দুর্গম পথের যাত্রী – ৫

বনু কুরায়জার সরদার কাব বিন আসাদের দরবার কক্ষে গোত্রের প্রভাবশালী নেতাদের সামনে কথা বলছিল লায়েস বিন মোশান।

মোশান বলল—’আমি ইউহাদাকে আমার কাছে নিয়ে এলাম। তার দেহটাই একটা জাদু। এমন অঙ্গ- সুষমা প্রভু খুব কম মেয়েকেই দিয়েছে। তার দেহ খাপখোলা তলোয়ারের চাইতে ধারাল। তাকে আমি এমন সব জাদুবিদ্যা শিক্ষা দিলাম, যা তার কাজে লাগবে। আমাকে আপনারা জাদুসম্রাট বলেন। আমি আমার জাদুর ঝাঁপি উজাড় করে খুলে দিয়েছি তার জন্য। একজন পুরুষকে ঘায়েল করার জন্য তার দেহের জাদুই যথেষ্ট। আমার জাদু তার মধ্যে এনে দিয়েছে এক অতি মানবিক শক্তি। এই শক্তির বলে হাজারো মুগ্ধ চোখের সামনে থেকে সে এমনভাবে উধাও হয়ে যেতে পারবে যে, কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। তাকে আপনারা বলতে পারেন মদিনার টসটসে তাজা খেজুর, যে খেজুরে মেখে রাখা হয়েছে সৌরভমাখা মিষ্টি বিষ। এই বিষ এরই মধ্যে যে অসাধ্য সাধন করেছে—তা আপনারা জানেন না, আমি জানি। মুসলমানদের বিনাশ করার সাথে সাথে যেন কুরাইশদের শক্তিও খর্ব হয়ে যায়, যাতে ইহুদিরাই হয়ে উঠে আরব ভূখণ্ডের প্রধান শক্তি—এই লক্ষ্যে তাকে কাজে নামিয়েছিলাম। এই অভিপ্রায়েই সে কুরাইশদের ছোটো দুটি গোত্রকে টার্গেট করে। তাদের সরদারকে সে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। গোত্রের যুবকদের মধ্যে সৃষ্টি করে মুসলিমবিরোধী উন্মাদনা। তাদের দিয়ে গড়ে তোলে ক্ষুদ্র এক বাহিনী। এই বাহিনীর প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছিল কুরাইশদের সেই বিশাল বাহিনী, যারা লড়াই করতে এসেও যুদ্ধ না করেই ফিরে গেছে। তারা সফল হলে মুসলমানদের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত পৃথিবীর বুক থেকে। লড়াইয়ের ঘা শুকানোর আগেই আমরা কুরাইশদের মধ্যে এমন বিভেদ সৃষ্টি করতাম, যাতে তারাও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। তখন আমাদের আধিপত্য মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকত না। কিন্তু এ পরিকল্পনা সফল না হওয়ায় আমাদের নতুন করে ছক তৈরি করতে হচ্ছে।’

কাব বিন আসাদ বলল—’বুঝলাম, অনেক দিন ধরেই আপনারা জাতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এখন কীভাবে কী করতে চান, একটু খুলে বলুন।’

‘ইউহাদার গল্প শেষ হয়নি। তার গল্পের বাকি অংশ শুনুন, তারপর বলছি কীভাবে কী করতে হবে।’ বলল জাদুসম্রাট লায়েস বিন মোশান।

ইউহাদা আবার ফিরে গেল তার গল্পে। বলল—’উস্তাদজি আমাকে ধর্মের শিক্ষা দিয়েছেন। আমি তার কাছ থেকেই জেনেছি, আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম। এই ধর্মের সেবকদের সাথে থাকেন স্বয়ং খোদা। আমি তার অনেক প্রমাণও পেয়েছি। ভেবে দেখুন, যে মরুঝড়ে আমার ঘোড়া ও সঙ্গী-সাথি সবাই মারা পড়ল, সে ঝড় আমার কোনোই ক্ষতি করল না। যে যুবক আমাকে তার লালসা চরিতার্থ করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল, তার হাত থেকেও খোদা আমাকে রক্ষা করলেন। আমি তার পিঠে খঞ্জর বসিয়ে ধাক্কা মেরে যখন ফেলে দিয়েছিলাম, তখন আমার ধারণা ছিল তাকে কাবু করতে পেরেছি, কিন্তু ঘটনা ঘটল ভিন্ন।

যুবক আপন মনে পথ চললেও সে ছিল যথেষ্ট হুঁশিয়ার। আলখেল্লা ভেদ করে আমার খঞ্জর তার কোমরের বেল্টে লেগে পিছলে যায়। আহত হওয়ার আগেই সে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়ে। নিচে নেমেই সে দাঁড়িয়ে যায় এবং উটের লাগাম টেনে ধরে। সে উটটিকে সেখানেই বসিয়ে দেয়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে—’এটা কী হলো ইউহাদা?’ আমি তখন নিরস্ত্র। আমার সাথের একমাত্র অস্ত্র খঞ্জরটি তখন তার পিঠের আলখেল্লায় ঝুলছে। আমার চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, মৃত্যু অতি নিকটে চলে এসেছে। তার প্রশ্নের জবাবে আমি কিছুই বলতে পারলাম না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। সে আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি করল। আমি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম—’হ্যা, আমি তোমাকে মারতে চেয়েছিলাম। আমার মন বলছিল, তোমার ভালোমানুষির পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কুমতলব লুকিয়ে আছে। তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে, তারপর লালসা মেটাবে। আমার কাছে জীবনের চাইতে ইজ্জত বড়ো। তোমাকে হত্যা করে আমি আমার ইজ্জত বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমি ব্যর্থ হয়েছি, এখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো।’ কী করে এতগুলো কথা বলতে পারলাম তা ভেবে আমি নিজেই চমৎকৃত হলাম। গুরুজি বলেছেন, কথা নাকি আমি বলিনি; আমাকে দিয়ে পরম প্রভু এ কথাগুলো বলিয়েছেন। এখন আমার মনে হয়—গুরুজি সত্যি কথাই বলেছেন।

জারিদ আমার কথা শুনে আমার দিকে গভীরভাবে তাকাল। বলল—’তোমার এমনটি মনে হলো কেন? সাক্ষাতের পর থেকে এ পর্যন্ত আমার কথায় বা আচরণে কি এমন কোনো ইঙ্গিত আমি দিয়েছি? আমার নিয়ত খারাপ থাকলে এই বিজন মরুতে তোমাকে ভোগ করা থেকে কেউ কি আমাকে বিরত রাখতে পারত? শোনো, আমার বিবি আছে, ছোটো একটি কন্যাও আছে। নিজের বিবি ছাড়া অন্য মেয়েদের দিকে লালসার নয়নে তাকানোকে আমি পাপ মনে করি। আর সেজন্যই তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করিনি। এক পবিত্ৰ মন নিয়ে তোমাকে আমি তোমার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি, আর বিনিময়ে তুমি আমার পিঠে খঞ্জর চালিয়ে দিলে!’

বিবেকের দংশনে তখন আমি ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিলাম। সত্যি, এ যুবক এ দীর্ঘ পথে কখনো আমার দিকে কুনজরে তাকায়নি। জারিদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। জারিদ বলল—’কী হলো, কথা বলো?’ আমি আমার চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললাম, যেন অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি। সে বলল—’কী হলো ইউহাদা, কথা বলো?’ আমি কাতর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম—’না জারিদ, তুমি নিষ্পাপ। পাপ ছিল আমার মনে, নইলে অমন কথা কেন আমি চিন্তা করতে গেলাম? কেন তোমাকে হত্যা করার বাসনা আমার মনে এলো? জারিদ, তোমার যা ইচ্ছা আমাকে শাস্তি দাও।’

জারিদ আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল—’তুমি যে জঘন্য অন্যায় করেছ, তার শাস্তি বড়ো ভয়াবহ হতে পারত। কিন্তু তুমি যে উদ্দেশ্যের কথা বললে, তা শুনে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে। আমাদের মেয়েরা এখনও ইজ্জতকে এতটা মূল্যবান মনে করে—এ কথা শোনার পর তোমাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। যাও, তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। এবার উটে চড়ো, তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিই।’ আমরা আবার উটে চড়লাম এবং একসময় সে উট আমাদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। আমি ফিরে এসেছি দেখে আব্বা এসে দৌড়ে গেট খুলে দিলো। আব্বা ধারণা করেছিলেন, ঝড়ের কবলে পড়ে আমি মারা গেছি। তিনি আমাকে দেখে এতটাই বিস্মিত হলেন, যা বর্ণনা করা কঠিন। তিনি জারিদকে কিছুতেই যেতে দিলেন না, ঘরে এনে নাশতা-পানি দিলেন। আমি সব খুলে বললাম আব্বাকে। এ ঘটনার পর আমার মনে হলো-জারিদ এক ফেরেশতা। কুদরতই আমাকে রক্ষা করার জন্য তাকে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এ কথা আমি জারিদকেও খুলে বললাম। তাকে অনুরোধ করলাম, সে যেন মাঝেমধ্যেই আমাকে এসে দেখে যায়।’

এ ঘটনার পর কয়েক দিন কেটে গেল, জারিদ আর এদিকে আসেনি। জারিদের অমায়িক ব্যবহার, ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ, উন্নত নৈতিক চরিত্র ইউহাদার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। জারিদের অনুপস্থিতিতে তার মন শূন্যতায় খা খা করতে লাগল। ইউহাদা অনুভব করল—সে জারিদকে ভালোবেসে ফেলেছে।

একদিন সে তার চাকরকে দিয়ে জারিদের কাছে এক চিঠি পাঠাল। তাতে লিখল—’জারিদ, তুমি আমার দেবতা। তোমার কাছে আমি কিছুই চাই না। শুধু একনজর দেখতে চাই। তুমি কি আসবে?’ জারিদ এলো। এভাবে আসা-যাওয়া করতে করতে জারিদের মনেও ভালোবাসা জন্ম নিল। ইউহাদা এ ভালোবাসাকে বলে পবিত্র ভালোবাসা। কারণ, এ ভালোবাসায় কামনা বা লালসার কোনো স্পর্শ ছিল না। এভাবেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল।

একদিন জারিদ বলল—’ইউহাদা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

ইউহাদা বলল—’জারিদ, আমি তোমাকে আমার দেবতা বানিয়েছি। বিয়ে করে আমি তোমাকে আমার সমপর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাই না। চিরকাল আমি তোমাকে দেবতার আসনেই রাখতে চাই।’

‘তুমি জানো, আমার একটি কন্যা সন্তান আছে, কিন্তু কোনো ছেলে নেই। আমার বিবি আমাকে আর সন্তান দিতে পারবে না। তাই আমি চাই, তুমি আমাকে বিয়ে করে আমাকে অন্তত একটি পুত্র সন্তান দাও।’

এ কথায় ইউহাদাও বিচলিত হয়ে উঠল। বলল—’জারিদ, জানি তোমার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন হয়ে আছে একটি পুত্র সন্তানের জন্য। এই পুত্র তোমাকে তোমার বিবিও দিতে পারে।’

‘না ইউহাদা, চিকিৎসক না করে দিয়েছে।’ বলল জারিদ।

‘নিরাশ হয়ো না। আমার একজন গুরুজি আছে। জাদুসম্রাট লায়েস বিন মোশান আমার সেই গুরু। তার চিকিৎসায় অনেক বন্ধ্যা মেয়েও মা হয়েছে। আমি তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। দেখবে—তিনি তোমার মনের আশা পূরণ করবেন।’

এরপর জারিদ সত্যি সত্যি ইউহাদার সাথে জাদুসম্রাট লায়েস বিন মোশানের কাছে গেল।

লায়েস বিন মোশান সবকিছু শুনে বলল—’ইউহাদা, এই যুবকের মনের ইচ্ছা পূরণ হবে কি না তা এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না। আমি পরীক্ষা করে দেখব, তার সন্তান জন্ম দেওয়ার আর আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। কেন তার এই অবস্থা? পরীক্ষার পরই আমি এ ব্যাপারে প্রকৃত কথা বলতে পারব।’

জারিদ বলল—’আমি রাজি। আপনি পরীক্ষা করুন এবং আমার মনের আশা পূরণ করুন।’

‘এক্ষুনি পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। তুমি ভালো করে ভেবে দেখ—আসলেই তুমি চিকিৎসা করাবে কি না? যদি করাতে চাও, তবে এ মাসের পূর্ণিমা রাত এখানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বিকালবেলা চলে আসবে। ইউহাদা, তোমাকেও তার সাথে আসতে হবে।’

লায়েস বিন মোশান তাদের সাথে আরও অনেকক্ষণ কথা বললেন। রাত ঘনিয়ে এলে বাড়ির পথ ধরল তারা।

আকাশে ফকফকা পূর্ণিমা। জারিদ ও ইউহাদা বিকালেই মোশানের বাড়িতে চলে এসেছে। রাতে জাদুসম্রাট মোশান জারিদকে নিয়ে এক অন্ধকার কামরায় প্রবেশ করল। বলল—’যাই ঘটুক ভয় পাবে না। আমি তোমার পাশেই থাকব।’ একটুপর কামরাটি ভরে গেল মিষ্টি সৌরভে। ক্ষীণ একটু আলোও যেন জ্বলছে কামরায়, তবে এ আলো হালকা নীলাভ। এরপর সেখানে ডেকে আনা হলো ইউহাদাকে। তার পরনে ফিনফিনে কাপড়ের আবরণ। মোশানের ইশারায় ইউহাদা শরবতের পেয়ালা তুলে ধরল জারিদের ঠোঁটে। জারিদ অপূর্ব স্বাদের সে শরবত পান করল তৃপ্তির সাথে। নীল আলো মিলিয়ে গেল। জ্বলে উঠল লালচে আলোর আভা। মোশান বিড়বিড় করে অনবরত মন্ত্র পড়ে চলেছে।

একসময় জারিদ দেখল—তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিকটদর্শন এক লোক। মোশান মন্ত্র থামিয়ে তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করল। বলল—’হে জিনের বাদশাহ! আপনার সামনে যে লোকটি বসে আছে, তার একটি আশা আছে। তার সে আশা কি পূরণ হবে?

জিনের বাদশাহ, এগিয়ে গেল জারিদের দিকে। তার চারদিকে চক্কর দিলো। তার মাথা, হাত, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ঘ্রাণ নিল। বলল—’যুবক, তুমি তোমার পরনের কাপড় খুলে ফেলো।’ জারিদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাই করল। জিনের বাদশাহ আবারও তার চারপাশে চক্কর দিলো। বলল—’বড়ো কঠিন প্রশ্ন। তার ওপর জাদুর প্রভাব কাজ করছে। এ জাদু বড়ো কঠিন জাদু। এর প্রভাব মুক্ত হতে হলে তাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। এ যুবক কি সেই কঠিন পরীক্ষা দিতে রাজি আছে?’

মোশান বলল—’জারিদ, প্রশ্নের জবাব দাও।’

জারিদ বলল—’একটি পুত্রের জন্য আমি যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। বলুন আমাকে কী করতে হবে?’

‘যে তোমাকে জাদু করেছে, তাকে খুন করতে হবে। তুমি কি তাকে খুন করে হলেও পুত্র চাও?’

‘চাই, চাই। আপনি বলুন সে কে? আমি তাকে খুন করব।’

‘খুন করব বললেই সে খুন হয়ে যাবে না। তাকে খুন করতে হলে মোশানের মতো জাদুসম্রাটের কথামতো এগোতে হবে, নইলে তুমি খুন করতে গিয়ে নিজেই ধরা পড়ে যাবে এবং প্রাণ হারাবে।’

‘আমি মোশানের ইশারামতোই সব করব। আপনি বলুন সে কে? কোথায় থাকে?’

‘সে এই মক্কাতেই ছিল, এখন মদিনায় থাকে। তার নাম মুহাম্মাদ।’

‘আমি মুহাম্মাদকেই হত্যা করব। তাহলে কি আমি পুত্র সন্তানের জনক হতে পারব?’

‘না, তারপর ইউহাদাকে বিয়ে করতে হবে। তার গর্ভেই জন্ম নেবে তোমার পুত্র সন্তান। তবে শর্ত হচ্ছে, ওই লোককে হত্যা করার আগে তুমি ইউহাদাকে বিয়ে করতে পারবে না। এখন তোমরা বাগানে যাবে। চাঁদ হেলে পড়ার আগে বিছানায় যাবে না। ‘

এভাবেই নেশা ও নারী দিয়ে আচ্ছন্ন করা হলো জারিদকে। জারিদ ফিরে গেল বাড়িতে। নেশার ঘোরে ওখানে মুহাম্মাদকে হত্যা করার কথা বলে এলেও বাড়িতে এসে সে কিছুতেই তার মনকে রাজি করাতে পারছিল না। ইউহাদা তাকে উত্তেজিত করলে একবার সে রাজি হয়, কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার আগেই তার সে সংকল্প শিথিল হয়ে পড়ে। ইউহাদার ক্রমাগত প্ররোচনায় অবশেষে একদিন মুহাম্মাদকে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে ইউহাদার সাথে সে মক্কা থেকে মদিনা পাড়ি জমায়। তাদের পরিকল্পনা, নব মুসলিম হিসেবে তারা মদিনায় আশ্রয় চাইবে এবং সুযোগ বুঝে একদিন মুহাম্মাদকে দাওয়াত দেবে তাদের ঘরে। খাবার সাথে বিষ মিশিয়ে মুহাম্মাদকে হত্যা করে পালিয়ে যাবে ওখান থেকে।

বনু কুরায়জার এ ষড়যন্ত্রের খবর বৈঠক শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলেন মহানবি (সাঃ)। মুসলমানরা তখন মদিনার অলিতে-গলিতে আনন্দ-উল্লাস করছিল। যে লোক বৈঠকে জানিয়েছিল নইমের মুসলমান হওয়ার কথা, তাকেই বৈঠক থেকে বলা হলো নইমের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে এবং তার কাছ থেকে কৌশলে তথ্য আদায় করতে। এ লোক ছিল নইমেরই গুপ্তচর। বৈঠক থেকে বেরিয়েই সে বৈঠকের পুরো বিবরণ নইমকে জানিয়ে দিলো এবং নইমের মাধ্যমে মহানবি (সাঃ)ও পেয়ে গেলেন এ খবর। নইম যখন এ খবর মহানবি (সাঃ)কে দেয়, সে সময় সেখানে ছিলেন কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সাহাবি। তারা বলাবলি করতে লাগলেন—’ইহুদিদের বিশ্বাস করা আর নিজের খঞ্জর নিজের বুকে বসিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’

খালিদ বিন ওয়ালিদ। মক্কা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। মাথার ওপর কড়া রোদ। গন্তব্য মদিনা। ঘোড়াটি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পথ চলছে ধীর গতিতে। খালিদের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে পথ চলছে ঘোড়া। ঘোড়ার ওপর বসে খালিদ হাতড়ে ফিরছে অতীত দিনের স্মৃতি। সে স্মৃতি বেদনার, সে স্মৃতি অপমান ও লজ্জার।

ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের সে বৈঠকের কিছুদিন পরের কথা। মক্কার অদূরে এক মরূদ্যানে বসে বিশ্রাম করছিল খালিদ। দেখল মদিনার দিক থেকে এক লোক মক্কার দিকে এগিয়ে আসছে। মরূদ্যানের কাছে এসে ঘোড়া থামাল সেই লোক। খালিদ চিনল তাকে, জারিদ। খুবই শরিফ আদমি। এখনকার যুবক বলতেই দাঙ্গাবাজ। জারিদ এদের মধ্যে পড়ে না। হাসিখুশি প্রাণবন্ত এক যুবক। খালিদ ওকে দেখেই বলল—’আরে! জারিদ যে, কোত্থেকে এলে?’

জারিদ তার ঘোড়াটিকে পানি পান করিয়ে এক গাছে বেঁধে বসতে বসতে বলল— ‘একটু মদিনা গিয়েছিলাম।’

‘মদিনা! এতদূর! ব্যাবসার কাজে বুঝি?’

‘আরে না।’

‘তাহলে?’

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে জারিদ এক দৃষ্টিতে ওয়েসিসের পানির দিকে তাকিয়ে রইল। খালিদ বলল—’তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে, ব্যাপার কী জারিদ?’

জারিদ এবার খালিদের দিকে ফিরে বলল—’তোমাকে বলা যায়। জাদু সম্রাট মোশান মদিনায় গিয়েছিলেন। তিনিই আমাকে তার সঙ্গে নিয়েছিলেন।’

‘ইহুদিরা তো ইহুদি ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করে না। তা ইহুদি যুবকদের রেখে হঠাৎ তিনি তোমাকে মদিনায় নিয়ে গেলেন কেন?’

‘খালিদ, এ কথা এখন কাউকে বলা যাবে না, তবে গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিলে তোমাকে বলতে পারি।’

‘আরে! বলো বলো। তুমি জানো, লোক দেখলেই পেটের কথা কারও গায়ে ঢেলে দেওয়ার মতো লোক আমি নই। তুমি নির্ভয়ে সব বলতে পারো।’

‘তোমরা যা পারোনি, ইহুদিরা তা-ই করতে যাচ্ছে।’

‘আমরা কী পারিনি অথচ ইহুদিরা তা-ই করবে?’

‘মুহাম্মাদকে হত্যা।’

খালিদের চেহারা লজ্জা ও অপমানে লাল হয়ে গেল। কথা তো জারিদ মিথ্যা বলেনি। আমরা তো মুহাম্মাদকে হত্যা করার জন্য বারবার তাঁকে যুদ্ধে জড়িয়েছি। কিন্তু বিশাল বাহিনী নিয়েও তাঁকে আমরা কাবু করতে পারিনি, হত্যা তো পরের কথা। বলল—’যেদিন আমার সম্প্রদায় বদরের ময়দানে পরাজয় বরণ করল, সেদিন থেকে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি তাঁকে হত্যা করার। পরপর তিনটি যুদ্ধ করলাম, কিন্তু তাঁকে পরাজিত বা হত্যা করতে পারলাম না।’

‘তোমরা কি রণে ভঙ্গ দিয়েছ, নাকি এখনও হত্যা করার আশা পোষণ করো?’

‘না, আমরা রণে ভঙ্গ দিইনি, আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

‘যুদ্ধ করে তোমরা তাঁর কিছুই করতে পারবে না। ইহুদিদের চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে।’

‘ইহুদিরা কী করতে চাচ্ছে?’

‘গোপনে আততায়ীর মাধ্যমে বা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে সেই খাবার খাইয়ে তাঁকে হত্যা করবে তারা। তুমি জানো না, লায়েস বিন মোশান কত বড়ো জাদুকর! তার মতো জ্ঞানী লোক আমি আর কাউকে দেখিনি। তিনি বলেন, একদিন বিশ্ব হবে ইহুদিদের করতলগত। আজ হোক, কাল হোক, শত বা হাজার বছর পরে হোক, এটা ঘটবেই। পৃথিবীতে বিজয়ী হবে ধোঁকা বা প্রতারণা। যুদ্ধ জয়ের সর্বোত্তম অস্ত্র হচ্ছে কূটকৌশল। কূটকৌশলে যে পারদর্শী, তার বিজয় কেউ রোধ করতে পারবে না। যেদিন প্রতারকরা পৃথিবীর দায়িত্ব নেবে, সেদিন ইহুদিরাই হবে প্রকৃত ক্ষমতাবান। মুহাম্মাদের কাছে জাদু আছে বলেই সে এখনও টিকে আছে। খোদার কসম! মোশানের জাদুর কাছে মুহাম্মাদের জাদু কিছুতেই টিকবে না।’

জারিদের কথায় মন ভারাক্রান্ত হলো খালিদের। ষড়যন্ত্র কোনো বীরের অস্ত্র হতে পারে না, অথচ সেই অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভেবে পুলকিত হচ্ছে ইহুদিরা। জারিদের সাথে সেই কথোপকথনের দৃশ্য ভেসে উঠল খালিদের অন্তরে। মনে মনে বলল—’জারিদ, মুহাম্মাদের জাদু কী তা দেখার জন্যই আজ আমি একাকী মদিনার পথ ধরেছি। আমি দেখতে চাই, কেন তার চেয়ে বেশি সৈন্য নিয়েও আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, কেন ইহুদিদের কোনো ষড়যন্ত্রই ফলপ্রসূ হচ্ছে না, কেন বারবার ব্যর্থ হয় জাদুসম্রাট মোশানের জাদু।’

খালিদের মন তখন অশান্ত ও বিপর্যস্ত। তাঁর মনে হলো-জারিদ তাঁকে ডেকে বলছে—’খালিদ, মুহাম্মাদের কাছে ভয়ংকর জাদু আছে। তাঁর কাছে যেয়ো না তুমি। তুমি তাঁর কাছে গেলে তোমাকেও গ্রাস করে ফেলবে তাঁর জাদু।

খালিদ আপন মনে বলল—’না না, জাদু বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। মানুষ যে জিনিস বুঝতে পারে না, তাকেই জাদু বলে আর যাকে প্রতিরোধ করতে পারে না, তাকে বলে জাদুকর।’ কিন্তু এই সিদ্ধান্তে অটল থাকে না তাঁর মন। মনের সাথে মন কথা বলে। বলে-’কিছু না কিছু রহস্য তো অবশ্যই আছে, নইলে তাঁর কথা তুমি বুঝতে পারবে না কেন? কেন ভক্তি-বিগলিত চিত্তে মানুষ মেনে নেয় তাঁর আধিপত্য! ‘

এ সময় তাঁর মনে পড়ে গেল কয়েক দিন আগের একটি ঘটনা। আবু সুফিয়ান একদিন তাঁকে, আকরামা ও সাফওয়ানকে ডেকে নিয়ে বলল—’মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কা আক্রমণ করতে আসছে।’

তারা জিজ্ঞেস করল-

‘আপনি জানলেন কী করে?’

আবু সুফিয়ান বলল—’এ খবর পেয়েছি আমাদের অতি বিশ্বস্ত গুপ্তচরের মাধ্যমে। তারা আমাকে নিশ্চিত করেছে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মদিনা শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। পথেই তাদের শেষ করে দিতে হবে। আমি বুঝতে পারছি না, মুহাম্মাদ (সাঃ) এমন দুঃসাহস পেল কী করে? কোন সাহসে সে মক্কা আক্রমণ করতে আসছে?’

খালিদ, আকরামা ও সাফওয়ান তাকাল পরস্পরের দিকে, ভয় ও আতঙ্কের বদলে তাদের চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি। আকরামা বলল—’এমনটাই হয় সরদার, মরণ ঘনিয়ে এলে মানুষের বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়। আমরা কতদিন মদিনা ঘেরাও করে বসে রইলাম, তাদের কিছুই করতে পারলাম না। শহরে ঢোকার পথ আটকে দিলো খাল কেটে। এবার? এবার নিজেই ছুটে আসছে মক্কায়। পালানোর কোনো পথ নেই। এবার তাঁকে আমরা পিষে মারব।’

‘কালসাপকে শহরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।’ বলল সাফওয়ান।

খালিদ বলল—’আমরা পথেই তাঁকে নিঃশেষ করে দেবো।’

কালবিলম্ব না করে তিন সেনাপতির নেতৃত্বে তিনটি বাহিনী ছুটল মদিনার পথে। খালিদ সঙ্গে নিল তিনশো’ বাছাই করা অশ্বারোহী। বাতাসের বেগ কেটে ওরা ছুটল মদিনার দিকে। মক্কা ও মদিনার পথ পাহারা দিত কাফিরদের বিশ্বস্ত গোয়েন্দারা। তাদের কাছ থেকেই খালিদ খবর পেল, মুসলমানরা কারা আল গাইয়ামের দিকে এগিয়ে আসছে। কারা আল গাইয়াম থেকে বড়োজোর তারা এখন ত্রিশ মাইল দূরে আছে। খালিদ ঘোড়া ছোটাল কারা আল গাইয়ামের দিকে। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের আগেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া।

কারা আল গাইয়াম মক্কা থেকে মাত্র ত্রিশ মাইলের পথ। মরুভূমির বিশাল বিস্তারে কঠিন এক পার্বত্য এলাকা। ছোটো-বড়ো নানা টিলায় ছেয়ে আছে পর্বতমালা। এই টিলা পূর্ব-পশ্চিমে কয়েক মাইল লম্বা। দুই পাশে টিলার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মদিনা যাওয়ার প্রশস্ত পথ। মদিনা থেকে যারা মক্কায় প্রবেশ করে, তারা সাধারণত এই পথটিই ব্যবহার করে। খালিদ ভেবে দেখল, সংখ্যায় কম হওয়ার পরও যারা এই টিলায় আগে পৌঁছতে পারবে, তাদের পরাভূত করা কঠিন ব্যাপার। টিলার আড়ালে লুকিয়ে তারা সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারবে এবং প্রতিপক্ষ কাছে এলে তাদের টার্গেটও বানাতে পারবে। তাই খালিদ সিদ্ধান্ত নিল—যে করেই হোক, সে ওখানে মুসলমানদের আগে পৌছাবে এবং সেখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সৈন্যদের এমনভাবে বিন্যস্ত করবে, যাতে কোনো মুসলমানই সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে না পারে।

প্রাণপণ ঘোড়া ছুটিয়ে অর্ধেক পথ পেরিয়ে এলো তারা। পথে ছোট্ট এক ওয়েসিসের পাশে খানিক থেমে ঘোড়াকে পানি পান করাল। সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে খালিদ বলল—’বন্ধুরা! মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথিরা আমাদের মুখে তিন-তিনবার কলঙ্কের কালি মাখিয়া দিয়েছে। আজ সেই কলঙ্কের কালি মুছে ফেলার দিন। মদিনা থেকে আজ তাঁরা অনেক অনেক দূরে। তাঁরা আসছে মক্কা কবজা করতে। আসছে আমাদের ইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দিতে। আমাদের দেবতা উজ্জা ও হোবলের মহিমা ম্লান করতে। আমাদের নারীদের দাসী বানাতে। আমরা তাদের আগেই কারা আল গাইয়ামে গিয়ে অবস্থান নেব। দেবতা উজ্জা ও হোবলের নামে শপথ নাও, একজন মুসলমানকেও আমরা প্রাণ নিয়ে পালাতে দেবো না। এবার আমরা কড়ায়-গন্ডায় আমাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেব। এ লড়াই আমাদের অস্তিত্বের লড়াই। এ লড়াই মক্কার পবিত্রতা রক্ষার লড়াই। এ লড়াই সম্মানিত দেবতাদের সম্মান রক্ষার লড়াই। প্রাণ দেবে কিন্তু মান দেবে না। পৃথিবীকে আবার জানিয়ে দাও, কুরাইশ বংশের রক্ত এখনও পানি হয়ে যায়নি, আমাদের বাহুতে মরচে ধরেনি।’

খালিদের এই তেজোদীপ্ত ভাষণে উদ্দীপনার একটা স্রোত যেন বয়ে গেল সৈন্যদের ওপর দিয়ে। তিনশত অশ্বারোহী সমস্বরে চিৎকার করে জয়ধ্বনি দিলো—’জয় হোবল, জয় উজ্জা, জয় কুরাইশ, জয় খালিদ।’

গর্বে ফুলে উঠল খালিদের বুক। উন্নত হলো মস্তক। সে তাঁর ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে বলল—’চলো।’ সাথে সাথে তিনশো অশ্বারোহী ছুটল মুসলমানদের ধ্বংস সাধনের জন্য।

ওরা যখন কারা আল গাইয়ামে পৌঁছল, ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। খালিদ প্রথমে ঘোড়াগুলোকে বিভিন্ন টিলার আড়ালে এমনভাবে লুকিয়ে রাখল, যাতে যখন ইচ্ছা চটজলদি তাদের মূল রাস্তার নিয়ে আসা যায়। এরপর সৈন্যদের ছড়িয়ে দিলো বিভিন্ন টিলায়। তাদের হাতে তির-ধনুক। এক দলকে বসিয়ে রাখল ঘোড়ার পাশে। সৈন্যদের বলল—’মুসলমানদের দেখলেই হামলা করে বসবে না। আমি তাদের টিলার অভ্যন্তরে নিয়ে আসতে চাই। খবর পেয়েছি, ওরা সংখ্যায় চৌদ্দশোর অধিক হবে না। পুরো দলটি টিলায় প্রবেশ করার পর আমি আকাশে অগ্নি তির নিক্ষেপ করব। তখন একদল ঘোড়সওয়ার তাদের পথ আগলে দাঁড়াবে। টিলার ওপরে যারা অবস্থান করবে, তারা থমকে যাওয়া মুসলিম বাহিনীর ওপর শুরু করবে তিরবৃষ্টি। ওরা পিছু হটতে চাইলে তাদের পথ আটকাবে পেছনের অশ্বারোহীরা। তিরবৃষ্টির হাত থেকে প্রাণ নিয়ে যারা বিভিন্ন টিলার আড়ালে ও গিরিপথে পালাতে চেষ্টা করবে, তাদের পদতলে পিষ্ট করবে লুকিয়ে থাকা অশ্বারোহীরা। মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে মুহাম্মাদকে, এবার তাঁকে সেই মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’

সৈন্যদের নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে খালিদ তাঁর বিশ্বস্ত ও চৌকস একদল অশ্বারোহীকে ডেকে নিল। বলল—’তোমরা মদিনার পথে দুজন দুজন করে এগিয়ে যাবে। পালা করে এক ঘণ্টা পরপর মুসলমানদের গতিবিধির রিপোর্ট করবে আমার কাছে।’

খালিদের নির্দেশ পেয়ে অশ্বারোহী দলটি মুহূর্তে হারিয়ে গেল মরুভূমির বিশাল বিস্তারে। অপেক্ষার প্রহর গোণা শুরু হলো খালিদের। প্রথম দলটি ফিরে এসে জানাল-’মুসলমানরা এখনও প্রায় পনেরো মাইল দূরে আছে, তাদের গতি খুব মন্থর। সঙ্গে অনেক বকরি, ভেড়া, উট। এই পশুর পালকে তাড়িয়ে আনতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে তাদের।’

খালিদ চিন্তায় পড়ে গেল। আপন মনেই বলে উঠল—’ওরা সঙ্গে এত পশু আনছে কেন?’

পাশ থেকে এক সঙ্গী বলল—’যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে খাবে কী—এই ভয়েই হয়তো ওরা এত পশু সঙ্গে আনছে।’

অপর সঙ্গী বলল—’ওরা তো মক্কাতে পৌঁছাতেই পারবে না, এই পশু ওদের কী কাজে লাগবে?’

‘এ নিয়ে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ওদের পশুগুলো তখন আমাদের রসনা পরিতৃপ্ত করবে।’

খালিদ ওদের এসব রসালাপে যোগ না দিয়ে অশ্বারোহী দুইজনকে বলল— – ‘ঠিক আছে, তোমরা ফিরে যাও। প্রতি ঘণ্টায় ওদের অগ্রগতির খবর আমাকে জানাবে।’ অশ্বারোহী দুজন পুনরায় ফিরে গেল মরুভূমিতে।

মুসলমানরা এগোচ্ছিল ধীর গতিতে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল কারা আল গাইয়ামের দিকে। তারা জানত না—ওখানে তাদের জন্য কী ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে। খালিদের পাতা ফাঁদের দিকেই তারা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল খালিদ ঘুরে ঘুরে সে ফাঁদের ফাঁকফোকড় খতিয়ে দেখে ফাঁদকে আরও নিখুঁত করে তুলছিল।

মহানবি (সাঃ)র নেতৃত্বে মুসলমানদের কাফেলা এগিয়ে চলেছে মক্কার দিকে। গতি খুবই মন্থর। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। রোদের তাপ কমে গেছে। দেখতে দেখতে রক্তবর্ণ সূর্যটা হারিয়ে গেল মরুভূমির বিশাল বিস্তারে। নেমে এলো রাত। বাতাস খুব দ্রুতই শীতল হয়ে এলো। মক্কা থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে ছোট্ট এক ওয়েসিসের পাশে আফফান নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করলেন মহানবি (সাঃ)। রাতটা ওখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সাহাবিদের বিশ্রামে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাঁর গোয়েন্দা দলকে বললেন—’সামনে পথ কতটা নিরাপদ সে খবর নাও। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়বে, বিশেষ করে কারা আল গাইয়াম ও তার আশপাশের কী অবস্থা জানাবে আমাকে। যারা আগে গেছে, তাদের সাথেও যোগাযোগ করবে।’ গোয়েন্দা দল বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনিও বিশ্রামে গেলেন।

মুসলমানরা বিশ্রাম করলেও বিশ্রাম ছিল না খালিদের। সে একবার এই টিলায় তো আবার ওই টিলায় চড়ছিল। সৈন্যদের সাহস জোগানোর জন্য তাদের শোনাচ্ছিল কুরাইশদের অতীত বীরত্বগাথা, আবার নেমে আসছিল গিরিপথে। শেষে ঘুরতে ঘুরতে মদিনার দিক থেকে গিরিপথে প্রবেশের মুখে এসে দাঁড়াল খালিদ। গোয়েন্দাদলকে সাবধান করে দিয়ে বলল—’মুসলমানরা রাতের জন্য যখন বিশ্রামে চলে গেছে, তখন আর পাহারার প্রয়োজন নেই। তোমরা মুসলমানদের চোখে ধরা পড়ে গেলে তারা এই ফাঁদে ধরা না-ও দিতে পারে। তাই তাদের এড়িয়ে চলাই এখন কর্তব্য।’ সালারের নির্দেশ পেয়ে ফিরে এলো কুরাইশ গোয়েন্দারা।

রাতের শেষ প্রহর। সাহাবিরা সবাই ঘুমিয়ে আছে, কেবল জেগে আছে পাহারাদাররা। হঠাৎ মহানবি (সাঃ)র ঘুম ভেঙে গেল। তিনি খুব দ্রুত কোনো অশ্বারোহীর এগিয়ে আসার পায়ের ধ্বনি শুনতে পেলেন। বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক সওয়ার মহানবি (সাঃ)র তাঁবুর পাশে এসে ঘোড়া থেকে নামল। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন মহানবি (সাঃ)। বললেন—’তোমার চেহারা বলছে তুমি কোনো সুখবর নিয়ে আসোনি, ব্যাপার কী বলত?’

এটা ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের শেষ দিন। গোয়েন্দা একটু দম নিয়ে বলল- ‘আমরা আর একটু হলেই কুরাইশদের পাতা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছিলাম!’

রাসূল (সাঃ) গোয়েন্দাকে বলল—’ঘটনা খুলে বলো।’

সে বলতে লাগল—’গতকাল দুপুরের একটু পর। আমি কারা আল গাইয়ামে এক পাহাড়ের আড়ালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। একসময় ঘোড়ার সম্মিলিত পদধ্বনি ভেসে এলো। ব্যাপার কী, দেখার জন্য আমি এক সুবিধাজনক গোপন স্থান বেছে নিলাম। দেখলাম, মক্কার দিক থেকে একদল অশ্বারোহী দ্রুত এগিয়ে আসছে। একটু পরেই তারা কারা আল গাইয়ামে এসে পৌঁছল। তারা এগিয়ে না গিয়ে কারা আল গাইয়ামেই আস্তানা গাড়ল। আমি সালারকে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, খালিদ বিন ওয়ালিদ এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে সৈন্যদের কারা আল গাইয়ামের সুবিধাজনক জায়গাগুলোতে এমনভাবে সন্নিবেশ করেছে যে, মদিনার দিক থেকে সেই গিরিপথে একবার কেউ প্রবেশ করলে আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারবে না। মনে হয় তারা আপনার অগ্রগতির খবর পেয়ে গেছে, তাই মক্কার প্রবেশ পথে তাদের সবচেয়ে চৌকস সেনাপতিকে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

মহানবি (সাঃ) বললেন—’তারা সংখ্যায় কত হবে?’

‘আনুমানিক তিন থেকে চারশো, সবাই অশ্বারোহী।’

এক সাহাবি বললেন—’তারা আমাদের অগ্রগতির খবর পেয়ে থাকলে ধরে নিয়েছে, আমরা মক্কা অবরোধ করতে যাচ্ছি। তারা আমাদের আসল উদ্দেশ্য জানে না বলেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে।’

মহানবি (সাঃ) স্পষ্ট ভাষায় বললেন—’আল্লাহর কসম! কুরাইশরা আমাদের যতই উত্তেজিত করুক না কেন, আমরা কিছুতেই যুদ্ধে জড়াব না। আল্লাহ আমাদের নিয়ত জানেন। আমরা খুন-খারাবি ও মারামারি করার জন্য মক্কায় আসিনি। আমরা এই দুম্বা, ভেড়া ও বকরি নিয়ে মক্কায় এসেছি ওমরা হজ পালন করার জন্য, এই পশুগুলো কুরবানি করার জন্য। যদি আমি আমার নিয়ত পালটে ফেলি, আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। এমনটা আমি কখনোই করব না।’

এ পরিস্থিতিতে কী করা উচিত এ নিয়ে বিশিষ্ট সাহাবিরা বৈঠকে বসলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তাঁদের পরামর্শ চাইলে সাহাবিগণ নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করলেন। রাসূল (সাঃ) এ মনোযোগ নিয়ে সবার কথা শুনলেন। সাহাবিদের পরামর্শ অনুযায়ী মহানবি (সাঃ) ঞ্জ বিশজনের একটি দল তৈরি করলেন। তাঁদের বললেন— ‘তোমরা কারা আল গাইয়ামের গিরিগুহা মুখে পৌছে যাবে, কিন্তু গিরিপথে প্রবেশ করবে না। যদি কুরাইশরা তোমাদের আক্রমণ করে, তবে পিছু হটে আসবে। অগ্রগামী বাহিনী ভেবে ওরা তোমাদের ওপর আক্রমণ না করে পুরো বাহিনীর যদি অপেক্ষা করতে থাকে, তবে গুহামুখের অদূরে এমনভাবে অপেক্ষা করবে, যাতে ওরা মনে করে তোমরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পিছু হটে আসবে, আবার একটু পরে ফিরে যাবে আগের জায়গায়। এভাবে আমাদের জন্য তোমরা অধীরতা প্রকাশ করবে, তাতে ওরাও আক্রমণ না করে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে।

আর আক্রমণ করলে বারবার পিছু হটবে, একটু পর আবার ফিরে যাবে। এতে ওরা ধরে নেবে, আমরা পেছনেই আছি। এভাবে দুপুর পর্যন্ত আটকে রেখে তোমরাও একসময় পালিয়ে এসে জাতুল হানজাল পর্বতের গিরিপথ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করবে। ইতোমধ্যে আমরা জাতুল হানজাল পর্বত পেরিয়ে মক্কায় পৌঁছে যাব।’

জাতুল হানজাল মক্কার অদূরে এক দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল। এ পর্বতে তেমন কোনো গিরিপথ নেই। দুর্গম বলে এদিক দিয়ে সাধারণত কেউ যাতায়াত করে না। উঁচু-নিচু টিলা মাড়িয়ে এ পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করা অনেক কষ্টকর। সাহাবিদের পরামর্শ অনুযায়ী এ দুর্গম পথেই মক্কায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন মহানবি (সাঃ)। কারণ, তিনি ও তাঁর সাহাবিরা এটা ভালোমতোই উপলব্ধি করতে পারছিলেন—কারা আল গাইয়াম পাহাড়ে যেহেতু অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে, মরুভূমির অন্যান্য পথেও নিশ্চয়ই ওত পেতে আছে দুশমন। অতএব, সেসব পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

মহানবি (সাঃ)র এ সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক ছিল। জাতুল হানজাল পর্বতে কুরাইশদের কোনো পাহারা ছিল না। এ পর্বত মদিনার পথে ছিল না বলে কুরাইশরা ধারণাই করতে পারেনি—মুসলমানরা এ পথে মক্কায় প্রবেশ করবে।

ফজরের আগেই মহানবি (সাঃ) চৌদ্দশো সাহাবি নিয়ে জাতুল হানজালের পথ ধরলেন এবং নির্বিঘ্নে সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন। পশুগুলো পার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলেও দুপুরের আগেই তিনি জাতুল হানজাল অতিক্রম করলেন।

কারা আল গাইয়ামের গুহামুখে পৌছে গেল মহানবি (সাঃ)র পাঠানো বিশজন অশ্বারোহীর দলটি। ওদের দেখেই আনন্দে নেচে উঠল খালিদের মন। মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার এতদিনের স্বপ্ন তাঁর সফল হতে যাচ্ছে। তিনি সৈন্যদের হামলা না করার নির্দেশ দিলেন, কিন্তু দীর্ঘসময় গুহামুখের অদূরে অপেক্ষা করে দলটি ফিরে গেল। খালিদ বুঝলেন, মূল বাহিনীর পৌঁছতে দেরি দেখে ওরা ফিরে গেছে। অপেক্ষা করতে করতে খালিদ যখন অধৈর্য হয়ে পড়েছে, সে সময় দেখলেন দলটি আবার ফিরে এসেছে। ধারণা করলেন, মূল বাহিনীর দেখা পেয়েই আবার ফিরে এসেছে অগ্রগামী বাহিনী। কিন্তু অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও মূল বাহিনীর দেখা মিলল না। অশ্বারোহী দলটি আবার ফিরে গেল। এভাবেই চলতে থাকল লুকোচুরির খেলা। বিশ অশ্বারোহীর দলটি আসে আবার ফিরে যায়। এক পর্যায়ে দুপুরের একটু পর আবার ফিরে এলো দলটি।

অস্থিরতা পেয়ে বসল খালিদকে। ওরা কোত্থেকে আসে আর কোথায় যায়? গিরিপথে প্রবেশ করে না কেন? তবে কি মুসলমানরা তাদের গোপন প্রস্তুতির খবর পেয়ে গেছে? খালিদ তাঁর দুই সৈন্যকে ডাকল। তাদের বলল——তোমরা বণিকের বেশে উটে চড়ে মদিনার পথে অগ্রসর হও। মুসলমানরা ঠিক কোথায় আছে এবং কী করছে, সে খবর নিয়ে ফিরবে।’ উষ্ট্রারোহী দুজন বণিকের বেশে হারিয়ে গেল মরুভূমিতে।

এগোতে এগোতে তারা সেখানে এসে পৌঁছল, যেখানে মুসলমানরা রাতে বিশ্রাম নিয়েছিল। ওরা সেখানে দেখল, মানুষের খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে, দাগ আছে তাঁবুর খুঁটির, কিন্তু ধারের কাছে কোনো জনমানব নেই। যা বোঝার বুঝে নিল ওরা; ছুটল কারা আল গাইয়ামের দিকে। সন্ধ্যার একটু পর ফিরে এলো তারা। বলল—’মুসলমানরা যেখানে ছিল সেখানে নেই। কোন দিকে গেছে তারও কোনো নিশ্চিত চিহ্ন রেখে যায়নি।’

খালিদের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ল ব্যঙ্গ—’তোমাদের চোখ কি আজকাল আর মানুষ দেখতে পায় না?’

‘পায়, যদি সেখানে মানুষের দেহ থাকে। অশরীরী আত্মাকে আমরা কখনোই দেখতে পাই না।’

‘তারা কোন দিকে গেছে তাও বলতে পারো না?’

‘না, বাতাসে বালিতে রেখে যাওয়া দাগ মুছে গেছে।’

খালিদ ভাবল, তাহলে কি তারা আমাদের ওত পেতে থাকার খবর কোনোভাবে জেনে গেছে? তারা আবার ফিরে গেছে মদিনায়? আমরা যেন ধাওয়া করতে না পারি, সেজন্য ক্ষুদ্র একটি দলকে রেখে গিয়েছিল আমাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য? কিন্তু না, মুহাম্মাদকে যতদূর জানি—এতটুকুতেই পালিয়ে যাওয়ার লোক সে নয়। তাহলে? তাহলে কি ওরা মক্কায় চলে গেছে কোনো ভিন্ন পথে?

রাত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খালিদের উদ্বেগ ও অস্থিরতা। খালিদের মনে হলো—আরে, তাই তো! বিকেলে মুসলমানদের দলটি ফিরে যাওয়ার পর তো আর ফিরে আসেনি!

অস্থিরতায় সারা রাত ঘুম হলো না তাঁর। তাঁর মন বলছিল, একবার নিজেই আফফান পর্যন্ত গিয়ে দেখে আসে। এই অস্থিরতার মধ্যেই রাত কেটে গেল। রাগী সূর্য আগুনের হলকা ছুড়ে দিলো মরুভূমিতে। খালিদ কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এ সময় হাঁপাতে হাঁপাতে এক অশ্বারোহী ছুটে এলো তাঁর কাছে। বলল—’আমি যা দেখেছি, তা দেখবে এসো!’

‘কী দেখেছ তুমি?’

‘তুমি আমার সাথে এসো, স্বচক্ষেই তুমিও তা দেখতে পাবে।’

‘আগে বলো কী দেখেছ?’

‘ধূলির মেঘ। কোনো কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছে মক্কার দিকে!’

খালিদ ঘোড়ায় লাফিয়ে চড়ল। গিরিপথ ধরে এগিয়ে গেল মক্কার দিকে। শেষ মাথায় গিয়ে সঙ্গীর দেখাদেখি সেও ঘোড়া ছেড়ে উঠে গেল টিলার মাথায়। স্পষ্ট দেখতে পেল—কাফেলার রেখে রাওয়া ধূলিমেঘ উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। খালিদ বসে পড়ল টিলার ওপর। বলল—’খোদার কসম! কুরাইশ বংশে মুহাম্মাদের মতো বুদ্ধিমান আর কেউ জন্মগ্রহণ করেনি। আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সে তাঁর গন্তব্যে ছুটে যাচ্ছে। মক্কায় পৌঁছা এখন তাঁর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।’

‘আপনি কি নিশ্চিত, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের জাল ছিন্ন করে সত্যিই মক্কা অবরোধ করতে যাচ্ছে?’

‘আহাম্মক! আমাকে এ প্রশ্ন করছ কেন, তুমি দেখতে পাচ্ছ না-তারা আমাদের জাল কেটে বেরিয়ে গেছে!’ বিরক্তির স্বরে বলল খালিদ।

খালিদ আর কোনো কথা না বলে তরতর করে নেমে এলো টিলা থেকে। লাফিয়ে ঘোড়ায় চেপে চিৎকার করে বলতে লাগল—’তোমরা সবাই বেরিয়ে এসো। মদিনার কাফেলা তোমাদের ধোঁকা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মক্কায়। প্রাণের মায়া ছেড়ে ঘোড়া ছোটাও মক্কার দিকে। যদি পথেই ওকে আটকাতে না পারো, তবে সে মক্কা অবরোধ করে বসবে, বিজয় ছিনিয়ে নেবে সে। মক্কার অলিতে- গলিতে গড়াগড়ি খাবে তোমাদের স্ত্রী-সন্তানরা। কই, আড়াল থেকে ছুটে এসো তোমরা। মাল-সামান সাথে কিছুই নেওয়ার দরকার নেই। শুধু অস্ত্র আর ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসো। নিজেদের বাড়িঘর বাঁচাতে ছুটে এসো। মা-বোনদের বাঁচাতে ছুটে এসো। ছুটে এসো দেবতাদের সম্মান বাঁচাতে।’

খালিদ পাগলের মতো ডাকছিল সবাইকে। লোকজন কিছু বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝল, মারাত্মক কিছু ঘটে গেছে। তারা সেনাপতির ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে এলো যার যার অবস্থান ছেড়ে দিয়ে। খালিদের চারপাশে এসে জড়ো হলো তারা। খালিদ বলল—’মদিনার মুসলমানরা আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। তারা আমাদের ফাঁকি দিয়ে মক্কার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি নিজে দেখেছি, তাদের ছুটন্ত ঘোড়ার ধূলিমেঘ। চলো চলো, মক্কাকে রক্ষা করার জন্য সর্বস্ব পণ করে চলো, আমরাও ফিরে যাই বজ্রের বেগে।

তিনশো অশ্বারোহী মুহূর্তে সেখানে সমবেত হয়ে গেল। খালিদ তাদের নিয়ে তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো মক্কার দিকে।

আজ খালিদের ঘোড়া যখন মদিনার সন্নিকটে, তখন তাঁর মনে পড়ল সেদিনের ঘটনা। সেদিন সে ভাবত, মুহাম্মাদের কাছে কোনো জাদু নেই, আছে বুদ্ধি ও অপূর্ব রণকৌশল। এ রণকৌশল যে জানে না খালিদ। এমন নয়—যদি সে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তবে সেও রণক্ষেত্রে জাদু দেখাতে পারত। কিন্তু কবিলার সরদার হচ্ছে আবু সুফিয়ান। লোকটা ধুরন্ধর, কিন্তু ভীতু ও কাপুরুষ। তার বিষয়বুদ্ধি যতটা প্রকট, রণনীতি ততটাই দুর্বল। তার কারণেই মুহাম্মাদের কাছে বারবার তাদের পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে। বদরে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবিলায় মুহাম্মাদ (সাঃ) মাত্র তিনশো তেরোজন সৈন্য নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। ঘটনাটা খালিদকে এতটাই বিহ্বল ও উত্তেজিত করেছিল যে, সে তখন শপথ নিয়েছিল—সময় আসুক, আমিও মুসলমানদের তিনগুণ শক্তিকে পরাজিত করে দেখিয়ে দেবো, ওয়ালিদের বেটাও যুদ্ধের জাদু জানে।

যখন সে শুনল, মুহাম্মাদ (সাঃ) চৌদ্দশো সাহাবি নিয়ে মক্কার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন সে সেই কারণেই মাত্র তিনশো অশ্বারোহী নিয়ে কারা আল গাইয়ামে অবস্থান নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল—তিনশো সৈন্যের হাতে মুসলমানদের চৌদ্দশো সাহাবির নাস্তানাবুদ ও পরাজিত হওয়ার দৃশ্য দেখে পৃথিবী যেন বলে—জাদু মুহাম্মাদের হাতে নয়; জাদু আছে খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে খালিদের জাল ছিন্ন করে কারা আল গাইয়াম অতিক্রম করে গেল, তখন সে উপলব্ধি করল—মুহাম্মাদের বুদ্ধি, যুদ্ধের রণকৌশলের কাছে খালিদ এখনও শিশু।

মাত্র বিশজন অশ্বারোহী পাঠিয়ে তিনশো অশ্বারোহীর দলকে বোকা বানিয়ে নির্বিঘ্নে সরে পড়া এবং চৌদ্দশো সাহাবির দলটিকে নিরাপদে অবরোধস্থল থেকে সরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে অনন্য যুদ্ধচালের কারণেই। খালিদের নিজের শক্তিমত্তা, বুদ্ধি ও রণকৌশলের ওপর যে আস্থা ছিল, এ ঘটনা তাতে বড়ো রকমের এক ফাটল তৈরি করেছিল। সে তখন ভাবছিল, মুহাম্মাদ (সাঃ) যদি সত্যি সত্যি মক্কা কবজা করে নেয়, তবে সমগ্র কুরাইশ সম্প্রদায় তাকে ধিক্কার দেবে। আবু সুফিয়ান তিরস্কার করে বলবে—’কিহে ওয়ালিদের বেটা! এজন্যই কি তোমাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলাম?’ এ ঘটনা কেবল আমাকে নয়; আমার বাপকেও অপমানিত করবে—যে বাপ চিরকাল কুরাইশদের শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। দুঃখে, অপমানে খালিদের তখন নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল।

যখন খালিদ বুঝল-মুসলমানদের চালের কাছে হেরে গেছে, তখন আহত বাঘের মতোই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে। বিলম্ব না করে তাঁর জানবাজ তিনশো অশ্বারোহী নিয়ে ছুটল মক্কার পথে। তাদের গতি এতটাই তীব্র ছিল যে, চোখের পলকে পার হয়ে যাচ্ছিল পাহাড়-পর্বত। ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল পেছনের আকাশ, কিন্তু তাতেও খালিদের মন ভরছিল না। তাঁর মনে হচ্ছিল পথ যেন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। কিছুতেই নাগালে আসছে না মক্কা। পাঁচ মাইলের পথ তাকে কাবু করতেই যেন হয়ে যায় দশ মাইল। একটু পরপর সে তাকাচ্ছিল মক্কার পানে, কিন্তু কোথায় মক্কা, সামনে শুধু ধু-ধু বালির সমুদ্র!

সীমাহীন পেরেশানি নিয়ে সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে খালিদ পৌঁছাল মক্কায়। সেখানে সে কী দেখবে, এই ভাবনায় সে ছিল অস্থির। কিন্তু মক্কায় পৌঁছে সে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পেল না। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামল খালিদ। ঘোড়ার পদধ্বনি শুনে মক্কার ফটকে এসে জড়ো হলো নারী ও শিশুরা। আবু সুফিয়ান এগিয়ে খালিদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বলল—’এসো বিজয়ী বীর, নিশ্চয়ই তোমার কৌশল এবার কাজে লেগেছে এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছে?’

এবার বিস্মিত হওয়ার পালা খালিদের। বলল—’কী বলছ আবু সুফিয়ান! মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কা অবরোধ করেনি?’

ধুরন্ধর আবু সুফিয়ানও বিস্মিত হলো। বলল——মানে কী, মুহাম্মাদকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতলে তুমি, আর আমাকে জিজ্ঞেস করছ মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কা অবরোধ করেছে কি না? মুহাম্মাদকে হত্যা না করে কোন মুখ নিয়ে তুমি মক্কায় এলে?’

খালিদের উদ্বেগ ও পেরেশানি কিছুটা দূর হলো। মক্কা এখনও আক্রান্ত হয়নি এটা অনেক বড়ো স্বস্থির খবর, কিন্তু তাহলে মুহাম্মাদ (সাঃ) কই? সে কি অতর্কিত রাতের আঁধারে হামলা করার জন্য কোথাও আত্মগোপন করে আছে, নাকি আমাদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে ফিরে গেছে মদিনায়? খালিদ মনের পেরেশানি চেপে রেখে আবু সুফিয়ানের প্রশ্নের জবাবে বলল—’আবু সুফিয়ান! মুহাম্মাদের সাথে আমাদের দেখা হয়নি। সে আমাদের ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে। বিশজন অশ্বারোহী পাঠিয়ে ধোঁকা দিয়েছে আমাদের। দিনভর তাঁদের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছি, কিন্তু তাঁরা আমাদের ফাঁদের ধারে কাছেও আসেনি। রাত কেটেছে চরম উৎকণ্ঠায়, কখন তাঁরা আসবে-এই চিন্তায় সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। দুপুরের একটু আগে আমার এক অশ্বারোহী এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখাল। দেখলাম, দূরে আকাশে উড়ছে ধূলিমেঘ। বুঝলাম, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে ছুটে আসছে মক্কার দিকে। বিলম্ব না করে ছুটলাম আমরাও। ভেবেছিলাম, এতক্ষণে সে মক্কা অবরোধ করে ফেলেছে, কিন্তু তোমরা বলছ সে আসেনি। তাহলে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর চৌদ্দশো সাহাবি, অগণিত উট, বকরি, ভেড়া, দুম্বা এসব গেল কই? মক্কার আশেপাশে কোথাও কি তারা গোপন কোনো জায়গায় আস্তানা গেড়েছে? তারা কি রাতের আঁধারে হামলা করার কথা চিন্তা করছে?’

খালিদের কথায়-চিন্তায় পড়ে গেল আবু সুফিয়ানও। বলল—’এ কেবল দুঃসংবাদ নয়, বড়ো ভয়েরও খবর। আমি বুঝতে পারছি না এ অবস্থায় কী করা উচিত?’

খালিদ বলল—’আবু সুফিয়ান! তুমি কি মক্কার চারদিকে এই রাতেই খন্দক বানাতে পারবে, যেমন বানিয়েছিল মদিনায় মুহাম্মাদ? বাঁচার এখন এটাই পথ।’

‘কী করে তা সম্ভব! তার চেয়ে চারদিকে গুপ্তচর পাঠাও। খবর নাও মুহাম্মাদ (সাঃ) কোথায় আছে? আকরামা ও সাফওয়ানকে খবর পাঠাও। শহর রক্ষার জন্য মক্কার চারদিকে সৈন্য মোতায়েন করো।’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল আবু সুফিয়ান।

‘আবু সুফিয়ান! বুঝতে পারছি না কী করব? তুমি তাঁর সন্ধানে লোক পাঠাতে পারো, কিন্তু দেখবে তারা আসার আগেই মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কা আক্রমণ করে বসেছে। দেবতাদের কসম! তাঁরা আসছে ঝড়ের গতিতে। কারা আল গাইয়ামের গিরিগুহায় প্রবেশ না করে তারা যে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, তা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। জানি না এই সয়লাব কখন, কীভাবে আঘাত হানবে মক্কার ওপর!’ বলল খালিদ

‘খালিদ, শান্ত হও। ভয়ে তোমার স্বর কাঁপছে।’

‘আবু সুফিয়ান! তুমি আমাদের সরদার, তাই কিছু বলতে পারছি না। তোমার মতো ভীতু ও কাপুরুষ কোনো গোত্রের সরদার হলে তাদের ভাগ্যে পরাজয় ও লাঞ্ছনা ছাড়া আর কী জুটবে?’

‘আমাকে ভীতু বলছ তুমি, অথচ তোমার কাপুরুষতার কারণেই প্রতিটি ময়দান থেকে আমরা পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে এসেছি।’

তারা যখন এসব বাদানুবাদ করছে, সে সময়ই আকরামা ও সাফওয়ান তাদের বাহিনী নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করল। কারা আল গাইয়াম থেকে খালিদ যখন বেরিয়ে এসেছে, তখন দূর থেকে তারা দেখেছে-কারা আল গাইয়াম থেকে ধূলিমেঘ মক্কার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খালিদকে দেখে আনন্দে তাদের হৃদয় ভরে গেল। মনে মনে বলল—শাবাশ বাপের বেটা! তাহলে মুহাম্মাদ (সাঃ) ঠিকই তোমার জালে ধরা দিয়েছে। মুহাম্মাদকে ঘায়েল করে তোমার মক্কার দিকে ছুটে যাওয়াই প্রমাণ করে—এবার তুমি বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়ার জন্যই এমন পাগলের মতো ছুটছ। যাও বন্ধু, আমরাও আসছি—এই বলে তারাও তাদের বাহিনীকে নিয়ে ছুটল মক্কার দিকে

খালিদ তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু আকরামা ও সাফওয়ানকে দেখেই চিৎকার দিয়ে বলল—’আকরামা, সাফওয়ান! মুহাম্মাদ (সাঃ) আমার জাল কেটে বেরিয়ে এসেছে। মরু সাইমুমের চাইতেও তাঁর আগমন ভয়ংকর দুঃসংবাদ আমাদের জন্য। ভুলে যাও মক্কার সরদার কে? মুহাম্মাদ (সাঃ) এই নামটি ছাড়া ভুলে যাও আর সবকিছু। নিজেকে বাঁচাও। পারলে নিজের জন্মভূমি মক্কাকে বাঁচাও। নিজের স্ত্রী- সন্তানদের বাঁচাও। দেবতাদের ইজ্জতের কসম! তুফান আসছে। এতদিন আমরা আক্রমণ করেছি মুহাম্মাদকে, সে নিজেকে রক্ষা করেছে। এবার সে আক্রমণ করতে আসছে, পারলে নিজেকে রক্ষা করো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *