দুর্গম পথের যাত্রী – ২

খালিদ বিন ওয়ালিদের ঘোড়া আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে মদিনার দিকে। ঘোড়ার পিঠে বসে খালিদ অনবরত স্মৃতি রোমন্থন করছে। মনের পর্দায় ভেসে উঠল এক বছর পরের কথা। যুদ্ধ না করে বদর থেকে পালিয়ে আসায় ইসলামের জাতশত্রু ইহুদিরা প্রমাদ গুনল। তারা আবু সুফিয়ানের সাথে দেখা করে যুদ্ধে সহযোগিতার আশ্বাস দিলো নিজের দুর্বলতা ঢাকতে আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরেই নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিলো। ইহুদিদের আশ্বাস পেয়ে এবং তাদের সহযোগিতা নিয়ে ব্যাপক আকারে বাহিনী গড়ে তোলার জন্য উঠেপড়ে লাগল সবাই। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলল সমর প্রস্তুতি। কুরাইশ ছাড়াও মক্কা এবং আরবের অন্যান্য এলাকার বিভিন্ন গোত্রকে এই যুদ্ধে শামিল করার জন্য তারা ছুটে বেড়াল অঞ্চলের পর অঞ্চল। ইহুদিরাও এ প্রচারণায় শামিল হলো।

পরের বছর ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস। বিভিন্ন গোত্রের যোদ্ধাগণ নিজ নিজ বাহিনীর সাথে শামিল হয়ে মাসের শুরুতেই দলে দলে মক্কা আসতে শুরু করে দিলো। এই অভিযানে শামিল হলো মক্কার বিভিন্ন গোত্রের হাজার হাজার সৈন্য। সবচেয়ে বেশি যোদ্ধা শামিল হলো বনি আসাদ গোত্রের। তবে তাদের কী পরিমাণ সৈন্য এ অভিযানে শরিক হয়েছিল, ইতিহাসে তা উল্লেখ নেই।

তাদের সালার ছিল তালহা বিন খাবিলত। এরপর সবচেয়ে অধিক সৈন্য ছিল বনি গাতফান গোত্রের। তাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল তিন হাজার। তাদের সালার নিযুক্ত হন মুনাইয়া। সাতশো সৈন্য পাঠাল বনি সালেম। কুরাইশদের নিজস্ব সৈন্য ছিল চার হাজার পদাতিক, তিন হাজার ছিল অশ্বারোহী আর উষ্ট্রারোহী সৈন্য ছিল দেড় হাজার। সম্মিলিত এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন আবু সুফিয়ান। খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিল সহকারী প্রধান সেনাপতি, আর আকরামা উপপ্রধান সেনাপতি। বিভিন্ন গোত্রের সৈন্যদের পরিচালনা করছিল নিজ নিজ বাহিনীর সেনাপতিগণ। এই বাহিনী গড়ে তোলার জন্য খালিদও কম দৌড়ঝাঁপ করেনি। এখন এই বিশাল বাহিনী দেখে তাঁর চোখ জুড়িয়ে গেল। তাঁর মনে এই বিশ্বাস জন্মাল, এবার মুহাম্মাদ (সাঃ) ধ্বংস হয়ে যাবে। দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মুসলিম জাতি। নিঃশেষ হয়ে যাবে ইসলাম নামের এই নতুন ধর্মমত।

মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পথে যেসব গোত্র বসবাস করত, তারা খবর পাঠাল- তারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। মক্কায় না গিয়ে তাদের অঞ্চল অতিক্রম করার সময় তারা মূল বাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে যাবে। ফলে বাহিনী যত এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই বাড়ছিল বাহিনীর কলেবর।

বিশাল বাহিনী মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। খালিদ তাঁর গর্বিত ঘোড়ার পিঠে চড়ে এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল। সেখান থেকে দেখতে লাগল সৈন্যদের মার্চ করার দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় অগণিত ফৌজ। যুদ্ধের দামামা বাজছে, সানাই বাজছে। সৈন্যদের চোখে খেলা করছে প্রতিশোধের আগুন। খেলা করছে গভীর আত্মপ্রত্যয়। খালিদ মনে মনে বলল, এই স্রোতের সামনে মুসলমানরা খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। তাদের পায়ের তলায় পড়ে থাকবে লাশ আর লাশ। মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হবে পাহাড়ের কঠিন শিলা ও সমতল বালিয়াড়ি। আরবের বুক থেকে ইসলাম চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে যাবে। মুহাম্মাদকে নিজ হাতে হত্যা করার কঠিন সংকল্প নিয়ে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলো খালিদ বিন ওয়ালিদ।

যেখানে উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই জায়গায় এসে পৌঁছাল এই সম্মিলিত বাহিনী।

এখানে দুটি নদী এসে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। কুরাইশরা এই নদীর মোহনায় তাঁবু গাড়ল। অন্যান্য ফৌজ তাঁবু গাড়ল উহুদ পাহাড়ের পূর্ব পাশে। এ যুদ্ধের ব্যাপারে আবু সুফিয়ান পূর্ব থেকে মুসলমানদের কিছু জানায়নি। সে বিপুল বাহিনী নিয়ে অতর্কিত মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চিন্তা করছিল। উহুদ প্রান্তরে তাঁবু ফেলে আবু সুফিয়ান দুজন গোয়েন্দাকে মদিনায় প্রেরণ করল সেখানকার সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য। তারা বণিকের বেশে মদিনায় গিয়ে পৌঁছল। আবু সুফিয়ান ধারণা করেছিল, মুসলমানরা কাফিরদের রণপ্রস্তুতি ও অগ্রগতির খবর জানে না। অন্যান্য সেনাপতিরও ধারণা ছিল একই রকম। কিন্তু যে দুজন ইহুদি গোয়েন্দাকে মদিনায় পাঠিয়েছিল, পরের দিন তারা ফিরে এসে বলল—’আমাদের অগ্রাভিযানের খবর মদিনাবাসী আগেই পেয়েছে। মদিনার অলিগলিতে ত্রাস ও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত শহরে একধরনের থমথমে ভাব ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কিন্তু এ খবরে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী- সাথিরা মোটেই ভীত-শঙ্কিত হয়নি। খবর পেয়ে তাঁরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহরের অলিগলিতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সবাইকে উদাত্ত আহ্বান জানানো হচ্ছে। এই ঘোষণা শুনে দলে দলে লোক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সমবেত হচ্ছে। তাদের মধ্যে উদ্দীপনার অভাব নেই। আমরা যতদূর বুঝেছি, তাতে বলতে পারি–মদিনায় সমবেত লোকের সংখ্যা তিন হাজারের ওপর হবে না।’ ইতিহাসবিদগণ এ যুদ্ধে মুসলমান মুজাহিদদের সংখ্যা তিন হাজার বলে উল্লেখ করেছে।

কাফিরদের সৈন্যসংখ্যা দশ হাজারের অধিক। পদাতিক ছাড়াও তাদের রয়েছে বিপুলসংখ্যক অশ্বারোহী। হস্তীবাহিনীও আছে দেড় হাজারেরও অধিক। আরবের জনগণ এর আগে এত বিপুলসংখ্যক সৈন্য একত্রে দেখেনি। তার মোকাবিলায় মুসলমানদের সৈন্য মাত্র তিন হাজার। গুটিকয়েক অশ্বারোহী থাকলেও হাতি নেই একটিও। যদি কোনো শিশুকেও জিজ্ঞেস করা হয় এ যুদ্ধে কাদের জেতার সম্ভাবনা অধিক? চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সে বলবে-কুরাইশদের। কোনো সমরনায়ককে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলবে, এ অবস্থায় মুসলমানদের আত্মসমর্পণ করা উচিত, আর নাহয় রাতের অন্ধকারে শহর ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করা উচিত। দশ হাজারের অধিক প্রশিক্ষিত সৈন্যের বিরুদ্ধে তিন হাজার মুজাহিদের লড়াই করার কথা কোনো সুস্থ মাথার মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।

আবু সুফিয়ান এ খবর শুনে তৃপ্তির হাসি হাসল। খালিদও ভাবছিল, এই বিশাল বাহিনী মদিনায় পৌঁছলে লড়াই করার কোনো মওকাই পাওয়া যাবে না। সহজেই এ বাহিনী মদিনার ইট-পাথর গুঁড়ো করে দেবে। কিন্তু তাদের জানা ছিল না, এটা সত্য-মিথ্যার লড়াই। এক পক্ষে দাঁড়িয়েছে বিশ্বজাহানের স্রষ্টা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল-প্রেমিক মুজাহিদবৃন্দ, অন্য পক্ষে নিষ্প্রাণ মূর্তিপূজক দাম্ভিক কাফির বাহিনী। আল্লাহ সব সময় সত্যের পক্ষে থাকেন এবং সংখ্যায় কম হলেও আল্লাহর সৈনিকরা যখন সর্বশক্তি নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন আল্লাহ তাদেরই বিজয় দান করেন। এর আগে বদরে তাঁরা এর প্রমাণ পেয়েছে। ফলে সংখ্যায় কম হলেও বিজয়ের তামান্না নিয়েই তাঁরা ময়দানে নেমে এসেছে।

মদিনার অলি-গলিতে ঘোষণা হচ্ছিল—’সত্যের সৈনিকরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসো। আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্বে ছুটে চলো ময়দানে। হক ও বাতিলের এ লড়াইয়ে আল্লাহ তোমাদের সাথেই আছেন। তোমরা লড়াই করো। মারো অথবা শাহাদাতের পেয়ালা পান করে চলে যাও আল্লাহর দরবারে। তোমরা কি জানো না- যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, আল্লাহ তাদের মৃত বলতে নিষেধ করেছেন? আমাদের হারানোর কিছু নেই। বাঁচলে আমরা গাজি আর মরলে শহিদ। উভয় ক্ষেত্রেই মুমিনের সাফল্য সুনিশ্চিত।

ওদের অস্ত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে, ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু মুমিনের অস্ত্র কখনো নষ্ট হয় না, ভাঙে না। আমাদের অস্ত্র হচ্ছে ঈমান ও মানোবল। আজ যদি আমরা পরাজিত হই, তাহলে নিঃশেষ হয়ে যাবে আমাদের অস্তিত্ব। নিঃশেষ হয়ে যাবে ইসলাম। দুনিয়ার বুক থেকে মুছে যাবে মুসলমানদের নাম-নিশানা আর আমাদের বিজয় মানে মদিনার বিজয়ই শুধু নয়; বিজয় হবে মানবতার, বিজয় হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের। কোনো ভয়-ভীতি মুমিনকে স্পর্শ করতে পারে না। জীবন-মৃত্যু আমাদের পায়ের ভৃত্য। যারা হাসতে হাসতে মরতে জানে, মরণ তাদের থেকে পালিয়ে যায় দূরে, বহু দূরে।’ এভাবে মদিনার সাহাবিরা উজ্জীবিত করছিল মুজাহিদদের। শাহাদাতের তামান্না নিয়ে মুজাহিদরা শামিল হচ্ছিল যুদ্ধের কাফেলায়।

উহুদের প্রান্তর মাড়িয়ে খালিদের ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে মদিনার দিকে। নিঃসঙ্গ পথিকের মনে ভাসছে অতীত দিনের স্মৃতি। খন্দক-যুদ্ধের কথা মনে পড়ল তাঁর। বিপুল বাহিনী নিয়ে এই উহুদ প্রান্তরে তারা যখন তাঁবু ফেলেছিল, তখন বিজয়ের স্বপ্নে মন ছিল টইটম্বুর। অল্প কজন মুসলমানের সাধ্য ছিল না তাদের হাত থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এটা মানুষের হিসাব, আল্লাহর হিসাব ছিল অন্যরকম। মুষ্টিমেয় মুসলমানকে রক্ষার ব্যবস্থা আল্লাহ নিজেই করে রেখেছিলেন। কীভাবে এই বিপদ থেকে রেহাই পাবে—এটা যেমন জানা ছিল না মুসলমানদের, তেমনি কাফিররাও জানত না—এবারও মুসলমানদের নিঃশেষ না করেই ফিরে যেতে হবে তাদের।

আল্লাহ মুসলমানদের রক্ষার এমন এক ব্যবস্থা করলেন, আরবের যুদ্ধ- ইতিহাসে যার কোনো পূর্বনজির নেই। এই অভাবিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নায়ক ছিলেন এক ভিনদেশি। সত্যের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পৌঁছেছিলেন মদিনায়। রাসূলের সাথে দেখা করে বৃদ্ধ বয়সে ইসলাম কবুল করে নিজের আত্মাকে শান্ত করেছিলেন। এই ব্যক্তির নাম সালমান ফারসি।

সালমান ফারসি ছিলেন পারস্যের অগ্নিপূজকদের ধর্মীয় নেতা। তিনি কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন এমন নন; যুদ্ধবিদ্যায়ও ছিলেন কুশলী ও পটু। পারস্যের সেনাপ্রধান যুদ্ধের সময় তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ঘোরতর যুদ্ধ বাধলে স্বয়ং সম্রাটও স্মরণ করতেন তাঁকে। ধর্মের প্রতি অনুরাগের কারণে পারস্যের জনগণ তাঁকে ধর্মীয় নেতা বলে মান্য করত। পারস্যবাসী ছিল অগ্নিউপাসক। তারা কেবল অগ্নিপূজাই করত না; সালমান ফারসিকেও দেবতাজ্ঞান করে তাঁর পূজা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্য সন্ধানী এক সাধকপুরুষ। সত্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। একদল আরব বণিক সিরিয়া যাচ্ছিল। তিনি সেই কাফেলায় শামিল হয়ে গেলেন।

একদিন এক বণিক তাঁকে শোনাল এক অদ্ভুত কথা—’মক্কার এক লোক নিজেকে নবি বলে দাবি করেছে। সে সবাইকে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলে। তাঁর দাবি—তাঁর কাছে ওহি আসে। সে আরও বলে—’এক আল্লাহর ইবাদত করো এবং আমাকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলে মেনে নাও।’ আমাদের মতো সে মূর্তিপূজা করে না। সে বলে—’যে মূর্তির গায়ে মাছি বসলে সেই মাছিও তাড়াতে পারে না, সেই মূর্তি মানুষের কল্যাণ করবে কীভাবে? যে আল্লাহ আমাদের বানিয়েছেন, আমাদের সব সমস্যা কেবল তিনিই দূর করতে পারেন।

মক্কার লোকেরা তাঁকে এসব বলা থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ দিলো, কিন্তু তিনি থামলেন না। তাঁকে সম্পদ, ক্ষমতা ও সুন্দরী নারীর প্রলোভন দেখানো হলো, তবু তিনি থামলেন না। তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হলো, কিন্তু তিনি নিবৃত হলেন না। অবশেষে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু তাঁর আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে দিলো। তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন।’

সালমান ফারসি-এর প্রচণ্ড লোভ হলো এই লোকটিকে দেখার। তাঁর মন বলল—এ লোক যদি সত্যি নবি হয়ে থাকে—তবে যে সত্যের সন্ধানে আমি ঘুরে মরছি, সেই সত্য তাঁর কাছে পাওয়া যেতে পারে। জীবন সমস্যার যেসব সমাধান খুঁজে ফিরছি আমি, হয়তো তাঁর কাছে পাওয়া যেতে পারে সেসব সমস্যার সমাধান। বুড়ো বয়সে কেবল সত্য ও সুন্দরের প্রত্যাশায় তিনি মদিনার পথ ধরলেন। কাফিররা যখন খন্দক যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হয়, তখন তিনি মদিনাতেই ছিলেন। ইতোমধ্যে তিনি রাসূলের সাথে দেখা করে এবং তাঁর সাথে কথা বলে প্রশান্ত চিত্তে ইসলাম কবুল করেছিলেন।

আবু সুফিয়ান কিংবা খালিদ কেউ জানত না সালমান ফারসি মদিনায় আছেন এবং তিনি যুদ্ধবিদ্যায় অসম্ভব রকমের পারদর্শী। খালিদের ঘোড়া উহুদের ময়দান অতিক্রম করছিল আর খালিদ স্মরণ করছিল খন্দক যুদ্ধের কথা। সালমান ফারসি যখন শুনতে পেলেন-মক্কা থেকে বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে এবং রাসূল (সাঃ) ও অল্পসংখ্যক মুসলমান এই বিপদের মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন মহানবি (সাঃ) ও তাঁর প্রিয় সাহাবিদের এক পরামর্শ দিলেন। বললেন—’বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অল্পসংখ্যক মুসলমান নিয়ে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। কাফিররা যদি যুদ্ধের পাশাপাশি মদিনা অবরোধ করে বসে, তবে মহাবিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। অরক্ষিত মদিনা সহজেই তারা কব্জা করে নিতে পারে। শহর অরক্ষিত রেখে বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করলে তার ভয়াবহ পরিণতি মুসলমানদের জন্য শুভ হবে না। মুসলমানদের উচিত মদিনাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।’

কোনো কোনো সাহাবি প্রশ্ন তুললেন—’তাহলে কি আমরা দুশমনকে নির্বিঘ্নে আমাদের ঘরের দুয়ার পর্যন্ত চলে আসার সুযোগ দেবো? আমাদের স্ত্রী-কন্যা ও শিশুদের দিকে তাকিয়ে হলেও আমাদের উচিত তাদের পথেই থামিয়ে দেওয়া, নইলে অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।’

তিনি বললেন—’আমরা দুশমনকে মদিনায় প্রবেশ করার কোনো মওকা দেবো না। এমন ব্যবস্থা করব, যাতে যত বড়ো বাহিনী-ই হোক, মদিনায় প্রবেশ করার সাহস তারা না পায়।’

চিন্তান্বিত সাহাবিরা বললেন—’কিন্তু কীভাবে?’ তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

তিনি বললেন—’আমরা শহরের চারপাশে পরিখা খনন করব।’

আরবের লোকেরা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে পরিখা ব্যবহারের কথা কেউ জানত না। এই অভিনব প্রস্তাব শুনে তারা বলল—’পরিখা কী? এটা দিয়ে কি দুশমনকে ঠেকিয়ে রাখা আদৌ সম্ভব হবে?’

তিনি জওয়াব দিলেন—’পরিখা মানে গর্ত। আমরা শহরের চারপাশে এমন গর্ত করব, যাতে কেউ চাইলেও লাফ দিয়ে তা পার না হতে পারে। আর এর উচ্চতা এমন হবে, যেন কেউ তাতে নেমে সহজে ওপরে উঠতে না পারে।’

সাহাবিরা বলল—’এটা কি আদৌ সম্ভব? এত বিশাল এলাকাজুড়ে গর্ত খনন করা তো বিশাল কাজ। এভাবে গর্ত করে আত্মরক্ষা করা যায় বলে তো কখনো শুনিনি!’

তিনি বললেন—’কেন সম্ভব নয়? সবাই মিলে হাত লাগালে খুব বেশি সময় লাগবে না। আর এর কার্যকারিতা? এ ব্যাপারে আপনাদের কোনো ধারণাই নেই। দুর্বলদের আত্মরক্ষার এ এক সহজ উপায়। ধরুন, বিশাল বাহিনী নিয়ে কাফিররা আমাদের অবরোধ করল। প্রতিদিন সেই বাহিনীর জন্য দরকার হবে প্রচুর খাদ্য ও পানীয়। শুধু তাদের নয়; খাদ্য-পানীয় লাগবে উট, ঘোড়ার জন্যও। রসদ ফুরিয়ে গেলে সুদূর মক্কা থেকে খাবার, পানি এনে সরবরাহ অটুট রাখবে এটা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে তাদের পিছু হটতে হবে এবং ফেরার মতো খাদ্য, পানীয় থাকতেই অবরোধ তুলে পালাতে হবে তাদের, নইলে মরুভূমির বিস্তারে না খেয়েই মরতে হবে।’

সালমান ফারসি-এর এ প্রস্তাব মনঃপূত হলো মহানবি (সাঃ)র। অধিকাংশ সাহাবিও চমৎকৃত হলো এ অভিনব প্রস্তাবে। কিন্তু বিপুল এলাকার খননকার্য নিয়ে দুশ্চিন্তা তাঁদের। মহানবি (সাঃ) প্রতি দশজনের একেকটা গ্রুপ করলেন। খন্দকের লম্বা, চওড়া ও গভীরতা হিসাব করে দেখা গেল, যদি প্রতি গ্রুপ চল্লিশ হাত গর্ত খনন করে— তবেই হবে; মানে প্রতিজনের ভাগে পড়ে মাত্র চার হাত। তিনি মদিনার তিন দিকে খন্দক খননের সিদ্ধান্ত নিলেন। চারপাশের পুরোটাই খনন করার দরকার হলো না। কারণ, একপাশের উঁচু পাহাড় প্রতিরক্ষাদেয়াল হিসেবে কাজ করবে।

মহানবি (সাঃ) গ্রুপ ভাগ করে সাহাবিদেরকে তাঁদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। সাহাবিরা তখনও কাজে নামেননি, দেখা গেল-কোদাল নিয়ে মহানবি (সাঃ) নিজেই খননকার্য শুরু করে দিয়েছেন। এটা দেখে সাহাবিরা সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও জড়তা ফেলে নিজ নিজ অংশের খননকাজে লেগে গেল।

খন্দকের গর্ত খোঁড়া চলছে। মুজাহিদরা যেন ক্লান্ত হয়ে না পড়ে সেজন্য মহানবি (সাঃ) তাঁদের উদ্দীপনামূলক কবিতা শোনাতে বললেন কবি হাসসান বিন সাবিত-কে। হাসসান ঘুরে ঘুরে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। কোথাও মুজাহিদরাও গাইছিলেন গান, আবৃত্তি করছিলেন কবিতা। সৈনিকদের উজ্জীবিত করার জন্য মহানবি (সাঃ) নিজেও শোনাচ্ছিলেন মিসরা, অর্থাৎ স্বরচিত ক্ষুদ্র কবিতা। এভাবেই বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কয়েক মাইল দীর্ঘ পরিখা খননের কাজ এগিয়ে চলল। কোথাও মাটির পরিবর্তে ছিল শুধু বালি, কোথাও আবার কঠিন শিলা। সেই পাথুরে শিলা ভেঙে এগিয়ে চলল গর্ত করার কাজ। মুজাহিদদের বিশ্রামের কোনো অবকাশ ছিল না। শত্রুরা ছিল ঘাড়ের ওপর। তারা মদিনার অনতিদূরে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাঁবু গেড়ে অপেক্ষা করছিল আগমনের জন্য।

খালিদের মনে পড়ল, এই পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সে দেখেছিল তাঁর বিশাল বাহিনী। পাহাড়ের পাদদেশে অগণিত তাঁবু। সৈন্যরা তাদের ঘোড়া ও উটের তদারক করছে। আগামীকাল ভোরে এরাই টুটে পড়বে মুসলমানদের ওপর। ভাবছিল, এ ফৌজের হাতেই এবার মুসলিম ফৌজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; চিরতরে মুছে যাবে মুহাম্মাদের নাম। সে এবং অন্যান্য সালাররা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল মুসলিম ফৌজের আগমনের।

পরদিন ভোরে আবু সুফিয়ান খালিদকে বলল—’মুসলমানরা ভয় পেয়েছে। এই বিশাল বাহিনী দেখে ঘাবড়ে গেছে তারা। ময়দানে আসতে সাহস পাচ্ছে না। আমরা কি এখানেই বসে থাকব? নাকি মদিনায় গিয়ে ওদের সাথে শেষ বোঝাপড়া করে নেব?’

খালিদ ভাবছিল ভিন্ন কথা। উহুদের ময়দানে সে দেখেছে মুসলমানদের সাহস। ভয় নামক শব্দটি ওদের অভিধানে নেই। মোকাবিলা না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ মুসলমানরা নয়। কিন্তু মুসলমানরা আসছে না কেন? নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো ‘কিন্তু’ আছে। কী সেই ‘কিন্তু’ জানে না সে। তবে কোনো না কোনো কারণ এর মধ্যে আছে—এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে আবু সুফিয়ানকে বলল—’আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তারা ময়দানে আসছে না কেন? তাদের মতলবটা আসলে কী?’

আকরামা বলল——সেটা বোঝার জন্য আমাদের মদিনা যেতে হবে। আবু সুফিয়ানের সাথে আমি একমত, এখানে বসে না থেকে আমাদের মদিনায় হামলা করা উচিত।’

আবু সফিয়ান বাহিনীকে মদিনা আক্রমণের হুকুম দিলো। খালিদ তাঁর বাহিনীর কাছে ফিরে গিয়ে বলল—’হে কুরাইশ বংশের বীর সন্তানেরা! মুসলমানরা ভয় পেয়েছে। তারা তাদের ঘাঁটি মদিনা ছেড়ে বাইরে আসার সাহস পাচ্ছে না। এগিয়ে চলো। মদিনাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেবতাদের অপমান করে মুহাম্মাদ (সাঃ) যে নতুন ধর্মমত প্রচার করছে, মদিনার ইট ও বালির নিচে কবর দিতে হবে তাঁকে। আগামীকালের সূর্যোদয় মুহাম্মাদ (সাঃ) নামে কাউকে যেন জীবিত দেখতে না পায়।’

সম্মিলিত কাফির বাহিনী এগিয়ে চলল মদিনার দিকে। বিশাল বাহিনীর ঠিক মাঝখানে আবু সুফিয়ান। ডানে খালিদ আর বায়ে আকরামা। মদিনার কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ করেই কাফেলা থেমে গেল। আবু সুফিয়ান চিৎকার করে বলল—’আগে বাড়ো।’ কিন্তু বাহিনী একচুলও নড়ল না, যেমন ছিল তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অধৈর্য হয়ে আবু সুফিয়ান নিজেই সামনে বাড়ল। কাফেলার সম্মুখভাগে গিয়ে যা দেখল, তাতে সে বিস্মিত না হয়ে পারল না। সে দেখল, শহরের বাইরে দীর্ঘ পরিখা। শহরে ঢোকার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সেই গর্ত এতটাই প্রশস্ত যে, লাফ দিয়ে পার হওয়ার উপায় নেই। গর্তে নেমে ওপাশে উঠাও দুষ্কর। মুসলমানরা নিরাপদ দূরত্বে তির-ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ গর্ত পেরিয়ে ওপাশে উঠতে গেলেই তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। এমন অভিনব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেখে আবু সুফিয়ানের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে চিৎকার করে বলল—’খালিদকে ডাকো, আকরামাকে ডাকো।’

একটু পর আবু সুফিয়ান দেখতে পেল, দুই দিক থেকে দুই দ্রুতগামী অশ্বারোহী এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে খালিদ ও আকরামা তার পাশে এসে দাঁড়াল। আবু সুফিয়ানের মতো তারাও দেখল সামনে অলঙ্ঘনীয় পরিখা। বিস্মিত খালিদ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একই অবস্থা আকরামারও। তাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটল আবু সুফিয়ানের কথায়। আবু সুফিয়ান বলল— ‘এটা কী খালিদ?’

খালিদ জবাব দেওয়ার আগেই আকরামা স্বাগত কণ্ঠে বলল—’এটা নিশ্চয় কোনো চতুর ইহুদির বুদ্ধি। ইহুদিরা যেমন কূটকৌশলী, তেমনি চিকন বুদ্ধির অধিকারী। তারা কাফিরদের সাথে যেভাবে ভাব রেখে চলছে, হয়তো একইভাবে মুসলমানদের সাথেও সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।’

‘এটা কী বলছ তুমি!’ আবু সুফিয়ান বিস্মিত কণ্ঠে বলল।

আফরামা বলল—’ঠিকই বলেছি। কোনো মুসলমানের মাথায় এমন অদ্ভুত বুদ্ধি আসার কথা নয়। মুসলমানের আমি যেমন চিনি, তেমনি আপনিও চেনেন। আপনি এটাও জানেন, ইহুদিরা হলো দুইমুখো সাপ। কূটকৌশল ও প্রতারণায় তাদের কোনো জুড়ি নেই। তারাই হয়তো এমন অভিনব প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বুদ্ধি দিয়েছে মুসলমানদের।

আবু সুফিয়ান বলল—’না আকরামা, এটা মুসলমানেরই কাজ। বুদ্ধি ও সমর কৌশলে মুহাম্মাদ (সাঃ) অতুলনীয়। বদরে শক্তিতে নয়; এই বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার কারণেই তাঁরা আমাদের পরাজিত করতে পেরেছিল।’ খালিদ বলল—’উহুদের যুদ্ধেও নিশ্চিত পরাজয় ধ্বংস থেকে বেঁচে গিয়েছিল এই বুদ্ধির জোরেই। শহরের চারদিকে খন্দক করে আত্মরক্ষার কৌশল অভিনব-সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশাল বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এমনটা করা সমর কৌশলেরই অংশ। মুহাম্মাদের চালের কাছে প্রতিবারই আমরা হেরে গেছি। খুব কম লোকই অবস্থা অনুযায়ী এমন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।’

‘আমরা কি তবে খন্দক পেরিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করব না?’ আকরামা খালিদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

‘নিশ্চয়ই করব। এসো ঘুরে দেখি। কোথাও না কোথাও ভেতরে ঢোকার মতো পথ পেয়েও যেতে পারি।’ আবু সুফিয়ান দৃঢ়তার সঙ্গে বলল।

খালিদ তখন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। সে ভাবছিল, কী করে এই বাধা ডিঙিয়ে মদিনায় হামলা করা যায়। খালিদকে চিন্তান্বিত দেখে আবু সুফিয়ান বলল——কী হলো ওয়ালিদের বেটা? কী ভাবছ তুমি?’

খালিদ বলল—’একজন সমরনায়কের চোখে আমি ওদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেখছি। শহরে কোনো শিশু, বুড়ো ও নারীকে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে ওদের ওরা নিরাপদ কেল্লায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা পাহারায়ও অল্পসংখ্যক লোককে রেখেছে, যাতে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা পালাক্রমে ডিউটি দিতে পারে। বাকি সৈন্যরা বিশ্রাম ও সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। তুমি যেদিক দিয়েই শহরে ঢুকতে যাবে, তারা সেখানেই প্রতিরোধের শক্ত দেয়াল তুলে দেবে। তাদের তিরের আঘাতে লুটিয়ে পড়বে আমাদের সৈন্যরা। আমাদের বিশাল বাহিনী এই পাড়ে বসে দাঁত কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।’

আবু সুফিয়ান বলল—’তারপরও পুরো খন্দক এলাকা আমরা ঘুরে দেখতে চাই। শহরে প্রবেশের কোনো উপায় যদি বের না করতে পারি, তবে আমরা শহর অবরোধ করব। কতদিন ওরা এই ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে থাকবে? দানা- পানির অভাব দেখা দিলে ওরা যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। এত বিশাল বাহিনী নিয়ে ওদের পরাজিত না করে মক্কায় ফিরে যাব না আমি।’

খালিদ বলল—’কিন্তু আবু সুফিয়ান, তুমি শুধু মুদ্রার এক পিঠ দেখছ, অপর পিঠ দেখছ না। ওদের রসদ ফোরাবে, তোমার ফোরাবে না? তোমার বিশাল বাহিনীর জন্য প্রতিদিন কি পরিমাণ খাদ্য-পানীয় লাগবে সেটা ভেবে দেখেছ? মক্কা এখান থেকে অনেক দূরে। ওখান থেকে রসদ এনে ঘাটতি পূরণ করবে সে সুযোগ নেই। ফেরার মতো রসদ না নিয়ে এখানে অবরোধ করে বসে থাকলে দুশমনের দরকার হবে না, না খেতে পেয়ে তোমার সৈনিকরা এমনিতেই মারা যাবে।’

‘কতদিন আমরা অবরোধ করে থাকব সে আলোচনা পরে করলেও চলবে। আগে চলো খন্দকটা ঘুরে দেখি।’ ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল আকরামা।

ওরা তিনজন নিরাপদ দূরত্ব দিয়ে খন্দক ঘুরে দেখল। না, শহরে প্রবেশের মতো কোনো ফাঁকফোকড়-ই রাখেনি মুসলমানরা।

আবু সুফিয়ান তার সেনাপতিদের নিয়ে যখন খন্দক দেখছিলেন, তখন এক ঘোড়সওয়ারকে তাদের দিকে আসতে দেখল। কাছে এলে তাকে চিনতে পারল আবু সুফিয়ান। এ লোক এক ইহুদি। কাফিরদের গোয়েন্দা হিসেবে যে দুজন মদিনা গিয়েছিল, সে তাদেরই একজন। আবু সুফিয়ান তাকে দেখেই বলল— ‘নতুন কোনো খবর আছে?’

সে বলল—’মুসলমানরা যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। অল্পকিছু লোককে তোমরা পাহারায় দেখছ, বাকিরা অপেক্ষা করছে তোমরা কোন দিক দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছ তার অপেক্ষায়। তোমরা যেদিক দিয়েই ঢুকতে চাও না কেন, তারা মুহূর্তে ছুটে যাবে সেখানে আর তিরের আঘাতে তোমাদের ধরাশায়ী করবে। রাতের আঁধারে খন্দক পার হওয়ার মতো বেশ কিছু কাঠের সাঁকো বানিয়ে রেখেছে ওরা। আর অনেকগুলো মোটা রশি বানিয়ে রেখেছে। অন্ধকারের সুযোগে তোমাদের দৃষ্টি বাঁচিয়ে তা-ই দিয়ে খন্দক পার হয়ে তোমাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করার ফন্দি আঁটছে।’

‘আবদুল্লাহ বিন উবাই কী করছে?’ আবু সুফিয়ান জানতে চাইল।

হাসল ইহুদি। বলল—’তোমরা ভুল লোককে বন্ধু বাছাই করেছ। আসলে তার কোনো ধর্ম নেই। এই লোক আগে ছিল ইহুদি। মুসলমানদের অগ্রযাত্রা দেখে সে হয়ে গেল মুসলমান। উহুদের যুদ্ধের সময় তার ভক্ত তিনশো লোককে ভাগিয়ে নিয়ে আসার পর থেকে মুসলমারা আর তাকে বিশ্বাস করে না। এখন তারা তাকে ডাকে মুনাফিক বলে। বিশাল বাহিনী নিয়ে তোমরা আসবে জেনে সে গোপনে তোমাদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল। কিন্তু খন্দক খননের পর মুসলমানদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি দেখে সে নিশ্চিত হয়ে গেছে, এবার তোমরা মুসলমানদের কিছুই করতে পারবে না। তাই সে তার চোখ উলটে ফেলে আবার মুসলমানদের সঙ্গী হয়ে গেছে। আসলে সে তোমাদেরও বন্ধু নয়, মুসলমানদেরও বন্ধু নয়। সে কেবল তার নিজের বন্ধু!’

আবু সুফিয়ানের চেহারা দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল। মদিনার সীমান্তে অল্প কজন পাহারাদার দেখে তার মুখে যে হাসি হাসি ভাব জমা হয়েছিল, এ খবর শোনার পর সে হাসি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। সে এবার প্রশ্ন করল——জুহাইয়া বিন আফতাব কোথায়? সে কী করছে?’

‘সে মদিনার ভেতরেই আছে। সে এবং আমার আরও কিছু সঙ্গী ওখানে মুসলমানদের মনোবল দুর্বল করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে।’

উহুদের প্রান্তর অতিক্রম করতে করতে এসব কথাই মনে পড়ছিল খালিদ বিন ওয়ালিদের। তাঁর মনে আছে, এই অবরোধ ২২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। এ ২২ দিনে কাফিররা মদিনার ওপর কার্যকর কোনো আঘাত হানতে পারেনি। তাদের খাদ্য ও রসদ কমে আসছিল। তার চেয়েও সংকট দেখা দিলো পানির। সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলো। বিশেষ করে কুরাইশ ছাড়া যেসব গোত্র এ অভিযানে শরিক হয়েছিল, তারা ফিরে যেতে চাইল। খালিদ দুঃসহ যন্ত্রণায় ছটফট করেছে এ বাইশ দিন।

ওই দিকে মদিনার অবস্থাও ভালো ছিল না। কাফিররা কতদিন অবরোধ অব্যাহত রাখবে জানা নেই তাদের। এ ব্যাপারে মহানবি (সাঃ) নিজেও জানেন না কিছু। তাই তিনি খাবার রেশন করে দিলেন। মদিনার সমস্ত জনসাধারণকে নিয়ে এলেন এই প্রোগ্রামের আওতায়। এই সুযোগকে কাজে লাগাল মুনাফিক ও ইহুদি সম্প্রদায়। তারা প্রচার করতে লাগল, মদিনায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আত্মসমর্পণ না করলে না খেয়ে মরতে হবে সবাইকে। তারা দাবি তুলল—’খাবার চাই, পানি চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই।’ এ সময় নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। এই গুজবের উৎপত্তি কোথায় কেউ জানত না। একবার গুজব ছড়িয়ে পড়ল, কাফিরদের জন্য খাদ্য ও রসদ নিয়ে এগিয়ে আসছে পারস্য বাহিনী।

জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ওরা বলাবলি করতে লাগল—’পেটের ক্ষুধায় আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। আমাদের চোখের সামনে মারা যাবে আমাদের শিশু ও নারীরা।’ লোকজন জটলা করে যখন এসব বলাবলি করছিল, তখন শোনা গেল এক সাহাবির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি বলতে লাগলেন—’হে মদিনার জনসাধারণ! আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা একজন নবি পেয়েছি। আল্লাহর সাহায্য সব সময় নবির সাথে আছেন। তিনি চাইলে আকাশ থেকে আমাদের জন্য খাবার পাঠাবেন, যেমন পাঠিয়েছিলেন মুসা নবির উম্মতের জন্য। আর যদি আল্লাহ তাঁর নবিকে না খাইয়ে মারতে চান, তবে আমরা এমন কী হয়ে গেছি যে, নবির চাইতেও অধিক মর্যাদা দাবি করব? তিনি না খেয়ে মরলে আমরাও না খেয়ে মরব, তবু কাফিরদের কাছে আত্মসমর্পণ করব না। যুদ্ধের সময় এ ধরনের আলোচনা কাপুরুষতা ও নির্লজ্জতার নামান্তর। আমরা তো নিয়মিত খাবার পাচ্ছি, তবে অহেতুক এই সব আলোচনা কেন? এরপরও যারা এ নিয়ে সমাজে অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তারা আল্লাহ ও তাঁর নবির দুশমন। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হব।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর লোকজন জটলা ভেঙে যার যার ঘরের দিকে চলে গেল।

অবরোধের দশ দিন চলে গেছে। কাফিররা কোনো আক্রমণই পরিচালনা করতে পারেনি। খালিদ উদাস নয়নে তাকিয়ে দেখে মদিনা। ভাবে, মুষ্টিমেয় মুসলমান আত্মরক্ষার কী কৌশলই না এঁটেছে! দশ হাজারের অধিক প্রশিক্ষিত বাহিনী নিয়েও তারা ওদের কিছুই করতে পারছে না। যুদ্ধ হলে তো জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন, যুদ্ধ- ই তো হচ্ছে না। আবু সুফিয়ান তাঁবুর বাইরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। তার অস্থিরতার কারণ—খাদ্য সংকট। কুরাইশের একদল সেনা পাশের গ্রামে হানা দিয়ে কিছু খাবার লুট করে এনেছে। এতে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। মদিনার আশপাশের গ্রামের লোকজন অধিকাংশই ছিল ইহুদি। এসব ইহুদি গ্রামবাসী, তাদের শত্রুজ্ঞান করা শুরু করেছে। অন্যদিকে অন্যান্য কবিলার সৈন্যরাও লুটপাটের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে বলছে—’কুরাইশরা লুট করতে পারলে আমাদের দোষ কোথায়?’

পায়চারি করতে করতে একসময় আবু সুফিয়ানের মনে পড়ল জুহাইয়া বিন আফতাবের কথা। এই ইহুদিই একমাত্র ব্যক্তি, যে মদিনার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির খবর নিয়মিত তাকে সরবরাহ করছিল। আবু সুফিয়ানের মনে নতুন খেয়াল এলো, মদিনার ইহুদিদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে এ লোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। পায়চারি থামিয়ে আবু সুফিয়ান এক রক্ষীকে ডেকে বলল—’জুহাইয়া ইবনে আফতাবকে খবর দাও। খুঁজে দেখ সে কোথায় আছে। তাকে বলবে, আমি জরুরি ভিত্তিতে তাকে স্মরণ করছি।’

রক্ষী বাহিনী চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাকে খুঁজতে। একসময় পেয়েও গেল। খবর পেয়েই ছুটে এলো জুহাইয়া বিন আফতাব। আবু সুফিয়ান তাকে জানাল খাবার লুটের ঘটনা। বলল—’আমি আশঙ্কা করছি, এতে ইহুদিদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে। এটা যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে তোমাকে।’

হাইয়া বিন আফতাব তাকে আশ্বস্ত করে বলল—’এটা নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনি চাইলে তাদেরকে আমাদের পক্ষে ব্যবহার করার একটা চেষ্টাও করতে পারি।’

আবু সুফিয়ান বলল—’এটা তো উত্তম প্রস্তাব। তাদের লোভ দেখাও। তারা যদি আমাদের সহায়তা করে, তবে আমরা তাদের এমন প্রতিদান দেবো, যা তারা কল্পনাও করতে পারবে না।’

সেদিনই রাতের ঘটনা। মদিনার উপকণ্ঠে বাস করত ইহুদিদের এক সম্প্রদায় বনু কুরায়জা। সেই সম্প্রদায়ের সরদার ছিল কাব বিন আসাদ। রাতে তিনি ঘুমিয়েছিলেন। গভীর রাতে শুনতে পেলেন, বাইরের ফটকের কড়া নাড়ছে কেউ। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ তিনি সেই কড়া নাড়া শুনলেন। শেষে অধৈর্য হয়ে চাকরকে বললেন—’দেখ তো, এত রাতে কড়া নাড়ছে কে?’

চাকর ফিরে এসে বলল—’জুহাইয়া বিন আফতাব এসেছে।’

সরদার তার নাম শুনে মনে মনে বলল—’নিশ্চয়ই কোনো কুমতলব নিয়ে এসেছে! নইলে এত রাতে আসার কারণ কী?’ চাকরকে বলল—’কেন এসেছে তোমাকে বলে যেতে বলো। আর যদি আমার সাথেই দেখা করতে চায়, তবে দিনের বেলা আসতে বলো।’

চাকর ফিরে গিয়ে জুহাইয়া বিন আফতাবকে মনিবের অভিপ্রায় জানাল। জুহাইয়া বলল—’ভীষণ জরুরি দরকার না হলে এ মুহূর্তে আমি আসতাম না। তুমি তোমার মনিবকে বলো, আমি এখনই তার সাথে দেখা করতে চাই।’

চাকর মনিবকে এসে সেই কথা জানাল। কাব বিন আসাদ অগত্যা তাকে দেখা করার সুযোগ দিলো। গায়ে কাপড় জড়িয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে বসল সরদার। চাকরকে বলল—’নিয়ে এসো তাকে।

জুহাইয়া বিন আফতাবকে দেখেই কাব বিন আসাদ বলল—’আমি জানি তুমি কেন এসেছ। তুমি আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব নিয়ে এসেছ। তাকে বলো, আমরা মুসলমানদের সাথে সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ। তারা আমাদের বিশ্বাস করে এবং সম্মান করে, আমরাও তাদের বিশ্বাস ও সম্মান করি। আমি বিশ্বাসঘাতক নই। মুসলমানদের সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’

জুহাইয়া বিন আফতাব বলল-’আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনি জানেন, কুরাইশরা মদিনা অবরোধ করে বসে আছে। আবু সুফিয়ান আপনার বন্ধুত্ব কামনা করছে। তিনি এর উপযুক্ত প্রতিদান দেওয়ারও অঙ্গীকার করেছে।’

বনু কুরায়জার সরদার বলল—’কিন্তু তুমি জানো মুসলমানদের সাথে আমাদের শান্তিচুক্তি আছে। আমরা আক্রান্ত হলে তারা আমাদের সহায়তা করবে, আর তারা আক্রান্ত হলে আমরা তাদের সহায়তা করব। চুক্তি ভঙ্গ করলে মুসলমানরা আমাদের সাথে সেই ব্যবহার করবে, যা করেছিল বনু কাইনুকা ও বনু নাজির গোত্রের সাথে।

হাইয়া বিন আফতাব বলল—’সে জন্যই তো বলছি। বনি কাইনুকা ও বনি নাজির গোত্র চুক্তি করার পরও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল বলে মুসলমানরা তাদের জন্মভিটা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রে জড়িত যুবকদের। আরবের সীমানার বাইরে গিয়ে তারা এখন সিরিয়ায় বসবাস করছে। এখন বাকি আছ তোমরা। কোনো একদিন ষড়যন্ত্র ভঙ্গের অজুহাত তুলে তোমাদেরও এখান থেকে বহিষ্কার করবে না এর নিশ্চয়তা কোথায়? তুমি জানো মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র হাজার তিনেক। আর কুরাইশরা আবু সুফিয়ানের মতো সেনাপতির নেতৃত্বে দশ হাজারের অধিক প্রশিক্ষিত সৈন্য নিয়ে এখানে এসেছে মুসলমানদের শায়েস্তা করতে। একটা শিশুও বলবে, এ যুদ্ধে কুরাইশদের জয় সুনিশ্চিত। তারা জয়ী হলে তোমরা মুসলমানদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে চিরতরে নিস্তার পেয়ে যাবে। এমন সুযোগ কেন হারাবে তোমরা? এ যুদ্ধে তোমরা সামান্য সহযোগিতা করলে বলতে পারবে—যুদ্ধে তোমরাই জয়ী হয়েছ। আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব তোমাদের জন্য এক মহা সুযোগ। কাব, এখনও সময় আছে সাবধান হও। এটা তোমার একার বিষয় নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে একটা সম্প্রদায়ের বাঁচা-মরার প্রশ্ন।’ জুহাইয়া বিন আফতাব আশায় বুক বেঁধে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

বনু কুরায়জার সরদার বলল—’যুদ্ধে জয় এত সহজ হলে আবু সুফিয়ান আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে কেন? না জুহাইয়া, মুসলমানদের সাথে বিজয় এত সহজ নয়। তোমরা পরাজিত হলে মুসলমানরা আমাদের সাথে কী ব্যবহার করবে তা তোমার অজানা নয়। তোমরা জেনেশুনে আমাকে এক মহা বিপদে ফেলতে চাচ্ছ। জুহাইয়া, আমি তোমার প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারছি না। আমি এতদূর করতে পারি, টালবাহানা করে মুসলমানদের সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকতে পারি।’

জুহাইয়া বিন আফতাব বলল—’তাতে এটাই প্রমাণিত হবে, তুমি মুসলমানদের সাথে চুক্তির শর্ত রক্ষা করোনি। সেক্ষেত্রে মুসলমানরা তোমাদের সাথে সেই ব্যবহারই করবে, যা করেছিল বনু কাইনুকা ও বনু নাজির গোত্রের সাথে। না, এমনটা করা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তুমি যদি আবু সুফিয়ানের সহযোগিতা না করো, তবে মুসলমানদেরই সহযোগিতা করো। যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই। হয় তুমি আবু সুফিয়ানকে সহযোগিতা করে তার বন্ধুত্ব ও উপহার লাভ করো, আর নাহয় মুসলমানদের সাহায্য করে ভবিষ্যতের জন্য বিপদ বাড়িয়ে তোলো। কোনটা করবে, ভালো করে চিন্তা করে দেখ।’

জুহাইয়া বিন আফতাব এভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বনু কুরায়জার সরদার কাব বিন আসাদকে প্ররোচিত করতে থাকে। তাকে বলে—’তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই কুরাইশরা পরাজিত হয়েছে, তাহলে তারা যখন দেশে ফিরবে, তোমরাও তাদের সাথে যাবে। বন্ধুত্বের বিনিময়ে সেখানে পাবে নতুন করে বসতি গড়ার সুযোগ। ‘

একসময় সফল হয় জুহাইয়া বিন আফতাবের চাল। আবু সুফিয়ানকে সহযোগিতার ওয়াদা নিয়ে তবে বিদায় হয় সে। কাব বিন আসাদ বলে—’জুহাইয়া, আমার সৈন্যদের প্রস্তুত করার জন্য আমাকে কিছুটা সময় দাও। আমি তোমাকে জানাব—কবে আমরা ময়দানে নামতে পারব।’

জুহাইয়া বিন আফতাব বলল—’এ নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না। তুমি মুসলমানদের সহযোগিতা করার জন্যই মদিনা যাবে। পরে যুদ্ধের কৌশল নিয়ে তাদের সাথে মত-বিরোধের সৃষ্টি করে গোলযোগ পাকিয়ে তুলবে। মুসলমানদের মনোযোগ যখন তোমাদের দিকে, সেই সুযোগে মক্কার বাহিনী মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তুমি তোমার বাহিনীকে বেশি ঝুঁকিতে না ফেলে সেখান থেকে সরে আসবে। আর হ্যাঁ, তুমি মদিনায় প্রবেশ করবে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। পাহাড়ের আড়ালে কুরাইশদের একটা অংশ ওত পেতে বসে আছে। তারা চেষ্টা করবে তোমার বাহিনীর সাথে মিশে মদিনায় প্রবেশ করতে। একবার মদিনায় ঢুকতে পারলে এরপর কী করতে হবে—সেটা ওরাই বুঝবে, ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।’

জুহাইয়া বিন আফতাবের চতুরতার কাছে হার মানল বনু কুরায়জার সরদার। তার সম্মতি নিয়ে রাতের আঁধারেই আবার বেরিয়ে এলো জুহাইয়া বিনতে আফতাব।

খালিদ বিন ওয়ালিদ উহুদের প্রান্তর পার হচ্ছে, স্মৃতিতে ভাসছে খন্দকের যুদ্ধ। কত ঘটনা-ই না ঘটেছে সেদিন! তাঁর মনে পড়ে গেল সাদ বিনতে আতিকের কথা।

সাদ বিন আতিক মদিনার এক সাধারণ যুবক। পেশায় একজন কামার। সারাদিন ছুরি আর তলোয়ার ধার দেয়। পরিশ্রমী বলেই শরীরে মেদ নেই, সুঠাম দেহ। বিস্ময়কর হচ্ছে তার কণ্ঠের জাদু। এমন সুমিষ্ট গলা, যার জুড়ি মেলা ভার! যখন কাজ করে, তখনও গুনগুন করে গান গায় আর রাতে বিভিন্ন আসরে গান গেয়ে মাত করে দেয়। তার গান শুনলে পথিক গন্তব্যের কথা ভুলে দাঁড়িয়ে যায় গান শুনতে। সেই সুর শ্রোতার অন্তরে প্রজাপতি হয়ে উড়তে থাকে। একদিন রাতে লোকালয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে নির্জন মাঠে বসে গানে টান দিলো সাদ। তন্ময় হয়ে গান গাইছে সে। চোখের পাতা নিমীলিত। হঠাৎ তার মনে হলো, তার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পাতা খুলে দেখল, এক অনিন্দ্যসুন্দর যুবতি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মনে হলো এ কোনো মানুষ নয়; জিন বা পরি হবে। ভয়ে গা কাঁটা দিলো তার। সে চুপ হয়ে গেল। যুবতি বলল—’থামলে কেন, গাও।’

সাদ বলল—’আমার ওপর দয়া করো। তুমি জিন বা পরি হলে এখান থেকে চলে যাও।’

অনুচ্চৈঃস্বরে হাসল মেয়েটি। বলল—’তুমি ভয় পাচ্ছ? আমি জিনও না, পরিও না; সামান্য এক নারী। ইহুদি গোত্র বনু কুরায়জার আদ বিন আরমানের কন্যা। তোমার সুর আমাকে ঘরছাড়া করেছে। সুরের টানে পাগল হয়ে এখানে ছুটে এসেছি আমি। আমাকে দেখে নীরব হয়ে গেলে কেন, গাও।’

সাদ চাঁদনী রাতে এমন নীরব-নির্জন প্রান্তরে মেয়েটিকে দেখে সত্যি ভয় পেয়েছিল। মেয়েটি বলার পরও কোনো গান এলো না তার কণ্ঠে। সে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বলল—’ঠিক আছে, আমি সামনে থাকলে যদি তুমি গাইতে না পারো, তবে আমি সরে যাচ্ছি তোমার দৃষ্টির আড়ালে, তবু তুমি গাও। তোমার সুরকে তুমি খুন করো না। তোমার সুরে যে মোহন জাদু আছে, তা থেকে বঞ্চিত করো না আমাকে।’

এতক্ষণে সাদের কণ্ঠে কথা ফুটল। বলল—’সত্যি করে বলো তো তুমি কে? তোমার এ অনিন্দ্য রূপ বলছে তুমি কোনো মানবী নও। তবে তুমি কে?

‘বলেছি তো, আমি বনু কুরায়জার আদ বিন আরমানের কন্যা। বিশ্বাস না করলে দিনের বেলা খোঁজ নিয়ে দেখ।

সাদ বলল—’তোমার কথা সত্যি হলে শোনো, তোমার মতো আমিও এক ইহুদির সন্তান ছিলাম। এখন অবশ্য আর ইহুদি নেই, মুসলমান হয়ে গেছি।’

ইহুদি মেয়েটি বলল—’এর মাঝে ধর্মকে টেনো না তো। গানের কোনো ধর্ম নেই। আমি তোমার গানের সুরে পাগল হয়ে এখানে ছুটে এসেছি; ধর্মের জন্য নয়।’

সাদ বিন আতিক মেয়েটির মুগ্ধ চোখের দিকে তাকাল। গভীর কালো সেই চোখে অথই মায়া। সাদের মন সেই মায়ার জালে জড়িয়ে গেল। সাদ রাত হলেই সে নির্জন প্রান্তরে চলে যায় আর গান গায়। গান শুরু হতেই মেয়েটি এসে বসে তার পাশে। কোনোদিন গান শুরুর আগেও চলে আসে। একদিন ইহুদি কন্যা সাদ বিন আতিককে বলল—’সাদ, আমার কিছু ভালো লাগে না। সারাদিন কেবল তোমার কথাই মনে হয়। তুমি আমাকে গ্রহণ করো সাদ, আমি তোমার কাছে চলে আসি।’

গান থামিয়ে সাদ বলল—’অবশ্যই তোমাকে আমি গ্রহণ করব, তবে কটা দিন

অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে। যুদ্ধের কারণে কাজের চাপ খুব বেড়ে গেছে। এত তলোয়ার জমা পড়ছে যে, সারাদিন ধার দিয়েও শেষ করতে পারি না। যুদ্ধটা শেষ হোক, এরপর তোমাকে আর অপেক্ষা করতে বলব না।

সেদিন সাদের আগেই মেয়েটি ওই মাঠে হাজির হয়ে অন্ধকারে বসেছিল। সাদ মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে বলল—’তুমি চলে এসেছ? বসো, আজ তোমাকে নতুন গান শোনাব। ‘

মেয়েটি বলল—’গান পরে হবে, আগে আমার কথা শোনো। কাল রাতেই তুমি শহর ছেড়ে পালাবে। কালকে পালাতে না পারলে আর কোনোদিন পালাতে পারবে না।’

‘কেন, কী হয়েছে? তুমি আমাকে পালাতে বলছ কেন?’

মেয়েটি সাদের হাত ধরে বলল—’সাদ!’ আমি এমন এক কথা জেনে ফেলেছি যে, এরপর থেকে সারাক্ষণ আমার বুক ধড়ফড় করছে।’

‘এত ভয় পেয়ো না। কী জেনেছ আমাকে খুলে বলো।’

‘সাদ, আমাদের বাড়িতে আজ কয়েকজন লোক এসেছিল। তারা বৈঠকখানায় বাবার সাথে কথা বলছিল। এদের মধ্যে জুহাইয়া বিন আফতাবও ছিল। তারা বলাবলি করছিল, মদিনার ইহুদিরা শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন করে শহরে গোলযোগ সৃষ্টি করবে। সেই সুযোগে মক্কার কুরাইশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়বে মদিনার ওপর। মক্কার বিশাল বাহিনী মদিনায় একবার হামলা করার সুযোগ পেলে মুসলমানদের আর রক্ষা নেই। আমি চাই এই যুদ্ধে তুমি জড়াবে না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। যেভাবেই হোক তুমি কালকে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাবে। কথা দাও সাদ, আমার কথা রাখবে?’

এ খবর শুনে সাদের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। সে বলল—’তুমি ঠিক জানো, বনু কুরায়জা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করবে?’

‘হ্যাঁ, বনু কুরায়জার সরদার ও জুহাইয়া বিন আফতাবের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। কুরাইশদের মদিনা আক্রমণের সুযোগ করে দেবে বনু কুরায়জা, বিনিময়ে তারা পাবে কুরাইশদের বন্ধুত্ব ও অনেক সম্পদ। দুই-একদিনের মধ্যেই বনু কুরায়জা শহরে গোলযোগ পাকিয়ে তুলে মুসলমানদের দৃষ্টি তাদের দিকে ফিরিয়ে নেবে, আর এই সুযোগে কুরাইশরা হামলা চালাবে মদিনায়।’

সেদিন আর গান হলো না। সাদ বিন আতিক বলল—’চলো তোমাকে এগিয়ে দিই।’

তারা দুজন সেখান থেকে উঠল এবং মেয়েটিকে এগিয়ে দিয়ে সাদও তার বাড়ির পথ ধরল। পথে এক প্রবীণ মুসলমানের সাথে দেখা হলো তার। সে ওই প্রবীণ মুসলমানের পথ আগলে বলল—’আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।’

প্রবীণ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল—’বলো কী বলতে চাও।’

সাদ ইহুদি মেয়েটির কাছ থেকে যা জেনেছিল, সব খুলে বলল। প্রবীণ বললেন— ‘এ কথা আমাকে বলে তুমি খুবই ভালো কাজ করেছ। তুমি ঘরে যাও, আমি এ খবর নবিজিকে বলে আসি।’

সাদ বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। প্রবীণ ব্যক্তি উলটো দিকে ফিরে নবিজির আস্তানার দিকে চললেন। নবিজির কাছে গিয়ে বললেন—’ইয়া রাসূলাল্লাহ! বনু কাইনুকা ও বনু নাজির গোত্রের মতো বনু কুরায়জা-ও শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারা কাফিরদের সাথে গোপন চুক্তি করেছে। অচিরেই শহরে গোলযোগ পাকানোর চেষ্টা করবে তারা।‘

মহানবি (সাঃ) মন দিয়ে এই প্রবীণের কথা শুনলেন, কিন্তু কিছু না বলেই তাকে বিদায় দিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অভিযোগ সত্য না মিথ্যা যাচাই করতে চাইলেন তিনি। তিনি দুজন সাহাবিকে দায়িত্ব দিলেন এর সত্যতা যাচাই করার জন্য। অবশেষে তিনি জানতে পারলেন, বনু কুরায়জা সত্যি সত্যি গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। জুহাইয়া বিন আফতাবের মধ্যস্থতায় কুরাইশ ও বনু কুরায়জার মধ্যে নতুন চুক্তি হয়েছে।

বনু কুরায়জার বিরুদ্ধে তিনি তখনও কোনো পদক্ষেপ নেননি, এ সময় ঘটল আরেক ঘটনা। ঘটনাটা এ রকম—মদিনার শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের কেল্লার ভেতর সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। রাসূল (সাঃ)-এর  ফুফু সুফিয়া আরও কয়েকজন মহিলার সাথে শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। সেদিন তিনি বাইরের অবস্থা দেখার জন্য কেল্লার প্রাচীরের ওপর উঠলেন। তিনি দেখতে পেলেন, প্রাচীর ঘেঁষে এক লোক খুব সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে কেল্লার প্রাচীর পরীক্ষা করছে। লোকটির চলাফেরা কেমন যেন সন্দেহজনক। তিনি লোকটির গতিবিধি লক্ষ করতে লাগলেন। একসময় সুফিয়া নিশ্চিত হলেন, এ লোক শত্রুপক্ষের। কেল্লায় প্রবেশের জন্য প্রাচীরের দুর্বল জায়গা খুঁজছে সে।

লোকটির হাতে বর্শা, কোমরে তলোয়ার। লোকটি যদি মুসলমান বা মুসলমানদের বন্ধু হতো, তবে কেল্লায় প্রবেশের জন্য সরাসরি কেল্লার ফটকে চলে যেত। সুফিয়া-এর আরও সন্দেহ হলো, এখন সবাই খন্দকের পাহারায় আছে, নয়তো মুজাহিদদের বিশ্রামস্থলে আছে। এ সময় একজন পুরুষ একাকী এখানে কী করছে? কেন বারবার থেমে কেল্লার প্রাচীর পরীক্ষা করছে। সুফিয়া যখন এসব ভাবছেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন-কবি হাসসান বিন সাবিত-কে। তিনি কেল্লার ভেতরে ছিলেন। সুফিয়া মনে করলেন, হাসসান বিন সাবিত কেল্লা রক্ষীদের কেউ। তাই তিনি তাঁকে ডাকলেন। বললেন—’এক লোক কেল্লার বাইরে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছে। তুমি এগিয়ে দেখ তো সে কী করছে এবং এখানে কেন? যদি দেখ সে ইহুদি, তবে তাকে হত্যা করবে। কারণ, ইহুদি বনু কুরায়জা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং দুশমনকে শহরে প্রবেশের পথ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।’

কবি হাসসান বিন সাবিত ভেতরের সিঁড়ি বেয়ে কেল্লার প্রাচীরে চড়লেন এবং লোকটিকে দেখতে পেলেন। দেখলেন, লোকটির হাতে বর্শা আর কোমরে তলোয়ার। তিনি সুফিয়া-এর দিকে তাকিয়ে বললেন—’তুমি জানো আমি একজন কবি। রাসূল (সাঃ) আমাকে যুদ্ধের কবিতা লেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। একজন নিরস্ত্র কবি অস্ত্রধারী এক লোকের মোকাবিলা করবে, তুমি এটা কী করে আশা করো?’ হাসসান সুফিয়া-এর-এর কথার গুরুত্ব না দিয়ে চলে গেলেন

কবি হাসসান-এর কথা শুনে সুফিয়া এমনভাবে তাঁর দিকে তাকালেন, যেন পারলে সে দৃষ্টি দিয়ে তাঁকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে। তিনি হাসসান-এর কথায় রাগান্বিত হয়ে নিজেই একটি লাঠি নিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সুফিয়া-এর সন্দেহ হলো এ লোক ইহুদি। ইহুদি বনু কুরায়জা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করেছে—এ কথা তখন অনেক মুজাহিদই জেনে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে সুফিয়া ছিলেন। তিনি ভাবলেন এ লোক ইহুদি বনু কুরায়জার কেউ নয়তো? তিনি লোকটির কাছে গিয়ে ধমকের সুরে বললেন—’তুমি কে? এখানে কী করছ?’

লোকটি পেছন ফিরে তাকাতেই সুফিয়া তাকে চিনতে পারলেন। বললেন— ‘আরে! তুমি বনু কুরায়জার লোক না? তোমার ওপর আল্লাহর গজব পড়ুক।’

লোকটি হঠাৎ সুফিয়া-এর কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। সুফিয়াকে দেখে বলল—’ওহ, তুমি? তুমি মুহাম্মাদের ফুফু না? তুমি এখানে কী করছ? হ্যাঁ, আমি বনু কুরায়জার সন্তান। এত জায়গা থাকতে তুমি আমার হাতে মরতে এলে কেন? এখনও সময় আছে, কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে চলে যাও

‘মরতে আমি আসিনি, তুই মরতে এলি কেন? খোদার কসম! তোকে আর জীবিত ফিরে যেতে দেবো না।’ এই বলে সুফিয়া লাঠি হাতে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেলেন। লোকটি সুফিয়া-এর মারমুখী অবস্থা দেখে আর অপেক্ষা করল না। হাতের বল্লমটি সুফিয়া-কে তাক করে ছুড়ে মারল। সুফিয়া চকিতে একপাশে সরে গেলেন এবং বল্লম দেয়ালে গিয়ে বিদ্ধ হলো। ইহুদি লোকটি তলোয়ারের বাটে হাত রাখল, কিন্তু তার আগেই সুফিয়া পূর্ণ শক্তিতে লাঠি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করলেন। লোকটির মাথা চক্কর দিলো, চোখ অন্ধকার হয়ে এলো, শিথিল হাত সরে গেল তলোয়ারের বাট থেকে। সুফিয়া এই সুযোগে তার মাথায়, ঘাড়ে আরও কয়েকটা বাড়ি বসিয়ে দিলেন। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল সশস্ত্র ইহুদি। সুফিয়া সেখানে দাঁড়িয়ে লোকটির ছটফটানি দেখলেন, নিথর না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।

লোকটি মারা গেলে সুফিয়া আবার প্রাচীরে উঠে এলেন। দেখলেন প্রাচীরের ভেতর হাসসান বিন সাবিত তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাঁকে ডাকলেন। কবি হাসসান বিন সাবিত আবারও উঠে এলেন প্রাচীরে। সুফিয়া বললেন—’হাসসান, আল্লাহর শোকর আদায় করো। আমি যে কাজ করে এসেছি, এ কাজ তোমার করা উচিত ছিল। তাকিয়ে দেখ, বনু কুরায়জার বিশ্বাসঘাতক এক ইহুদি প্রাচীরের পাশে মরে পড়ে আছে। যাও, তার অস্ত্র নিয়ে যাও তুমি। তার দেহ তল্লাশি করে দেখ, যদি মালে গনিমত কিছু পেয়ে যাও, তা-ও নিয়ে নিয়ো। মালে গনিমতের কোনো প্রয়োজন নেই আমার। ইসলামে মহিলাদের পরপুরুষের দেহ স্পর্শ করা নিষেধ। তাই নারী হয়ে অন্য এক পুরুষের দেহ তল্লাশি করতে চাই না আমি। সেজন্যই তোমাকে আবার ডেকেছি। যাও, মালে গনিমত নিয়ে লোকটির লাশের সৎকার করো, এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও লাশ।

হাসসান অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন লাশের দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে তিনি বললেন—’লোকটাকে আপনি সত্যি মেরে ফেলেছেন! একজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে এক নিরীহ ও নিরস্ত্র নারী কী করে কুপোকাত করতে পারে!’

‘পারে, যখন তার সাথে আল্লাহর মদদ থাকে। শোনোনি, আবরাহার হস্তীবাহিনীকে আল্লাহ নিকেশ করেছিলেন আবাবিল পাখি দিয়ে। আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব। শর্ত হলো, মুমিন হৃদয় আল্লাহ নির্ভরতায় পরিপূর্ণ থাকা চাই। যাও, কথা না বাড়িয়ে লাশটা সরাও।’

এদিকে যুদ্ধের অবস্থা তখন বড়োই নাজুক ও সংকটপূর্ণ। অনন্তকাল বসে থাকার মতো খাদ্য সামান নিয়ে কেউ ময়দানে আসে না। মাসের প্রায় অর্ধেক হয়ে গেল খালিদরা মদিনা অবরোধ করে বসে আছে। তাদের খাবার ও পানি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। অথচ মদিনা আক্রমণের মতো কোনো পথই পাচ্ছে না কুরাইশরা। সীমাহীন অস্থিরতা ও উদ্‌বেগ খালিদ-কে কুরে কুরে খাচ্ছে। খালিদ একজন জাত সৈনিক। যুদ্ধে এসে লড়াই না করে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা তাঁর জন্য যেমন কষ্টকর, তার চেয়েও কষ্টকর বিজয় অর্জন না করে ফিরে যাওয়া।

খালিদ সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। সকাল হলেই সে ঘোড়া নিয়ে খন্দকের এক প্রান্ত থেকে ছুটে যেত অপর প্রান্তে, কিন্তু মদিনায় প্রবেশের সুবিধাজনক কোনো জায়গাই তাঁর নজরে পড়ত না। ওপারে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা যদিও কম, কিন্তু খন্দক পেরিয়ে ওপার গেলে মুসলিম সৈন্যদের তিরের নিশানা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। না খন্দকে সাঁকো বানিয়ে পার হওয়ার উপায় আছে, না খন্দকে নেমে কেউ ওপারে উঠতে পারবে। রাতের আঁধারে খন্দক পার হওয়া যায় কি না সে চেষ্টা করেও দেখেছে। রাতে মুসলমান পাহারাদারদের সংখ্যা দিনের দুই-তিনগুণ হয়ে যায়। আর সৈন্যরা এমন দূরত্বে মশাল জ্বালিয়ে রাখে যে, মুসলিম সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে কারও পক্ষেই মদিনায় প্রবেশ করা অসম্ভব ব্যাপার। একরাশ হতাশা নিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ তাঁর সৈন্যদের মাঝে ফিরে আসে।

অন্যদিকে মহানবি (সাঃ)র পেরেশানিরও কোনো কমতি ছিল না। তাঁর সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তা ছিল খাদ্যসংকট নিয়ে। কুরাইশরা যদি এভাবে অবরোধ অব্যাহত রাখে, তবে একদিন মদিনাবাসীকে না খেয়েই মরতে হবে। অবশ্য এই ভেবে তিনি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলেন যে, মুসলমানদের চেয়ে কাফিরদের খাদ্যঘাটতিও কম হওয়ার কথা নয়। তারা এত অধিক খাদ্য নিয়ে যুদ্ধে আসেনি যে মাসের পর মাস এভাবে অবরোধ চালিয়ে যাবে। মহানবি (সাঃ)র এই দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিলো বনু কুরায়জার ষড়যন্ত্র। তিনি খবর পেলেন, বনু কুরায়জার লোকজন মুসলমানদের সাথে শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে গোপনে কুরাইশদের সাথে হাত মিলিয়েছে। যেকোনো সময় তারা শহরে গোলযোগ পাকিয়ে তুলতে পারে।

যুদ্ধ হচ্ছে একধরনের কৌশলের খেলা। শক্তির চাইতেও কৌশল যুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করে। যাদের কৌশল যুদ্ধে অধিক কার্যকর হয়, শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয় লাভ করে। মহানবি (সাঃ) ভাবছিলেন বনু কুরায়জার ষড়যন্ত্র নিয়ে। বনু কুরায়জাকে শায়েস্তা করার চাইতে কুরাইশদের চালের জবাব দেওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি গোপনে খবর নিয়ে জানতে পারলেন, কুরাইশদের সাথে বনু গাতফান গোত্র প্রায় দুই হাজার সৈন্য নিয়ে শামিল হয়েছে। বনু গাতফান গোত্রের সৈন্যরা আরবে বীর ও লড়াকু বলে পরিচিত। মহানবি (সাঃ) গোপনে গাতফান গোত্রের সেনাপতি আয়নালের কাছে দূত পাঠালেন। আয়নাল যুদ্ধ করতে এসে যুদ্ধবিহীন বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত। তার সে বিরক্তি একসময় হতাশায় রূপ নেয়। তার হতাশার বড়ো কারণ, সৈন্যদের খাবারের মজুদ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। সে যখন অবরোধ তুলে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করছিল, সে সময় মহানবি (সাঃ)র দূত গিয়ে গোপনে দেখা করল তার সাথে। বলল—’আমরা খবর পেয়েছি, আপনার সৈন্যদের মাঝে ক্রমেই অসন্তোষ বাড়ছে। আপনাদের খাবারেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মহানবি (সাঃ) ময়দানের সব খবরই নিয়মিত রাখছেন। এ যাত্রা মদিনায় প্রবেশের কোনো সুযোগ আপনারা পাবেন না। আপনাদের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। কুরাইশদের শত্রুতার বোঝা আপনারা কেন নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন? কুরাইশদের রসদ ফুরিয়ে গেলে তারা যখন বাড়ি ফেরার কথা ভাববে, তখন মুসলিম বাহিনীর একটা অংশ পেছন থেকে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করলে এই হামলার শিকার হবেন আপনারাও। আপনারা যদি আগেই ময়দান থেকে সরে যান, তবে আপনাদের পিছু ধাওয়া করা হবে না। আপনারা আগ্রহী হলে মহানবি (সাঃ) আপনাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না।’

‘কিন্তু আমাদের পথখরচ? আবু সুফিয়ান বলেছে, যুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে এ বাবদ যত খরচ হবে সব কুরাইশরা বহন করবে, কিন্তু আমরা আগে চলে গেলে কুরাইশরা তা বহন করতে অস্বীকার করে বসতে পারে। জানি যুদ্ধ হবে না এবং আমাদের একজন সৈন্যকেও জীবন দিতে হবে না, তাহলে আমরা শুধু শুধু এই ঝুঁকি নিতে যাব কেন?’

হাসলেন মুসলিম দূত। বললেন—’এ ব্যাপারে মহানবি (সাঃ)র সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন—আপনারা যদি তাঁর প্রস্তাব মেনে নেন, তবে এ বছর মদিনায় যত খেজুর উৎপন্ন হবে, তার তিন ভাগের এক ভাগ আপনারা পাবেন। ফসল তোলার আগেই আপনারা এখানে চলে আসবেন এবং নিজেদের অংশ নিজেরা বুঝে নেবেন। ‘

গাতফান গোত্রের কাছে মহানবি (সাঃ)র দূত পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল—যদি তাদের ফিরে যেতে রাজি করানো যায়, তবে কুরাইশদের দল থেকে দুই হাজার সৈন্য কমে যাবে। তার চেয়েও বড়ো লাভ যেটি হবে তা হলো, কুরাইশ ছাড়া অন্যান্য যেসব গোত্র এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মনোবল ভেঙে যাবে এবং তারাও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবে বা যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে যাবে। যুদ্ধের ময়দান থেকে মন উঠে গেলে সেই সৈন্য আর যুদ্ধ করতে পারে না। সংখ্যায় যত বেশিই থাকুক না কেন, পরাজয়ই হয় তাদের কপালের লিখন

দূতের উদ্দেশ্য সফল হলো। বনু গাতফান গোত্র ময়দান ছেড়ে চলে যাবে—এই ওয়াদা নিয়ে দূত ফিরে এলো মহানবি (সাঃ)র দরবারে।

এটা ছিল বনু কুরায়জার ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ। এই এক চালেই যুদ্ধ একটি ফয়সালার দিকে এগিয়ে গেল। বনু গাতফানের সরদার আবু সুফিয়ানকে বলল—’আবু সুফিয়ান! আমাদের খোরাকি শেষ হয়ে আসছে। যেটুকু খোরাকি আছে, তা আমাদের ফিরে যাওয়ার চলার পথেই লাগবে। এখানে শুধু শুধু বসে থাকার কোনো মানে হয় না। এটি এক নিষ্ফল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলমানদের নিকেশ করার আশা দূরাশাই থেকে যাবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা চলে যাব। তুমি আমাদের যুদ্ধের খরচ মিটিয়ে দাও।’

‘কী বলছ আয়নাল!’ বিস্মিত কণ্ঠে আবু সুফিয়ান বলল—’পরাজয়ের তিলক নিয়ে তুমি ফিরে যেতে চাও?’

‘কীসের পরাজয়? যেখানে যুদ্ধই হয়নি, সেখানে পরাজয়ের প্রশ্ন উঠে কী করে?’

‘যে জন্য এসেছ তা সমাধা না করে ফিরে যাওয়া কি পরাজয় নয়?’ আবু সুফিয়ান তাকে উত্তেজিত করতে চাইল।

আয়নাল বলল—’এখন মুসলমানদের ধ্বংস করা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। এতদিন হয়ে গেল আমরা কোনো হামলাই করতে পারলাম না। এখন সৈন্যদের মনে হতাশা ছেয়ে বসেছে। খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কায় কমে এসেছে তাদের বাহুর শক্তি। দেখছ না, সৈন্যদের তির আর আগের মতো দূরে যায় না। এখানে বসে থাকলে না খেয়েই মরতে হবে আমাদের। আমি আমার সৈন্যদের না খাইয়ে মারতে চাই না। অবরোধ উঠিয়ে সময় থাকতে চলো সবাই চলে যাই; আর নাহয় তুমি বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গোনো, আমি যাই।’

কুরাইশদের সম্মিলিত বাহিনীর মাঝে এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল যে, গাতফানরা ময়দান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সাথে সাথে অন্যান্য গোত্রপ্রধানরাও উপলব্ধি করল—আয়নালের সিদ্ধান্তই সঠিক। এ অবরোধ অর্থহীন। তাদেরও উচিত এক্ষুনি ময়দান ছেড়ে দেওয়া।

গাতফানরা ময়দান ছেড়ে চলে যেতে চায়—এটা ছিল আবু সুফিয়ানের জন্য বড়োই পেরেশানি ও মর্মপীড়ার কারণ। কিন্তু ঘটনা এখানেই থামল না। বিভিন্ন গোত্রের সেনাপতিরাও আবু সুফিয়ানের সাথে দেখা করে একই রকম আবেদন জানাতে থাকল। আবু সুফিয়ান অভিজ্ঞ সেনাপতি। বাস্তব অবস্থা তাকে বলছিল, এইসব সেনাপতিদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে অবিলম্বে অবরোধ উঠিয়ে নাও। আর তার প্রাণের আকুতি তাকে বলছিল, মক্কায় ফিরে আপন নারীদের কাছে কী জবাব দেবে আবু সুফিয়ান? এত প্রস্তুতি, এত অস্ত্ৰ, এত সেনা মোতায়েন করে কী নিয়ে তুমি মক্কায় ফিরবে?

উহুদ পাহাড়ের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে খালিদ। তাঁর ঘোড়া উহুদ পাহাড় অতিক্রম করলেও তাঁর মন পড়ে ছিল খন্দকের ময়দানে। যুদ্ধে কখন কী ঘটবে আগে থেকে কিছু বলা যায় না। একজন অভিজ্ঞ সেনানায়ক হিসেবে সেও জানে, যুদ্ধ হচ্ছে কৌশলের খেলা। মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কুশলী চালের মোকাবিলায় আরও দূরদর্শী ও কুশলী চাল দেওয়া ছাড়া বিজয়ের স্বপ্ন দেখা অবান্তর। একটা কুশলী চাল তারাও দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কোনো কাজে আসেনি। যুদ্ধে ছোটো ছোটো ঘটনাই যে অনেক বড়ো হয়ে দেখা দেয়-তা খালিদ প্রত্যক্ষ করেছে খন্দকের যুদ্ধে। গাতফান গোত্র যে মহানবি (সাঃ)র সাথে নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, তা আর গোপন থাকেনি। গোয়েন্দা মারফত এ খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান বিচলিত হলেও খালিদের মনে নতুন চিন্তার উদয় হয়েছিল। সে গোয়েন্দা মারফত এ খবর মদিনার ইহুদিদের জানিয়ে বলল—’তোমরা মদিনাবাসীকে উত্তেজিত করে তোলো। এখানে কোনো যুদ্ধই হয়নি, অথচ মুহাম্মাদ (সাঃ) তোমাদের এবং মদিনাবাসীর ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ গাতফান গোত্রকে দেওয়ার ওয়াদা করেছে। এটা তোমাদের পেটে লাথি মারার শামিল। এভাবে সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাও তোমরা। মদিনাবাসীকেও জানাও কী ঘটতে যাচ্ছে। এ নিয়ে মদিনায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলো।’

খালিদের এ পরিকল্পনা কাজে লাগল। মদিনার ইহুদি এবং সাধারণ জনগণ এতে উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা বলল—’এখানে কোনো যুদ্ধ হয়নি যে যুদ্ধ ফান্ডে আমাদের শস্যের এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে দিতে হবে। আমরা এ সিদ্ধান্ত মানি না।’ মানুষ মাত্রই স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন। নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগায় এ খবরে মদিনার জনগণ বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তারা বলল- ‘গাতফানকে আমরা আমাদের শস্যের একটি দানাও দেবো না।’

মহানবি (সাঃ) এতে বিচলিত হলেন। সারা শহরেই এ নিয়ে কানাঘুষা চলতে লাগল। অবস্থা জটিল আকার ধারণ করলে এক সাহাবি জটলারত লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলল—’তোমাদের এ আলোচনা শুনে অবাক হচ্ছি আমি। তোমরা কি জানো না, মহানবি (সাঃ) এ যুদ্ধের সেনাপতি এবং মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান? এ বিশাল কাফির বাহিনীর হাত থেকে মদিনাকে রক্ষা করার জন্য তিনি এমন চুক্তি করতেই পারেন। খোদার কসম! যুদ্ধের ফয়সালার ব্যাপারে নবির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলা কোনো মুজাহিদ বরদাশত করতে পারে না। কেউ এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাকে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। আমি সবাইকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছি।’

তার এ বক্তব্যের পর পথে-ঘাটে এ নিয়ে আলোচনা বন্ধ হলেও ঘরের চারদেয়ালের ভেতর এ আলোচনা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করল। গোয়েন্দা মারফত সব খবরই পাচ্ছিলেন মহানবি (সাঃ)। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি। যখন মদিনাবাসীর ঐক্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তখন এ ধরনের আলোচনা নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। অবস্থা জটিল আকার ধারণ করলে তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। বললেন—’হে আল্লাহ! তুমি তোমার বান্দাদের গায়েবি মদদ দিয়ে হেফাজত করো। আমাদের ওপর তোমার রহম নাজিল করো।’

মহানবি (সাঃ)র এ প্রার্থনা যে বিফল যায়নি, তার সাক্ষী তো স্বয়ং খালিদ বিন ওয়ালিদ ৯। আজও তাঁর মনে পড়ছে নইমের কথা। নইম বিন মাসউদ। গাতফান গোত্রের এক চৌকশ যুবক। বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে সে ছিল সবার পরিচিত। যুদ্ধের সময় তিনটি গোত্রের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করা ছিল তাঁর অন্যতম গুরুদায়িত্ব। এ তিনটি গোত্র হচ্ছে কুরাইশ, গাতফান ও বনু কুরায়জা। গাতফান গোয়েন্দা বাহিনীর সে ছিল অন্যতম সদস্য।

যুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন আগের কথা। কুরাইশদের পয়গাম নিয়ে তাকে আসতে হয়েছিল বনু কুরায়জার কাছে। সে সময় মদিনার একদল মুসলমানের সাথে তাঁর কথা হয়। তারা নইমকে ইসলামের দাওয়াত দেয়। নইম গোপনে তাদের সামনে ইসলাম কবুল করে। তাঁর পরিচয় পেয়ে মুসলমানরা তাকে বলে, ‘এক্ষুনি তোমার মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করার দরকার নেই। এখন যে দায়িত্ব পালন করছ, করে যাও। যুদ্ধের ময়দানে একজন গোয়েন্দা হাজার যোদ্ধার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সময়ই বলে দেবে, কখন নিজেকে প্রকাশ করবে।

নইম বিন মাসউদ মদিনার অসন্তোষের খবরে বিচলিত হয়ে পড়ল। যুদ্ধের ময়দানে তাঁর কাজ ছিল ঘুরেফিরে খবর সংগ্রহ করা এবং তা সেনাপতি আবু সুফিয়ানকে জানানো। মদিনার অসন্তোষের খবর পেয়ে সে পাহাড়ের উলটোদিকে চলে গেল এবং রাতের আঁধারে পাহাড় অতিক্রম করে মদিনায় প্রবেশ করল। সে তাঁর পরিচিত এক মুসলমানের বাড়িতে গিয়ে উঠল এবং বলল—’আমাকে মহানবি (সাঃ)র কাছে নিয়ে চলো।’

রাতেই তাকে নিয়ে আসা হলো মহানবি (সাঃ)র দরবারে। মহানবি (সাঃ) তাঁকে দেখেই বললেন—’তুমি? তুমি তো আমাদের দলের কেউ নও, তাহলে আমার সাথে দেখা করতে চাও কেন?’

‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! কিছুদিন আগে আমি গোপনে মুসলমান হয়েছি। এরা জানে সে খবর। তারাই আমাকে এ কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন।’ এরপর সে তাঁর পরিচয় দিয়ে বলল—’মদিনায় যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তা দূর করার ব্যাপারে আমি সামান্য চেষ্টা করতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে আমি আমার মতো করে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে অনুমতি নেওয়ার জন্যই আজ আপনার দরবারে ছুটে এসেছি।’

‘আল্লাহ তোমার ওপর রহম নাজিল করুক।’ মহানবি (সাঃ) বললেন—’ইসলামের খেদমতের জন্যই হয়তো আল্লাহ তোমাকে এ জটিল সময়ে এখানে পাঠিয়েছে। তোমার প্রতি আমার দুআ রইল।’

নইম বলল—’আমি যে মুসলমান হয়েছি-এটা যেন এখনই জানাজানি না হয়। আমি ফিরে যাচ্ছি, দুআ করবেন আমি যেন সফল হই।’

রাতের আঁধারে আবার সেই পাহাড় ডিঙিয়ে নইম ফিরে এলো মক্কার বাহিনীর কাছে। ততক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে। সূর্য উঠে এসেছে পূর্বাকাশে। বিভিন্ন বাহিনীর সেনাপতিরা নিজেদের তাঁবু ছেড়ে প্রাতভ্রমণে বের হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকেই চলে এসেছে আবু সুফিয়ানের তাঁবুর কাছে। আবু সুফিয়ানের তাঁবুর পাশেই ছিল বিশাল এক তাঁবু। সেনাপতিদের নিয়ে ওখানেই বৈঠক করতেন তিনি। আবু সুফিয়ান তাদের নিয়ে সেই তাঁবুর ভেতর ঢুকলেন। নানা গল্পগুজবে মেতে উঠলেন সেনাপতিরা। নইম বিন মাসউদ সোজা সেই তাঁবুতে গিয়ে হাজির হলো।

নইমকে দেখেই আবু সুফিয়ান বলল-’আরে নইম যে, বলো কী খবর নিয়ে এসেছ? রাতে কোথায় ছিলে? মনে হয় সারারাত ঘুমাওনি?’

নইম বলল—’আপনি ঠিক ধরেছেন। পাহাড় ডিঙিয়ে আমি মদিনায় গিয়েছিলাম। আপনার জন্য কোনো ভালো খবর আনতে পারিনি।’

‘সে তো কেউ আনতে পারছে না। বলো কী খবর নিয়ে এসেছ তুমি?’ আবু সুফিয়ান আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল।

‘বনু কুরায়জা আপনার বন্ধুত্ব গ্রহণ করেনি। জুহাইয়া বিন আফতাবের কথার জালে বন্দি হয়ে বন্ধুত্বের ওয়াদা দিলেও তারা এখনও মুসলমানদের বন্ধুই রয়ে গেছে।’

‘নইম!’ আবু সুফিয়ান বললেন—’তুমি যা বলছ বুঝে বলছ তো! তোমার তথ্যে যদি ভুল থাকে, তাহলে আমি তোমায় ছাড়ব না!

‘মদিনায় আমার কয়েকজন বন্ধু আছে বনু কুরায়জা গোত্রের। তারা কবে ময়দানে আসতে পারবে সেটা জানার জন্য ওদের সাথে আমি দেখা করি। ওদের মধ্যে যুদ্ধের কোনো আলামতই দেখতে না পেয়ে আমি কিছুটা বিস্মিত হই। আমি ওদের বলি—’কী ব্যাপার! তোমরা কবে ময়দানে নামছ? তোমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনো আলামত তো দেখতে পাচ্ছি না।’

আমার কথার জবাব না দিয়ে ওরা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। আমি বলি—’কী ব্যাপার, কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?’

আমার এক বন্ধু বলে—’নইম! তুমি এত বোকা কেন? তুমি জানো না আমরা মুসলমানদের পেটের ভেতর বসবাস করি। জলে বাস করে কুমিরের সাথে কি লড়াই করা যায়?’

‘কিন্তু তোমরা তো আবু সুফিয়ানকে কথা দিয়েছ। আবু সুফিয়ানের উপঢৌকন গ্রহণ করেছ।’

‘আমাদের সরদার মদ আর মেয়ে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। তা ছাড়া জুহাইয়া বিন আফতাবের কথার মারপ্যাচে পড়ে আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু ওটা তার মনের কথা ছিল না। তিনি জানেন, এ যাত্রায় আবু সুফিয়ানকে ব্যর্থতার বোঝা নিয়েই ফিরে যেতে হবে। মদিনায় আক্রমণ করার সাধ তার পূরণ হবে না।’

তাদের কথা সত্য না মিথ্যা এটা যাচাই করার জন্য রাতেই আমি কাব বিন আসাদের বাড়িতে যাই। তার চাকর প্রথমে আমাকে ঢুকতেই দিতে চায়নি তাকে বললাম—’তুমি জানো না, তোমার মনিব আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব কবুল করেছে? তার জন্য গোপন বার্তা আছে, এক্ষুনি দেখা না করলে তার মহা ক্ষতি হয়ে যাবে।’ আমার এ কথার পর চাকর ফটক খুলে দিলো। ভেতরে গিয়ে আমি তো অবাক। কাব বিন আসাদ আপনার দেওয়া মদ পান করছে, তার দুই পাশে আপনার পাঠানো দুই মেয়ে! আমি তাকে বললাম – ‘কাব, এসব কী শুনছি?’

‘কী শুনছ বন্ধু?’

‘আপনি নাকি আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্ব ফিরিয়ে দিচ্ছেন?’

তিনি মদের গ্লাস টেবিলে রেখে আমার দিকে গভীর চেখে তাকালেন। বললেন—’কে বলল তোমাকে এ কথা? আমি তার বন্ধুত্ব কবুল না করলে সে আমাকে এই নারী ও মদ পাঠাবে কেন? আর আমিই-বা তা গ্রহণ করব কেন?’

‘তাহলে ওয়াদামতো আপনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন না কেন?’ আমি জানতে চাইলাম।

হাসল কাব বিন আসাদ। বলল—’ওহ, এই কথা! দেখ, মুসলমানদের সাথে আমাদের চুক্তি হচ্ছে, ওরা আক্রান্ত হলে আমরা ওদের সাহায্যে এগিয়ে যাব এবং আক্রমণকারীকে প্রতিহত করব। এই চুক্তির দাবি হচ্ছে, আমরা এখন মুসলমানদের সাথে মিলে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরি। কিন্তু আমি কি তাই করছি? আমি কি আবু সুফিয়ানের বন্ধুত্বের খাতিরে আমার তলোয়ার কোষবদ্ধ রাখিনি? তাহলে আবু সুফিয়ানের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন?’

‘বুঝলাম, কাব বিন আসাদ চোখ উলটে ফেলেছে। সে আমাদের পক্ষে অস্ত্র ধরবে না।’

ভেসে এলো আবু সুফিয়ানের হুংকার—’নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। আমার সাথে চালাকি করবি আর আমার পাঠানো মদ খেয়ে আমারই দেওয়া মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করবি? তোকে যদি হত্যা করে আমার ঘোড়ার পেছনে বেঁধে মদিনা থেকে মক্কা পর্যন্ত টেনে নিয়ে না যাচ্ছি, তবে আমার নাম আবু সুফিয়ান না।’ প্রচণ্ড রাগে দাঁতে দাঁত পিষছিল আবু সুফিয়ান। বলল—’আমি মদিনার অবরোধ উঠিয়ে নেব। মক্কা ফেরার আগে বনু কুরায়জার বস্তি আমি বালির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো।’

খালিদ তখন ওখানেই ছিল। যা বোঝার বুঝে নিল সে। বুঝল, অর্থহীন এক অভিযানের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে সে। আবু সুফিয়ানের পক্ষে মদিনা আক্রমণ করা আর সম্ভব হচ্ছে না। মুসলমানদের অস্তিত্ব দুনিয়ার বুক থেকে মিটিয়ে দেওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে সে মক্কা ছেড়েছিল, সে স্বপ্ন আর পূরণ হওয়ার নয়। অপারগতার দুঃসহ ভারে নুয়ে এসেছিল তাঁর মস্তক। মাথা নত করে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছিল খালিদ। আজও সে স্মৃতি তার অন্তরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। তবে সেদিন ছিল অন্তরজুড়ে ব্যর্থতার হাহাকার, আজ সে ব্যর্থতার কথা স্মরণ করে অন্তরে একধরনের স্বস্তি অনুভব করছিল খালিদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *