ঝিঁঝিঁ – ৫

শুভ্র কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে করিডর দিয়ে হেঁটে লিফটে উঠল। মেয়েটার নাম সুলেখাই তাহলে। তবে কি এই লোকগুলো জানে না মেয়েটার নাম সুলেখা? সে শুনেছিল বটে এসকর্টদের আসল নাম গোপন করা থাকে।

লিফট দিয়ে নেমে এসে এনক্লেভের বাইরে দাঁড়াল সে। ফোন দেখল। কোন ইন্সট্রাকশন নেই।

অদ্ভুত! কী করতে হবে এতক্ষণ তো দিব্যি নির্দেশ আসছিল।

এখন আবার কী হল?

শুভ্র বেশ খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এনক্লেভের বাইরের চায়ের দোকানে বসতে গিয়েই দেখল ফ্ল্যাটটা থেকে তখন যে লোকটা বেরিয়েছিল সে রাস্তায় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে।

সে আর চায়ের দোকানে বসল না। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা কোন দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার গায়ের রং আফ্রিকানদের মত কালো। পেশিবহুল চেহারা। শুভ্র মোবাইলের গ্যালারি খুলে একের পর এক ছবি সোয়াইপ করতে শুরু করল।

হ্যাঁ, নাইট কিং বারের একটা দরজার সামনে সুলেখা দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে কালো পোশাক পরে এই লোকটা দাঁড়িয়ে। এই লোকটা তার মানে বাউন্সার।

একটু পরেই এসপ্ল্যানেডগামী একটা বাস এল। লোকটা উঠল।

শুভ্রও উঠে পড়ল।

লোকটা সামনেই বসার সিট পেয়ে গেল। পিছনের দিকে বসার জায়গা ছিল। শুভ্র পিছনে চলে গেল। বাইরের দিকে তাকাল। সন্ধ্যে নেমেছে শহরে।

ফোন বাজছিল তার। শুভ্র দেখল সৌমিতা ফোন করছে। ধরল সে “বল”।

সৌমিতা বলল “কোথায়? মেসে?”

শুভ্র বলল “না, বেরিয়েছি একটু”।

সৌমিতা অবাক গলায় বলল “কোথায় বেরিয়েছিস? আর তোর ফোনের কী হয়েছে? বার বার নট রিচেবল বলে যাচ্ছে?”

শুভ্র একটু থমকে বলল “ওহ, তোকে বললাম না ফোনটা পড়ে গেছে, সেটার জন্যই হয়ত নেটওয়ার্ক নিচ্ছে না মাঝে মাঝে”।

সৌমিতা বলল “বেরিয়েছিস কোথায়?”

শুভ্র ফোনটা একটু দূরে নিয়ে গিয়ে “হ্যালো হ্যালো” করতে করতে ফোন কেটে সৌমিতার নাম্বারটা ব্লক করে দিল। কী হচ্ছে সে নিজেই কিছু বুঝতে পারছে না, সৌমিতাকে কী করে বোঝাবে? তাছাড়া, আবার শক খাওয়ার কোন ইচ্ছে তার নেই।

কন্ডাকটার টিকিট কাটতে এলে শুভ্র একেবারে এসপ্ল্যানেড অবধিই টিকিট কেটে নিল। লোকটা কোথায় নামবে কে জানে! তার থেকে গোটা রাস্তার টিকিট থাকা ভাল। যেখানে নামবে, সেখানে সেও নেমে যাবে। কিছুক্ষণ পরে বাসে ভিড় হয়ে গেল।

শুভ্র আর লোকটাকে পিছন থেকে দেখতে পারছিল না। অস্বস্তি হচ্ছিল। সে সিট ছেড়ে দিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে চলে গেল।

আশ্বস্ত হল। লোকটা এখনও বসেই আছে।

প্রবল ভিড়। কোন মতে দাঁড়িয়ে রইল শুভ্র।

রাস্তায় বাসের গতি এমন কিছু বেশি না, এদিকে প্রতিটা স্টপেজে ভিড় বাড়ছে। গরম লাগছিল প্রবল।

হঠাৎ শুভ্রর মনে হল তার প্যান্টের পকেটে কেউ হাত দিয়েছে। বাসের ভিড়ে হাত প্যান্টের পকেট অবধি নেওয়ার অবস্থা ছিল না তার। কোন মতে ডান পকেটে হাত দিয়েই তার হৃদকম্প হল। ফোনটা নেই। সে এদিক সেদিক তাকাল। ফোন যে চুরি করেছে সে বাসেই আছে। বাস কালীঘাট মেট্রো স্টপেজে দাঁড়াতে সেও নেমে গেল। একটা রোগা মত লোক বাস থেকে নেমেই দৌড় দিয়েছে। শুভ্র বুঝল নির্ঘাত এই লোকটাই তার ফোনটা নিয়েছে। কোন কিছু না ভেবেই সে দৌড়তে শুরু করল।

লোকটা গড়িয়াহাটের দিকে দৌড়তে শুরু করেছে। কোন দিকে না তাকিয়ে শুভ্র দৌড়তে লাগল। বাসের লোকটার কথা তার মাথাতেও ছিল না। বেশ খানিকটা দৌড়নোর পর শুভ্র দেখল লোকটা যেন ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মত রাস্তায় বসে পড়ল। পরক্ষণেই ছটফট করতে করতে শুয়ে পড়ল।

রাস্তার লোক জড়ো হতে সময় লাগল না। শুভ্র “চোর চোর” বলে চিৎকার জুড়ে লোকটার বুক পকেটে হাত দিতেই মোবাইলটা পেয়ে গেল।

জড়ো হওয়া লোকজনের বুঝতে একটু সময় লাগল। পরক্ষণেই সবাই মিলে লোকটার ওপর “চোর চোর” বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুভ্র সরে এল। হাঁফ ধরে গেছিল। এত দামী ফোন হারিয়ে গেলে কে টাকা দিত!

মাথায় চিনচিনে ব্যথাটা শুরু হয়েছে। ঝিঁঝিঁর মত কন্ঠস্বর ভেসে এল “লোকটাকে মিস করে দিলে তো?”

শুভ্র বলল “কী করব? ফোনটা চুরি হয়ে যাচ্ছিল যে!”

“এত ক্যালাস হলে হবে?”

শুভ্র অপরাধীর মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।

“যাও, মেট্রো ধরে পার্ক স্ট্রীটে গিয়ে নাইট কিং বার খোঁজ। দেরী কোর না। যাও”।

“কী আছে সেখানে?”

“গিয়ে দেখবে। যাও”।

শুভ্র কালীঘাট মেট্রোর দিকে দৌড়তে শুরু করল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

একেকটা দিন এরকম আসে যে জীবনটাই অন্য রকম হয়ে যায়।

দুপুর থেকে যে তার জীবনটাই পালটে যেতে পারে সেটা শুভ্র কোন দিন ভেবেও দেখে নি। মেট্রোতে বসে সবটা একে একে মনে করতে চেষ্টা করল সে।

১) কলেজের কমন রুমে রোজকার মত শুয়ে পড়ে একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখল।

২) ঘুম ভেঙে স্বপ্নের একটা চরিত্র দেখল।

৩) তার মাথায় অজানা কেউ ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

৪) অজানা অচেনা লোকেদের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার অ্যাকাউন্টে টাকা চলে আসছে। একটা অত্যন্ত দামী মোবাইল অবধি তাকে গিফট করা হয়েছে।

পার্ক স্ট্রীটে নেমে সে প্রায় দৌড়িয়েই রাস্তায় উঠল।

রাতের কলকাতা তো সে আগে এভাবে দেখে নি! মফস্বলের ছেলে। কলেজ থেকে মেসে ফিরে কোন দিন তাস খেলেছে, কোন দিন পড়াশুনা করেছে, সৌমিতাকে ফোন করেছে, রাতের খাওয়া খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এভাবে এসব জায়গায় তো আগে আসে নি।

মাথাটা চিনচিন করে উঠল তার। ঝিঁঝিঁর ডাকের মত শুনতে পেল “নাইট ক্লাবে যাওয়ার মত পোশাক তোমার নেই শুভ্র”।

শুভ্র নিজের পোশাকের দিকে তাকাল। সত্যিই তো। এই পোশাকে কে পাত্তা দেবে তাকে? সে বলল “হ্যাঁ, নেই তো”।

“ডান দিকে ‘অল ইন’ দোকানটা দেখতে পাচ্ছ?”

শুভ্র ডান দিকে তাকাল। বেশ বড় দোকানটা। বলল “হ্যাঁ”।

“চলে যাও। কাউন্টারে বলা আছে। তোমার নাম বল। ড্রেস দিয়ে দেবে। ওখানেই ট্রায়াল রুমে ড্রেস চেঞ্জ কর”।

শুভ্র মন্ত্রমুগ্ধের মত ‘অল ইন’ এর কাউন্টারে গেল। নিজের নাম বলা মাত্র তাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলল “স্যার, ট্রায়াল রুমটা ওদিকে”।

শুভ্র কোন কথা না বলে ট্রায়াল রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিল। নিজেকেই চিনতে পারছিল না সে।

মোবাইলে মেসেজ টোন এল। নাইট কিং এ যাওয়ার ডাইরেকশন।

সে ট্রায়াল রুমেই তার পুরনো পোশাক রেখে হাঁটতে শুরু করল জিপিএসে আসা নির্দেশ অনুসারে। মিনিট দশেক হাঁটার পরেই “নাইট কিং” নাইট ক্লাবটা চোখে পড়ল।

গেটে সেই বাউন্সারটা!

শুভ্র অবাক হল।

সে কোন দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এন্ট্রান্সের ঠিক আগে একজন অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে তাকে ডাকল “আপনি শুভ্র”?

শুভ্র অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটা বলল “আমি আশনা। চল আমরা ভিতরে যাই”।

শুভ্র বলল “তুমি… মানে আপনি আমাকে চেনেন?”

মেয়েটা হাসল “সিওর। একা যেতে দেবে না তো। চলুন”।

আশনা এগিয়ে এসে শুভ্রর হাত ধরল। শুভ্রর সব গুলিয়ে গেল। সৌমিতা দেখলে তাকে গুলি করে দেবে! এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে?”

দুরুদুরু বুকে গেটে পৌঁছলে কোন প্রশ্ন ছাড়াই নাইট কিং এর ভেতরে যাওয়ার ছাড়পত্র মিলল। ভিতরে ঢুকে আশনা তার কানে কানে বলল “তুমি নাচবে?”

শুভ্র সভয়ে বলল “না না”।

আশনা প্রায় তার গায়ের সঙ্গে লেগেছিল। তার হাত জড়িয়ে ধরে বলল “ওকে। চল বসি”।

ভিতরে অস্বাভাবিক জোরে গান বাজছে। লোকজন নাচছে। এরকম পরিবেশে শুভ্র কোন দিন আসে নি।

আশনা তার গালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল “কী নেব? হুইস্কি? না টেকিলা শট?”

শুভ্রর মনে পড়ল তার মানিব্যাগের কথা। সে বলল “না না কিচ্ছু লাগবে না”।

আশনা কথা শুনল না। দুজনের জন্য স্কচ নিল। ফিশ কাবাব নিল।

এবারে কী করতে হবে শুভ্রর মাথায় আসছিল না। আশনা জুটল কেন? কী করবে?

সে আশনাকে বলল “তোমাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?”

আশনা মিষ্টি হেসে বলল “তোমাকে যে পাঠিয়েছে। কে পাঠিয়েছে তোমায়?”

শুভ্র ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল “জানি না”।

আশনা হেসে বলল “সেম হিয়ার”।

শুভ্র ঘড়ির দিকে তাকাল। দশটা বেজে গেছে। কিছু কিছু মানুষের কাছে সবে রাত শুরু হয়েছে। মেসে থাকলে মশারি করে ফেলত এতক্ষণে। অতীনদার পার্টিতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে দু তিন জন বমি করে ফেলেছে। শুভ্রর মন খারাপ লাগছিল। সবাই অপরিচিত। কোথায় যাচ্ছে সে?

পাশের টেবিলে একজন কালো স্যুট পরিহিত বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে বসল। শুভ্রর চেনা চেনা লাগছিল ভদ্রলোককে।

কয়েক সেকেন্ড পরেই বিদ্যুচ্চমকের মত মনে পড়ল এই লোকটাকেও তো সে স্বপ্নে দেখেছিল। এই সেই বৃদ্ধ!

দুজন কম বয়েসী মেয়ে নিয়ে এসেছে। সিগার ধরাল এসেই। স্বপ্নে দেখা সে বৃদ্ধ আর এই লোকটার মধ্যে অবশ্য কোন মিল নেই। দুজনের পোশাক, স্টাইল সব আলাদা। শুধু লোকটার মুখটা একদম এক।

আশনা শুভ্রর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল “রহমান লতিফ। বাংলাদেশের খুব বড় ব্যবসায়ী”।

শুভ্র আশনাকে বলল “তুমি কী করে জানলে?”

আশনা শুভ্রর কথার উত্তর দিল না।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

নাইটক্লাবের মিউজিকের শব্দে অত্যন্ত অস্বস্তি হচ্ছিল শুভ্রর। কিন্তু সে রহমান লতিফের দিক থেকে চোখ সরাল না।

এও কি সম্ভব? স্বপ্নে দেখা সব কিছু এভাবে মিলে যেতে পারে?

সে গুগল করল রহমান লতিফের নামে। লতিফ ইন্ডাস্ট্রির মালিক। চামড়া, দামী কাপড় ইত্যাদির ইম্পোরটার এক্সপোরটার। একটা চ্যানেলও আছে ওর। শুভ্রর চোখ কপালে উঠল। এই লোকটা এখানে কী করছে?

শুভ্র স্কচে চুমুক দিল।

বিকেলের নেশা নেমে গেছে অনেকক্ষণ। এখন স্কচটা খেতে ভাল লাগছে।

লতিফ একটা খুব বড় ফোন হাতে নিয়ে কাউকে ফোন করে যাচ্ছে।

শুভ্র নাইট ক্লাবের চারদিকে তাকাল। আস্তে আস্তে পারদ চড়ছে জায়গাটার। কিছু ছেলে মেয়ে উদ্দাম নাচছে। শুভ্র আড়চোখে মেনু কার্ডটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল। আগুনে দাম প্রতিটা আইটেমের। টাকাও কি অদৃশ্য নির্দেশদাতা দিয়ে দেবে? না দিলে তো বাসন ধুয়ে টাকা দিতে হবে। জেলও হতে পারে। শুভ্রর ভয় লাগছিল।

আশনা তার কানে কানে বলল “লতিফ তোমায় খুঁজছে। যাও”।

শুভ্র অবাক হয়ে আশনার দিকে তাকিয়ে বলল “আমায় খুঁজছে মানে?”

আশনা গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ করে। বলল “দেরী কোর না। যাও”।

শুভ্র সত্যিই দেখল লতিফ চারদিকে কাউকে খোঁজার মত করে তাকাচ্ছে। সে আশনাকে আবার বলল “আমাকে খুঁজছে মানেটা কী?”

আশনা গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল “পাসওয়ার্ড হল ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি। যাও। এখনই যাও”।

শুভ্র কিছু না বুঝেই লতিফের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। লতিফের দুজন দেহরক্ষী আছে আগে দেখা যায় নি। এখন দেখা গেল। তাকে লতিফের দিকে এগিয়ে যেতে দেখেই দুজন এগিয়ে এল।

লতিফ চ্যাচাল “আসতে দাও”।

শুভ্র দেখল দুজন সরে গেল কোন কথা না বলে। ঠিক যেন পোষ মানা কুকুর। শুভ্রর হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল। লতিফ তাকে হাত বাড়িয়ে কাছে ডেকে বলল “বল”।

শুভ্র বলল “কী বলব?”

লতিফ হঠাৎ করে দাঁত বের করে তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল “কী বলবে জানো না? ইয়ার্কি মারতে আসছো বুঝি?”

শুভ্র এবারে বুঝল পাসওয়ার্ড বলতে বলছে। সে হড়বড় করে বলল “ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি”।

লতিফের মুখে হাসি খেলে গেল। পাশের সিট দেখিয়ে বলল “বস”।

শুভ্র বসল।

লতিফ তার সামনের টেবিল থেকে একটা গ্লাস শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। পারবে?”

শুভ্র কিছুই বুঝল না। বলল “কোথায়?”

লতিফ হাসতে হাসতে বলল “সেটা তো বলব না। তোমার জানা উচিত। জানো না?”

শুভ্রর মাথাটা চিনচিন করে উঠল, ঝিঁঝিঁ বলল “বল জানি। যা যা বলবে চুপচাপ করে যাও”।

শুভ্র মাথা নেড়ে লতিফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল “জানি”।

লতিফ বলল “চল”।

শুভ্র কোন কথা না বলে উঠে পড়ল।

লতিফ বেরোল। শুভ্র তার পিছন পিছন গেল। মাথা ঘুরিয়ে দেখল দেখল আশনা দূর থেকে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লতিফের সঙ্গে যে মেয়ে দুটো এসেছিল তারাও এল না। ওখানেই বসে রইল।

বিল দিলই না? শুভ্র আর কিছু বোঝার চেষ্টা করল না।

লতিফ বেরোতে একটা লম্বা সেডান গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়াল। শুভ্র দেখল সেই কালো বাউন্সার লোকটা কোন কথা না বলে গাড়ির সামনের সিটে বসল।

লতিফের একজন দেহরক্ষী দরজা খুলে দিল।

লতিফ বলল “ভিতরে গিয়ে বোস”।

শুভ্র বসল ভেতরে গিয়ে।

লতিফ বসতে গাড়ি স্টার্ট দিল। একজন দেহরক্ষীও গাড়িতে উঠল না।

গাড়ি চলতে শুরু করল।

লতিফ ফোন বের করে গম্ভীর মুখে ফোন করতে শুরু করল।

ফোন স্পিকারে দিল।

ওপাশ থেকে একজন হ্যালো বলতেই লতিফ বলল “গট হিম”।

ওপ্রান্ত বলল “গুড। নাও প্রসিড”।

লতিফ ফোন রাখল। তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল “ওয়েলকাম”।

শুভ্র ক্যাবলার মত হাসল।

লতিফ বলল “পানি খাবে?”

শুভ্র মাথা নাড়ল।

লতিফ একটা বোতল এগিয়ে দিল তার দিকে।

শুভ্র বেশ খানিকটা জল খেয়ে নিল।

রাত হয়েছে। রাস্তা ঘাট ফাঁকা। গাড়ি বেশ ভাল গতিতেই চলছে।

শুভ্র বাইরের দিকে তাকিয়ে রাস্তা দেখছিল। হঠাৎ তার মনে হল মাথা হালকা হতে শুরু করেছে। রাজ্যের ঘুম ঘনিয়ে আসছে চোখে।

সে আতঙ্কিত হচ্ছিল। মনে মনে বলল “আছেন? আমাকে অজ্ঞান করে দিচ্ছে”।

মাথা চিনচিন করে উঠে ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল “যা করছে দেখে যাও। অজ্ঞান করছে, হও”।

এরপরে শুভ্রর আর কিছু মনে নেই।

সে জ্ঞান হারাল।

#

জ্ঞান ফেরার পর শুভ্র দেখল সে একটা আরামদায়ক চেয়ারে বসে আছে। শরীরের ওজন হালকা লাগছে। তার সামনে লতিফ বসে একটু একটু করে একটা গ্লাস থেকে পানীয় চুমুক দিচ্ছে। দুজন সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।

শুভ্র বলল “আমি কোথায়?”

লতিফ আঙুল দিয়ে দেখাল “দেখো কোথায়?”

শুভ্র দেখল লতিফ জানলার দিকে দেখাচ্ছে। সে লতিফের দিকে তাকিয়ে বলল “প্লেনে?”

লতিফ মাথা নেড়ে বলল “হ্যাঁ। কোন চিন্তা নেই। নাও কিছু খেয়ে নাও। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ তুমি”।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

শুভ্র এর আগে একবারই প্লেনে চড়েছিল। বাড়ির সবার সঙ্গে দিল্লি গেছিল। ফেরার পথে সস্তার ফ্লাইটে উঠেছিল। একটা ফ্লাইটে গিজগিজ করছে লোক, যেন কলকাতা দীঘা বাস সার্ভিস।

প্লেনের ভেতরটা যে এরকম হতে পারে সেটা সে সিনেমাতেই দেখেছিল। বড় বড় সিট। অত্যন্ত সুন্দরী বিমান সেবিকা।

লতিফ যে একজন বিরাট ব্যবসায়ী সেটা বোঝা যাচ্ছে প্লেনের ভেতরটা দেখেই। সে মাথার ভেতর নিজের মনে মনেই অজানা নির্দেশদাতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল “আছেন?”

উত্তর এল না কোন। শুভ্র এবার ভয় পেল।

সামনে রাখা ফ্রুট জুস এক ঢোকে খেয়ে নিল গ্লাস থেকে। লতিফ বলল “সিট বেল্ট পরে নাও আমরা ল্যান্ড করব এবার”।

একজন বিমান সেবিকা এগিয়ে এসে তাকে সিট বেল্ট পরিয়ে দিল। শুভ্রর দু চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এল। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে বুঝতে পারল এই ফ্রুট জুসের মধ্যেও কিছু মেশানো ছিল।

#

এবারে তার ঘুম ভাঙল একটা গাড়ির ভেতর। পাহাড়ি রাস্তায় একটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে। শুভ্র ধড়মড় করে উঠে বসল।

তার পাশে লতিফ বসে আছে। তাকে উঠে বসতে দেখে খুশি হয়ে বলল ‘যাক, এতক্ষণে ঘুম ভেঙেছে তোমার”।

শুভ্র লতিফের দিকে শূন্য চোখে তাকাল।

লতিফ বলল “আমরা এসে গেছি প্রায়। তোমার ঘুম কেমন হয়েছে?”

শুভ্র বলল “আমায় ঘুম পাড়িয়ে রাখার কারণ কী?”

লতিফ বলল “ঘুমই তো ভাল। লং রুটে ঘুমিয়ে থাকা তো ব্লিস। তুমি জেগে থাকলে পথশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে যেতে”।

শুভ্রর মনে একগাদা প্রশ্ন ভর করে আসছিল কিন্তু সে কোন প্রশ্ন করল না। রাস্তাটা খুব একটা ভাল না। গাড়ি মাঝে মাঝেই গর্তে পড়ে লাফাচ্ছে।

তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? সে কি বেঁচে থাকবে? মার কথা মনে পড়ল হঠাৎ করে। অনেক কষ্টে চোখের জল আটকাল সে।

লতিফের সামনে একটা স্ক্রিন ছিল।

লতিফ সে স্ক্রিনটা ছুঁয়ে কিছু করল, একটা ভিডিও শুরু হল।

ভিডিওতে নয় এগারোর টুইন টাওয়ার ধ্বংস দেখা যাচ্ছে।

লতিফ তার দিকে তাকিয়ে বলল “চেনা লাগছে?”

শুভ্র বলল “হ্যাঁ। এটা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ঘটনাটা”।

লতিফ খুশি হয়ে বলল “রাইট। কারা এই প্লেন হাইজ্যাক করেছিল মনে আছে?”

শুভ্র বলল “আল কায়দা”।

লতিফ বলল “টেন অন টেন। আল কায়দার কারা ছিল জানো?”

শুভ্র মাথা নাড়ল।

লতিফ বলল “ওসামা বিন লাদেনকে কোথায় মারা হয়েছিল বলতে পারবে?”

শুভ্র বলল “পাকিস্তানে”।

লতিফ বলল “হ্যাঁ। অ্যান্ড পাকিস্তান ডিড নট হ্যাভ এনি ফাকিং নলেজ অ্যাবাউট ইট। ভাবতে পারো? একটা দেশ আরেকটা দেশের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে ইচ্ছা হলে, আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমেরিকা বলেই এটা সম্ভব হয়েছে”।

শুভ্র লতিফের দিকে তাকাল। লতিফের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে।

গাড়িটা একটা টানেলের ভেতর প্রবেশ করল। অন্ধকার টানেল। শুধু গাড়ির হেডলাইটে আলোকিত হচ্ছে রাস্তাটা। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার তাদের গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই রাস্তায়।

লতিফ একটা ভিডিও চালিয়ে চুপ করে সেটা দেখতে লাগল। শুভ্র চোখ বন্ধ করল। টানেলটা শেষ হতেই একটা খাড়াই পথে বেশ খানিকটা গিয়ে গাড়িটা একটা গেটের সামনে দাঁড়াল।

লতিফ গাড়ি থেকে নেমে নিজে গেটটা খুলে দিল।

গাড়িটা গেট পেরোতে লতিফ গেট বন্ধ করে আবার গাড়িতে উঠে বসল।

খানিকটা যাবার পর তারা একটা বড় ঘেরা জায়গায় এসে উপস্থিত হল। গাড়িটা একটা বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়াল। বিল্ডিং এর হোরডিং এ কোনো একটা ভাষায় কিছু লেখা আছে।

লতিফ তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল “এসে গেছ। চল”।

ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিল।

লতিফ তাকে নিয়ে নেমে বিল্ডিং এ প্রবেশ করল। আরবী ভাষায় কেউ জোরে জোরে কিছু একটা পড়ছে। লতিফ সে ঘরে প্রবেশ করতে শুভ্র দেখল একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা মৌলবী লতিফকে দেখে এগিয়ে এসে লতিফকে জড়িয়ে ধরল।

লতিফ তার দিকে তাকিয়ে অজানা ভাষায় মৌলবীকে কিছু একটা বলল।

মৌলবী তারস্বরে কাউকে ডাকল।

একজন লম্বা চওড়া লোক এল। গোঁফ নেই, দাড়ি আছে। মাথায় ফেজ টুপি।

মৌলবী তাকে দেখিয়ে লোকটাকে কিছু একটা বলল।

লোকটা আদরের সঙ্গে তাকে একটা রদ্দা মারল।

শুভ্র আবার জ্ঞান হারাল।

#

জ্ঞান ফিরল একটা সিঙ্গল খাটে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে পুরুষাঙ্গে। শুভ্র যন্ত্রণায় কাতরে উঠল। কোনমতে চোখ খুলে দেখল তার সামনে লতিফ হাসি হাসি মুখে বসে আছে। বলল “তোমার মুসলমানি সম্পন্ন হয়েছে। আজ থেকে তোমার ট্রেনিং শুরু”।

শুভ্র ব্যথা ভুলে হা করে লতিফের দিকে তাকিয়ে রইল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরানো হয়েছে তাকে। পুরুষাঙ্গ থেকে অনেকটা ব্লিডিং হয়েছে।ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে জায়গাটা। এমনিতেই পথশ্রমে ওষুধের প্রভাবে ক্লান্ত ছিল, এখন শরীরও খারাপ লাগছিল শুভ্রর।

স্যুপ খেতে দেওয়া হয়েছিল তাকে। কিছু খেতে পারে নি সে।

আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। জ্ঞান ফিরল যখন, তখন বুঝতে পারল একটা হুইল চেয়ারে করে তাকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লতিফ ছাড়াও সেখানে বয়স্ক তিন জন মানুষ বসে আছে।

সে ঘরে ঢোকামাত্র লতিফ বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল “আতিক। আমার নিউ রিক্রুট। ওর আগে নাম ছিল

শুভ্র যদিও। এখন আতিক নাম দিয়েছি আমি। আতিক ওর দেশকে ঘেন্না করে। আমাকে নিয়মিত মেইল করেছে। আমি ওকে ইমেলে একগাদা প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম, তার যথোপযুক্ত উত্তর আমাকে আতিক দিয়েছিল। আমি তখনই বুঝেছিলাম আতিক একজন ভাল মুজাহিদিন হতে পারবে। এর পরের ঘটনা তো আপনারা জানেন”।

বাকি লোকগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। শুভ্র অবাক হল। সে তো কারো সঙ্গে কোন দিন ইমেলে এ ধরণের কোন কথা কারো সঙ্গে বলে নি। এসব করে কে তাকে ফাঁসাল? আর মুজাহিদিন মানে কী?

এক বয়স্ক লোক বলল “ওকে দুদিন বিশ্রাম দেওয়া হোক।তারপর না হয় ওকে আমাদের ট্রেনিং এ নেওয়া যাবে। মুসলমানীতে অনেকটা রক্তপাত হয়। ছেলেটা দুর্বল”।

লতিফ মাথা নাড়ল “একদম। এই দুদিন ওকে ভিসুয়াল ক্লিপগুলো দেখানোর ব্যবস্থা করা হোক”।

লতিফ তার দিকে তাকিয়ে বলল “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হতে চলেছে। শুভান আল্লাহ”।

শুভ্রকে একটা হলঘরে নিয়ে যাওয়া হল। বেশ কয়েকজন ছেলে প্রার্থনা করছে। তাকে দেখে সবাই কৌতূহলী চোখে তাকাল। লতিফ তার দিকে তাকিয়ে বলল “আজ থেকে এরা তোমার সহযোদ্ধা। এই উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেছে বেছে এদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আশা করি তোমরা কেউই আমাদের হতাশ করবে না”।

শুভ্রর কান্না পাচ্ছিল। তার ফোনের কথা মনে পড়ল।

লতিফকে জিজ্ঞাসা করল “আমার ফোনটা?”

লতিফ বলল “এখানে নেটওয়ার্ক পাবে না তুমি। ফোন নিয়ে কী কব্রবে? ওটা আমার কাছেই থাকবে”।

শুভ্র আর কিছু বলল না। ঘরে প্রোজেক্টর স্ক্রিন লাগানো হয়েছে।

সেখানে ইরাক, আফগানিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকানদের নিষ্ঠুরতা দেখানো হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখাতে শুরু করল প্রতিশোধ নেবার কাহিনী। দেখানো হল দল থেকে পালানোর চেষ্টা করায় একজনের গলা ছুরি দিয়ে জবাইয়ের মত কেটে নেওয়া হচ্ছে। শুভ্রর বমি আসছিল কিন্তু সে চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল। ভিডিওটা শেষ হলে শুভ্র ঘরে থাকা বাকি ছেলেদের দিকে তাকাল। প্রত্যেকে যেন উত্তেজনায় ফুটছে।

লতিফ শুভ্রর কাঁধে হাত রেখে বলল “তুমি যে পথ বেছে নিয়েছ, সে পথ তোমাকে উপরওয়ালাই দেখিয়েছেন। একজন মানুষকে অনেক ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। কেউ সেটা বুঝতে পারে, কেউ পারে না। তুমি বুঝতে পেরেছ, এটাই অনেক”।

শুভ্র কিছু বলল না। লতিফ বলল “এখানে তোমার যত্ন নেওয়ার জন্য সেলিমাও থাকবে। ওকে তোমার যা প্রয়োজন বলে দিও”।

লতিফ হাত তালি দিলেন। এবার শুভ্র চমকে উঠল। এতো সুলেখা! এখানে এল কী করে?

এর নাম সেলিমা হয়েছে এখন?

সে অনেক কষ্টে বিস্ময় ধামাচাপা দিল। সুলেখা এসে তার হুইলচেয়ার নিয়ে তাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল। শুভ্রর মনে অনেক প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। সুলেখা এখানে কী করছে? সেই এলিট এনক্লেভের ফ্ল্যাটেই বা কী করছিল? সে বেশি ভাবতে পারল না। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা করছে।

সুলেখা একটাও কথা না বলে তাকে হুইলচেয়ার থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ছোট একটা ঘর। কিছু নেই কোথায়। শুভ্রর খেয়াল হল ঘরে ঘরে স্পিকার লাগানো আছে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারল কেন স্পিকার। প্রার্থনা শুরু হল।

শুভ্র আচ্ছন্নের মত পড়ে থাকল।

(ক্রমশ)

ঝিঁঝিঁ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *