের দিক থেকে সমর্থন তুলে নিলে সেই সমর্থন চলে যাবে মুসলমানদের পক্ষে। সামনে মূল শত্রু থাকলে পাশে থাকবে শত্রুর লেজ।’

আজকে মদিনার দিকে যেতে যেতে খালিদ-এর সে কথা মনে পড়ায় অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। সেদিনের সে কথা কতই না সত্য ছিল। মাত্র তো দুই বছর আগের কথা। সবই স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। খালিদ-এর কথা শুনে আকরামার চেহারায়ও চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। আকরামা দেখছিল, সেনাপতি আবু সুফিয়ানের চেহারাও বিমর্ষতায় ছেয়ে আছে।

একসময় লোকজনের ভিড় কমে এলো। আকরামা ও খালিদ বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে। আকরামা খালিদ-কে জিজ্ঞেস করল—’কী চিন্তা করছ খালিদ?’

খালিদ বলল—’আমার চিন্তার সাথে সেনাপতি আবু সুফিয়ানের চিন্তা কখনোই মেলে না। আমি পুরো খন্দক ঘুরে দেখেছি। এক জায়গায় খন্দক খানিকটা চাপা, গভীরতাও তেমন বেশি নয়। আমি সেনাপতি হলে এই বিপুল সৈন্য এভাবে বসিয়ে রাখতাম না। হয়তো খন্দক পার হতে গিয়ে আমাদের ক্ষতি কিছুটা বেশি হতো, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলে পার হওয়া যাবে না—এমন নয়। কিছু সৈন্য নিহত হওয়ার পরও যে পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আমরা ওপারে উঠতাম, তার মোকাবিলা করা মুসলমানদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে আমাদেরই জয় হতো। কিন্তু আবু সুফিয়ান এতই ভীতু যে সে সেনাপতি হবে, কিন্তু বিপদের বোঝা মাথায় নেবে না। এ রকম সেনাপতি নিয়ে কি যুদ্ধে জেতা যায়?’

আকরামা বলল—’ঠিক বলেছ খালিদ, আবু সুফিয়ানকে এজন্যই মান্য করি— সে আমাদের গোত্রপ্রধান ও সরদার, কিন্তু তার মতো ভীতু ও কাপুরুষ কোনো গোত্রের সেনাপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। আমিও তোমার সাথে একমত। হামলায় প্রথম দিকে আমাদের ক্ষতি একটু বেশি হলেও খন্দক পার হওয়া অসম্ভব নয়। এত বড়ো বিশাল বাহিনী এভাবে বসিয়ে রাখলে তাদের মনোবল ক্রমেই কমে আসবে। দিন যত যাচ্ছে, ততই আমরা দুর্বল হচ্ছি। কিন্তু যত দূর বুঝতে পারছি, আবু সুফিয়ান মদিনায় হামলা না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে।’

খালিদ বলল—’আকরামা! আমার একবার ভাগ্য পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি যে জায়গার কথা বলছি, এ জায়গা দিয়ে অশ্বারোহী পার করা সম্ভব। তুমি রাজি থাকলে আমরা একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। এপারে তিরন্দাজ থাকবে। ওরা অতর্কিত তিরবৃষ্টি শুরু করলে মুসলমানরা ক্ষণিকের জন্য হলেও পিছু হটতে বাধ্য হবে। সেই সুযোগে অশ্বারোহীর দলকে আমরা ওপারে পাঠিয়ে দেবো। ওরা যুদ্ধ করবে জয়ের জন্য নয়; ওদের লড়াইয়ের মূল টার্গেট থাকবে আমাদের সৈন্যরা যাতে খন্দক পার হতে পারে।’

‘তুমি ভালো করে ভেবে দেখ। রাতভর চিন্তা করে ঠিক করো কী করবে। তুমি হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলে আমি থাকব তোমার সাথে।’ বলল আকরামা।

পরদিন ভোর। পূর্ব দিগন্তে উঠে এসেছে রক্তিম সূর্য। সেই সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে মদিনা শহরে। ছড়িয়ে পড়েছে শহরের পার্শ্ববর্তী খোলা প্রান্তরে, যেখানে তাঁবু গেঁড়ে মদিনা শহরকে অবরোধ করে রেখেছিল কুরাইশরা।

খালিদ আকরামাকে বলল—’আবু সুফিয়ান অবরোধ উঠিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হলেও আমি মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি রাজি থাকলে চলো, এক্ষুনি আমি মদিনা আক্রমণ করতে চাচ্ছি।’

আকরামা বলল—’তোমার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে মল্লযুদ্ধ শুরু করতে হবে। এজন্য সব সৈন্য ওপারে নেওয়ার দরকার নেই। মল্লযুদ্ধ করতে পারে—এমন কিছু অশ্বারোহী বাছাই করে তাদের নিয়ে আগে আমি ওপারে যেতে চাই।’

খালিদ বলল—’তুমি এপারেই থাকো, আগে আমি যাই।’

আকরামা বলল—’না, আগে আমি যাব।’

ওরা সুঠামদেহী সাতজন অশ্বারোহী বাছাই করল। তাদের একজন উমরু বিন আবদুহু। দৈত্যের মতো বিশাল শরীর তার। যেমন তার শরীর, তেমনি সাহস। একাই একশোজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতেও ভয় পায় না সে। তাঁবুর সামনে সার বেঁধে দাঁড়াল ওরা। কুরাইশ সৈন্যরা তাকিয়ে দেখল ওদের। আকরামা ওদের বুঝিয়ে বলল কী করতে হবে। তারপর খালিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লাফিয়ে চড়ল ঘোড়ার পিঠে। আকরামা ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষল। ঘোড়া আকরামাকে নিয়ে ছুটল সামনের দিকে। ঘোড়ার মুখ খন্দকের দিকে। তার পেছনে সাত অশ্বারোহী। তারাও ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। বাতাসের বেগে উড়ে চলল ঘোড়া। তাদের পিছু নিল একদল তিরন্দাজ। ঘোড়া নয়; তারা যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। সবার আগে আকরামার ঘোড়া।

জোবার পাহাড়ের পশ্চিমে এবং সালেহ পাহাড়ের পূর্ব পাশে খন্দক সামান্য চাপা। স্থানটি আগেই দেখেছে খালিদ ও আকরামা। চেষ্টা করলে এখানকার খন্দক লাফিয়ে পার হওয়া সম্ভব—এমনটাই ধারণা খালিদ ও আকরামার। সমস্যা হচ্ছে—খন্দকের ওপারেই মুসলমানদের ক্যাম্প। মুসলমানদের সামনে পড়লে ওরা তাদের কচুকাটা করবে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ ছাড়া খন্দক পার হওয়ার সুবিধাজনক জায়গা আর নেই। আকরামার ঘোড়া সেদিকেই ছুটছে। খন্দক যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।

উমরু বলেছিল—’আকরামা! আগে আমি যাই, তুমি আমার পেছনে এসো।’ কিন্তু আকরামা তাতে রাজি হয়নি। বলেছে—’দলনেতা হিসেবে আমারই আগে থাকার কথা, আমি তা-ই করব। এরপর থাকবে তোমার ঘোড়া, তারপর অন্যদের।’

সেভাবেই এগিয়ে গেল দলটি।

ওরা খন্দকের কাছে চলে এসেছে। আকরামা জোরে ঘোড়ার পেছনে চাবুক মারল। ঘোড়া যেন শূন্যে ভেসে চলেছে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে এগিয়ে আসছে বাকি ছয়জন। খন্দকের কিনারায় এসে আকরামা সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত হানল ঘোড়ার পিঠে। দুরন্ত অশ্ব লাফ দিলো খন্দক পার হওয়ার জন্য। তার সামনের পা পার হয়ে গেল খন্দক, কিন্তু পেছনের পা খন্দকের কিনারায় পড়ে পিছলে গেল। আকরামা ছিটকে পড়ল ঘোড়া থেকে। কিন্তু মুহূর্তেই তলোয়ার হাতে উঠে দাঁড়াল সে। পেছন থেকে উমরু বিন আবদুহু চিৎকার করে উঠল—’সরে যাও আকরামা! আমি লাফ দিচ্ছি।’ কেউ ভাবেনি বিশালদেহী উমরুকে নিয়ে ঘোড়া খন্দক পেরোতে পারবে, কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখল, উমরুর ঘোড়া খন্দক পার হয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছেছে। একে একে সাতটি ঘোড়ার পাঁচটিই অক্ষত অবস্থায় ওপারে পৌঁছল, একটি পার হতে গিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল আর একটির পা ভেঙে গেল। অবশ্য এ দুই ঘোড়ার আরোহী অক্ষত ছিল, তারা ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়েছিল।

মুজাহিদদের অধিকাংশই তখন সেনাক্যাম্পে। টহল বাহিনী অবশ্য টহল দিচ্ছিল। তারা দূর থেকে দেখল, এই অবিশ্বাস্য ঘটনা। তারা চিৎকার করে উঠল—’কাফিররা খন্দক পার হচ্ছে, হুঁশিয়ার মুজাহিদ, হুঁশিয়ার!’ তাদের ডাক- চিৎকারে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এলো মুসলমানরা। তারাও দেখল এই অবিশ্বাস্য ঘটনা। হাতিয়ার নিয়ে তারা ধাবিত হলো খন্দকের দিকে। আকরামা চিৎকার করে বলল—’খবরদার, কেউ খন্দকের কাছে আসবে না। মুহাম্মাদকে বলো আকরামা এসেছে। কারও যদি সাহস থাকে, আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করো। এগিয়ে এসো মল্লযুদ্ধের জন্য। আমাদের যেকোনো একজনকে হত্যা করতে পারলে বাকি ছয়জনকেও হত্যা করতে পারবে তোমরা। সবার আগে মুহাম্মাদকে খবর দাও। আমি দেখতে চাই—তিনি কোন বীরকে আগে আমাদের মোকাবিলায় পাঠান।’

নিরাপদ দূরত্বে থমকে দাঁড়িয়ে গেল মুসলমানরা। প্রিয় নবির কানে পৌঁছে দেওয়া হলো আকরামার বার্তা। হজরত আলি-কে নিয়ে সেখানে এলেন মহানবি (সাঃ) বল। তাকিয়ে দেখলেন অসম সাহসী আকরামা দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার ছয় সঙ্গী। আকরামা আবারও মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানাল। বলল—’তোমাদের রক্ত পান করার জন্য মদিনার বালুকারাশি তৃষ্ণাকাতর হয়ে পড়েছে। কে আছ সেই তৃষ্ণা নিবারণ করবে? এগিয়ে এসো।’

দুর্গম পথের যাত্রী

আকরামার বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিমা দেখলেন মহানবি (সাঃ) দেখল মরুর বাতাস, উদার আকাশ আর জ্বলজ্বলে সূর্য। দূর থেকে দেখল আবু সুফিয়ান ও কাফির সৈন্যরা। এই ঘটনার সাক্ষী রইল মদিনার সুরক্ষা প্রাচীর ও অনাগত কালের ইতিহাস। মহানবি (সাঃ) নিজের মাথার পাগড়ি খুলে সেটা হজরত আলি-এর মাথায় পরিয়ে দিলেন। তাঁর হাতে তুলে দিলেন সেই বিখ্যাত তলোয়ার ‘জুলফিকার’।

আকরামার বদলে ভেসে এলো সেই দৈত্যাকার পুরুষ উমরুর কণ্ঠস্বর—’কে আছ বাহাদুর, এগিয়ে এসো। তোমার রক্ত যতক্ষণ শুষে না নিচ্ছে এই শুকনো বালুকারাশি, ততক্ষণ আমরা ফিরে যাব না।’ উমরুর কণ্ঠে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—’আমার মোকাবিলা করবে তোমাদের মাঝে এমন কাউকে তো দেখছি না। হোবল ও উজ্জার কসম! রক্ত পান না করে আমরা ফিরে যাব না।’

উমরু আসলেই প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিল। সে তার ঘোড়াকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারত। কেউ তার মোকাবিলা করবে—এটা সে ভাবতেই পারত না। মহানবি (সাঃ) তার হুংকার শুনছিলেন আর মনে মনে বলছিলেন—’হে আল্লাহ, এই দৈত্যের বিরুদ্ধে আলিকে পাঠালাম, তুমি তাঁর মোহাফেজ ও সাহায্যকারী হয়ে যাও।’

হজরত আলি মহানবি (সাঃ)র দুআ নিয়ে উমরুর মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে গেল। তাঁর হাতে জুলফিকার। ঐতিহাসিকবিদরা বলেন, এই তলোয়ারের মূল মালিক ছিল এক কুরাইশ যোদ্ধা। তলোয়ারটির বিশেষত্ব হচ্ছে—সাধারণত তলোয়ারের ধার থাকে এক পাশে, কিন্তু এর দুই পাশই সমান ধারাল। হজরত আলি-কে এগিয়ে আসতে দেখে উমরু বিন আবদুহু ঘোড়া থেকে নেমে এলো। কাছাকাছি এলে বলল—’হে আবু তালিবের বেটা! তুমি কি ভুলে গেছ তোমার বাবা আমার কত বড়ো বন্ধু ছিল? এটা খুবই অন্যায় হবে যে, আমি আমার একান্ত প্রিয় বন্ধুর ছেলেকে হত্যা করি। তুমি ফিরে যাও, তোমার বদলে আমার মোকাবিলার জন্য অন্য কাউকে পাঠাও।’

হজরত আলি বললেন—’হে আমার বাপের বন্ধু! আমি ইসলাম গ্রহণের পর অতীতের সব সম্পর্কই শেষ হয়ে গেছে। তোমার অনুশোচনার কিছু নেই। তুমি নির্দ্বিধায় আমার মোকাবিলা করতে পারো। হয় তুমি আমাকে হত্যা করবে, নয়তো আমি তোমাকে হত্যা করব। ময়দানে নেমে বাহানা তালাশের চেষ্টা বাদ দাও। তবে তোমাকে হত্যা করার আগে আমি তোমাকে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছি। আমাদের সবার স্রষ্টা এক আল্লাহকে নিজের মালিক ও মুনিব বলে মেনে নাও। তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)–কে নিজের নেতা বলে স্বীকার করো।

আর নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামকে নিজের জীবনবিধান বলে মেনে নাও, তাহলেই তুমি আমার হাত থেকে বেঁচে যেতে পারবে, আর নাহয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। এখনও সময় আছে ভেবে দেখ। আমি দ্বিতীয়বার তোমাকে এ কথা বলব না এবং নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো মওকা তুমি পাবে না।’

‘হে আবু তালিবের বেটা, তুমি একবার আমাদের ধর্ম ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ আর আমি হাজারবার তোমাকে বলতে চাই, তুমি আমার বন্ধুর সন্তান। আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না। তুমি ফিরে যাও।’

আলি বললেন—’না, ফিরে যাওয়ার জন্য আমি তোমার সামনে আসিনি। হয় আল্লাহর দ্বীনকে মেনে নাও, নাহলে নিজেকে বাঁচাও রাসূলের দেওয়া তলোয়ার থেকে। আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করো না।’

উমরু বিন আবদুহু অবাক হয়ে দেখছিল হজরত আলি-এর দৃঢ়তা ও নির্ভীকতা। সে নিতান্ত তাচ্ছিল্য সহকারে খাপ থেকে তলোয়ার বের করে এগিয়ে এসে আঘাত করল হজরত আলি-কে। আলি চকিতে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করল। উমরু এভাবে আরও কয়েকটা আঘাত করল, কিন্তু প্রতিবারই আলি জায়গা বদল করে ঠেকিয়ে দিলো সে আঘাত। উমরুর চেহারা এবার রাগে ভয়ংকর হয়ে উঠল। সে ভয়ংকর চেহারার বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। চোখ থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল আগুন। রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল উমরু। সেই রাগ সে ঢেলে দিলো হজরত আলি-এর ওপর। পাগলের মতো এলোপাথারি আঘাত করে চলল ক্রমাগত। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেল তার। এ পর্যন্ত আলি একটি আঘাতও করেননি। তিনি ক্ষিপ্র গতিতে জায়গা বদল করে ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত ঠেকিয়ে জাচ্ছিলেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ লড়াই চলল। উৎসুক জনতা রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল সে লড়াই। মুসলমানরা একদম চুপ। এক দৈত্যের সাথে লড়ছেন আলি। যেভাবে উমরু আঘাতের পর আঘাত করছে, কতক্ষণ তাকে সামাল দিতে পারবেন আলি? দুশ্চিন্তায় গলা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছিল মুসলমানদের। উমরুর প্রতিটি আঘাতের সময়ই ভাবছিল, এই বুঝি সব শেষ। অপরদিকে খন্দকের ওপারে এসে জমা হয়েছিল কাফিররা। তারা উল্লাস করছিল। চিৎকার করে বলছিল—’হোবল ও উজ্জার দোহাই! উমরু, শেষ করে দাও এই ধর্মত্যাগীকে।’

দীর্ঘক্ষণ লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে গেল উমরু। সে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিতে গেল, আলি ল্যাঙ মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো। মাটিতে ফেলে দিয়েই উমরুর বুকের ওপর চেপে বসলেন আলি। চেপে ধরলেন উমরুর কণ্ঠনালি। ঘটনাটা এত আকস্মিক ছিল যে, উমরু কিছু বুঝে উঠার আগেই ধরাশায়ী হয়ে গেল। আলি তলোয়ার ফেলে কোমর থেকে খঞ্জর বের করলেন। সেই খঞ্জর উমরুর গলায় চেপে ধরে বললেন—’এখনও সময় আছে উমরু, মুহাম্মদের শিষ্যত্ব মেনে নাও, প্রাণে বেঁচে যাবে।’

উমরু চেষ্টা করছিল আলি-এর পাকড়াও থেকে বাঁচার, কিন্তু নড়তে গেলেই গলায় খঞ্জরের চাপ বেড়ে যায়। নিচে পড়ে রাগে গো গো করছিল উমরু। কিছুতেই আলি-এর সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সে আলি-এর মুখে থুতু ছুড়ে মারল। এবার আলি-এর চেহারায়ও এসে জমা হলো রাগ। তিনি খানিকক্ষণ ওভাবেই বসে রইলেন। শেষে রাগ কিছুটা কমলে তিনি উমরুর বুকের ওপর থেকে নেমে গেলেন। বিস্মিত উমরু উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল—’কী হলো আলি, তুমি আমাকে হত্যা করলে না কেন?’

আলি কয়েক কদম সরে গিয়ে তলোয়ার তুলে নিতে নিতে বললেন—’তোমার বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনো আক্রোশ নেই। তোমাকে হত্যা করতে নেমেছিলাম দ্বীনের স্বার্থে। এই হত্যার বিনিময়ে আমি পেতাম আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সন্তোষ। কিন্তু যখন তুমি আমার মুখে থুতু ছুড়ে মারলে, আমার অন্তর ভরে গেল রাগে। ব্যক্তিগত রাগের বশে কাউকে হত্যা করার অনুমতি নেই আমাদের ধর্মে। তখন তোমাকে হত্যা করলে আমি হয়ে যেতাম একজন খুনি। এই খুন করা মহাপাপের কাজ। একজন মুমিন জেনেশুনে এই মহাপাপে নিজেকে জড়াতে পারে না। তাই থুতু দেওয়ার পর তোমাকে হত্যা করতে পারিনি। এবার আসো, আঘাত করো। তখন তোমাকে হত্যা করতে আর কোনো বাধা থাকবে না।’

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়ে উমরু বিন আবদুহু কিছুটা অবাক হয়েছিল। আলি-এর বক্তব্য শোনার পর রহস্যের জট খুলল তার। ইসলামের সৌন্দর্য ও মানবিকতার এ অনন্য রূপের সাথে পরিচিত ছিল না ওর। আলি-এর হাতের জুলফিকারের ঝলক দেখে সংবিৎ ফিরে এলো তার। মনে পড়ে গেল, এইমাত্র সে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে। আলি-কে হত্যা করতে না পারলে যেকোনো সময় মরণ আবার তাকে কাবু করে ফেলতে পারে। সে অতর্কিত আলি ওপর হামলা করে বসল। এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না আলি। দ্রুত তিনি ঢাল দিয়ে আঘাত ফেরালেন, তবে কাঁধে সামান্য আঘাত পেলেন। উমরকে আর কোনো সুযোগ দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, ভাবলেন আলি। এই প্রথম তিনি আঘাত করলেন এবং রাসূলের দেওয়া তলোয়ার জুলফিকারের এক আঘাতেই তার শাহরগ কেটে গর্দানেরও খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। উমরু আর কোনো আঘাত করার সুযোগ পেল না, আলি-এর দ্বিতীয় আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দৈত্যাকার উমরু বিন আবদুহু।

মুহূর্তে কাফির শিবিরের উল্লাস ও আনন্দধ্বনি থেমে গেল। এতক্ষণ মুসলমানরা ছিল নিশ্চুপ, এবার তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো আল্লাহু আকবর ধ্বনি। আকরামা আগেই বলেছিল—’একজনকে হত্যা করতে পারলেই তোমরা বাকি ছয়জনকেও হত্যার অধিকার পেয়ে যাবে।’ উমরু পরাজিত হতে পারে—এমনটা কেউ কল্পনাও করেনি। এই অভাবিত ঘটনায় সবার মতো আকরামাও বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল, কিন্তু মুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিল এবং ঘোড়ার মুখ খন্দকের দিকে করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। বাকিরাও অনুসরণ করল তাকে। আকরামার ঘোড়া খন্দক পার হতে পারল না। ওপারের মাটিতে আছড়ে পড়ে গড়িয়ে খন্দকে পড়ে গেল। আকরামা মাটিতে বর্শা আটকে কোনোমতে আত্মরক্ষা করল এবং ওপারে পৌঁছল। আকরামাসহ পাঁচজন খন্দক পার হলেও একজন ঘোড়াসমেত খন্দকে পড়ে গেল। মুজাহিদরা তাকে হত্যা করল। এই অভিযানে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরতে পারলেও আকরামাকে হারাতে হলো তার দুই জাঁদরেল যোদ্ধাকে। মুসলমানরা তির-ধনুক নিয়ে পাহারা জোরদার করল। কাফিররা দ্রুত খন্দকের কাছ থেকে সরে পড়ল।

খালিদের স্পষ্ট মনে আছে সে ঘটনা। আকরামাকে পাঠিয়ে সে এপারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। পুরো ঘটনাই সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। অভিযানের খবর পেয়ে আবু সুফিয়ানও ছুটে এসেছিল সেখানে। খালিদের পাশে দাঁড়িয়ে সেও দেখেছে আকরামার শোচনীয় পরিণতি। আকরামা ফিরে এসে কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের তাঁবুর ভেতর গিয়ে ঢুকেছিল। খালিদ তাঁবুতে ঢুকলে বলেছিল—’দোস্ত, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’

এ ঘটনার পর খন্দকের পাশে পাহারা আরও জোরদার করার হুকুম দিলেন মহানবি (সাঃ) এ। ফলে পাহারার জনবল দ্বিগুণ করা হলো। বিশেষ করে খন্দকের তুলনামূলক সরু অঞ্চলে পাহারা বাড়ানোর সাথে সাথে নতুন ক্যাম্পও স্থাপন করা হলো।

এই সংঘাতের কোনো প্রভাব পড়ল না দিন-রাত্রির আবর্তনে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সময়মতো একটি অন্ধকার রাত এলো এবং রাতের পর আবারও সূর্য উঠল আগের দিনের মতো। ঘুমন্ত সৈনিকরা জেগে উঠল। রোজকার মতো সৈন্যরা অংশ নিল প্রভাতি কুচকাওয়াজে। আবু সুফিয়ান আজও প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। তিনি দেখলেন—গতকালের মতো আজও একটি অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে জড়ো হচ্ছে একদল সৈন্য। তিনি এগিয়ে গেলেন। খালিদের কাঁধে হাত রেখে বললেন—’এসব কী দেখছি খালিদ? এ রকম নিষ্ফল অভিযানের প্রস্তুতি তুমি নিতে পারো না। গতকালের কথা মনে নেই? আকরামার পরিণতির কথা এরই মধ্যে ভুলে গেলে? কেন তুমি কুরাইশ বংশের গায়ে কলঙ্কের কালিমা লেপন করতে চাও? তুমি কি মনে করো এভাবে বিজয় লাভ করা সম্ভব?’

খালিদ বলল—

‘জানি না, তবে পরাজয়ের কলঙ্ক নিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে চাই না। বিজয় আনতে না পারলেও বীরের রক্তদানের সুযোগ থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পারো না।’

আবু সুফিয়ান বলল-

‘অবশ্যই পারি। আমি আমার এক সেনাপতিকে আবেগের দরিয়ায় ভাসতে দিতে পারি না। আবেগকে সংযত ও সংহত করো। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে যুদ্ধের প্রতিটি চাল দিতে হবে তোমাকে, নইলে দুঃখজনক পরাজয়ের গ্লানি বইতে হবে। গতকাল আকস্মিক অভিযান চালিয়েও আকরামাকে পরাজয় মেনে নিয়ে ফিরে

আসতে হয়েছে। আজ সেখানে পাহারা আরও জোরদার করা হয়েছে। আকরামা তো খন্দক পার হতে পেরেছিল, তুমি আক্রান্ত হবে খন্দক পেরোনোর আগেই। অতএব, মাথা ঠান্ডা করো, আত্মঘাতী অভিযানের চিন্তা বাদ দাও মাথা থেকে।’

দূর থেকে আকরামা দেখতে পেল তাদের। আবু সুফিয়ানের শেষের কথাগুলো কানে গেল তার। সে এসে খালিদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল—’দোস্ত, তুমি যদি আমার গতকালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অভিযান চালাতে চাও— তবে বলব, বাদ দাও। আর যদি এ অভিযানের মধ্য দিয়ে তুমি সম্মিলিত বাহিনীর গৌরব বৃদ্ধি করতে পারবে বলে মনে করো, তবে তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো।’

‘কিন্তু আমরা যদি একজনের পরাজয় দেখে অন্যজন পিছিয়ে দাঁড়াই, তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মুসলমানদের গোলাম হয়ে আমাদের বসবাস করতে হবে।’ খালিদ বলল।

আবু সুফিয়ান বলল—’না। আমরা জয়-পরাজয় নির্ধারণ না করেই এবারকার মতো ফিরে যাব। আরও শক্তি সংগ্রহ করে মুসলমানদের ডেকে নেব উন্মুক্ত প্রান্তরে। আজ নয়; সেদিনই নির্ধারিত হবে যুদ্ধের জয়-পরাজয়।’

এই তো সেদিনের কথা। তবুও এর মধ্য দিয়ে পার হয়ে গেছে প্রায় দুটি বছর। আজ মদিনার দিকে যেতে যেতে সেদিনের কথা মনে হওয়ায় নিজের মনেই হেসে উঠল খালিদ বিন ওয়ালিদ। সত্যি, সেদিন বড়োই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। খালিদের মনে সেদিনের স্মৃতি আজও কেমন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

আবু সুফিয়ানের কথার জবাবে খালিদ বলল—’স্বীকার করছি বাস্তবতা কঠিন কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলে মুসলমানদের পরাজিত করা যে একেবারেই অসম্ভব, তা আমি মনে করি না। ভেবে দেখুন, মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার আর আমাদের সৈন্যসংখ্যা দশ হাজারের অধিক। এই তিন হাজার সৈন্য এক জায়গায় জমাট বেঁধে নেই। তারা মদিনা শহরের চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তিন দিকের বিশাল এলাকাজুড়ে ছোটো ছোটো ক্যাম্প করেছে খন্দকের পাশে। এক দলকে ডিউটি দিয়ে রেখেছে পাহাড়ের পাদদেশে। আমরা যদি আমাদের দশ হাজার সৈন্যকে চারদিকে ছড়িয়ে দিই, তবে একদিকেই আমাদের সৈন্য থাকবে ওদের সব সৈন্যের সমান। আমাদের অস্ত্রের অভাব নেই, সৈন্যেরও কমতি নেই। জানি, আমরা এগিয়ে গেলে ওরা তিরবৃষ্টি করবে, কিন্তু কতক্ষণ? আমরাও তিরবৃষ্টি করে ওদের পিছু হটিয়ে দিয়ে খন্দক পার হয়ে শহরে প্রবেশ করার চেষ্টা করব। যদি ওরা না হটে এবং অবিরাম তিরবৃষ্টি অব্যাহত রাখে, তবে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করব, যতক্ষণ ওদের তিরের মজুদ শেষ না হবে। একদিকে খাদ্যঘাটতি, অন্যদিকে অস্ত্রঘাটতি ওদের একসময় পিছু হটতে বাধ্য করবে। আর তখন বিজয় এসে আমাদের পায়ে চুমু খাবে।’

‘ওদের কী পরিমাণ তির মজুদ আছে আমরা জানি না, জানি না কতদিন ওরা তিরের দেয়াল তৈরি করে রাখতে পারবে। আমরা যদি এতদিন বসে না থেকে প্রথম থেকেই লড়াই শুরু করতাম, তবে তোমার এ চিন্তা ফলদায়ক হতো। কিন্তু এখন তো আমাদেরই খাদ্যঘাটতি শুরু হয়ে গেছে। আমরাই তো আর বেশিদিন এভাবে অবরোধ রাখার ক্ষমতা রাখি না। এ অবস্থায় আমরা কয় দিন যুদ্ধ করতে পারব?’ বললেন আবু সুফিয়ান।

আকরামা বলল—’আপনি আমাদের প্রধান সেনাপতি। যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব আপনার। আমি শুরু থেকেই লক্ষ করছি, আপনি লড়াই না করে মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা এবং সে যুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব। আপনি যদি আমার ও খালিদের পরামর্শ মতো যুদ্ধ শুরু করতেন, তবে আমরা বুঝতে পারতাম, মুসলমানদের বাহুর জোর কত? এখন আপনি ফিরে যেতে চাচ্ছেন, অথচ আমরা জানতেই পারলাম না, মুসলমানরা কী পরিমাণ শক্তি নিয়ে আমাদের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হয়েছিল!’

‘এখন তোমরা কী করতে চাও?’ জানতে চাইলেন আবু সুফিয়ান।

‘খালিদের পরিকল্পনামতো অন্তত একবার আমরা ওদের টোকা দিয়ে দেখতে চাই। যাওয়ার আগে আমরা যে এসেছিলাম, সে কথা তাদের মনে করিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’ বলল আকরামা।

‘তোমরা যা ভালো বোঝ করো। এতে আমার সম্মতি-অসম্মতির প্রশ্ন অবান্তর। তোমাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার দিলাম।’ আবু সুফিয়ান এ কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল।

পরদিন ভোর। রণসাজে সজ্জিত হয়ে কাফিররা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাফিরদের যুদ্ধসজ্জা দেখে মুসলমানরাও সক্রিয় হয়ে উঠল। তাদের এক দল নেমে গেল পরিখার মধ্যে। সেখান থেকে তারা তিরবৃষ্টি শুরু করল। অপর দল নিরাপদ দূরত্বে তির নিয়ে অপেক্ষায় রইল। ঝটিকা হামলা করে প্রথম দলকে এড়িয়ে কেউ যদি খন্দক পারও হতে পারে, সে যেন মুসলমানদের বিপদের কারণ না হয়—সে ব্যবস্থা করার জিম্মা দ্বিতীয় দলের। মুসলমানদের তিরের জবাবে তিরবৃষ্টি শুরু করল কাফিররা। খালিদ প্রথমে খন্দকের সরু অংশ দিয়ে খন্দক পার হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দেখল, এখানকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেক শক্তিশালী। এরপর সে গেল যেখানে খন্দকের পাশ বেশি সেদিকে। সেদিক দিয়ে পার হতে গিয়েও সে বিস্তর বাধার সম্মুখীন হলো। এরপর সে এমন একটি ভাব নিল, যেন সে যুদ্ধ থেকে ফিরে যাচ্ছে। তার ধারণা ছিল, ওদের ফিরে যেতে দেখলে মুসলমানরা পাহারায় ঢিল দেবে। তখন ছুটে এসে অতর্কিত সে খন্দক পার হতে চেষ্টা করবে, কিন্তু তার এ চাল কোনো কাজে লাগল না। মুসলমানদের প্রতিরোধে বিন্দুমাত্র ঢিল হলো না কোথাও।

দিনভর হাজার হাজার তির এদিক থেকে ওদিক গেল আর ওদিক থেকে এদিক এলো। অতিরিক্ত সাহস দেখাতে গিয়ে কাফিরদের কয়েকজন মারাও পড়ল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না, মুসলমানদের সাহস তাতে বিন্দু পরিমাণও কমল না।

বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে এলো। রণক্লান্ত কাফিররা ফিরে গেল তাঁবুতে। সেই রাতেই ঘটল এক মহাবিপর্যয়।

ক্লান্ত-শ্রান্ত সৈনিকরা রাতের খানার পর ঘুমিয়ে পড়েছে। সহসা শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ে উড়ে গেল তাদের তাঁবু। ভিজে গেল রসদসম্ভার। ঝড়ের তাণ্ডবে ছিঁড়ে গেল ঘোড়ার রশি। ঘোড়া ছুটল দিকবিদিক। ঘোড়ার পায়ের তলে পিষে মরল ঘুমন্ত কিছু সৈনিক। মরুভূমির বিশাল বিস্তারে হারিয়ে গেল বেশ কিছু ঘোড়া। ঝড়ের সাথে শুরু হলো বৃষ্টি। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। কাফিরদের মনে হলো কিয়ামতের প্রলয় শুরু হয়ে গেছে। এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল হলো। তখনও একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে। সেনাপতিগণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল সৈনিকদের খোঁজে। আকরামা আর খালিদও নিজ নিজ সৈন্যদের তালাশ করে ফিরছিল। খালিদের স্পষ্ট মনে আছে, তার সৈন্যরা ঝড়ের সময় শায়খিন পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল। ভোরে এই শায়খিন পাহাড়ের পাদদেশেই সে এসে সৈন্যদের সাথে মিলিত হয়েছিল।

খালিদ সেই সকালের কথা কোনোদিন ভুলবে না। জীবনে সে খুব কমই ভয় পেয়েছে। কিন্তু সেদিন সকালের কথা মনে হলে এখনও তার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রভাতের আলোয় মুসলমানরা তাকিয়েছিল তাদের তাঁবুগুলোর দিকে। রাতে যেখানে তাঁবু দেখেছিল, সেখানে কোনো তাঁবু নেই। অনেকগুলো তাঁবু দলা পাকিয়ে ঘোড়ার আস্তাবলের খুঁটিতে জমা হয়ে আছে। সৈন্যরা এলোমেলো। অস্ত্রপাতি ভেজা। এ সময় মুসলমানরা খন্দক পেরিয়ে যদি হামলা করত, তবে তাদের দশ হাজার সৈন্য মুসলমানদের এক হাজার সৈন্যের কাছেই পরাজিত হয়ে যেত। মুসলমানদের হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কিত ছিল খালিদ। একই অবস্থা ছিল আকরামারও। তারা দ্রুত সৈন্যদের সংগঠিত করে মুসলিম হামলা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

আজ খালিদের মনে হচ্ছে—এটা কোনো ঝড় ছিল না, একেই বলে আল্লাহর গায়েবি মদদ। সামান্য একটু ঝড় কীভাবে তছনছ করে দিয়েছিল এক বিশাল সেনাবাহিনী। মুসলমানরা যে বলে মুমিনের সাথে আল্লাহ থাকেন—এটা মিথ্যা নয়। বিশাল বাহিনীর হাত থেকে গুটিকয়েক মুসলমানকে সেদিন আল্লাহই রক্ষা করেছিলেন; এই পরিখা বা ঝড় উপলক্ষ্য মাত্র, মুসলমানদের মূল রক্ষক ছিলেন আল্লাহ। তিনিই তাদের মাথায় খন্দক খোঁড়ার অভিনব বুদ্ধি দিয়েছিলেন। আমরা যখন মুসলমানদের ওপর হামলা করলাম, আল্লাহ প্ৰচণ্ড ঝড় দিয়ে আমাদের তছনছ করে দিলেন।

সেই ভোরের কথা মনে পড়ল খালিদের। ওরা যখন নিজেদের সৈন্য একত্রিত করার কাজে ব্যস্ত, আবু সুফিয়ান এক উটের পিঠে চড়ে চিৎকার করে বলছিল——হে কুরাইশ বাহিনী! এখন, এই মুহূর্তে সবাই মক্কার পথ ধরো। এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। সেনাপতি হিসেবে এটা আমার নির্দেশ। এই যে আমি রওনা হয়ে গেলাম। তোমরা আমার পিছু নাও।’

খালিদের জীবনে খন্দকের যুদ্ধ এক বিষাক্ত স্মৃতি হয়ে আছে। যখন তারা মক্কা থেকে রওনা হয়েছিল, তখন বিশাল বাহিনী দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল খালিদের। সহায়-সম্পদহীন, অস্ত্রবলহীন হাজার তিনেক মানুষকে ধ্বংস করার জন্য এত বড়ো বাহিনী দেখে খালিদের মনে হয়েছিল, এবার মুসলমানদের নিস্তার নেই। তিন হাজার মানুষ আরবের সম্মিলিত বাহিনীর মোকাবিলা করবে, এটা হতেই পারে না। তাই উদ্ধত মস্তকে বীরদর্পে তারা ছুটছিল মদিনার দিকে। কিন্তু যখন ফিরে যাচ্ছিল—তখন তাদের মস্তক ছিল অবনত, চেহারা বিধ্বস্ত। পরাজিত সৈনিকের বিমর্ষতা লেপটে ছিল সারা অবয়বে। তারা পালাচ্ছিল ঊর্ধ্বগতিতে। ভয় তাড়া করছিল তাদের। এই বিধ্বস্ত অবস্থায় মুসলমানরা তাড়া করলে আর রক্ষা নেই। বাহিনী বিশাল হলেও মোকাবিলা করার মানসিকতা নেই কারও। তাই ওরা ছুটছিল ভয়ার্ত হরিণীর মতো।

নইম এই পলায়নরত বাহিনীর সঙ্গী হয়নি। ওরা যখন পালানোর জন্য ব্যস্ত, তখন নইম সবার অলক্ষ্যে খন্দক পার হয়ে চলে এসেছিল মুসলিম শিবিরে। রাসূলের দরবারে বসে বর্ণনা করেছিল কাফিরদের শোচনীয় পরিণতি

মুসলমানদের কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল কাফিরদের পিছু ধাওয়া করার জন্য। কিন্তু মানবপ্রেমিক মহানবি (সাঃ) সে প্রস্তাবে আমলে দেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল—মানুষ হত্যা করার জন্য ইসলাম দুনিয়ায় আসেনি; ইসলাম এসেছে মানুষের জীবনকে সুন্দর ও পরিপূর্ণ করতে। নিশ্চিত পরাজয়কে যে মহান সত্তা বিজয়ে রূপান্তরিত করেছেন, সিজদায় লুটিয়ে পড়ে সেই মহান সত্তার শোকর আদায় করাই মুমিনের কর্তব্য। তিনি মুজাহিদদের একটা ছোটো দলকে দূর থেকে তাদের অনুসরণ করতে বললেন। বললেন—’যখন বুঝবে চলে যাওয়াটা কোনো চাল নয়, সত্যি সত্যি ওরা ফিরে যাচ্ছে, তখন চলে আসবে।’ খালিদ দূর থেকে অনুসরণকারী সেই দলটিকে দেখেছিল। তাদের মতলব কী, তাদের পেছনে আরও কোনো বাহিনী আছে কি না জানা ছিল না তাঁর। তাই আশঙ্কার একটা কাঁটা তাঁর মনে গেঁথেই ছিল; যদিও সে এ কথা কাউকে বলেনি।

খালিদের ঘোড়া ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল মদিনার দিকে। খালিদের মনে পড়ল, এ পথ দিয়েই সেদিন পালিয়েছিল তারা। পালানোর সেই দৃশ্য, সেই স্মৃতি এখনও তাকে যেন তাড়া করে ফিরছে।

অনুসরণকারী দল অনেক দূর পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করল। দলনেতা বলল— ‘খোদার কসম! রাসূল (সাঃ) নিষেধ করেছেন, নইলে আমি ওদের ওপর হামলা করে বসতাম।’

তার সঙ্গী বলেছিল—’যে আল্লাহ ইসলামের দুশমনকে না মেরে অক্ষত অবস্থায় তাড়িয়ে দিলেন, তাদের আক্রমণ করা ঠিক হবে না। ইসলাম তো প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আসেনি। শুনোনি রাসূলের বাণী, ইসলাম এসেছে মানুষকে ভালোবাসা শেখাতে, প্রেম শেখাতে। পতিত শত্রুকে আঘাত করা অশোভন ও অমানবিক।’

ফিরে এলো অনুসরণকারী দল। তারা জানাল-’কাফিররা শুধু পালাচ্ছেই না; তারা ভয় ও আতঙ্কে যে যেভাবে পারে ছুটছে মক্কার দিকে। তাদের আর ফিরে আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই।’

এ খবরে মহানবি (সাঃ) কোমর থেকে তলোয়ার খুলে একপাশে রাখলেন। তারপর গোসল করলেন। সাহাবিদের নিয়ে মসজিদে নববিতে গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লেন। মুজাহিদরা আবার যার যার বাড়ি ও কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলেন। মদিনার ঘরে ঘরে বয়ে গেল আনন্দের বন্যা। রাস্তায় নেমে এলো শিশু ও যুবকরা। নারায়ে তাকবির ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল মদিনার অলি-গলি। তাদের এ আনন্দের সাথে শরিক হলো মদিনায় বসবাসরত বনু কুরায়জার লোকজন। মুসলমানদের জয়কে তারা নিজেদের বিজয় মনে করছিল। বনু কুরায়জার এসব লোক মুহাম্মদের আনুগত্য মেনে নেওয়ার প্রমাণস্বরূপ বাৎসরিক সামান্য জিজিয়া দিত। বিনিময়ে তারা পেত নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা। মুসলমানদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। কুরাইশদের হাত থেকে মদিনা রক্ষা পাওয়ায় তারাও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এ জন্য তারা ছিল খুশি। তাই তারা রাস্তায় নেমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ-উল্লাসে শরিক হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *