দুর্গম পথের যাত্রী – ১

আরবের ঊষর মরুভূমি। নিঃসঙ্গ পথ চলছে এক পথিক। সময়টা ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ, অষ্টম হিজরি। সে সময় আরবের এই মরু অঞ্চল—যেখানে মক্কা ও মদিনা অবস্থিত, সেখানে ভীষণ ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছিল। খইফোটা উত্তপ্ত বালুকা প্রান্তরের বিপুল বিস্তার চারদিকে। প্রচণ্ড দাবদাহের ঝলসানো উত্তাপে পথ চলা দায়। একে তো নিদারুণ প্রকৃতি, তার ওপর ডাকাত ও লুটেরাদের ভয়। পথিকেরা পথ চলে দল বেঁধে, কাফেলার সাথে একাত্ম হয়ে। কিন্তু এই পথিক পথ চলছেন একাকী। ঘোড়াটি তাঁর বেশ উন্নত জাতের। পরনে যুদ্ধের পোশাক। কটিবন্ধে তলোয়ার। হাতে বল্লম। চেহারা নির্বিকার।

পথিকের বুক প্রশস্ত। একহারা লম্বা দেহ। সুঠাম শরীর। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। তিনি যে ভঙ্গিতে অশ্বপৃষ্ঠে বসে আছেন-তা দেখলে যে কেউ ভাববে, তিনি একজন রাজকুমার; কোনো সাধারণ মানুষ নন।

তাঁর চোখে-মুখে ভয়, সংকোচের সামান্যতম লেশমাত্র নেই। পথে ডাকাতের দল এসে লুটে নেবে তাঁর উন্নত জাতের ঘোড়া, বিপন্ন অবস্থায় তাকে পাঁয়ে হেঁটে চলতে হবে—এমন কোনো সম্ভাবনার কথা তিনি আদৌ ভাবছেন না। তাঁর চেহারায় কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। মনের পর্দায় ভেসে উঠছে তাঁর অনেক স্মরণীয় ঘটনা, জীবনের অনেক তিক্ত-মধুর স্মৃতি। কোনোটা মনে উদয় হয়েই হারিয়ে যাচ্ছিল, কোনোটা আবার হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যাচ্ছিল আরও গভীরভাবে।

সামনে দুটো উঁচু পাহাড়। মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ গিরিপথ। ছন্দময় তালে নির্বিঘ্নে ছুটে চলেছে ঘোড়া। একসময় আরোহীকে নিয়ে প্রবেশ করল গিরিপথে। গিরিপথ ক্রমান্বয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সে পথ ধরে এগিয়ে চলল ঘোড়াটি। একসময় উঠে এলো পাহাড়ের চূড়ায়। চূড়ার সমতল জায়গাটিতে পৌঁছে আরোহী ঘোড়া থামালেন। পাদানিতে দাঁড়িয়ে ঘুরে পেছন ফিরে দেখলেন। না, এখন আর মক্কা দেখা যাচ্ছে না। দিগন্তের অন্তরালে হারিয়ে গেছে।

কে যেন তাঁর ভেতর থেকে কথা বলে উঠল—’আবু সুলাইমান! আর পেছন ফিরে তাকিয়ো না, মক্কার কথা মন থেকে মুছে ফেলো। তুমি এখন সীমাহীন দিগন্তের এক নিরলস যাত্রী! মক্কার কথা স্মরণ করে নিজের সত্তাকে দুভাগে ভাগ করো না। আবেগকে সংহত করো। সংযত করো চিত্তকে। মনকে দৃঢ় করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল হও। মক্কা নয়; তোমার গন্তব্য এখন মদিনা।’ তিনি মক্কার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। লাগাম টেনে ঘোড়াকে ইঙ্গিত করলেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। ঘোড়া আরোহীর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পা বাড়াল। পূর্ণ গতিতে ছুটে চলল মদিনার দিকে।

আরোহীর বয়স ৪৩, কিন্তু বয়সের তুলনায় তাঁকে যুবক বলেই মনে হয়। সুলাইমান তাঁর ছেলের নাম। পিতার নাম ওয়ালিদ। আরবের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তাঁর নাম হওয়ার কথা খালিদ বিন ওয়ালিদ। কিন্তু এ মুহূর্তে নিজেকে আবু সুলাইমান ভাবতেই তাঁর ভালো লাগছে। নিঃসঙ্গ মরু প্রান্তরে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে চলেছে রাজকীয় আরোহী। তাঁর জানা নেই, একদিন তাঁর এ ছুটে চলা হবে ইতিহাস। হাজার বছর পরও মানুষ গর্বভরে স্মরণ করবে তাঁর কথা। তবে আবু সুলাইমান নামে নয়; স্মরণ করবে খালিদ বিন ওয়ালিদ নামে। প্রতিটি জিহাদের ময়দানে মুজাহিদের অন্তরে খোদাই করা থাকবে এ নাম। যেখানেই সত্য আর মিথ্যার সংঘাত বাধবে, সেখানেই এ নাম সাহস ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে সত্যের সংগ্রামীদের। কিন্তু ৪৩ বছর বয়সে যখন তিনি মদিনায় যাচ্ছিলেন, তখনও মুসলমানের কাতারে শামিল হননি তিনি। বরং এতদিন ইসলাম ও কুফরের মধ্যে যেসব ছোটো ছোটো খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে, সেসব যুদ্ধে; এমনকী বদর ও উহুদের প্রান্তরে মুসলমানদের সাথে কাফিরদের যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়, তাতেও তিনি কাফিরদের পক্ষেই অস্ত্র ধরেছিলেন।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দের পবিত্র এক সোমবার। মহানবি (সাঃ)র ওপর নাজিল হয় আল্লাহর প্রথম ওহি। খালিদের বয়স তখন ২৪ বছর। তিনি তখন তাঁর সম্প্রদায় বনু মাখজুমের ফৌজি সালার। বনু মাখজুম কুরাইশ সম্প্রদায়েরই একটি সম্মানিত শাখা। কুরাইশ গোত্রের নিরাপত্তা ও সামরিক কর্তৃত্ব এই বংশের ওপর ন্যস্ত। কুরাইশ গোত্রের সকলেই খালিদের পিতা ওয়ালিদের কর্তৃত্ব মেনে চলত। তাঁর আদেশ ও মীমাংসা মেনে নিত সন্তুষ্টচিত্তে। ২৪ বছর বয়সেই খালিদের ওপর এই সম্মানজনক দায়িত্ব অর্পিত হয়। দীর্ঘ উনিশ বছর তিনি এই সামরিক দায়িত্ব পালন করেন সাফল্যের সাথে, কিন্তু তারপর? তারপর একদিন সেই দায়িত্ব পরিত্যাগ করে আবু সুলায়মান মক্কা ছেড়ে মদিনার পথ ধরেন।

আবু সুলাইমান আপন মনে পথ চলেছেন, গন্তব্য মদিনা। কৈশোর ও যৌবনের হাজারো স্মৃতি তাঁকে পিছু টানছে। এ স্মৃতির টানে বারবার তিনি পিছু ফিরে তাকাতেন।

কিন্তু তাঁর সংকল্প এসে তাঁকে আহ্বান জানাত—খালিদ, আর পিছু ফেরা নয়, তোমার সামনে এখন অপেক্ষা করছে এক নতুন জীবন! তুমি ওয়ালিদের সন্তান এ কথা ঠিক, কিন্তু সে তো মরে গেছে। এখন তুমি সুলাইমানের বাবা! সে জীবিত আছে। তার জন্য সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার দায়িত্ব তোমার। যে পৃথিবী হবে হানাহানিমুক্ত, ভালোবাসায় সিক্ত, মানবতার জয়গানে মুখর। তাঁর চেতনায় বারবার আঘাত হানছে দুটো নাম। একদিকে রয়েছে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ), যিনি একটি নতুন দ্বীন প্রচার করছেন। অন্যদিকে ওয়ালিদ—তাঁর পিতা, যিনি এই দ্বীনের ঘোর শত্রু ছিলেন। পিতা এই শত্রুতা উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁকে দিয়ে গেছেন। তিনি এখন দুনিয়ায় নেই, কিন্তু তার শত্রুতার উত্তরাধিকার বহন করছেন তার সন্তান খালিদ বিন ওয়ালিদ।

খালিদের ঘোড়া আপন গতিতে এগিয়ে চলছে। এগিয়ে যাচ্ছে পানির এক উৎসের দিকে। খালিদ সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন। খেজুরের সতেজ বৃক্ষরাজি শোভিত মনোরম এক মরূদ্যান। অশ্ব সেদিকেই ছুটে চলেছে।

বাগানে প্রবেশ করে খালিদ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নামলেন। পাগড়ি খুলে ঝরনার পাশে দাঁড়িয়ে দুই পা একত্রিত করে ঝুঁকে পড়লেন। অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে মুখে-মাথায় ছিটালেন। দেখলেন, তাঁর ঘোড়াটিও পানি পান করছে। খালিদ ঝরনার অন্য পাশে চলে গেলেন। প্রাণভরে পান করলেন সুপেয় পানি। তারপর ফিরে এলেন ঘোড়ার কাছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে জিন নামিয়ে জিনের সাথে বাঁধা মোটা কাপড়ের বিছানা খুলে গাছের ছায়ায় বিছিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লেন তিনি।

পথশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত খালিদ। শুয়ে শুয়ে ভাবলেন, একটু ঘুমিয়ে নেবেন। কিন্তু মনের ভেতর স্মৃতির হাজারো কাফেলা এমন ছোটাছুটি শুরু করল যে, কিছুতেই আর ঘুমাতে পারলেন না। সাত বছর আগের একটি দিনের কথা স্মরণ হলো তাঁর। সেদিন অত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই একজোট হয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ) কে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনায় খালিদের বাবা ওয়ালিদ ছিলেন সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ও অগ্রগামী।

৬২২ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের এক রাত! কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা রাসূলে আকরাম-কে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করার জন্য মেতে উঠল। তারা এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য এমন সব লোক বাছাই করল, যারা আসলে মানুষরূপী পশু, বর্বর ও জংলি। খালিদ বিন ওয়ালিদ কুরাইশ বংশের শ্রেষ্ঠ গোত্রের বলিষ্ঠ নওজোয়ান। বয়স সাতাশ বছর। রাসূল (সাঃ)-কে হত্যার জন্য সংগঠিত ঘাতকদলের সদস্য থাকাটাই তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু তিনি ঘাতক দলের অন্তর্ভুক্ত হলেন না। সাত বছর আগেকার রাত, অথচ মনে হচ্ছে সেদিনের ঘটনা। সেদিন কী এক দ্বিধা এসে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাঁকে। এ হত্যা-পরিকল্পনার ব্যাপারে একবার মনে হচ্ছিল তিনি সন্তুষ্ট, আবার পরক্ষণেই উৎকট অসন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠছিল তাঁর চেহারায়।

যখন মনে হতো মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর আপন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্ম—যে ধর্ম যুগ যুগ ধরে তার বাপ-দাদারা পালন করে আসছে—সেই পৌত্তলিক ধর্মকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন এবং নিজেকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলে দাবি করেছেন, তখন মনে হতো—তাঁকে হত্যা করাই উচিত। এ কথা মনে হলেই তাঁর চেহারায় ফুটে উঠত সন্তুষ্টির ভাব।

কিন্তু যখন রাতের অন্ধকারে গোপনে হত্যা করার পরিকল্পনা গৃহীত হলো, তখন বিদ্রোহ করে উঠল তাঁর মন। এ কেমন বর্বরতা! কোনো রকম আত্মরক্ষার সুযোগ না দিয়ে শত্রু নিধনের এ কেমন কাপুরোষোচিত পদ্ধতি! একজন মাত্ৰ লোককে হত্যা করার জন্য বিশাল বাহিনী গড়ে তোলার এ কেমন অসম চেষ্টা! তাঁর অসন্তুষ্টির কারণ এখানেই। সে উত্তেজিত শত্রুকে সম্মুখ লড়াইয়ে নির্দ্ধিধায় হত্যা করতে পারে, কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় শত্রু নিধনের কথা চিন্তা করতেও বিবেকে বাধছে তাঁর। এই দোটানায় পড়ে এ ষড়যন্তের বিরোধিতা যেমন তিনি করেননি, তেমনি তাদের সঙ্গে শামিল হওয়ারও কোনো আগ্রহ জাগেনি তাঁর মধ্যে।

নির্দিষ্ট রাতে যখন খুনিরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করতে গেল, তখন নবিজির ঘর ছিল ফাঁকা। সেখানে নবিজি তো ছিলেনই না; এমনকী ঘরে নবিজির আসবাবপত্রও ছিল না। নবিজির উঠান, আস্তাবল সব ছিল শূন্য।

সে রাতে ষড়যন্ত্রকারী কুরাইশরা এই আশা বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছিল যে, সকালবেলা তারা শুনতে পারবে—তাদের ধর্মকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী আর নেই; নিহত হয়েছে সে। কিন্তু সকালবেলা তারা যখন শুনল মুহাম্মাদকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, তখন নিরাশায় ছেয়ে গেল তাদের মন। তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল আর কানে কানে জিজ্ঞেস করছিল—’এই, এটা কী হলো? মুহাম্মাদ (সাঃ) কোথায় গেল?’

আল্লাহর মহিমায় রাসূলে আকরাম তাঁকে হত্যা করার এই ষড়যন্ত্রের খবর আগেই পেয়েছিলেন। তাই রাতে হত্যাকারীরা তাঁর বাড়িতে চড়াও হওয়ার অনেক আগেই তিনি বিশ্বস্ত সঙ্গী আবু বকরকে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনার পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তখন মদিনার নাম ছিল ইয়াসরিব। সকাল হওয়ার আগেই তিনি ওদের নাগালের বাইরে বহু দূরে চলে গিয়েছিলেন।

সে ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে সাতটি বছর। আজ সাত বছর পর একইভাবে মদিনার পথ ধরেছেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব। চলার পথে সারাক্ষণ একটি নাম অন্তরে ধারণ করে আছেন, সে নাম—মুহাম্মাদ।

উহুদ যুদ্ধের কথা মনে পড়ছে তাঁর। দেবতা হোবল ও উজ্জার শত্রু মুহাম্মাদ-কে হত্যার জন্য কী প্রাণপণ চেষ্টাটাই না করেছিলেন সেদিন! আল্লাহর অশেষ রহমত, আহত হলেও সেদিন মারা যাননি তিনি। সেদিন যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত, তাহলে কোথায় পেতেন তিনি এমন মহামানব! যার জন্য তাঁর অন্তরে সৃষ্টি হয়েছে একশো একটি সমুদ্রের ভালোবাসা। খালিদের মনে কত কথা, কত স্মৃতিই না এখন তোলপাড় করছে! সেই স্মৃতির পাতা উলটাতে উলটাতে কেটে গেছে ষোলোটি বছর। মনে পড়ছে ৬১৩ খ্রিষ্টাব্দের এক সন্ধ্যা। রাসূলে করিম (সাঃ) এ কুরাইশদের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দাওয়াত করেছেন তাঁর বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়ার পর রাসূলে করিম (সাঃ) মেহমানদের উদ্দেশ্য করে বললেন—

‘হে বনি আবদুল মুত্তালিব! তোমাদের সামনে এখন আমি যে উপঢৌকন ও উপহার পেশ করব, তা আরবের কোনো ব্যক্তিই তোমাদের সামনে পেশ করতে পারবে না। এ মহা উপহার-সামগ্রী তোমাদের সামনে হাজির করার জন্য আল্লাহ আমাকেই মনোনীত করেছেন। আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, আমি যেন তোমাদের এমন এক পথের দিকে ডাকি, যে পথ তোমাদের দুনিয়ার জীবনে পরিপূর্ণ তৃপ্তি ও আনন্দ দেবে এবং সেইসঙ্গে দুনিয়া থেকে যেদিন চলে যাবে, সেদিন তোমাদের পরকালীন জীবনের সাফল্যও নিশ্চিত করবে।’

এমনিভাবে রাসূলে আকরাম এ ওহির প্রথম তিন বছর তাঁর নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। খালিদ সেদিনের সেই মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন না, তবে তাঁর পিতা ওয়ালিদ ছিলেন নিমন্ত্রিতদের মধ্যে। মাহফিল থেকে ফিরে এসে পুত্র খালিদকে উপহাস করে বলেছিলেন—’শুনেছ খালিদ, আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে কিনা সে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, নবি!’

‘আমি জানি, আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের নামকরা সরদার ছিলেন।’ ওয়ালিদ পুত্রকে আরও বলছিলেন—’নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদের বংশ খুবই মর্যাদাবান, কিন্তু তাই বলে তাঁর বংশের কোনো ব্যক্তি কেমন করে নবুয়তের দাবি করতে পারে? আল্লাহর কসম! হুবল ও উজ্জার কসম! আমার বংশ-মর্যাদা কারও চেয়ে কম নয়। নবুয়তের দাবি করলেই কি কেউ আমাদের চেয়ে বেশি মর্যাদাবান হয়ে যাবে?’

‘আপনি তাকে কী বলে এসেছেন?’ পিতার কথা শুনে প্রশ্ন করেছিল খালিদ।

‘এ কথা শুনে প্রথমে আমি তো ‘থ’ বনে গেলাম। পরে আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।’ ওয়ালিদ বললেন। ‘কিন্তু মুহাম্মাদের চাচাতো ভাই আলি মুহাম্মাদের নবুয়ত মেনে নিয়েছে।’ খালিদ তাঁর পিতার ব্যঙ্গমাখা হাসির কথা আজও ভোলেনি।

.

৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের একটি দিন।

মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার রাস্তার পাশে এক খেজুর বাগানে শুয়ে খালিদের মনে পড়ল সে দিনটির কথা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুয়তের দাবি কুরাইশপ্রধানগণ মেনে নিতে পারছিল না। অন্যদিকে, নির্যাতিত-অসহায় সাধারণ মানুষ তাঁর নবি হওয়ার দাবি মেনে নিয়ে অনেকেই তাঁর অনুসারী হয়ে যাচ্ছিল এদের বেশিরভাগই ছিল যুবক। যদিও নিঃস্ব ও গরিবরাই ইসলাম কবুল করছিল, তবু এতেও নবি করিম (সাঃ)-এর উদ্দীপনা ও শক্তি বাড়ছিল। আশান্বিত হয়ে তিনি প্রচারকাজ আরও বাড়িয়ে দিলেন। তিনি ছিলেন মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী। মুসলমানরা আশায় দিন গুনছিল-কবে তারা কাবাঘরে রক্ষিত ৩৬০টি মূর্তি সেখান থেকে অপসারণ করতে পারবে।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও আরবের লোকেরা সবাই এক আল্লাহকে মানতো, কিন্তু পূজা করত মূর্তিগুলোর। তারা সেগুলোকে দেবতা ও দেবী বলত এবং আল্লাহর পুত্র ও কন্যা বলে গণ্য করত।

কুরাইশরা যখন দেখল, তারা মুহাম্মাদের যে দ্বীনের উপহাস করছে, সেই দ্বীনই সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছে, তখন তারা তাঁর প্রচারকাজে বাধা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু এতেও মুহাম্মাদ (সাঃ) বিরত না হওয়ায় তারা দলবদ্ধভাবে তাঁর মোকাবিলা করতে চাইল। তারা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন শুরু করল এবং তাদের বেঁচে থাকার পথে বাধার দেয়াল খাড়া করে দিতে লাগল।

খালিদ অবাক হয়ে দেখত, মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কার অলিগলি, রাস্তা ও বাজারের যেখানেই লোকজনকে দেখতে পেত, সেখানেই ছুটে যেত এবং তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিত। মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রচণ্ড আবেগ ও আকুতি নিয়ে লোকজনকে বলত- ‘এই মূর্তি তোমাদের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, মানুষের উপকার বা ক্ষতি করার কোনো শক্তি এদের নেই। তোমরা মূর্তিপূজা ছেড়ে দাও। ইবাদত করো একমাত্র আল্লাহর; যিনি সর্বশক্তিমান, যাঁর কোনো শরিক নেই।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র বিরোধিতায় কুরাইশদের যে চারজন নেতা বেশি তৎপর ছিলেন, তারা হলো—খালিদের বাবা ওয়ালিদ, রাসূলের আপন চাচা আবু লাহাব,

দুর্গম পথের যাত্রী

ধনকুবের আবু সুফিয়ান ও খালিদের চাচাতো ভাই আবুল হাকাম। মুসলমানদের ওপর এরা অকথ্য জুলুম, অত্যাচার শুরু করেছিল। কুরাইশদের এ চার শীর্ষ নেতা মূর্খতা ও বর্বরতার শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের হিংসা ও হিংস্রতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। রাসূলের বিরোধিতায় তারা এমন সব কাজ করতে লাগল, যা কোনো সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক করতে পারে না।

সে সময় আরবে রক্তের বন্ধন ছিল খুব দৃঢ়। আপন গোত্রের লোক অন্যায় করলেও তারই পক্ষ নিত গোত্রের লোকেরা। সেই বন্ধন ছিন্ন করে আবুল হাকাম আপন ভাতিজার সাথে অমানুষিক আচরণ করায় লোকজন আড়ালে- আবডালে তাকে আবু জাহেল অর্থাৎ মূর্খের বাবা বলে ডাকতে শুরু করল। অল্প দিনের মধ্যেই এ নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুদিন পর অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, জনগণ তার আসল নামটাই ভুলে গেল। ইতিহাসও এই ছোটোখাটো শক্ত-পোক্ত লোকটিকে আবু জাহেল নামেই স্মরণ রেখেছে।

এই সব জাহেলদের কথা মনে হতেই অসহ্য যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠল তাঁর মন। পুরোনো সে দিনগুলোর কথা স্মরণ করে লজ্জিত হলো নিজে। কুরাইশের লোকেরা কতবার যে রাসূলের ঘরে দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা ছুড়ে ফেলেছে! মনে পড়ছে—যেখানেই কোনো মুসলমান ইসলামের দাওয়াত দিতে গেছে, সেখানেই কুরাইশের লোকেরা গিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি করেছে। চরিত্রহীন ও সৃষ্টিছাড়া বাউন্ডুলে লোকদের রাসূলের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

খালিদের তবু একটু প্রশান্তি ছিল, তাঁর পিতা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বিরোধী হলেও এমন জঘন্যতম কাজে কখনো লিপ্ত হননি। তিনি কুরাইশের অন্য তিন শীর্ষ নেতার সঙ্গে মিলে একাধিকবার রাসূল (সাঃ)-এর  চাচা আবু তালিবের সাথে দেখা করে তাঁর ভাতিজাকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে বলেছেন। তারা কিছুটা হুমকিও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—’যদি ভাতিজাকে মূর্তির বিরোধিতা করা ও নবুয়তের দাবি থেকে বিরত রাখতে না পারো, তবে দেখবে—কোনো একদিন সে কারও হাতে খুন হয়ে গেছে!’ আবু তালিব অবশ্য দুবারই ওদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন

পিতার বিরাট ত্যাগের কথা খালিদের স্মরণে এলো। আম্মার ছিল খালিদের সহোদর ভাই। দেখতে ছিল খুবই সুন্দর এবং অত্যন্ত মেধাবী। খালিদের বাবা ওয়ালিদ একদিন তাকে কুরাইশ সরদারের কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন— ‘তোমরা এই ছেলেটিকে মুহাম্মাদের চাচা আবু তালিবের কাছে নিয়ে যাও আর বলো, একে রেখে যেন সে তার পরিবর্তে মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে সঁপে দেয়।’

খালিদ তাঁর পিতার এমন কঠিন সিদ্ধান্তে কেঁপে উঠেছিল। পিতা যখন ভাইকে নিয়ে গেল, তখন খালিদ ভাইয়ের বিচ্ছেদে নির্জনে বসে অঝোরে কতই না কেঁদেছিল!

সরদাররা আম্মারকে রাসূল (সাঃ)-এর  চাচার সামনে রেখে বলল—’হে আবু তালিব! এই সুন্দর ছেলেটাকে তুমি চেনো? এ আম্মার বিন ওয়ালিদ! তুমি এও জানো, তুমি যার সরদার, সেই বনু হাশিমের খান্দানে এমন সুশ্রী ও বুদ্ধিমান যুবক আজ অবধি জন্মেনি। এই যুবককে তোমার কাছে চিরদিনের জন্য সঁপে দিতে এসেছি। যদি একে তুমি তোমার সন্তান হিসেবে রাখো, তবে সে সারা জীবন তোমার অনুগত থাকবে। আর যদি তাকে গোলাম বানিয়ে রাখো, তবে আল্লাহর কসম করে বলতে পারি! তোমার জন্য এই ছেলে আপন জীবনও উৎসর্গ করবে।’

আবু তালিব বললেন—’কিন্তু তোমরা এই সুন্দর যুবককে কেন আমার কাছে দিতে চাচ্ছ? তবে কি বনু মাখজুম গোত্রের মায়েরা আপন সন্তানকে শেষ পর্যন্ত নিলাম করা শুরু করেছে? বলো, তোমরা এর কত মূল্য দাবি করো?’

কুরাইশের একজন সরদার দাবি জানাল—’এর মূল্য কিছু না, এর বিনিময়ে শুধু তোমার আপন ভাতিজা মুহাম্মাদকে দিয়ে দাও!’ তোমার ভাতিজা তোমার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণ হয়েছে। সে তোমার বাপ-দাদার ধর্মকে বাতিল করে নতুন ধর্ম তৈরি করেছে। তুমি কি দেখ না, সে আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর শত্রুতা সৃষ্টি করছে?

‘তোমরা আমার ভাতিজাকে নিয়ে কী করবে?’

‘আমরা ওকে হত্যা করব।’

আরেক নেতা উত্তর দিলো—’আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করলে তাতে বেইনসাফি হবে না। কারণ, আমরা তোমার ভাতিজার বিনিময়ে তোমাকে আমাদের সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান যুবককে দান করছি।’

আবু তালিব বললেন—’কিন্তু এটা হবে মহাঅন্যায় ও অবিচার! তোমরা আমার ভাতিজাকে হত্যা করবে, আর আমি তোমাদের সন্তানকে লালন-পালন করব, আদর-যত্ন করব, আমার সম্পদ থেকে এর জন্য ব্যয় করব, তোমরা আমার কাছে এ কেমন দাবি নিয়ে এসেছ? এ বিনিময় সম্ভব নয়, আমি তোমাদের সসম্মানে বিদায় জানাচ্ছি।’

খালিদ যখন দেখল সরদাররা তাঁর ভাইকে নিয়ে ফিরে এসেছে, আর তাদের কাছে শুনল—আবু তালিব তাকে গ্রহণ করেননি, তখন খালিদের আনন্দ আর ধরে না।

.

আরেক দিনের ঘটনা

নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ (সাঃ) এ বীরপুরুষ, কিন্তু রেকানা বিন আবদ ইয়াজিদের কাছে তিনি কিছুই না। রেকানা যেমন বিরাট পালোয়ান, মশহুর বীর, তেমনি মোটাসোটা দৈত্যের মতো বিশাল তার দেহ। দেখলেই ভয় ধরে যায়। শারীরিক শক্তি দিয়ে তাকে ধরাশায়ী করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।

এই রেকানা বিন আবদে ইয়াজিদ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র চাচা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। আরবের একজন শ্রেষ্ঠ কুস্তিগির হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন তিনি। দেশের সাধারণ কুস্তিগিররা তার সাথে লড়ার সাহস পেত না। নামকরা কুস্তিগিররা তার সঙ্গে লড়তে এসে এক পাকড়ানোতেই ধরাশায়ী হয়ে যেত; আর উঠার সুযোগ পেত না। রেকানার স্বভাবটা ছিল বন্য প্রকৃতির, শুধু মারধর আর লড়াই করাই জানত।

খালিদের সেই সময়ের কথা মনে পড়ছে, যখন মুসলমানদের বিরক্ত করতে একদিন তিন-চারজন লোক রেকানাকে ধরল। তারা রেকানা কুস্তিগিরকে ভালোমতো খাইয়ে-দাইয়ে বলল—’তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদকে কেউ পরাস্ত করতে পারে না। তাঁর সাথে লড়তে গেলে সে বাহাদুরের মতো অসি চালায়, কাউকে ভয় পায় না। জনগণ তাঁর কথার জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি তাঁকে সোজা করতে পারো না?’

রেকানা নেশায় মহিষের মতো ফোঁস করে উঠল। গর্বের সাথে বলল—’তোমরা কি আমার হাত দিয়ে তাঁর হাড্ডি গুঁড়ো করাতে চাও?’ তাঁকে নিয়ে এসো আমার সামনে।’ তারপর কী মনে হতে বলল—’আরে, তাঁকে আনবে কী, সে তো আমার নাম শুনেই মক্কা ছেড়ে পালিয়ে যাবে। না, না, তাঁর সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে ছোটো করতে পারব না।’

সে উসকানিদাতাদের কথায় রাজি হলো না। বলল—’আমি কোনো বীরকেই আমার সমকক্ষ মনে করি না, আর কিনা… না, না, এ অসম্ভব!’

রেকানার কথায় মুসলিমবিদ্বেষীরা সকলেই চুপ হয়ে গেল। তারা চিন্তা করতে থাকল, কেমন করে আল্লাহর রাসূলকে পরাজিত করা যায়।

মক্কার ইহুদিরা রাসূলের ঘোরতর দুশমন ছিল, কিন্তু তারা প্রকাশ্যে সামনে আসতে চাইত না। মহানবি (সাঃ)র কারণে কুরাইশ সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তারা মনে মনে খুশি ছিল। তারা যখন শুনল— কুরাইশের কিছু লোক রেকানা কুস্তিগিরকে রাসূল (সাঃ)-এর  সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য উত্তেজিত করতে গিয়ে বিফল হয়েছে, তখন তাদের মনে এক শয়তানি খেয়াল চাপল।

একদিন রাতে রেকানা এক নির্জন গলি দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তার সামনে পড়ল এক ইহুদি যুবতি। চাঁদনি রাতে রেকানাকে চিনতে পেরে যুবতি খিলখিল করে হেসে উঠল। রেকানাও কম বর্বর ছিল না। সে দাঁড়িয়ে মেয়েটির রাস্তা আগলে ধরল।

‘তুমি হাসলে কেন?’

‘তুমি কি জানো না, মেয়েরা পুরুষকে দেখে হাসলে তার অর্থ কি হয়?’

রেকানা জিজ্ঞেস করল—’তুমি কে?’

‘আমি সাবাত বিনতে আরমান।’

‘ও, ইহুদি আরমানের মেয়ে!’ রেকানা মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে বলল—’তোমার কী আমার দেহ পছন্দ, না আমার শক্তি?’

‘তোমার দেহটা দশাসই ঠিক, তবে শক্তির বড়াই আর করো না। তুমি তো তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদকেও ভয় পাও!’

‘কে বলে আমি ভয় পাই?’ রেকানা গর্জে উঠে।

‘সবাই তো বলে!’ সাবাত ধীর কণ্ঠে বলল—’যদি তুমি মুহাম্মাদকে পরাজিত করতে পারো, তবেই আমি তোমাকে এ দেহ পুরস্কার দিতে পারি। হাতির মতো দেহধারী না-মরদ আমি মোটেই পছন্দ করি না।’

‘আমি আমার সন্তানের কসম দিয়ে বলছি! তোমার শর্ত পূরণ করেই আমি তোমার সামনে আসব।’ রেকানা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল—’কিন্তু তুমি ভুল শুনেছ, আমি মুহাম্মাদকে মোটেই ভয় পাই না। মূলত কথা হলো—আমি দুর্বলের সাথে লড়াই করা নিজের জন্য অপমানজনক মনে করি। কিন্তু তুমি যখন বলছ, তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করবই।’

এরপর রেকানা গেল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র কাছে। রাসূল (সাঃ)-কে লক্ষ করে বলল— ‘ভাতিজা! শুনলাম তুমি নিজেকে খুব শক্তিধর মনে করছ? তুমি নাকি নিজেকে আল্লাহর নবি মনে করো, আর নিজেকে নবি মনে করো বলে আমাদের চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবো? কিন্তু পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় শক্তি পরীক্ষায়। এসো, আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এসো! লড়াইয়ে যদি তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারো, তবে আমি তোমাকে আল্লাহর নবি মেনে নেব।’ সে রাসূল (সাঃ) কে যুদ্ধে প্রলুব্ধ করার জন্য আরও বলল—’আল্লাহর কসম! যদি তুমি আমাকে পরাজিত করতে পারো, তবে আমি তোমার ধর্ম গ্রহণ করব।’

মহানবি (সাঃ) উদ্‌বেগহীন কণ্ঠে বললেন—’কিন্তু চাচা, এটা তো শুধু চাচা- ভাতিজার কুস্তি নয়; এ লড়াই একজন মূর্তিপূজক এবং একজন সত্য দ্বীনের বার্তাবাহকের লড়াই হবে। যদি তুমি হেরে যাও, তবে তোমার ওয়াদা কিন্তু ভুলে যেতে পারবে না।’

মক্কার অলিগলিতে দাবানলের মতো দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, কুস্তিগির রেকানা ও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এই দুজন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। এ লড়াইয়ে যে হারবে, সে বিজয়ীর ধর্ম গ্রহণ করবে।

মক্কার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নারী-পুরুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে এসে জমায়েত হলো লড়াইয়ের ময়দানে। মূর্তিপূজক, ইহুদি, মুসলমান—সকলেই ময়দানে উপস্থিত। যদিও মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য, তবে তারা সবাই ছিল অস্ত্রসজ্জিত। কারণ, তারা ভয় করছিল, কুরাইশরা কুস্তির নাম করে রাসূল (সাঃ) -কে হত্যা করতে চাইছে।

.

লড়াই শুরু হলো।

একদিকে আরবের শ্রেষ্ঠ কুস্তিগির শক্তিধর রেকানা আবদে ইয়াজিদ এবং অন্যদিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবপ্রেমিক আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)। রেকানা রাসূলের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তেজিত ভাষায় গালাগালি শুরু করল। রাসূল (সাঃ) সম্পূর্ণ শান্তভাবে রেকানার চোখে চোখ রেখে তার গতিবিধি লক্ষ করতে লাগলেন, যেন সে আকস্মিক কোনো কৌশল অবলম্বন করে তাঁকে ঘায়েল করতে না পারে। রেকানা নবিজির চারপাশে এমনভাবে উন্মত্তের মতো ঘুরতে লাগল, যেন সে এক্ষুনি তাঁকে খেয়ে ফেলবে। দর্শকরা চারদিক থেকে তাকে উৎসাহ দিতে লাগল। মুসলমানরা চুপচাপ সব লক্ষ করছে আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। শেষে না জানি কী হতে কী হয়ে যায়—ভেবে চরম উৎকণ্ঠায় তাদের হাতগুলো সঙ্গের হাতিয়ারে চেপে বসেছে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কেমন কৌশল খেললেন? ইবনে আছির লিখেছেন—’রাসূলুল্লাহ (সাঃ)রেকানাকে পাকড়াও করে উঠিয়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। রেকানা আহত বাঘের মতো মাটি থেকে উঠে গর্জন করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে আক্রমণ করে বসল। তিনি আবারও আগের মতোই তাকে মাথার ওপর তুলে মাটিতে আছড়ে ফেললেন। রেকানা মাটি থেকে উঠার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তাকে তৃতীয়বারের মতো মাথায় তুলে দূরে ছুড়ে ফেললেন। স্থূলদেহী বীর তিন- তিনবার আছাড় খেয়ে কুস্তি লড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। কতক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে থাকল, তারপর কোনো রকমে উঠে মাথা নিচু করে লড়াইয়ের ময়দান থেকে বেরিয়ে গেল।’

পিনপতন নীরবতা নেমে এলো জনতার মাঝে। এতক্ষণের উল্লাসমুখর উন্মাত্ততা থেমে গেল আচমকা। প্রথমে মুসলমানরাও হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল! কিন্তু যখন ঘোর কেটে গেল, তখন মুসলমানরা খোলা তরবারি ও বল্লম মাথার ওপর তুলে তাকবির ধ্বনি দিতে লাগল।’

রাসূল (সাঃ) এ রেকানার কাছে গিয়ে বললেন—তোমার ওয়াদা এবার পূরণ করো। এখানে এই জনতার সামনেই এবার ঘোষণা করো তুমি মুসলমান হয়েছ।’

রেকানা লজ্জায় ও অপমানে মাথা নত করল ঠিক, কিন্তু ওয়াদামতো ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে বসল।

‘এই শক্তি কোনো শারীরিক শক্তি ছিল না।’ খালিদ মরূদ্যানের খেজুর বাগানে শুয়ে শুয়ে নিজের মনেই বলতে লাগল, রেকানাকে তিন-তিনবার আছাড় দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! আরবের কোনো বীরই আজ পর্যন্ত এমনটি পারেনি।

রাসূল (সাঃ)-এর  সেই অভাবিত দৃশ্য, সেই দৃষ্টিনন্দন ছবি খালিদের স্মৃতিপটে ভাসছে এখন। খালিদ ভেবে পায় না—সেই চিরচেনা মানুষটা হঠাৎ কেমন করে এমন বদলে গেল। তাঁর মন তখন বলছিল—যে মুহাম্মাদকে এতদিন চিনতাম, আজকের মুহাম্মাদ (সাঃ) তিনি নন; যেন অন্য কেউ। যাকে ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, জেনে আসছি, সে জানায় কত ফাঁক ছিল! নবুয়তের দাবির পর রাসূল (সাঃ)

-এর সঙ্গে কথাবার্তা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে আর কয়দিনের কথা! অথচ এ কয়দিনে একটি মানুষ কোথা থেকে কোথায় উঠে গেছে! সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছে অসাধারণ! গাছের ছায়ায় শুয়ে ভাবছে খালিদ, মাঝে মাঝে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার ইচ্ছে তো আমারও জাগত! কিন্তু আমি রেকানার মতো বীর ছিলাম না। আমি একজন সৈনিক 1 যুদ্ধের ময়দানে আক্রমণকারীর মুখোমুখি হওয়াই আমার কাজ; কুস্তি লড়া নয়। ফলে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মুখোমুখি কোনোদিন দাঁড়ানো হয়নি আমার।

কিন্তু লড়াইয়েই-বা কি অবস্থা হয়েছিল আমার! কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের যখন প্রথম যুদ্ধ হলো, সে সময় এমন অবস্থা হয়েছিল আমার, আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণই করতে পারিনি। সেজন্য কতই না আফসোস ছিল আমার! এ ছিল বদরের যুদ্ধ। যেখানে মাত্র তিনশো তেরোজন মুজাহিদ এক হাজার কুরাইশকে পরাজিত করেছিল! খবর পেয়ে সেদিন আমি দাঁতে দাঁত পিষেছিলাম।

কিন্তু আজ? আজ এই খেজুর বাগানে শুয়ে মনে পড়ছে, সেদিন পরাজয় বরণ করে আসা এক কুরাইশকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—’মুসলমানদের মধ্যে এমন কি গুণ ছিল, যার জন্য তারা বিজয় লাভ করল?’ সে আমার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

খালিদ উঠে বসল এবং আঙুল দিয়ে বালির ওপর বদর ময়দানের দৃশ্য, কুরাইশ ও মুসলমানদের অবস্থান এবং যুদ্ধের কৌশলগুলো রেখাচিত্রের সাহায্যে আঁকতে চেষ্টা করল। পিতার কাছ থেকে সে যুদ্ধের কলাকৌশল ও আঘাতের নিপুণতা ভালোই শিখেছিল। শৈশবেই পিতা তাঁকে অশ্ব চালনা, অস্ত্র চালনা শিক্ষা দিয়েছিলেন। কী করে দ্রুতগামী ও উদ্ধৃত ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা অল্প সময়েই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। যৌবনে তাঁর মতো চৌকস অশ্বারোহী মক্কা শহরে কমই ছিল। কেবল ঘোড়া নয়; উট চালনায়ও সে ছিল অতিশয় নিপুণ। পিতাই ছিল তাঁর উস্তাদ! তিনি তাঁকে শুধু সৈনিকের ট্রেনিংই দেননি; সেনাপতিত্ব করার কায়দা–কৌশলও শিখিয়েছিলেন। খালিদও যুদ্ধের ব্যাপারে বরাবরই ছিল প্রচণ্ড আগ্রহী। সব সময়ই সে যুদ্ধের পদ্ধতি ও কৌশল অতিশয় মনোযোগ সহকারে লক্ষ করত। যৌবনে যখনই সে সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছে, তখনই যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে।

বদরের যুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় তাঁর বিশেষ রকম আফসোস ছিল। কী করে এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া যায়, দীর্ঘদিন এ চিন্তা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। কিন্তু এখন তাঁর চিন্তাধারা বইছে ভিন্ন দিকে, ভিন্ন গতিতে। এ পরিবর্তন শুরু হয়েছে মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। এ চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু রাসূলে আকরাম; যিনি বীর রেকানাকে তিন- তিনবার পরাজিত করেছিলেন। যার নেতৃত্বে বদরের যুদ্ধে মাত্র তিনশো

তেরোজন মুজাহিদ পরাজিত করেছিল কুরাইশদের এক হাজার দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে। এটা যে কোনো মানবিক শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়, এর পেছনে কাজ করেছে অন্য কোনো শক্তি—এ কথা আর কেউ না বুঝুক, খালিদ আজ তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করছে।

বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা কুরাইশদের অনেক লোককে বন্দি করেছিল। এজন্য কুরাইশদের মনে যে অসহনীয় দুঃখ ছিল, তার একটা মন্দ প্রভাব খালিদকেও আচ্ছন্ন করেছিল। তাঁর মনে পড়ছে, যখন বদরের যুদ্ধ চলছিল, তখন মক্কার লোকেরা উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিল বদরের পথের দিকে। কখন ধূলিঝড় তুলে ছুটে আসবে কোনো অশ্বারোহী, শোনাবে বিজয়ের আনন্দময় বার্তা। পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মক্কাবাসীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এ যুদ্ধে পরাজয়ের বার্তা শুনতে হবে—এমন কোনো আশঙ্কা তাদের ছিল না। তারা শুধু পেরেশান ছিল এজন্য যে, বিজয়ের বার্তা আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন!

অবশেষে ঘোড়া নয়; দূর থেকে দেখা গেল এক উটের আরোহী এগিয়ে আসছে বদরের দিক থেকে। জনগণ দৌড়ে গেল তার কাছে। আরোহী আরবের প্রথা অনুযায়ী তার জামা ছিঁড়ে ফেলল এবং ক্রন্দন করতে থাকল। দুঃসংবাদ বহনকারী কাসেদ এমন নিয়মই পালন করে থাকে। যখন সবাই সমবেত হলো, তখন সে কেঁদে কেঁদে বলল—’বড়ো রকমের বিপর্যয় ঘটে গেছে, কুরাইশরা পরাজিত হয়েছে।’

যাদের আপনজন, আত্মীয়স্বজন যুদ্ধে গিয়েছিল, তারা একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পেছনে ফেলে আরোহীর কাছে এগিয়ে গিয়ে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকল—’অমুক কি বেঁচে আছে? অমুকের কী অবস্থা? কে কে আহত হয়েছে? কয়জন মারা গেছে?’ নানা প্রশ্নে ওরা ব্যতিব্যস্ত করে তুলল আরোহীকে।

যুদ্ধে নিহতদের মধ্যে সতেরোজন খালিদের বনু মাখজুম গোত্রের লোক ছিল। এদের সাথে ছিল খালিদের রক্তের সম্পর্ক। আবু জাহেল নিহত হয়েছে। খালিদের ভাই অলিদ বন্দি হয়েছে যুদ্ধে।

কুরাইশ সরদারদের প্রধান আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা সেখানে সকলের মাঝে উপস্থিত ছিল। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল—’হে সংবাদবাহক! আমার বাবা ও চাচাদের সম্পর্কে বলো।’

‘তোমার বাবা উতায়বা আলি ও হামজার হাতে নিহত হয়েছে, আর তোমার চাচা শায়বাকে হামজা একাই হত্যা করেছে। তোমার বেটা হানজালা আলির হাতে নিহত হয়েছে।’ কাসেদ সবিস্তারে বলল।

আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার চেহারা ক্ষোভে বিবর্ণ হয়ে গেল। সে আলি ও হামজা-কে উচ্চৈঃস্বরে গালি দিতে দিতে চিৎকার করে বলল—’আমি আমার বাবা, চাচা ও আমার সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নেবই নেব।’

আবু সুফিয়ান স্ত্রীর পাশে নীরব পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে শুনছিল— তার সম্প্রদায়ের নিদারুণ দুর্ভাগ্যের কাহিনি। এ খবর শুনে খালিদের রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। এ যুদ্ধে কুরাইশদের সত্তরজন নিহত আর প্রায় সমপরিমাণ বন্দি হয়েছিল।

খালিদ উঠে দাঁড়াল। বিছানার চাদর ঝেড়ে-গুছিয়ে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চড়ে বসল ঘোড়ায়। ঘোড়া ছুটল মদিনার দিকে।

খালিদ চিন্তা থেকে তাঁর মাথাকে মুক্ত করতে চাইল, কিন্তু আবেগের ঘোড়া এসে তাঁর চিন্তাস্রোতকে উড়িয়ে নিয়ে চলল ঝড়ের বেগে। তাঁর হৃদয়ের মরুভূমিতে শুরু হলো সাইমুম ঝড়। কখন আমি মদিনা পৌঁছব! কখন দেখা পাব প্রেমের নবির! ইয়াসরিব! না, না, মদিনা! যেখানে রয়েছেন রাহমাতুল্লিল আলামিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। যে মাটি আজ পরিণত হয়েছে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রভূমিতে।

হুজুর-এর কথা মনে পড়তেই তাঁর স্মৃতি আবার পলকে চলে গেল অতীতের জীবন্ত সব দৃশ্যের দিকে। তাঁর সামনে ভেসে উঠল সেই সব দৃশ্য, যেসব দৃশ্যের স্রষ্টা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।

তাঁর মনে পড়ল, স্বামী আবু সুফিয়ানকে হিন্দা বলছে—’আমি আমার বাবা ও চাচাকে ভুলতে পারি না। তুমি কি আমার কলিজার টুকরা হানজালাকে ভুলে যেতে বলো? মা তার আপন সন্তানকে কেমন করে ভুলে যাবে? আল্লাহর কসম! আমি আমার ছেলের খুনের বদলা নেব-ই। মুহাম্মাদকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। এর বদলা তাকে দিতেই হবে। কারণ, এ যুদ্ধ সে-ই বাধিয়েছে। আর হামজা ও আলির পাওনা আমি কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দেবো। ওদের নিস্তার নেই। কখনো ওরা ক্ষমা পেতে পারে না। কারণ, ওরা আমার বাপ-চাচা এবং সন্তানকে খুন করেছে। হিন্দার হৃদয়ে খুনির জন্য কোনো রহম নেই।’

‘হিন্দা! সন্তান কি কেবল তোমার, আমার নয়? এ আমি কী শুনলাম! আমার সন্তান সত্যি যদি বদরের প্রান্তরে খুন হয়ে থাকে, তাহলে আমি লাত ও মানাতের কসম খেয়ে বলছি! এ রক্তের বদলা আমি নেব-ই। এক্ষুনি আমার রক্ত গরম হয়ে উঠেছে আমার সন্তান হত্যার প্রতিবাদে।’ আবু সুফিয়ান হিন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন—’আমার সন্তানের খুনের বদলা নেওয়া আমার জন্য ফরজ হয়ে গেছে। সবার আগে আমি মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে বিরাট এক বাহিনী গড়ে তুলতে চাই, যে বাহিনী আগামীতে এই বিপর্যয়ের ক্ষতি সুদে-আসলে আদায় করতে পারবে।’

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও লেখক আল ওয়াকেদি লিখেছেন—’আবু সুফিয়ান দেশের সমস্ত সরদার ও নেতাদের ডাকলেন পরামর্শের জন্য। এই সরদারদের বেশিরভাগ ছিল যারা কোনো না কোনো কারণে বদরের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি, কিন্তু তাদের কোনো কোনো আত্মীয় ও আপনজন বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তাদের বুকে তখনও ধিকিধিকি জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। সে আগুনকে আরও উসকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ান এ বৈঠকের আয়োজন করেছে, যেন সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তারা আরও বলিষ্ঠ ও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে পারে।’

আবু সুফিয়ান বললেন-’এরপরও কি আমার আর বেশি কথা বলার প্রয়োজন আছে? আমার এক তরুণ ছেলে মারা গেছে। যদি আমি তার প্রতিশোধ না নিতে পারি, তবে আমার বেঁচে থাকার কী মানে আছে?’

খালিদের চাচাতো ভাই আবু জাহেলের ছেলে আকরামা উত্তেজিত হয়ে বলল— ‘কুরাইশদের এমন বেইজ্জতির পরও কি আমরা চুপ করে বসে থাকব? সাফওয়ান বিন উমাইয়ারা কি কুরাইশদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা চিন্তা করবে না? স্বজাতির এ দুর্দিনে ওয়ালিদের সন্তানেরা কি চুপ করে থাকবে?’

আবু সুফিয়ান বলল—’আমরা এখানে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে আসিনি।’ খালিদ! তোমার এমন কথা বলা উচিত হয়নি, যাতে অন্য কেউ অপমান বোধ করে।’

খালিদ বলল—’আমাদের মধ্যে আজ আর কোনো সম্মানিত ব্যক্তি বেঁচে নেই। আমরা কেউ সে পর্যন্ত সম্মানিত হতে পারব না, যে পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নির্মূল না করতে পারি। আমার ঘোড়ার লাগামের কসম! কসম আমার টকটকে লাল রক্ত আর রক্তিম চক্ষুদ্বয়ের! কেবল মুসলমানদের রক্তই এই চোখ শীতল করতে পারে।’ খালিদ আরও বলল—’আমি জানি, এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে নেতারা এখন এগিয়ে যাবেন। যুদ্ধের ময়দানে আমি কোথায় থাকব তা-ও আমি জানি। আমি ওয়াদা করছি, এ যুদ্ধে সেনাপতির আদেশ আমি মেনে চলব, কিন্তু যদি মনে করি—সেনাপতি আমাকে যে আদেশ করছেন তাতে আমাদের ক্ষতির আশঙ্কা আছে-তাহলে সে আদেশ আমি অমান্য করতে দ্বিধা করব না।’

বৈঠকে সবাই একমত হয়ে আবু সুফিয়ানকে সরদার মনোনীত করল।

কয়েক দিন আগের কথা। ফিলিস্তিন থেকে মক্কাবাসীদের একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা মক্কায় ফিরে আসে। এই কাফেলায় মক্কাবাসী বিশেষ করে কুরাইশদের সকল বংশেরই মালামাল ছিল। কাফেলায় ছিল কমপক্ষে এক হাজার উট এবং এসব উটে বোঝাই ছিল বিপুল অর্থের মালামাল। কাফেলার সরদার ছিলেন আবু সুফিয়ান।

কাফেলা ফেরার পথে আবু সুফিয়ানের মনে হলো—মদিনার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় যদি মুসলমানরা আক্রমণ করে এসব মালামাল ছিনিয়ে নেয়? আতঙ্কিত আবু সুফিয়ান মক্কায় এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে সাহায্য চেয়ে পাঠাল। তখন তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো এক বিশাল বাহিনী। এ বাহিনীই বদর প্রান্তরে মুসলমানদের তিনশো তেরোজনের এক ক্ষুদ্র বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। বদরের এ পরাজয়ে মক্কার পরিবেশ হয়ে উঠল বেদনাবিধুর।

খালিদের অশ্ব আপন গতিতে ছুটে চলেছে মদিনার দিকে, কিন্তু খালিদের চিন্তাস্রোত ঘুরপাক খাচ্ছে ফেলে আসা দিনগুলোর ঘটনাবহুল জীবনের পরতে পরতে। মনে পড়ছে তাঁর, কুরাইশরা প্রতিশোধের পরিকল্পনা তৈরি করতে সকলে একত্রিত হয়েছে। তারা সেদিন যে যা বলেছিল, সব যেন খালিদ এখনও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

‘যদি তোমরা আমার নেতৃত্বে কাজ করতে চাও, তবে আমার সকল সিদ্ধান্ত তোমাদের মেনে নিতে হবে। আবু সুফিয়ান বললেন—আমার প্রথম সিদ্ধান্ত হলো—এবারের ব্যবসায় যে ৫০ হাজার দিনার লাভ হয়েছে, সে অর্থ পাওনাদারদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করা হবে না। লাভের এ সমুদয় অর্থ যুদ্ধ ফান্ডে জমা করা হবে এবং এ অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা হবে এমন এক বাহিনী, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধে অংশ নেবে। আমার এই সিদ্ধান্ত কি আপনারা সবাই মানতে রাজি আছেন?’

সকলের আগে এর জবাব দিয়েছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ। বলেছিল—’হ্যাঁ, আমি রাজি আছি।’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চারদিক থেকে আওয়াজ উঠল—’তা-ই করা হোক, তা-ই করা হোক।’

আবু সুফিয়ান আবার বললেন, ‘আমার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হলো—বদর যুদ্ধে আমাদের যে সকল লোক মারা গেছে, তাদের জন্য সবাই আহাজারি করছে। আমি মেয়েদের করুণ সুরে বিলাপ করতে এবং পুরুষদের কাঁদতে শুনেছি। আল্লাহর কসম! যখন মানুষের চোখের পানি ঝরে যায়, তখন প্রতিশোধের আগুন নিভে ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই আজ থেকে বদরের নিহতদের জন্য কেউ আর শোক করতে পারবে না।

আমার তৃতীয় সিদ্ধান্ত—বদর যুদ্ধে আমাদের যে সকল লোককে মুসলমানরা বন্দি করে নিয়ে গেছে, তাদের মুক্তির জন্য কোনো চেষ্টা করা হবে না। তোমরা সবাই জানো, মুসলমানরা বন্দিদের মুক্তিপণ নির্ধারিত করে ফেলেছে। জনপ্রতি এক হাজার হতে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত মুক্তিপণ ধার্য করেছে। আমরা মুসলমানদের একটি দিরহামও দেবো না। কারণ, সে অর্থ ওরা আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে।’

আবু সুফিয়ানের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল সবাই। ঘোড়ার পিঠে বসে সে কথা মনে হতেই খালিদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেল। চেহারায় ফুটে উঠল একধরনের যন্ত্রণা ও ক্রোধ। সেই রাগ ছড়িয়ে পড়ল তাঁর সমস্ত অস্তিত্বে। তাঁর রাগের অনেক কারণ ছিল। সিদ্ধান্ত ছিল মুসলমানদের কাছে কেউ বন্দি মুক্ত করতে মদিনা যাবে না। কিন্তু দেখা গেল, গোপনে একজন মদিনা গিয়ে ফিদিয়া দিয়ে তার পিতাকে মুক্ত করে নিয়ে এলো। এর প্রভাব পড়ল অন্যদের ওপর। এরপর দেখা গেল, প্রতি সপ্তাহে কুরাইশদের কেউ না কেউ গোপনে মদিনা চলে যাচ্ছে আর আপনজনকে মুক্ত করে নিয়ে ফিরে আসছে; এমনকী আবু সুফিয়ান নিজেও নিজের আদেশ লঙ্ঘন করে বসল!

খালিদের সহোদর ভাই অলিদও মুসলমানদের কাছে বন্দি ছিল। যদি কুরাইশের অনেক বন্দিকে সে সময় মুক্ত করে আনা না হতো, তবে খালিদ তাঁর ভাইকে মুক্ত করতে কখনো যেত না। সবাই বন্দিদের মুক্ত করে আনছে দেখে তাঁর অন্যান্য ভাইরা তাকে বলল—’ভাই, অলিদের মুক্তির জন্য তুমি সেখানে যাও!’ খালিদ তাঁর ব্যক্তিত্বকে খাটো করবে না—এই সিদ্ধান্তেই অটল ছিল। কিন্তু তাঁর মনে পড়ল, রাসূলে করিম (সাঃ) তো তাদেরই গোত্রের লোক, আর যারা তাঁর অনুসারী হয়েছে, সবাই তো তাদেরই লোক। তারাও কুরাইশ এবং মক্কার বাসিন্দা ছিল। তারা তো আর আকাশ থেকে নেমে আসেনি। তারা এমন কোনো শক্তিধর ছিল না যে, তিনশো তেরোজনে এক হাজার যোদ্ধাকে পরাস্ত করবে? এখন তাদের মধ্যে কী এমন শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে যে আমাদের দুর্বল করে আমাদের কাছ থেকে নির্ধারিত মুক্তিপণ আদায় করছে?

খালিদ এই চিন্তাই করছে—’তাঁকে একনজর দেখব। মুহাম্মাদকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করব।’ সে চার হাজার দিরহাম সঙ্গে নিল। কারণ সে জানত, বনু মাখজুম গোত্রের সরদার ওয়ালিদের পুত্রের মুক্তিপণ চার হাজার দিরহামের কম হবে না।

ঠিক তাই হলো। সে যখন মুসলমানদের কাছে গিয়ে তাঁর ভাইয়ের মুক্তির আবেদন করল—তখন যিনি বন্দিদের মুক্তি ও মুক্তিপণ আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি বললেন—’এর মুক্তিপণ চার হাজার দিরহাম। মুক্তিপণ দিয়ে তুমি তোমার ভাইকে নিয়ে যাও।’

খালিদের ভাই হিশাম আবেদনের সুরে বলল—’আমি মুক্তিপণের ব্যাপারে আরেকটু বিবেচনা করতে বলছি। তোমরা তো আমাদেরই লোক। অতীতের আত্মীয়তার কথা মনে করো।’

তিনি বললেন—’এখন আর আমরা তোমাদের কেউ নই। আমরা এখন আল্লাহর রাসূলের অনুসারী, তাঁরই অনুগত।’

‘আমরা কি তোমাদের রাসূলের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ হিশাম বলল।

খালিদ গর্জে উঠে বলল—’হিশাম! আমি আমার ভাইকে আত্মসম্মানের ওপর কুরবানি করেছিলাম। কিন্তু তুমি যখন সঙ্গে এলে, তখন এরা যা দাবি করছে তা-ই দিয়ে দাও। আমি মুহাম্মাদের সামনে গিয়ে করুণার জন্য হাত পাততে পারব না।’ সে দিরহামের থলিটি মুসলমানের সামনে ছুড়ে দিলো—’গুনে নাও আর আমার ভাইকে ছেড়ে দাও।’

সাহাবি মুক্তিপণ বুঝে পেয়ে অলিদকে হিশাম ও খালিদের হাতে তুলে দিলো। তিন ভাই তখনই মক্কা অভিমুখে যাত্রা করল। রাস্তায় দুই ভাই অলিদকে তাদের পরাজয়ের কারণ জিজ্ঞেস করল। তাদের ভরসা ছিল, অলিদ একজন লড়াকু বংশের যুবক হিসেবে যুদ্ধে কুরাইশদের ভুল চাল ও কৌশল সম্পর্কে নিপুণভাবে ত্রুটিগুলো বর্ণনা করতে পারবে। কিন্তু অলিদ তাদের প্রশ্নের জবাবে কিছু না বলে সামান্য একটু মুচকি হাসল শুধু। ভাবখানা এমন—এর পেছনে যে গোপন রহস্য আছে, তা সে কাউকে বলতে চায় না।

খালিদ অধৈর্য হয়ে তাকে আবার তাগাদা দিলো। ‘অলিদ, তুমি কিছু তো বলো! আমাকে যে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হবে। কুরাইশের সমস্ত সরদাররা আবার কোমর বেঁধে নেমেছে। আশেপাশের সমস্ত সম্প্রদায়কেও আমরা একত্রিত করছি, তারা সবাই মক্কায় এসে শামিল হতে শুরু করেছে।’

‘সমস্ত আরবকে একত্রিত করলেও তোমরা মুসলমানদের পরাজিত করতে পারবে না। আমি এ কথা বলছি না যে, মুহাম্মাদের হাতে কোনো জাদু আছে। কিংবা ভেব না, আমি তাঁর নতুন বিশ্বাস সত্য বলে মেনে নিয়েছি। এটাও ভেব না, আমি তাঁর বন্দি হয়ে তাঁকে অপছন্দ করি না।’

‘কিন্তু তোমার জবান তো বলছে, তুমি নিজ সম্প্রদায়ের কাছে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হয়েছ।’ হিশাম বলল—’বিশ্বাসঘাতক হও আর যা-ই হও, সেই ইহুদি নেতার কথাই ঠিক, মুহাম্মাদের কাছে কোনো নতুন বিশ্বাস বা ধর্ম নেই; তাঁর কাছে আছে নতুন কোনো জাদু।’

‘হ্যাঁ, তাঁর কাছে নতুন কোনো জাদুই আছে; নইলে কুরাইশরা কখনো পরাজয় বরণ করতে পারে না।’ খালিদ বলল।

অলিদ যেন তাদের কথা শুনতেই পাচ্ছে না, তার ঠোঁটে খেলা করছে মৃদু হাসির আভা। সে বারবার ঘুরে মদিনার দিকে তাকাচ্ছিল।

মদিনা থেকে বেশ খানিকটা দূরে জিল হালিফা নামে এক স্থান, তিন ভাই সেখানে পৌঁছল। ততক্ষণে বেশ রাত নেমে এসেছে। তিন ভাই রাত কাটানোর জন্য সেখানেই তাঁবু গাঁড়ল।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, দেখল অলিদ নেই। তার ঘোড়াও নেই সেখানে। খালিদ ও হিশাম চিন্তা করে শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল, অলিদ অবশ্যই মদিনা চলে গেছে। কারণ, তারা লক্ষ করেছে, মুক্ত হওয়ার পরও তার মধ্যে আনন্দের কোনো আভাস লক্ষ করা যায়নি। সে যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, তার ভেতরে কীসের যেন ঝড় বইছে। জিন-ভূতের আছরের মতোই কোনো আকর্ষণ টানছে ওকে। তখন তার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততার দ্যুতি খেলা করছিল। সব মুসলমানই কি এই অজানা আকর্ষণের পেছনে ছুটছে!

অলিদকে ছাড়াই দু-ভাই মক্কা ফিরে এলো। কিছুদিন পর তারা খবর পেল, অলিদ মুহাম্মাদকে আল্লাহর সত্য রাসূল (সাঃ) বলে মেনে নিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। রাসূল (সাঃ)-এর  বাণী, ব্যবহার ও ব্যক্তিত্ব তাকে এতই মুগ্ধ করেছে যে, শেষে রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলাম গ্রহণ করে সে আত্মাকে তৃপ্ত করেছে। ইতিহাসবিদগণ লিখেছেনে—’অলিদ বিন ওয়ালিদ রাসূল-এর খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন এবং কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।’

খালিদের সে সময় খুবই রাগ হয়েছিল। একে তো তাঁর ভাই গেল, তার ওপর চার হাজার দিরহামও গেল। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খালিদের আক্রোশ আরও বেড়ে গেল। খালিদ ও তাঁর ভাইয়েরা মুক্তিপণ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করলে অলিদ রাসূলে করিম (সাঃ)-কে বলল—’আমি যুদ্ধবন্দি হিসেবে আপনার কাছে আসিনি; এসেছি স্বেচ্ছায়। মুক্তিপণ নিয়ে আপনারা যখন আমাকে ফেরত দিয়েছিলেন,

তখনই মুক্তিপণের হিসাব চুকে গেছে। আমি জেনে এসেছি, কুরাইশরা মুসলমানদের সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুতরাং একটি দিনার দিয়েও তাদের সাহায্য করার কোনো অবকাশ নেই।‘

মরুভূমি মাড়িয়ে খালিদ মদিনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দূর দিগন্তে ভেসে উঠল এক পাহাড়ের আবছা দৃশ্য। জায়গাটা চিনতে পারল খালিদ। ওটাই উহুদের পাহাড়ি অঞ্চল। মদিনা থেকে মাত্র চার মাইল উত্তরে। খালিদ বালিয়াড়ির উঁচু-নিচু টিলার ওপর দিয়ে ক্রমাগত চলেছে।

‘উহুদ! উহুদ!’ খালিদের মুখ থেকে অস্ফুট বাক্য বেরিয়ে এলো, ‘আমি আবু সুলাইমান!’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্মৃতিপটে ফুটে উঠল এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মারকাট আর্তনাদ। অসংখ্য ঘোড়ার পদধ্বনি ও তলোয়ারের ঝনঝনানি শুনতে পেল সে। খালিদ এ যুদ্ধে লড়াই করার জন্য ছিল ব্যাকুল, বেকারার। যুদ্ধে সে লড়াই করার সুযোগও পেয়েছিল।

খালিদের স্মৃতি চার বছর পেছনে সরে গেল। চার বছর। হ্যাঁ, মাত্র চার বছর আগেই ঘটেছিল এই লোমহর্ষক ঘটনা। ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস। তৃতীয় হিজরির সাওয়াল মাস। কুরাইশরা মদিনার ওপর আক্রমণ করার জন্য যে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করছিল, তারা সবাই মক্কায় একত্রিত হয়েছে। তিন হাজার যোদ্ধার বিশাল বাহিনী। তার মধ্যে সাতশো ছিল নিয়মিত সামরিক সেনা। অশ্বারোহী দুই শতাধিক। যুদ্ধের মাল-সামান ও খাদ্যদ্রব্য তিন হাজার উটের পিঠে চাপানো হলো। সৈন্যরা সবাই অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রস্তুত।

খালিদের স্মৃতিপটে আজও এ ঘটনা যেন জীবন্ত। এত সৈন্য দেখে খালিদের মন খুশিতে ভরপুর! এতদিনের প্রতিশোধের আগুন নেভানোর সময় এসে গেছে। সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ান! খালিদ সেনাদলের এক অংশের কমান্ডার। তাঁর বোন সেনাবাহিনীর সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। এ ছাড়াও এসেছে চৌদ্দজন মহিলা। এদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাও রয়েছে। আরও আছে উমর বিন আস ও আবু জেহেলের ছেলে আকরামের স্ত্রী। মহিলারা সবাই সৈন্যদের উজ্জীবিত করার জন্য গান-বাজনার সামগ্রী সাথে নিল। তারা ঢোল ও দফের বাজনার তালে তালে জ্বালাময়ী গান ধরল। মেয়েদের কাজই ছিল এই। তারা প্রেরণাদায়ক গান গেয়ে সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করবে আর বদরের যুদ্ধে যারা মারা গেছে, তাদের স্মৃতি জাগিয়ে তুলবে।

খালিদের স্মৃতিপটে ভেসে উঠল আফ্রিকার হাবশি কৃতদাস ওয়াহশি বিন হারবের কথা। সে ছিল কুরাইশ গোত্রের সরদার জুবায়েরের কৃতদাস। প্রকাণ্ডদেহী কালো রঙের এ হাবশি ছিল অসম্ভব শক্তিধর। বর্শা চালনায় সে ছিল অতিশয় নিপুণ ও খ্যাতিমান। তাঁর কাছে ছিল আফ্রিকার তৈরি নিজস্ব বর্ণা। তাঁর আফ্রিকান নাম থাকলেও যুদ্ধের নিপুণতা দেখে জুবায়ের তাকে আরবি নাম দিয়েছিল।

যুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার আগে জুবায়ের তাকে বলল—’বিন হরব! দেখ, আমার চাচার হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে! সম্ভবত আমার সুযোগ না-ও হতে পারে। আমার চাচাকে মুহাম্মাদের চাচা হামজা হত্যা করেছে। যদি তুমি হামজাকে হত্যা করতে পারো, তবে তোমাকে আমি মুক্ত করে দেবো।’

‘হামজা আমার বর্শার আঘাতে মারা যাবে, কথা দিলাম প্রভু!’ ওয়াহশি বলল। হাবশি গোলাম মহিলারা যে উটের ওপর আরোহণ করেছিল, সেদিকে চলে গেল।

‘আবু ওসামা।’ কোনো এক মহিলার স্বর ভেসে এলো। এটা ছিল ওয়াহশি বিন হারবের আরেক নাম। সে থেমে গেল এবং দেখল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তাকে ডাকছে। সে তার কাছে এগিয়ে গেল।

হিন্দা ধীরে ধীরে বলল—’আবু ওসামা! অবাক হচ্ছো না! তোমাকে আমিই ডাকছি। আমার বুকটা প্রতিশোধের জ্বালায় পুড়ে যাচ্ছে! তুমি কি প্ৰতিশোধ নিয়ে আমার বুক শীতল করবে, আমাকে একটু শান্তি দেবে?

‘মহিয়সী, আদেশ করুন! আপনি আমার প্রভুর সেনাপতির বেগম! আপনার জন্য জীবন দিয়ে দেবো। বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’

হিন্দা বলল—’তুমি তো হামজাকে ভালোমতোই চেনো! বদরের যুদ্ধে আমার পিতাকে হামজা হত্যা করেছে। এদিকে দেখ! আমার শরীর ভরা সোনার গহনা, যদি তুমি হামজাকে হত্যা করতে পারো, তবে এগুলো সবই তোমার হবে।

ওয়াহশি হিন্দার গহনার দিকে তাকিয়ে হাসল। সদম্ভে ঘোষণা করল—’আমিই হব হামজার হত্যাকারী, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

খালিদ তাঁর নিজস্ব বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করছিল। এ রাস্তা ধরেই তাঁর বাহিনী সেদিন মদিনার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। উঁচু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সে তাঁর সৈন্যদের দেখছিল। গর্বে ফুলে উঠল তাঁর বুক। মদিনার মুসলমানদের জন্য তাঁর করুণা হলো, কিন্তু সে করুণাও তাঁকে দিচ্ছিল অপার আনন্দ। এ লড়াইয়ের সাথে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের নিধন করার বিরাট সংকল্প কাজ করছিল তাঁর ভেতরে।

উহুদ যুদ্ধের অনেক দিন পর তারা প্রথম জানতে পারে, মক্কায় কুরাইশরা যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সে সময় প্রতিমুহূর্তে তাদের তৎপরতা ও অগ্রগতির প্রতিটি খবর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র কাছে পৌঁছে যেত। যখন মদিনা আক্রমণের জন্য তারা রওনা দিয়েছিল, তখনই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)জানতেন তারা কতজন, কী ধরনের অস্ত্র ও বাহন নিয়ে রওনা দিয়েছে। তারপর তারা যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনও তাদের গতিবিধি ও অগ্রগতির খবর অনবরত পাচ্ছিলেন তিনি। মক্কা থেকে কুরাইশ বাহিনীর যাত্রা ও অগ্রগতির এ সকল খবর নবিজির কাছে পৌঁছে দিতেন হজরত আব্বাস।

কুরাইশের সম্মিলিত সেনাবাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে পৌঁছে মদিনা থেকে সামান্য দূরে উহুদ পাহাড়ের কাছে এমন স্থানে ঘাঁটি গেড়েছিল, যেখানে ময়দান ছিল সবুজে ভরা। ছিল পানির মজুদ। খালিদের জনা ছিল না, মুসলমানদের দুজন গোয়েন্দা এদের সমস্ত তৎপরতার খবর রাসূলকে পৌঁছে দিচ্ছেন।

.

৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ।

রাসূলে করিম (সাঃ) মুজাহিদ বাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন। মুজাহিদরা শায়খিন নামক এক পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে অবস্থান নিল।

এ যুদ্ধে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজার, এর মধ্যে মাত্র ১০০ জন ছিল যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত। ঘোড়া ছিল সাকুল্যে দুটি—একটি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে, অন্যটি এক মুজাহিদদের নিকট।

এ সময় প্রথম মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টির এক ভয়াবহ চেষ্টা হয়। মদিনার বিভিন্ন গোত্রের এমন কিছু লোকও ইসলাম গ্রহণ করেছিল, যারা সত্যিকার অর্থে ঈমানদার ছিল না। কিছুটা হুজুগে মেতে, কিছুটা নতুন ধর্ম দেখার লোভে এরা মুসলমান হয়েছিল। রাসূলে মকবুল এদের বলেছেন মুনাফিক। সে সময় কে সঠিক মুসলমান আর কে মুনাফিক-এটা বোঝা খুব সহজ ছিল না। মুজাহিদরা মদিনা থেকে যখন শায়খিন পাহাড়ের দিকে রওনা হলো, তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই রাসূল (সাঃ)-এর  সাথে তর্ক জুড়ে দিলো। বলল—’কুরাইশ সৈন্য মুসলিম বাহিনীর তিনগুণ, এজন্য মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করা সমীচীন হবে না।’

হুজুর মুজাহিদ বাহিনীর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মত নিলেন। অধিকাংশই শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পক্ষে মত দিলো। নবি করিম (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের মত পছন্দ করলেও অধিকাংশের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের সিদ্ধান্তই মেনে নিলেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দিলেন। আব্দুল্লাহ বিন উবাই শহর ছেড়ে বাইরে যেতে অস্বীকার করল। আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিল যথেষ্ট প্রভাবশালী লোক। সে মুসলিম বাহিনী থেকে সরে দাঁড়ালে তিনশো লোক তাকে অনুসরণ করল। এরাই মুনাফিক বলে চিহ্নিত হলো। আব্দুল্লাহ বিন উবাই হলো তাদের দলনেতা।

এতক্ষণ ৩ হাজার কুরাইশের মোকাবিলায় ছিল এক হাজার মুজাহিদ। এখান থেকে ৩০০জন সরে পড়ায় সাতশো মুজাহিদকেই এগিয়ে যেতে হলো কুরাইশদের মোকাবিলায়। হৃদয় তাদের এতটুকু টলল না। রাসূলূল্লাহ এর নেতৃত্বে জিন্দাদিল মুজাহিদরা উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শায়খিন প্রান্তরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল শত্রুর মুখোমুখি। খালিদ একটি উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে মুসলমানদের সারিবদ্ধ হওয়ার দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করল। কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে সেনাপতি আবু সুফিয়ানকে সবকিছু রিপোর্ট করে নিজের জায়গায় চলে গেল খালিদ।

দীর্ঘ এক হাজার গজ এলাকা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল মুজাহিদরা। একপাশে পাহাড়, অন্যপাশ উন্মুক্ত, ফাঁকা। রাসূলে করিম (সাঃ) পঞ্চাশজন তিরন্দাজকে পাহাড়ের ওপর সতর্ক পাহারায় বসিয়ে দিলেন। এদের কমান্ডার নিযুক্ত করলেন আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে নির্দেশ দিলেন—’তোমার দায়িত্ব বুঝে নাও, আব্দুল্লাহ! তোমরা পেছনের দিকটায় সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। শত্রুরা পেছন দিক দিয়ে ঢুকে পড়লে আমরা মহাবিপদে পড়ে যাব। শত্রুদের অশ্বারোহী বাহিনী রয়েছে, আমাদের নেই। শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনী এগিয়ে এলে তিরন্দাজদের লাগিয়ে দেবে তাদের মোকাবিলায়। সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। পদাতিক বাহিনী নিয়ে তেমন কোনো ভয় নেই।’

প্রায় সকল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক, বিশেষ করে ইবনে হিশাম ও ওয়াকেদি লিখেছেন—’রাসূল (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘শুধু আমাদের পেছনের দিকটার হেফাজতের জিম্মা তোমার। এদিকে জাগ্ৰত দৃষ্টি রাখবে। তোমার সামান্যতম ত্রুটি আমাদের শোচনীয় পরাজয় ডেকে আনতে পারে। স্মরণ রেখ আব্দুল্লাহ! জয়-পরাজয় কোনো অবস্থাতেই তোমরা তোমাদের অবস্থান ছাড়বে না। যদি দেখ শত্রুর আক্রমণে আমরা কাবু হয়ে পড়েছি, তবু তোমরা আমাদের সাহায্যের জন্য ছুটে আসবে না। কোনো অবস্থায়ই তোমরা নিজের অবস্থান থেকে এক পা-ও নড়বে না।

পাহাড়ের এই উঁচু চূড়া যেন কখনো শত্রুর করায়ত্ত না হয়। এই উঁচু জায়গা তোমাদের। এখান থেকে নিচের সমস্ত এলাকা তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যে পর্যন্ত তিরন্দাজদের তিরের নিশানা পৌঁছে যায়।’

খালিদ মুসলমানদের সামরিক ব্যুহ লক্ষ করে আবু সুফিয়ানকে বলল—’মুসলমানরা খোলা ময়দানে লড়াই করবে না।’

অগনিত সৈন্যের বিশালতার গর্ব ছিল আবু সুফিয়ানের। তিনি চাচ্ছিলেন খোলা ময়দানে বা বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত হয়ে লড়াই করতে—যাতে পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে দলিত-মথিত করা যায়।

খালিদকে তাঁর বাবা যুদ্ধের নানা রকম কৌশল ও নৈপুণ্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই শত্রুর ওপর অতর্কিত আক্রমণ, পাশ থেকে কিংবা পেছন থেকে আক্রমণ, শত্রুকে আবর্তন করে আঘাত করা ইত্যাদি সবকিছুই শিখিয়েছিলেন। কী করে নিজের অবস্থানের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়, কী করে স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিপুল সংখ্যক বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়—এমন সব বিষয়েই প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ ও পরীক্ষিত সালারের দৃষ্টি নিয়ে তিনি মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থান ও ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করলেন। তিনি অনুভব করলেন, যুদ্ধের নৈপুণ্যে এবারও মুসলমানরা শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে পারে। আবু সুফিয়ান তার সৈন্যদের মুসলমানদের মুখোমুখি নিয়ে গেল। অশ্বারোহীদের পাঠাল মুসলমানদের পাশ থেকে আক্রমণের জন্য। একপাশ দিয়ে খালিদ অন্যপাশ দিয়ে আকরামা এগিয়ে গেল। দুজনের সাথেই একশো করে অশ্বারোহী। অশ্বারোহী বাহিনীর মূল কমান্ডার উমর বিন আস। আবু সুফিয়ান সরাসরি সামনে এগোলো পদাতিক বাহিনীর একশো তিরন্দাজ নিয়ে। কুরাইশদের পতাকা তুলে দিলো তালহা বিন আবু তালহার হাতে। যুদ্ধের ময়দানে এ পতাকার মূল্য প্রাণের চেয়েও অধিক। পতাকার পতন হলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যায় এবং ময়দান ছেড়ে পালাতে শুরু করে সকল সৈন্য।

যুদ্ধের সূচনায় কুরাইশদের ব্যুহ থেকে আবু আমের ফাসিক অগ্রসর হয়ে মুজাহিদদের কাছে গেল। তার পেছনে কতক দাস। আবু আমের ছিল মদিনার বাসিন্দা আউস গোত্রের সরদার। রাসূলে করিম (সাঃ) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা চলে এলেন, তখন আবু আমের রাসূল (সাঃ) এ সহ সকল মুসলমানকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করবে বলে কসম খেয়েছিল। এক সুন্দরী ইহুদি ও ইহুদিদের ধন-সম্পদের লোভ তার ওপর জাদুর মতো প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল।

ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় ইহুদিরা ছিল সব সময় এক পায়ে খাঁড়া; যদিও প্রকাশ্যে তারা মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। আবু আমের ছিল তাদের হাতে কাঠের পুতুল। তারাই তাকে কুরাইশদের মিত্র হিসেবে তৈরি করে রেখেছিল।

মুজাহিদরা লড়াইয়ের জন্য মদিনা থেকে বেরিয়ে এলে আবু আমের দ্রুত গিয়ে কুরাইশদের দলে যোগ দেয়। তার গোত্রের বহু লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে কুরাইশদের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল ময়দানে। আবু আমের সামনে অগ্রসর হয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলতে লাগল—’আউস গোত্রের নির্লজ্জ বীরেরা! তোমরা আমাকে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ? আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে নাও। আর…’ সে তার উত্তেজিত ও উসকানিমূলক কথা শেষ করার আগেই মুজাহিদদের মধ্য থেকে আউস গোত্রের এক লোক গর্জে উঠে বলল- ‘ফাসিক! তোমার জবান সংযত করো, আমরা তোমার নামের ওপর থুতুও ফেলি না, সাহস থাকে তো…’

খালিদের মনে পড়ল সে সময়ের কথা। আবু আমের কথা থামিয়ে তার দিকে একটি পাথর ছুড়ে মারল। মুজাহিদদের সারি থেকে আবু আমের ও তার দাসদের ওপর শুরু হলো পাথর বর্ষণ। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন—’পাথর বর্ষণকারী লোকেরা সবাই ছিল আউস গোত্রের।’ আবু আমের ও তার সঙ্গীরা পাথরের আঘাত খেয়ে পেছনে পালাল।

ইহুদিরা মদিনায় বসে যুদ্ধের খবরাখবর নিচ্ছিল। যে ইহুদি রমণীর রূপের জাদুতে আবু আমের বন্দি ছিল, সে সুখবর শোনার জন্য ছিল অধীর আগ্রহী। সে জনতে পারল, তার রূপের মোহে মোহগ্রস্ত যুবক মুসলমানদের পাথরের ঘা খেয়ে জর্জরিত হয়েছে!

আবু আমের ফাসিকের এই ঘটনা ঘটার আগেই কুরাইশ মহিলারা সৈন্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে বদর যুদ্ধে নিহতদের কথা স্মরণ করে উদ্দীপনাময় গীত গাওয়া শুরু করে দিলো। সে গান শোনামাত্র যে কারও রক্ত গরম হয়ে উঠত

মহিলাদের পেছনে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলো আবু সুফিয়ান। তখন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে গাইছিল নিদারুণ ব্যথাভরা প্রাণস্পর্শী গান। তাতে উদ্দীপনার সাথে ছিল নির্লজ্জতার ছড়াছড়ি। ছিল নর-নারীর যৌন সম্ভোগের কথা। গানের মধ্যে যে আবদুদ্দারের উল্লেখ আছে, তা বনু উমাইয়ার একটি শাখা। বনু আবদুদ্দার কুরাইশের অনেক উচ্চ বংশের নাম। ইতিহাস লেখকগণ তার পূর্ণ গীতটি লিখতে পারেননি। যেটুকু লিখেছেন তা এ রকম—

‘হে আবদুদ্দারের সন্তানগণ!
হে আমাদের গৃহের অনুগামী!
আমরা তোমাদের রাতের রানি।
আমরা বালিশের মাঝে সঞ্চারণ করি,
এই সঞ্চালনে আনন্দ ও মজার সৃষ্টি হয়,
যদি তোমরা শত্রুর ওপরে বিজয় লাভ করো
তোমাদের আমরা তুলে নেব আমাদের ভরা বুকে।
আর যদি পলায়ন করো, তবে তোমাদের কাছেও আসব না।’

এ গানের পরপরই শুরু হয়েছিল আবু আমের ফাসিকের ওপর মুজাহিদদের পাথর বর্ষণ। এর জবাবে কুরাইশ বাহিনী মুজাহিদদের ওপর তির বর্ষণ শুরু করল। মুজাহিদরাও তার পালটা জওয়াব দিলো তির বর্ষণ করে। খালিদ বাম দিক থেকে মুজাহিদদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হলো। তাঁর জানা ছিল না, পাহাড়ের ওপর তিরন্দাজরা ওত পেতে আছে তাদের অপেক্ষায়। তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী বিনা বাধায় ছুটে আসছিল। সংকীর্ণ পথে নেমে আরোহীরা বাধ্য হলো কাতারবন্দি হয়ে আগে পিছে আসতে।

খালিদ জেনে-শুনেই ময়দানের এ পথ ধরে আরোহীদের পরিচালনা করেছিল। বাবার দেওয়া প্রশিক্ষণ অনুসারে তাঁর আত্মবিশ্বাস ও ভরসা ছিল, সে অচিরেই মুসলমানদের এমন পজিশনে নিয়ে আসবে, তখন তারা পিছু হটতে বাধ্য হবে। পিছু হটতে গিয়ে যদি তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে কুরাইশদের অশ্বারোহী বাহিনীর পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাবে তারা।

কিন্তু তখনও ওরা মূল মুসলিম বাহিনীর কাছে পৌঁছেনি। পাহাড়ের ওপর থেকে তির বর্ষণ শুরু হলো ছুটন্ত অশ্বারোহীদের ওপর। সংকীর্ণ পথ ধরে সামনে অগ্রসর হওয়ার আর কোনো উপায়ই রইল না তাদের। ফলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এরই মধ্যে বেশ কিছু আরোহী তিরবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তিরবিদ্ধ ঘোড়াগুলো ময়দানে কিয়ামত সৃষ্টি করে দিলো। পেছনের আরোহীরা দ্রুত পেছনে সরে আত্মরক্ষা করল।

কুরাইশ রমণীরা তখনও দফ বাজানোর তালে তালে গান গেয়েই চলছে—

‘হে আবদুদ্দারের সন্তানগণ!
হে আমাদের গৃহের অনুগামী!
আমরা তোমাদের রাতের রানি…’

ইতিহাসবিদ ওয়াকেদি লিখেছেন—’সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী প্রথমে অনুষ্ঠিত হতো দ্বন্দ্বযুদ্ধ। একদল থেকে একজন বীর ময়দানে নেমে এসে আহ্বান জানাত প্রতিপক্ষের বীরকে। এভাবে পর পর নেমে আসত আরও কয়েকজন। তারপর শুরু হয়ে যেত সামগ্রিক লড়াই। কুরাইশদের পতাকাবাহী তালহা বিন আবু তালহা অগ্রসর হয়ে মুজাহিদদের আহ্বান জানাল—’কে আছিস বাপের বেটা! কার মরার শখ হয়েছে, সামনে আয়!’

হজরত আলি বাতাসের বেগে ময়দানে লাফিয়ে পড়ে বলল—’আমি আসছি, তোর সাথে লড়ার জন্য।’

তালহা বিন তালহা তার তলোয়ার দুলিয়ে হুংকার দিয়ে সামনে বাড়ল, কিন্তু তার আঘাত বাতাস চিরে শব্দ করে উঠল। সে নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই হজরত আলির তরবারির আঘাত এমন গভীর জখম করল, প্রথমে তার পতাকা পড়ে গেল, শেষে সে নিজেও পড়ে গেল। কুরাইশের এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে পতাকা নিয়ে পিছিয়ে গেল। হজরত আলি তাকে ফেলে দিতে পারতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত লড়াইয়ে এমন নিয়ম ছিল না। এ সময় তালহার বংশের আরেকজন এগিয়ে এলো।

বলল সে—’আলি, আমি এর বদলা নেব। এবার আমার তলোয়ারের ধার দেখ!’

আলি নীরবে তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে এগিয়ে এলেন। দুজন একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা চক্কর দিলো। হঠাৎ উভয়ের তলোয়ারের ঠোকাঠুকির আওয়াজ উঠল এবং দেখা গেল—তার ঢাল ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে আর হজরত আলির তলোয়ার থেকে রক্তের ফোটা ঝরে পড়ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী তখন মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল।

এভাবে একের পর এক কুরাইশের অসংখ্য ব্যক্তি হুংকার দিয়ে সামনে এলো, আর মুজাহিদদের তলোয়ার তাদের পাঠিয়ে দিলো মৃত্যুর কোলে। কুরাইশ বীরদের এ শোচনীয় পরিণতি দেখে ক্ষেপে উঠল সেনাপ্রধান আবু সুফিয়ান। যুদ্ধের নিয়ম মতে সেনাপতির দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামার কথা নয়। কারণ, সেনাপতির মৃত্যু ঘটলে সেনাদলে বিভীষিকা নেমে আসে। কিন্তু এতসব ভাবার সুযোগ নিল না সে; ঘোড়া ছুটিয়ে হুংকার ছেড়ে এগিয়ে গেল সামনে।

হিন্দা তাকে ময়দানে ছুটে যেতে দেখে উটের ওপর আরোহণ করে উচ্চৈঃস্বরে গাইতে লাগল—

‘যদি তোমরা শত্রুর ওপরে বিজয় লাভ করো
তোমাদের আমরা তুলে নেব আমাদের ভরা বুকে।
আর যদি পলায়ন করো, তবে তোমাদের কাছেও আসব না।

আবু সুফিয়ান ঘোড়ার ওপর আসীন ছিল, তার সঙ্গে মোকাবিলায় যে মুসলমান এগিয়ে এলো, সে ছিল পদাতিক বাহিনীর। ইতিহাস তাকে হানজালা বিন আবু আমের নামেই উল্লেখ করেছে। আবু সুফিয়ানের হাতে দীর্ঘ ফলাযুক্ত বল্লম ছিল। কেউ আশা করেনি, তলোয়ারধারী পদাতিক অশ্বারোহীর দীর্ঘ বল্লমের আঘাত থেকে বেঁচে যাবে। আবু সুফিয়ানের ঘোড়া তীব্র বেগে হানজালার দিকে ছুটে এলো। কাছে এসে আবু সুফিয়ান বর্শা তুলে তাক করে ছুড়ে মারল হানজালার দিকে। কিন্তু চোখের পলকে একদিকে সরে গেল হানজালা।

এভাবে তিনবার আবু সুফিয়ানের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করল হানজালা। তৃতীয়বারও আঘাত ফসকে গেলে আবু সুফিয়ান আবার আঘাত হানার জন্য ঘোড়া নিয়ন্ত্রণে এনে ঘোরাতে গেল, হানজালা এই সুযোগে ঘোড়ার পায়ে এমন জোরে আঘাত করল যে, আহত হয়ে ঘোড়াটি পড়ে গেল। আবু সুফিয়ান ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেল এক পাশে। হানজালা ছুটে গেল তাকে আক্রমণ করতে। আবু সুফিয়ান ছিটকে পড়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল। হানজালাকে ছুটে আসতে দেখে শুয়ে থাকা ঘোড়ার চারদিকে ছুটাছুটি করতে করতে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার শুরু করল।

কুরাইশদের এক পদাতিক দৌড়ে এলো ময়দানে। মুসলমানরা ভাবল, ও আবু সুফিয়ানকে নিয়ে যেতে আসছে। কিন্তু সে যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করে পেছন থেকে হানজালাকে আঘাত করে তাকে শহিদ করে দিলো। আবু সুফিয়ান দ্রুত তার দলে গিয়ে শামিল হয়ে গেল। সবশেষে কুরাইশদের পক্ষ থেকে ময়দানে এলো আবদুর রহমান বিন আবু বকর। ঐতিহাসিক ওয়াকেদি এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—’আবদুর রহমান বিন আবু বকর যখন হুংকার দিয়ে সামনে এলো, তখন তার পিতা আবু বকর তলোয়ার উন্মুক্ত করে নিজের যুবক সন্তানকে মোকাবিলা করার জন্য ময়দানে নামলেন।’

‘সামনে এসো মুসলমান পিতার কাফির সন্তান!’ আবু বকর অকম্পিত স্বরে বললেন। রাসূলে করিম (সাঃ) দেখলেন, বাপ-বেটা নেমে পড়েছে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে। এর অনিবার্য পরিণতি তো এই, দুজনের একজনকে মরতেই হবে। তিনি দৌড়ে এসে আবু বকরকে থামালেন। বললেন—’তলোয়ার খাপে পুরে নাও আবু বকর।’ তারপর তাকে তিনি টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।

খালিদ যেন এখনও তাঁর কানে যুদ্ধের শোরগোল শুনতে পাচ্ছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সেইসব ভয়াবহ দৃশ্য। দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষ হতেই কুরাইশরা সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাসূলে করিম (সাঃ) এর উহুদ পাহাড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। মুজাহিদদের সামনে পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ভয় ছিল না। ছিল সামনাসামনি ভীষণ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের সম্ভাবনা, কিন্তু মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম। এত কম সৈন্য নিয়ে মুখোমুখি লড়াই যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, রাসূল (সাঃ) ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলেন। এ জন্য তিনি তিরন্দাজদের কাজে লাগালেন। প্রচণ্ড লড়াই চলছে। একপক্ষ লড়ছে বিপুল সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রের বলে, অন্যপক্ষ লড়ছে ঈমানের জোরে। কেউ হার মানতে রাজি নয়।

খালিদ দূর থেকে তাকিয়েছিল রাসূল (সাঃ)-এর  দিকে। তিনি ময়দানের ঠিক মাঝখানে অবস্থান না নিয়ে এক পাশে সরে এসেছিলেন। এদিক দিয়েই খালিদের আক্রমণ করার কথা। খালিদ তাঁর বিপর্যস্ত অশ্বারোহীদের একত্রিত করে আদেশ দিলো—’যে পথ দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, আবারও সে পথেই এগোতে হবে। মুসলমানরা সংখ্যায় অল্প হতে পারে, কিন্তু পেছন থেকে অতর্কিত হামলা করা ছাড়া তাদের পরাজিত করা অসম্ভব। যত ক্ষতিই হোক, তিরবেগে অশ্ব ছুটিয়ে সংকীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে যেতে হবে আমাদের।’

খালিদ তাঁর বাহিনী নিয়ে সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে তির বেগে ছুটে এলো। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের পঞ্চাশজন তিরন্দাজ শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনীকে আবারও পিছু হটতে বাধ্য করল। তারা বেশ কিছু আহত ঘোড়া ও অশ্বারোহীকে ময়দানে ফেলেই চলে যেতে বাধ্য হলো।

প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। শুধু এক ব্যক্তিই যুদ্ধের ময়দানে এমন ছিল, যে যুদ্ধ করছিল না, সে ময়দানে বর্শা উঁচিয়ে এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন কাউকে খুঁজছে। তার নাম ওয়াহশি বিন হারব। সে খুঁজছিল হামজা-কে। কারণ, হামজাকে হত্যা করতে পারলে তার জন্য রয়েছে দু-টি পুরস্কার। প্রথমত, তার মনিব তাকে গোলামি থেকে মুক্ত করে দেবে। দ্বিতীয়ত, আর আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার মূল্যবান গহনাপত্র উপহার হিসেবে পাবে, যা সে পরিধান করে আছে।

ঘুরতে ঘুরতে একসময় হামজা-কে সে দেখতে পেল। তিনি তখন সাবা বিন আব্দুল উজ্জাকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন। আরবে আগের যুগে মেয়েরা খতনা করত। ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের মতে, ইসলামপূর্ব যুগে আরবে মেয়েদের খতনা করার প্রথা ছিল। হামজা যে সাবাকে যুদ্ধে আহ্বান করছিলেন, তার মা খতনা করাতো।

হামজা তাকে যুদ্ধে আহ্বান জানিয়ে বললেন—’ওরে খতনাকারীর বেটা! এদিকে আয়, আমাকে শেষবারের মতো দেখে নে।’

সাবা বিন উজ্জা হামজা-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, রাগে তার মুখ লাল। সে তলোয়ারের যুদ্ধে ছিল অসম্ভব পটু। হামজাও কম পটু ছিলেন না। দুজনেই সামনাসামনি এসে এক অপরকে আঘাত হানতে লাগল। দুজনের ঢাল সে আঘাত প্রতিরোধ করে চলল।

ওয়াহশি বিন হারব চুপি চুপি হামজা-এর দিকে এগিয়ে গেল। উঁচু-নিচু জমিন ও ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়াল নিয়ে অতি সন্তর্পণে সে হামজা-এর নিকটবর্তী হলো। হামজা-এর দৃষ্টি তখন শত্রুর চোখের দিকে নিবদ্ধ। একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী সাবা ছাড়া অন্যদিকে তাকানোর কোনো সুযোগ ছিল না তার। ওয়াহশি বর্শা নিক্ষেপে খুব পটু ছিল। সে উঠে দাঁড়াল এবং মজবুত হাতে বর্শা ধরে তাক করল হামজা-কে। হামজা ততক্ষণে সাবাকে আঘাতের পর এবার সাবার পেট লক্ষ্য করে

আঘাত হেনে কাবু করে এনেছেন। হামজা তরবারির আঘাত হানল। এ আঘাত ঠেকাতে ব্যর্থ হলো সাবা। হামজা তাঁর তরবারি পেট থেকে এমনভাবে টেনে বের করলেন যে, পেট আরও ফেড়ে গেল। সাবা হামজা-এর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল।

হামজা সাবার পেট থেকে তরবারি বের করে উঠে দাঁড়ানোর আগেই ওয়াহশি তাঁর ওপর পূর্ণ শক্তিতে বর্শা নিক্ষেপ করল। বর্শা হামজা-এর পেটে এমনভাবে বিদ্ধ হলো যে, সাথে সাথে তাঁর নাড়িভূড়ি বেরিয়ে গেল। হামজা চট করে চোখ তুলে দেখলেন ওয়াহশিকে। বর্শাবিদ্ধ অবস্থায়ই তিনি ওয়াহশির দিকে ছুটে গেলেন। কিন্তু আঘাত করার আগেই পড়ে গেলেন তিনি ওয়াহশি তাঁর শরীর নিথর হওয়া পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করল। যখন হজরত হামজার দেহের স্পন্দন থেমে গেল, তখন ওয়াহশি তাঁর কাছে গেল। সে হামজা রাদিয়াল্লাহর শরীর থেকে বর্শাটি টেনে বের করে ওখানে আর সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত অন্য দিকে চলে গেল। সে হিন্দা এবং তার প্রভু জুবায়ের বিন মুনতায়ামকে খুঁজতে লাগল তাদের এ খবর দেওয়ার জন্য।

খালিদ যতই সে যুদ্ধের কথা মনে করছে, ততই তাঁর মনে চেপে বসছে ভীষণ এক বোঝার ভার। তাঁর অশ্ব ছুটে চলেছে। এগিয়ে যাচ্ছে নিম্নভূমি অতিক্রম করে। এ জন্য উহুদ পাহাড়ের উপত্যকা তাঁর চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল। তাঁর মনে পড়ল আপন সম্প্রদায়ের নারীদের কথা; যারা কুরাইশ ও তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি করে চলছিল। খালিদের মনে পড়ল, যুদ্ধের অবস্থা দেখার জন্য সে একটি উঁচু জায়গায় গিয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে সে দেখতে পাচ্ছিল মুসলিম মহিলাদের। মুসলমানরা তাদের আহতদের পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের সেবা-শুশ্রূষা করছে মহিলারা। তারা তাদের আহত স্থানে মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছে, তাদের পানি পান করাচ্ছে। এ যুদ্ধে চৌদ্দজন মুসলিম মহিলা ময়দানে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফাতিমাও।

যুদ্ধের অবস্থা এখন একটি ফয়সালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অল্পসংখ্যক মুজাহিদ অধিকসংখ্যক কাফিরদের ওপর বিজয় লাভ করতে যাচ্ছে। কুরাইশদের পতাকাবাহী পড়ে গেল। অন্যজন এসে উঠিয়ে নিল ভূ-পাতিত পতাকা। সেও যখম হয়ে পড়ে গেল। এমনিভাবে একের পর পতাকাধারীর পরিবর্তন ঘটতে থাকল। শেষবারের মতো একজন গোলাম পতাকা উঠিয়ে ধরল, সেও মারা গেল। মুসলমানরা আর কাউকে পতাকা তুলে ধরার সুযোগ দিলো না। কুরাইশদের সকল উদ্দীপনা একেবারে থেমে গেল।

খালিদ কুরাইশদের পিছু হটা দেখল, আর দেখল মুসলমানদের পিছু ধাওয়া করার দৃশ্যও। কুরাইশরা তাদের ক্যাম্পেও থাকতে পারল না, তাদের মাল- সামান সব ফেলে যে যেদিকে পারল পালাল। যুদ্ধ শেষ। মুসলমানরা বিজয় উল্লাস করতে করতে প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে চড়াও হলো। তাদের মাল-সামান লুট করতে লাগল পরম উৎসাহে। কুরাইশরা দিশেহারা হয়ে ছুটে পালাচ্ছিল। মাল-সামান তো দূরের কথা, আপন মহিলাদের কথাও মনে রইল না তাদের। মহিলারা নিজেরাই পায়ে হেঁটে পলায়ন করছিল, কিন্তু মুসলমানরা তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত।

কুরাইশদের অশ্বারোহী বাহিনীর যে দল দুটি আকরামা ও খালিদের নেতৃত্বে মুসলমানদের পেছন থেকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল, তারা ছিল মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন ও অন্তরালে। আবারও তারা আক্রমণ করার সুযোগ খুঁজছিল, কিন্তু যুদ্ধের গতি বিশেষভাবে উলটে যাওয়ায় তারা থমকে গেল।

আকরামা ও খালিদ পুনরায় তাদের অশ্বারোহীদের আগের অবস্থানে এনে একত্রিত করল। যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আকরামা যখন নিরাশ, খালিদ তখন ভাবছিল অন্য কথা। সে ভাবছিল, এখনও এই পরাজয়কে বিজয়ে রূপ দেওয়া সম্ভব, যদি মুসলমানদের পেছন থেকে অতর্কিত হামলা চালানো যায়। কিন্তু এ হামলা চালাতে হলে যে পথ দিয়ে সেখানে যেতে হবে, সেই সংকীর্ণ পথে তখনও মুসলিম তিরন্দাজরা পাহারা দিচ্ছিল। হামলা করার সুযোগ না পেয়ে খালিদ তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

পাহাড়ের ওপর থেকে মুসলিম তিরন্দাজরা যখন দেখল—কুরাইশরা পালিয়ে গেছে আর তাদের সাথিরা গনিমতের মাল লুটছে, তখন তাদেরও কিছু লোক গনিমতের মালের লোভে নিজেদের স্থান ত্যাগ করতে থাকে। কমান্ডার আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের তাদের বললেন—’দেখ, তোমরা রাসূলের আদেশ লঙ্ঘন করো না। হুজুরের হুকুম হচ্ছে, তিনি নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আমরা যেন নিজ স্থান থেকে এক ‘পা-ও না নড়ি।’

‘কিন্তু এখন তো যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে!’ বলে তিরন্দাজরা আনন্দ-উল্লাস করে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নেমে গেল। তারা তখন চিৎকার করছিল— ‘গনিমতের মাল! গনিমতের মাল! আমাদের বিজয় হয়েছে!’

আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের তখনও নিজের জায়গায় অটল। সঙ্গে মাত্র নয়জন তিরন্দাজ।

খালিদ যখন এ দৃশ্য দেখল, তখন তাঁর মনে হলো—সে যেন স্বপ্ন দেখছে। কারণ, সে তো এটাই চাচ্ছিল! সে তিরন্দাজদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। যখন তারা কুরাইশদের ক্যাম্পে গিয়ে পৌছল, তখন সে ওই পাহাড়ি এলাকায় আক্রমণ করে বসল। আবদুল্লাহ বিন জুবায়ের ও তাঁর সঙ্গীরা তির বর্ষণ শুরু করল। খালিদ প্রতিশোধের নেশায় তাঁর অশ্বারোহীদের নিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে শুরু করল। মুজাহিদরা নিরূপায় ভঙ্গিতে তির বর্ষণ তীব্রতর করল।

আকরামা যখন খালিদকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে মুজাহিদদের ওপর আক্রমণ করতে দেখল, তখন সেও অশ্বারোহীদের নিয়ে সেদিকে ছুটে গেল এবং ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিক থেকে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। তাদের কাছেও তির-ধনুক ছিল। তারা ওপর দিকে তির চালাতে চালাতে এগিয়ে গেল। নয়জন মুজাহিদের পক্ষে দেড় শতাধিক অশ্বারোহীর এ আকস্মিক অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না; অশ্বারোহীরা ওপরে উঠে গেল। তিরন্দাজরা তির ফেলে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল তাদের সামনে। শুরু হলো হাতাহাতি লড়াই। মুজাহিদদের প্রায় সকলেই আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ল। খালিদ আহতদের পাহাড়ের পাদদেশে এনে গড়িয়ে নিচে ফেলে দিলো। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরও শহিদ হয়ে গেলেন।

খালিদ ও আকরামার মিলিত ফৌজ দ্রুত সেখান থেকে নিচে নেমে এলো। যেখান থেকে মুসলমানরা যুদ্ধের সূচনা করেছিল, সেখানে এসেই খালিদ গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত মুসলমানদের ওপর ঝটিকা আক্রমণের নির্দেশ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দলছুট বিচ্ছিন্ন মুসলমানদের ওপর টুটে পড়ল অশ্বারোহীরা। কিন্তু রাসূলে করিম (সাঃ) তাঁর সঙ্গে সামান্য পরিমাণ মুজাহিদের নিয়ে এগিয়ে এলেন এই তুফানের বিরুদ্ধে।

কুরাইশদের সঙ্গী মহিলারা পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওমরাহ নামের এক মহিলা তাদের সাথে পালাতে না পেরে লুকিয়ে ছিল এক কাঁটা-ঝোঁপের আড়ালে। সে যখন দেখল কুরাইশ অশ্বারোহীরা আবার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে বসেছে, তখন সে ছুটে বেরিয়ে এলো ঝোঁপ থেকে এবং কুরাইশদের পতাকা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ওপরে উঁচিয়ে ধরল।

আবু সুফিয়ান পালাতে পালাতেই পেছন ফিরে তাকাল এবং দেখল, ময়দানে তাদের পতাকা উড়ছে। সে থমকে দাঁড়াল এবং পলায়নরত পদাতিক বাহিনীকে চিৎকার করে থামতে বলল। পদাতিক বাহিনীর জওয়ানরা আবু সুফিয়ানের চিৎকার শুনে ময়দানের দিকে তাকাল এবং দেখতে পেল-ময়দানে তাদেরও পতাক উড়ছে। ওরা তখন ‘জয় হোবল! জয় উজ্জা!’ ধ্বনি দিয়ে ময়দানে ফিরে এলো এবং মুসলমানদের ঘিরে ফেলল।

খালিদের সে সময়ের কথা স্মরণ হলো—যখন সে ময়দানে রাসূল (সাঃ)-কে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে ঘটনার চার বছর পর আজ আবার সে মদিনায় রাসূলের কাছে ছুটে যাচ্ছে। তাঁর হৃদয়-সাগরে ভাসছে রাসূলের অনিন্দ্যসুন্দর প্রশান্ত মুখাবয়ব।

খালিদ এখন দিগন্তের পাড়ে উহুদ পাহাড়টি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। খালিদের ঘোড়া আপন গতিতে, আপন তালে এগিয়ে যাচ্ছে সেই পাহাড়ের দিকে। সে তার হৃদয়-কাবায় এমন এক প্রশান্তি অনুভব করল, যা সে ভাষায় ব্যক্ত করতে অক্ষম। তাঁর মনে হচ্ছিল—এখন আর তাঁর কোনো তাড়া নেই। অন্য সময় গন্তব্যের কাছাকাছি গেলে যেমন ঘোড়ার লাগামে ঝটকা মেরে দ্রুত পৌঁছার জন্য গতি বাড়াত, আজ তেমন কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না; যদিও যে গন্তব্যে সে যাচ্ছে, ওই স্থানটি এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তার কেবল মনে হচ্ছে, কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর সে টানে চুম্বকের মতো সে এগিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রের দিকে।

‘খালিদ!’ সহসা তাঁর ভেতর থেকে কে যেন ডেকে উঠল তাকে। সে সত্যি কেউ তাকে ডেকেছে মনে করে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে চারদিকে চোখ বোলাল, কিন্তু আশপাশে বালি ছাড়া সে আর কিছুই দেখতে পেল না। আবারও আওয়াজ হলো—’খালিদ, এ কি সত্যি, যা আমি শুনেছি?’ খালিদ এবার চিনতে পারল এটা কার শব্দ। এ শব্দ তার সঙ্গী ও বন্ধু আকরামার। গতকালই আকরামা তাকে বলেছিল—’যদি তুমি ভেবে থাকো—মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত নবি, তবে তুমি সে ধারণা মন থেকে মুছে ফেলো। মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজনের খুনি। নিজের সম্প্রদায়ের দিকে তাকাও, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না, সূর্য ডোবার আগেই মুহাম্মাদকে হত্যা করার শপথ নিয়ে কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে!’

খালিদের মন আবারও চার বছর অতীতে চলে গেল, যখন সে উহুদ যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে খুঁজছিল। সূর্য ডোবার আগেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে হত্যা করার শপথ তো সেদিন তারও ছিল! মুসলমান তিরন্দাজরা পাহাড়ের অবস্থান ছেড়ে গিয়েছিল বলেই না সেদিন সে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের এবং তাঁর নয়জন সঙ্গীকে শেষ করতে পেরেছিল। খালিদের চাইতে এ কথা আর কে বেশি জানে, সেই যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজয় বরণ করেছিল কেবল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদেশ অমান্য করার কারণে। খালিদ ও আবু জেহেলের বেটা আকরামা যুদ্ধের কৌশলে যতই পটু থাকুক না কেন, তিরন্দাজরা না সরলে তাদের পরাজয় কেউ রোধ করতে পারত না সেদিন। তারপর? তারপর সেসব তিরন্দাজদের ভুলের মাশুল হিসেবে যখন তারা পরাজয়কে বিজয়ে পরিণত করল, তখনকার ঘটনা কি সে ভুলতে পারবে? তাদের কাছে তখন বিচ্ছিন্ন মুসলমানকে হত্যা করা কোনো ব্যাপারাই ছিল না। সে সময় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মুসলমানদের সাহায্য করার আর কেউ ছিল না। খালিদ দেখেছিল, মুসলমানরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মুসলমানদের বড়ো অংশটা ছিল বিচ্ছিন্ন, যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র কমান্ড থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। রাসূল (সাঃ)-এর  সঙ্গে তখন মাত্র গুটিকয়েক সাহাবি। তাদের মনে মাল-দৌলতের কোনো লোভ নেই। সংখ্যায় তারা মাত্র জনা-ত্রিশেক। এর মধ্যে ছিলেন আবু দাজানা, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, হজরত আলি, হজরত আবদুর রহমান বিন আওফ, হজরত আবু বকর, হজরত আবু ওবায়দা, তালহা বিন আব্দুল্লাহ, মাসআব বিন আমির প্রমুখ। মাত্র ত্রিশজন, অথচ সকলেই কেমন মৃত্যুভয়হীন; কী অনড়, অটল, সংকল্প-দৃঢ় চেহারা! সেই চেহারা যে জীবনে একবার দেখেছে, কোনো দিন তা ভুলতে পারবে না।

যে চৌদ্দজন মহিলা আহত মুজাহিদদের দেখাশোনা ও সেবা-শুশ্রূষার জন্য এসেছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন মাত্র রাসূল (সাঃ)-এর  পাশে ছিলেন। একজন উম্মে আম্মারা ও অন্যজন উম্মে আয়মান, যিনি ছিলেন এক হাবশি মহিলা। উম্মে আয়মান হুজুর-এর শিশুকালের দাই ছিলেন। বাকি বারোজন মহিলাই তখনও পর্যন্ত আহতদের জখমে ব্যান্ডেজ বাঁধার কাজে ব্যস্ত।

খালিদ রাসূল (সাঃ)-কে খুঁজছিল, কিন্তু ময়দানে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করার সুযোগ ছিল না তাঁর। কারণ, তাঁর অধীনে চলছে সেই অশ্বারোহী বাহিনী; যারা একটু আগে নিজেদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করেছে। এ সময় হঠকারী সিদ্ধান্ত বা এলোমেলো আক্রমণের কোনো অবকাশ নেই। শত্রু বিনাশের চাইতে এ বিজয় ধরে রাখাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

আজ চার বছর পরও সেসব কথা, সেসব স্মৃতি কতই না জীবন্ত, কতই না বাস্তব হয়ে ধরা পড়ছে। আজ যখন সে সম্পূর্ণ একাকী মরুভূমির দিগন্ত বিস্তৃত রাস্তায় ঘোড়া ছোটাচ্ছে, তখনও সে তাঁর মাথার মধ্যে যুদ্ধের ময়দানে ছুটন্ত ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে তির-ধনুকের শনশন আওয়াজ! শুনতে পাচ্ছে মর্দে মুজাহিদ মুষ্টিমেয় মুসলমানের বজ্রনিনাদের তকবির ধ্বনি। এ তকবির ধ্বনি যে তাদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে দিচ্ছে। এর ফলে যে তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে ভয়াল মৃত্যুর বিভীষিকা, এ কথা কি তারা একবারের জন্যও ভাবছে না? এটাকে মুসলমানদের বোকামি ভেবে তিরস্কার ও ঘৃণায় তার মুখে হাসি এসেছিল। মনে মনে ভেবেছিল—ভালোই হলো, যত বেশি সম্ভব মুসলমানকে হত্যা করে নেব এই সুযোগে। যত কমসংখ্যক বন্দি করা যায়, ততই ভালো। এসব যখন ভাবছিল, তখনও তাঁর চোখ খুঁজে ফিরছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে। কিন্তু কোথায় রাসূলে মকবুল?

সে দেখতে পেল—আবু সুফিয়ান পলায়নরত কুরাইশদের সাথে নিয়ে ফিরে এসে মুসলমান সৈন্যদের বড়ো অংশের ওপর আক্রমণ করে বসেছে। মুসলমানরা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও প্রাণের মায়া ছেড়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতা ও তেজের সাথে লড়াই করছে। তারা জীবনের শেষ যুদ্ধ মনে করে বীরত্ব ও নির্ভীকতার এমন সব প্রদর্শনী দেখাচ্ছে, যা দেখে কুরাইশ সৈন্যরা হতবাক হয়ে পড়েছে।

এ অবস্থা দেখে খালিদ ক্ষেপে গেল। সে তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে আবু সুফিয়ানের সাহায্যে ছুটে যেতে হুকুম দিলো। মুসলমানদের ওপর পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করে বসল খালিদের বাহিনী। খালিদ তলোয়ার খাপের মধ্যে রেখে বর্ণা তুলে নিল হাতে। আক্রমণ করে বসল পেছন থেকে। বর্শার আঘাতে একের পর এক মুসলিম মুজাহিদকে হত্যা করে চলল সে। তাঁর বর্শা যখন কোনো মুসলমানকে বিদ্ধ করত, তখন সে চিৎকার দিয়ে বলে উঠত—’আমি আবু সুলাইমান!’ প্রতিটি বর্শাবিদ্ধ মুজাহিদ শুনতে পেত সেই একই গর্জন— ‘আমি আবু সুলাইমান! ‘

আজ চার বছর পর যখন সে মুসলমানদের কেন্দ্রভূমি মদিনার দিকে চলেছে, তখনও তাঁর সেই গর্জন ভেসে আসছে নিজের কানে—’আমি আবু সুলাইমান!’ তার জানা নেই, তাঁর বর্শা কত মুসলমানকে হত্যা করেছিল। খুনের নেশায় তখন সে রাসূল (সাঃ)-এর  কথাও ভুলে গিয়েছিল। একটু পরে যখন সে জানতে পারল—মুসলমানরা তাদের নবির আদেশে ময়দান ছেড়ে সরে পড়েছে, আর আকরামা তাদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর হুশ হলো।

যুদ্ধের অবস্থা তখন খুবই নাজুক। মুসলমানরা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। দুশমনরা রাসূল (সাঃ) এ-কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সঙ্গী-সাহাবিরা তাঁকে ময়দান থেকে সরিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু তিনি সঙ্গীদের ছেড়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে যেতে রাজি হলেন না। অগত্যা সাহাবিরা তাঁকে ঘেরাও করে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি জানতেন, কুরাইশরা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাঁর ও তাঁর দলের ওপর কঠিন আক্রমণ চালাবে এখন কুরাইশরা।

তিনি সাহাবিদের সাথে নিয়ে একটি পাহাড়ি আশ্রয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সাহাবিরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে রেখেছিলেন। তিনি সামান্য পথ অতিক্রম করেছেন, এ সময় আকরামা ছুটে এসে অশ্বপৃষ্ঠ থেকেই হুজুর-এর ওপর আক্রমণ করে বসল। তার সঙ্গীরা আক্রমণ করে বসল নবিজির সঙ্গী- সাথিদের ওপর। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী-সাহাবিদের কারও আর বাঁচার বিন্দুমাত্র আশা নেই। দুজন মহিলাসহ হুজুরের ত্রিশজন জানবাজ সাহাবি তখনও তাঁর সঙ্গে। তারা সবাই দেহ-প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখলেন নবিজিকে।

খালিদের স্মরণ হলো—রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তো শারীরিক শক্তিতেও প্রসিদ্ধ। তার বড়ো প্রমাণ, তিনি আরবের বিখ্যাত কুস্তিগির বীর রেকানাকে তিন-তিনবার মাথার ওপর তুলে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। এখন এ যুদ্ধের ময়াদানে তাঁর সেই শারীরিক শক্তি পরীক্ষারও সময় এসে গেছে। তাঁর জন্য প্রাণ বিলিয়ে দেওয়ার তামান্না নিয়ে যারা তাঁর চারপাশে দেহ-প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছিল, হুজুর সে প্রাচীর নিজেই ছিন্ন করলেন। হাতে তাঁর তির-ধনুক। তিরের থলিতে তিরও আছে। খালিদ তখনও মুসলিম বাহিনীর অপেক্ষাকৃত বড়ো দলের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। যখন সে জানতে পারল—রাসূলুল্লাহ (সাঃ)দুই মহিলাসহ ত্ৰিশজন সঙ্গী নিয়ে কুরাইশ বাহিনীর সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করছেন, তখন সে একটু অবাকই হলো।

সে বলতে বাধ্য হলো—’এ আসলে শারীরিক শক্তি নয়, হতেই পারে না। এ শক্তির রহস্য অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।’ সে সময় থেকে তাকে একটি প্রশ্নই সদা-সর্বদা অস্থির করে রেখেছে, এই বিশ্বাসটি কোন শক্তি হতে পারে? সে তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের কারও কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আশা করতে পারে না। কারণ, খুব শীঘ্রই তাঁর ওপরেও এ অপবাদ আসবে, মুহাম্মদের জাদুর প্রভাব পড়েছে তাঁর ওপরও।

আজ সে এ প্রশ্ন মাথায় নিয়েই মদিনার দিকে চলেছে। উহুদ পাহাড়ের চূড়া এখন দিগন্তের অন্তরাল থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চার বছর আগের সেই পুরোনো স্মৃতি যেন তাকে ওই পাহাড়ি অঞ্চলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর মনে হচ্ছে, সেখান থেকে কেউ তাকে বারবার ডেকে যাচ্ছে—’আবু সুলাইমান! আবু সুলাইমান!‘

সে তখনও তাঁর মনের আয়নায় দেখতে লাগল সেই মুষ্টিমেয় ত্রিশজন নারী ও পুরুষকে। দেখতে লাগল, এত বড়ো অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে কেমন অসীম বীরত্বের সাথে লড়াই করে চলেছে তারা! রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তাঁর পবিত্র হাতে তির বর্ষণ করে চলেছেন। তাঁর সঙ্গী-সাথিরা জীবন বিপন্ন করে তাঁকে বারবার তাদের বেষ্টনীর মধ্যে ঘিরে রাখছে।

মাগাাজ নামক এক ঐতিহাসিক লিখেছেন—’হুজুর এ বারবার বেষ্টনী ভেদ করে যেদিক থেকে শত্রুরা এগিয়ে আসছে, সেদিকে তির ছুড়তে থাকেন। তাঁর শারীরিক শক্তি ছিল সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি। তিনি ধনুক এমন জোরে টানতেন যে, তাঁর নিক্ষিপ্ত তির কারও গায়ে বিঁধলে, তিরের ফলা শরীরের একদিক থেকে বিঁধে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যেত। প্রচণ্ড চাপ সইতে না পেরে রাসূল (সাঃ)-এর  ধনুকটি হঠাৎ ভেঙে গেল। তিনি তিরগুলো সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে দিয়ে দিলেন। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসও একজন নিপুণ তিরন্দাজ। তাঁর তিরের সামনে কেউ টিকতে পারত না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)নিজেও তাঁর তিরের প্রশংসা করতেন।’

একদিকে মুসলিম মুজাহিদরা আবু সুফিয়ান ও খালিদের হাতে অকাতরে শাহাদাতের পেয়ালা পান করছেন, অন্যদিকে রাসূল (সাঃ)-এর  ত্রিশজন জানবাজ সাহাবি ও দুজন মহিলা সাহাবি এমনভাবে যুদ্ধ করছেন, যেন তাদের শরীর বলে কিছু নেই; শুধু আত্মাই যুদ্ধ করে যাচ্ছে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক তাবারি লিখেছেন—’তখন একেকজন মুসলমান একই সঙ্গে চার-পাঁচজন কুরাইশের সঙ্গে প্রাণপণে মোকাবিলা করে যাচ্ছিলেন। তাদের ভয়ংকর রূপ ও ক্ষীপ্রতা লক্ষ করে কুরাইশরা পিছু হটে যায়।’

কুরাইশরা যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র এ জিন্দাদিল সঙ্গীদের বীরত্বের ভয়ংকর অবস্থা দেখল, তখন তারা পেছনে সরে গিয়ে পাথর বর্ষণ করতে শুরু করল। অকস্মাৎ কুরাইশের কয়েকজন অশ্বারোহী ক্ষীপ্রবেগে ছুটে এসে নবিজির ওপর আক্রমণ চালাল, কিন্তু সাহাবিদের নিক্ষিপ্ত তির তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করল। তারা তখন আত্মরক্ষার জন্য সমানে মেঘের মতো তির ও পাথর বর্ষণ করতে লাগল।

খালিদকে পরে আকরামা বলেছে, সাহাবি আবু দাজানা রাসূলের সামনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর পিঠ ছিল শত্রুর দিকে। তিনি একই সঙ্গে দুটি কাজ করছিলেন। একদিকে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে তিরের জোগান দিচ্ছিলেন। সাদ সে তির দ্রুত নিক্ষেপ করছিলেন কুরাইশদের দিকে। অপরদিকে আবু দাজানা রাসূলে আকরামকে তিরের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তির ও পাথর বর্ষণের মাঝে কউে লক্ষ করেনি—আবু দাজানার কী অবস্থা হয়েছে। কিন্তু যখন আবু দাজানা মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন দেখা গেল তাঁর পিঠে এত তির বিদ্ধ হয়েছে যে, তার সারা পিঠ তিরের আড়ালে হারিয়ে গেছে, নতুন কোনো তির বসারমতো জায়গা সেখানে নেই।

রাসূলে আকরাম-কে বাঁচানোর জন্য তাঁর কয়েকজন সাহাবি জীবন দান করলেন। কিন্তু যারা তখনও বেঁচে ছিলেন, তারা এমন প্রচণ্ডভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যে, আকরামা ও তার বাহিনী ভয় পেয়ে পেছনে সরে গেল। কুরাইশরা ততক্ষণে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাসূলে করিম (সাঃ) সামান্য অবকাশ পেয়ে সাহাবিদের দিকে তাকালেন। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। সকলেই কমবেশি আহত। কিন্তু এখন আহত সাহাবিদের জখমে মলম ও পট্টি বাঁধার কোনো সুযোগ নেই, আর পট্টি বাঁধারও কেউ নেই। শত্রুরা আবারও আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পেছনে সরে গেছে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবিদের বললেন। ‘আমি কুরাইশদের পক্ষ থেকে আর এক ব্যক্তির আগমনের অপেক্ষা করছি।’

একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন—’ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! কে সেই ব্যক্তি? সে কি আমাদের সাহায্য করতে আসছে?’

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন—’না! সে আমাকে হত্যা করতে আসবে, তার তো

এখন আসার কথা!’

‘কিন্তু সে কে?’ সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন।

হুজুর বললেন। ‘উবাই বিন খালফ।’

উবাই বিন খালফ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র কট্টর বিরোধীদের মধ্যে একজন। সে ছিল মদিনার বাসিন্দা। সে যখন জনতে পারল, রাসূল (সাঃ) নবুয়তের দাবি করেছেন, তখন একদিন সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র কাছে এলো এবং রাসূলকে ব্যঙ্গ করল। নবি করিম (সাঃ) ধৈর্যের সাথে শান্তভাবে তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন।

‘তুমি কি আমাকে এতই দুর্বল মনে করো যে আমি তোমার ভিত্তিহীন বিশ্বাসকে গ্রহণ করে নেব?’ উবাই বিন খালফ বেয়াদবের মতো বলল—’আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে নাও মুহাম্মাদ! কোনো একদিন দেখে নিয়ো—আমার ঘোড়া; যাকে এখন খাইয়ে মোটা তাজা করছি—যখন তুমি কুরাইশদের আবার যুদ্ধের হুমকি দেবে, আমি এই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসব, আর তুমি আমাকে যুদ্ধের ময়দানে তোমার সামনে দেখতে পাবে। তুমি বদরের স্বপ্ন ভুলে যাও। আমি আমার দেবতার কসম করে বলছি! আমি তোমাকে নিজ হাতে হত্যা করব।’

‘উবাই!’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)একটু মুচকি হেসে বললেন—’জীবন ও মৃত্যু সেই আল্লাহর ইচ্ছাধীন, যিনি আমাকে নবুয়ত দান করেছেন এবং যিনি আমাকে পথহারা লোকদের সঠিক পথে আনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এমন কথা মুখে আনবে না, যা আমার আল্লাহ ছাড়া আর কেউ পূরণ করতে পারে না। এমনও তো হতে পারে, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসে নিজেই লাশ বনে যাবে!’

উবাই বিন খালফ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখে এ কথা শুনে তিরস্কার ও ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে হাসতে হাসতে চলে যায়।

এখন এই উহুদ যুদ্ধের ময়দানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র মনে পড়ে গেল উবাই বিন খালফের কথা। যখন তার নাম মনে পড়েছে, তখন দূরে দেখা গেল, একটি ঘোড়া তির বেগে ছুটে আসছে। সকলেই সেদিকে তাকিয়ে দেখল।

‘আমার প্রিয় সাহাবিগণ!’ রাসূলে করিম (সাঃ) সাহাবিদের লক্ষ্য করে বললেন— ‘ওই আরোহীকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে উবাই বিন খালফই আমার দিকে ছুটে আসছে। যদি সত্যি সে উবাই হয়, তবে তাকে কোনো বাধা দিয়ো না। তাকে আমার কাছে আসতে দাও।’

ঐতিহাসিক ওয়াকেদি, মাগাজি ও ইবনে হিশাম লিখেছেন, সে অশ্বারোহী উবাই বিন খালফই ছিল। রাসূল-এর সামনে এসে সে হুংকার দিয়ে বলল— ‘সাবধান হয়ে যা মুহাম্মাদ! উবাই এসে গেছে! এই দেখ সেই ঘোড়ার ওপর চড়েই এসেছি, যে ঘোড়া তোকে দেখিয়েছিলাম।’

‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)!’ রাসূলের তিন-চারজন সাহাবি আবেগতপ্ত হৃদয় নিয়ে এগিয়ে মিনতিভরা কণ্ঠে বললেন—’অনুমতি দিন হুজুর, এই খবিসকে নিকেশ করে দিই।’

রাসূলে আকরাম বললেন—’না। ওকে আমার কাছে আসতে দাও, ওর রাস্তা ছেড়ে দাও।’

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)র মাথায় ঝুলওয়ালা লৌহ শিরস্ত্রাণ। হাতে বর্শা, কোমরে তলোয়ার। উবাইয়ের ঘোড়া নিকটে এসে গেল।

রাসূলে করিম (সাঃ) বললেন—’সামনে এসো উবাই! আমি ছাড়া তোমার সাথে

আর কেউ লড়বে না।’

উবাই বিন খালফ তার ঘোড়া নিয়ে রাসূলের কাছে এসে থামল। মুখে তার বিদ্রুপের হাসি। সে যে রাসূলকে হত্যা করতে পারবে, এ ব্যাপারে যেন সে নিশ্চিত। তার তরবারি তখনও খাপে আবদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)তার কাছে গেলেন। সে ছিল শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে আর নবিজি মাটিতে। সে যেই তরবারি টেনে বের করল, সঙ্গে সঙ্গেই নবি করিম (সাঃ) অগ্রসর হয়ে তাকে বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন। সে একদিকে কাত হয়ে আঘাত থেকে বাঁচতে চাইল, কিন্তু রাসূলের বর্শার মাথা তার কাঁধের নিচে গেঁথে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে গেল এবং তার পাঁজরের হাড় ভেঙে গেল।

ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, রাসূলে করিম (সাঃ)-এর আঘাত এত-ই শক্ত ছিল যে, উবাইয়ের মতো শক্তিশালী ব্যক্তি আর উঠতেই পারেনি। সে পড়েছিল ঘোড়ার উলটো পাশে, রাসূলে করিম (সাঃ) তাকে আবার আঘাত করার জন্য ছুটে গেলেন। সে এমনটি কল্পনা করেনি। মৃত্যুর বিভীষিকা নেমে এলো তার চোখের সামনে। সে কোনো রকমে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে ঘোড়া ফেলেই ছুটে পালাল। সে চিৎকার করে বলে উঠল—’মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাকে খুন করে ফেলেছে! হে কুরাইশের লোকেরা, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাকে হত্যা করে ফেলেছে।’

কুরাইশের লোকেরা যখন দেখল তার জখম তেমন গভীর নয়, তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—’তোমাকে কেউ হত্যা করেনি। সামান্য আঘাত পেয়েছ, দুদিনেই সেরে উঠবে।’ সে তখন চিৎকার করে বলতে লাগল—’না না, তোমরা জানো না, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজের মুখে বলেছে, আমি তাঁর হাতেই নিহত হব, আমি আর বাঁচব না।’ ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম এ পর্যন্ত লিখেছেন যে, উবাই এ কথাও বলেছিল—’যদি মুহাম্মাদ (সাঃ) আমার ওপর থুথু নিক্ষেপ করে, আমি তাতেও মারা যাব।’

উহুদ যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আহত উবাই কুরাইশদের সঙ্গে মক্কা রওয়ানা হলো। রাস্তায় তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠল। কুরাইশরা যাত্রাবিরতি করে তার সেবাযত্ন করল, কিন্তু সে সবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সেখানেই মারা গেল।

চার বছর আগের এ স্মৃতি, খালিদের যেন মনে হচ্ছে, কালকের ঘটনা। একদিন তাঁর বিশ্বাস ছিল, কুরাইশরা মুসলমানদের পদদলিত করে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু মুসলমানদের কুরবানি দেখে খালিদ বড়োই অস্থিরতা বোধ করল। তার মনে হচ্ছিল—কুরাইশদের ঘোড়াগুলো মুসলমানদের দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। খালিদ দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে রক্তাক্ত সমর থেকে আৰু সুফিয়ানকে খুঁজে বের করল এবং তার কাছে গিয়ে পৌঁছাল।

খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলল—’আমরা কি মুসলমানদের শেষ পরাজয় বরণ করানোর যোগ্য নই?’ কুরাইশ মাতাদের দুগ্ধ কি ব্যর্থ হয়ে গেল? এই মুষ্টিমেয় মুসলমানের ভয়ে কি ভীত হয়ে পড়েছ?’

আবু সুফিয়ান বলল—’দেখ খালিদ! যে পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদের সাথে আছে, আর সে জীবিত ও নিরাপদে আছে, এদের শেষ রক্তবিন্দু ঝরে যাওয়া পর্যন্ত ওরা পরাজয় বরণ করবে না।’

খালিদ তখন বলল—’আমাদের সেনাপতি হয়ে তুমি এমন কথা বলতে পারলে! ধিক আবু সুফিয়ান, ধিক তোমাকে! তবে লড়াই করার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছ না কেন?’

আবু সুফিয়ান বলল—’বাজে বকো না। তুমি তোমার আরোহীদের কাছে যাও। তোমার নেতৃত্ব ছাড়া ওরা অসহায় হয়ে পড়বে। মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের আক্রমণ করার জন্য আমি পদাতিক বাহিনী পাঠাচ্ছি।’

আজ মদিনার দিকে যেতে যেতে খালিদের বড়োই আনন্দ হলো—আবু সুফিয়ান তার বিরাট সংকল্প নষ্ট করে দিয়েছিল বলে। সে তো মুহাম্মাদ-কে হত্যা করে দেবতা হোবল ও উজ্জার সন্তুষ্টি লাভ করতে চেয়েছিল। সেনাপতির নির্দেশ মান্য করা আবশ্যক ছিল বলে সেদিন সে ময়দানে নিজের বাহিনীর কাছে ফিরে গিয়েছিল। রাসূলে করিমের সঙ্গী তখন মাত্র কয়েকজন, অথচ তাঁকে হত্যা করার সুযোগ না পাওয়ায় সেদিন তাঁর খুব আফসোস হয়েছিল। কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, এখন তাঁকে হত্যা করা কোনো ব্যাপারই না। আর রাসূলকে হত্যা করতে পারলে নতুন ধর্ম ও মুসলমানদের উঠে দাঁড়ানোর আর কোনো ক্ষমতাই থাকবে না।

খালিদ যুদ্ধের ময়দানের অবস্থা ভালো করে দেখার জন্য আবারও এক উঁচু চূড়ায় উঠে দাঁড়াল। সে দেখতে পেল-উহুদ প্রান্তরের দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মাটি রক্তে লালে লাল হয়ে গেছে। কোথাও ছটফট করছে আহত ঘোড়া, কোথাও মানুষ রক্তে রঞ্জিত হয়ে আর্তনাদ করছে, অথচ আহতদের উঠিয়ে নেওয়ার মতো কেউ নেই।

সে আরও দেখতে পেল—কুরাইশদের পদাতিক বাহিনী রাসূল (সাঃ)-এর  কাছে পৌঁছে গেছে। হ্যাঁ, এই তো তারা এখন রাসূলের সাথিদের বেষ্টনী ভেঙে দিচ্ছে। কুরাইশদের তিন ব্যক্তি উতবা বিন আবি ওয়াক্কাস, আব্দুর রহমান বিন শিহাব ইবনে কুম্মা রাসূল-এর ওপর পাথর বর্ষণ করছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, উতবার আপন ভাই সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাসূলে করিমের হেফাজতের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে! রাসূলে করিমের সঙ্গীদের সংখ্যা ক্রমেই কমছিল এবং তারা যুদ্ধ করতে করতে নেতিয়ে পড়ছিল।

কুরাইশরা বিরামহীনভাবে পাথর নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। সে পাথরে ধরাশায়ী হচ্ছে রাসূলে করিমের কষ্টকর জীবনের অন্তরঙ্গ সাথি ও প্রাণপ্রিয় সাহাবিগণ। বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এ লড়াইয়ের ইতি ঘটবে। নিশ্চিত পরাজয় ও মৃত্যুর বিভীষিকা গ্রাস করবে মুসলমানদের, কিন্তু এত আঘাত এবং বিপর্যয়ের পরও একজন মুসলমানও মহানবি (সাঃ)র সঙ্গ ত্যাগ করছে না।

মুসলমানদের প্রতিরোধশক্তি আরও দুর্বল হয়ে এলো। রাসূলকে রক্ষার জন্য তারা যে দেহপ্রাচীর তৈরি করেছিল, সে বেষ্টনী ফাঁকা হতে থাকল। দেহ-প্রাচীর সৃষ্টিকারী মুজাহিদরা শহিদ হয়ে গেলে সে স্থান পূরণ করার মতো সেখানে আর কেউ ছিল না। হঠাৎ উতবার নিক্ষিপ্ত একটি পাথর রাসূলে করিমের চেহারা মোবারকে আঘাত হানল। সে আঘাত এমন প্রচণ্ড ছিল যে, নবিজির ঠোঁট কেটে গেল এবং দাঁত ভেঙে গেল। এর পরপরই ছুটে এলো আরেকটি পাথর। আব্দুল্লাহর ছুড়ে মারা সে পাথরের আঘাতে রাসূলের কপালে সৃষ্টি হলো গভীর ক্ষত। ইবনে কুম্বা নামে এক কুরাইশ রাসূল (সাঃ)-এর  আরও নিকটবর্তী হয়ে এমন জোরে পাথর ছুড়ে মারল যে হুজুরের লৌহ শিরস্ত্রাণের কড়া ভেঙে গালের মধ্যে ঢুকে গেল। এই ভাঙা কড়া গালের নরম মাংশ ভেদ করে চোয়ালের হাড়েও আঘাত হানল। তিনি বর্শা নিয়ে লড়াই করছিলেন বলে শত্রুরা তাঁর কাছে না ভিড়ে দূর থেকে পাথর বর্ষণ করছিল, আর এক-একটি পাথরের আঘাতে রক্ত ঝরছিল তাঁর পবিত্র শরীর থেকে।

আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রাসূলের শরীর থেকে অনর্গল রক্ত ঝরছে। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়লেন। দুর্বল শরীরে ক্রমাগত আঘাতের ধকল সইতে না পেরে একসময় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সাহাবি তালহা নবিজিকে পড়ে যেতে দেখে কুরাইশদের সাথে লড়াই বন্ধ করে দৌড়ে তাঁর কাছে গেলেন। তাঁর চিৎকার শুনে অন্যান্য সাহাবিরাও ছুটে এলেন। পাথর বর্ষণকারী কুরাইশরা এবার তরবারি উঁচিয়ে ছুটে এলো। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস তাঁর সহোদর ভাই উতবা বিন আবি ওয়াক্কাসকে আক্রমণ করে বসল। উতবা ভাইয়ের উত্তেজিত হুংকার শুনে ভয়ে তাঁর সামনে থেকে পালিয়ে গেল।

তালহা রাসূলকে ধরে ওঠালেন। দেখলেন, তিনি সম্পূর্ণ স্বজ্ঞানে আছেন। এ ঘটনা সাহাবিদের মধ্যে এমন প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া ও বেদনার সৃষ্টি করল যে, এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলল তারা। জীবনের প্রতি মায়া- মমতাহীন মুষ্টিমেয় সাহাবি যখন এরপর কুরাইশদের দিকে ফিরে তাকাল, সে দৃষ্টির বর্ণনা করতে পারে—এমন কোনো ভাষা পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। এসব সাহাবিরা তখন আক্রমণ প্রতিহত করার পরিবর্তে নিজেরাই কুরাইশদের ওপর আহত সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। গুটিকয়েক সাহাবির রণ-হুংকার ও আক্রমণ এত বেপরোয়া ও ভয়ংকর ছিল যে, কুরাইশরা তাদের এ ভয়ানক রূপ দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল।

ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি রাগে-দুঃখে বারবার বলছিলেন—’আমি আমার ভাইকে হত্যা করে তার শরীরকে টুকরো টুকরো করে এর প্রতিশোধ নেব! বেইমানের এত বড়ো আস্পর্ধা! সে আমার সামনে আমার নবিজিকে আক্রমণ করে!’ তিনি কুরাইশদের পেছনে এমন বেপরোয়া ধাওয়া করেন যে, তাকে ফেরানো মুশকিল হয়ে গেল। অবশেষে রাসূল (সাঃ) এ নিজে হস্তক্ষেপ করে অতি কষ্টে তাকে থামালেন। রাসূল (সাঃ) নিজে যদি তাকে না থামাতেন, তবে তিনি কখনো থামতেন না।

দীর্ঘক্ষণ ধরে একনাগাড়ে যুদ্ধের ফলে কুরাইশরাও ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হলো। সাহাবিগণ রাসূলে করিমের সেবাযত্নে মনোযোগ দিলেন। মহিলা সাহাবি দুজন হুজুর-কে পানি পান করালেন এবং কাপড় দিয়ে আহত স্থানগুলো পরিষ্কার করলেন। দেখা গেল, লৌহ শিরস্ত্রাণের শিকলের টুকরো হুজুরের গালের হাড় পর্যন্ত বিঁধে আছে। সাহাবি আবু ওবায়দা লোহার সে টুকরো বের করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাত দিয়ে টানটানি করে বের করতে না পেরে শেষে দাঁত দিয়ে কামড়ে একটি টুকরো বের করে আনলেন। কিন্তু দ্বিতীয় টুকরাটি যখন বের করতে চেষ্টা করেন, তখন তাঁর সামনের দু-টি দাঁত ভেঙে যায়। পরে লোকেরা আবু ওবায়দাকে ‘আল আহরাম’ বলা শুরু করল, যার অর্থ হলো—’দুই-দাঁত হারা ব্যক্তি’। ইতিহাসে এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।

রাসূলে আকরামের শিশুকালের ধাত্রী উম্মে আয়মান হুজুরের অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রাসূলের দিকে ঝুঁকে ব্যাকুল চিত্তে অবস্থা লক্ষ করছিলেন। হঠাৎ একটা তির এসে উম্মে আয়মানের পেটে বিদ্ধ হলো, সঙ্গে সঙ্গে দূরে খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল। চমকে সকলেই সে দিকে ফিরে দেখলেন, হুব্বান ইবনুল আবকা দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে; তার হাতে ধনুক, তিরটি সেই চালিয়েছে। সে হেসে সরে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরছে, রাসূলে আকরাম একটি তির সাদের হাতে দিয়ে বললেন—’এই লোক যেন এখান থেকে এই তির নিয়ে ফিরে না যায়।’ সাদ ধনুকে তির টেনে হুব্বানের প্রতি ছুড়লেন, তিরটি হুব্বানের ঘাড়ে গিয়ে বিঁধে গেল। সাদ ও অন্যান্য সাহাবিদের চেহারায় ফুটে উঠল স্বস্তির হাসি। হুব্বান দুলতে দুলতে কয়েক পা এগিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

এসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে খালিদ এগিয়ে চলেছে মদিনার দিকে। উহুদ পাহাড় ক্রমেই নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে, সহসা কয়েকজন সঙ্গীর কথা মনে পড়ল তাঁর। সে দেখেছে, বিশ্বাসের পার্থক্য কেমন করে ভাইকে ভাইয়ের শত্রু বানায়। খালিদের ধারণা ছিল-লোকেরা তাদের বিশ্বাস ও মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করে বেড়ায় সেই মতবাদ ও বিশ্বাসের নেতা সাজার জন্য। কিন্তু মুসলমানদের খুব কাছ থেকে ও গভীরভাবে দেখে খালিদের মনে হলো, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা একটি ভিন্ন জিনিস। এ নিয়ামত সবার ভাগ্যে জোটে না।

একটি প্রশ্ন তাকে আবার অস্থির করে তুলল—’আমি মদিনা যাচ্ছি কেন? আমার নিজের মতকে মদিনাবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিতে, নাকি তাদের মতবাদ ও বিশ্বাস নিজের ওপরে চাপিয়ে নিতে?’

গতকাল আবু সুফিয়ান তাকে জিজ্ঞেস করেছিল—’এটা কি সত্যি, তুমি মদিনা যাচ্ছ? ওয়ালিদের শোণিতধারা কি তোমার শিরা থেকে মুছে গেল?’

মদিনার উদ্দেশ্যে যখন থেকে সে মরুভূমির ধুলো উড়ানো শুরু করেছিল, তখন থেকেই এ শব্দগুলো তাকে তাড়া করে ফিরছিল। বলতে গেলে পুরো পথটাই এসব শব্দ তাকে অনুসরণ করেছে। আর এর সাথে লড়াই করতে গিয়ে সেই সব বন্ধুদের কথা তাঁর স্মরণে এলো, একসময় যাদের বিরুদ্ধে সে লড়াই করেছে, তাদের রক্তের স্রোতধারা বইতে দেখেছে সে মরুভূমির তপ্ত বালিরাশিতে এদেরই একজন ছিলেন মাসআব বিন আমির।

কুরাইশরা যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে বেশ কিছুদূর চলে এসেছে। খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে আবু সুফিয়ানকে ধরল। বলল—’তোমরা যুদ্ধের অর্ধেকটা রেখে কোথায় যাচ্ছ? এখন মুসলমানদের নিশ্বাস তো শেষ পর্যায়ে।’ আবু সুফিয়ান ও চাচ্ছিল, এ যুদ্ধেই মুসলমানদের সাথে শেষ ফয়সালা করতে। ইসলামের নাম-নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে মুছে দিতে। এ কথায় তারা আবার ফিরে এসেছিল ময়দানে। আবু সুফিয়ান খালিদকে তাঁর বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই এসেছিল নবি করিমের ওপর আক্রমণ করতে।

ইবনে কামআ লড়াই করতে করতে মুসলমানদের বেষ্টনী ভেঙে রাসূল (সাঃ)-এর  কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছিল। সে সময় রাসূলে আকরাম-এর কাছে ছিলেন মাসআব বিন আমির ও উম্মে আম্মারা। উম্মে আম্মারা আহতদের পানি পান করাচ্ছিলেন। তিনি যখন কুরাইশদের আবার হামলা করতে দেখলেন, তখন এক আহত মুজাহিদের তরবারি উঠিয়ে কুরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। কুরাইশের প্রথম যে আরোহীটি তার কাছে এলো—তিনি তার নাগাল না পেয়ে তলোয়ার দিয়ে তার ঘোড়ার ওপর এমন আঘাত করলেন যে ঘোড়াটিই শুয়ে পড়ল, আরোহী ঘোড়ার অপরদিকে ছিটকে পড়ল। উম্মে আম্মারা ঘোড়ার ওপর দিয়েই লাফিয়ে কুরাইশ লোকটিকে আঘাত হানল। আহত অশ্বারোহী কোনো রকমে উঠেই দৌড়ে পালাল।

মাসআব বিন আমিরের শরীরের গঠন ও আকৃতির সাথে রাসূলে কারিমের চেহারায় বেশ সাদৃশ্য ছিল। ইবনে কামআ মাসআব-কে রাসূলে আকরাম মনে করে তাঁর ওপর আক্রমণ করে বসল। মাসআব প্রস্তুত ছিলেন, তিনি ইবনে কামআর আঘাত ফিরিয়ে দিলেন। এরপর কিছুক্ষণ দুজনের তলোয়ার ক্রমাগত ঠোকাঠুকি করে চলল। অকস্মাৎ ইবনে কামআ এমন একটি আঘাত করল, যা তিনি আর ফেরাতে পারলেন না। আঘাত খেয়েই পড়ে গেলেন তিনি এবং সঙ্গে সঙ্গে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। উম্মে আম্মারা মাসআবকে পড়ে যেতে দেখে রাগে গর্জন করে ইবনে কামআর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইবনে কামআ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক যোদ্ধা আর আঘাতকারিণী একজন মহিলা হওয়ায় সহজেই সে আত্মরক্ষা করে পালটা আঘাত হানল। উম্মে আম্মারা কাঁধে আঘাত পেলেন এবং সামান্য মোকাবিলা করে আহত হয়ে পড়ে গেলেন।

রাসূলে করিম (সাঃ) এগিয়ে এলেন ইবনে কামআর মোকাবিলায়। ইবনে কামআ রাসূলের ওপর প্রচণ্ড জোরে আঘাত হানল। আঘাতটি রাসূলের কাঁধে সামান্য জখম সৃষ্টি করে বর্মের ওপর দিয়ে পিছলে যায়। রাসূলের পেছনে ছিল একটা গর্ত, তিনি আহত হয়ে পিছু সরতে গিয়ে গর্তে পড়ে যান। ইবনে কামআ পেছন ফিরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল—’আমি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি! এরপর সে আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করতে করতে যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেল।

তার চিৎকারধ্বনি কুরাইশ ও মুসলমানরা উভয়েই শুনতে পেল। কুরাইশদের জন্য এ ছিল যেমন খুশির খবর, তেমনি মুসলমানদের জন্য ছিল অন্তহীন বেদনা ও চরম বিপর্যয়ের। এ চিৎকার মুসলমানদের জন্য ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর ও মর্মান্তিক আঘাত। যুদ্ধের ময়দানে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ল। মুসলমানরা সাহস হারিয়ে উহুদের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে সরে যেতে লাগল।

পলায়নরত মুসলমানদের সামনে সাবধান বাণী শোনা গেল, ‘ওহে নবির প্রেমিকরা! ‘যদি নবি না থাকেন, তবে আমাদের ওপর অভিশাপ। কারণ, আমরা যারা এখনও জীবিত আছি, আমরা কেমন নবির প্রেমিক? নবিজির শাহাদাতের সঙ্গে সঙ্গে তোমরাও শাহাদাতের পেয়ালা পান না করে কাপুরুষের মতো মৃত্যুভয়ে কোথায় পালিয়ে যাচ্ছ?’

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পলায়নপর মুসলমানরা। এই উদ্দীপ্ত আহ্বান তাদের মনে নতুন করে আগুন ধরিয়ে দিলো। মানুষের মধ্যে যখন মরণের ভয় থাকে না, তখন তাদের সাহসের কোনো অভাব হয় না। এসব মুজাহিদদের সাথে কোনো ঘোড়া ছিল না বটে, কিন্তু তাতে কি! তারা অসামান্য ক্ষিপ্রতা ও তীব্রতা নিয়ে খালিদ ও আকরামার অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে বসল। সে আক্রমণের তীব্রতার বর্ণনা দেওয়ার কোনো ভাষা খালিদের জানা নেই। এখনও মুজাহিদদের দৃঢ়তা ও দুঃসাহসের কথা মনে হলে খালিদের শরীর শিউরে ওঠে।

খালিদের আজ একে একে মনে পড়ছে তাঁর হাতে নিহত হওয়া মুসলমানদের কথা। তাদেরই একজন ছিলেন রাফাআ বিন ওয়াকাশ। খালিদের অশান্ত চিত্তে বেদনার ঢেউ উঠল। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগল হৃদয়-মন। সে অনুভব করল—এতদিন সে শুধু উদ্দেশ্যহীনভাবেই রক্ত প্রবাহিত করেছে, কিন্তু এ ছাড়া তাঁর উপায়ই-বা কী ছিল! কারণ, সে সময় তো মুসলমানদেরই তাঁর সবচেয়ে বড়ো শত্রু মনে হতো!

মুসলমানদের শক্তি তখন নিঃশেষ হয়ে এসেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন পদাতিক আর কতক্ষণ বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবে! তারা নিরুপায় হয়ে পার্বত্য অঞ্চলের দিকে পিছু হটতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)নিজেও এক সংকীর্ণ প্রান্তরের দিকে সরে যাচ্ছেন। যুদ্ধের গতি এখন পুরো উলটো দিকে। একটু আগে মুসলমানরা যেমন গনিমতের মাল লুট করার জন্য ছুটোছুটি করছিল, ঠিক তেমনি কুরাইশরাও এখন মুসলমানদের লাশ ও আহতদের আর্তনাদ উপেক্ষা করে গনিমতের মাল সংগ্রহ করতে উঠেপড়ে লেগে গেছে, তবে এর মধ্যেও কিছু কুরাইশ গনিমতের লোভ সংবরণ করে রাসূলের পেছনে ছুটে গেল। রাসূলের প্রিয় সাহাবিরা অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা ও দৃঢ়তায় তাদের মোকাবিলা করল। তারা হামলাকারী কুরাইশদের ওপর এমন প্রাণপণ আক্রমণ চালাল যে, তাতে ধাওয়াকারীদের প্রায় সকলেই নিহত হয়ে গেল। তবে সামনে সাক্ষাৎ মরণ দেখে যারা প্রাণ নিয়ে পেছন থেকে পালিয়ে গেল, তারা কোনো রকমে বেঁচে গেল।

রাসূল (সাঃ) এ প্রান্তর পার হয়ে একটি উঁচু স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখান থেকে তিনি যুদ্ধের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে নবিজির সঙ্গী ত্রিশজন সাহাবির মধ্যে শহিদ হয়ে গেছেন ষোলোজন। যে চৌদ্দজন এখনও বেঁচে আছেন, তারা সবাই কমবেশি আহত। প্রায় প্রত্যেকের শরীর থেকেই রক্ত ঝরছে। তিনি সেখান থেকে গভীরভাবে যুদ্ধের ময়দান নিরীক্ষণ করলেন। দেখলেন, যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও আর কোনো মুসলমান দেখা যাচ্ছে না। রাসূল (সাঃ) শহিদ হয়ে গেছেন-এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় মুসলমানদের মধ্যে গভীর নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে যে যেদিকে পারে উদ্‌ভ্রান্তের মতো সরে পড়েছিল। এদের কেউ কেউ ফিরে গেছে মদিনায়। কেউ-বা কুরাইশদের প্রতিশোধের ভয়ে পাহাড়ের কোনো গোপন স্থানে গিয়ে আত্মগোপন করে আছে।

রাসূল (সাঃ) এ এবার আহতদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। নবিকন্যা ফাতিমা আনহা পিতাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান-পেরেশান হয়ে একেবারেই লবেজান হয়ে পড়েছেন। যখন তাঁর পা আর কিছুতেই চলছে না, এমন সময় তিনি নবিজিকে দেখতে পেলেন এবং ক্লান্ত পায়ে ছুটে গেলেন তাঁর কাছে। হজরত আলি পাশের এক ঝরনা থেকে পানি এনে হুজুর এ-কে পান করালেন। ফাতিমা

পিতার আহত স্থানগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে লাগলেন, আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

খালিদের মনে আছে, রাসূলে করিমের শাহাদাতের খবর শুনে তিনি আত্মায় শান্তি অনুভব করেছিলেন, কিন্তু সে শান্তি নষ্ট করে দিলো একটি হুংকার। সমস্ত প্রান্তরজুড়ে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল সে গর্জন। কেউ একজন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল—’হে মুসলমানগণ, তোমরা আনন্দিত হও! আমাদের নবি জীবিত আছেন! সুস্থ আছেন!’ এই উদাত্ত ঘোষণায় প্রথমে চমকে উঠেছিল খালিদ। তারপর তাঁর যেমন হাসি এলো, তেমনি দুঃখও হলো। সে নিজেকেই নিজে বলল—’কোনো মুসলমান কি পাগল হয়ে গেছে?’

ঘটনাটি ছিল এ রকম—মুসলমান দু-একজন তখনও আরও ভালো জায়গায় লুকানোর আশায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে কাব বিন মালিক

পাহাড়ের সেই জায়গায় এসে পৌঁছলেন, যেখানে রাসূল (সাঃ) বিশ্রাম করছিলেন। তিনি নবিজিকে দেখতে পেয়ে আনন্দে উদ্‌বেলিত হয়ে উঠলেন এবং জোরে তাকবির ধ্বনি দিলেন। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগলেন—’আমাদের নবি জীবিত আছেন! আমাদের নবি জীবিত আছেন!’ যেসব মুসলমান ছিন্নভিন্ন হয়ে পাহাড়ের খাঁজে এখানে-ওখানে লুকিয়ে ছিল, এই ঘোষণা শুনে সবাই দৌড়ে সেখানে ছুটে এলো। হজরত উমর দৌড়ে রাসূলের কাছে এসে পৌঁছলেন।

কুরাইশ সেনাপতি আবু সুফিয়ান যুদ্ধের ময়দানে পড়ে থাকা লাশগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। রাসূলে করিমের পবিত্র দেহ মোবারক খুঁজছিলেন তিনি। সামনে যাকে পেতেন, তাকেই জিজ্ঞেস করতেন—’তুমি কি মুহাম্মাদের লাশ দেখেছ?’

একসময় খালিদকে সামনে পেয়ে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন—’তুমি কি মুহাম্মদের লাশ দেখেছ?’

‘না!’ খালিদ উত্তর দিলো। আবু সুফিয়ানের দিকে সামান্য ঝুঁকে খালিদ প্রশ্ন করল—’আপনি কি নিশ্চিত, মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছেন?’

আবু সুফিয়ান উত্তর দিলো—’হ্যাঁ! সে আমাদের আক্রমণ থেকে বেঁচে কোথায় যাবে? কেন, তোমার কি এ ব্যাপারে সন্দেহ হয়?’

খালিদ উত্তর দিয়েছিল—’হ্যা, আবু সুফিয়ান! আমার সন্দেহ দূর হবে না, যতক্ষণ আমি নিজ চোখে তাঁর লাশ দেখতে না পাব। মুহাম্মাদ (সাঃ) এত সহজেই নিহত হওয়ার লোক নয়।’

আবু সুফিয়ান গর্বের সাথে বলল—’মনে হচ্ছে তোমার ওপর মুহাম্মদের জাদুর প্রভাব পড়েছে? মুহাম্মাদ (সাঃ) কি আমাদেরই কেউ নয়? তুমি কি তাকে চেনো না? যে ব্যক্তি এত হত্যাযজ্ঞের নায়ক, একদিন তাকেও নিহত হতে হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (সাঃ) নিহত হয়েছে। যাও, তাঁর লাশ খুঁজে বের করো, আমি তাঁর মাথা কেটে মক্কায় নিয়ে যাব।’

ঠিক সেই সময়ই পার্বত্য এলাকা থেকে কাব বিন মালিকের উদাত্ত কণ্ঠে ধ্বনিত হলো——হে মুসলমানগণ, তোমরা আনন্দিত হও! আমাদের নবি জীবিত আছেন! সুস্থ আছেন!’ এ শব্দ যেন বিজলির মতো চমক তুলে কড়কড় শব্দে গর্জন করে আদিগন্ত প্রান্তর ছেয়ে ফেলল।

খালিদ বলল—’শুনেছ আবু সুফিয়ান!’ এখন বুঝলে মুহাম্মাদ (সাঃ) কোথায়? লাশের মাঝে তাকে খুঁজে পাবে না। তুমি চাও তো, আমি তাকে আক্রমণ করতে যেতে পারি। কিন্তু তোমাকে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারব না, আমি মুহাম্মাদকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করতে পারব।’

খালিদ একটু আগেই সাহাবিদের নিয়ে রাসূলে করিমকে পাহাড়ের আড়ালে চলে যেতে দেখেছে, কিন্তু সে অনেক দূরে। খালিদ নতি স্বীকার করার বা সংকল্প শিথিল করার লোক নয়। সে কিছু অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের সেই জায়গার দিকে অগ্রসর হতে থাকল, যেদিকে রাসূলে করিমকে সে যেতে দেখেছে। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের লেখা থেকে জানা যায়—রাসূলুল্লাহ (সাঃ)এ যখন খালিদ ও তাঁর সাথিদের পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আসতে দেখলেন, নবিজির মুখ থেকে সহসা বের হয়ে গেল—’আল্লাহ জুলজালাল, ওকে তুমি ওখানেই থামিয়ে দাও।’

খালিদ তাঁর অশ্বারোহীদের সঙ্গে নিয়ে সংকীর্ণ পথ বেয়ে ওপরে উঠছিল। পথ ক্রমশ এতটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে যে, ঘোড়াগুলোকে এক লাইনে চালাতে হচ্ছিল। রাসূলে করিম (সাঃ) ক্ষতের যন্ত্রণায় চুর হয়ে পড়েছিলেন। হজরত উমর খালিদ ও তাঁর অশ্বারোহীদের ওপরে আসতে দেখে তলোয়ার বের করে নিচে নামলেন।

হজরত উমর গর্জে উঠলেন—’দ্যাখ! ওয়ালিদের বেটা। যদি লড়াই করা জানিস, তবে এই সংকীর্ণ গিরিপথ দেখে নে, এর প্রশস্ততা দেখে নে। তোর অশ্বারোহীসহ কেউ কি আমার হাত থেকে এখন জীবিত ফিরে যেতে পারবি?’

খালিদ যুদ্ধের কৌশল ভালো করেই জানত। সে দেখল, যে জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে-সেখানে দাঁড়িয়ে ঘোড়া নিয়ে লড়াই করা আসলেই অসম্ভব। জায়গাটি খুবই ভয়াবহ। খালিদ নীরবে ঘোড়া ফিরিয়ে নিল, সেখান থেকে ফিরে গেল সাথিদের নিয়ে।

উহুদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু শেষ হয়েছে চূড়ান্ত মিমাংসা ছাড়াই। নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে কুরাইশরা যতটুকু করেছে—তাতে তারা হয়তো এতটুকু দাবি করতে পারে যে, তারা মুসলমানদের বেশি ক্ষতি করতে পেরেছে। কিন্তু মুসলমানদের নির্মূল করার যে স্বপ্ন তাদের ছিল, সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। যে উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বিশাল বাহিনী নিয়ে ছুটে এসেছিল, সে উদ্দশ্য সফল না করেই ফিরে যেতে হয়েছে তাদের। ফলে খালিদের বারবারই মনে হয়েছে, এই যুদ্ধ হারজিত ছাড়াই শেষ হয়েছে।

পথ চলতে চলতে খালিদ মনে মনে বলল—আসলে কি তাই! এ যুদ্ধ কি সত্যিই হার-জিত ছাড়াই শেষ হয়েছে? না, এ যুদ্ধে আসলে আমাদেরই পরাজয় হয়েছিল। মুসলমানদের সৈন্য ছিল মাত্র সাতশো আর আমাদের ছিল তিন হাজার! কুরাইশদের অশ্বারোহী ছিল দুশো, মুসলমানদের ছিল দুজন। একটি শিশুকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এ রকম অবস্থায় কারা জিতবে? চোখ বন্ধ করেই সে নির্দ্বিধায় বলবে—কুরাইশরা। যদি কোনো সাধারণ মানুষকে এ প্রশ্ন করা হয়, সেও ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বলবে—কুরাইশরা। যেকোনো হিসেবেই আমাদের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত, কিন্তু আমরা সব হিসাব ভুল প্রমাণ করেছি। এ যুদ্ধে আমাদের বিজয় তখনই হতো, যদি নবি মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারতাম।

একটি মাত্র লোক, কিছুদিন আগেও যে ছিল আমাদেরই একজন, যে লোকটি এতিম, যে লোকটি স্বজনহারা, সেই একটি লোককে হত্যা করার জন্য আরবের সম্মিলিত বিশাল বাহিনী নিয়ে এসে তাঁর লাশ ছাড়া ফিরে যাওয়ার পরও কি কেউ বলবে—আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম? যুদ্ধে আসার সময় মক্কার বীর যোদ্ধারা বুক ফুলিয়ে নিজ নিজ নারীদের কাছে গর্ব করে বলেছিল—’হাসিমুখে বিদায় দাও, মুহাম্মদের মস্তক আনা গাছ থেকে খেজুর পাড়ার চাইতে কঠিন কাজ তো নয়, সেই নারীদের কাছে মাথা নিচু করে ফিরে আসার পরও কি বলতে হবে আমরা বিজয়ী হয়েছি! যে যোদ্ধা যুদ্ধ থেকে ফেরত এসে আপন বধূ-মাতা-ভগ্নিদের ধিক্কার কুড়ায়, তার মতো অধম আর কে আছে? উহুদের পাহাড় আর প্রান্তরের বালিয়াড়ি যেমন সাক্ষী আমাদের পরাজয়ের, তেমনি সাক্ষী মক্কার ধূলিকণা, ঘরের অবলা নারী।

খালিদের চিন্তা-তরঙ্গে বয়ে যাচ্ছে অজস্র হিন্দোল। ঢেউয়ের দোদুল দোলায় ভাসছে ভাবের সহস্র বুদবুদ। ভাবনার এতসব ঘুরপাকে পড়ে নিজেই অস্বস্তি. বোধ করল সে। বারবার এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল। অবশেষে দাঁত কটমট করে জোরে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকাল। চোখের সামনে ভেসে উঠল যুদ্ধের শেষ দৃশ্য। সে এই ভয়াবহ স্মৃতি মন থেকে মুছে দিতে যতই মাথা ঝাঁকায়, সাগরে ঢেউ তোলার মতো সেই স্মৃতি হৃদয়-সমুদ্রে আরও জোরে তোলপাড় তোলে। মনে মনে তাঁর খুব লজ্জাবোধ হতে লাগল। যুদ্ধবাজরা কখনো এমন করে না।

খালিদ যখন উমর-এর ধমক খেয়ে ফিরে আসছিল, তখন সেই পাহাড়ের উপত্যকা থেকে তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল যুদ্ধের ময়দানে। সেখানে তখন ছড়ানো- ছিটানো অজস্র লাশ। হয়তো কেউ কেউ তখনও পুরোপুরি মারা যায়নি, আহত ও অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। লাশ ও আহতদের উঠানোর জন্য না কোনো মুসলমান এগিয়ে এলো, না কোনো কুরাইশ। খালিদের চোখ আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাকে দেখতে পেল সেই লাশ ও আহতদের সমুদ্রে। সে হাতে ছোরা নিয়ে দৌড়াচ্ছে ময়দানময়। তার সঙ্গে তাল রেখে তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে তার সখী, বাদি ও যুদ্ধে আসা অন্যান্য মহিলারাও।

হিন্দা ছিল দশাসই চেহারার জাঁদরেল মহিলা। যেমন বলিষ্ঠ শরীর, তেমনি শক্ত-সামর্থ্য। সে এক লাশ থেকে আরেক লাশের পাশে ছুটে যাচ্ছিল এবং প্রতিটি লাশ খুটে খুটে দেখছিল। কোনো কোনো লাশ মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল, সে পা দিয়ে ঠেলে সেই লাশ সোজা করে দেখত। সে সঙ্গিনীদের বারবার তাগাদা দিয়ে বলতে লাগল—’জলদি খোঁজো, জলদি খোঁজো, হামজার লাশ খুঁজে বের করতেই হবে।’

এভাবে হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে একসময় সে হামজা-এর লাশ পেয়ে গেল। ক্ষুধার্ত পশুর মতো সেই লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। কেটে- ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে লাগল হামজা-এর লাশ। সেইসব টুকরো সে ছুড়ে ফেলতে লাগল এদিক-ওদিক। অন্যান্য মহিলারা হতবাক হয়ে দেখছিল এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সে অন্য মহিলাদের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে লাগল—’এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস তোরা?’ মহিলাদের মনে হলো হিন্দা পাগল হয়ে গেছে। ‘এই দেখ, আমি আমার বাবার, আমার চাচা ও আমার ছেলের খুনির লাশকে কী অবস্থা করে দিলাম! যা, মুসলমানদের প্রত্যেক লাশের এমনি অবস্থা কর। প্রত্যেকের কান কেটে আন, নাক কেটে আন। যা, জলদি যা, সর এখান থেকে বলছি।’

‘মহিলারা হিন্দার উন্মাদিনী রূপ দেখে ভয় পেয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল। হিন্দার ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ শহিদদের লাশগুলো টানা-হেঁচড়া করতে লাগল, কেউ-বা কাটাছেঁড়াও শুরু করল। হিন্দা আপন মনে হামজা-এর লাশ টুকরো টুকরো করতে লাগল। এবার সে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হামজা-এর বুক চিরে দুই ভাগ করে ফেলল। পাঁজরের হাড়ের ফাঁক দিয়ে হিন্দা তার হাত ঢুকিয়ে দিলো বুকের মধ্যে। যখন লাশের ভেতর থেকে হাত বের করে আনল, তখন দেখা গেল তার হাতে হামজা-এর কলিজা। টপটপ করে কলিজা থেকে রক্ত ঝরছিল, হিন্দা সেই রক্তাক্ত কলিজা টুকরো টুকরো করতে বসল এবার, কিন্তু কলিজা টুকরো করেও শান্ত হলো না তার মন। সে এবার হামজা-এর কলিজার টুকরো মুখে পুরে কুকুরের মতো চিবাতে লাগল। অন্যান্য মহিলারা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল হিন্দার দিকে। তারা দেখল, সে কলিজার একটি টুকরো গিলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই গিলতে পারছে না। তার গলা দিয়ে কিছুতেই টুকরোটি নিচে নামছে না। স্বস্তির বদলে হিন্দার চেহারা রাগে বীভৎস হয়ে উঠল। সে টুকরাটি মুখ থেকে বের করে ছুড়ে ফেলে দিলো দূরে।

খালিদ দেখতে পেল, আবু সুফিয়ান দূরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছে। হিন্দার এই পাশবিক কাণ্ড দেখে সে যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছে। খালিদ একজন যুদ্ধবাজ। সামানাসামনি লড়াই করে শত্রুকে হত্যা করতে তাঁর বাধে না। কিন্তু লাশের সাথে এমন দুর্ব্যবহার তাঁর মনকে বিষিয়ে তুলল। মানুষ এমন ঘৃণিত কাজ করতে পারে? লাশের ওপর এভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে? এভাবে কাঁচা মাংস চিবিয়ে খেতে পারে? এ অবস্থা দেখে তাঁর সারা শরীর রিরি করে উঠল। এ ঘটনায় সে মনে মনে খুবই কষ্ট পেল।

খালিদ ঘোড়া ছুটিয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে এলো। খালিদ রাগে ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে বলল—’আবু সুফিয়ান! তুমি কি তোমার স্ত্রীর এই ঘৃণিত ও পাশবিক কাজ পছন্দ করছ?’

আবু সুফিয়ান অসহায় দৃষ্টি মেলে খালিদের দিকে তাকাল।

‘চুপ করে আছ কেন আবু সুফিয়ান!’ খালিদ আবার বলল একই ভঙ্গিতে।

আবু সুফিয়ান অস্ফুট সরে বলল—’তুমি হিন্দাকে চেনো না খালিদ! ও এখন পাগলের চেয়েও উন্মাদিনী। এখন যদি আমি বা তুমি তার কাজে বাধা দিতে যাই, তবে সে আমাদের পেটও ছুরি দিয়ে ফেড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না।’

খালিদ হিন্দাকে ভালোমতোই জানত। সে আবু সুফিয়ানের অসহায়ত্ব বুঝতে পারল। আবু সুফিয়ান মাথা নিচু করে ঘোড়ার লাগাম টেনে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। খালিদও এ দৃশ্য সহ্য করতে পারল না, সেও সরে গেল ওখান থেকে।

যখন হিন্দা হামজা-এর কলিজা চিবিয়ে ছুড়ে ফেলছিল, তখন পেছনে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিল আরও একজন, জুবায়ের বিন মুতায়িমের-এর গোলাম ওয়াহশি বিন হারব। তার হাতে তখনও সেই আফ্রিকান বর্শা-যা দিয়ে সে হামজা-কে শহিদ করেছিল।

হিন্দা হারবকে দেখতে পেয়ে বলল—’এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ বিন হারব? যাও, মুসলমানদের লাশগুলো টুকরো টুকরো করো।’

ওয়াহশি বিন হারব খুব কম কথা বলে, চেষ্টা করে ইশারা ও ইঙ্গিতে কথা বলার। সে হিন্দার আদেশ মান্য করার পরিবর্তে তার হাত হিন্দার সামনে বাড়িয়ে দিলো। তার দৃষ্টি এখন লেপটে আছে হিন্দার গলায় পরা সোনার হারের দিকে হিন্দার মনে পড়ল তার প্রতিশ্রুতির কথা। সে ওয়াহশিকে বলেছিল—’যদি তুমি আমার বাবা, চাচা ও সন্তানের খুনিকে হত্যা করতে পারো, তবে আমার পরনে যত গহনা আছে সব তোমার হবে।’ এখন সে পুরস্কার নিতে এসেছে। হিন্দা তার সমস্ত গহনা খুলে ওয়াহশি বিন হারবের হাতে দিয়ে দিলো। ওয়াহশির ঠোঁটে হাসির আভা ফুটে উঠল, সে গহনা নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। হিন্দার সমগ্র চেতনায় তখন বিজয় ও প্রতিশোধের ভূত চেপে ছিল।

‘দাঁড়াও বিন হারব। শোনো, কাছে এসো।’ হিন্দা চেঁচিয়ে ডাকল হাবশি গোলামকে। যখন সে তার কাছে এলো তখন হিন্দা বলল—’আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার কলিজা ঠান্ডা করতে পারলে তোমাকে আমার গহনা দেবো, কিন্তু তুমি তার চেয়েও বেশি পাওয়ার হকদার।’ হিন্দা কুরাইশ মহিলাদের দিকে ইশারা করে বলল—’তুমি জানো এই নারীদের মধ্যে কে কে দাসী আছে, সেইসঙ্গে কে যুবতি ও সুন্দরী। তোমার যে দাসী ভালো লাগে, তাকে নিয়ে যাও।’

ওয়াহশি বিন হারব তার স্বভাবসিদ্ধ অবস্থায় নীরবে কিছুক্ষণ হিন্দার মুখের দিকে গভীরভাবে চেয়ে রইল। কিন্তু একবারও দাসীদের দিকে না তাকিয়ে সে

অবজ্ঞায় মাথা নত করে সেখান থেকে চলে গেল।

একটু পর যুদ্ধের সেই ভয়াবহ পরিবেশে হিন্দার ভরাট গলার সুমিষ্ট সুরের গান শোনা গেল। ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, সে সুমিষ্টি গানের ভাষা ছিল এ রকম—

‘আমি বদরের যুদ্ধের হিসাব এবার বুঝে পেয়েছি।
একটি রক্তাক্ত সমরের প্রতিশোধ রক্তাক্ত সমরেই নিয়েছি।
উতবা আমার পিতা, তার শোক আমার সহ্যের অতীত ছিল
আমার চাচার জন্য শোক ছিল, সন্তানের জন্য শোক ছিল
সে শোকের প্রতিশোধ নিয়ে এখন আমার বুক শীতল হয়েছে।
আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি।
ওয়াহশি আমার হৃদয় যাতনার ওষুধ দিয়েছে
আমি ওয়াহশির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব তত দিন-
যতদিন আমার হাড় মাটির সাথে মিশে না যাবে।’

আবু সুফিয়ান তার দুই সঙ্গীর সাথে আলাপ করছিল। বলছিল—’আমার বিশ্বাস হচ্ছে না মুহাম্মাদ (সাঃ) জীবিত আছে।’

‘খালিদ হয়তো দূর থেকে অন্য কাউকে দেখে মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে ভুল করেছে।’ বলল তার এক সঙ্গী।

আবু সুফিয়ান বলল—’আমি স্বচক্ষে দেখেছি, খালিদ অশ্বারোহীদের নিয়ে সেই সংকীর্ণ গিরিপথের দিকে গিয়েছিল, যেখান থেকে মুসলমানদের বসে থাকা দেখা যায়। সে গিরিপথ পার হয়নি, দূর থেকে মুসলমানদের দেখেই ফিরে এসেছে। ফলে তার দেখায় ভুল থাকা অসম্ভব নয়।’

আবু সুফিয়ান গিরিপথের গোড়ায় দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলল—’মুহাম্মাদের অনুসারীগণ! ‘তোমাদের মাঝে কি মুহাম্মাদ (সাঃ) বেঁচে আছে?’

রাসূলে করিম (সাঃ) সে শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি মুসলমানদের ইশারা করে চুপ থাকতে বললেন। আবু সুফিয়ান আরও জোরে আবারও বলল—’তোমাদের মাঝে কি মুহাম্মাদ (সাঃ) বেঁচে আছে?’

কিন্তু মুসলমানরা শুনতে পেয়েও তার কোনো জবাব দিলো না।

আবু সুফিয়ান এবার চিৎকার করে বলল-’আবু বকর কি তোমাদের মাঝে জীবিত আছে?’

এবারও তার কোনো জবাব দিলো না কেউ। তিনবার জিজ্ঞেস করেও কোনো জবাব না পেয়ে সে আবার ডাকল—’উমর! তুমি কি জীবিত আছ?’

মুসলমানরা নীরব।

আবু সুফিয়ান ঘোড়া ঘুরিয়ে নিচে নেমে এলো। সেখানে কুরাইশদের অনেক লোক জটলা করে রাসূলে আকরাম সম্পর্কে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা করছিল। কিন্তু নিশ্চিত করে কেউ সঠিক খবর বলতে পারছিল না। তারা আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে সঠিক খবর জানার জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল।

আবু সুফিয়ান চিৎকার করে বলল—’হে কুরাইশ সম্প্রদায়! মুহাম্মাদ (সাঃ) মরে গেছে; আবু বকর, উমরও বেঁচে নেই! এখন মুসলমানরা তোমাদের ছায়া দেখেও ভয় পাবে। আনন্দ করো! আনন্দে নাচো, গাও।’

কুরাইশরা আনন্দে নাচতে শুরু করল, কিন্তু সে কেবল মুহূর্ত কালের জন্য। হঠাৎ গিরিপথের ওপর থেকে কারও ভরাট কণ্ঠের এমন গর্জন ভেসে এলো যে তারা সব নীরব, নির্বাক এবং পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল।

‘হে আল্লাহর দুশমন!’ শোনা গেল হজরত উমর-এর কণ্ঠ, ‘মিথ্যা বলিস না আবু সুফিয়ান, যাদের তুই মৃত বললি—তাঁরা তিনজনই বেঁচে আছে। নিজের সম্প্রদায়কে ধোঁকা দিস না আবু সুফিয়ান। তোর পাপের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমরা সকলেই জীবিত আছি।’

আবু সুফিয়ান ব্যাঙের হাসি হেসে গলা উঁচু করে বলল—’হে ইবনুল খাত্তাব! তোর আল্লাহ তোকে যে এখনও আমাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সে জন্য শোকর কর। তুই কি আমাদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলছিস? আমাদের বীরেরা এমন স্বপ্ন বেশিদিন দেখার জন্য তোকে বাঁচিয়ে রাখবে ভাবিস না। আর মুহাম্মাদ (সাঃ) বেঁচে আছে বলে কেন মিথ্যা ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছিস?’

উমর তোর প্রতিটি কথাই তিনি শুনতে পাচ্ছেন।’

বললেন—’আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বেঁচে আছেন এবং আরবের প্রথা অনুযায়ী—যুদ্ধ শেষে দুই পক্ষের সরদার ও সেনাপতিরা একে অপরের ওপর তিরস্কার ও গালমন্দের তির বর্ষণ করত। আবু সুফিয়ান সেই প্রথা অনুযায়ী দূরে দাঁড়িয়ে হজরত উমর-এর সাথে কথা কাটাকাটি করতে থাকে।

‘হে ইবনুল খাত্তাব! তুই হোবল ও উজ্জার ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের খবর কি কিছুই জানিস না?’ বলল আবু সুফিয়ান।

হজরত উমর রাসূলে আকরামের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাসূল (সাঃ) ইশারায় তাকেই জবাব চালিয়ে যেতে বললেন।

গমগম করে বেজে উঠল হজরত উমর-এর কণ্ঠ। বললেন——হে বাতিলের পূজারি! আল্লাহ তো সেই সত্তা, এ বিশ্ব চরারের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা। অহমিকার পর্দা ছিঁড়ে যদি বেরিয়ে আসতে পারতি, তবে তুইও দেখতে পেতি আল্লাহ কত বড়ো শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী!’

আবু সুফিয়ান বলল—’আমাদের দেবতা যেমন হোবল এবং দেবী উজ্জা, তোমাদের কি তেমন কোনো দেবতা ও দেবী আছে?’

‘যে দেবতার দেবী ছাড়া চলে না, আর দেবীর চলে না দেবতা ছাড়া, তেমন পরমুখাপেক্ষী দেবতার আমাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের আছে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ! যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অমুখাপেক্ষী। তোমাদের তো তেমন কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ আল্লাহ নেই।’

আবু সুফিয়ান বলল—’এবারের মতো যুদ্ধ তো শেষ হলো, তোমাদের বদরের ময়দানে আমাদের যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছিলে, এবার এই পাহাড়ের পাদদেশে আমরা তোমাদের থেকে তার প্রতিশোধ নিলাম। আগামী বছর আমরা তোমাদের আবার বদরের ময়দানে যুদ্ধের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’

হজরত উমর জবাব দিলেন—’ইনশাআল্লাহ! তোমাদের যদি আবারও ধোলাই খাওয়ার শখ হয়ে থাকে, তাহলে সে আশা পূরণ করার জন্য আমরা অবশ্যই বদরের ময়দানে হাজির হব। সেদিন আবার বলো না যে আমরা তোমাদের বেইজ্জতি করেছি; বরং বোকারা যেমন নিজের দুর্গতি নিজেই ডেকে আনে, তোমাদের দুর্গতিও হবে তোমাদেরই হাতের কামাই।’

আবু সুফিয়ান ঘোড়া ফিরিয়ে দুই কদম অগ্রসর হয়েই আবার ঘোড়া থামাল। পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল—’হে উমর, আবু বকর ও মুহাম্মাদ।’ আবু সুফিয়ানের কণ্ঠ এখন যথেষ্ট মার্জিত ও নরম, ‘তোমরা যখন ময়দান থেকে লাশ তুলবে, তখন এমন কিছু লাশ পাবে—যাদের অঙ্গ কাটা-ছেঁড়া। আল্লাহর কসম! আমি কোনো লাশ বিকৃত করার হুকুম দিইনি এবং লাশের সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার পছন্দও করি না। এ ব্যাপারে আমার ওপর কোনো দোষ চাপালে আমার ওপর জুলুম করা হবে।’ আবু সুফিয়ান মুখ ঘুরিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

উহুদ পাহাড়ের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে খালিদ। মদিনা আর খুব বেশি দূরে নেই। যেতে যেতে খালিদের ঘোড়া নিজে নিজেই দিক পরিবর্তন করল। খালিদ বাধা দিলো না। সে বুঝতে পারল, ঘোড়াটি কোনো পানির সন্ধান পেয়েছে।

কিছুদূর গিয়ে ঘোড়া নিচের দিকে নেমে যেতে লাগল। খালিদের মনে পড়ে গেল এই জায়গার কথা। উহুদ যুদ্ধের পর ফেরার পথে কুরাইশরা এখানে থেমেছিল বিশ্রামের জন্য। নিচে পানির বিশেষ উৎস মজুদ ছিল।

ঘোড়া খুব দ্রুত সে পানির ঘাটে নেমে গিয়ে থামল। খালিদ ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামল এবং অঞ্জলি ভরে মুখে পানি ছেটাল। এরপর একটু বিশ্রামের জন্য উপত্যকার এক বৃক্ষের ছায়ায় বসে পড়ল।

তার সেই সময়ের কথা মনে পড়ছে, যখন উহুদের যুদ্ধ শেষে কুরাইশরা ফিরে এসেছিল এখানে। এখানে বিশ্রাম করার সময়ই কুরাইশ সরদারদের মাঝে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। একদল বলছিল, মুসলমানদের সাথে বোঝাপড়া শেষ না করে, দুনিয়ার বুক থেকে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর নতুন ধর্মকে নিশ্চিহ্ন না করে তারা মক্কায় ফিরে যাবে না। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিয়ে তারা মুসলমানদের ওপর আরও একবার আক্রমণ চালাবে এখান থেকে। সাফওয়ান বিন উমাইয়া বলল—’আমরা পরাজয় বরণ করে আসিনি। যদি তোমরা মনে করো যে মুসলমানের অবস্থা খুবই খারাপ, তবে নিজেদের অবস্থা দেখ; আমাদের অবস্থাও ভালো নেই। মুসলমানদের সঙ্গে এত তাড়াতাড়ি আবার যুদ্ধ বাধানোর বিপদ মাথায় নেওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। এক্ষুনি আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে এমনও তো হতে পারে, ভাগ্য আমাদের পক্ষে না-ও থাকতে পারে।’

কুরাইশদের মধ্যে যখন এই বিতর্ক চলছিল, তখন কয়েকজন লোক দুজন পথিককে ধরে নিয়ে সরদারদের সামনে হাজির করে বলল— এই দুজন লোক যারা নিজেদের পথিক বলছে, এরা আমাদের তাঁবুর আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। এমন সময় আমাদের চার-পাঁচজন লোক তাদের জিজ্ঞেস করে— ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ তারা এমন এক জায়গার নাম বলল, যে জায়গা আমাদের কেউ চেনে না।’

আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য সরদাররা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করল। এবারও তারা একই উত্তর দিলো। তখন আবু সুফিয়ানের ইশারায় তাদের দেহ তল্লাশি করা হলো। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেল ছোরা ও তরবারি। তাদের জিজ্ঞেস করা হলো—’তোমরা এই অস্ত্র গোপন করে রেখেছিলে কেন?’

তারা এর কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। খালিদের সন্দেহ হলো—এরা মুসলমানদের গোয়েন্দা। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হলো কুরাইশ সৈন্যদের সামনে। তাদের দাঁড় করিয়ে কুরাইশ সৈন্যদের জিজ্ঞেস করা হলো—’এদের কেউ চেনো?’

দুই-তিনজন উত্তর দিলো—’আমরা এদের চিনি, এরা মদিনার বাসিন্দা।’

কুরাইশের এক ব্যক্তি উঠে বলল—’এদের একজনকে আমি ভালোমতোই জানি। ওকে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখেছি।’

আবু সুফিয়ান দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল—’তোমরা যদি নিজের মুখে স্বীকার করো তোমরা মুহাম্মাদের গোয়েন্দা, তাহলে আমি তোমাদের বাঁচানোর জিম্মা নিলাম।’

দুজনের একজন স্বীকার করল।

‘যাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করলাম।’ আবু সুফিয়ান বলল।

এ দুজন মূলত মুসলমানদের গোয়েন্দা ছিল এবং তারা কুরাইশদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য নিতে এসেছিল। ছাড়া পেয়ে ওরা দুজন হাসিমুখে তাদের উটের দিকে চলে যাচ্ছিল। আবু সুফিয়ানের ইঙ্গিতে তিরন্দাজরা দুজনের ওপর পেছন থেকে তির চালাল। ওরা তির খেয়ে পড়ে গেল আর উঠতে পারল না।

আবু সুফিয়ান তার পাশে দাঁড়ানো সরদারদের বলল—’তোমরা কি এর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছ? ‘গোয়েন্দা পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো—মুসলমানরা হেরে যায়নি, তারা এক্ষুনি বা কিছুক্ষণের মধ্যে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে। আমার নির্দেশ হচ্ছে, তোমরা জলদি মক্কায় রওনা হও এবং আগামীতে যুদ্ধের জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নাও।’

পরের দিন রাসূলে করিম (সাঃ) এ সংবাদ পেলেন—কুরাইশরা যেখানে অবস্থান করেছিল, সেখানে তারা দুজন গোয়েন্দাকে হত্যা করে লাশ ফেলে মক্কায় চলে গেছে।

খালিদ এই প্রথম বড়ো কোনো যুদ্ধে লড়াই করল। সে বুঝতে পারল, তারা মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি। চার বছর পর আজও তাঁর চিন্তা-চেতনা বলছে, মুসলমানদের এই শক্তি কোনো সাধারণ শক্তি নয়। এ শক্তির পেছনে রয়েছে কোনো নিগূঢ় গোপন রহস্য, যে রহস্য আজও সে জানতে পারেনি। তাঁর কাছে কুরাইশদের কিছু ত্রুটি ধরা পড়ল। কুরাইশদের কিছু কথা ও কিছু কাজ তাঁর ভালো লাগেনি। ইহুদিদের দুজন অসামান্য সুন্দরী মেয়ের কথাও মনে পড়ল তার, যারা কুরাইশ সরদারদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে গিয়েছিল। সে জানত, ইহুদিরা তাদের সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে জাদুর খেলা দেখায়। এরা কুরাইশ সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, সে প্রভাব মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে। এ পদ্ধতি তাঁর কাছে মোটেই পছন্দনীয় ছিল না।

এই দুই সুন্দরীর একজন খালিদের সঙ্গে দেখা করেছিল। খালিদ তখন অনুভব করেছিল, এই মেয়ে কেবল সুন্দরী নয়; সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী। মেয়েটির যৌবন ও সৌন্দর্যে যেমন তাক লাগানো জাদু আছে, তার কথার জাদু তার চেয়েও শক্তিশালী।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত এই নারী খালিদের মানসপটকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাঁর ঘোড়া যখন হ্রেষা রবে ডেকে উঠল, তখন খালিদ যেন স্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে উঠল। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল এবং ঘোড়ায় চড়ে পুনরায় মদিনার রাস্তা ধরল।

ওয়ালিদের পুত্র খালিদ ছিল রাজপুত্রের মতোই বিত্ত-বৈভবের অধিকারী। বিলাসিতা, সুখ ও আনন্দের প্রতিও সে বিমুখ ছিল না। কিন্তু বিলাসিতা ও সুখের চাইতে যুদ্ধের উন্মাদনা তাঁর কাছে বেশি গুরুত্ব পেত। মদিনার দিকে যাওয়ার সময় তাঁর মনে সেই কামনীয় ইহুদি যুবতির ছবি বারবার ভেসে উঠল—যার নাম ইউহাদা। সে তাঁর মন থেকে সেই ইহুদি নারীর ছবি জোর করে সরিয়ে দিতে চাইল, কিন্তু ইউহাদা রংবেরং-এর প্রজাপতি হয়ে তাঁর মনে উড়ে বেড়াতে লাগল। খালিদ অনেক চেষ্টা করেও সেই প্রজাপতিকে তাঁর সামনে থেকে সরাতে পারল না।

উহুদ যুদ্ধের তিন-চার মাস পরের ঘটনা। কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্র করে, যে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল না খালিদ। কিন্তু সে কুরাইশ সম্প্রদায়ের এমন প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ না করলেও তার দায় সে এড়াতে পারত না। সে এমন দাবি করতে পারত না যে সে তাতে জড়িত নয়।

উহুদ যুদ্ধে আহত হওয়া বিভিন্ন কুরাইশ যোদ্ধার ক্ষত তখনও সম্পূর্ণ ভালো হয়নি! একদিন খালিদ সংবাদ পেল, মদিনা থেকে ছয়জন মুসলমান ইসলামের তাবলিগের জন্য রাজির দিকে যাচ্ছে। পথে আফফান থেকে কিছু দূরে একটি অমুসলিম সম্প্রদায় তাদের বাধা দেয় এবং দুজনকে ধরে মক্কাতে নিয়ে আসে। খালিদ খবর পেল, তাদের এখন নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে।

খালিদ দৌড়ে সেখানে গেল। দেখল, মুসলমানদের একজন জুবায়ের বিন আদি, অন্যজন জায়েদ বিন দিসনা। খালিদ দুজনকেই ভালো করে চিনত এবং জানত। তারা উভয়ে-ই খালিদের সম্প্রদায়ের লোক ছিল। ইসলাম গ্রহণ করে তাঁরা মদিনায় চলে যায়। রাসূলের জন্য তাঁদের ভালোবাসা এমন প্রচণ্ড ছিল যে, তাঁরা নবি করিমের জন্য প্রাণ দিতে সব সময়ই ছিল এক পায়ে খাঁড়া।

রাসূলে করিম (সাঃ) -ও তাদের খুবই প্রিয় জানতেন। খালিদ দেখল, তাদের একটি মঞ্চে দাঁড় করানো হয়েছে আর তার চারপাশে কুরাইশরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের হাতই রশি দিয়ে বাঁধা এবং যারা তাদের ধরে এনেছে, তাদের চার ব্যক্তি সে রশি ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

একজন মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল—’এই দুজন মুসলমান! এরা দুজনই উহুদ যুদ্ধে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এদের হাতে তোমাদের বহু আত্মীয়স্বজন মারা গেছে। এমন কেউ কি আছ, প্রতিশোধের আগুন নেভাতে চাও? তাহলে এদের ক্রয় করো এবং নিজ হাতে হত্যা করো। রক্তের বদলে রক্ত—এই শর্তেই এদের কিনতে পারবে। যারা বেশি মূল্য দেবে, তারাই পাবে এদের।’

‘দুই অশ্ব।’ একজন বলে উঠল |

‘দুই অশ্ব, দুই অশ্ব…’ ডাকতে থাকল সে।

‘দুটি ঘোড়া ও একটি উট।’ আরেকজন বলে উঠল।

‘ঘোড়া ও উটের কথা বাদ দাও, সোনার বলি দাও। সোনা আনো, শত্রুর রক্তে প্রতিশোধের আগুন নেভাও।’ বলে উঠল একজন।

যাদের নিকটাত্মীয় উহুদ যুদ্ধে মারা গিয়েছিল, তারা বেশি বাড়িয়ে বলছিল। জুবায়ের ও জায়েদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তাদের মুখে কোনো ভয় বা শঙ্কার লেশমাত্র নেই। নেই আতঙ্ক বা সামান্যতম অশান্তির বোধ। খালিদ ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

জুবায়ের খালিদকে দেখে চিৎকার করে বলল——হে কুরাইশের যুদ্ধবাজ সন্তান! আমাদের দুজনের রক্ত প্রবাহিত করে তোমরা কখনোই সেই পবিত্র বাণীকে স্তব্ধ করতে পারবে না, যে বাণী হেরা পর্বতের গুহা থেকে বেরিয়ে আজ মদিনা হয়ে সারা দুনিয়ায় আলোর মতো বিচ্ছুরিত হতে যাচ্ছে। কাপুরুষদের কাছে আমরা কোনো অনুকম্পা চাই না। যদি সাহস থাকে, তবে তোমাদের শ্রেষ্ঠ বীরকে আমার সামনে এনে আমার হাত খুলে দাও। দেখ, কে কার রক্তের পিপাসা মেটায়।’

জুবায়ের থামতেই ভেসে এলো জায়েদের বলিষ্ঠ কণ্ঠ—’যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে আসা হে পলাতক বীরেরা! তোমরা তোমাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ আমাদের ভাইদের লাশের ওপর নিয়েছ, তোমাদের নারীদের দিয়ে উহুদের ময়দানে আমাদের লাশের নাক-কান কেটে মালা বানিয়ে গলায় পরেছ। কাপুরুষের মতো আমাদের হত্যা করতে চাচ্ছ, কিন্তু এভাবে ইসলামের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে—এমন দুরাশা মোটেই করো না।’

চার বছর পর আজ মদিনায় যাওয়ার পথে খালিদের কানে স্পষ্ট ভেসে আসছে জুবায়ের ও জায়েদের সেই বীরত্বব্যঞ্জক হুংকার। খালিদ জায়েদের তিরস্কার সহ্য করতে পারছিল না, লজ্জায় ও শরমে মরে যাচ্ছিল।

আজ মদিনা যাওয়ার পথে সেই তিরস্কার মনে পড়ায় তার শরীর কেঁপে উঠল একের পর এক লোমহর্ষক সব দৃশ্য এসে আছড়ে পড়ল তাঁর মনের পর্দায় উহুদের ময়দানের সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল, যখন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা হামজার কলিজা চিবিয়ে গিলতে না পেরে উগরে দিয়েছিল। যখন সে সঙ্গিনীদের বলছিল—মুসলমানদের লাশের নাক-কান কেটে আনতে, তখন তারা তার হুকুম তামিল করতে গিয়ে মুসলমানদের নাক-কান কেটে আনল, আর হিন্দা সে নাক-কানের মালা গেঁথে গলায় পরল। সে তখন পাগলিনীর মতো নেচে নেচে গান করছিল, আর সে দৃশ্য উপভোগ করছিল তার স্বামী আবু সুফিয়ান। কিন্তু খালিদ যখন তাকে তিরস্কৃত করল, তখন তার ভেতরেও বিবেক জেগে উঠেছিল এবং সে সেখান থেকে সরে পড়েছিল। খালিদও ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে সরে গিয়েছিল সেখান থেকে।

তিন-চার মাস পর দুই বন্দি মুসলমান হাত-পা বাঁধা অবস্থায়ও যখন সে জন্য তিরস্কার করছিল, তখন সেদিনকার কাপুরুষতার কথা স্মরণ করে লজ্জার সাথে সাথে ক্ষোভও হলো তাঁর। সে সেখান থেকে সরে পড়ল ও কুরাইশদের ভিড়ে মিশে গেল।

যে সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলমান দুজনকে বেঁধে এনেছিল, তাদের নাম কোনো ইতিহাস গ্রন্থেই পাওয়া যায় না। ইবনে হিশাম শুধু এতটুকু বলেছেন, তারা কুরাইশদের সহযোগী একটি লড়াকু সম্প্রদায় ছিল।’

খালিদ সেই লড়াকু সম্প্রদায়ের লোকদের জিজ্ঞেস করল—’তোমরা এই দুজনকে কীভাবে পাকড়াও করলে?

‘এ আর এমন কঠিন কি কাজ।’ ওরা বলল—’খোদার কসম! যদি বলো, তবে মুসলমানদের রাসূলকেও ধরে এনে এই নিলামে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি।’

খালিদ বলল—’বাজে বকো না, যে কাজ করতে পারবে না তার কসম খেয়ো না। আমাকে শুধু বলো, এই দুজনকে কোত্থেকে ধরে আনলে?’

সে লোকটি বলল—’তাহলে শোনো। এরা ছিল ছয়জন। আমরা উহুদ যুদ্ধে আমাদের নিকটাত্মীয়দের রক্তের প্রতিশোধ নিচ্ছি। ভবিষ্যতেও এভাবে প্রতিশোধ নেওয়া অব্যাহত থাকবে। কীভাবে ওদের আমরা ধরেছি সে এক মজার কাহিনি।

ঘটনাটা এ রকম—আমাদের কবিলার কিছু লোক মদিনায় মুহাম্মদের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা মুহাম্মাদকে আরও জানায়, আমাদের কবিলার সমস্ত লোক ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করতে চায়, কিন্তু সময়-সুযোগ করে তারা সবাই মদিনা আসতে পারছে না। তাদের ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য যদি কয়েকজন মোবাল্লিগ পাঠানো যায়, তবে আশা করা যায়—কবিলার সকলেই মুসলমান হয়ে যাবে। কবিলার মুসলমানদের কিছুদিন ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্যও সেখানে কয়েকজন মোবাল্লেগ প্রয়োজন।

আমাদের এই লোকেরা যখন ফিরে আসে, তখন তাদের সাথে ছয়জন মুসলমানকে মোবাল্লিগ হিসেবে পাঠানো হয়। এদিকে আমাদের সরদার শারজা বিন মুগিহ একশো লোককে রাজি নামক স্থানে পাঠিয়ে দিলো। যখন এই ছয়জন মুসলমান রাজিতে পৌছল, তখন আমাদের লোকেরা তাদের ঘেরাও করে আত্মসমর্পণ করতে বলল। তুমি শুনে বিস্মিত হবে, আমাদের সশস্ত্র একশো লোকের সাথে ছয়জন মুবাল্লিগ শুধু তলোয়ার সম্বল করে যুদ্ধে লেগে গেল! যুদ্ধে তিনজন নিহত ও তিনজন বন্দি হলো।

শারজা বিন মুগিহ নির্দেশ দিয়েছেন, মদিনা থেকে যাদের ধোঁকা দিয়ে আনা হয়েছে, তাদের বন্দি করে মক্কায় নিয়ে যাবে এবং বদর ও উহুদের প্রান্তরে আপন আত্মীয়স্বজন খুন হওয়ার প্রতিশোধের নেশায় যারা পাগলপারা, তাদের হাতে বিক্রি করে দেবে। বন্দি তিনজনকে নিয়ে আমরা মক্কার দিকে আসছি। পথিমধ্যে তাদের একজন কেমন করে যেন রশি খুলে হাত বের করে ফেলল। মুক্ত হয়ে সে পালানোর চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সে তা না করে অসম্ভব দ্রুততার সাথে আমাদের একজনের তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনকে হত্যা করে ফেলল! আহাম্মক একবারও ভাবল না, একলা এত লোকের সাথে লড়তে এলে তার ভাগ্যে মরণ ছাড়া আর কিছুই জুটবে না। যাই হোক, আমরা তার দেহ কেটে কিমা বানিয়ে ওখানে ফেলে এসেছি। এখন এ দুজন অবশিষ্ট আছে। তবে এদের আর পালানোর উপায় নেই, আমরা তাদের আরও শক্ত করে বেঁধে নিয়েছি।’

খালিদের কণ্ঠ থেকে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল, ‘আর তোমরা এতেই মহা খুশি হয়ে গেলে! মুহাম্মাদ (সাঃ) এ ঘটনা শুনে কী বলবে সে কথা ভেবে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। মুহাম্মাদ (সাঃ) কি ভাববে না, কুরাইশ ও তার সহযোগীরা এখন এতই কাপুরুষ হয়ে গেছে যে, লড়াইয়ে ভয় পেয়ে তারা এখন ধোঁকা ও প্রতারণার পথ ধরেছে? যোদ্ধাদের সামনে আসার সাহস না থাকায় তারা এখন মোকাবিলায় নামে মুবাল্লিগদের? তাও আবার ছয়জন মুবাল্লিগকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের দরকার হয় একশোজন যোদ্ধার বিশাল বাহিনীর? ছি! এসব কথা ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। তোমরা নিজেদেরই কেবল অপমান করোনি, যে মায়েরা তোমাদের দুধ খাইয়ে বড়ো করেছে, সেই মায়েদেরও অপমান করেছ!’

‘ওয়ালিদের বেটা! বেশি বড়াই করো না। তোমাদের বাহাদুরি তো আমরা দেখেছি। যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানদের সামনে তোমাদের বীরত্ব দেখে মক্কার রমণীরা যে থুতু ফেলেছে, সে কথা কি ভুলে গেছ? মুহাম্মাদের শক্তির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার সামর্থ্য কি তোমাদের আছে? বদরের যুদ্ধে আরবের বাছাই করা এক হাজার যোদ্ধা নিয়ে লড়াই করতে নেমে মাত্র তিনশো তেরোজনের কাছে চরম মার খেয়ে পালিয়ে এসেছিলে। উহুদের যুদ্ধে মুহাম্মাদের বাহিনীতে কয়জন ছিল? সাতশোরও কম, আর তোমরা কয়জন ছিলে? হাজার হাজার। শোনো খালিদ, মুহাম্মাদের হাতে জাদু আছে। যেখানে জাদু চলে, সেখানে তলোয়ার চলে না।’

খালিদ জিজ্ঞেস করল—’তবে তোমার তলোয়ার চলছে কেমন করে? যদি মুহাম্মাদের হাতে জাদু থাকে, তবে তিনি তোমাদের ধোঁকায় কেমন করে পড়লেন? তাদের চার ব্যক্তিকে কী করে হত্যা করলে? এদের দুজনকে মুহাম্মাদের জাদু কেন মুক্ত করতে পারছে না? মূলত তোমরা তাঁর মোকাবিলা করতে ভয় পাও এবং মিছেমিছি তাঁর কাছে জাদু আছে বলে নিজেদের ধোঁকা দিয়ে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করো।’

‘না, না, খালিদ! আমরা জাদুকে জাদু দিয়েই মোকাবিলা করেছি।’ লোকটি বলল—’আমাদের কাছে ইহুদি জাদুকর এসেছিল। সাথে ছিল তিনজন ডাইনি। তাদের একজনের নাম ইউহাদা। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, সে হাতে তুড়ি বাজাল আর ঘন জঙ্গল থেকে শট করে বেরিয়ে এলো একটা বর্শা! আবার তুড়ি বাজাল, বর্শাটি ঝোপের মধ্যে ফিরে চলে গেল এবং সাপ হয়ে বেরিয়ে এলো। সাপটি আমাদের চারদিকে একবার চক্কর দিয়ে আবার ঝোপের মধ্যে চলে গেল। তখন ইউহাদা বলল—’সাপের ঘেরাওয়ের মধ্যে যারা ছিলে, তারা এখন মুহাম্মাদের জাদুমুক্ত। তোমাদের ওপর মুহাম্মাদের জাদু আর কাজ করবে না।’ এ কারণেই আমরা তাদের সামনে যাওয়ার সাহস পেয়েছি।’

মদিনার দিকে যেতে যেতে খালিদের এসব ঘটনা একের পর এক স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল। খালিদ এখন আর এসব কথা মনে করতে চায় না। সে যতই এসব কথা মন থেকে তাড়াতে চাচ্ছে, ততই তাঁর মনবাগানে বিষাক্ত বোলতার মতো এসব স্মৃতি ভনভন করে উড়তেই থাকল। মনে পড়ল তাঁর ইউহাদার কথা।

বাস্তবেও সে জাদুকন্যা কি না সে কথা জানে না খালিদ, কিন্তু তার সুঠাম শরীর, অপূর্ব দেহবল্লরী, চমক দেওয়া চাহনি, মধুর হাসি ও কথা বলার সুমিষ্ট স্বরে অবশ্যই জাদু আছে। লোকটির মুখে যখন সে ইউহাদার নাম শুনল, তখন সে চমকে উঠল।

উহুদ যুদ্ধের পর যখন কুরাইশ সৈন্যরা মক্কায় ফিরে এসেছিল, তখন মক্কার ইহুদিরা এমন অসহায়ের মতো আবু সুফিয়ান, খালিদ ও আকরামার কাছে এসেছিল, যেন ইহুদিদেরই পরাজয় হয়েছে। ইহুদি সরদাররা আবু সুফিয়ানকে বলল—’এ যুদ্ধে মুসলমানের পরাজয় হয়নি; বরং এ যুদ্ধ জয়-পরাজয় ছাড়াই শেষ হয়েছে।’ কুরাইশদের এ ব্যর্থতাকে ইহুদিরা যেন তাদের ব্যর্থতাই গণ্য করছিল। কুরাইশদের প্রতি তারা এমনভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করছিল, যেন তারা এ ব্যর্থতার দুঃখে ও যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছিল।

সে দিনের কথা খালিদের এখনও স্পষ্ট মনে আছে। সে ঘোড়া নিয়ে জনবসতির বাইরে বেড়াতে গিয়েছিল। যখন ফিরে আসছিল, তখন রাস্তায় ইউহাদার সাথে তাঁর দেখা। ইউহাদার মুচকি হাসি তাঁর চলার গতি থামিয়ে দিয়েছিল। ইউহাদা সেই হাসি অক্ষুণ্ন রেখেই বলেছিল—’আমি মোটেই মেনে নিতে পারছি না, ওয়ালিদের বেটা যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ময়দান থেকে ফিরে এসেছে।’

ইউহাদা খালিদের ঘোড়ার গর্দানে হাত রেখে বলল—’আমার এই ঘোড়ার ওপর বড়ো একটা আকর্ষণ ও ভালোবাসা রয়েছে। কারণ, এ অশ্বটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েছিল।’

খালিদ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে এলো, যেন ইউহাদার জাদুই তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে এনে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো।

ইউহাদা বলল—’এর চেয়ে বড়ো ব্যর্থতা আর কী হতে পারে যে, তুমি মুসলমানদের পরাজিত করতে পারোনি।’ তোমাদের পরাজয় আমাদেরই পরাজয়। তোমাদের মতো যুবকদেরই সঙ্গ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে আমার মতো যুবতিরা, কিন্তু কোনো মেয়েই পরাজিত সৈনিকের গলায় মালা পরানোর জন্য আগ্রহী হয় না।’

খালিদের মনে হলো তাঁর জবান বন্ধ হয়ে গেছে। সমগ্র চেতনা ও সত্তায় কেমন একটা অলস, অচেতন ভাব। যুদ্ধের ময়দানে সে তির, তলোয়ার ও বর্শার আঘাত মোকাবিলা করতে পারে, কিন্তু ইউহাদার মিষ্টি হাসির মোকাবিলা করার কায়দা তাঁর জানা নেই! সে ইউহাদার সামনে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

খালিদের দিকে তাকিয়ে ইউহাদা প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। খালিদ প্রশ্ন করল— ‘তুমি কি মনে করো—শুধু তিরই মানুষকে বিদ্ধ করতে পারে?’

ইউহাদা বলল—’মেয়েদের মিষ্টি হাসিও তোমার মতো বাহাদুর ও যোদ্ধা পুরুষকে বিদ্ধ করতে পারে। পারে তাদের হাত থেকে অস্ত্র ও তলোয়ার ফেলে দিতে।’

খালিদ তাকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ইউহাদা অধরে হাসি ধরে রেখেই চোখ টিপে দিলো। খালিদ আবার বোবা হয়ে গেল। ইউহাদা খালিদের আরও কাছে সরে এলো, খালিদ অপলক চোখে অভিভূতের মতো তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে তার আপন অস্তিত্ব ও শিরায় শিরায় আনন্দের অচেনা ধারা বয়ে যাওয়া অনুভব করল। ইউহাদা বলল—’চলি খালিদ, তোমাকে বলি বলি করেও বলা হয়নি, মনে রেখ, ইউহাদা কেবল বাহাদুরেরই পূজা করে।’

ইউহাদা খালিদকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে হাত নেড়ে বিদায় জানাল তাকে। খালিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘোড়ার লাগাম ধরে। ইউহাদা একটু সরে যেতেই সংবিৎ ফিরে পেল সে, লাফিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসল। কিছুদূর গিয়ে খালিদ পেছন ফিরে তাকাল, দেখল ইউহাদা ফিরে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। খালিদ পেছন ফিরতেই ইউহাদা আবারও তাঁর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল।

তখনও মুসলমান দুজন নিলামের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। খালিদ কুরাইশদের জানাল, কেমন করে ধোঁকা দিয়ে তাদের ধরা হয়েছে। এর পরিণাম কী হতে পারে, তাও ভেবে দেখতে বলল সরদারদের। এ নিয়ে যখন জটলা চলছে, তখন খালিদ শুনতে পেল আরও চমকপ্রদ কাহিনি।

এ ঘটনা আরও আগের। তিন-চারজন ইহুদি সরদার ইউহাদা ও আরও কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে শারজা বিন মুগির কাছে গেল। শারজার সম্প্রদায়টা ছিল খুবই যুদ্ধবাজ ও কলহপ্রিয়, কিন্তু তাদের ওপর মুসলমানদের ভীতিকর এক প্রভাব পড়েছিল। জাদুকরদের সব সময়ই মানুষ ভয় পায়। তাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, রাসূলে করিমের হাতে জাদু আছে। ফলে মুসলমানদের ব্যাপারে প্রচণ্ড এক ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল এদের মধ্যে।

ইহুদিরা ছিল ষড়যন্ত্রে অসম্ভব পটু। তারা ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে এই সম্প্রদায়কে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল। কারণ, স্বভাবগতভাবে এরা যুদ্ধবাজ ও কলহপ্রিয় হওয়ায় যেকোনো বিপর্যয় সৃষ্টির কাজে এদের ব্যবহার করা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ ও নিরাপদ।

ইহুদিরা কেবল চালাক-চতুর নয়; কূটকৌশলেও বিশ্বসেরা। তারা চিন্তা করে দেখল, যদি মুসলমানের জাদুর ধারণা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, তবে তার প্রভাবে সেসব সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়বে। তাই ইহুদি সরদাররা শারজা বিন মুগির কাছে গিয়ে মুসলমানরা যে আসলে জাদুকর নয়—এই ধারণা ওদের মনে বদ্ধমূল করার চেষ্টা করল। এ ব্যাপারে তারা অনেক কথাই বলল, কিন্তু শারজা বিন মুগিহ তাদের কথা বিশ্বাস করল না।

রাতে শারজা মেহমানদের জন্য খোলা আকাশের নিচে এক ভোজসভার আয়োজন করল। ইহুদিরা বলল—’আমরা তোমার দাওয়াত কবুল করতে পারি, কিন্তু তাতে মদ ও সুরা পান করানোর দায়িত্ব আমাদের দিতে হবে। তোমাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের প্রমাণস্বরূপ এটাকে আমাদের শুভেচ্ছা-উপহার মনে করতে পারো।’

শারজা বিন মুগিহ অগত্যা তাদের প্রস্তাব মেনে নিল। ভোজসভায় সে তার সম্প্রদায়ের কিছু বিশেষ ব্যক্তিকে দাওয়াত করল। ইহুদিরা নিজ হাতে তাদের মদ-সুরা পান করাল। শরাবের মধ্যে তারা এক প্রকার গুঁড়ো মিশিয়ে দিলো। সেই গুঁড়োর প্রভাবে তারা যখন নেশাগ্রস্ত হলো, তখন ইহুদিরা তাদের দেখাল নানা রকম চমকপ্রদ জাদু। সে জাদু দেখে তারা তো বিস্ময়ে হতবাক!

এরপর শুরু হলো নাচ-গানের আসর। ইউহাদা দেখাল তার চোখ ধাঁধানো রূপের চমক। নাচের আসরে ইহুদি নর্তকীরা সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে নেশা ধরিয়ে দিলো সবার। তারা স্টেজে এলো অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায়। নাচতে নাচতে একসময় দেহের বাকি আবরণটুকুও ছুড়ে ফেলে দিলো মাটিতে। দর্শকদের পলকহীন চোখ যখন তাদের গিলছিল, তখন তারা দর্শকদের হা করা মুখকে আরও হা করে দিয়ে ব্যান্ড পার্টি নিয়ে নেমে গেল নিচে।

পরদিন সকালে যখন শারজা বিন মুগিহ চোখ খুলল, তখন তার মনে হলো, যেন সে এক সুন্দর রঙিন স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল। তার গতকালের ধারণা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ পালটে গেল। ইহুদিদের কথায় বিশ্বাস ও আস্থা ফিরে এলো তার।

কিছুক্ষণ পরে সে তার গোত্রের অন্যান্য সরদারদের নিয়ে ইহুদিদের সাথে আবার বৈঠকে বসল। ইহুদি তরুণী ও নর্তকীরাও শামিল হলো সে বৈঠকে। ইউহাদাকে দেখে শারজার হৃদয় অধীর হয়ে উঠল। সে ইউহাদাকে টেনে তার কাছে বসাল।

এক ইহুদি বলল—’যুদ্ধের ময়দানে সামনাসামনি লড়াই করে মুসলমানদের পরাজিত করার আর প্রয়োজন নেই। আমরা তাদের কৌশলে শেষ করতে পারি। তোমরা যদি সেসব কৌশল শিখতে চাও, তবে তার একটা পদ্ধতি তোমাদের এক্ষুনি শিখিয়ে দিতে পারি।’

খালিদ শুনল, যে ছয়জন মুসলমানকে ধোঁকা দিয়ে মদিনা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের নিয়ে আসার এ কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিল সেই ইহুদি। শারজা বিন মুগিহ যে লোকগুলোকে রাসূলের কাছে পাঠিয়েছিল, তাদের মধ্যেও একজন ইহুদি ছিল। খালিদ মুসলমানদের তাঁর সবচেয়ে বড়ো দুশমন মনে করত, কিন্তু তাই বলে এমন যুদ্ধহীন ষড়যন্ত্র মেনে নিতে পারল না তাঁর বিবেক। খালিদ বাড়ি গিয়ে তাঁর এক চাকরানিকে বলল—’জলদি ইউহাদাকে ডেকে নিয়ে এসো।’

ইউহাদা খবর পেয়ে এত তাড়াতাড়ি এলো, যেন সে এ আহ্বানের আশায় পাশেই কোথায়ও অপেক্ষা করছিল।

খালিদ ইউহাদাকে বলল—’মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে এভাবে হত্যা করার বুদ্ধি কি তুমিই দিয়েছ? তুমি জানো, শারজা বিন মুগির সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমাকে ডাইনি ও জাদুকর বলছে? যদি তা-ই হয় তাহলে জেনে রাখো, এ পদ্ধতি আমার কাছে মোটেই পছন্দনীয় নয়।’

ইউহাদা তাঁর পাশে গিয়ে বসল এবং তাঁর ঊরুতে হাত রেখে বলল—’আমার কথা মন দিয়ে শোনো খালিদ! দুশমনকে মারা প্রয়োজন, কিন্তু কীভাবে মারলে এটা বড়ো কথা নয়। তলোয়ার দিয়ে মারো, তির দিয়ে মারো কিংবা কৌশলে নিধন করো—সবটারই ফলাফল এক। তলোয়ার ও তির চালিয়ে শত্রু নিধনে ঝুঁকি আছে। ঝুঁকি না নিয়েই যদি শত্রুকে নিধন করা যায়, সেটা কি আরও মঙ্গলজনক নয়? তা ছাড়া তোমরা পুরুষরা যে ঝুঁকি নিতে পারো, মেয়ে হওয়ার কারণে আমরা তা পারি না। তাই বলে দেশের প্রতি, জাতির প্রতি আমাদের কি কোনো মায়া নেই? কোনো দায়িত্ব নেই? আমরা আমাদের কৌশল প্রয়োগ করেছি এবং আমাদের কৌশল যে অব্যর্থ ও সার্থক, তার প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছ। আমি তো ভেবেছি, এজন্য তুমি আমায় বাহবা দেবে, আমার প্রশংসা করবে।’

খালিদ ইউহাদার শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছিল। ইউহাদা তাঁর এত কোল ঘেঁষে বসেছিল যে, একবার মুখ ফেরাতে গিয়ে তার তুলোর মতো নরম গাল খালিদের মুখ স্পর্শ করে গেল। এ সামান্য স্পর্শ খালিদের সারা দেহে অদ্ভূত এক শিহরন জাগিয়ে তুলল, যেন তাঁর শরীরে বয়ে যাচ্ছে এক আনন্দময় বিদ্যুৎ। কিন্তু কোত্থেকে যেন একরাশ সংকোচ এসে ঘিরে ধরল তাঁকে। সে একটু দূরে সরে বসল।

আজ চার বছর পর যখন সে ঊষর মরুভূমি পাড়ি দিয়ে একাকী এগিয়ে যাচ্ছিল মদিনার দিকে, তখনও সে ইউহাদার ঠোঁটের সেই কোমল স্পর্শ যেন অনুভব করতে পারছিল। তাদের সঙ্গে ইহুদিরা আছে বলে সে তো বরং খুশিই ছিল; যদিও সে জানত, ইহুদিদের এ বন্ধুত্বের কারণ মুসলমানদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা। অবশ্য এতে ইহুদিদের যেমন লাভ আছে, তেমনি তাদের নিজেদেরও লাভ আছে। সুতরাং ইউহাদা জাদুকন্যা না হলেও তার দেহে যে জাদু আছে, এই জাদুর প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচানোর তেমন কোনো চেষ্টা করল না; বরং বলা যায়, ইউহাদার সাথে তাঁর সম্পর্কটা সে মেনেই নিয়েছিল।

খালিদের ঘোড়া মদিনার দিকে ছুটে চলেছে। তাঁর স্মৃতিপটে জুবায়ের বিন আদি ও জায়েদ বিন দিসনার কথা ভেসে উঠল আবার। লোকেরা খুব জাঁকজমক ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে নিলামে অংশ নিল। শেষে কুরাইশের দুই ব্যক্তি তাদের অনেক সোনা দিয়ে কিনে নিল। এ দুই ব্যক্তি খরিদ করা গোলামদের নিয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে গেল।

‘সরদার! আমাদের ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে এ দুই ব্যক্তি মুহাম্মাদের কাছে চলে গিয়েছিল। উহুদের ময়দানে এরাই আমাদের আপনজনদের রক্ত প্রবাহিত করেছিল। কুরাইশদের সেই খুনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই এদের আমরা ক্রয় করে এনেছি। আপনি আমাদের সরদার ও সেনাপতি। আমাদের বুকে স্বজন হারানোর কী অসহনীয় ব্যথা ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে-তা আপনি ভালো করেই জানেন। আমাদের সেই খুনের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য আমরা এদের আপনার হাতে সমর্পণ করছি।’

আবু সুফিয়ান বলল—’হ্যাঁ! মক্কার মাটি মুসলমানদের রক্তের জন্য পাগল হয়ে আছে। এ দুই মুসলমানের রক্ত এ মাটির সে তৃষ্ণা কিছুটা হলেও নিবারণ করবে। এদের তোমরা তোমাদের ইচ্ছেমতো খুন করতে পারো, এ ব্যাপারে আমার পূর্ণ সমর্থন ও সম্মতি আছে। কিন্তু এটা যে পবিত্র মাস! দেবতা উজ্জা ও হোবল এই পবিত্র মাসে খুন-খারাবি ও রক্তপাত পছন্দ করেন না। এ মাস শেষ হতে দাও। আগামী মাসের পয়লা তারিখেই এদের খোলা মাঠে কাঠের খাম্বার সাথে বেঁধে আমাকে খবর দেবে।’

এ খবর ছড়িয়ে পড়ল মক্কার ঘরে ঘরে। খালিদের কানেও এ সংবাদ এলো। খবর শুনে খালিদ আবু সুফিয়ানের কাছে গেল।

খালিদ আবু সুফিয়ানকে স্পষ্ট ভাষায় বলল—’আমার কাছে আপনার এ সিদ্ধান্ত ভালো লাগছে না। আমরা দ্বিগুণ-তিনগুণ সেনা নিয়েও অল্প সংখ্যক মুসলমানকে পরাজিত করতে পারিনি। আরবের বিপুল জনগোষ্ঠীর মাঝে অল্পকজন মুসলমান এখনও বেঁচে আছে, এ ব্যর্থতা আমাদের। কিন্তু বীরের মতো মোকাবিলা না করে ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এভাবে ডেকে এনে তাঁদের রক্ত পান করা কাপুরুষতা, আবু সুফিয়ান। আপনি কি জানেন, মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে ডেকে আনার পেছনে তিনজন মহিলা ছিল? আপনি কি আপনার দুশমনদের মুখ দিয়ে বলাতে চান, কুরাইশ পুরুষরা এখন মেয়েদের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে? ওদের বাহু এতই কম জোর হয়ে পড়েছে যে, অবলা নারীর সমান শক্তিও আর তারা রাখে না!’

আবু সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বলল—’খালিদ! জুবায়ের ও জায়েদকে আমিও আমার নিকটাত্মীয় মনে করতাম, যেমন তুমি মনে করো। বুঝতে পারছি, তুমি এখনও ওদের নিকটাত্মীয়ই ভাবছ। কিন্তু ভুলে যাচ্ছ কেন, এখন ওরা আমাদের দুশমন! তুমি বলেই বলছি, যদি তুমি ওদের মুক্ত করতে চাও, তবে এর দ্বিগুণ সোনা নিয়ে এসো। আমি এদের তোমার হাতে তুলে দিতে রাজি আছি।’

‘না!’ পর্দার পেছন থেকে ভেসে এলো নারী কণ্ঠ। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলে উঠল—’হামজার কলিজা চিবিয়েও আমার অশান্ত বুক শান্ত হয়নি। এখনও প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে এ বুকে। যদি দুনিয়ার সব সোনা এনে আমার সামনে দাও, তবুও আমি এদের মুক্ত করতে দেবো না। তুমি ওদের মূল্য দ্বিগুণ করলে আমি করব চারগুণ! ওয়ালিদের বেটা, দরকার হলে আমার সব সম্পত্তি ওদের জন্য কুরবান করব।’

খালিদ বলল—’আবু সুফিয়ান! যদি আমার স্ত্রী আমার কথার মধ্যে এভাবে নাক গলাত, তবে আমি তার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম।’

হিন্দা বলল—’তুমি তোমার বিবির জিহ্বা টেনে ছিঁড়তে পারো। কারণ, তোমার বুকে প্রতিশোধের আগুন নেই। মুসলমানদের হাতে তোমার বাবা মারা যায়নি, তোমার কোনো সন্তানও মারা যায়নি; তোমার চাচাও মারা যায়নি। তোমার এক ভাই বন্দি হয়েছিল, তোমরা মুসলমানদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ দিয়ে ভাইকে মুক্ত করেছিলে। যদি তোমার একজন আপনজনও মুসলমানদের হাতে নিহত হতো, তবে স্বজন হারানোর বেদনা কী, তা তুমি বুঝতে পারতে। তাহলে এত বড়ো বড়ো কথা আর তোমার মুখ থেকে বের হতো না। তখন তুমি আমার অন্তরে যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে—তাকে শ্রদ্ধা করতে, কিন্তু স্বজন হারানোর যে যন্ত্রণা, যে দাহ, সে সম্পর্কে তুমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অতএব, এ ব্যাপারে তোমার নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই।’

খালিদ আবু সুফিয়ানের দিকে তাকাল। গোত্রের সরদার ও সেনাপতি হিসেবে আবু সুফিয়ানের মুখে যেখানে পৌরুষ ও শৌর্য-বীর্যের দ্যুতি ও দৃঢ়তা থাকা উচিত ছিল, সেখানে খেলা করছে এক অসহায় স্বামীর করুণ অবস্থা।

আৰু সুফিয়ান বলল—’হ্যাঁ খালিদ! যার অন্তরে ব্যথা আছে, তার অনুভূতি তোমার থেকে ভিন্ন হতে পারে। কাউকে শত্রু বলা বা ভাবা এককথা, সেখানে প্রতিশোধের তীব্র অনুভূতি না থাকলেও চলে, কিন্তু প্রিয়জনের খুনিকে মাফ করা অসম্ভব ব্যাপার। তুমি কেন তোমার সম্প্রদায়ের অনুভূতির প্রতি সম্মান না দেখিয়ে শত্রুপক্ষের লোকদের সমর্থন করবে? কেন এ দুজন মুসলমানের জীবন দান করার জন্য তদবির করবে তুমি? তুমি চলে যাও খালিদ, এ দুই মুসলমানের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব তোমার সম্প্রদায়ের ওপর ছেড়ে দাও।’ খালিদ নীরবে চলে গেল।

অতঃপর খালিদের সামনে সেই ভয়াবহ নির্দয় দৃশ্য ফুটে উঠল, যে দৃশ্য সে কখনোই স্মরণ করতে চায় না। প্রকাশ্য ময়দানে কাঠের দুই খাম্বার সঙ্গে জুবায়ের ও জায়েদকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারদিকে দর্শকদের অসহ্য চিৎকার ও শোরগোল। সবার মধ্যে বিজয়ের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ-উল্লাস। চোখে-মুখে তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের দুর্দমনীয় নেশা। বন্দিদের প্রতি তিরস্কারের বান ছুড়ে মারছে যে যেভাবে পারছে। ক্রমশ বেড়ে চলেছে শোরগোল, হইহুল্লোড়। উপচে পড়া এই আনন্দের ভিড়ে একজন মাত্র লোক ছিল, যার বুকে আনন্দের লেশ মাত্র ছিল না। সে ভিড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখছিল, মানুষের চোখে-মুখে লেপটে থাকা নগ্ন জিঘাংসার নিষ্ঠুরতার ছবি। সে-ও এই উল্লাসমুখর জনতারই অংশ, কিন্তু আসলেও কি তাই? তাহলে তার মনে কেন আনন্দের কোনো অনুভূতি জাগছে না? আনন্দ দূরে থাক; বরং মানুষের চোখে-মুখে জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতার যে ছবি সে দেখতে পাচ্ছে, তাতে বিষিয়ে উঠছে তাঁর মন। এ কাপুরুষ দলের সে-ও একজন—এ কথা মনে হতেই নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর। পরিচিতজন ও স্বজন পরিবেষ্টিত হয়েও তাঁর মনে হচ্ছে সে একাকী, নিঃসঙ্গ। এ লোক আর কেউ নয়, এ ছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ।

আবু সুফিয়ান ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে বন্দিদের কাছে গেল। বলল—’অন্তিম মুহূর্তে তোমাদের কিছু চাওয়ার বা বলার থাকলে বলো?’

জুবায়ের ও জায়েদ উভয়েই জীবনের শেষ ইচ্ছে ব্যক্ত করল আবু সুফিয়ানের কাছে। বলল—’আমাদের নামাজ আদায় করার সুযোগ দাও।’

খালিদ মদিনার দিকে যাচ্ছে। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠছে দুই মুজাহিদের প্রশান্ত চেহারা ও আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃশ্য। ভয়ভীতি বা শঙ্কার লেশমাত্র নেই তাঁদের চোখে-মুখে।

বন্দি দুজনের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। ধীরেসুস্থে অজু সেরে কেবলার দিকে মুখ করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল ওরা দুজনেই। দর্শকদের শোরগোল কমে এলো।

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বন্দিদের দিকে, কিন্তু এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বন্দিদের। তারা একান্ত নিবিষ্ট মনে একাগ্র চিত্তে নামাজ আদায় করছে পরম প্রশান্তির সাথে। তাদের সে প্রশান্ত চেহারার কথা আজও খোদাই হয়ে আছে খালিদের অন্তরে। সে সময়টার এমন একটি প্রভাব তাঁর মনের ওপর পড়ে আছে যে, আজ চার বছর পরেও তাঁর মনে সেই স্মৃতি অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে। মুসলমান দুজনের সেই ত্যাগ ও কুরবানির কথা মনে হতেই ঘোড়ার পিঠে বসেও খালিদের মাথা নত হয়ে এলো।

জুবায়ের বিন আদি ও জায়েদ বিন দিসনাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই প্রচণ্ড ভিড়, চিৎকার ও হট্টগোল কিছুই যেন তাঁদের স্পর্শ করছে না। মৃত্যু সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্ভয়। অত্যন্ত শান্ত মনে তাঁরা নামাজ শেষ করল। নামাজ শেষ করে ওরা আল্লাহর দরবারে দুআর জন্য হাত উঠাল। পৃথিবীর কেউ জানল না-তাঁরা সেদিন আল্লাহর কাছে কী চেয়েছিল, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কী ছিল তাঁদের শেষ প্রার্থনা। যারা তাঁদের খুন করার জন্য অপেক্ষা করছিল এবং যারা তাদের রক্ত দেখে উল্লাস করার জন্য সমবেত হয়েছিল, শুধু তারা অবাক বিস্ময়ে দেখল—নামাজ শেষে প্রশান্ত মনে তারা উঠে দাঁড়াল এবং আবারও কাঠের খুঁটির সাথে পিঠ লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল।

আবু সুফিয়ান উচ্চৈঃস্বরে জুবায়ের ও জায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল— ‘ওরে হতভাগার দল! তোদের ভাগ্য ও তোদের জীবন এখন আমার হাতে। তোরা মুখ দিয়ে শুধু বল, আমরা ইসলাম ত্যাগ করছি এবং আগের মতো কুরাইশ সম্প্রদায়ে শামিল হয়ে গেলাম। আমরা তিনশো ষাট দেবতাকেই স্বীকার করি। যদি তোরা এই কথা স্বীকার করিস, তবে আমি তোদের জীবন ফিরিয়ে দেবো, যদি তা না করিস আর তবে মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে যা। তবে এ কথাও মনে রাখিস, মরতে চাইলেও তোদের মৃত্যু সহজ হবে না। কঠিন পীড়াদায়ক কষ্ট দিয়ে তিলে তিলে মারা হবে তোদের।’

জায়েদের কণ্ঠ গমগম করে উঠল—’হে বাতিলের পূজারি আবু সুফিয়ান! আমরা অভিশাপ দিই ওই পাথরের মূর্তির ওপর, যারা তার ওপর মশা-মাছি বসলে তা- ও তাড়াতে পারে না। আমরা অভিশাপ দিই উজ্জা ও হোবলের ওপর, যারা তোমাদের পরজগতে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবে। আমরা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার ইবাদত করি। আর আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ) এ-কে আমাদের জীবন চলার একমাত্র পথপ্রদর্শক ও নেতা মনে করি।’

জায়েদ থামতেই ভেসে এলো জুবায়েরের কণ্ঠ—’আমার পথও ওই এক ও অভিন্ন পথ, যা জায়েদ বলেছে। হে মক্কাবাসীরা, আমরা সত্যের জন্য কুরবানি হতে পারছি, এ আমাদের সৌভাগ্য। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছিলাম আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাচ্ছি। আমরা যেখানে যাচ্ছি—সে জায়গা এখান থেকে অনেক বেশি সুন্দর, অনেক বেশি পবিত্র ও মনোরম।’

আবু সুফিয়ান আদেশ করল-’বেঁধে ফেলো এদের খুঁটির সাথে। এরা যখন মৃত্যুর মজা চাখতে বেশি আগ্রহী, আমরা সে মজাই তাদের দেবো।’

দুজনের হাত পেছনে খুঁটির সাথে শক্ত করে বাঁধা হলো। আবু সুফিয়ান ঘোড়া ফিরিয়ে ভিড়ের দিকে চলে এলো।

আবু সুফিয়ান উচ্চৈঃস্বরে ভিড় লক্ষ্য করে বলল—’উজ্জা ও হোবলের শপথ! আমি আমার সম্প্রদায়ের এমন একজন লোককেও দেখলাম না, যে সরদারের মহব্বতে জীবন কুরবানি করতে প্রস্তুত। অথচ দেখ, মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাঁর নামের ওপর কেমন অকাতরে নিজের জীবন ও প্রাণ নজরানা হিসেবে পেশ করছে!’

হিন্দা একটু দূরে ঘোড়ায় আরোহণ করে দেখছিল এ দৃশ্য। তার পাশে এক গোলাম। এক কৃতদাস তার প্রভুকে খুশি করার জন্য জোশের সঙ্গে বর্শা উঁচিয়ে সরদারের আদেশ ছাড়াই বন্দিদের দিকে দ্রুত দৌড়ে গেল এবং খুঁটিতে বাঁধা জায়েদের বুকে এমন জোরে বর্শা বিদ্ধ করল যে, বর্শাটি বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল। জায়েদ বিন দাসনা সঙ্গে সঙ্গে শহিদ হয়ে গেলেন।

গোলাম এবার বুক টান করে উৎফুল্লভাবে জনতার দিকে এগিয়ে গেল। তার আশা ছিল—দর্শকরা তাকে বাহবা দেবে এবং তাকে কোলে তুলে নাচবে। কিন্তু জনতা তার ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এবং চিৎকার করে বলতে লাগল——এটা কেমন হলো, একি কোনো প্রদর্শনী হলো? এত সহজে এই মুসলমানকে কেন তুমি পরপারে পাঠিয়ে দিলে?’

কেউ চিৎকার করে বলতে লাগল—’এই গাধাটা আমাদের সব আনন্দ মাটি করে দিলো। এদের নিয়ে একটু খেল-তামাশারও সুযোগ দিলো না।’

হিন্দা খুব তীক্ষ্ণ ও কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে বলল—’খুন করো এই গোলামকে। ব্যাটা মুসলমানকে দয়া দেখাতে গেল! তাকে এত তাড়াতাড়ি মেরে ফেলল।’

কয়েকজন লোক তলোয়ার ও বর্শা নিয়ে দৌড়ে গেল গোলামের দিকে। ধাওয়া খেয়ে ছুটে পালাল গোলাম। কিছু লোক ধাওয়াকারীদের পথ আগলে তাদের থামিয়ে দিলো।

এক অশ্বারোহী খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে ময়দানে ছুটে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল—’সাবধান! পেছনে সরে যাও সবাই। আরবের রক্ত এত হীন নয় যে, দুজনকে বেঁধে সমস্ত কুরাইশ সম্প্রদায় একত্রিত হবে তাদের মারার জন্য। আল্লাহর কসম, যদি আবু সুফিয়ানের পরিবর্তে আমি নেতা হতাম, তবে এ দুজনকে মুক্ত করে দিতাম। আমাদের যোদ্ধারা কাপুরুষ নয় যে, তারা যুদ্ধের বদলে শত্রুদের ধোঁকা দিয়ে এনে তাদের বেঁধে রেখে হত্যা করার জন্য মেতে উঠবে। কুরাইশরা! যদিও এরা এখন আর আমাদের ধর্মে নেই, তবু এদের শরীরে বইছে আমাদেরই রক্ত। শত্রু হলেও এরা এখন আমাদের মেহমান আমরা তাদের খুন করব ঠিকই, তবে এখানে নয়; খুন করব যুদ্ধের ময়দানে।’

ভিড়ের মধ্য থেকে অনেকেই চিৎকার দিয়ে উঠল—’ও ঠিক কথাই বলছে। শত্রুকে বেঁধে হত্যা করা আরবের নিয়ম-বিরুদ্ধ। এতে হত্যাকারীদের কাপুরুষতাই প্রমাণ হয়। এ অপবাদ আমরা নিজ হাতে নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে পারি না।

দর্শকদের নিজেদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল বাকবিতণ্ডা। অনেকে বলতে লাগল— ‘আমরা খেল দেখব। দুশমনকে এমনভাবে মারব, যেন সে মরতে মরতে বেঁচে যায়, বাঁচতে বাঁচতে মরে যায়।’

কিছুক্ষণের মধ্যে দর্শকরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। একদল জুবায়েরের হত্যার বিরুদ্ধে। তাদের বক্তব্য, এটা আরবের রীতি-নীতির বিরোধী, আরবের বুকে কুরাইশদের সম্মান ও মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করার এ এক জঘন্য প্রয়াস। তাদের বীরত্বের বিরুদ্ধে এ এক প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ। সামান্য দুজন লোককে হত্যা করে তারা যুগ যুগ ধরে কাপুরুষ বলে গালি খেতে নারাজ। আর অন্য দল জুবায়েরকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করতে চাচ্ছিল। সেই আঘাত খেয়ে সে কেমন ছটফট করে মরে-তা দেখার জন্য তারা হয়ে উঠেছিল হিংস্র পশুর মতো।

জুবায়ের তখনও খুঁটির সাথে বাঁধা, কিন্তু সেদিকে নজর দেওয়ার অবকাশ নেই এখন মক্কাবাসীদের। নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগে যাওয়ার উপক্রম প্রায়। দুই দলই নিজের মতের ওপর অটল এবং মারমুখী হয়ে উঠল। খালিদ যখন দেখল অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন, তখন সে শঙ্কিত হয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে গেল।

খালিদ বলল—’আবু সুফিয়ান! আমি আগেই বলেছিলাম, তোমার এ সিদ্ধান্ত আমার মনঃপূত নয়; এতে অপমানের গ্লানি ছাড়া আমরা আর কিছুই পাব না। এখন দেখ ময়দানের অবস্থা। তোমার নিজের লোকেরা এখন পরস্পরের রক্তের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠছে। দেখ এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কত লোক ধ্বনি- প্রতিধ্বনি তুলছে। এখনও সময় আছে আবু সুফিয়ান! একজনকে হত্যা করেছ, বাকি যে আছে—তাকে ছেড়ে দাও; নতুবা কুরাইশবাসী নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দেবে এবং নিজেদের রক্তে নিজেদের হাত রঞ্জিত করবে।’

হিন্দা দূর থেকে দেখতে পেল, খালিদ আবু সুফিয়ানের সাথে কথা বলছে। সে বুঝে নিল, খালিদ জুবায়েরকে মুক্ত করার তদবির করার জন্যই আবু সুফিয়ানের কাছে এসেছে। বিলম্ব না করে তাই হিন্দা দ্রুত ঘোড়া তাড়িয়ে ওদের কাছে ছুটে এলো।

হিন্দা কর্কশ স্বরে বলল—’খালিদ! আমি জানি তুমি কী চাও। তুমি কি আবু সুফিয়ানকে সরদার বলে মান্য করো না? যদি মান্য না করো, তবে এখান থেকে চলে যাও, তোমার সাথে তার কোনো কথা নেই। আর যদি মান্য করো, তবে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—তা মেনে নাও। বেয়াদবের মতো বাড়াবাড়ি করো না। আমি যা চিন্তা করেছি তা-ই হবে। ওদের তুমি বাঁচাতে পারবে না।

আবু সুফিয়ান বলল—’খালিদ! যদি তুমি মনে করো আমার আদেশ সঠিক নয়, তবুও তুমি আমাকে আমার মর্জিমতো কাজ করতে দাও। এখন যদি আমি আমার আদেশ ফিরিয়ে নিই, তবে আমার দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। জনসাধারণ আমার আদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। ভাববে, সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার দৃঢ়তা নেই। ফলে ভবিষ্যতে আমার নেতৃত্ব সংকটে পড়ে যাবে। তাই আমি যে আদেশ দিয়েছি, তা আর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।’

খালিদের আজ মদিনা যেতে যেতে এসব কথা একে একে মনে পড়ছিল। আজ তাঁর আফসোস হচ্ছে এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত সে আবু সুফিয়ানের আদেশই মেনে নিয়েছিল। কারণ, খালিদ ছিল একজন জাত সৈনিক। একজন সৈনিক সব সময় সেনাপতির আদেশ মেনে নেওয়াকে সবকিছুর ওপরে স্থান দেয়। সরদারের আনুগত্য করাকে সে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করে। খালিদ সেদিন বুকে পাথর চেপে শুধু এ কারণে আবু সুফিয়ানের আদেশ মেনে নিয়েছিল যে, নইলে কুরাইশদের মধ্যে নেতার আদেশ লঙ্ঘনের বদ রেওয়াজ চালু হয়ে যাবে।

আবু সুফিয়ান বিবাদমান দর্শকদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল——হে মক্কাবাসী! যদি আজ এখানে দুজন মুসলমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে যাই, যদি ওদের কেন্দ্র করে আজ নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাই, তবে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছুই হতে পারে না। যদি দুজন শত্রুকে কেন্দ্র করে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে যেতে পারি, তবে আমরা যখন অসংখ্য শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ব, তখন সেখানে তোমরা কয় দলে বিভক্ত হবে? এতে করে তোমাদের ওপর তোমাদের শত্রুরা বিজয় পতাকা উড়াবে, এই দলাদলির সময় সে কথা কি তোমাদের একবারও মনে পড়ল না? যদি তোমরা চাও, তাহলে তোমরা তোমাদের সরদারের আনুগত্য থেকে ফিরে যেতে পারো, কিন্তু আমি জানি—তার পরিণাম খুবই খারাপ হবে। আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, তোমাদের সে করুণ পরিণতির জন্য আমাকে দায়ী করতে পারবে না।’

আবু সুফিয়ানের বক্তব্য শুরু হতেই দর্শকরা নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি বন্ধ করে তার চারপাশে এসে সমবেত হতে লাগল। নিজেদের জটলা থামিয়ে তারা উদ্গ্রীব হলো আবু সুফিয়ানের বক্তব্য শোনার জন্য। থেমে গেল ভিড়ের চিৎকার-চ্যাঁচামেচি

আবু সুফিয়ানের কথা শেষ হলো। খালিদ দেখল, মক্কার কয়েকজন সরদার ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ময়দান থেকে সরে পড়ল। খালিদও সরে পড়তে চাচ্ছিল, কিন্তু একটা অঘটন ঘটার আশঙ্কার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সরে পড়তে পারল না। কারণ, আবু সুফিয়ানের এত বক্তৃতার পরও লোকজন পুরোপুরি শান্ত হয়নি। দেখা গেল—ময়দানজুড়ে কানাঘুষা, ফিসফাস বেশ জোরেশোরেই চলছে; যেকোনো মুহূর্তে একটি সংঘর্ষ বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা তখনও শেষ হয়ে যায়নি। সে তার দলের ও গোত্রের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাদের কাছে ছুটে গেল। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার ফলে সে যাত্রায় কুরাইশরা এক রক্তাক্ত সংঘাত থেকে রেহাই পেয়েছিল।

এ দুজন মুসলমানকে হত্যা করে দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য হিন্দা মনের মতো পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সেই পরিকল্পনামতো হিন্দা এবার তার কাজ শুরু করে দিলো। তার ইঙ্গিতে চল্লিশজন কিশোর বালক বর্শা হাতে ময়দানে নেমে এলো। নানা রকম আনন্দ ধ্বনি দিতে দিতে তারা এগিয়ে চলল জুবায়েরের দিকে। জুবায়েরের সামনে এসে তারা তাঁকে ঘিরে নাচতে শুরু করল। নাচের সঙ্গে এবার শুরু করল সমবেত কণ্ঠে গান। নাচ-গানের তালে তালে তারা বর্শা উঁচিয়ে জুবায়েরের নাগালের মধ্যে চলে এলো। এরপর নাচের তালে তালে বিভিন্ন দিক থেকে সে বর্শা দিয়ে আস্তে আস্তে খোঁচা দিতে লাগল জুবায়েরের গায়ে।

কিন্তু সবাই সতর্ক থাকল—যেন আঘাত খুব জোরে না লাগে, যেন আঘাতের চোটে তাঁর এক্ষুনি মৃত্যু না ঘটে। তারা নাচছে, ঘুরছে আর শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত হেনে চলেছে। জুবায়েরের সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল। কিশোররা এবার তালে তালে একদল এগোয়, একদল পিছায় আর বর্শা ছোড়ার ভঙ্গি করে। ওরা মুখ ভেংচে ভয় দেখাতে চেষ্টা করল জুবায়েরকে। কিছুক্ষণ এভাবে ভয় দেখিয়ে আবার একটু একটু করে আঘাত করতে লাগল। জুবায়ের আঘাতের তালে তালে জিকির শুরু করল—’লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)!’

ছেলেরা বর্শা উঁচিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগল। আঘাতে আঘাতে জুবায়ের-এর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল। কিন্তু সারা শরীর ক্ষত–বিক্ষত

করলেও তারা জুবায়ের-এর বুকে আঘাত করল না। ছেলেরা জুবায়ের কে ভেংচালো, খোঁচাল, ভয় দেখাল। দর্শকরা ছেলেদের কাণ্ড দেখে কখনো আনন্দ ধ্বনি দিলো, কখনো খিলখিল করে হেসে উঠল, কখনো-বা হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিলো তাদের।

ছেলেদের এই খেলা চলল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর ছেলেরা তাদের আঘাত আরও জোরদার করল। জুবায়ের-এর কণ্ঠ থেকে প্রতিটি আঘাতের সাথে উচ্চরিত হতে থাকল ‘আল্লাহু আকবার’ ও ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)’ ধ্বনি। তাঁর সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। দর্শকদের আনন্দ ধ্বনি চলতে থাকল বিরতিহীনভাবে। দীর্ঘ সময় ধরে এই খেলা চলার পর আবু জাহেলের বেটা আকরামা হাতে বর্শা নিয়ে বালকদের কাছে গেল এবং তাদের কীভাবে আঘাত করবে শিখিয়ে দিতে লাগল। এখন জুবায়ের-এর শরীরে এমন এক ইঞ্চি জায়গাও, নেই যেখানটা বর্শার আঘাতে ঝাঁঝরা হয়নি। এমন এক চিলতে জায়গাও নেই, যেখান থেকে রক্ত ঝরছে না।

ছেলেরা তাঁর মুখেও বর্শার আঘাত করল এবং সারা মুখ ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো। যখন নেচে-গেয়ে ও বর্শার আঘাত করতে করতে ছেলেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল, তখন আকরামা তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিলো। জুবায়ের-এর দেহ রক্তে রঞ্জিত, কিন্তু তিনি তখনও জীবিত। ছেলেরা সরে পড়ায় এখন আর কেউ তাঁকে আঘাত করছে না। তিনি আস্তে আস্তে চোখ খুললেন এবং চারদিকে তাকালেন, দেখলেন বর্শা হাতে আকরামা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আল্লাহর নাম জপতে থাকলেন। আকরামা ধীরেসুস্থে জুবায়ের-এর বুক লক্ষ্য করে বর্শার নিশানা করল। তারপর সহসা প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আঘাত করল জুবায়ের-এর বুকে। বর্শা জুবায়ের-এর বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলো। শহিদ হয়ে গেলেন জুবায়ের।

হিন্দার ঝাঁজালো স্বরে শোনা গেল—’এদের লাশ এভাবেই বাঁধা থাক। যতদিন লাশ পচে-গলে নিঃশেষ না হবে, ততদিন এখানেই থাকবে লাশ। দর্শকরা দেখতে পারবে—আমাদের সাথে দুশমনি করার পরিণাম!

এই ঘটনা ঘটেছিল ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে। খালিদের মনের পর্দায় আজও সে দৃশ্য ভাসছে। আজও তাঁর মনে বয়ে যাচ্ছে সে ব্যথার ঢেউ। জুবায়ের ও জায়েদ

-কে হত্যার মধ্য দিয়ে কুরাইশদের মধ্যে রোপিত হলো বিভেদের বীজ। শেষবারের মতো এই দুই বীর শহিদ যখন প্রশান্ত চিত্তে নামাজ পড়ছিলেন, সে দৃশ্য দেখে অনেক সাধারণ কুরাইশ এমনকী কোনো কোনো সরদারেরও বুকের ভেতরের কলকবজা নড়ে উঠেছিল। ইসলাম থেকে ফিরে আসার জন্য আৰু সুফিয়ানের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মধ্য দিয়ে আদর্শের প্রতি তাদের দৃঢ়তা ও শ্রেষ্ঠত্বের যে স্বাক্ষর তাঁরা রাখলেন, সে মহত্ত্বের কথা স্মরণ করে অভিভূত হয়ে গেল অনেক যুবক ও তরুণ। এই দৃশ্য কুরাইশের কিছু নেতার মনে এমন গভীরভাবে রেখাপাত করল যে, তারা এ দুই বীরের বীরত্বে মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়ে গেল। খালিদ বিন ওয়ালিদ তাদেরই একজন। সে মনে মনে জুবায়ের ও জায়েদ বীরত্বের খুবই প্রশংসা করল। সেইসঙ্গে এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় আবু সুফিয়ান ও হিন্দার বিরুদ্ধে তাঁর মনে জন্ম নিল অপরিসীম ঘৃণা ও ক্রোধ।

খালিদ আপন মনেই নিজেকে বলল—’এটা যোদ্ধাদের পক্ষে মেনে নেওয়ার মতো কোনো রীতি নয়। এ ঘটনা যোদ্ধাদের জন্য অশোভন ও অমর্যাদাকর।’

কয়েক দিন পরের কথা। একদিন খালিদ ওইসব সরদারদের নিয়ে এক বৈঠকে বসল, যারা রাসূলে কারিম-এর সাহাবিদ্বয়ের হত্যার বিরুদ্ধে সেদিন মাঠে সোচ্চার হয়েছিল।

‘তোমরা কি জানো, মৃত্যুবরণকারী সাহাবি মাত্র দুজন নয়, ছয়জন ছিল?’ খালিদ জিজ্ঞেস করল।

এক সরদার উত্তর দিলো—’হ্যাঁ! এ ছিল শারজা বিন মুগির অপকর্ম। সে এই ছয়জন মুসলমানকে ধোঁকা দিয়ে মদিনা থেকে বের করে এনেছিল। আর এ অপকর্মের বুদ্ধি ও পরামর্শদাতা ছিল মক্কারই কয়েকজন ধুরন্ধর ইহুদি।’

‘তাদের সাথে ইহুদিকন্যা ইউহাদা ও কয়েকজন ইহুদি নারীর রূপের ফাঁদও জাদুর মতো কাজ করছিল।’ বলল খালিদ।

বলল একজন সরদার, ‘ইউহাদা আসলেই এক জাদুকন্যা। সে এমন জাদু জানে যে, এক ভাইকে দিয়ে আরেক ভাইকে সে জবাই করাতে পারে।

‘এটা কি আমাদের জন্য ভয়ের কারণ নয়? ইহুদিরা আমাদের পরস্পরের মধ্যেও এমন দুশমনি সৃষ্টি করে ফেলতে পারে।’ অন্য এক সরদার বলল।

এক বৃদ্ধ সরদার বলল—’না! মুহাম্মাদ (সাঃ) তাদের যেমন শত্রু, তেমনি আমাদেরও। ইহুদিরা চাচ্ছে তাদের শত্রু খতম হোক, কিন্তু তারা তাঁর মোকাবিলায় দাঁড়াতে রাজি নয়। তারা আমাদের ব্যবহার করেই মুসলমানদের ওপর জয়ী হতে চায়। চায় মুসলমানদের সাথে আমাদের শত্রুতা এমন তীব্র ও কঠিন হোক, যাতে আমরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দিই।’

অন্য এক সরদার বলল—’ইহুদিদের ওপর আমাদের সন্দেহ করা উচিত নয়; বরং প্রয়োজনে আমরা ইহুদিদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে তলে তলে ব্যবহার করতে পারি।’

খালিদ বলল—’কিন্তু এমন নয়, যেমন শারজা করেছে। আর এমনও নয়, যেমন আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী করেছে।’

বুড়ো সরদার বলল—’তোমরা কি জানো, ইউহাদা মক্কার কিছু ইহুদির সঙ্গে মদিনায় চলে গেছে? সে মদিনা ও তার আশেপাশে ইহুদি ও অন্যান্য জাতিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকানি দেবে। ইসলামের উন্নতিতে সে নিজে ভয় পাচ্ছে। যদি মুহাম্মাদের বিশ্বাস ও মতবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আর যুদ্ধের ময়দানে মুহাম্মাদের অনুসারীদের প্রেরণা যেমন আমরা দেখছি যদি তা-ই থাকে, তবে খোদ ইহুদিদের সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবে।

খালিদ বলল—’কিন্তু ইহুদিরা যুদ্ধ করার জাতি নয়। যুদ্ধের ময়দানে তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে না।’

অন্য এক সরদার বলল—’যুদ্ধের ময়দানে তারা আমাদের জন্য একটা বড়ো সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারবে। তারা ইউহাদার মতো রূপসী মেয়েদের দিয়ে মুসলমান সরদার ও সেনাপতিদের যুদ্ধের ময়দানে আসার অযোগ্য করে দিতে পারবে।’

খালিদ উহুদ পাহাড়ের প্রান্তে এসে দাঁড়াল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। এতক্ষণ স্মৃতিপটে যেসব দৃশ্য একের পর এক ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সহসা সেগুলো হারিয়ে গেল। তাঁর চোখ এখন পাহাড়ের দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। পাহাড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে ঘোড়া। একের পর এক মাড়িয়ে যাচ্ছে চড়াই-উতরাই। তাঁর ঘোড়া এখন নিচের দিকে নামছে। এই প্রান্তরটি প্রায় এক মাইল দীর্ঘ ও আধা মাইল পাশ। এর মাঝে কোথাও কোথাও ছোটো ছোটো বালির টিলা দাঁড়িয়ে আছে। নিরেট বালি নয়; বালি ও মাটি মিশ্রিত ঢিবি। খালিদ কোনো জন্তুর দৌড়ানোর পদধ্বনি শুনতে পেল। সে সেদিকে চমকে তাকাল এবং তাঁর হাত তলোয়ারের বাঁটের ওপর চলে গেল। দেখল পাঁচটি হরিণ নিচের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে একটি হরিণ আর একটিকে গুঁতা দিলো। গুঁতা খাওয়া হরিণটি ফিরে দাঁড়াল। ফলে সামনাসামনি শুরু হয়ে গেল পরস্পর গুঁতাগুঁতি। অন্যান্য হরিণগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই গুঁতাগুঁতি দেখছিল। আহ, কী সুন্দর প্রাণী! খালিদ মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছিল ওদের খেলা। হঠাৎ একটি হরিণ দেখে ফেলল খালিদের ঘোড়া। সাথে সাথে সে ঘাড় উঁচু করে মাটিতে পায়ে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ওদের লড়াই। চকিতে মাথা তুলে একদিকে ছুটে পালাল সমস্ত হরিণ। মুহূর্তের মধ্যে খালিদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল হরিণগুলো।

কুরাইশ সরদাররা মানসিকভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল। যদিও তাতে করে তখনও নিজেদের মধ্যে পরস্পর শত্রুতার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু প্রীতি, ভালোবাসা ও ঐক্যের যে বন্ধন এতদিন অটুট ছিল, তা আর অটুট থাকল না।

খালিদের মনে পড়ছে, এইতো সেদিনও কুরাইশের সকলেই আবু সুফিয়ানকে সরদার ও সেনাপতি হিসেবে অসম্ভব শ্রদ্ধা, ভক্তি ও মান্য করত। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যখন কুরাইশদের মধ্যে ঐক্যের বিশেষ প্ৰয়োজন, তেমনি এক জরুরি মুহূর্তে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো এই মানসিক ভাঙন। একজন সেনানায়ক হিসেবে খালিদ বুঝতে পারছিল, এর পরিণতি শুভ হবে না। কিন্তু দৈহিক ফাটল বন্ধ করা যত সহজ, মানসিক ফাটল বন্ধ করা তত সহজ নয়। কারণ, এ ফাটল চোখে দেখা যায় না। খালিদ বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল।

খালিদ একদিন আবু সুফিয়ানকে বলেছিল, ‘আপনার কি জানা নেই, নিজেদের মধ্যে ফাটল শত্রুদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি করে? আপনি কি কখনো চিন্তা করেছেন—কীভাবে এ ফাটল বন্ধ করা যায়? কীভাবে আবার সব সরদারদের চিন্তাধারাকে একসূত্রে আবদ্ধ করা যায়?’

আবু সুফিয়ান হতাশ কণ্ঠে বলল—’অনেক চিন্তা করেছি খালিদ! অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সকলে আগের মতোই এখনও আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি, তাদের সবার মন আর আগের মতো পরিষ্কার নেই। তুমি কি এমন কোনো উপায়ের কথা বলতে পারো, যাতে তাদের অন্তরগুলো আবার আগের মতো হয়ে যায়?’

খালিদ বলল—’হ্যাঁ! একটা উপায় আমি চিন্তা করেছি। আর আমি এ চিন্তাই আপনার সামনে রাখতে চাচ্ছিলাম। সরদারদের মনে এখন নানা রকম সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছে, আমরা এখন নামে মাত্র যোদ্ধা, মুসলমানদের ভয় আমাদের অন্তরে ঢুকে গেছে। শারজা যে ছয়জন মুসলমানকে ধোঁকা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে দুজনকে আপনার দ্বারা হত্যা করিয়ে আমাদের ইমেজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এর একমাত্র প্রতিকার হলো—আবার মদিনার ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা। সবার সামনে এটা প্রমাণ করা যে, আমরা যুদ্ধবাজ এবং বীর জাতি। মুসলমানদের ব্যাপারে আমরা সব সময়ই আপসহীন।

আবু সুফিয়ান লাফিয়ে উঠে বলল—’আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ খালিদ। তোমার কি মনে আছে, উহুদের যুদ্ধ শেষে আমি মুহাম্মাদকে বলেছিলাম— ‘তুমি বদরের যুদ্ধে আমাদের পরাজিত করেছিলে, আমরা উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তার প্রতিশোধ নিয়েছি।’ আমি আরও বলেছিলাম—’কুরাইশের বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে, জ্বলতে থাকবে। আগামীতে বদরের ময়দানেই তোমাদের আমরা যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানাব?’’

‘হ্যাঁ! আমার মনে আছে।’ খালিদ বলল—’অন্যদিকে উমর বলেছিল—’আল্লাহ যদি চায়, তবে আগামীতে বদরের ময়দানেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হবে।’

আবু সুফিয়ান বলল—’হ্যাঁ, কথাগুলো উমরের মুখ দিয়েই উচ্চারিত হয়েছিল ঠিক, কিন্তু কথাগুলো ছিল মুহাম্মাদের।’ মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন ভীষণভাবে আহত ছিল! ফলে সে কিছু বলতে পারছিল না। আমি মুহাম্মাদকে সংবাদ পাঠাচ্ছি, অমুক দিন বদরের ময়দানে এসো এবং পরিণাম ভোগ করো।’

দুজনে পরামর্শ করে একটা দিন ঠিক করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, একজন ইহুদিকে দিয়ে এ খবর মদিনায় পাঠানো হবে।

পরের দিনই আবু সুফিয়ান কুরাইশদের সমস্ত সরদারকে তার কাছে ডেকে পাঠাল। বৈঠকে আনন্দের সাথে ঘোষণা করা হলো, মুসলমানদের আবার বদরের ময়দানে যুদ্ধের আহ্বান জানানো হচ্ছে। কুরাইশরা এ ধরনের ঘোষণারই অপেক্ষায় ছিল। কারণ, তারা আত্মীয়স্বজনের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ছিল বেকারার।

তাদের অন্তরে রাসূলে আকরাম-এর ওপর আক্রোশ বারুদের মতো পূর্ণ ছিল। মাত্র একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায় ছিল তারা। ঘোষণা শুনে তারা বলল—’মুহাম্মাদ (সাঃ) বাপে-বেটায় ও ভাইয়ে-ভাইয়ে শত্রুতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। আমরা এমন একটি ঘোষণারই অপেক্ষায় ছিলাম।’

আবু সুফিয়ানের এ ঘোষণা সকলের মনে আবার ঐক্যের বন্ধন দৃঢ় করল। তারা জোরেশোরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগল। একজন বিজ্ঞ ইহুদিকে বাছাই করা হলো এ খবর নিয়ে মদিনায় যাওয়ার জন্য। তাকে বলা হলো—’এ খবর দেওয়ার পর নবি করিম (সাঃ) কী উত্তর দেয়—তা-ও তুমি শুনে আসবে।’

খালিদের মনে আছে, সেদিন তাঁর মনে প্রশান্তি ও আনন্দ ফিরে এসেছিল। কুরাইশ সরদারদের মনেও সেনাপতি ও নেতৃত্বের ব্যাপারে যে অনাস্থার ভাব সৃষ্টি হচ্ছিল, তা দূর হয়ে গিয়েছিল। খালিদ মনে মনে সংকল্প নিয়ে ফেলেছিল, সে রাসূলে করিমকে নিজের হাতে হত্যা করবে।

ইহুদি দূত মদিনা থেকে উত্তর নিয়ে ফিরে এলো। রাসূলে করিম (সাঃ) নির্দিষ্ট সময়ে আবু সুফিয়ান ও তার বাহিনীর জন্য বদর প্রান্তরে অপেক্ষায় থাকবেন বলে জানিয়েছেন। যুদ্ধের সময় ঠিক করা হয়েছে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে।

অন্যান্য বছর শীতকালের এ সময় যেমন বৃষ্টিপাত হয়, এ মৌসুমে তেমন বৃষ্টিপাত হলো না। ফলে মৌসুমটা প্রায় শুষ্কই কেটে গেল। মার্চ মাসে গরম এত বেশি পড়ল যে, বেদুইনদের পক্ষেও তা সহ্য করা কঠিন ছিল। আবু সুফিয়ান এ আবহাওয়া ও পরিবেশকে যুদ্ধের উপযোগী মনে করতে পারল না, সে যুদ্ধযাত্রার ব্যাপারে টালবাহানা করতে লাগল।

এতে খালিদ যারপরনাই লজ্জা অনুভব করল। আবু সুফিয়ান গরমের ছুতো তুলে যুদ্ধকে পিছিয়ে নিতে চাইল। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ লিখেছেন- ‘আবু সুফিয়ান কুরাইশ সরদারদের ডেকে বলল—’যুদ্ধাভিযান চালানোর আগে মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা দরকার। এ ব্যাপারে ইহুদিদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।

এরপর এক ইহুদিকে বিশেষ মূল্য দিয়ে বণিকের বেশে মদিনায় পাঠানো হলো। তাকে বলা হলো—মদিনায় গিয়ে তুমি এই গুজব ছড়াবে যে, কুরাইশরা এত অধিকসংখ্যক সৈন্য নিয়ে এবার বদরের দিকে যাত্রা করছে যে, মুসলমানরা আগে কখনো এত অধিক সৈন্য একত্রে দেখেনি।’

ইহুদি যথাসময়ে গিয়ে মদিনায় পৌঁছল এবং ঠিকমতোই এ গুজব ছড়িয়ে দিলো। মদিনাবাসীরা এ গুজব সত্য বলে বিশ্বাস করল। কিন্তু মুসলমানরা এতে ভীত হলো কি না—ঠিক বোঝা গেল না, তবে মদিনায় একটা থমথমেভাব সৃষ্টি হলো। রাসূল (সাঃ) ও এ খবর শুনলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, খবরটি মুসলমানদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। রাসূল (সাঃ) সাহাবিদের সমবেত করলেন। বললেন—’আল্লাহর নামে জীবন পণকারী মুজাহিদবৃন্দ! কুরাইশরা সংখ্যায় অনেক বেশি হবে—শুধু এইটুকু কথা শুনেই তোমরা কি ভয় পেয়ে গেছ? একমাত্র আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষা যারা পেয়েছে, মূর্তিপূজারিদের আধিক্য দেখে তারা কি ভয় পেতে পারে? যদি তোমরা কুরাইশদের ভয় পেয়ে থাকো আর যুদ্ধের আহ্বান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও, তবে শুনে রেখ— যিনি সর্বশক্তিমান, যিনি আমাকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়েছেন—সেই আল্লাহর কসম! বদরের ময়দানে কুরাইশদের মোকাবিলা করতে আমি একাই যাব।’

রাসূলে আকরাম এর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সাহাবিরা তাকবির ধ্বনি দিয়ে আসমান-জমিন কাঁপিয়ে তুলল। গুজবের রেশমাত্রও কোথাও রইল না। রাসূলে কারিমের ক্ষুদ্র এ ভাষণের ফলে মদিনার মাটি থেকে গুজবের প্রভাব একেবারে উধাও হয়ে গেল। মুসলমানরা ব্যস্ত হয়ে উঠল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে। যুদ্ধাভিযানের সময় মুসলমানদের সংখ্যা পৌঁছাল দেড় হাজারে, তার মধ্যে পঞ্চাশজন অশ্বারোহী।

ইহুদি মক্কায় ফিরে এসে বলল—’প্রথম দিকে গুজবের বেশ প্রভাব পড়ছিল মদিনায়। কিন্তু একদিন মুহাম্মাদ (সাঃ) মুসলমানদের সমবেত করে মাত্র কয়েকটি কথা বলল, সাথে সাথে গুজবের সমস্ত প্রভাব মুছে গেল মদিনার বুক থেকে। মুসলমানরা বদরে অভিযান চালানোর জন্য পূর্ণ উদ্যমে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজারে পৌঁছে গেল। আমার মনে হয়—যুদ্ধের সময় এ সংখ্যা আরও বাড়বে।’

আজ মদিনা যাওয়ার পথে এ ঘটনা মনে করে তাঁর বড়ো লজ্জা হচ্ছিল। সে তখন মনে করছিল, আবু সুফিয়ান কোনো না কোনো কারণে মুসলমানদের সম্মুখীন হতে ভয় পায়। খালিদ যখন মুসলমানের সংখ্যার কথা শুনল, তখন সে ভীত-সন্ত্রস্ত আবু সুফিয়ানের কাছে গেল।

খালিদ তাকে বলল—’আবু সুফিয়ান! সরদারের আদেশ মান্য করা আমার কর্তব্য। কিন্তু মুসলমানদের ভয় আপনার মধ্যে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে, আপনি ঠিকমতো আদেশ করতে পারবেন কি না আমার তা-ই সন্দেহ হচ্ছে। আমার মধ্যে কুরাইশদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এত বেশি যে, ভীতুদের সাথে আমি চলতে পারব কি না জানি না। আপনি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের চেষ্টা করুন, নইলে আপনার আদেশের দিকে হয়তো আমি লক্ষই রাখতে পারব না।’

আবু সুফিয়ান খালিদের দিকে তাকিয়ে বলল—’তুমি কি শোনোনি, আমি ইহুদিকে মদিনায় কেন পাঠিয়েছিলাম? আমি মুসলমানদের যুদ্ধের আগেই ভীত- সন্ত্রস্ত করে তুলতে চেয়েছিলাম।’

খালিদ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল—’আবু সুফিয়ান! যুদ্ধে পারদর্শীরা কখনো ভয় করে না। আপনি কি মুসলমানদের সংখ্যায় অল্প কজন হওয়ার পরও বিপুল বাহিনীর মোকাবিলায় যুদ্ধ করতে দেখেননি? আপনি কি জুবায়ের ও জায়েদকে হত্যা করার সময়ও ইসলামের বিজয় ধ্বনি দিতে শোনেননি? আমি আপনাকে শুধু এ কথাই বলতে এসেছি, আপনি আপনার নেতৃত্বের সম্মান রক্ষা করুন এবং অবিলম্বে বদরের অভিযানের ব্যবস্থা করুন।’

পরের দিনই মক্কায় সংবাদ পৌঁছল, মুসলমানরা মদিনা থেকে বদরপ্রান্তে এসে অবস্থান নিয়েছে। এ খবর শোনার পর আবু সুফিয়ানের পক্ষে যুদ্ধ যাত্রার আদেশ না দিয়ে আর কোনো উপায় রইল না। এবারের এ বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল দুই হাজার পদাতিক ও একশো অশ্বারোহী। প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ান, সহপ্রধান সেনাপতি খালিদ এবং উপপ্রধান সেনাপতি ছিল আকরামা ও ছাফওয়ান। বরাবরের মতোই গায়িকা, নর্তকী, বাজনাদার, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা এবং তার সাথে উদ্দীপনাময় উচ্ছল তরুণী, রমণী ও দাস-দাসীরা সঙ্গে ছিল।

মুসলমানরা রাসূলে আকরামের নেতৃত্বে ৪ এপ্রিল, ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক পহেলা জিলকদ, হিজরির ৪ সালে বদরের ময়দানে এসে পৌঁছেছিলেন।

কুরাইশরা যাত্রা করে আসফান নামক স্থানে পৌঁছার পর রাত নেমে এলো। রাতে আর অগ্রসর না হয়ে তারা সেখানেই রাত কাটাল। পরদিন ভোরে কুরাইশ বাহিনী বদরের দিকে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবু সুফিয়ান সৈন্যদের সকলকে একত্রিত করে তাদের সামনে ভাষণ দিলো। ভাষণে আবু সুফিয়ান বলল—’কুরাইশের বীর জওয়ানরা! মুসলমানরা তোমাদের বড়ো ভয় পায়। তাদের সঙ্গে আমাদের এবারের যুদ্ধ হবে শেষ যুদ্ধ। এই মুষ্টিমেয় মুসলমানকে আমরা এবার নিশ্চিহ্ন করে দেবো। না মুহাম্মাদ (সাঃ) এই মাটিতে থাকবে, না তাঁর সমর্থকরা থাকবে। কিন্তু আমরা এমন এক অবস্থায় যুদ্ধ করতে যাচ্ছি যে, পরিবেশ আমাদের প্রতিকূল হতে পারে। যদি আমরা শত্রুর ওপর ঠিকমতো আঘাত হানতে না পারি, তবে তা আমাদের পরাজয়ের কারণও হতে পারে। তোমরা কি লক্ষ করেছ—আমরা পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য সঙ্গে আনতে পারিনি? এখন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করাও কঠিন। কারণ, এখন শুষ্ক মৌসুম, সারা দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে।

তা ছাড়া এখনকার প্রচণ্ড গরমের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। আমি চাই না—আমার বীর সেনারা ক্ষুৎপিপাসায় মরে যাক। আমরা যেহেতু মুসলমানদের সাথে চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামতে চাই, তাই আমি মনে করি-আমাদের অনুকূল অবস্থার জন্য অপেক্ষা করা উচিত। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা আর সামনে অগ্রসর হব না; এখনকার মতো আমরা এখান থেকেই মক্কায় ফিরে যাব।’

খালিদের বেশ মনে আছে, কুরাইশ সৈন্যদের মাঝে এর দুই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। একদল যুদ্ধের পক্ষে ধ্বনি দিচ্ছিল, তারা প্রতিকূল অবস্থায়ও মুসলমানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য কৃতসংকল্প। আরেক দল ধ্বনি দিচ্ছিল আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্তের সপক্ষে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনাপতির আদেশ-ই সকলকে মানতে হলো। খালিদ, আকরামা ও সাফওয়ান আবু সুফিয়ানের আদেশ মান্য করতে অস্বীকার করল, কিন্তু আবু সুফিয়ান তাদের প্রতিবাদের দিকে কান দিলো না।

এ তিনজন তাদের সঙ্গে কতজন থাকতে চায় তা পর্যবেক্ষণ করতে চাইল। কিন্তু তাদের এ পর্যবেক্ষণ তাদের বিপক্ষেই গেল। সেনাদলের অধিকাংশই আবু সুফিয়ানের আদেশে মক্কায় ফিরে চলল। বাধ্য হয়ে খালিদ ও তাঁর সঙ্গীদেরও তাদের পিছু পিছু মক্কায় ফিরে আসতে হলো। সেদিনের সেই ফিরে যাওয়ার স্মৃতি খালিদের আজও স্পষ্ট মনে আছে। তারা কুরাইশ সেনাদলের পিছু পিছু মক্কায় ফিরে আসছে। লজ্জায় আকরামা, সাফোয়ানসহ সকলের মাথা নিচু। কেউ কারও দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছিল না। খালিদের বারবার মনে হচ্ছিল— যুদ্ধে যদি তাঁর একটি পা কাটা পড়ত, একটি বাহু ছিন্ন হয়ে যেত বা তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে যেত, তবুও সে এত দুঃখ পেত না। সে সময় তাঁর এমনও মনে হচ্ছিল-যেন সে মরে গেছে আর তাঁর লাশ ঘোড়ার ওপর তুলে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুসলমানের নবিকে হত্যা করার পরিকল্পনা ও প্রতিজ্ঞা পূর্ণ না করেই সে ফিরে যাচ্ছে—এ কথা তাঁর মনকে তখন বিচ্ছুর মতো দংশন করছিল।

আজ তাঁর অনেক কথাই মনে পড়ছে। স্মৃতির এক রেকর্ড যেন অনবরত মনের পর্দায় বেজে চলছে; যার কোনো শেষ নেই, থামার কোনো নাম নেই। ইহুদিদের তিনটি গোত্র : বনু নাজির, বনু কুরায়জা ও বনু কায়নুকার কথা মনে পড়ল তাঁর। যখন তারা দেখল কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই না করেই ফিরে আসছে, তখন তাদের মাথা গরম হয়ে গেল।

তারা কুরাইশদের এমনভাবে তিরস্কৃত করতে লাগল, যেন মুসলমানের বিরুদ্ধে কুরাইশরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু কুরাইশ নেতা আবু সুফিযান এসব উসকানিতে একটুও কান দিলো না। খালিদ আজও ভেবে পায় না, আবু সুফিয়ানের মনে কী ছিল? কেন সে মুসলমানদের সঙ্গে লড়াই করতে এত ভয় পেয়েছিল?’

সেই বছরে শীতের মৌসুমে শুরুতে খায়বারের কিছু বিশিষ্ট ইহুদি মক্কায় গেল। বানু নাজির গোত্রের সরদার হাইয়া বিন আফতাব ছিল এদের দলনেতা। ইহুদিদের সাথে ছিল ধন-সম্পদ ও বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ। তারা কুরাইশ সরদার আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য সরদারদের জন্য মোটা অঙ্কের উপঢৌকন নিয়ে এসেছিল। এ ছাড়াও তাদের সঙ্গে ছিল সুন্দরী যুবতি, নর্তকী ও গায়িকা। মক্কাতে এরা আবু সুফিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। তার হাতে তুলে দিলো বিপুল উপঢৌকন সামগ্রী। রাতের অধিবেশনে আহারাদির পর শুরু হলো নাচ ও গানের আসর। অনুষ্ঠানে খালিদ, আকরামা ও সাফওয়ানও উপস্থিত।

আলোচনা পর্বে হাইয়া বিন আফতাব বলল—’যদি আপনারা মুসলমানদের শেষ না করেন এবং তাদের অগ্রগতিতে বাধা না দেন, তবে তারা অচিরেই ইয়ামামা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। যদি তারা এভাবে সফল হয়, তবে কুরাইশদের জন্য এই বাণিজ্যপথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। বাহরাইন ও ইরাকের সাথে যোগাযোগের এ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির নিয়ন্ত্রণভার মুসলমানদের হাতে চলে গেলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কুরাইশ সম্প্রদায়। কারণ, আপনাদের আয়-রোজগারের সিংহভাগ আসে এই পথ দিয়ে। এ পথ দখল করা আর আপনাদের শাহরগে তলোয়ার ধরা এককথা।’ হাইয়া বিন আফতাব আরও বলল—’যদি আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকেন, তবে আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগতে পারি। আমরা এবার ষড়যন্ত্রের এমন জাল বিছাতে চাই, যা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার সাধ্য মুসলমানদের হবে না।’

আবু সুফিয়ান বলল—’আমরা মুসলমানদের সংখ্যায় দ্বিগুণ ছিলাম, তবুও তাদের পরাজিত করতে পারিনি। এদের সঙ্গে তিনগুণ শক্তি নিয়ে লড়লেও তাদের পরাজিত করা যাবে না। তবে যদি আরও কিছু গোত্র ও সম্প্রদায় আমাদের সাথে মিলিত হয়, তাহলে আমরা মুসলমানদের চিরতরে শেষ করতে পারব।’

হাইয়া বিন আফতাব বলল—’আমি এ ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি। গাতফান ও বনু আসাদ সম্প্রদায় আপনাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছে। আরও কয়েকটি গোত্রকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছি। আশা করি তারাও আপনাদের সঙ্গে থাকবে।’

তিন-চার বছর আগেকার সেই কলঙ্কিত কাহিনি খালিদের আজও পরিষ্কার মনে আছে। আবু সুফিয়ানের ভীত ভীত চেহারাটা এখনও যেন দেখতে পাচ্ছে সে। খালিদ জানত, ইহুদিরা কেন কুরাইশ সম্প্রদায়কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছে। ইহুদিদের ধর্ম ইসলামের সাথে প্রতিযোগিতায় আজ অতি বিপদের সম্মুখীন, কিন্তু তারা নিজেরা এর মোকাবিলা করতে পারছে না। তাই তারা আবু সুফিয়ানকে এমন একটি নকশা দেখাচ্ছে, যাতে মনে হয় মুসলমানদের ধ্বংস করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। এজন্য তারা যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে মুসলমানদের ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তারপরও খালিদ, আকরামা ও সাফওয়ান বিন উমাইয়া দেখল, আবু সুফিয়ান আগের মতোই ভীত-শঙ্কিত, যেন আর মাথা তোলার ক্ষমতা নেই তার।

আবু সুফিয়ানের নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠলে কথা বলল খালিদ——আমি আপনাকে আমাদের সরদার হিসেবে মান্য করি। কিন্তু এটা না বলে পারছি না যে, আপনি একজন কাপুরুষ। যদি মুসলমানরা খারাপ আবহাওয়ায় এবং দুর্ভিক্ষের সময় যুদ্ধ করতে পারে, তবে আমাদের বাধা কোথায়? আমরাও যুদ্ধ করতে পারতাম!’

আকরামা উষ্ণ কণ্ঠে বলল—’আপনি মিথ্যা বলে আমাদের ধোঁকা দিয়েছেন।’

আবু সুফিয়ান কাপুরুষ, সে আমাদের পুরো সম্প্রদায়ের মাথায়ও কাপুরুষের কলঙ্ক লাগিয়ে দিয়েছে। এখন মুহাম্মাদের শিষ্যরা আমাদের মাথায় চড়ে বসবে।’ সাফওয়ান বলল।

এভাবে আবু সুফিয়ানকে তিরস্কার করতে করতে রাগে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে এলো ওরা। এখন মক্কার অলিতে-গলিতে এসব কথা গুঞ্জরিত হচ্ছে। এটাও ছিল ইহুদিদের আরেক ষড়যন্ত্র, যেন আবু সুফিয়ান না চাইলেও কুরাইশ সম্প্রদায় তাদের লজ্জা ও অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠে। ফলে অবস্থা এমন খারাপ হয়ে উঠল যে, আবু সুফিয়ানের পক্ষে বাড়ির বাইরে যাওয়াই কঠিন হয়ে গেল।

খালিদের ঘোড়া উহুদের প্রান্তর মাড়িয়ে ছুটে চলেছে মদিনার দিকে। খালিদের মনে ভেসে উঠছে পুরোনো দিনের কত তিক্ত-মধুর ঘটনা! এসব ঘটনার বেশিরভাগই লজ্জার ও বেদনার। খালিদ এসব ঘটনা মনে করতে চায় না, কিন্তু সেসব স্মৃতিই যে এখন তাঁর একমাত্র সঙ্গী। কত অনাহুত স্মৃতিরা এসে ভিড় করছে তাঁর হৃদয় ক্যাসভাসে! ঘোড়া এগিয়ে চলেছে। ঘোড়ার পিঠে বসে স্মৃতি রোমন্থন করছে খালিদ। দৃষ্টি তাঁর মদিনার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *